Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"প্রিয় রাগান্বিতাপ্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৮+২৯

প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৮+২৯

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৮
________________
ভোরের আলো সদ্য ফুটছে ধরণী জুড়ে। কিচিরমিচির পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শীতল বাতাস ছুটছে অন্দরমহল ঘিরে। তালুকদার ভিলাটা বিশাল বড়। পুরো রেশবপুরে এই একটাই বিশাল বাড়ি আছে যার নাম তালুকদার ভিলা। এটা একটা পুরনো বাড়ি রাগান্বিতার বাবার দাদারও আগের আমলের বাড়ি। বছর শেষে রঙ দেয়া আর জিনিসপত্রের মেরামত করা হয় শুরু।’

রাগান্বিতা দাড়িয়ে আছে কুহুর কক্ষের সামনে। কেমন যেন বুক কাঁপছে। অস্থির অস্থির লাগছে। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো রাগান্বিতা। কুহু মারা যাওয়ার পর রাগান্বিতা ভুলেও একঘরে পা রাখে নি। তার আপার ওপর ভীষণ রাগ ছিল,ক্ষোভ ছিল, আজও আছে। আপা তার কাছে অনেককিছু লুকিয়ে চলে গেছে এটা কি আপার অন্যায় ছিল না। এভাবে বিষ খেয়ে মরে গেলেই কি জীবনের সব যান্ত্রিকতা শেষ হয়ে যায়। মরে গিয়ে আপা কি খুব ভালো আছে। রাগান্বিতা আস্তে করে কুহুর কক্ষের দুয়ারের কপাট খুললো। ভিতরে ঢুকতেই আপার গায়ের গন্ধ যেন নাকে ভাসলো। রাগান্বিতার বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠলো। কান্না আসতে চাইলো ভিতর দিয়ে। রাগান্বিতার তার আপাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতো। অথচ তার আপাই তাকে কিছু না বলে এভাবে পালিয়ে গেল। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো পালঙ্কের দিকে চাইলো। তার মনে হচ্ছে তার আপা পালঙ্কেই শুয়ে আছে আর সে ডাকতে এসেছে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে নিলো। ভাবলো এমনই এক সকালের কথা। রাগান্বিতা সেদিন প্রথম চা বানিয়েছিল বাড়ির সবার জন্য। কি আনন্দকর মুহুর্ত ছিল সেই দিনটা।সেই সকালটা।”

চায়ের কাপ হাতে কুহুর কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি। কুহু কেবলই বই পড়ে শুয়ে ছিল পালঙ্কে। সেই মুহুর্তেই রাগান্বিতা ছুট্টে গিয়ে বললো,
“আপা, এই আপা উঠো জলদি দেখো আমি চা বানিয়ে এনেছি।”

কুহুর ঘুমে বে’ঘাত ঘটলো খানিকটা। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললো,
“এখন খাবো না তুই পরে নিয়ে আসিস।”

রাগান্বিতা তাও গেল না অনেক সাধার পরও কুহুকে উঠতে না দেখে রাগান্বিতা চলে যায় কুহুর আয়নার দিকে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললো,
“আপা তোর আলমারি থেকে আমি একটা ডাইরি নিলাম পড়ে আবার দিয়ে যাবো।”

সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠলো কুহু। কুহু আলমারিতেই তার বেশিরভাগ ব্যাক্তিগত ডাইরি লুকিয়ে রাখতো। কি যে লিখতো কে জেনে। রাগান্বিতা সেদিন একটা ডাইরি নিয়ে পুরো অন্দরমহল ছুটেছে আর তার পিছন পিছন কুহু। ডাইরির কিছু দেখি নি রাগান্বিতা শুধুমাত্র আপাকে ক্ষেপাতে ছুটেছিল। কি সুন্দর মুহুর্ত ছিল হাসি আর উল্লাসে ভরা। অথচ আজ সব ফাঁকা।’

রাগান্বিতা তার চোখ খুললো। কান্না ভেজা গলায় বললো,“এভাবে ছেড়ে না গেলে কি একদমই চলতো না আপা।”

রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে সোজা চলে যায় আলমারির কাছে। নিশ্বাস কেমন ভাড়ি হয়ে আসছে তার। রাগান্বিতা আলমারি খুললো সঙ্গে সঙ্গে আপার গায়ে জড়ানো কিছু শাড়ি নজরে পড়লো। রাগান্বিতা হাত বুলালো শাড়িতে। একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে মুখ চেপে কাঁদলো। এত যন্ত্রণা নাহি সহে। রাগান্বিতা শাড়িতে চুমু কাটলো। নীরবে বললো,“তুই খুব খারাপ আপা। এভাবে চলে গিয়ে একদম ঠিক করিস নি। দাদিমা যা বলেছে তা যদি সত্যি হয় আমি তবে তাকে ছাড়বো না আপা, খুঁজে বের করে নিজ হাতে খুন করবো দেখে নিস। আমার পবিত্র আপাটাকে যে কলঙ্কিত করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না কিছুতেই না।”

রাগান্বিতা শাড়ি ছেড়ে পুরো আলমারি দেখলো। অদ্ভুত ব্যাপার আপার লেখা একটা ডাইরিও এখানে নেই। সব গেল কই। দাদিমা সরিয়ে দেয় নি তো। রাগান্বিতার নিজেকে অসহায় লাগলো। রাগান্বিতা নিচে বসে পড়লো। সবকিছু কেমন শূন্যতায় আঁকড়ে ধরলো। রাগান্বিতা নির্বিকার, নির্লিপ্ত। তার মনে হচ্ছে আপার সাথে রাগ দেখিয়ে সে এ কক্ষে এতদিন না এসে ভুল করেছে। হঠাৎই আলমারির একদম নিচের তাকে থাকা একটা শাড়ির দিকে নজর গেল রাগান্বিতার। শাড়িটা খয়েরি রঙের। এই শাড়িটা রাগান্বিতা কুহুর দুজনের পছন্দের ছিল কিন্তু বাবা এনেছিল একটা। একবার ঝগড়াও হয়েছিল এর জন্য কিন্তু পরে রাগান্বিতায় দিয়ে দেয় শাড়িটা। রাগান্বিতা শাড়িটা বের করতেই একটা চিঠি খোসে পড়লো নিচে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে চিঠিটা ওঠালো সাদা খামের মাঝে লেখা চিঠিটা। রাগান্বিতা তার চোখের পানি মুছে চিঠিটা খুললো। পড়তে লাগলো যেখানে প্রথমেই লেখা ছিল,
“প্রিয় বোন!
তুই যখন আমার এই লেখাটা পড়বি তখন বোধহয় আমি আর এই দুনিয়াতে থাকবো না। আমি জানি তুই ভীষণ রাগ করবি আমার ওপর, হয়তো কবরটাও দেখতে যাবি না। কিন্তু কি করবো বোন আমি যে নিরুপায়। মৃত্যু ছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় নেই। আমি যে কলঙ্কিত!

রু’হুটা যে কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার ‘আমি যে কলঙ্কিত’ কথাটা দেখে। তার আপা কলঙ্কিত নয়। রাগান্বিতার কথাটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। রাগান্বিতা আবার চিঠিতে চোখ বুলালো। লেখা দেখলো,

বিয়ের আগে কখনো কোনো মানুষকে ভালোবাসবি না বোন। ভালোবাসা খুব যন্ত্রণার হয় যদি মানুষটা সঠিক না হয়। আমি ভালোবেসেছিলাম একটা মানুষকে। তার নাম ছিল আরফান মজুমদার। শহরে থাকতো। মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করে ঠকেছিলাম। আমাদের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু পরে জানি ওটা নাকি কোনো বিয়েই ছিল না। শুধুমাত্র একটা সাদা কাগজে আমার আর তার সই ছিল। নিজের সবটা দিয়ে যাকে ভালোবাসলাম, যার সন্তানের মা হতে চলেছিলাম সেই মানুষটা যখন বলে আমাদের বিয়েটা নাকি মিথ্যে ছিল শুধুমাত্র আমাকে ভোগ করার জন্য এত নাটক। অথচ বিয়ের আগে একবারও মনে হয় নি মানুষটা আমাকে ব্যবহার করছে। আমায় নিয়ে খেলছে। এত নিখুঁত অভিনয় ছিল তার। কষ্ট হচ্ছে বোন, তোদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তাও ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবসময় ভালো থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি। কখনো বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে ভালোবাসবি না। বাবা তোর জন্য যাকে আনবে তাকেই বিয়ে করবি, ভালোবাসবি। আপার মতো ভুল করিস না কখনো। কতটা যন্ত্রণা নিয়ে যে পৃথিবী ছাড়ছি বোন যদি তোকে বোঝানো যেত। তোকে শেষ বারের মতো একবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় যে নেই। আজ চললাম ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস পারলে আপাকে ক্ষমা করিস।

