প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৯

0
540

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৯
________________
মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর তার সামনেই রাগে মাথা গরম করে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতার বাবা। রাগান্বিতা চুপ থাকায় রাগান্বিতার বাবা প্রশ্ন করলো,
“তুমি ওই দুপুরবেলা বাড়ির বাহিরে কেন গিয়েছিলে রাগান্বিতা?”
“আমি কোথাও যাই নি বাবা।”
“মিথ্যে বলছো তুমি। পাশের বাড়ির রফিক তোমায় দেখেছে তুমি শাপলার বিলের ওদিকে গেছিলে।”

এবার আর মিথ্যে বলতে পারলো না রাগান্বিতা। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বললো,
“আমি দুঃখিত বাবা। কিছু শাপলা আনতে গিয়েছিলাম। আমার ভুল হয়ে গেছে আমি আর কখনো তোমায় না বলে কোথাও যাবো না।”

মেয়ের দুঃখিত মুখ দেখলেই কেমন একটা হয়ে যায় রাগান্বিতার বাবা আজও তাই ঘটলো তবে প্রকাশ করলেন না। খানিকটা রাগী রাগী কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে এবারের মতো তোমায় ক্ষমা করলাম কিন্তু পরেরবার এমনটা যেন আর না হয়।”

বাবার কথা শুনে মাথা নিচু করেই নরম গলায় বললো রাগান্বিতা,
“ঠিক আছে বাবা।”

রাগান্বিতার বাবা চলে গেল। বাবা রুম পর্যন্ত যেতেই রাগান্বিতা আড় চোখে তা দেখলো। হঠাৎই আকাশে ভয়ংকরভাবে গর্জে উঠলো কতক্ষণ যাবৎ হয়ে থাকা কালো আকাশ বেয়ে হতে লাগলো বর্ষণ। রাগান্বিতা দৌড়ে ছুটে গেল সদর দরজার সামনে রিনিঝিনি শব্দ করে হতে লাগলো বৃষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো রাগান্বিতা।
—–
রাগান্বিতার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর ভিড়ের আঁকাবাকা রাস্তা পেরিয়ে বর্ষার মাঝে কোথাও একটা হেঁটে যাচ্ছে ইমতিয়াজ। বৃষ্টির পানিতে তার পুরো শরীর ভিজে চৌচির। ইমতিয়াজের কোনো হেলদোল নেই সে তার মতো হেঁটে যাচ্ছে। মূলত একটা বাড়ির দিকে। খানিকটা জঙ্গলের মতো একটা জায়গা একপাশে গাছপালা আর আরেকপাশে ছোট্ট নদী বয়ে চলছে। দূর সীমানা দিয়ে লঞ্চ জাহাজ চলতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর মাটির তৈরি পুরোটা তবে উপরে ছনের আচ্ছাদন। ইমতিয়াজ হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শুয়ে পড়লো কাঁদায় জমানো বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠানটায়। আশেপাশে কেউ নেই পুরো নির্জন আর নির্জীব একটা জায়গা। মাঝে নদীর মধ্যে বয়ে চলা ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়। ইমতিয়াজ তার মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে আয়েশ করে শুয়ে রইলো। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো নিমিষেই। সঙ্গে সঙ্গে একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসলো। সে কি যেন বলে খুশি মনে দৌড়াচ্ছে। ইমতিয়াজও হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে, “দাড়া বলছি।” কিন্তু মেয়েটা শোনে না এক পর্যায়ে ছুটাছুটি করে শুধু। ইমতিয়াজ চোখ খুলে ফেললো বুকের ভিতরটা খা খা করছে তার। দীর্ঘ শ্বাসে নিশ্বাস হচ্ছে ভাড়ি। ইমতিয়াজ চোখ খুলে আকাশ পানে তাকিয়ে থেকেই বললো,
“এই নগরের কোথাও ভালোবাসা নেই। এই নগরে আছে শুধু খুন আর খুন সঙ্গে তাদের শরীর ভেজা রক্ত। বিষাক্ত এই নগরীতে প্রেম কখনোই কাম্য নয় ইমতিয়াজ। কখনোই নয়। এ নগরে প্রেম মানেই মৃত্যু।

বলেই উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ।

——
নতুন একটা দিনের শুরু। মুয়াজ্জিনের নামাজের আহ্বানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বাহিরে। ফজরের আযান দিচ্ছেন তিনি। রাগান্বিতা ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎই কারো ডাকার শব্দ কানে আসলো। কেউ ডাকছে তাকে সঙ্গে বলছে,
“রাগান্বিতা উডো হয়ালে ফজরের আযান দিতাছে।”

রাগান্বিতা নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম গলায় বললো,
“দাদিমা আর একটু ঘুমাই।”
“নামাজ পইড়া আবার ঘুমাবা আনে এহন তো উডো।”

এবার রাগান্বিতা আর কথা না বারিয়ে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ ডলতে ডলতে বললো,
“উঠেছি আমি।”

দাদিমা খুশি হলেন। বললেন,
“তাড়াতাড়ি আহো আজ আমরা একলগে নামাজে খাড়ামু।”

দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতাও খুশিমাখা মুখ নিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।”
“আইচ্ছা তাড়াতাড়ি আইয়ো।”
“হুম আসছি তুমি কলপাড়ে দাড়াও গিয়ে।”
“ঠিক আছে।”

দাদিমা চলে গেলেন। দাদিমা যেতেই রাগান্বিতা কতক্ষণ এদিক সেদিক ঘাড় মুড়িয়ে গায়ের ওপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। রাগান্বিতার খুব পুরনো দিনের অভ্যাস সে ফজরের এই সময় বিছানা থেকে উঠেই তার রুমের পুকুরের ওদিকটার জানালা খুলে ফেলে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না রাগান্বিতা হেঁটে গিয়ে জানালা খুলে দিলো। জানালাটা খুলতেই সামনের একটা গাছের গোড়া থেকে কে যেন ছুটলো রাগান্বিতা ঘুমের ঘোরে থাকায় বিষয়টা তেমন নজরে আসলো না। রাগান্বিতা তার গায়ে জড়ানো কাপড়টা ঠিক করে আস্তে আস্তে চললো কলপাড়ের দিকে। রাগান্বিতা নামতে নামতে তার বাবা অলরেডি নামাজের জন্য বেরিয়ে পড়েছেন। রেজওয়ান অসুস্থ থাকায় বাড়ির বাহিরে আর যায় নি। ঘরে বসেই তার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাগান্বিতা তার মাথায় কাপড় জড়িয়ে এগিয়ে গেল তারপর দাদিমা আর রাগান্বিতা একসাথে ওজু করে বাড়ির ভিতর চললো। বাড়ির নামাজের কক্ষে দুজন একসাথে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালো।

নামাজ শেষে মোনাজাত পড়ে রাগান্বিতা অনেকক্ষণ বসে রইলো। পাশেই দাদিমা আরো অনেকক্ষণ মোনাজাত পড়ছেন মোনাজাত দিতে দিতে কুহুর কথা ভেবে কান্নায় চোখ ভেসে আসলো তার। কুহুর জন্য দোয়া করলেন খুব। রাগান্বিতা পুরোটাই বুঝতে পেরেছে তবে কোনো শব্দ করে নি পুরোটা সময় চুপচাপ দাদিমার কান্নাটা শুনে গেছে। রাগান্বিতার মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড পাষাণ মনে হয় তার বোনটা চলে গেল কতগুলো দিন চলে গেল অথচ তার চোখে পানি আসছে না। রাগান্বিতা মাঝে মাঝে ভেবে পায় না সে এতোটা কঠিন কেন? কারো মৃত্যুতেও তার চোখে পানি আসে না কেন? তার বড্ড খারাপ লাগে,লেগেছে, এখনো লাগছে বোনের হুট করে মৃত্যুটা কেন যেন সে মেনে নিতে পারি নি। হয়তো বোনটা নিজ ইচ্ছে মারা গিয়েছিল বলে এমনটা হয়েছে। রাগান্বিতা চুপচাপ বসে রইলো, আজ আর তার ঘুম আসবে না। আচমকাই পিছনের বাগানটা দিয়ে কি যেন চলে যাওয়ার শব্দ আসলো। শব্দটা কানে আসতেই রাগান্বিতা একবার পিছন ঘুরেও ছিল কিন্তু কিছু দেখে নি।

সময় গড়ালো। দাদিমা তার চোখের পানি মুছে নামাজ ছেড়ে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাজ করতে লাগলেন দ্রুত রাগান্বিতাও উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎই তার কি যেন মনে পড়লো সে দাদিমাকে প্রশ্ন করলো,
“তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করবো দাদিমা?”

দাদিমাও স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন,
“হুম কর।”
“কাল তুমি আমার শাপলা ফুলের অলংকারের সাজ দেখে ওভাবে ঘাবড়ে কেন গিয়েছিলে দাদিমা?”

দাদিমা যেন চমকে উঠলেন আবার। হাত থেকে জায়নামাজটা পড়ে গেল নিচে। মুহুর্তেই ভয়ংকরভাবে কাঁপলেন তিনি। দাদিমার রিয়েকশন দেখে আবার বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো তোমার?”

দাদিমা নিজ থেকে জায়নামাজটা উঠিয়ে থর থর করে বললেন,
“তোমারে তো কাল কইছিলাম ওই বাড়ির মুন্নার মাইয়াডারে,

পুরো কথা শেষ করার আগেই রাগান্বিতা বললো,
“তুমি আমায় মিথ্যে বলো নি তো দাদিমা?”

দাদিমা খানিকটা দূরে সরে গেলে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“মিছা কি কমু।”

রাগান্বিতা দাদিমার মুখোমুখি দাঁড়ালো চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছো। সত্যি কিছু লোকাচ্ছো না তো দাদিমা?”

দাদিমা সরে গেলেন আবার। বললেন,
“না কি লুকামু কও তেমন কিছু হইলে তোমারে কইতাম তো তোমার আব্বাজানে আইয়া পড়বো চা বানানো লাগবো আমায়। আমার যাওন লাগবো রাগান্বিতা।”

বলেই এক প্রকার পালিয়ে চলে গেল দাদিমা। আর রাগান্বিতা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দাদিমার যাওয়ার তার কেন যেন মনে হচ্ছে দাদিমা তার থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছে? কিন্তু কি লোকাচ্ছে? আর কেনই বা লোকাচ্ছে ওই সামান্য শাপলা ফুলের মাঝে কি এমন লোকানোর মতো থাকতে পারে?’ ভেবে পেল না রাগান্বিতা।
—–

প্রায় আট নয়দিন পর স্কুলের পথে পা বারিয়ে ছিল রাগান্বিতা। কিন্তু সারাদিন কোনোকিছুই ভালো লাগে নি তার কেমন একটা একঘেয়েমি ভাব নিয়ে চলে গেল স্কুলের সময়টা। রাগান্বিতা হাতে বই নিয়ে একা পথে হাঁটছে। তার সহপাঠীরা অনেক আগেই চলে গেছে সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটার কারণে সবার থেকে পিছনে পরে গেছে। তবে এসবে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। দাদিমার সেই ঘাবড়ানোর বিষয়টা নিয়ে এখনো ভাবছে রাগান্বিতা সে এটাই বুঝচ্ছে না দাদিমা তার থেকে কেন কিছু লোকাচ্ছে, নাকি লোকাচ্ছে না তার সন্দেহ করাটা ভুল হয় নি তো। কিন্তু দাদিমার ভয় পাওয়ার ফেসটা আজ সকালের সেই ভয়ার্ত চাহনী বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে রাগান্বিতা। রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই আচমকাই কিসের যেন সুর ভেসে আসলো কানে। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে পড়লো সুরটা তার চেনা সে এর আগেও একবার এই সুরটা শুনেছে। রাগান্বিতা বেশি না ভেবেই আশেপাশে চোখ বুলালো হঠাৎই তার চোখ গেল একটা গাছের গোড়ার সামনে কেউ একজন বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। রাগান্বিতার বুঝতে বাকি রইলো না মানুষটা যে ইমতিয়াজ?’

রাগান্বিতা আনমনেই এগিয়ে যেতে লাগলো ইমতিয়াজের কাছে। কেন যাচ্ছে জানে না? কিন্তু তার মন বলছে একবার যা কাছে গিয়ে পাশে বস তোর মন ভালো হয়ে যাবে।’

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে