#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯
ব্যবসায়িক কাজের সূত্র ধরে পূরবকে কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়া যেতে হয়েছিলো। সেই দিনগুলোতে সেহেরের উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার মতো পূরব যখন আর কাউকেই পাচ্ছিলোনা তখন সেহেরের রুমমেট সুমা আর শিলাকে খুব করে অনুরোধ করলো ওর করা প্রতিটি কাজের খবর টাইম টু টাইম ওকে জানাতে। আর ভার্সিটিতে যা কিছু হবে সেগুলো জানতে জিসানকে দিয়ে শেফাকে রাজি করিয়েছে। শেফা আর রিমি রাজি হতে চাইছিলোনা সেহেরের অগোচরে। কিন্তু পূরবের অনুরোধ ওরা ফেলতে পারলোনা। পূরব শুধুমাত্র তার ধানিলংকাটার নিউজ জানতে চায়। সে কী করছে, কি খাচ্ছে, কোথায় গিয়েছে এভরিথিং! এতোদিনে পূরবের এসব অস্বাভাবিক আচরণ আর সেহেরের প্রতি অতিরিক্ত কেয়ারিং দেখানোর ফলে জিসান, রিমি, শেফা, সুমা, শিলা বুঝেই গিয়েছে সে সেহেরের প্রতি দুর্বল। অবশ্য ওরা মনে মনে খুশিই হলো। সেহের ওর মতোই কাউকে ডিজার্ভ করে। যাইহোক, পূরব ইন্ডিয়া যাওয়ার পরে সবাই ওর কথামতো সেহেরের খোঁজখবর দিতে থাকলো।
ভার্সিটির একটা ছেলের সাথে সেহেরের বন্ধুত্ব হলো। ছেলেটার নাম মাহিম। খুবই ভদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেহেরেকে পড়াশোনায় যথেষ্ট সাহায্য করে, বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। দুজনে মিলে একদিন তো শিশুপার্কে ঘুরেও এসেছে। এই খবর জিসান ফোন করে পূরবকে জানালো। ও রেগে আগুন। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কয়েকদিনের মধ্যে দেশে ফিরলো। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা সেহেরের ভার্সিটি রওয়ানা দিলো। এবং সেখানে পৌঁছে দেখলো জিসানের কথাই ঠিক। ছেলেটা সারাক্ষণ ওর সাথে থাকে। ক্লাসে পাশাপাশি বসে, অফ টাইমে মাঠে বসে গল্প করে। গিটার বাজিয়ে গান গায় বন্ধুমহলে। হাবভাবে বোঝাতে চায় সেহেরকে সে পছন্দ করে। সেটা সেহের না বুঝলেও পূরব বুঝতে পারলো। তখনই ওর অস্থিরতা বেড়ে গেলো। মন কু ডাকতে লাগলো, সেহের বুঝি আর তার হলোনা। ভালোবাসার অনুভূতির মতো মারাত্মক অনুভূতি দ্বিতীয়টি নেই। সেহেরের ব্যক্তিত্ববোধে মুগ্ধ পূরব নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা যখন দেখলো ওরই সামনে দিয়ে অন্য কোনো লোক সেহেরের সাথে মেলামেশা করছে। ঠিক মেলামেশা নয়, কিন্তু সেহেরের প্রতি খুবই কেয়ার দেখাচ্ছে যা পূরব কোনোভাবেই মানতে পারছেনা। রাগে ওর শরীর ফেটে গেলো৷
কোনোমতে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরলো। জিসান আর ইরফান সাহেব ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিলেন। ওকে হঠাৎ দেখে দুজনেই অবাক। কাজের লোক আব্দুল মিয়া চা- নিয়ে এলো। পূরব সোজা বাবার কাছে গিয়ে বসলো। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে ইরফান সাহেব কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ফিরবে জানালে না কেন?’
‘এমনি।’
জিসান জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই ফিরবি বললে তো আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।’
‘ম্যানেজার সাহেব জানতো। ওনি অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।’
ইরফান সাহেব গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? এরকম করছো কেন?’
পূরব বাবার কথায় মুখ তুলে চাইলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। তারপর সরাসরি বলল, ‘আব্বু আমি আজ একটা জরুরি কথা বলতে চাই।’
ইরফান আহমেদে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘কী কথা?’
‘তুমি কিন্তু না করতে পারবেনা।’
‘রিল্যাক্স। তার আগে তুমি মাথা থেকে হ্যাট খুলো। এরকম ইংরেজ সেজে থাকতে কতোক্ষণ ভালোলাগে?’
‘মোটেও ইংরেজ বলবেনা। আমার ভালোলাগে তাই পরি।’
জিসান হেসে বললো, ‘ভাই এতো ডেস্পারেট হয়ে আছিস কেন? বিপি লো করবে তো!’
পূরব ফুঁসে ওঠে বলল, ‘বিপি লো হয়ে মরে যাক।’
‘কী যে বলিস তুই৷ রেগে আছিস বলে যা তা বলবি নাকি? অফ যা!’
ইরফান সাহেব এবার বলে উঠলেন, ‘ওকে ওকে। ফ্রেশ তো হয়ে আসো। তারপর আরাম করে তোমার কথা শুনবো।’
পূরব ছোট্ট করে বলল, ‘ওকে।’
ওদের সাথে কথা বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পূরব ঘরে চলে এলো। সানগ্লাস, হ্যাট, ওয়ালেট বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তোয়ালে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো৷ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ওর উগ্র মস্তিষ্ক তখন ভাবনায় মত্ত! নাহ, সেহেরের সাথে ওই মাহিমের চলাফেরা একদম মানায় না। সেহেরকে শুধু ওর সাথেই মানায়৷ সাধে কি সেহেরের বলা চোর কথাটা মেনে নিয়েছে? ভালোবেসেছে বলেই মেনেছে। তাই বলে ওর সাত খুন মাফ করে দেবে তা কিন্তু নয়৷ পূরব যেমন ভালোবাসতে জানে, তেমনি কীভাবে ভালোবাসাকে আগলে রাখবে তাও ভালোভাবেই জানে। মেয়েটার কতোবড় স্পর্ধা, পূরবকে আজ ভার্সিটিতে দেখেও এমন একটা ভাব করলো যেন সে দেখেইনি। পনেরোদিন ছিলোনা দেশে, তাই বলে এতোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে? অন্য লোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাবে, আইসক্রিম খেয়ে নাকের পানি মুছবে অন্য লোকের রুমালে? কেন? পূরবের কী রুমাল নেই? দরকার হলে ওর শার্টে মুছুক, ওর হাতে মুছুক, মানা করেছে নাকি ও?? দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পূরব দেওয়ালে একটা ঘুসি মারলো। ব্যথায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড় হলেও মুখ দিয়ে “টু” শব্দটি পর্যন্ত করলোনা।
ওদিকে জিসান আর ইরফান আহমেদ চিন্তিতমুখে বসে আছেন পূরবের কথা শোনার আশায়। কি বলবে ও? আর এতো রেগেই বা আছে কেন? হলোটা কী ওর? দেখাই যাক কি বলতে চায়!
★
শেফা, রিমি, সেহের আর মাহিম আজ পুরোটা দিন একসাথে কাটিয়েছে। তিনজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। পূরবকে ওরা কেউই দেখতে পায়নি। সারাদিন হৈ-হল্লা করে কাটিয়ে মাহিম বাড়ি ফিরে গেলো। রিমিও চলে গেলো। শেফা অনেক জোর করে সেহেরকে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। রাতে ঘুমানোর সময় শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘মাহিম্মা আর রিমির রিলেশনটা মনে হয় হয়েই যাবে, কী বলস?’
সেহের বলল, ‘মনে তো তাই-ই হয়! মাহিমের ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা। রিমিকে দেখলেই তার নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করে।’
‘এটা আমিও খেয়াল করছি। মাহিমের আম্মা আবার রিমিকে খুবই পছন্দ করে। সেবার আমরা ওর বাসায় গেলাম না? তখন তো ওনি কী আহ্লাদীপনা করলেন।’
সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘কবে গেলি? বললি না তো।’
‘আরে সেদিন তুই ভার্সিটি শেষে টিউশনে চলে গেলি আর মাহিম্মা জোর করে আমাদেরকে ওর বাসায় নিয়া গেলো। তোকে বলতে ভুইলা গেছি।’
‘ওহহ। ওদের কথা বাদ দে। ওই জিসান ভাইয়ের সাথে তোর এতো ফুটুরফাটুর কীসের রে? তলে তলে টেম্পু চালাস না তো আবার?’
শেফা থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে?’
সেহের আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোরা প্রেম করোস তাইনা? কি ভাবছিস আমার চোখকে ফাঁকি দিবি আর আমি কিছু জানতেও পারবোনা?’
শেফা আহত গলায় বলল, ‘মোটেও না।’
‘মিথ্যা বলবি না একদম। তোর মোবাইলে ওনার এতো ম্যাসেজ কেন তাহলে? সেদিন তো দেখলাম বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো তোকে “আই লাভ ইউ” ও লিখেছে। তোর আম্মাকে বলতে হবে!’
শেফা ভয় পেয়ে বলল, ‘কী বলবি?’
‘বলবো আন্টি আপনার মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সে সেলিব্রিটি চোরের বন্ধুর সাথে প্রেম করে।’
এই পর্যায়ে এসে শেফাকে স্বীকার করতেই হলো ওর আর জিসানের মধ্যে রিলেশন আছে। খুব বেশিদিনের নয়। জিসানই প্রথম ওকে প্রপোজ করেছে। সেহের হাসতে হাসতে বলল, ‘তুইও প্রেমে পড়লি ভাই, রিমিরও
মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। আফসোস আমি আজীবন সিঙ্গেল থেকে গেলাম। কী দুঃখ, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি! আমাকে কেউ সান্ত্বনা দে!’
শেফা ভাবুক গলায় বলল, ‘মাহিম আমাদের তিনজনের সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। পরশু জিসান ভাই জিজ্ঞেস করলো ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? আমি মজা করে হ্যাঁ বললাম আর ওনি বিশ্বাস করে নিলো। ওনি তো আর জানেন না মাহিম অলরেডি বুকড! হা হা।’
সেহের শেফার হাসির সাথে তাল মেলালো। হঠাৎ শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাই দ্যা ওয়ে, তোর ওই সেলিব্রেটি চোরের খবর কী?’
সেহের ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কে?’
‘আরে পূরব ভাই! ভুলে গেলি? তোর জানালার বাইরে যিনি দাঁড়ায় থাকতো?’
‘ওহ ওনি? তুই ওনার খোঁজ জানতে চাইছিস হঠাৎ? কেন?’
‘না অনেকদিন যাবৎ দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাই বললাম!’
সেহের গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘জানিনা। তিন সপ্তাহ আগে দেখেছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন দাঁড়ায় না, হয়তো এখন মতি পাল্টেছে।’
শেফা মনে মনে হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’
সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’
‘কেন?’
‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’
‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’
সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!