ইতি,
তোর অভাগী আপা
কুহুু”

এক বুক হাহাকার নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। চিঠিটা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বললো, আপা, আমার প্রিয় আপা! যন্ত্রণায় ছটফট করছে, হৃদয়টা কাতরাচ্ছে। কেমন যেন চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রাগান্বিতার। এতদিনের রাগ নিয়ে জমানো কান্না বুঝি আজ বাঁধ ভাঙলো।

রাগান্বিতার এইভাবে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার দৃশ্যটা বুঝি দুয়ারের কাছে দাড়িয়ে কেউ দেখলো। মুখ চেপে নিঃশব্দে কাদলো খুব।’
—-
সকালের রোদ মুখে পড়তেই ঘুমটা ভাঙলো ইমতিয়াজের। চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে রাগান্বিতাকে না দেখে আস্তে করে মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসলো সে। এরই মাঝে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ভিতরে ঢুকলো রাগান্বিতা। চোখ দুটো কেমন ফুলে গেছে। ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো তার দিকে। রাগান্বিতা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে। ইমতিয়াজের মুখোমুখি এসে পালঙ্কে বসলো। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু ইমতিয়াজের মুখের দিকে। ইমতিয়াজ চিন্তিত স্বরে শুধায়,
“কি হয়েছে বলো আমায়?”

আচমকাই ইমতিয়াজকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ হতভম্ব। রাগান্বিতা কাঁদলো। শক্ত করে ইমতিয়াজকে চেপে ধরে অনেক কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল। ইমতিয়াজ নির্বিকার। অনেকক্ষণ চুপ থাকলো দুজনেই। শুধুমাত্র রাগান্বিতার গোঙানো ছাড়া কিছুরই শব্দ শোনা গেল না। ইমতিয়াজও কোনো প্রশ্ন করলো না মিনিট দশেক। সে অনুভব করলো রাগান্বিতার কান্নার স্বরে তার ভিতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। চারপাশ ছারখার হচ্ছে। এত যন্ত্রণা তো আগে অনুভব হয় নি ইমতিয়াজের।’

ধীরে ধীরে প্রকৃতি হলো পুরোপুরি শান্ত। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ছাড়লো এবার বুঝি একটু হাল্কা লাগছে নিজেকে। রাগান্বিতা তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই আলাদা শান্তি অনুভব করে রাগান্বিতা। রাগান্বিতা দেখলো, ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো এবার। বললো,
“হাল্কা লাগছে?”

মাথায় নাড়ায় রাগান্বিতা। যার অর্থ হা লাগছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
“এবার বলো কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে বললো,
“আপা!’

ইমতিয়াজ বিস্মিত হয়ে বললো,“আপা মানে কুহু।”
আবারও মাথা নাড়ায় রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে,
“আপার কথা মনে পড়েছে?”

নিষ্পলক চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে রাগান্বিতা,
“আপনি জানেন আমার আপা বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছিল।”

চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। অবাক স্বরে বললো,“কেন?”

রাগান্বিতা বলবে ভেবেও কেন যেন চেপে গেল। মাথা নিচু করে বললো,“জানি না। হঠাৎই বিষ খায়।”

ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে। পরে প্রশ্ন করে,
“পুলিশকে জানানো হয় নি?”
“না বাবার সম্মানহানির ভয়ে চেপে গেছেন।”

হঠাৎই মাথায় হাত দিয়ে আহ্ করে উঠলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা ঘাবড়ে গেল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“কি হলো?”
“যন্ত্রনা হচ্ছে।”

রাগান্বিতা খেয়াল করলো ইমতিয়াজের কপাল দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে। রাগান্বিতা হতভম্ব স্বরে বললো,“রক্ত!”

#চলবে….

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৯
________________
বিষণ্ণতায় ঘেরা চারপাশ। কবিরাজ হাকিমকে আবারও ডাকা হলো তালুকদার ভিলাতে। সকাল সকাল এমন ঘটনায় সবাই হতভম্ব। ইমতিয়াজের মাথা দিয়ে আবার রক্ত বের হচ্ছে এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। কবিরাজ বলেছে যত দ্রুত সম্ভব ইমতিয়াজকে শহরে নেয়ার জন্য। দাদিমার ইচ্ছে ছিল রাগান্বিতাদের জন্য নিজ হাতে পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে কিন্তু এ ইচ্ছে বোধহয় এবার আর পূরণ হলো না। কবিরাজ পুনরায় ইমতিয়াজের মাথায় বাঁধা পট্টি খুলে নতুন করে জড়িবুটি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো। তার ধারণা মাথায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। কবিরাজ তার পটলিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পালঙ্কেই বসা ছিল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা, দাদিমা দূরে দাঁড়িয়ে। মোতালেব তালুকদার পালঙ্কের কর্নারে বসা। রেজওয়ান নেই এখন। সে ফজরের নামাজের পর যে বেরিয়েছে আর ফেরে নি। কবিরাজ মোতালেব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তালুকদার সাহেব জামাইডারে যত হয়ালে পারেন শহরে পাডাইয়া দেন। জখম কিন্তু খুব গভীর। হয়ালে চিকিৎসা না করাইলে বিপদ হইতে পারে।”

তালুকদার সাহেব চিন্তিত হলেন। বেশি না ভেবেই দুপুরের ট্রেনেই ওদের শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাগান্বিতা তার ব্যাগপত্র গোছানোর তোড়জোর করলো। বাকিরা একে একে কক্ষ থেকে বের হলো। দাদিমা চললেন এদের জন্য রান্না করতে।’

রাগান্বিতা উত্তেজিত হয়ে তার ব্যাগপত্র গোছানোর কাজটা করছে৷ ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাবভাব দেখছে। মেয়েটা বড্ডই তাড়াহুড়ো করছে। ইমতিয়াজ ধীরে সুস্থে পালঙ্ক থেকে নামলো। মাথাটায় এত বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে যে এখন ইমতিয়াজের অসহ্য হচ্ছে। হাতের কাছে বদমাশটাকে পেলে না আচ্ছা করে দিতো দু’গা। ইমতিয়াজ গিয়ে জানালার দিকে তাকালো। চিক চিক করা রোদ্দুরেরা ছুঁয়ে দিলো তাকে। ইমতিয়াজ তাকালো কুহুকে শুয়ে রাখা কবরের ওদিকটায়। তেমন কিছু নজরে আসছে না তার৷ ইমতিয়াজ একা মনে আওড়ালো,
“তুমি বিষ খেয়েছিলে কুহেলিকা! খুব যন্ত্রণা হয়েছিল নিশ্চয়ই।”

রাগান্বিতা এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের কাঁধে হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
“উঠে আসলেন যে, শুয়ে থাকুন না।”

ইমতিয়াজ নীরব চোখে তাকালো রাগান্বিতার দিকে। শীতল সুরে বললো,
“তুমি এতো ভেবো না আমায় নিয়ে। আমার কিছু হয় নি।”
“জানি তো কিছু হয় নি। তাও শুয়ে থাকুন। আর বেশি কথা বলবেন না। আমার মনে হয় আপনি আমার সাথে এত কথা বলছিলেন বলেই মাথায় চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারনে রক্ত বের হচ্ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাত ধরে নিয়ে আসলো। ইমতিয়াজও বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে বসিয়ে দিলো পালঙ্কে। পুরোটা সময় ইমতিয়াজ শুধু দেখেই গেল রাগান্বিতা। হঠাৎই রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি তোমার আপাকে খুব ভালোবাসতে তাই না বউ?”

রাগান্বিতা দু’মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ইমতিয়াজের প্রশ্নে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
“হুম বাসতাম তো খুব বাসতাম। আপা তো আমার প্রাণ ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না আর রাগান্বিতা মৃদু হেঁসে বললো শুধু,“শুয়ে থাকুন।”

ইমতিয়াজ শুয়ে পড়লো। রাগান্বিতা নরম হাতে তার মাথায় হাত বুলালো।
—-
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকলো রেজওয়ান। চিন্তিত মুখ তার। কারন কাল থেকে তার বন্ধু মনজুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার কাল বিকেলে রেজওয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। প্রাণ প্রিয় বিশ্বস্ত বন্ধুটা হঠাৎ কোথায় গেল বুঝতে পারছে না রেজওয়ান। আজ ফজরের নামাজে মসজিদে আসতে না দেখেই কেমন যেন লাগে রেজওয়ানের কারণ মনজু কখনোই সুস্থ থাকতে নামাজ কাযা করে না। রেজওয়ান চিন্তিত হয়ে মনজুদের বাড়ি যায়। গিয়ে শোনে মনজু নাকি কাল রাত থেকেই বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে কে জানে! রেজওয়ান সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো মোতালেব তালুকদারের। তিনি রেজওয়ানকে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখে গম্ভীর আওয়াজে বললেন,“রেজওয়ান দাঁড়াও।”

রেজওয়ান দাঁড়িয়ে পড়লো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,“জি বাবা।”

মোতালেব তালুকদার এগিয়ে আসলেন। রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিছু কি হয়েছে? তোমায় খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

রেজওয়ান প্রথমে ভেবেছিল কথাটা চেপে যাবে। কিন্তু পরে ভাবলো না থাক। সে সরাসরিই বললো,
“আসলে বাবা আমার বন্ধু মনজুকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বৃদ্ধ বাবা-মা খুব চিন্তা করছেন তাই আর কি।”

মোতালেব তালুকদার চরমভাবে অবাক হলেন। বললেন,
“খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে। কোথায় গেছে?”
“সেটাই তো বুঝচ্ছি না। ও বলেছিল ও আজ থেকে আমার সাথে কৃষিকাজে যোগ দিবে।”

মোতালেব তালুকদার কিছু বললেন না। তবে চিন্তিত হলেন খুব। জলজ্যান্ত ছেলেটা গেল কোথায়?”
—–
নদীর ঘাটে বাক্সপেটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের ইচ্ছে ছিল গতবারের মতো এবারও তারা জাহাজে করে শহরে যাবে। কিন্তু মাথার জখম বড্ড বেশিই জ্বালাতন করছে। ভাড়ি লোহা জাতীয় কিছু দিয়ে মেরেছিল কি না কে জানে। রাগান্বিতা তার দাদিমা, বাবা আর ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কথা বললো। মনকে শক্ত রাখলো। কথা শেষে গিয়ে বসলো নৌকায়। ইমতিয়াজও মোতালেব তালুকদার আর দাদিমার সাথে দু’মিনিটের মতো কথা বললো। রেজওয়ানের দিকে তাকাতেই বুঝলো ছেলেটা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। অবশ্য সে শুনেছিল মনজু নামের রেজওয়ানের কোন প্রিয় বন্ধুকে নাকি কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এ গ্রামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানেই তো ভাবলো না ইমতিয়াজ। সে শুঁকনো হেঁসে রেজওয়ানকে বললো,“ভালো থাকবেন ভাইজান।”

বিনিময়ে রেজওয়ানও হাল্কা হেঁসে বললো,“তুমিও ভালো থেকো। আমার বোনটার খেয়াল রেখো সঙ্গে নিজেরও। মাথার জখমটা ভালোভাবে দেখিয়ে নিও। আর সাবধানে যেও।”

ইমতিয়াজ হাল্কা হেঁসে বললো শুধু,
“জি ভাইজান।”
“এভাবে বলার দরকার নেই। আমরা তো সমবয়সই তুমি করে বললেই হবে।”

ইমতিয়াজও বিনিময়ে বলে শুধু,“ঠিক আছে।”

অতঃপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে শহরের বাড়িতে পাড়ি জমালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ।’

রাগান্বিতারা বসতেই নৌকা ধীরে ধীরে চলতে লাগলো তার গন্তব্যের দিকে। বোরকা পরিধিত রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে বেরিয়ে থাকা তার আঁখিযুগল নিয়ে তাকিয়ে থাকলো বাবা, ভাই আর দাদিমার দিকে। না জানি আবার কবে দেখা হবে। দাদিমা তার চোখ মুছলেন বোঝাই যাচ্ছে কাঁদছে। মানুষটা রাগান্বিতাকে এত ভালোবাসে যা বলার বাহিরে। রাগান্বিতাও বাসে। খুব বাসে।’

ইমতিয়াজ তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। সেখানে কি যেন ভাসছে। সে বেশি গুরুত্ব দিলো না মাছটাছ হবে বোধহয়। ইমতিয়াজের মাথা ঘুরছে, সে ঝাপসা চোখে তাকালো নদীর ঘাটের দিকে। দু’মুহুর্তের জন্য হলেও তার মনে হলো কুহু বুঝি তাদের বিদায় জানাতে এসেছে। কি সাংঘাতিক ভাবনা! ওদিকে মেয়েটা শুয়ে আছে মাটির নিচে।’

ইমতিয়াজের অবস্থাটা খেয়াল করলো রাগান্বিতা। সে ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,“শরীর খারাপ লাগছে?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ায়। বলে,
“খানিকটা।”

রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরেই আশ্বাস দিয়ে বলে,
“একটু ধৈর্য্য ধরুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। তবে মনে মনে আওড়ায়,“সত্যি কি ধৈর্য্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যায়!”
—–
সময় গড়ালো। দেখতে দেখতে কেটে গেল টানা পনের দিন। এই পনের দিন ইমতিয়াজের সেবার কাজেই নিয়োজিত ছিল রাগান্বিতা। গ্রাম থেকে ফিরেই সোজা ডাক্তারের কাছে যাওয়া। তারপর তার কথা অনুযায়ী সব করা। ইমতিয়াজ শুধু মুগ্ধ হয়ে এ ক’দিন দেখেছে তার বউকে। মেয়েটা তাকে এত বেশি ভালোবাসে কেন, কে জানে! সে নিজেও যে ভালোবাসতে শুরু করে নি এমনটা নয়। রোজ রাতেই সে রাগান্বিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“মেয়েটা তাকে পাগল বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো শেষে।”

তবে এসবের মধ্যে ঘটে যায় আরেকটা ঘটনা। যা ঘটে রেশবপুরে। রাগান্বিতাদের ফিরে আসার ঠিক দু’দিন পরই নদীর পানিতে ভেসে ওঠে মনজুর লাশ। লাশটা ভেসে গিয়েছিল আটপাড়ার ওদিকটায়। গ্রামবাসীরা এবার বেশ আতঙ্কে আছেন খালি গ্রামে মৃত্যু ঘটছে। প্রথমে মুরতাসিন, এরপর মাহাদ আর এখন মনজু। পুলিশ কেসটা নিয়েছে তদন্ত চলছে তবে এখনও কিছু জানা যায় নি। রেজওয়ান অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তার প্রানপ্রিয় বন্ধুটার এমন মৃত্যুতে সে সত্যি শোকাহত। শোকের জন্য ঘর বন্দীও থেকেছে দু’দিন। গ্রামবাসীদের কারো কারো ধারণা গ্রামে বুঝি ভূত প্রেতের উপদ্রব হয়েছে যার কারণে এইসব অনৈতিক কাজকর্ম হচ্ছে। কেউ কেউ তো কুহুর হঠাৎ মৃত্যুতেই বুঝি গ্রামের দূর্দশা হয়েছে এসবও বলছে। কিন্তু আসলে কি ঘটছে তা তো কেউই জানে না!’

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