প্রিয় তুমি পর্ব-১৫

0
1715

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

সেহের চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলো। পূরব সেহেরকে প্রতিনিয়ত লজ্জায় ফেলার জন্য বিভিন্ন কথা বলছে আর ড্রাইভ করছে। যাইহোক, একপর্যায়ে ওরা বাড়ি পৌঁছে গেলো। তখন গোধূলি শেষে সন্ধ্যা। গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই পূরবের কাজিনের দল হামলা চালালো। সেহেরকে গাড়ি থেকে নামালো৷ পূরব শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে৷ ওদেরকে বরণ করলো পূরবের বড় খালা। তারপর বিভিন্ন নিয়মনীতি মেনে ওদেরকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেওয়া হলো৷

সেহের ভারী সাজগোজ নিয়ে অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছে। কাকে বলবে সে এই কথা? পূরবও নেই। কিন্তু ওকে বলতে হলোনা। পূরবের খালা’রা এসে ওর হাতে একটা পার্পল রঙের শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে যেতে বললো৷ সেহের আনন্দে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিলো। এবার ভীষণ শান্তি লাগছে। এরপর সবার সামনে আড্ডা দেওয়া হলো। খালারা সবাই ভীষণ ভালো মানুষ। সেহেরকে খুব সহজেই আপন করে নিলো৷ ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্নই করলোনা ওরা।

সেহেরকে নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন বড়খালা। এরপর সেহেরকে সাজাতে বসানো হলো। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছিলো মিঠারঙা শাড়িটাতে। আজ ওর বাসর রাত। ভেবেই সারা শরীরে কাঁপন ছড়িয়ে পড়লো সেহেরের। একসময় পূরবের কাজিনরা ওকে পূরবের ঘরে এনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রাত তখন বারোটা। ক্লান্তিতে বুজে আসছিলো ওর চোখ। পূরব কোথায়? এলো মিনিট পাঁচেক পরেই। অবশেষে সেহের তার প্রিয় মানুষটাকে দেখে চোখ জুড়ালো। পূরব দরজা বন্ধ করে এসে সোজা হাতমুখ ধুয়ে এসে ওর পাশে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ওয়েট করছিলে?’

‘হুম। কোথায় ছিলেন আপনি?’

‘জিসানকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে এসেছি।’

‘কেন?’

‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথে মিলে প্ল্যান করছিলো কীভাবে বাসর রাতে আমাকে জ্বালাবে। আমিও কম না, আগেই সব জানতে পেরে গেছি। বাকি বন্ধুদের টাকা দিয়ে হাত করে জিসানকে ওর ঘরে তালা মেরে, ওর ফোনটাও নিয়ে এসেছি। এবার প্ল্যান করার মজা বুঝুক!’

‘ওনাকে একা কেন? বাকিরাও তো প্ল্যান করেছিল?’

‘ওকে দিয়েছি কারণ, মাস্টার প্ল্যানটা ওর ছিল। তাই।’

সেহের হেসে বললো, ‘আপনি পারেনও বটে।’

‘তো পারতে হবেনা? জীবনের স্পেশাল রাত এটা। কি ভেবেছো তুমি? এমনি এমনিই ছেড়ে দিব? নো নো!’

সেহের লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলো। পূরব বলল, ‘এই বাসর রাতের জন্য পঞ্চাশ হাজার জলে ফেলে দিলাম, আর তুমি লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছো? এটা কেমন কথা সেহের?’

‘পঞ্চাশ হাজার? এত? আমার ছয়মাসের থাকা-খাওয়া,বাসা ভাড়া, গাড়ি ভাড়া আর পড়ার খরচ হয়৷ আর আপনি সামান্য বাসর রাতের জন্য এত টাকা নষ্ট করলেন? ও মাই গড!’

পূরব সেহেরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’এত আনরোমান্টিক তুমি? বাসর রাতে মাসের হিসাব নিয়ে বসেছ? ওফ নো!’

সেহের ভয় পেয়ে আমতাআমতা করে মিথ্যা কথা বলল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব আমি৷’

পূরব রেগে ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল, ‘কী বললে? ঘুমাবে? মিথ্যা বলার জায়গা পাও না? তুমি মিথ্যা ভালো বলতে পারোনা সেহের। যদি সত্যি বলতে তাহলে তুমি আজ ছাড়া পেতে, কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার অপরাধে এখন আমাকে কুড়িটা চুমু দিতে হবে। আর তাও যদি না চাও, কংগ্রাচুলেশনস মিসেস। আমি এর থেকে বেশিকিছু করার জন্য রেডি আছি। সো কোনটা চাও? অপশন “ওয়ান” অর “টু”?

সেহের কিছু বললো না। পূরবটা কি শুরু করেছে ভেবেই মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাচ্ছে। বিশটা চুমু? কখনো পারবেনা সেহের। ওর এই নীরবতা দেখে পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘কোনটা মিসেস?’

সেহের সিক্ত কন্ঠে জবাব দিল, ‘কোনোটাই না।’

‘তা বললে হবেনা। তাহলে অপশন “টু” –ই ঠিক আছে। কি বলো?’

সেহের বালিশে মুখ গুঁজে বলল,’আপনার লজ্জা নেই!’

‘বউয়ের সামনে কীসের লজ্জা?’

‘ছিঃ!’

‘ছিঃ বললে ডাবল হবে সবকিছু। ইউ নো, কুড়ির পরিবর্তে চল্লিশ, আই রিপিট চল্লিশ!!’

বলতে বলতে পূরব সেহেরের মুখটা উপরে তুললো। লজ্জারাঙা সেই মুখ দেখেই পূরব আবিষ্ট হয়ে গেলো। মাথার ভেতর সবকিছু গুলিয়ে এলো। সেহেরের ঠোঁটজোড়া অল্প কাঁপছে। মোহনীয় এক দৃশ্য! একটা চোখ মেরে সেহেরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই সেহেরের চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। হঠাৎই করেই আক্রমণ। সেহের লজ্জায় পূরবকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। কিন্তু পারলোনা৷ ভালোবাসা জড়ানো সেই আদরে দুটি মন আবারও এক হয়ে গেলো৷ প্রিয়দের প্রিয় তুমিকে নিজের করে পেলো। সেহেরের সাধ্যি কী এই ভালোবাসাকে দূরে ঠেলবার? পারবেনা সে কখনো! অদ্ভুত সে এক ভালোবাসা। আদরে মোড়ানো, ভালোবাসায় জড়ানো! আবেশে পূর্ণ মায়াবী সেই রাত!

পরিশিষ্ট: এটা একটা ডায়েরি। সোনালি জড়ির মলাটে মুড়ানো মোটা ডায়েরি। এর মলাটে খোদাই করে লেখা “প্রিয়দের প্রিয় তুমি!” এবং এই ডায়েরিটা যখন শেষবার খোলা হয়েছিলো তখন ঊনত্রিশ মে’, ২০১২ সাল। গোটা গোটা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা একটা প্রেমকাহিনী। লিপিকারের নাম সেহের৷ তাঁর নামের আগে-পরে কোনো টাইটেল নেই। তিন শব্দের ছোট্ট নাম। এই ডায়েরিতে তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলোর কথা সে লিখে রেখেছে। একটা এতিম, অসহায় মেয়ের প্রেমের ঘটনা, দুঃখের জীবন। যত্ন করে সেটা রেখে দিয়েছে ইফরাজ পূরব নামক একজন ব্যক্তি। ডায়েরির শেষদিকের পৃষ্ঠাগুলোর লেখাগুলো ছিলো এরকম,

__________অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সুমা,শিলা, রিমি-মাহিম,জিসান-শেফার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওদের ঘরে একটা সন্তানও আছে। সব পাল্টে গিয়েছে। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে এখন কারো সাথে দু-দন্ড কথা বলার সময়ই নেই কারোর। তবুও দিনশেষে সেই চঞ্চলা বিকেলের কথা মনে পড়ে তাঁদের। সোনালি দিনগুলোর হাজারো স্মৃতি চোখের কোণে পানি নিয়ে আসে। সেহেরের চাচীর মৃত্যু হয়েছে দুইবছর আগে, তার ছয়মাস পরে চাচারও মৃত্যু ঘটেছে। জিসান-শেফাকে নিয়ে লন্ডনে স্যাটেল। রিমি-মাহিম চট্টগ্রামে তাঁদের বাড়িতে। সংসার জীবনে অবশ্য সবাই-ই খুশি। আর রইলো বাকি সেহেরের কথা। সেহের মেয়েটা মূলত আমি৷ গল্পাকারে তুলে ধরছি আমি/সেহেরের কথা,

ছয় বছর পরের কথা। শরৎের একটি উষ্ণতম দিন। আকাশ গাঢ় নীল। বিশাল আকারের মেঘের দলেরা দল বেঁধে ভাসছে। মিষ্টি রোদ ঝিকমিক করে ছড়িয়ে পড়ছিলো গাছগাছালির পাতার উপর। হাওয়া সুন্দর, কোমল। শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, সৌন্দর্য সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। জ্যামে বসে বিরক্ত হচ্ছে ইফরাজ পূরব। একসময়ের জনপ্রিয় মডেল। বিয়ের পরপরই মডেলিংয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল পূরব। বেশ নামধামও করে ফেলেছিল সেহেরের ইচ্ছেয়। পরবর্তীতে কোনো এক কারণে স্বেচ্ছায় সেই পথ থেকে সরে আসে এবং ব্যবসায় মনোযোগ দেয়। হঠাৎ রাস্তায় পথচারী একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে চমকে তাকায় ও। বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে আনমনেই হেসে ওঠে। মাথায় সারাক্ষণ সেহেরের মুখটা বসবাস করে। যার দিকে তাকায় তাঁকেই সেহের মনে হয়। এতগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও ওর এই স্বভাবটা গেলোনা। আর ওমন কিউট একটা বউ থাকলে পাগলামো স্বভাবগুলো যেতে চায় নাকি!! সেহেরের মতো একজন জীবনসঙ্গী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। পূরব বিগত দিনের ভাবনায় ডুবে গেল।

ওদের বর্তমানে সংসার সুখ,শান্তিতে পরিপূর্ণ হলেও অতীতে তা ছিলোনা৷ বিবাহ পরবর্তী দিনগুলো ভালো কাটলেও ধীরেধীরে আলো কেটে আঁধারে ডুবে যায় তাদের জীবন। সেই অন্ধকার কাটাতে কত প্রার্থনাই না করেছে সেহের-পূরব। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও ওদের স্বস্তি ছিলোনা। কারণ বিয়ের এক বছরের মাথায় কনসিভ করে সেহের। পূরবের খুশি দেখে কে! কত স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল দুজন মিলে, কিন্তু মাস তিনেকের মাথায় আচমকাই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। খুব ভেঙ্গে পড়ে সেহের। কিন্তু নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে আবারও একবার কনসিভ করে। সেটাও টেকেনি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেটাও মিসক্যারেজ। তারপর একপ্রকার ট্রমাট্রাইজড হয়ে পড়ে সেহের। পাগলের মতো আচরণ আর কান্নাকাটি করতো। পূরব নিজের সাথে সাথে ওকেও সামলিয়েছে সেই কঠিন সময়টাতে। পৃথিবীতে সন্তান হারানোর মতো কষ্ট আর কোনোকিছুতে নেই। প্রতিবার সেহেরকে সামলানো ওর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে। তৃতীয়বারের সময় আল্লাহ তায়ালা সহায় হলেন। পূরবের দিনরাত নামাজ পড়ে দোয়া, সেহেরের চোখের পানি সেবার বৃথা যায়নি। একটা ছোট্ট পরী যখন ওদের কোলজুড়ে এলো নিমিষেই সব কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলো। বিগত দিনগুলোর যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা ভুলার চেষ্টা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে পেলো ওরা। এখন তাঁদের পরিবারে আর কোনোকিছুরই কমতি নেই। ইরফান আহমেদ ব্যবসা থেকে একপ্রকার অবসর নিয়েছেন। তিনি সারাদিন নাতনিকে সঙ্গ দেন। তবে এতো ঝড়-ঝাপটার পরেও সেহের-পূরবের ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি পড়েনি। বরং দিনদিন তা বেড়েছে।

