#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭
সেহেরের কাছে এই প্রস্তাব রাখা হলে ও সোজাসুজি না করে দিলো। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে তবু্ও ওই বজ্জাত সেলিব্রিটির কোনো দয়া সে নেবেনা। এখন কেন চাকরি দিতে চায়? যখন ওর প্রয়োজন ছিলো তখন তো দেয়নি, এখন তাঁর বাবাকে বাঁচিয়েছে সেজন্য কি মূল্য পরিশোধ করতে চায়? লোকটা কী জানে মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মূল্যবান কাজের কোনো পুরষ্কার হয়না! জিসান নিজে এই প্রস্তাব নিয়ে ওর বাসায় এসেছিলো৷ কিন্তু সেহের ওকে না করে দিয়েছে। সুমা, শিলা বেশ অবাক হলো। এতবড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি? ওরা হলে অফারটা কখনোই ফিরিয়ে দিতোনা৷ যতইহোক, ওরা বেশ বড় পজিশনের লোকজন! ওদের সাথে কাজ করতে পারলে আর কোনো চিন্তা করার দরকারই ছিলোনা। সেহের মেয়েটা কী বোকা, ইশ! তবে স্বীকার করতে হবে, সেহের মেয়েটা ভালো।
ভার্সিটি শেষে সারাদিনে পাঁচটা টিউশন সেরে বাসায় রওয়ানা দিলো সেহের। হেঁটে হেঁটে ফিরছে। এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। শেফার ফোন।
‘হ্যালো হ্যালো।’
‘হ্যাঁ বল শুনছি।’
‘তুই নাকি পূরব ভাইয়ের দেওয়া চাকরির অফার না করে দিয়েছিস? কেন না করলি?’
‘বুঝলি না? আমাকে দয়া দেখাতে আসছে। আমার ওসবের দরকার নেই। দরকার হলে না খেয়ে থাকবো তবুও ওই লোকের দয়া আমি নেব না।’
‘কিন্তু তোর তো একটা চাকরি পাওয়া ভীষণ জরুরি। এভাবে তো আর চলেনা সেহের। সুযোগ বারবার আসেনা রে।’
সেহের বলল, ‘শোন, ওনাকে আমি মনুষ্যত্বের খাতিরে বাঁচিয়েছি। বাঁচানোর আগ অবধি আমি জানতাম না ওনি ইরফান সাহেব। আমি কোনো আশা রাখিনি, সাধারণ মানুষ ভেবেই হেল্প করেছি কিন্তু এর বিনিময় আমি কি করে নেই? আমাকে জোর করিস না প্লিজ। এতোদিন তো কষ্ট করেছি, আরেকটু না হয় করি। তবুও নিজের যোগ্যতায় আমি একটা কাজ পেতে চাই।’
শেফা হতাশ গলায় বলল, ‘তুই না আসলে একটা বোকা মেয়ে..’
‘বোকা কিনা জানিনা। কিন্তু ওই পূরবের কিছুর সাথে আমি জড়াতে চাইনা।’
‘পূরব ভাই কিন্তু ততো খারাপও নয়।’
সেহের ধমকে বলল, ‘তোর ভাই লাগে? বারবার ভাই ভাই বলিস কেন?’
‘মুখ ফসকে চলে আসে। ওনার চেহারাটা দেখতে ভাই ভাই লাগে!’
সেহের হেসে ফেললো। আরও প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা সেরে রাতের রান্নাটা করে নিলো। সুমা, শিলাও এখন ওর সাথে খায়। যাইহোক, তিনজন মিলে রাতের খাবার শেষ করে স্টাডি টেবিলে বসে পড়লো। সেহের নিজের ঘরে বসে পড়ছে৷ ওর টেবিলটা জানালার সাথে লাগোয়া৷ ওখান থেকে রাস্তাঘাট দেখা যায়, চায়ের দোকান দেখা যায়৷ তারপরই আছে একটা খাল। মূলত ওটা বুড়িগঙ্গা নদীর একটা অংশ। এখান দিয়েই প্রবাহিত হয় নদীর পানি। রাতের আকাশে উঠা মস্ত বড় গোল চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে পানিতে। সেখান থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে পানিতে। দেখতে খুবই মোহনীয় লাগছে৷ বৃষ্টি হলে ভালো হতো৷ সেহের বইয়ে মনোযোগ দিলো। পড়তে পড়তে একসময় চোখটা লেগে এলো। মাথাটা হেলে পড়তেই গ্রিলে বারি লাগলো। সেহের চমকে উঠলো। জানালার বাইরে দৃষ্টি পড়তেই দেখলো পূরব সেদিনের মতো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কেউ নেই। মাথায় কালো হ্যাট। দু-হাত ভাঁজ করে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহেরের বুক ধুকপুক করছে। এই লোকটা কী রাত-বিরেতে ওকে চমকে দিয়ে মেরে ফেলতে চায় নাকি? এখানে কীসের প্রয়োজন আর সেহেরকে জ্বালাচ্ছেই বা কেন? উফ…
দু-তিনদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরেও সেহের খেয়াল করলো পূরব প্রতিদিন রাতে এসে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটা সেহের শেফা আর রিমিকে জানালে ওরা হেসেই উড়িয়ে দিলো, কিন্তু শেফা জিসানকে জিজ্ঞেস করার পর এই ঘটনা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো। ওর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সুমা আর শিলাও খেয়াল করলো। পূরবের মতো ম্যাচিউরড এবং স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীর এরকম আচরণ এরকম হতে পারে তা কেউ মানতেও পারলোনা। এটাতো ষোলো বছর বয়সী কিশোরের আচরণ, প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য রাত-বিরেতে এভাবে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, কাউকে তোয়াক্কা না করা!
এটা নিয়ে সুমা, শিলা ওরা যখন হাসাহাসি শুরু করে দিলো তখন সেহের ভীষণ রেগে গেলো। পেয়েছেটা কী ওই পূরব? যা খুশি তা-ই করে ওকে হ্যারেজ করবে? আজ আচ্ছামত একটা শিক্ষা দিয়ে আসবে! যাতে সেহেরের দশ মাইলের কাছাকাছি আসার সাহসও পায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই সেহের বাসা থেকে বেরুলো। অনেক হয়েছে আর নয়। এই বাসায় কোনো মালিক বা কেয়ারটেকার নেই। মাসের ভাড়া মাস শেষে এসে নিয়ে যান, ওনারা ধানমন্ডিতে থাকেন। তাই এসবের ঝামেলাও নেই। সেহের মাথায় ইয়া বড় এক ঘোমটা টেনে ধীরপায়ে রাস্তা পার হলো। পূরব ওকে দেখলো ঠিকই কিন্তু ভাবতেও পারেনি সেহের এভাবে নিচে নেমে আসবে! সেহের ওর দিকে এগিয়ে গেলো। পূরব ওকে দেখে আচমকা হতভম্ব। এই মেয়েকে তো একটু আগেই জানালার পাশে দেখেছিলো, নিচে নেমে এলো কখন? ওতো সেটা লক্ষ্য করেনি! ড্যামেট..
সেহের গলায় রাগী ভাব এনে বলল, ‘আপনি এখানে? এতো রাতে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
পূরব বোকা বনে গেলো। এখন কী বলা উচিৎ তাঁর? তবুও নিজেকে সামলে নিলো। ভাব নিয়ে বলল, ‘হাওয়া খেতে এসেছি।’
‘তো হাওয়া খেতে আমারই বাসার সামনে কেন? এটাতো আপনাদের মতো বড়লোকদের এলাকা নয়। এখানকার বাতাস দুর্গন্ধযুক্ত, আপনার ভালো লাগবেনা।’
‘সেটা আমার ব্যাপার!’
সেহের কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তো গত তিনদিনও আপনি এখানে হাওয়া খেতে এসেছিলেন? মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না?’
‘ওফফ..তোমার এতো কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
‘মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ লোক কোথাকার!’
পূরব রেগে বলল, ‘কী বললে তুমি? আবারও বেয়াদবি শুরু করেছো? সেদিনের কথা ভুলে গেলে?’
‘সেহেরের সঙ্গে মিথ্যা বলা? আবার আপনি আমাকেই চোখ রাঙাচ্ছেন? আসলে আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি? আমি যে চাকরিটা ফিরিয়ে দিয়েছি সেটা কী আপনার ইগোতে লেগেছে? তাহলে আ’ম সো স্যরি মিস্টার পূরব। আমি কারোর দয়া নেই না!’
পূরব এবার বেজায় রেগে গেলো। মেয়েটা তখন থেকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। ও কী করে বুঝাবে এই ঠাস ঠাস করে কথা বলা মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে? কী করে বলবে? মেয়েটার ব্যবহার বারবার ওকে রাগিয়ে দিচ্ছে, তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে পূরব। রাগ মানুষের চরম শত্রু, তাই ও চাচ্ছে আগেরবারের মতোন এবারেও যাতে রাগ এসে সব নষ্ট না করে ফেলে। একই ভুল বারবার করা মানে নিজেকে বোকা প্রমাণ করা। পূরব ঠান্ডা মাথায়, খুব শান্তভাবে বলল, ‘আমি তোমাকে দয়া করিনি। আব্বু তোমাকে খুব পছন্দ করেছে কারণ তুমি তাঁকে বাঁচিয়েছো। জানি এর মূল্য শোধ করার নয়, কিন্তু তোমাকে হেল্প তো করতে পারে ওনার ছোট্ট একটা সাহায্য! বাট তুমি অফারটা এক্সেপ্ট করোনি, দ্যান ওই ব্যাপার ওখানেই শেষ। আর আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা আমার ইচ্ছে। তুমি এখানে কেন ইন্টারফেয়ার করছো ইডিয়ট?’
‘আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করছিনা৷ দাঁড়াতে হলে অন্যকোথাও দাঁড়ান। আমার জানালার বরাবরই কেন? আপনি জানেন, আমার রুমমেটটা আপনাকে নিয়ে কতোটা হাসাহাসি করে?’
পূরব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলে?’
‘আপনাকে কেন বলতে হবে?’
‘বিকজ আমার ফ্যানেরা আমাকে নিয়ে কী বলে তা জানার আমার খুব ইন্টারেস্ট৷ পৃথিবীতে বোধহয় তুমিই আমার প্রথম হেটার্স! যে এইরকম বাহাদুরি দেখাও আমার সাথে। অন্যান্য হেটার্সরা আড়ালে যা করার করে, কিন্তু আমার সামনে কখনো নয়।’
সেহের বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি এখানে আর দাঁড়াবেন না কখনো৷ এবার আসতে পারেন।’
পূরব ভাব নিয়ে বলল, ‘যাবোনা। আমার শুধু একজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে কারোর রেগে যাওয়া লাল নাকটাকে!’
সেহের অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে সে?’
পূরব হ্যাটটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে!’
সেহের হতভম্ব। এই দুইনাম্বারি লোকের কথা শুনে ওর গা জ্বলে গেলো। আবার ওর নামেই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। এতোটা বেহায়াও কোনো মানুষ হতে পারে?আবার ওকে ভালোবাসার কথাও বলছে! ওদের প্রেমে পড়া আর আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা৷ ওরা ভালোবাসার কী বোঝে? যত্তসব মিথ্যুকের দল! সেহের কটমট করে বলল, ‘মিস্টার ইফরাজ পূরব, আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমি আপনার কী অবস্থা করতে পারি?’
পূরবের চোখ হাসছে। সেহেরের রেগে যাওয়া মুখটা দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হাসি আটকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করতে পারো শুনিতো?’
‘এলাকার লোক ডেকে আপনার হিরোগিরি ছুটিয়ে দিতে পারি৷ এদিকে সব খেটে খাওয়া, কর্মঠ লোকেরা
থাকে। আশা করি ওনাদের হাতের ডান্ডার বারি খেলে আপনার মাথা থেকে এসব প্রেম-ভালোবাসার কথামালার চিরসমাপ্তি ঘটবে।’
‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে..ইনশাআল্লাহ!