প্রিয় তুমি পর্ব-০২

0
1690

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

পেটের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সেহের দাঁড়িয়ে আছে হ্যাট পরা লোকটির সামনে। ওর চোখে পানি টলমল করছে। কেননা রেস্টুরেন্টে ওর কাজটা গ্রান্টেড হয়নি। ওরা অন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছে। দুদিন পর এসে এই কথাটি জানার পরে সেহেরের শেষ আশাটুকুও এক নিমিষেই নিভে গেলো। মুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া! ওর গায়ে হলুদ রঙের মলিন একটা কামিজ, পায়ে কমদামী স্যান্ডেল। এলোমেলো ভাবে চুলগুলো বেণী করা। হাতব্যাগটারও যাচ্ছেতাই অবস্থা। তার উপর পিরিয়ডের অসহনীয় ব্যথা আর চাকরি না পাওয়ার কষ্ট। সব মিলিয়ে ওর চেহারা বিধবস্ত দেখাচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো সেদিনের হ্যাট পরিহিত লোকটা অট্টহাসি দিয়ে সেহেরকে বলল, ‘এটা তোমার পানিশমেন্ট ছিলো পেঁচিমুখী। আমাকে কামড় দেওয়া ও চোর বলার শাস্তি।’

লোকটার হাসি দেখে সেহেরের গা জ্বলে উঠলো। চোখের পানিটুকু মুছে ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘আপনার রেস্টুরেন্ট নয় এটা, আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেননা। আমি এখন বুঝতে পারছি আমাকে কাজ না দেওয়ার পেছনে আপনার হাত আছে! আমি এখানকার মালিকের সঙ্গে কথা বলবো। আমি জিজ্ঞেস.. ‘

লোকটি ডিভানের উপর বসতে বসতে ভাব নিয়ে বলল, ‘হাত থাকবে কী? এটাতো আমারই রেস্টুরেন্ট। আমিই এটার মালিক। এখানে আমার অর্ডারেই সব হবে! কাকে কাজ দেবো না দেবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।’

সেহের অবাক চোখে চেয়ে আছে। ওর মুখ চুপসে গিয়েছে। এই তাহলে এখানকার মালিক। আর সেদিন ও একে চোর বলেছে? ও মাই গড! সেহের কথাটা ঠিক হজম করতে পারলোনা। ওর মাথা ঘুরে এলো, কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। এর জন্যই সেদিন এতো এতো লোক ভিড় জমিয়েছে এখানে? এই সেই সেলিব্রিটি? সেহের যখন এসব ভাবনায় মত্ত তখন ওর চোখ পড়লো লোকটার উপর। লোকটার গা জ্বালানো চাহনি আর দাম্ভিক হাসি নজরে পড়তেই মন বিষিয়ে উঠলো। সেহেরকে বোকা বানিয়েছে সেদিন! রাগে হাত-পা কাঁপতে লাগলো ওর।এখন মনে হচ্ছে, এখানে কাজ পেলে হয়তো এর মুখোমুখি হতে হতো, তার চেয়ে কাজ পায়নি সেটাই ভালো। অন্তত হ্যাট পরা লোকটার হিরোদের মতো শয়তানি চেহারা আর এই অহংকারী হাসিটা দেখতে হবেনা।

‘তার মানে আপনিই সেই সেলিব্রেটি? যাকে দেখতে এতো এতো লোক ভিড় করেছিলো?’

‘ইয়েস পেঁচিমুখী।’

‘একদম পেঁচিমুখী বলবেন না।’

‘তো? কী বলবো? তোমাকে দেখতে ঠিক পেঁচার মতোই লাগছে। তোমাকে ডাকার জন্য এরচেয়ে ভালো কোনো নাম আমি খুঁজে পাইনি!’

সেহের কটমট করে বলল, ‘আমার খুব ভালো একটা নাম আছে বুঝলেন ভাই? সেহের! আমার নাম সেহের।’

‘হোয়াট দ্যা ভাই? কে তোমার ভাই? আর তুমি কী ভেবেছো তোমার নাম আছে আর আমার নেই? কোথা থেকে যে এরা আসে…’

‘আপনার নাম শোনার আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আর এখানে কাজ পাওয়ারও ইন্টারেস্ট নেই।’

সেহের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে লোকটা ওকে ডেকে বলল, ‘এক কাপ কফি খেয়ে যেতে পারো। আমাদের সার্ভিস ভালো।’

কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দেওয়া হচ্ছে! সেহের রেগে বলল, ‘আপনার কফিতে আর আপনার এই আলিশান রেস্টুরেন্টে থু থু মারি!’

লোকটার মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো। সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরাতেই রেগে যাওয়া লাল চোখদুটো দেখে ওর গলা শুকিয়ে এলো। বুঝতে পারলো এই কথাটা বলা ওর ঠিক হয়নি। লোকটা চিৎকার করে বলল, ‘আমার সাথে? এই ইফরাজ পূরবের সাথে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস দেখালে? তুমি জানোনা তুমি কত বড় ভুল করলে, এর জন্য ভুগতে হবে তোমায়। সেদিনের বেয়াদবির জন্য তোমাকে কাজ দেওয়া হয়নি, তারপরও তোমার শিক্ষা হয়নি? ওকে, আমি দেখে নেবো তোমায়! রাইট নাও, গো টু হেল ড্যামেট…’

সেহের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। ভালোয় ভালোয় জান নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এটাই ভালো। খোলা হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়েও ওর শান্তি লাগছেনা। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছুর উপর বিরক্ত সে। ওর ভাগ্যই ওর সাথে বেঈমানি করলো! কেন ওর সাথে সবসময় খারাপ হয়? কই ভেবেছিলো কাজটা হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ, পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো কই? বড়লোকরা বুঝি এমনই হয়! গরিবদের উপরই ওদের যত অত্যাচার।

পথেঘাট রোদের আলোয় চিকচিক করছে। বাতাস বন্য। সেহের হাতব্যাগ খুঁজে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলোনা ও। এই টাকাটা দিয়ে বাসা পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু এখন বাসায় যাওয়া যাবেনা, কারণ এখন ভার্সিটির সময় হয়ে গিয়েছে। ক্লাস মিস করা যাবেনা, আবার ভার্সিটি গেলে বাসায় আসার টাকা পাবেনা। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। অবশেষে বাড়ির পথেই রওয়ানা হলো। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা মিস হয়ে যাওয়ায় ওর খুব খারাপও লাগলো। কিন্তু কিছু করার নেই। একদিন হলো কয়েকজন অচেনা মেয়ের সাথে সাবলেটে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। তাছাড়া জিনিসপত্র গোছানো হয়নি, এখন গিয়ে সেই কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে! তাহলে রাতজেগে পড়াশোনা করতে সুবিধা হবে।


পেঁচিমুখী মেয়েটার স্পর্ধা দেখে পূরব এখনো রাগে কাঁপছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। সামান্য একটা মেয়ে বলে কিনা ‘থু থু’ মারি? এতো সাহস? সেদিনের ঘটনায় মেয়েটাকে কিছু করেনি বলে আস্কারা পেয়ে গিয়েছে। ওর সাথে গলা উঁচু করে কথা বলে! একে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতেই হবে। পূরব বাঁকা হেসে মনে মনে বলল, ‘যার যতো টাকা, তার ততো ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতার বলেই পৃথিবী জয় করা যায়। আর সেখানে তোমার মতো বেয়াদব মেয়েকে সোজা করা এই পূরবের বাঁ হাতের খেল!’

এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে জিসান নামটা। পূরব ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিসান বলে উঠলো, ‘মাথায় কাউবয় হ্যাট পরে, ঘোড়ার পিঠে বসে, ঘোড়াকে চাবুক মারতে মারতে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করছে। তা আসবে নাকি আমাদের রাজকুমার ইফরাজ পূরব?’

পূরব রেগে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ঘুসি দিয়ে বলল, ‘ফ্লাট করবিনা একদম। আমার মনমেজাজ ভালো নেই, কিছু একটা বলে ফেললে তোরই খারাপ লাগবে। তাই কাজের কথা বল..’

জিসান বলল, ‘ওকে ওকে..তুই কী আসছিস? আজ একটা পার্টি আছে!’

‘আমি কোনো পার্টিতে যাবোনা। বাসায় যাচ্ছি.. তুই চলে আয়!’

‘তুই না গেলে আমিও যাবোনা। আচ্ছা আমি আসছি।’

পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওকে।’

জিসান এবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে ভাই? এতো রেগে আছিস কেন?’

পূরব ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার সাথে একজন বেয়াদবি করেছে। ভাবতে পারছিস?’

জিসান বড্ড অবাক হলো। তার এই রাগী বন্ধুটির সাথে কেউ বেয়াদবি করেছে এটাও কোনোদিন ওকে শুনতে হবে তা কখনোই ভাবতে পারেনি। ব্যবসায়ী ইরফান আহমেদের ছেলে, হাজারো মেয়েদের ক্রাশ ইফরাজ পূরবের সাথে কথা বলতে গেলে যেখানে দু’বার ভাবতে হয়, সেখানে কে এই দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো? কিন্তু ভাবনার প্রহরকে সাইডে রেখে জিসান গলা উঁচু করে বলল, ‘একবার বল ভাই কে তোকে কি বলেছে। তোর সাথে কেউ বেয়াদবি করবে আর আমি বন্ধু হয়ে সেটা মেনে নেবো তা কখনোই হবেনা। দরকার হলে গাজা দিয়ে মশাল বানিয়ে তার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে পুরো ঢাকা শহরে আন্দোলন করবো৷ তবুও বল কে সে? কোন অধম বান্দা তোকে রাগিয়েছে! একবার বল ভাই, তার অবস্থা আমি খারাপ করে দেবো!’

‘একটা মেয়ে। আর কোন মেয়ে জানিস? যাকে কাজ না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আজ রেস্টুরেন্টে এসেছি!’

বলেই ফোনটা কেটে দিলো পূরব। জিসান বাক্যহারা হয়ে গেলো। একটা মেয়ে ওর বন্ধুকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে? হা হা। এই দিনও দেখতে হচ্ছে ওকে! মেয়েটাকে দেখার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কে সেই রমণী? ভাবতে ভাবতে বন্ধুদের আড্ডামহল থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো জিসান। তারপর রওনা দিলো পূরবের বাসার উদ্দেশ্যে!


সেহের বাসায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবকাজ করে ফেললো। কাপড়চোপড় ট্রাঙ্কে রেখে, বইখাতা সেলফে সাজিয়ে নিলো। তারপর বিছানা করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছলো। এসব করতে করতেই রাত নয়টা বেজে গেলো। অতঃপর রান্না চাপালো। ভাত আর ডিমের তরকারি। অন্যান্য রুমমেটরা নিজেদের ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। কারো রুমে ঢোকার পার্মিশন নেই সেহেরের। তাই ও আর সেদিকে যায়না। গোসল সেরে খাবার নিয়ে বসলো জানালার ধারের পড়ার টেবিলটায়। পেট ক্ষিধেয় চোঁ চোঁ করছে। কষ্ট করে রান্না করা ভাতের লোকমাটা মুখে তুলতে গেলেই বাইরে থেকে কিছু একটা এসে জানালা ভেঙে সোজা ওর থালায় পড়ে। হাত ফসকে থালাটা সোজা মেঝেতে পড়ে ভাতগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে সেহের কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। ভাতগুলো মেঝেতে দেখে ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। বাইরে থেকে কেউ পাথর নিক্ষেপ করেছে। সেহের জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো কয়েকটা ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে হাসছে। পাশেই বিকেলের হ্যাট পরা লোকটি আর সাথে চেক শার্ট পরিহিত অন্য একটা যুবক। সবাই হাসছে যেন খুব মজার ঘটনা ঘটেছে। কাচের জানালাটা ভেঙ্গেছে। মূলত ওদের উদ্দেশ্য ছিলো জানালা ভাঙ্গা, কিন্তু তারা তো আর জানেনা এই কাজে একটা মেয়েকে সারারাত না খেয়ে কাটাতে হবে! বড়মাপের সেলিব্রিটি টাইপের, একজন লোক রাতবিরেতে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারে ভেবেই গা গুলিয়ে উঠলো সেহেরের। ছিঃ এতো নিচু মানসিকতা…কিন্তু, কিন্তু এই লোক ওর বাসার ঠিকানা পেলো কীভাবে? হুয়াই?

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে