#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৮
________________
সন্ধ্যা নেমেছে প্রকৃতি জুড়ে। জানালা বেয়ে ধেঁয়ে আসছে বাতাস। বিছানায় এলেমেলোভাবে পাগল বেশে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় খাটে বসে আছে রাগান্বিতা। ইলিয়াসের ইনজেকশন পুস করার পর মাত্রই ঘুমটা ভাঙলো তার। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো আস্তে আস্তে পায়ের শিকল নিয়েই খাট থেকে নিচে নামলো সে। খাটের নিচেই ছিল একটা বাক্স। রাগান্বিতা বাক্সটা বের করলো, কতগুলো শুকিয়ে যাওয়া শাপলা ফুলের অলংকার দেখলো। সেগুলো হাতেও নিলো খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। অদ্ভুদ স্বরে নিস্তব্ধ হয়ে বললো,
“দেখেছো ইমতিয়াজ তোমার সেই সাজিয়ে দেওয়া শাপলা ফুলের অলংকার আমি আজও ফেলি নি। তাহলে তুমি আজও কেন আসছো না?”
আচমকাই দরজার খোলার আওয়াজ আসতেই রাগান্বিতা ঘাবড়ে গিয়ে সামনে তাকালো আবারও ইনজেকশন পুস করা সেই ডাক্তারকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললো,
“আপনি আবার আমায় ইনজেকশন দিতে এসেছেন?”
ইলিয়াস ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো। রামুর মুখে শাপলার বিলের পর আর কিছু শুনতেই পারলো না ইলিয়াস তার আগেই রামুকে যেতে হয়েছে। বলেছে বাকিটা নাকি কাল বলবে? কিন্তু ইলিয়াসের ধৈর্য্য হচ্ছে না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে রাগান্বিতাকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলে সেই সবটা বলবে তাকে। ইলিয়াস এখনো বুঝলো না রাগান্বিতার দাদিমা রাগান্বিতার ওই ফুলের সাজ দেখে কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন?’
ইলিয়াস ধীরে ধীরে রাগান্বিতার কাছে এগোতে লাগলো সাথে ধীর কণ্ঠে বললো,
“তুমি ভয় পেও না রাগান্বিতা আমি কোনো ইনজেকশন দিবো না তোমায়।”
রাগান্বিতা শুনতে চাইলো না ভয়ে ভয়ে দেয়ালের সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো। ইলিয়াস রাগান্বিতাকে আশ্বাস দেয়ার জন্য তার হাতের ইনজেকশনটা রাগান্বিতাকে দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রেখে বললো,
“এই দেখো আমি তোমায় ইনজেকশন দিবো না এটাকে রেখে দিলাম আমি তো তোমার সাথে শুধু একটু কথা বলতে এসেছি।”
ইলিয়াসের কথা শুনে রাগান্বিতা ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,
“আমি কারো সাথে কথা বলবো না। আপনি বাবাকে ডাকুন। বাবা! বাবা!”
ইলিয়াস হতাশ হলেন আবারও আশ্বাস দিতে বললো,
“তোমার বাবা আসবে রাগান্বিতা তুমি এভাবে চেঁচিও না প্লিজ।”
রাগান্বিতা এবার খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। নিজে নিজে বললো,
“আপনি দেখি বোকা ডাক্তার সাহেব, মৃতব্যক্তি কখনো ফিরে আসে নাকি।”
ইলিয়াস যেন ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেল রাগান্বিতার কথা শুনে। তবে কি রাগান্বিতা জানে পাঁচ বছর আগেই তার বাবা কোনো এক কারণে মারা গিয়েছিল! যদি জেনেই থাকে তাহলে সারাক্ষণ বাবা বাবা বলে চেঁচায় কেন?’ ইলিয়াসের ভাবনার মাঝেই রাগান্বিতা আবার বলে উঠল,
“জানেন ডাক্তার সাহেব আজ না আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।”
ইলিয়াস ধীরে ধীরে রাগান্বিতার সামনাসামনি বসে বললো,
“কি স্বপ্ন?”
রাগান্বিতা হাসি হাসি মুখ করে বললো,
“আমার ইমতিয়াজ ফিরে এসেছে।”
ইলিয়াস রাগান্বিতার সাথে আর একটু নরম হলো। খুবই শান্ত স্বরে বললো,
“এই যে তুমি সারাক্ষণ ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ করো এই ইমতিয়াজ আসলে কে? তোমার কি হয়?”
রাগান্বিতা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“ইমতিয়াজ আমার স্বামী আমাদের বিয়ে হয়েছিল জানেন।”
ইলিয়াস যেন আরেকটা ধাক্কা খেল রাগান্বিতার কথা শুনে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার স্বামী ছিল। ওদের বিয়ে কি হয়েছিল! রাগান্বিতা কি সত্যি বলছে! নাকি ভুলভাল বকছে। ইলিয়াস রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাদের বিয়ে হয়েছিল?”
“হুম! কেন আপনি জানেন না?”
“না কিভাবে জানবো কেউ তো বলে নি। আচ্ছা তুমি আমায় বলবে তোমাদের কিভাবে বিয়ে হয়েছিল তোমার কি সব মনে আছে?”
মাথা নাড়ায় রাগান্বিতা। বলে,
“হুম মনে থাকবে না কেন?”
“তাহলে শোনাও আমায়! তুমি বলবে কিভাবে তোমার আর ইমতিয়াজের বিয়ে হয়েছিল?”
রাগান্বিতা চুপ করে রইলো। যার অর্থ সে বলবে না। ইলিয়াস এতক্ষণ পর নজরে গেল রাগান্বিতার হাতে শাপলা ফুলের শুকিয়ে যাওয়া অলংকারের দিকে। ইলিয়াস হাত দিয়ে ছুঁতে নিলো তা সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা চেঁচিয়ে বললো,
“ওগুলো ছুঁবেন না ওগুলো আমায় ইমতিয়াজ দিয়েছে।”
ইলিয়াসের যেন চোখ ভেসে উঠলো ফুলগুলো দেখে সেই কবেকার ফুল রাগান্বিতা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ওদের মাঝে এত প্রেম ছিল তাহলে ইমতিয়াজ কোথায় গেল? আর গেল তো গেল এখনো ফিরে কেন আসছে না? সে কি জানে না রাগান্বিতা তাকে ছাড়া ভালো নেই!’
ইলিয়াস উঠে দাঁড়ালো না তাকে এই স্টোরির পুরোটা জানতেই হবে এক্ষুণি সে রামুর কাছে যাবে। রাগান্বিতার দাদিমা সেদিন কেন রাগান্বিতার ফুলের সাজ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছি তা তাকে জানতেই হবে। আর ইমতিয়াজও বা গেল কই! এসব না জানতে পারলে ইলিয়াসের ঘুম আসবে না! শান্তি মিলবে না! ইলিয়াস এসব ভেবেই রাগান্বিতার রুম থেকে বেরিয়ে গেল দরজা আঁটকে ছুটে গেল রামুর বাড়ির দিকে। তাকে শেষটা জানতেই হবে।’
এদিকে,
রাগান্বিতা তাকিয়ে আছে ফুলগুলোর দিকে।কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে একদিন ইমতিয়াজের বলা একটা কথা মনে করলো যেখানে ইমতিয়াজ তাকে বলেছিল,
“জানো তো রাগান্বিতা, প্রেম মানে হলো এক আসমান যন্ত্রণা তাও দেখো মানুষ বেছে বেছে সেই প্রেমে পড়বেই যেমন আমি পড়েছি।”
_________________
১৯৮১ সালে! সেদিন দুপুরে রাগান্বিতা আর তার দাদিমাকে নিয়ে তেমন একটা ভাবে নি। গোসল সেরে এসে বিছানায় রাখা সেই ইমতিয়াজের ফুল দিয়ে বানানো অলংকারগুলো সযত্নে তার রুমে থাকা ছোটমোটো একটা বাক্সে ভরে খাটের তলে রেখে দিল। ফুলগুলো কালো আর নেতিয়ে গেছে পুরো। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাঝার শব্দ কানে ভেসে আসলো রাগান্বিতার। রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হলো ডাকপিয়ন এসেছে। রাগান্বিতা দৌড়ে ছুটে গেল জানালার ধারে, তাকালো বাহিরে সাইকেল এসেছিল ঠিকই তবে ডাকপিয়ন ছিল না অন্য আরেকটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল কোথায় যেন। রাগান্বিতা যেন সস্থির নিশ্বাস ছাড়লো। তার মনে পড়লো তখন কার সেই ডাকপিয়নের দিয়ে যাওয়া চিঠিটার কথা সে তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার রুমের ড্রয়ারটার দিকে। বেশি না ভেবেই ড্রয়ারটা খুলে চিঠিটা বের করলো। ভাজটা খুলেই পড়তে লাগলো আজ বেশ বড় করেই লেখা আছে কিছু। রাগান্বিতা বিছানায় বসেই চিঠিটা পড়তে লাগলো,
“আমাদের একটা বিকেল হবে,
গন্ধে গন্ধে প্রেম ছড়াবে;
নদীর পাড়ে নৌকা বইবে
পাখিতে গাইবে গান।
তুমি যদি একবার বলো ভালোবাসো
আমি নিরদ্বিধায় দিতে পারি নিজের এই ঠুনকো প্রাণ!’
আমাদের একটা বিকেল হবে
বাতাসে তার প্রেম ছোঁয়াবে;
হৃদয়ে দিবে টান।
আমি তো এক নিষ্ঠুর প্রেমিক পুরুষ
তুমি চাইলেই নিতে পারো আমার এই নিষ্ঠুর জান।”
ইতি,
~ নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ!’
‘নিষ্ঠুর’ কথাটা যেন চরম ভাবে ভাবালো রাগান্বিতাকে। আজ প্রথম যেন চিঠি পড়ে তার বড্ড হাসি পেল। কে এই প্রেমিক? জানতে চায় সে! কিন্তু কিভাবে জানবে। হঠাৎ বাবার হাক শোনা গেল তিনি রাগান্বিতাকে ডাকছেন সাথে। বলছেন,
“রাগান্বিতা, রাগান্বিতা। দ্রুত নিচে আসো।”
রাগান্বিতা যেন চমকে উঠলো তার বাবা হঠাৎ এভাবে কেন ডাকছেন? কি ঘটলো আবার! বাবা জেনে যায় নি তো সে শাপলা কুড়াতে বেরিয়ে ছিল?’
চলবে…….