#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪০
________________
বিষণ্ণ চারপাশ। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কান্নার শব্দ নেই তেমন। বাড়ির পিছনে পুকুরঘাটের পাশে মশারি টানিয়ে চারপাশ বিছানার চাদর দিয়ে লেপ্টে শেষ গোসল করানো হচ্ছে দাদিমাকে। রাগান্বিতা মশারির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্তর পুরে ছারখার হচ্ছে, ইচ্ছে করছে মাটির ওপর শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে। সেই ছোট বেলা থেকে এই মানুষটা রাগান্বিতাকে অনেক যত্ন করেছে। মায়ের চেয়েও বোধহয় বেশি স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছে। মাকে তো দেখে নি রাগান্বিতা দেখেছে দাদিমাকে। কুহু আপাকেও দারুণ ভালোবাসতো দাদিমা। রাগান্বিতাকে কতবার বাবার ঝার খাওয়া থেকে রক্ষা করেছে, কতবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তার হিসাব নেই। সেই মানুষটা আর নেই। ভাবলেই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা নিজের ডান হাতটা মুখের চেপে ধরলো কেঁদে উঠলো আবার, তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। দাদিমা কিছু বলতে চাইছিলেন, কি বলতে চাইলেন এই আফসোস যাচ্ছে না রাগান্বিতার। সে আরো আগে কেন এলো না এখানে, কেন আসতে পারলো না দাদিমার কাছে। এই শোক রাগান্বিতাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যন্ত্রণায় পুরো শরীর বুঝি তীর তীর করে কাঁপছে। রাগান্বিতা ওখান থেকে সরে এলো। আর সইতে পারছে না। কুহু আপার মরণের সময় রাগান্বিতা কাঁদে নি। সে শক্ত ছিল, রাগ ছিল বলা যায় তাই বুঝি কাঁদতে পারে নি। কিন্তু আজ এতটা ভেঙে গেল রাগান্বিতা নিজেকে সামলাতেই পারছে না। রাগান্বিতা বাড়ির ভিতর ঢুকলো ইমতিয়াজ তখন কবর খননের কাজে বাহিরে। দাদিমার শেষ ইচ্ছে ছিল নাকি, কুহুর বামপাশে তাকে যেন কবর দেয়া হয়। কুহু আপা ছোট্ট কাল থেকে দাদিমার বুকের ডানপাশে শুয়ে থাকতে পছন্দ করতো। মোতালেব তালুকদার সেই ইচ্ছে রাখছেন। কুহুর বামপাশে কবর খনন করছেন দাদিমার জন্য।
রাগান্বিতা ঘরের সদর দরজা পর্যন্ত আসতেই দেখা মিললো মোতালেব তালুকদারের সঙ্গে। তিনি রাগান্বিতাকে দেখেই বললেন,
“রাগান্বিতা শুনো,
রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার দিকে অশ্রুভেজা আঁখি নিয়ে তাকালো। সেই শক্তপক্ত রাগান্বিত মেয়েটার চোখে অশ্রু দেখে ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো রাগান্বিতার বাবার। নিজেকে সামলালেন তিনি। রাগান্বিতা হেঁটে আসলো। মাথা নুইয়ে দাড়ালো। মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় বললেন,
“এত কাঁদছো কেন?”
রাগান্বিতা বাবার দিকে তাকালো তারও চোখ ভেজা। কি আশ্চর্য না। বাবা নিজেও কাঁদতে অথচ আমায় প্রশ্ন করছে এত কাঁদছো কেন! এখন রাগান্বিতা যদি প্রশ্ন করে,তুমি কেন কাঁদছো বাবা?” কিন্তু রাগান্বিতা প্রশ্নটা করলো না। রাগান্বিতার বাবা শক্ত পক্ত গলায় বললেন,
“শোনো রাগান্বিতা আজ কিছু কথা বলি তোমায়। জীবনে কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে বেশি ভাঙতে দিবে না। শক্ত থাকবে ঘরের খুঁটির মতো। মনে রাখবে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমারও থাকবে না আমারও থাকবে না। মৃত্যু চিরন্তন সত্য আজ নয় কাল এটা ঘটবেই। আজ দাদিমা গেছেন, কাল আমিও যাবো। আজ তোমায় একটা আদেশ দিলাম, আমি মারা গেলে তুমি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলবে না। শক্ত রাখবে নিজেকে। জীবনে কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। কখনো ভেঙে পড়বে না, নিজেকে শক্ত রাখবে সবসময়। জীবনের জটিল মুহুর্তগুলোর সময় নিজেকে ওই আকাশের মতো শীতল মনে করবে। চেষ্টা করবে নিজেকে আকাশের মতো স্থির রাখার। দেখো না হাজার ঝড় বৃষ্টি গেলেও আকাশ সবসময় তার জায়গায় স্থির থাকে। তুমিও তেমন থাকবে। তোমার নামটা আমি রাগান্বিতা কেন রেখেছি জানো,
রাগান্বিতা এবার বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,“কেন?”
রাগান্বিতার বাবা সরল কণ্ঠে বলে উঠলেন আবার,
“তুমি ছোট থেকেই শক্তপক্ত ছিলে সহজে কাঁদতে না। ব্যাথা পেলেও কাঁদতে না যে জিনিসটা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তোমার চোখে ছিল আগুন, কেউ অন্যায় করলে তুমি তার দিকে যে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে তা আমি এই রেশবপুরের কোনো নারীর চোখে দেখিনি। তাই আমি তোমার নাম রেখেছিলাম রাগান্বিতা। এই নামের কোনো অর্থ নেই। তোমার নামটা হলো অর্থহীন তবে এর ওজন কিন্তু ভাড়ি। সেই তুমি আজ এভাবে ভেঙে পড়ছো আমি নিতে পারছি না। তুমি আর কাঁদবে না। আর যদি কাঁদতে হয় তাও লোকসমাজে কাঁদবে না। মনে রাখবে, আনন্দ ভাগ করতে হয় সবার সামনে, কিন্তু কাঁদতে হয় আড়ালে। সবাইকে চোখের পানি দেখাতে নেই। বুঝেছো আমি কি বলেছি,
রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে নিল। মাথা উঁচু করে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“বুঝেছি বাবা।”
রাগান্বিতার বাবা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললন। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“তোমায় হাজার বছর বাঁচতে হবে রাগান্বিতা, এভাবে কাঁদলে চলবে না। কাঁদতে হলে একা কাঁদবে, মনে রাখবে মানুষের চোখের পানি অতীব মূল্যবান জিনিস এই জিনিস দেখার সৌভাগ্য সবাইকে দিতে নেই।”
রাগান্বিতা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাবার মুখের দিকে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বাবা কত শক্ত হয়ে কথাগুলো বললো। রাগান্বিতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“আমি তোমায় জড়িয়ে ধরবো বাবা?”
মোতালেব তালুকদার থমকে গেলেন। এত বছরের জীবনে এমন আবদার কোনোদিনও করে নি রাগান্বিতা। নিরুত্তর মোতালেব তালুকদার। রাগান্বিতা আবার বললো,“কি হলো বাবা আমি কি তোমায় জড়িয়ে ধরবো একবার।”
মোতালেব তালুকদার শক্ত গলায় উত্তর দিলেন এবার, “না।”
আহত হলো রাগান্বিতা। কারো ডাক শোনা গেল সেই সময়। মোতালেব তালুকদারকে ডাকছে। মাদরাসায় পড়ুয়া কিছু হাফেজ ছেলেরা এসেছে কোরআন শরীফ পাঠ করার জন্য।
রাগান্বিতা বাবার যাওয়ার পানে শুধু তাকিয়ে রইলো। একটু জড়িয়ে ধরতে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো বাবার। অন্যদিকে মোতালেব তালুকদার ভাবছেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দেন নি এই কারণেই যে, এই মুহূর্তে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দিলে মোতালেব তালুকদার নিজেকে শক্ত রাখতে পারতেন না। এত কড়া কড়া কথা বললেন। অথচ যদি নিজেই রাখতে না পারে সেই কথা। তবে মেয়ে রাখবে কেমন করে। পৃথিবীতে সবসময় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অন্যকে কথা শোনানো উচিত। নিজে যেটা পারবো না সেটা অন্যকে বোঝানো নিতান্তই নিজেকে বড় দেখানোর একটা অযুহাত। যা একটা সময় ভয়ংকর বিপদে ফেলতে পারে। মেয়ে অভিমান করেছে এটা বুঝেছেন মোতালেব তালুকদার। তবুও উপায় নেই, কিছু কিছু জিনিসকে মাঝে মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় সুযোগের।
—-
সন্ধ্যা ৭ঃ০০টা। নিজ কক্ষের জানালা দিয়ে কুহু আপার পাশের কবরখানার দিকে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। নিঃশব্দে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। দুটো প্রাণের মানুষ, কাছের মানুষ কি সুন্দর মাটির নিচে শুয়ে আছে। আর সে জমিনের বুুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। দুনিয়া এত কঠিন কেন, সৃষ্টির কেন শেষ হয়। সৃষ্টিদেরকে আজীবন অমর রাখতে পারলো না আল্লাহ। তাহলে কত সুন্দর হতো। কোনো দুঃখ থাকতো না। রাগান্বিতার কাঁধে কারো স্পর্শ পাওয়া গেল। চেনা সেই স্পর্শ। রাগান্বিতা ঘুরলো না। তবে এই স্পর্শ যে ইমতিয়াজের এটা বুঝতে বাকি নেই রাগান্বিতার। ইমতিয়াজ আওড়ালো,“বউ।”
রাগান্বিতার ঠোঁটে কথা নেই। সে চুপচাপ। ইমতিয়াজ আবার বললো,“আমার সঙ্গে কথা বলবে না বউ।”
রাগান্বিতা না ঘুরেই স্থির কণ্ঠে বললো,“আপনি কাল আমায় মিথ্যে কেন বললেন, যে দাদিমা আমায় ছেড়ে যাবে না।”
ইমতিয়াজ নিরুত্তর! এখন কি বলবে। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“মাঝে মধ্যে কিছু ভালোর জন্য আমাদের মিথ্যে কথা বলতে হয় বউ।”
এবার ঘুরে তাকালো রাগান্বিতা। চোখে পানি নেই তার। তবে লাল হয়ে আছে। রাগান্বিতা বললো,
“কি ভালো হয়েছে?”
“ওই যে তুমি ঢাকার বাড়ি থেকেই মন খারাপ করে আসো নি। পুরো পথটা তো হাসিতে ছিলে। তুমি সারারাস্তায় মন খারাপ করে আসতে আমারও তো কষ্ট হতো। তাই আমি কিছু সময়ের জন্য স্বার্থপর হয়েছি। নিজের দিকটা দেখেছি। নিজেকে কিছুটা সময় ভালো রাখারই চেষ্টা করেছি।”
রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। সে নিরদ্বিধায় জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শক্ত করে ধরলো। ইমতিয়াজ অনুভব করলো সেটা। কিছু বললো না। স্থির। চুপচাপ। নিরিবিলি পরিবেশ। কোনো শব্দ নেই। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি জড়লো তবে তাতেও শব্দ আসলো না। সে বললো,
“আমার কি করার উচিত এখন?”
ইমতিয়াজ নীরব কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু না। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো।”
“আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
“আমি বুঝতে পারছি তাও শান্ত থাকো।”
“আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না।”
“বাবা বারণ করেছেন।”
“আপনি শুনেছিলেন সবটা।”
“হুম। দুয়ারের কর্নারে দাঁড়ানো ছিলাম তখন।”
“বাবা কি কিছু ভুল বলেছেন?”
“একদমই না।”
“কিন্তু আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদি।”
“সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই।”
“আমি মানতে পারছি না।”
“সত্য তো মানতে একটু সময় লাগবে।”
“আমি আপনায় সারারাত জড়িয়ে ধরে থাকবো?”
“তুমি ছাড়তে চাইলেও আমি ছাড়ছি না।”
এমন অনেক কথা বললো না দুজন। রাত অনেক গভীর হলো। কিন্তু তাদের কথা শেষ হলো না। রাগান্বিতা কাঁদলো না। তার চোখের পানি আস্তে আস্তে কমে গেল। কষ্ট পাওয়া বন্ধ হলো। কি আশ্চর্যকর যাদু ছিল জানে না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো হঠাৎ,
“পা ব্যাথা করছে না?”
“তোমার যন্ত্রণার তুলনায় কম।”
“আপনার যন্ত্রনা হচ্ছে না?”
“হচ্ছে তো তোমায় দেখাতে চাচ্ছি না। মানুষ হারানোর শোক আমিও বহুবার পেয়েছি বউ। তুমি তো জানো।”
রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজও আর কিছু বললো না।রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো, তখনই দাদিমার বলা সেই শেষ শব্দ দুটো কানে বাজলো। রাগান্বিতা মিলালো। চি,ডি মানে চিঠি। রাগান্বিতা গভীর এক ভাবনায় ভেবে মনে মনে বললো,“তবে কি দাদিমা আমার জন্য কোনো চিঠি লিখে গেছেন! কি থাকতে পারে সেই চিঠিতে কোনো বিষাদময় বার্তা নয় তো।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪১
________________
সকাল সকালই তালুকদার ভিলাতে হাজির হলো তাদের বাড়ির পুরনো সদস্য রামু। যে এ বাড়িতে কাজ করে। পরিবারের কিছু সমস্যার কারণে এতদিন ছুটিতে ছিল। দাদিমার খবর শুনেই হাজির হলো তালুকদার ভিলাতে। রামু সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম দেখা মিললো ইমতিয়াজের সঙ্গে। সকাল সকাল কোথায় যেন যাচ্ছে ইমতিয়াজ। কথা হলো না কোনো শুধু একপলক রামুকে দেখেই চলে যায় ইমতিয়াজ। রামুও চিনতে না পেরে চলে যায় ভিতরে। রামুর চোখে পানি টলটল করছে দাদিমা অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ ছিলেন তাকে খুব ভালোবাসতো। রামু সোজা চলে যায় মোতালেব তালুকদারের কক্ষে।
নিজ কক্ষের পালঙ্কে চুপচাপ বসে আছে মোতালেব তালুকদার দৃষ্টি তার বাহিরে যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন। কাল সারারাত সে ঘুমায় নি। শক্ত হয়ে বসে ছিলেন চুপচাপ। এভাবে হুট করে কন্যা যাওয়ার ছ’মাসের মাথাতেই মা সমতুল্য মানুষটাও চলে যাবেন ভাবতে পারে নি মোতালেব তালুকদার। চোখের চশমা খুলে চোখের পানিটুকু মুছলেন। এমন সময় তার কক্ষের দুয়ারে কড়া নাড়লো রামু। বললো,
“চাচা আব্বা আমি কি ঘরে আমু?”
বহুদিন পর রামুর কণ্ঠ কানে আসতেই পিছন ঘুরলেন মোতালেব তালুকদার। নিঃস্ব স্বরে বললেন,“আয়!”
রামু ভিতরে ঢুকলো। রামুর ভালো নাম রতন। কিন্তু সবাই ওকে রামু বলে ডাকে। রামু সোজা গিয়ে মোতালেব তালুকদারের পাশে বসলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো,“এগুলান কি হইয়া গেল চাচা আব্বা? কুহু আফাও হঠাৎ কইরা চইলা গেল এখন দাদিমাও এগুলান কেন হইলো চাচা আব্বা?”
বলতে বলতে রামু কেঁদে উঠলো। মোতালেব তালুকদার রামুর মাথায় হাত বুলালেন। বললেন,“কাঁন্দিস না কানলে কি মানুষ গুলা ফিইরা আইবো। তোর মায় কেমন আছে?”
রামু চোখের পানি মুছে বললো,“ভালাই।”
—–
চি’ ডি! রাগান্বিতা চিডি! ঘুমের ঘোরে কাল দাদিমার শেষ বার্তাটুকু কানে বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো রাগান্বিতা। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। আশেপাশে তাকালো কোথাও ইমতিয়াজ নেই। বোধহয় বাহিরে গেছেন। রাগান্বিতা তার উত্তেজিত মনটাকে দমালো। আগে সামলালো নিজেকে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললো কয়েকবার। কিছুক্ষণ বসে থেকে হনহনিয়ে ছুটে গেল বাহিরে। বাহিরে যেতেই দেখা রামুর সঙ্গে। রামু প্রশ্ন করলো, “রাগান্বিতা আফা তুমি কেমন আছো?”
রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
“ভালো তুমি?”
“মিছা কতা কও আফা তুমি ভালো আছো।”
রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল। রামুও কিছু বললো না। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?”
রামুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হ ভালাই আছে। আম্মাও আইতে চাইছিল আমি আনি নাই।
“যাক ভালো করেছো এমনিতেই অসুস্থ মানুষ।”
“হুম আফা।”
“আচ্ছা আমি একটু আসছি।”
“আচ্ছা আফা যাও।”
রাগান্বিতা আর দেরি না করে হেঁটে গেল। রামু চেয়ে রইলো তার পানে। রাগান্বিতা হনহনিয়ে নিচে নেমে এসে সোজা চলে যায় দাদিমার কক্ষের দিকে। দুয়ারের কাছে আসতেই বুকটা থমকে গেল রাগান্বিতার। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো তার কিন্তু রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। বোঝালো শক্ত হতে হবে নিজেকে। রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে কক্ষের দুয়ার খুলে ভিতরে ঢুকলো। পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। তার মনে হচ্ছে দাদিমা বুঝি তার সামনের ওই পালঙ্কে বসে বলছে,“তুমি আইছো রাগান্বিতা এত দেরি করলা কেন আইতে?”
রাগান্বিতার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। মনে মনে বললো,“আমি খুব দেরি করে ফেলেছি দাদিমা। কেন করলাম দেরি। তুমি আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে না আমার জন্য।”
কথাটা মনে মনে বলে তো দিল কিন্তু উত্তর আসলো না। রাগান্বিতা আস্তে আস্তে পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। দাদিমা কি সত্যি তার জন্য চিঠি রেখে গেছে। রাগান্বিতা পুরো কক্ষে খুঁজলো, বিছানার চাদর, দাদিমার আলমারিতে, দাদিমার কাপড়ের ভাজে ভাজে, আলমারির ওপর, আলমারির ওপর থাকা বাক্সপেটরা, ঘরের আনাচে-কানাচেতে সব জায়গায় কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। রাগান্বিতা নিরাশ হয়ে পালঙ্কে বসে পড়লো। তবে কি সে ভুল ভাবলো দাদিমা কোনো চিঠি লিখে যায় নি তার জন্য। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
—–
রেশবপুরে থাকা সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের সামনে বসে আছে ইমতিয়াজ। এই বাড়িটাতেই ইমতিয়াজ সর্বপ্রথম থেকেছিল রেশবপুরে এসে। আকাশটা পরিষ্কার। উঠুনটা নিরিবিলি। ইমতিয়াজের সব কিছু এলেমেলো লাগছে। সবটা কেমন এলেমেলো হয়ে গেল। সে যখন প্রথম এই রেশবপুরে পা রেখেছিল তখন তার মাথায় ছিল কি ভাবনা, এক বিষাক্ত ভাবনা নিয়ে সে এখানে পা রেখেছিল। ভেবেছিল সব ধ্বংস নিজের হাতে করবে। অথচ আজ সে দেখছে ধ্বংসের খেলা খেলতে এসে সে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য মনটা আনচান করছে। কি নিদারুণ এক যন্ত্রণা! ইমতিয়াজের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। রাগান্বিতাকেও সঙ্গে নিবে না। হয় কষ্ট হোক তাও নিবে না। আবার ভাবে এটা করেও তো শান্তিতে থাকতে পারবে না। ইমতিয়াজ নিঃস্ব হয়ে বসে রইলো। একা মনে আওড়ালো,
“তোমার চোখে ঘৃণা দেখার আগে আমার মরণ হোক বউ।”
—-
রাগান্বিতার কিছু একটা মনে পড়লো। একদিন দাদিমা তাকে বলে ছিল,
“জানো রাগান্বিতা এই যে আমার পালঙ্কের তলায় থাকা ট্রাঙ্কটা দেখতে পাইতাছো এইডারে আমি খুব যত্নে রাহি। আমি মরণের পর যখন এই ট্রাঙ্কটা খুলবা দেখবা আমি তোমার আর কুহুর জন্য কতকিছু গুছাইয়া রাখছি।”
রাগান্বিতা যেদিন খুব অবাক হয় মশকরা করে ট্রাঙ্কটা খুলতেও যায় কিন্তু দাদিমা খুলতে দেয় না। এরপর রাগান্বিতা আর কখনো এটা নিয়ে ভাবে নি। এই কথা যেদিন দাদিমা বলেছিল তখন কুহুও ছিল। চট করেই কথাগুলো মাথায় আসতেই রাগান্বিতা পালঙ্কের নিচটা দেখলো দাদিমার ট্রাঙ্কটা তখনও সেখানে। রাগান্বিতা দ্রুত ট্রাঙ্কটা পালঙ্কের নিচ থেকে বের করে পালঙ্কের উপরে রাখলো। ছোট্ট তালাবদ্ধ ছিল সেটা। চাবিটা আলমারিতেই থাকার কথা। রাগান্বিতা আবার আলমারিতে হাত দিল একটু খুঁজতেই চাবিটা পেয়ে গেল। রাগান্বিতার কেন যেন হাত কাঁপছে তার মনে হচ্ছে দাদিমা এই ট্রাঙ্কেই তার জন্য চিঠি রেখে গেছে। রাগান্বিতা ট্রাঙ্কটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসলো তার আর কুহুর কিছু ছোট বেলার স্মৃতি। তাদের কিছু ছোট ছোট জিনিসপত্র ছোট বেলার জামা, খেলনা, একটা আঁকার খাতা সব গুছিয়ে রেখেছে দাদিমা। আঁকার খাতাটা কুহুর। কুহু ছোট বেলা থেকেই আঁকাআকি খুব পছন্দ করতো। রাগান্বিতার এসব দেখে আবার চোখ ভিজে আসলো। দাদিমা তাদের কত ভালোবাসতো। দাদিমার যখন পনের বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয় বিয়ের তিনবছরের মাথাতেই তার স্বামী মারা যান কোনো সন্তান ছিল না। তারপর থেকেই দাদিমা এখানে থাকেন। বিয়ে দেওয়ার কথা বললেও তিনি আর বিয়ে করেন নি। রাগান্বিতা, কুহু আর রেজওয়ানকে নিয়ে ভালো ছিলেন। জীবন কাটিয়ে দিলেন এমন ভাবেই। পরে অবশ্যও একদিন জানা গিয়েছিল, দাদিমা তার স্বামীর অসুস্থের সময় কথা দিয়েছিলেন তাকে ব্যতীত আর কোনো পুরুষকে তিনি স্বামী হিসেবে মানবেন না। সেই কথা রাখতেই এতকাল দাদিমা একা ছিলেন।
সব জিনিসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই পরিশেষে একটা চিঠি পেল রাগান্বিতা। দ্রুত চিঠিটা বের করলো। পড়তে লাগলো। যেখানে শুরুতেই লেখা ছিল,
আমার রাগান্বিতা দাদিমা। এই চিডিহান আমি শুধু তুমার জন্য লেখছি। তুমারে অনেক কিছু জানানোর ইচ্ছে হইলো আমার। তুমার লগে আর দেখা হইবো কি না জানি না। তুমার আব্বায় আমারে যতই মানা করুক আমার মনে হয় তুমার কুহুর ব্যাপারে হগল কথা জানা উচিত। তুমি হেদিন আমারে জিগাইছিলা আমি হাপলা দেইখা কেন ডরাইছি। কারণ তুমি যেমন ভাবে হাপলা দিয়া হেইদিন হাজজিলা ঠিক হেমনভাবেই একদিন কুহুও হাজজিল। আমি ভয় পাইছিলাম। কেন পাইছিলাম আমি নিজেও জানি না। তাও খুব ভয় পাইছিলাম। মনে হইলো কুহুর নাহান তুমার ওপরও বুঝি কারো কালো ছায়া পড়ছে। হেরপর একদিন তুমি চিডি পাও হেইয়া নিয়া গ্রামের হগল মানুষরে ডাকলা ওইদিন মোতালেবও খুব ভয় পাইছিল কারণ এই রহম চিডি কুহুও পাইছিল। কেউ ওর নামে চিডি পাডাইতো। এই চিডির কথা কুহুই লেখছিল। ওর ঘরে আমি চিঠি পাই হেইহানে এডি লেখা ছিল। কুহু দুইহান চিডি লেখছিল যার একখান তুমি পড়ছিলা আর একখান আমার ট্রাঙ্কে আছে। আরো একটা পৃষ্ঠায় কিছু লেহা আছে। একখান শুকনা কাটাওয়ালা গোলাপফুলও আছে। ফুলডা মনে হয় কুহুরে যে পোলাই পেমের ফান্দে ফালাইছিল হেয় দিছিল। তুমিও চিডি পাও কুহুও পাইছে এইয়া দেইখা মোতালেব ভয়ে তোমার বিয়া ঠিক করে। ওয় ভাবে ওর কোনো শত্রু মনে হয় এমন করছে। কিন্তু কেডা করছে ধরতে পারে নাই। তুমি যহন এই চিডিডা পড়বা আমিও মনে হয় তহন থাকমু না। আমি খুব অসুস্থ। মনে হয় বেশিদিন বাঁচমু না। তুমি ভালো থাইকো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজরে নিয়া সবসময় ভালো থাইকো। আমারে ভুইলা যাইও না। আমি কিন্তু তুমারে খুব ভালোবাসি দাদিমা। ভালো থাইকো কেমন!
ইতি,
তোমার দাদিমা।”
চোখ ভেসে উঠলো রাগান্বিতার। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কখনো ভুলমু না দাদিমা তোমারে কি ভোলা যায় কও।”
রাগান্বিতা ট্রাঙ্কের ভিতর একটা চিঠি, একটা চিরকুট আর একটা কাঁটাওয়ালা শুঁকনো গোলাপফুল পেল। ফুলটা ধরতে গিয়েই কাঁটার আঘাত পেল রাগান্বিতা। মনে পড়লো সেই বিয়ের দিন ইমতিয়াজও তাকে দেওয়া একটা কাটাওয়ালা গোলাপের আঘাতের দৃশ্যের কথা। কিন্তু বেশি গুরুত্ব দিলো না। কুহুর চিঠিটা পড়লো। সে কাউকে লিখেছিল,
প্রিয় আরফান,
আপনার দেয়া শাপলাফুলগুলো খুবই সুন্দর হয়েছে। শাপলার অলংকার দিয়ে আমি সেজেছিলাম। দাদিমা দেখে কি প্রশংসা করলো কিন্তু আপনি দেখতে পেলেন না। শুনুন হুটহাট এমন চিঠি দিবেন না কেউ দেখে ফেললে তখন। আপনার সাথে দেখা করতে আমি শীঘ্রই শহরে যাবো। কেমন। ততদিন ভালো থাকবেন।
ইতি
আপনার কুহেলিকা।
রাগান্বিতা এবার সেই চিরকুটটা হাতে নিলো আরফানের দেয়া বোধহয়। চিরকুটটা খুলতেই সেখানে লেখা দেখলো,
“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো রাগান্বিতা এই চিঠি তো সেও পেয়েছিল প্রথম চিঠি ছিল। কথাটা এক থাকলেও হাতের লেখা ভিন্ন।
রাগান্বিতা আরো চারপাঁচবার কথাটা পড়লো। কেন পড়লো নিজেও জানে না তবে তার মনে হচ্ছে এই হাতের লেখা সে চেনে। এই হাতের লেখা সে আরো চারপাঁচবার বা তারও বেশি দেখেছে খুব কাছ থেকে দেখেছে, আচমকাই বুকটা কামড়ে উঠলো রাগান্বিতার। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
“ইম..তিয়াজ!”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️