পূরব ভাবনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চারদিকে আলো-আঁধারির খেলা, বোঝাই যাচ্ছে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। রাস্তাঘাটের জ্যাম ততক্ষণে পাতলা হয়েছে। পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। বিরক্তির একটা শব্দ করে পূরব গাড়ি স্টার্ট করলো। মাথায় আজও সেই কালো হ্যাট, চোখে সানগ্লাস আর গায়ে ডেনিম শার্ট। সন্ধ্যাবেলার শহর। রাস্তার দু-পাশের গাছগাছালিকে পেছনে ফেলে বাড়ির পথে এগোলো সে।

সেহের মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য সারা ঘরময় দৌঁড়াচ্ছে। চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এত চঞ্চল হতে পারে, জানা নেই সেহেরের। জোর করে একটু খাবার মুখে তুলে দিতেই ‘পূর্বা’ হা করে সেটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। সেহের রাগে মেয়েকে এমন ধমক দেয় যে পূর্বা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। ইরফান সাহেব সেহেরকে বললেন, ‘আহা, বকছো কেন এভাবে? কান্না করোনা পূর্বা। তুমিতো গুড গার্ল, ওদের কখনো কাঁদতে আছে নাকি বোকা মেয়ে?’

ইরফান সাহেব নাতনিকে কোলে তুলে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। পূর্বার হাতে ক্যাটবেরি ধরিয়ে দিয়ে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেলেন। ইশারায় সেহেরকে জানালেন আধঘন্টা পরে খাবার নিয়ে আসতে। মেয়ের গায়ে হাত তোলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা ও। এতো কষ্টের সন্তান ওর, কখনো উচ্চস্বরে কথা-ই বলেনি আর আজ সোজা ধমক দিলো ভেবেই ওর খারাপ লাগছে। চোখ জলে টলমল করছে ওর। মুখ গম্ভীর করে রান্নাঘরে চলে গেলো। একটু পরেই কলিংবেলের শব্দ হলো। সেহের দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো পূরব দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে পূরব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘চোখে পানি কেন? তুমি নাকি পূর্বাকে ধমক দিয়েছ আবার নিজেই কাঁদছো? আব্বু ফোন করে জানালো।’

সেহের মাথা নিচু করে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘আমি স্যরি।’

‘ইট’স ওকে। নিজেই বকা দিয়ে নিজেই কষ্ট পাও।কী লাভ এভাবে বকাঝকা করার! বাচ্চাদের ধমকিয়ে খাওয়ানো ঠিকনা, বুঝলে আমার বউ? ওরা পরে জেদি হয়ে যায়। আদর করে, ধৈর্য ধরে, বুঝিয়ে খাওয়াবে দেখবে আর এরকম করবেনা। ঠিক আছে? বুঝতে পেরেছো আমার কথা?’

সেহের মাথা নাড়ালো। পূরব ওর চোখ মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তো আমার কফি? সেটা কই?’

‘ছাড়ুন বানাচ্ছি।’

‘ওকে আমি ঘরে যাচ্ছি৷ তুমি নিয়ে আসো আবার হাতটাত পুড়িয়ে ফেলোনা, রহিমা খালাকে বলো।’

‘আচ্ছা।’

পূরব উপরে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। সেহের রান্নাঘরের সব কাজ গুছিয়ে রাখলো। রহিমা খালা কফি তৈরি করে দিলে সেহের কফি নিয়ে উপরে এলো। ততক্ষণে পূরবের শাওয়ার নেওয়া শেষ। খালি গায়ে টাওয়াল পরিধান করে ফোনে কথা বলছিল জিসানের সাথে। সেহের ওর এ অবস্থা দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। পূরব আড়চোখে ওকে দেখে জিসানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লন্ডন থেকে কবে ফিরছিস তোরা?’

জিসান বলল, ‘ভাবছি ডিসেম্বরে আসব। আসলে শেফা এখন একটু অসুস্থ।’

‘ওহ।’

‘তোরা আয় না, কতদিন দেখা হয়না…’

পূরব বলল, ‘গিয়েছিলি কেন? দেশে কী পিএইচডি করতে পারতিস না? কী আমার প্রফেসর রে? আমাকে দেখে শেখ, পিএইচডি করেও দেশে আছি, হুহ!’

জিসান আর্তনাদ করে বলল, ‘মনে হয় ভুলই করেছি। কতদিন আম্মুদের দেখিনা!!’

‘এবার চলে আয়।’

‘হুম। তোর মনে আছে আমার বাসর কীভাবে ভেস্তে দিয়েছিলি? এবার দেশে ফিরে আমি সেই শোধ নেব?’

পূরব হু হা করে হেসে বলল, ‘আমার বউয়ের সাথে প্রতিটা মুহূর্তই আমার বাসর মুহূর্ত। তুই আর কী নষ্ট করবি শালা!!’

জিসান কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘নির্দয় লোক একটা।’

‘আচ্ছা রাখি। ইট’স রোমান্স টাইম!’

তারপর জিসানও কিছু একটা বলে ফোন রেখে দিলো। পূরব পেছনে ঘুরে দেখলো সেহের রাগী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনই পূরবকে ভস্ম করে দেবে। পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’

‘আপনি এখনো এতটা নির্লজ্জ? ছিঃ। কীসব কথাবার্তার ছিরি!!’

পূরব বলল, ‘এখানে নির্লজ্জের কী আছে? বউ আমার, রোমান্স আমার, সবাইকে বলে বেড়াবো আমি, তোমার তো কোনো প্রবলেম হয়নি মিসেস ইফরাজ!’

সেহের তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘তাহলে সবাইকে কোলে বসিয়ে রোমান্স করুন। এই সেহেরের পাশে ঘেঁষবেন না। ছিঃ!’

‘এখানে ছিঃ ছিঃ করার কী হল? ঠিকই তো আড়চোখে আমার জিম করা বডি দেখছিলে, তখন নিজেকে নির্লজ্জ মনে হয়নি? আমি বলাতেই নির্লজ্জ? বাহ সেহের বাহ!!’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কখন আপনার বডি দেখছিলাম? নিজে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা খেয়াল নেই? শুধু একটা টাওয়াল পরে, এখন যদি এটা খুলে যায় তাহলে… ছিঃ!’

সেহের নাক সিঁটকালো। পূরব বাঁকা হাসি দিয়ে একটান দিয়ে ওকে কাছে নিয়ে এলো। কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আসো বউ আদর করি।’

‘আপনার আদরের গুষ্ঠি কিলাই৷ তিন সন্তানের বাপ হয়েছেন তাও লুচুগিরি কমেনা। কী লোকরে বাবা!!’

ঠিক এসময় পূর্বা ঘরে ঢুকলো ছোট্ট পায়ে। বাবা-মাকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আমাতে তোলে নাও পাপ্পা!’

পূরব মেয়েকে দেখে হুট করে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। মাথা চুলকে বোকার মতো হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!’

পূর্বা বাবার কোলে ওঠে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,’তুমি মাম্মিতে আদল তরচিলে?’

পূরব সেহেরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার মাম্মি একটা দুষ্টু। সে আমার আদর নেয়না। আমি নাকি পঁচা।’

পূর্বা ওর গাল টেনে ধরে বলল, ‘তুমি বালো। আমি আদল দিব।’

বলেই ওর সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিল। পূরব মেয়েকে বলল, ‘তুমি নাকি খাওনি? মাম্মিকে এত জ্বালায় কেউ? মাম্মি তো কাঁদছিল!!’

পূর্বা মাথা নুইয়ে সেহেরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ মাম্মি স্যলি। তোমাকে জ্বালাব না। আমি খাব।’

সেহের মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘চলো। আসুন আপনি খাবার দিচ্ছি। কফি তো খেলেন না।’

পূরব বলল, ‘থাক। চলো।’

এরপর ওরা তিনজন নিচে নেমে এলো। রহিমা খালা ডাইনিংয়ে সব খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। ইরফান সাহেব, পূর্বা, পূরব, সেহের একসাথে রাতের খাবার সেরে যার যার ঘরে চলে গেলো। রাত এগারোটা। পূর্বা পূরবের সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেহেরকে জড়িয়ে ধরে পূরব ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘একসাথে কতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। এখনো সবকিছু নতুন মনে হয়, আমাদের নতুন সংসার। তাইনা?’

সেহের হেসে বলল, ‘হুম। প্রতিনিয়ত নতুন করে আপনার প্রেমে পড়ছি।’

পূরব মুচকি হেসে সেহেরের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, ‘তাই নাকি? এখন তো শাস্তি পেতে হবে!’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের শাস্তি?’

‘আমার প্রেমের হাবুডুবু খাওয়ার অপরাধে। ইউ নো হোয়াট সেহের? আমি আজকাল চারপাশে শুধু তোমাকেই দেখতে পাই। আমি বোধহয় ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়া এক প্রেমিক, যে শুরু আমার প্রিয় মানুষটাকেই খুঁজে ফিরি। তোমাকে দেখার সাধ আমার যেমন মেটেনা, তেমন শুধু মনে হয় আমি তোমাকে হয়তো সেভাবে সুখীও রাখতে পারিনি। অথচ আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত প্রিয় কোনোকিছুর একটা আমার পরিবার, আর অন্য প্রিয়টা শুধুই তুমি। খুব ভালোবাসি তোমাকে।’

সেহের ওর বুকে মাথা রেখে গভীর কন্ঠে বলল, ‘ভালোবাসি।’

‘জানি আমি।’

‘আচ্ছা ঘুমান এবার।’

পূরব সেহেরের কপালে চুমু খেলো। পূর্বাকে অন্যহাতে জড়িয়ে ধরে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে আকাশপানে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লো। সেহের তখনো ঘুমায়নি। ঘুমন্ত পূরবের নিষ্পাপ মুখখানা দেখবার লোভ সে কখনো সামলাতে পারেনা৷ আজ ছয়টা বছর পরেও সেহেরের এই অভ্যাসটা রয়ে গিয়েছে৷ পূর্বার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে মুচকি হাসলো ও। এভাবেই সে তার পরিবারের মানুষদের সুখী দেখতে চায়। ওর নিজের তো বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর সৌভাগ্য কোনোদিনও হয়নি। নিজের সন্তানকে ও সর্বোচ্চটা দিয়ে আগলে রাখতে চায়। প্রিয় তুমি’দের সাথেই বাকিজীবন কাটাতে চায়। সেদিন ছিলো শরৎের এক পূর্ণিমারাত। শিউলিমালার মাতাল করা সুবাস আর হাওয়ার বেপরোয়া ছুটে চলা। এলোমেলো হয়ে যায় মনটা, প্রিয় একটা গানের সুর কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। উফ..প্রিয়’রা এতো মুগ্ধ হয় কেন? পৃথিবী এত সুন্দর কেন!! ভাবনার প্রতিফলনেই পাশ থেকে কে যেন ঘুমের মাঝেই অস্ফুটস্বরে সেহেরের কানে কানে বলল উঠে, ‘আমার প্রিয় তুমি!’

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে