প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩৮+৩৯

0
571

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৮
________________
নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে সবেমাত্র ঢাকার বাড়িতে পা রাখলো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। সদর দুয়ারের সামনেই দাড়ানো ছিল রবিন আর ওর বউ। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে হেঁটে আসলো তাদের সামনে। সদর দুয়ারের কাছে এসেই বলো ইমতিয়াজ,
“কেমন আছো চাচা?”
“ভালা। তুমি?”
“ভালোই। চাচিও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে যে কেমন আছেন চাচি?”

চাচি মিষ্টি হাসলেন। ইমতিয়াজের গালে আলতো স্পর্শ করে বললো,“ভালাই আছি। তুমরা কেমন আছো?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে জবাব দিলো,“ আমরাও ভালো।”
এরপর রাগান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ,“ইনি রবিন চাচার বউ রাগান্বিতা।”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। নিকাবের আড়ালে মিষ্টি গলায় বললো,“আসসালামু আলাইকুম চাচি ভালো আছেন?”

চাচি মৃদুস্বরে বললেন,“হ ভালোই আহো ঘরে আহো।”

রাগান্বিতাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল চাচি। আর ইমতিয়াজ রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ব্যবসার অবস্থা কেমন চাচা?”
“ভালাই। তুমি কি এহন যাইবা দ্যাখতে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“দেখি।”

ভিতরে ঢুকলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা তখন সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে যাচ্ছিল। তখনই পিছন থেকে ইমতিয়াজ বলে উঠল,
“বউ শুনো,

রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। দ্রুত কয়েককদম নিচে নেমে এসে বললো,“জি বলুন।”

ইমতিয়াজও এগিয়ে আসলো খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,“আমার একটা কাজ আছে কাজটা সেরেই আমি আসছি। তুমি চিম্তা করো না আমার আসতে একটু দেরি হবে।”

রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কোথায় যাবেন? মাত্রই তো এলেন এখনই যাবেন। কাজটা কি খুব জরুরি?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বললো,“হুম।”
রাগান্বিতা আর বারণ করলো না। বললো,“ঠিক আছে সাবধানে যাবেন কাজ সেরে দ্রুত চলে আসবেন কেমন।”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,“ঠিক আছে।”
ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো তারপর চট করেই রাগান্বিতার কপালে চুমু কেটে বললো,“ভালোবাসি বউ, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”

কথাটা বলেই ঝড়ের গতিতে চলে গেল ইমতিয়াজ। আর রাগান্বিতা লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। পরক্ষণেই মৃদু হেসে অগ্রসর হলো নিজ কক্ষে যাওয়ার জন্য।

সময় গড়ালো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। তাও ইমতিয়াজের খবর নেই। যদিও ইমতিয়াজ বলেছিল তার ফিরতে দেরি হবে তবুও বিকেল গড়িয়ে কত সময় চলে যাচ্ছে। মানুষটা রাস্তায় কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। সেই সকালবেলা চা নাস্তা করেছিল মাত্র এরপর আর কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। রাগান্বিতার খুব চিন্তা হচ্ছে। রাগান্বিতা বার বার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। চাচি বিষয়টা লক্ষ্য করলেন মুচকি হেসে বললেন,“চিন্তা কইরো না ইমতিয়াজ আইয়া পড়বো নে।”

বিনিময়ে রাগান্বিতা আমতা আমতা করে বললো,
“চিন্তা করছি না চাচি।”

চাচি মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“এগুলান চেহারা দেখলে বোঝন যায়।”

বলেই নিজের শয়নকক্ষে চলে গেল চাচি। তার বাচ্চাটা কাঁদছে, বোধহয় ঘুম থেকে উঠে গেছে। রাগান্বিতা খানিকটা লজ্জা পেল চাচির কথা শুনে।
——
গ্রামের নাম আনন্দপুর। ঢাকা থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। সেই গ্রামেরই সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়িটির নাম সিকদার মঞ্জিল। এককালে বিপুল প্রাচুর্যে ঘেরা ছিল এই বাড়ি। অথচ আজ সেই বাড়ি পরিত্যাক্ত কেউ ভুলেও এই বাড়ির ত্রিসীমায় আসে না। বাচ্চাদের ছোট থেকেই এখানে আসতে নিষেধ করেন তাদের বাবা মা। তাদের ধারণা এ বাড়িতে ভূত প্রেত আছে। বহুবছর আগে এ বাড়ির জমিদার মতিন সিকদার আর তার দ্বিতীয় বউ যমুনা বেগম খুন হন। সেই থেকেই এ বাড়ি পরিত্যাক্ত! বাড়িতে যত মানুষ ছিল তারাও সেই মৃত্যুর পর আতঙ্কে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকেই অযত্ন আর অবহেলার কারণে বনজঙ্গলে ভরে ভুতুড়ে ভুতুড়ে হয়ে গেছে চারপাশ।

জং ধরা গেটের শিঁকল খুলে সিকদার মঞ্জিলে পা রাখলো ইমতিয়াজ। ক্যাচ ক্যাচ করে আওয়াজ হলো কেমন। দু’একজন দূর থেকে দেখলো। ইমতিয়াজ বেশি না ভেবেই তার চটি(জুতা) খুলে আস্তে করে চলে গেল ভিতরে। বাড়ির ডানদিকে একটা সরু রাস্তা আছে ইমতিয়াজ সেই পথ ধরেই হেঁটে গেল। হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিললো একটা সুন্দর পরিপাটি বেড়া দেয়া কবরস্থান। এই বাড়ির বাকি সব স্থান অগোছালো থাকলেও এই জায়গাটা পরিষ্কার। ইমতিয়াজ বেড়ার একপাশ খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। তারপর বসলো সোজা মৃত ব্যক্তিটির পায়ের কাছ দিয়ে। আলতো করে পায়ের দিকের ওপরের মাটি স্পর্শ করে বললো,
“আম্মা, আমার প্রাণের আম্মা। আমি এসেছি আম্মা। তোমার ছেলে ইমতিয়াজ এসেছে, তুমি কি আমার লগে কথা কইবা না আম্মা। এইবার আমি আইতে খুব দেরি করছি তুমি খুব রাগ করছো তাই না। জানো আম্মা তোমারে দেহার জন্য আমার মনডা ছটফট করে। এমনে কেন চইল্যা গেলা আম্মা। আইজ তুমি বাইচ্যা থাকলে আমার জীবনডা এমন বিষণ্ণমাখা হইতো তুমি কও। আমি প্রতিহিংসায় জ্বলছি আম্মা।”

এমন নানা কিছু বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। চারপাশে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। পুরো নিরিবিলি পরিবেশ। ইমতিয়াজের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে এতক্ষণে ভয়েই কেঁপে যেত। অথচ ইমতিয়াজ একদম স্বাভাবিক। যেন মনে হচ্ছে মায়ের পাশে বসে সে গল্প করছে। আর তার মা আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নীরবে সেই গল্প শুনছে। অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না এ ভয়ার্ত পরিবেশে একাই বক বক করছে ইমতিয়াজ। কতকিছুই যে বলছে সে ছাড়া আর কেউই শুনছে না।

অনেক সময় পার হলো। বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামার সময় আসলো। ইমতিয়াজ তখনও বসা তার আম্মার কবরের পাশে। কারো আওয়াজ শোনা গেল। এক বৃদ্ধলোক বললো,
“তুমি কেডা এই সন্ধ্যাহালে এহানে কি করো?”

ইমতিয়াজের হুস ফিরলো। সে ঘুরে তাকালো। সামনে দেখলো কিছু মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা লোক বললো,
“এই জায়গাডা ভালা না। তুমি এহিনে ঢুকছো হেই কহন, আর আহোনা দ্যাইখা আমরা সবাই মিল্লা খুঁজতে আইছি। তুমি কেডা কও তো তোমারে এর আগেও দেখছি এহানে আইয়া কান্দো। কি হইছে তুমার?”

মাগরিবের আজানের শব্দ শোনা গেল। সবাই কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে বললো,
“আর বইয়া থাইকো না লও আমগো লগে।”

ইমতিয়াজ শুনলো আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বেড়াভেদ করে বাহিরে এসে আবার বেড়া আঁটকে দিলো। মৃদু আওয়াজে বললো,“আমি তাইলে যাই আম্মা। আবার সময় করে দেখতে আসবো কেমন। এবার আর দেরি হবে না।”

বলেই চলে আসলো ইমতিয়াজ। লোকগুলাও সঙ্গে সঙ্গে বের হইলো তার। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো ইমতিয়াজকে,“তুমি কেডা কও তো এই বাড়ির কেউ লাগো।”

ইমতিয়াজ বাড়ির বাহিরেই সেই জং ধরা শিকলটা পুনরায় আটকে গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,“আমি ইমতিয়াজ সিকদার।”

কথাটা বলেই চটি পড়ে চলে যায় ইমতিয়াজ। বাকিরা নিজেদের মধ্যে বলতে থাকে, ইমতিয়াজ সিকদার আবার কেডা?”

তখনই সেই বৃদ্ধ লোকটি বলে,“ইমতিয়াজ সিকদার হইলো মতিন সিকদারের প্রথম বউয়ের পোলা। যে কবরডার পাশে বইসা পোলাডা কানছিল ওইডা এই পোলার আম্মার কবর।”

সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে সবাই ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। বলে,“এই সেই ইমতিয়াজ সিকদার যে কি না হেই ছোডোহালে বাপের অত্যাচারে ঘরদুয়ার ছাইড়া চইল্লা গেছিল।”

বৃদ্ধ লোকটি বললো,“হয়। একখান কতা কি জানো এই ইমতিয়াজ জায়োনের তিনদিন পরই খুন হয় মতিন সিকদার আর হের দুই নাম্বার বউ যমুনা বেগম।”

একলোক বললো,“হুনছিলাম মতিন মিয়ার নাকি একখান মাইয়াও আছিল হেয় গেল কই?”

বৃদ্ধ লোকটি হাঁটতে হাঁটতে বললো,“হের কতা জানি না খুনের হওয়ার পর তোন আর খবর পাওন যায় নাই। মাইয়াডা ছোডো আছিল ইস্কুলে পড়তো কি হইছিল হেইদিন রাইতে কে জানে। ইমতিয়াজের থ্যাইক্কা দুই বছরের ছোডো আছিল। গ্রামের হগোলে কইছিল যে বা যারা খুন করছিল হেই মনে হয় মাইডারেও খুন টুন কইরা নদীর পানিতে হালাই থুইছে নইলে নিজের লগে লইয়া গেছিল। জানি না মাইয়াডার কি হইছিল।
—-
মধ্যরাত! নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের অপেক্ষা করছে সে। সেই কখন বেরিয়েছে এখনো খবর নেই। কখন আসবে ইমতিয়াজ! দুয়ার খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রাগান্বিতা তৎক্ষনাৎ দুয়ারের পানে তাকালো। দেখলো খানিকটা এলেমেলো চুল আর ক্লান্তিকর চেহারা নিয়ে হাজির হলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“অবশেষে আপনি এলেন।”

ইমতিয়াজ ভিতরে ঢুকলো ক্লান্ত মুখখানা নিয়ে বসলো পালঙ্কে। রাগান্বিতা দ্রুত ইমতিয়াজের জন্য পানি এনে দিলো। বললো,“পানি খান।”

ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে পানিটা নিল। ঢক ঢক করে পুরো পানিটা গিলে বললো, আমরা কাল রেশবপুরে যাবো বউ।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৯
________________
“রাগান্বিতা হুনো জীবনে হগল মানুরে বিশ্বাস করবা না। সব মানুষ কিন্তু ভালা হয় না।”

প্রচন্ড কঠিন গলায় কথাটা বললো দাদিমা। দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা বিস্মিত গলায় বললো,“কেন দাদিমা কি হইছে?”

দাদিমা ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো,
“তুমি কোনো কথা কইবা না তুমার লগে আমার আড়ি। তুমারে এতবার কইলাম বাড়িত আও তাও আও না আমার লগে আর কোনো কথা কইবা না।”
“দাদিমা শুনো,

রাগান্বিতা বহুবার ডাকলো কিন্তু দাদিমা ফিরে তাকালেন না। হনহনিয়ে চলে গেলেন কোথায়। রাগান্বিতা হেঁটে গেলো সামনে কিন্তু কালো ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখলো না। রাগান্বিতা চেঁচিয়ে ডাকলো, “দাদিমা, দাদিমা কোথায় তুমি!” কিন্তু না দাদিমার আর খোঁজ নেই কণ্ঠ শোনা গেল না তার।

ঘুমের মধ্যে আচমকাই হকচকিয়ে উঠে বসলো রাগান্বিতা। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো সে ইমতিয়াজের পাশে নিজ কক্ষে বসে আছে। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। ইমতিয়াজের ঘুমটা ভেঙে গেল রাগান্বিতাকে হতভম্ব দেখে প্রশ্ন করলো,“কি হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়ালো। আতঙ্ক নিয়ে বসে রইলো। দাদিমা তাকে ছেড়ে গেল কোথায়! রাগান্বিতার মাঝে অজানা এক ভয় অনুভব হলো। সে ইমতিয়াজকে বললো,“আমার দাদিমা কোথায় যেন চলে গেছেন আমায় ছেড়ে?”

ইমতিয়াজ বিস্মিত হলো সে দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে রাগান্বিতার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে খাইয়ে দিল রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতাও ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেল। ভয়ে ভয়ে বললো,
“আমার দাদিমা আমায় ছেড়ে কোথাও চলে যাবেন না তো?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে বসলো। আশ্বাস দিতে বললো,
“ভয় পেও না কোথাও যাবে না তোমার দাদিমা।”

রাগান্বিতা তাও শান্ত হতে পারলো না। তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“আমরা কখন যাবো?”
“এই তো ভোরের আলো ফুটলেই।”

রাগান্বিতা থরথর করে কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিষয়টা বুঝতে পেরে রাগান্বিতাকে কাছে আনলো মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,
“এত ভয় পেও না কিছু হয় নি। তুমি শুধু একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছো আর কিছু না।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে আসলো। এই স্বপ্নের ইঙ্গিত তো ভালো নয়। রাগান্বিতা মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন আমার দাদিমা কোথাও যাবে না তো আমায় ছেড়ে।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার মাথায় হাত বুলাতে বললো,
“না কোথাও যাবে না।”

কথাটা বলে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে ভাবলো “কোথাও যাবে না” কথাটা বলে তো দিল। কিন্তু রাগান্বিতার বাবার চিঠি তো অন্য কথা বলছে। ইমতিয়াজ আনন্দপুর থেকে ফিরতেই একটা চিঠি পায় যেটা ছিল রাগান্বিতার বাবার। দাদিমার অবস্থা ভালো নয়, এ কথাও স্পষ্ট লেখা ছিল চিঠিতে তাই তো ইমতিয়াজ রেশবপুরে যাওয়ার কথা বলে। রাগান্বিতাকে আপাতত কিছু জানাতে চাচ্ছে না ইমতিয়াজ। সোজা বাড়ি গিয়েই না হয় দেখুক।

ধীরে ধীরে রাগান্বিতা শান্ত হলো। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইমতিয়াজও রাগান্বিতকে নিয়েই শুয়ে পড়লো। মাথায় বিলি কাটতে লাগলো আপনমনে। আকাশের চাঁদটা তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে। ইমতিয়াজ তাকিয়ে রইলো সেই চাঁদটার পানে। খানিকটা মেঘ জমেছে তার চারপাশে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। ইমতিয়াজ হঠাৎই বিড়বিড় করে বললো,
“মেঘ বলেছে বৃষ্টি হবে
আকাশটা তাই অন্ধকার;
মনের মাঝে ঝড় উঠেছে
তাকে হারানোর আশঙ্কার।”
—–
সকালের ট্রেনে চড়েই রেশবপুরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাস্তায় সে কি কথা রাগান্বিতার। বাড়ি গিয়ে দাদিমাকে চমকে দিবে, জড়িয়ে ধরে এটা বলবে সেটা করবে,প্রেম নগরের ওই জায়গাটার বর্ণনা করবে, টিয়াপাখির সেই মিষ্টি ডাকটার কথা তো সবার আগে বলবে। এমন নানা কিছু বলছে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু শুনে যাচ্ছে উত্তরে শুধু হুম, হা, ঠিক আছে এসব বলছে। মেয়েটার উত্তেজনা দেখে ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে, সে কি ভুল করলো আবার কিন্তু বললেও তো ঠিক হতো না। সারারাস্তায় মেয়েটা গুমরে থাকতো তা দেখে ইমতিয়াজের আরো হৃদয় পুড়তো। ইমতিয়াজের কেন যেন মনে হচ্ছে সে একের পর এক ভুল করছে। অথচ সঠিক কি তাও বুঝচ্ছে না। কি এক বিচ্ছিরি ব্যাপার।

আগেরবারের তুলনায় এবার বুঝি বেশ দেরি হচ্ছে রেশবপুর যেতে রাগান্বিতা খুব উত্তেজিত হয়ে বলছে,“এখনো আমরা যাচ্ছি না কেন?”

ইমতিয়াজ আলতো হাতে রাগান্বিতাকে ক্যাভিনের পালঙ্কে বসালো। নীরব স্বরে বলল, “এত উত্তেজিত হয়ো না।”

রাগান্বিতা চুপটি করে বসে রইলো। বোধহয় সত্যি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে।’

সময় চললো কয়েক ঘন্টা পেরোতেই রাগান্বিতারা ট্রেন পেরিয়ে নৌকায় এসে পৌঁছালো রেশবপুরের ঘাটের কাছে। রাগান্বিতা দ্রুত দ্রুত নৌকায় ছেড়ে নামলো সে পারুক দৌড়ে ছুটে যাক বাড়ি। কিন্তু পারছে না। ইমতিয়াজ আসলো রাগান্বিতার পাশে দাঁড়ালো কিন্তু আশেপাশে কোনো গরু বা মহিষের গাড়ি দেখছে না এবার তারা যাবে কিভাবে। মিনিট দশ যেতেই একটা ছোট্ট গরুর গাড়ির দেখা মিললো রাগান্বিতা দ্রুত ছুটে গিয়ে বসলো সেই গাড়িতে তাড়া দিয়ে বললো,“দাদুভাই, তাড়াতাড়ি তালুকদার ভিলায় নিয়ে চলুন।”

গাড়িচালক রাজি হলো। ইমতিয়াজ উঠে বসলো। মেয়েটার এত উত্তেজনা একটুপরই কমে যাবে কথাটা ভাবলেই ইমতিয়াজের খারাপ লাগছে। দেখতে দেখতে দেড়ঘন্টার মাথায় এসে গরুরগাড়ি পৌঁছালো তালুকদার ভিলার সামনে। রাগান্বিতা আগেই গরুর গাড়ি থেকে নামলো বাড়ির ভিতরটায় তাকাতেই কেমন যেন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগলো। বুকটা আচমকাই কেঁপে উঠলো। সে ইমতিয়াজকে রেখেই ছুটে গেল বাড়ির ভিতরে। উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলো,“দাদিমা, দাদিমা, আমি এসেছি দাদিমা।”

বাড়ির ভিতর ঢুকতেই বুকটা থমকে গেল রাগান্বিতার। কারণ বাড়ির মধ্যে অনেক মানুষের মুখ। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে গেল, আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো। আতঙ্কের স্বরে বললো,“কি হয়েছে, তোমরা সবাই এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

ততক্ষণে ইমতিয়াজও সদর দুয়ারে পা রাখলো। একটু দূরেই চিন্তিত মুখে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা। ইমতিয়াজ সেদিকে গেল। ভিতর কক্ষেই মহিলাদের ভীড়। রাগান্বিতা সেই কক্ষেই গেছে মাত্র। ইমতিয়াজ মোতালেব তালুকদারের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব।”
মোতালেব তালুকদার ঘুরে তাকালেন মিনমিনিয়ে বললে,
“ওলাইকুম আসসালাম। ভালো আছো বাবা?”
“জি ভালো। দাদিমা কেমন আছেন?”

উত্তরে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। দৃষ্টি দেখেই বোঝা গেছে দাদিমা ঠিক নেই।

উপস্থিত সবার দিকেই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা। এরই মাঝে আতিব দৌড়ে এসে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
“আফা তুমি আইছো আফা দেহো দাদিমা কতা কয় না খালি হগলডির দিকে তাকাইয়া থাহে।”

আতিবের কথা শুনে বুঝি এক নিমিষেই রাগান্বিতার সব উত্তেজনা বন্ধ হয়ে গেছে। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। তড়িৎ গতিতে তার হৃপিন্ডটা বুঝি কেঁপে উঠলো। সবাই সামনে থেকে সরে গেল পালঙ্কের পাশেই নিচে শুয়ে আছে দাদিমা। রাগান্বিতা দৌড়ে গেল। থরথর কণ্ঠে বললো, “তুমি এভাবে শুয়ে আছো কেন দাদিমা কি হয়েছে তোমার?”

দাদিমা কিছু বলতে পারলেন না শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন রাগান্বিতার মুখের দিকে তার ঠোঁট কাঁপছে কিছু একটা বলতে চাইছেন তিনি কিন্তু বলতে পারছেন না। রাগান্বিতার কথার মাঝে ওর এক সহপাঠি মিলি এসে বললো,“কয়দিন আগে দাদিমা নাইতে গিয়া পানিতে পইড়া গেছিল হেরপর থেইকাই অসুস্থ। আইজগো বেশি খারাপ।”

রাগান্বিতা কিছু বললো না শুধু শুনেই গেল। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার উপর রাগ করছো দাদিমা আমার সাথে কথা কইবা না।”

দাদিমা চেষ্টা করছেন সে কিছু বলতে চাইছেন দুই তিনটা শব্দ বের হচ্ছে মুখ থেকে কিন্তু সেই শব্দগুলো এত অল্প স্বরে বলছে যে রাগান্বিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। রাগান্বিতা তার কানটা দাদিমার নিকট নিলো। দুটো শব্দ শুনতে পেল শুধু,“চি ডি”

রাগান্বিতা আসার তিনঘন্টা পরই দাদিমা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার অসমাপ্ত কথাটা শেষ করার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। কান্নার রোল পড়লো পুরো তালুকদার ভিলায়। আজরাইল বুঝি অনেক আগে থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল দাদিমার পুরো কক্ষে শুধুমাত্র রাগান্বিতা আসার শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করার জন্যই বুঝি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। সবার কান্নার শব্দ পেতেই ছুটে আসলেন মোতালেব তালুকদার আর ইমতিয়াজ শোনা গেল ”দাদিমা আর নেই”। ভেঙে পড়লেন মোতালেব তালুকদার ইমতিয়াজ তাকে ধরলো। মা সমতুল্য মানুষটা আর নেই। ভাবতেই বুকে ছিঁড়ে যাচ্ছে মোতালেব তালুকদারের। শেষমেশ দাদিমা সত্যি সত্যি তাকে কিছু না বলে চলে গেল। রেজওয়ান ছুটে আসলো। চারপাশ কেমন ধোঁয়াশায় পরিণত হলো। রাগান্বিতা স্তব্ধ তার কান্নার শব্দ আসছে না। আচমকাই দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে উঠলো। পুরো তালুকদার ভিলা বুঝি কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার সেই কান্নার শব্দে। ইমতিয়াজের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। ধারালো ছুরির আঘাত লাগলো বুঝি বুকে। কি মর্মান্তিক সেই যন্ত্রণা!’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে