#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং-১
প্রিয়ন্তি!
ভালো আছিস নিশ্চয়? ভালো থাকবি, এ প্রত্যাশা ও কামনাই সর্বদা করেছি। আমি জানি, তুই ভালো থাকতে না পারলেও ভালো থাকবি। মানুষের স্বপ্ন ও আশা থাকে জীবনের চেয়েও বেশি। একজন মানুষ যতগুলো সেকেন্ড বাঁচে তার চেয়ে অধিক পরিমাণে আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। আর সে সব স্বপ্ন কিংবা আশা ভঙ্গ হলেই কষ্ট পায়, দুঃখ বোধ করে। কিন্তু পৃথিবীতে অযুত-কোটি মানুষের মাঝে আমি তোকে একটু ব্যতিক্রম দেখেছি। যার স্বপ্ন ছিল না, আশার দানারা ডোরে গাঁথতে চাইত না। তাই তোর কষ্টও কম ছিল। তোকে পাথর ছুড়ে ভেঙে ফেলা কাঁচের মতো হাসতে দেখেছি অনেক। সুখের গানে আকণ্ঠ হাবুডুবু খেতে দেখেছি। অথচ কাঁদতে দেখেছি একটা মাত্র দিন। মেয়েদের চোখের কোণায় নাকি জল জমে থাকে? সেটা কি তবে মিথ্যা?
আমি তোর ভাই। তাই না? কারো পাতিয়ে দেওয়া ভাই নই কিন্তু। স্রষ্টার নিয়মে জন্ম নিয়ে তোর ভাই হয়েছি। এ আমার বড় সৌভাগ্য। জানিস, তোর ভাই হয়ে যতটা সৌভাগ্য অর্জন করেছি, ‘প্রিয় ভাই’ না হতে পেরে নিজেকে ততটাই হতভাগা মনে হয়? বরং এর চেয়েও বড় দুর্ভাগ্যটা নিয়ে আমার পৃথিবীতে আসা হয়েছে।
তোর কি মনে আছে, একবার তোকে খুব পিটিয়েছিলাম? ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়েছিলাম। আমি জানি, সে কথা তুই ভুলে যাসনি। বরং সেদিন তো কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলি, ‘তোমার এ আচরণ আমি কক্ষনোই ভুলব না। লজ্জা থাকা উচিত, ছোট বোনকে পেটাচ্ছো।’
সেদিনই তোকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়ে লিখিত একটা দিন সেটি।
সত্যিই, আমি তখন নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছিলাম প্রিয়ন্তি! এতটাই বেহায়া হয়ে গিয়েছিলাম যে, পরম সৌভাগ্য দিয়ে যে মানুষটা আমার বোন হয়েছে; আমি তাকেই পিটিয়েছি। সেদিনটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলে মরমে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করে। শক্ত শুকনো ঢাল যেভাবে চুলার উপরে উঠতে চাওয়া আগুনে মরমর করে জ্বলে, কয়লায় রূপ নেয়, ঠিক সেভাবে আমারও ভিতরটা অনুশোচনায় পুড়তে থাকে। মরমে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করে। এরপর ভেবেছিলাম আর কখনোই তোকে মুখ দেখাব না। এ পোড়া মুখ দেখিয়ে তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু সে তুই-ই কিনা গভীর রাতে এসে আমাকে কফি হাতে ধরিয়ে বলেছিলি, ‘আমার কোনো রাগ নেই। দুপুরে যা হয়েছে তা আমি ভুলে যেতে চাই। যিনি কাল সকালে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাচ্ছেন, তিনি যেন কিছুতেই না পালান! তাহলে তার বোনটা খুব কষ্ট পাবে। কখনোই তাকে ক্ষমা করবে না।’
জানিস, সেদিন তুই কষ্ট পাবি বলে আমি বাড়ি ছাড়িনি। কিন্তু সত্যিই আমার তোকে মুখ দেখাতে বড় লজ্জা লাগছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, তোর পায়ে পড়ে কাঁদি। হাউমাউ করে কাঁদি! পারিনি বলে আফসোসটা আজও রয়ে গেল।
তোকে কখনো মার্কেটে যেতে দেখিনি। বাবাকে দিয়েই সবটা কিনিয়ে আনতি। তোর ফ্রেন্ড ছিল না। কারো সাথে মেলামেশা করতি না। কেমন যেন একা-ফাঁকা থাকতি। কেন এমনটা করতি? আজকাল বন্ধুত্ব করিস তো?
