#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
রৌদ্রস্নাত বিকেল। মিষ্টি বাতাসে গাছাগাছালি দুলছে। আকাশ কিছুটা কালচে নীল। বৃষ্টি নামার আগে যখন আকাশটা বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে যায়, অনেকটা তেমন। রোদে ধুয়ে চকচক করছে সেহেরের সাবলেট বাসার বারান্দাটা। ওখানে বসে শেফা আর রিমির সাথে গল্প করছে সেহের। আজ বিশেষ নাস্তাও তৈরি করেছে সেহের। হাতখরচের টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আজ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র ও কিনেছে। সেই টাকাটা ধার দিয়েছে শেফা। যদিও সেহের নিতে চায়নি, কিন্তু জোরজবরদস্তির চোটে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেনাকাটা অবশ্য সেহের ওদের দুজনকে সাথে নিয়েই করেছে। রিমি, শেফা আজ রাতটা এখানে কাটাবে বলে ঠিক করলো। একা একা সেহেরে একদম ভালো লাগেনা। তাছাড়া ওর মনমেজাজও কিছুদিন ধরে ঠিক যাচ্ছেনা! এসব কারণেই মূলত শেফা, রিমি এসেছে। তিন’জন মিলে যখন গল্পে মগ্ন তখন দেখলো কালো রঙের একটা গাড়ি ঠিক রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ এবং এই গাড়িটা আর কারোর নয়, পূরবের! সেহের ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো! যখন থেকে পূরবের আসল পরিচয় জানতে পেরেছে তখন থেকেই ওর মধ্যে উৎকন্ঠা কাজ করছে, ভয় হচ্ছে। এই বুঝি হাজার খানেক ক্যামেরা নিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো মিডিয়ার লোকজন। আর নানা বিব্রতকর প্রশ্নে ওকে জর্জরিত করা হলো! আর পূরবকে চোর বলা আর পানি ঢালার শাস্তি হিসেবে ওকে বেড়ধক পিটানো হয়েছে। হাজার হোক সেলিব্রিটি বলে কথা। মানবসেবায় নিজেকে শামিল করে অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গিয়েছেন এই লোক। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আর বাবা ইরফান আহমেদের ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেও বেশ ভালোই পরিচিতি পেয়েছেন। আর তাঁর ইউনিক স্টাইলে চলাফেলা, আর গুড লুকের জন্য সর্বদা তাঁর নামের ছড়াছড়ি। এককথায় সিনেমায় অভিনয় না করেও বাস্তব জীবনে সে সেলিব্রিটি। অসংখ্য মানুষ তাঁকে ভালোবাসে! কিন্তু এই মানবদরদী মহাপুরুষের যে ভালো মানুষের আড়ালে কুৎসিত একটা রুপ আছে, সেটা সেহেরের থেকে ভালো আর কে জানে??
পূরবের গাড়িটা ওরা তিন বান্ধবীই লক্ষ্য করেছে। শেফা মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা তো পূর.. পূরব ভাইয়ের গাড়ি!’
সেহের মিনমিন করে বলল, ‘ভাই? তোর ভাই লাগে?’
‘আরে ধুর…ভয়ের চোটে গলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
রিমি গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘সেহের? এখন কী হবে রে?’
সেহের চুপ করে বাইরে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। টেনশন হচ্ছে খুব। ইশ..একবার যদি জানতো এই লোক এমন কিছু করতে পারে তাহলে অভদ্র ব্যবহার করতোনা। কিন্তু এখন কী হবে? তাছাড়া পূরবকে ও দেখা যাচ্ছেনা! তবে কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থেকে পূরব আর জিসানকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে এই লোক। সেহের ভয় পেয়ে রুমে চলে এলো, পেছন পেছন রিমি আর শেফাও এলো। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বড়লোকদের সাথে লাগতে গেলে এমনই হবে রে সেহের। এবার লাত্থি-ঘুসি খা। মনে মনে কথাগুলো বলে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে রইলো সেহের!
মিনিটখানেক পরই দরজায় ঠকঠক ঠকঠক শব্দ হলো। ওরা তিন বান্ধবীই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
রিমি সেহেরের কাঁধ খামচে ধরে ঢোক গিলে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই তোকে ধরতে এসেছে, কি বলে ডাকবো আর ভাই ছাড়া। ভাইটাই ডেকে যদি কিছু একটা করতে পারি..’
শেফা দাঁত কটমট করে বলল, ‘চুপ থাক রিমি! টেনশনেই বাঁচিনা এখন তোর উল্টাপাল্টা কথা শোনার মুড নেই একদম। এই সেহের, দরজা খুলবো?’
‘ওনারা এসেছেন তাইনা?’
‘মনে তো হচ্ছে, আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখি!’
সেহেরের সাথে যে মেয়েগুলো ফ্ল্যাট শেয়ার করে তারা আজ বাসায় নেই, গ্রামে গিয়েছে। তাই কোনোরকম চিন্তাভাবনা নেই। শেফা মেইন দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে সাহসী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলোনা। শেফা আবারও ডাকলো কিন্তু কেউওই সাড়া দিলোনা। তাই ও ভাবলো বোধ হয় কেউ নেই আর পূরবরা এসে থাকলেও চলে গিয়েছে। নইলে তো সাড়া দিতোই। যাইহোক, কনফার্ম হওয়ার জন্য দরজাটা অল্প একটু খুলতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পূরব রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে তার বেস্ট ফ্রেন্ড জিসান। চিনতে পারলো শেফা। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাতে নিলেই দরজা ঠেলে একেবারে ঘরে এসে পড়ে পূরব। সেহের আর রিমি তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এতো সরাসরি বাসায় ঢুকে পড়েছে। এখন যদি ওকে মেরে ফেলা হতো তাহলে কেউ জানতেও পারবেনা, ভাগ্যিস শেফা, রিমি আছে!
ঘরে ঢুকেই পূরব প্রথমে যে কাজটা করলো সেটা হলো চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নাকে হাত দিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন সে কোনো ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। জিসান পূরবের এই কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো। কারণ সে যতোই হাই ক্লাস ফ্যামিলিতে বড় হোক বা স্টাইলিশভাবে চলাফেরা করুক এইধরনের কান্ড কস্মিনকালেও করেনি। বরংচ নিজ হাতে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করেছে। ডাস্টবিন পড়ে থাকা সদ্য জন্মানো শিশুকে বুকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু আজ একটা মেয়ের বাসায় এসে কোনো কারণ ছাড়াই যে উদ্বত্যভাব দেখাচ্ছে তা জিসানকে প্রচন্ড ভাবিয়ে তুলেছে! ওর ঘোর কাটলো পূরবের হুংকারে।
‘সেহের কে সেহের? আই মিন ওই বেয়াদব মেয়েটা,কোথায় সে?’
পেছনে ঘুরেই দেখলো কাঁচুমাচু হয়ে বিছানার সাথে লেপ্টে বসে থাকা সেহেরকে। মেয়েটার অসহায় মুখটা দেখে ও চরম মজা পাচ্ছে। চিল্লিয়ে বলে উঠলো, ‘এই বেয়াদব মেয়ে, নামো বলছি বিছানা থেকে ফার্স্ট… ‘
সেহেরের আত্না প্রায় বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পূরবের সামনে দাঁড়ালো। শেফা আর রিমি পূরবের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। পূরবের মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস। কিন্তু সেহেরের সাথে কথা বলতে বলতে চোখ থেকে নীল রঙা সানগ্লাসটা খুলে ফেললো। ভয়ংকর রাগী, কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়ার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকলো সেহের। এই প্রথম পূরবকে এভাবে দেখেছে। সানগ্লাস ছাড়া এই লোকটাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। যাইহোক, সেহের মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আমি সেহের। কীজন্য এসেছেন এখানে?’
‘তুমি আমায় কী কী বলে এসেছিলে সেগুলো আবার রিপিট করো। নাও লেটস স্টার্ট..’
সেহের ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল নাকি এই লোকটা? বাড়ি বয়ে এখানে এসেছে সিনেমাটিক ডায়লগ শুনতে?আর ও কী না কী ভেবে এতোক্ষণ বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করছিলো।
‘শুনুন, আপনার সাথে আমার ওরকম বিহেভ করা উচিৎ হয়নি। তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আসলে জানতাম না আপনি কে!’
‘কেন? জানলে কী করতে?’
‘জানলে আমি আপনাকে চোর বলতাম না। আর না আপনার মাথায় পানি ঢালতাম।’
পূরব কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘ওহহ তারপর?’
সেহের বিরক্ত চোখে তাকালো। বলল, ‘তারপর কিছুনা। স্যরিটা আপনার পাওনা ছিলো, মিটিয়ে দিলাম। এবার প্লিজ আমাকে ফলো করা বন্ধ করুন।’
পূরব রেগে বলল, ‘ফলো করি মানে?’
সেহের থতমত খেয়ে বলল, ‘করেনই তো। আমি যেখানে যাই সেখানেই আপনি হাজির, তাছাড়া সেদিন রাতে এসে আমার জানালায় ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করেছেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন, আবার রেস্টুরেন্টেও দেখা, ক্যান্টিনেও আপনি। মানে আমি যেখানে আপনি সেখানে টাইপ!’
পূরব ‘ফলো করা’ কথাটি শুনে রেগেমেগে একাকার। আজ পর্যন্ত ওর কাউকে ফলো করা তো দূর, বরং অন্যরা ওকে ফলো করে। আর সেখানে এই মেয়েটা এসব কি বলছে? সেহের ওর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘আর একটা কথা, আপনি আমার বাসার ঠিকানা জানলেন কী করে?’
‘জিসানননন….’
‘বল দোস্ত।’
‘একে বল চুপ থাকতে, নইলে ওর কী হাল করবো সেটা কিন্তু নিজেও বুঝতে পারছেনা!’
জিসান ওর কথার মানে বুঝতে পেরে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপুমণি তুমি ওর সাথে বেয়াদবের মতো আচরণ করোনা।’
‘আমিতো বেয়াদবি করছিনা, জাস্ট জানতে চাচ্ছি আমার বাসার ঠি..’
পূরব সেহেরের গাল চেপে ধরলো। জিসান, শেফা আর রিমি ভয় পেয়ে গেলো। সেহের অবাক হয়ে গেলো। পূরব হুংকার দেওয়া কন্ঠে বলল, ‘আমার কাছে কৈফিয়ত চাও? এতো সাহস? দেখি তোমার কত দম আছে আমার সাথে লাগার! আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ!’
এটুকু বলে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর আশপাশ খুঁজে একটা কলস দেখতে পেয়ে ওটা তুলে নিয়ে এলো। তারপর কলসের পুরো পানিটা সেহেরের উপর ঢেলে দিয়ে ওকে ভিজিয়ে দিলো। অবাক হয়ে গেলো বাকিরা। জিসান ওকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘তুই এরকম অদ্ভুত আচরণ কেন করছিস? ও একটা মেয়ে, এভাবে পানি ঢালাটা ঠিক হলোনা।’
ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!