#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪
হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হলো বেশ রাতে। পূরব অনুষ্ঠান শেষে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ফ্রেশ হতে গেলো। বিয়ে করায় যে কত প্যারা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সবার সাথে রোবটের মতো আচরণ করতে ওর বিরক্ত লাগছে, পুতুলের মতো সবার কথা শুনে শুনে চলতে হচ্ছে। তার উপর মিডিয়ার উটকো ঝামেলা। গায়ে হলুদে এসেও তাদের একটাই প্রশ্ন পূরব কবে মডেলিংয়ে যোগ দিচ্ছে। ও কোনোমতে ওদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়ে পূরব বেরিয়ে এলো। গায়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার চাপিয়ে জিসানকে ফোন করে ঘরে খাবার দিয়ে যেতে বললো। খানিক পরেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে খুললো। দেখলো জিসান প্লেটে করে ওর প্রিয় বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে এসেছে। ক্ষিধের চোটে পূরব তাড়াহুড়ো করে খেতে বসলো। জিসানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘খেয়েছিস? নাকি কামলা খেটে মরছিস?’
জিসান বন্ধুর কথা শুনে হু হা করে হেসে বললো, ‘বন্ধুর বিয়েতে কামলা খাটতেই হয়। আমার বিয়ের সময় তুই কামলা খাটবি। শোধবোধ হয়ে গেলো না!!’
‘হুহ। বিয়ে করছি কি তোর বিয়েতে কামলা খাটার জন্য নাকি? আমার এত ঠ্যাকা পড়ে নাই। তবে একটা কাজ করে দিতেই পারি, নো প্রবলেম।’
জিসান উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন কাজ?’
পূরব আয়েশ করে বলল, ‘তোর বাসর রাত মাটি করার কাজ। অবশ্য এই কাজটা তুই চাইবিনা জানি, তবে আমি তো করবোই।’
জিসান বড়বড় চোখ করে বলল, ‘মীরজাফর গিরি করবি? তাও আমার সাথে? তোর খারাপ লাগবেনা?’
‘এখানে খারাপ লাগার কী আছে? বাসর হবে আর তা ইফরাজ পূরব পন্ড করবেনা তা কী করে হয়?’
জিসান কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘তোর সাথে এরকম করার কোনো চিন্তাই করিনি আর তুই??’
‘তুই চিন্তা কর বা হাজারো, লক্ষ্য, কোটি প্ল্যান বের করতে পারিস। তাতে আমার বাসর কিছুতেই মাটি হবেনা।’
জিসান বলল, ‘জীবনে কোনোদিন প্রেমট্রেম করিনাই শুধু এই বাসর রাতটার জন্য। আর তুই আমার সাতাশ বছর ধরে দেখা স্বপ্নটার মধ্যে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য বসে আছিস? এমন তুই?’
‘প্রেম করার সাথে এর কী সম্পর্ক? আর সাতাশ বছর ধরে বাসর করার স্বপ্ন দেখছিস মানে? ও মাই গড জিসান, তুই কী জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই এডাল্ট বিষয়গুলো বুঝে গিয়েছিলি? পেন্ডাকালীন বয়সেও তুই বাসরের স্বপ্ন দেখতিস? ছিহ! ইউ নো হোয়াট জিসান? তুইতো একটা বিরল প্রজাতির প্রাণী, তোকে তো ফ্রান্সের জাদুঘরে রেখে আসা উচিৎ!’
জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই? মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি আবার?’
পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘কাল বিয়ে। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, তুইও শুয়ে পড়। আর দিন গুণতে থাক, কীভাবে তোর বাসর পন্ড করি। গুড নাইট মাই সুইট এন্ড ইয়াং বয়।’
জিসান বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। পূরব খাওয়া শেষে মোবাইল স্ক্রল করতে করতে শুয়ে পড়লো। জিসানও ওর ঘরে চলে গেলো। তারপর ফোন লাগালো শেফাকে। কয়েকবার ট্রাই করার পরেও কেউ ধরলোই না। তাই জিসানও আর চেষ্টা না করে ঘুমিয়ে পড়লো।
ওদিকে হলুদের আয়োজন শেষ করে ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো সেহের। সুমা, শেফা ওরাও গোসল সেরে ঘুমে মগ্ন। ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসতেই সেহেরের ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো পূরবের কল। সেহেরের ঘুম পাচ্ছে, তাই কোনোমতে কলটা রিসিভ করে মিনিট পাঁচেক কথা বললো৷ কথা বলার অবস্থায়ই সেহের ঘুমিয়ে পড়লো। পূরব অবাক হলো। পরক্ষণেই হেসে খুন। কী এক মেয়েরে পাল্লায় পড়েছে সে,হবু বরের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পূরব ফোন কলের ওপাড় থেকে সেহেরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। পৃথিবীর আর কেউ কী জানতো, ওদের এই মিষ্টি ভালোবাসার কথা? বোধহয় জানতোনা। শুধু এই অন্ধকার রাত আর সময়ই সাক্ষী হয়ে রয়েছিল এই মুহূর্তটার৷
আজ বিয়ের দিন। সকাল থেকেই সব আয়োজন শুরু। বরের বাড়ি থেকে বিশাল অঙ্কের গেস্টরা আসবে, সব হাই প্রোফাইলের লোকজন। সকাল থেকেই বাড়ির পেছনের উঠোনে বাবুর্চিরা কয়েক পদ রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। এ কাজে তাঁদেরকে সাহায্য করছে সেহেরের চাচা। ওর চাচী ভেতরের ঘরে মেহমানদের জন্য নাস্তা তৈরি করছেন৷ সেহেরকে সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে তিনি খাইয়ে দিয়েছেন। তারপর আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন।
বেলা গড়াতেই সেহেরকে সাজাতে বসলো শেফারা। লাল রঙের ওয়েডিং লেহেঙ্গা, ভারী গয়না আর মেকআপে ওর শ্যামরঙা চেহারাটা দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। জীবনে কোনোদিন এভাবে সাজেনি সেহের। সাজতে ইচ্ছে হতো একটা সময়ে, কিন্তু চাচীর অত্যাচারে কোনদিন যে সেই ইচ্ছেটা মরে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। সেজন্য এত সেজেও ওর কোনো অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছেনা। আজ নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই চিনতে পারছেনা সেহের। এতো আটা-ময়দা মাখানোর কী প্রয়োজন ছিল? সবার সামনে যেতে, বিশেষ করে পূরবের সামনে এভাবে যেতে তো লজ্জায় মরেই যাবে। ওদিকে ওর অবস্থা দেখে রিমি আরও লজ্জা দিতে শুরু করেছে। বললো, ‘তোকে দেখেতো ভাই চিনতেই পারবেনা। তোকে এই সাজে যা লাগছেনা দোস্ত…সসসসস পূরব ভাইয়া না হার্ট অ্যাটাক করে!!’
সেহের ধমকে বলল, ‘চুপ কর।’
‘উফ কী লাগছে রে তোকে। খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে আমারই, পূরব ভাইয়ের না জানি কী ইচ্ছা হয়। আয় তোর সাথে ছবি নিই।’
‘আমি ছবি তুলব না।’
‘বললেই হলো? একমাত্র বিয়ে আর তুই ছবি নিবিনা? পাগলের মতো কথা বলিস না তো।’ সুমা বললো।
ছবিটবি তোলা শেষ হতেই সেহেরের চাচাতো বোন অনু এসে জানালো বরপক্ষ এসে গেছে৷ শুনেই সেহেরের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। পূরবের কাজিনরা সবাই ওকে দেখতে এলো। ভাবি ভাবি করে জান বের করে ফেলার জোগাড়। সেহের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলো। ওর প্রতিবেশীরা কানাঘুষা করে বলতে লাগলো, ‘এতিম মাইয়াটা রাজকপাল লইয়া দুনিয়ায় আইছে। কী ভাগ্য দেখছো? কত বড়লোকের পোলা রাজি হইছে ওরে বিয়ে করতে।’
এসব শুনতে পেলোনা সেহের৷ পূরবের কাজিনদের সাথে কথা বলে ওর ভালোই লাগলো। সবাই বেশ ফ্রি-লি কথা বলছে। আর পূরবের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বেচারা ওয়েডিং শেরওয়ানি পরে স্বস্তি পাচ্ছেনা। গরমে ঘেমে মুখচোখ লাল হয়ে গিয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এটাই শেষ, আর কোনোদিন ফ্যামিলি গেদারিং করবেনা। এমন কোনো অনুষ্ঠানে ও যোগ দিবেনা৷ এত গরম?? মনে হচ্ছে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মাংসপেশি। আর এতক্ষণ লাগছে কেন? বিয়ে করতে এসেছে বিয়ে করে ও ওর বউ নিয়ে চলে যাবে, সেখানে এত লোককে দেখাতেই বা হবে কেন? উফ শিট..
যখন ওর সামনে আস্ত একটা খাসির ডিশ সাজিয়ে ওকে খেতে বলা হলো তখন পূরবের চরম রাগ উঠলো। কিন্তু বাবার দিকে চেয়ে রাগ সামলে সবার সাথে একসঙ্গে খাওয়া শুরু করলো। বিয়ের সময় যে নিজেকে পুতুল হয়ে থাকতেহয় তা আরো একবার প্রুফ হলো। যাইহোক, সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রোল করা রেজিষ্ট্রেশন খাতায় নিজের সাইন আর তিনবার “আলহামদুলিল্লাহ কবুল” বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
সেহের নিজেও জানেনা হঠাৎ ওর এতো কান্না কেন পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে৷ অথচ শত কষ্টেও ওর চোখে পানি আসেনা। আজ সামান্য একটা সাইন করার সময় ওর হাত কাঁপছে, কবুল বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে। এটাই বোধহয় মেয়েদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের সময়। একসময় নির্বিঘ্নে বিয়ের পর্ব শেষ হলো। অতঃপর বিদায়ের পালা৷ পূরব হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার কোনোমতে নিজের বৌকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেই হয়।
বিদায়ের সময় সুমা, শেফা, রিমি, শিলা সবার চোখে জল। তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড আজ অন্য কারোর বউ হয়ে গিয়েছে। চাচা-চাচী আড়ালে চোখ মুছলেন৷ সবার মুখ থমথমে। এই বিষন্ন সময়টাতে সেহেরের মন খারাপ হয়ে এলো। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আশ্চর্যের বিষয় গাড়িতে কোনো ড্রাইভার নেই। ড্রাইভ করছে স্বয়ং পূরব। ও আজ তার প্রিয়তমার দিক থেকে চোখই সরাতে পারছেনা। এই মেয়ে এত সেজেছে কেন? ওকে পাগল করে দিচ্ছে একেবারে! শক্ত করে সেহেরের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আমিতো আছি। একদম কাঁদবেনা।’
সেহের বলল , ‘কাঁদছিনা তো।’
‘মিথ্যা বলবেনা। তাহলে এখমই চুমু খেয়ে ফেলব।’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!