মেয়েদের নাকি সাজগোছের একটা বাতিক থাকে। অথচ তোর ঊনিশটা বসন্ত আমার সামনেই পেরিয়ে গিয়েছিল। কোনোদিনই তোকে সাজতে দেখিনি। আমার বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল তোকে মেকাপে দেখব! সেটা ভেবে ঢাকা থেকে তোর জন্য পায়েল আর মেকাপবক্স কিনে নিয়েছিলাম। সেদিন তোর চোখেমুখে আমি হাসির ঝিলিক দেখেছি, খুশির চমক দেখিনি! কেন বল তো? তোর কি উপহারগুলো পছন্দ হয়নি? ভেবেছিলাম তোর হাঁটায় ছন্দ থাকবে। পায়েল পরে হাঁটলে রিনিঝিনি শব্দে ঘরটা অনুরণিত হবে। অথচ হয়নি!
প্রিয়ন্তি,
আমি বাড়ি ছাড়লে তুই কষ্ট পাবি, বলেছিলি। এরপর ঠিকই আমি বাড়ি ছেড়েছি। এতগুলো দিন বাবা-মায়ের সাথে অভিমান করে কাটিয়ে দিয়েছি। আমার মতো তোরও কি অভিমান জমে আছে? আমার কিংবা বাবা-মায়ের উপর? বাড়ি ছাড়ার কারণে তুই কষ্ট পাসনি বোন? এখন কি আমায় ঘৃণা করিস, নাকি অপছন্দ?
তোর কাছে আমার এ চিঠি জীবনের প্রথম ও শেষ চিঠি। আর হয়ত কখনোই চিঠি লিখব না। তেমন ইচ্ছে নেই। হয়ত ইচ্ছে হলেও সুযোগ হবে না!
শ্রাবণের মেঘ যেভাবে এখন আসে তখন যায়, আমারও তেমনি সুখ আসে, দুঃখ যায়। ফের আবারও ঘিরে ধরে দুঃখের পঙ্গপাল। তুই কি শান্তাকে চিনতি? আমি কিন্তু ওকেই বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আবার বাবাও হয়েছিলাম। সেসব তোরা শুনেছিস প্রিয়ন্তি? মা-বাবা জেনেছে? কে জানে! আমি তো পরিচিত কাউকে জানাইনি। স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম তো, তাই।
শান্তা বাচ্চা জন্মদানকালে মারা গিয়েছিল। মায়ের অবর্তমানে ওর সন্তানকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ওরা দুজনই আমার সাথে অভিমান করে ওপারে চলে গেছে। শুনছি, ওদের অভিমান নাকি শেষ হয়েছে। তাই আমিও একসঙ্গে থাকতে চাই। রওনা দিব অতিশীঘ্র!
পিঠটা এখন আর বিছানা ছাড়তে চায় না। এত ধকল সইবে কীভাবে, বল! ডাক্তার বলেছেন আমার নাকি দুটোই কিডনিই শরীর চালাতে অযোগ্য। তাই যাত্রা শুরু করতে চাই। অতিশীঘ্র মিলিত হব শান্তা আর ওর কষ্টের রক্তটার সঙ্গে।
মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তোর প্রিয় ভাই হওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। চৌকাঠ পেরিয়ে গেলেই কি তোর নাম প্রিয়ন্তির ‘প্রিয়’ মর্যাদা দিবি? নাকি এ আমার আমৃত্যু স্বপ্নই থেকে যাবে?
যা হোক, অনেক কথা বললাম। ভালো থাকিস আগের মতো। খিলখিলিয়ে হাসবি। বাবার দিকে খেয়াল রাখিস, মাকে ভালোবাসিস। তোর প্রিয় বড় ভাইকে আরো প্রিয় করে আগলে রাখিস। আমাকে ভুলে যেতে নিষেধ করব না কিছুতেই। এ অধিকারটাই বা কবে অর্জন করেছিলাম?
ইতি
আমৃত্যু প্রিয় হওয়ার স্বপ্ন দেখে যাওয়া তোর ভাই
মুহাম্মাদ সা’দ সাকী