প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
রাজিব তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো একা পরে থাকে পুরো বাড়িটাতে। মীরা চলে যাবার পরপর মিলনও চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়-
: “আজ যা ঘটলো এটা তোমার নিজের কামাই, কি সুন্দর সংসার ছিলো তোমার! সুন্দরী স্ত্রী, ফুটফুটে একটা বাচ্চা, সাজানো ব্যাবসা, সমাজিক প্রতিপত্তি কিসের কমতি ছিলো তোমার? দিনের পর দিন তুমি পরনারী নিয়ে মেতে ছিলে, আজ তোমার এই দুর্দিনে কোথায় তারা?
কিছু সময় চুপ থাকে মিলন, তারপর আবারো বলে-
তুমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে না? আমার বৌ এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন ভালোবাসে আমায়? ওর কাছে আমার প্রতি একটা ভরসা আছে, যে যাই করি ওর জায়গাটা এ পৃথিবীতে অন্য কাওকে দেবো না আমি। মেয়েরা কিসের নিজেকে সপে দেয় জানো?
শুদ্ধতম ভালোবাসায়, যার একছত্র অধিপত্য কেবল তারই থাকবে। আর তুমি – রিলিফের চালের মতো জনে জনে বিতরন করেছো তা। আমি আগে যদি ভাবীর এসব কথা জানতাম কক্ষনো আসতাম না তোমার হয়ে সুপারিশ করতে। আমার লজ্জা লাগছে যে আমি তোমার মতো দুশ্চরিত্রের বন্ধু। ছিহ্ রাজিব! ছিহ্!
মিলন রাজিবের দোষে আরো রঙ মিশাতে ভুলে না। যতটুকুতে রাজিব ভিতর থেকে আরো গুড়িয়ে যাবে, উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকুও পাবে না তারচেয়ে বেশী রঞ্জিত করে তুলে ধরে ওর দোষ গুলোকে। রাজিব তো আগে থেকেই ভাঙা, মীরা ওকে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো এই তো একটু আগে। এখন মিলনের কথাগুলো ওভার ডোজের মতো প্বার্শ প্রতিক্রিয়া করা শুরু করে। দূর্বল হৃদয়ের রাজিব কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে যায়। মিলন কি বলছে তা যেন ওর কানেই ঢুকে না৷ মিলন বেরিয়ে যাবার সময় ও কেবল দেখলো ওর চলে যাওয়া, রাগান্বিত কন্ঠে কি বললো বুঝলো না কিছুই, তারপর ক্রমশ ঝাপসা হতে শুরু করে ওর চারপাশের দৃশ্যপট। একটা সময় ও আর মাথা সোজা করে রাখতে পারলো না। তবে মাথা তখনো পরিষ্কার কাজ করছে। ওর মনে হচ্ছে ঘরে যাওয়া উচিত, কিন্তু ও এ-ও বুঝলো এ ও পারবে না। তবুও চেষ্টা করলো ঘরের বিছানা অবধি যাবার। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ও তা পারলো না, ড্রইং রুমের ওয়াকিং স্পেসের পাশে নূহার প্লেয়িং জোনের কাছটায় পরে গেলো রাজিব, ওর অনিয়ন্ত্রিত পতনের কারনে নূহার টেন্ট, খেলনাপাতি সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বাম হাতটা পরলো বেকায়দায়, সেটাকে তুলে আনতে গিয়ে ও ঘটালো আরেক বিপত্তি। অপর দিকে রাখা নূহার বাড়ি, রান্নাঘর, বাসনকোসন ছোট্ট নূহার সাজানো সংসার সব তছনছ হয়ে গেলো তারপর ব্ল্যাকআউটের মতো চোখ বুজে এলো, রাজিবের তখন মনে হলো মেয়ের সংসারটাও গুড়িয়ে দিলাম, এরপর কেবলি প্রবল আচ্ছন্নতা, ওর মনে হলো মৃ*ত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ও। এমন অবস্থায় ও মুখে একটা হাসি ফুটলো রাজিবের, এসব যন্ত্রণা চোখে দেখার চেয়ে মৃ*ত্যুই ভালো। সবসময় বেঁচে থাকার স্বাদ নিয়ে ব্যাস্ত থাকা রাজিব সানন্দে গ্রহণ করলো মৃ*ত্যুকে।
———————
মাটির তৈরী জিনিস পোড়াবার আগে যেমন পানি লাগলে গলে যায়, শুকালে ভয় থাকে ভেঙে যাবার তেমনি সম্মান আর সামঞ্জস্যহীন সম্পর্কগুলোও ভঙ্গুর হয়। ঠিক সাথী আর সাকলায়েনের সংসারের মতো। ওদের সংসারের তার কাটে খুব অল্পেই, পাঠকের কল্পনার চেয়েও দ্রুততর সময়ে। কারন দুজনই অধৈর্য আর অসংযম চুড়ান্ত রূপ। দুজনেই জীবণে চলার পথে সময়ের কাছে যাই পেয়েছে তা হয় ছিনিয়ে নিয়েছে নয়তো আদায় করে, অর্জন করা কি তা না জানে সাথী, অজানা সাকলায়েনেরও । দুজনে দুই দিকে থেকেও জীবণকে দেখেছে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে। লো*ভ, ভো*গ, এ শব্দ দুটি যেন ওদের চরিত্রের বর্ননায় ওদের প্রতিশব্দ। একজনের লো*ভ নিত্য নতুন মেয়েতে, তো আরেক জনের ধনবান পুরুষে। দুজনের কেউরই কিন্তু বিবেকের দেয়ালে ধাক্কা লাগেনি বিবাহিত কারো সাথে সম্পর্ক তৈরীতে। সাথীর যেমন বিবাহিত ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরীতে বিবেকের দংশন হয়নি, সংকোচ হয়নি সন্তানসম্ভবা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে, সাকলায়েন তো ছাড়া গরু। ওর কাছে মূল্যবোধ তো বহুত দামী শব্দ, ওর মতো হীন লোকেদের কাছে মূল্যবোধের মতো অদৃশ্য সত্তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আল্লাহ ঠিক মিলিয়ে দিয়েছে মানিক-রতন।
সাথীর বাবা মা, বোনেরা সপ্তাহ খানিক থেকে চলে গেছে বাড়িতে। ধান বোনার সময় এখন, তাছাড়া সবার স্কুল কলেজ সব ঐদিকেই, লম্বা ছুটিতে সবার পড়ালেখার ক্ষতি হবে। তারা যাবার আগে সাথী ওর বাবা-মাকে বলে রেখেছে কলেজ পড়ুয়া মিথির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে ঢাকায় এনে নিজের কাছে রাখার কথা, তারা অমত করেননি, বরং খুশিই হয়েছেন মেয়ের এমন আবদারে । এ কথা শুনে কলেজ পড়ুয়া মিথি খুব খুশি আর ওর পরের দুই বোন স্মৃতি ও প্রীতি মনে মনে হিংসে করতে শুরু করে মিথিকে, ইশ্ কত্ত ভালো হতো ঢাকায় এই এত সুন্দর বাসাটায় ওরাও থাকতে পারতো যদি। কিন্তু ছোট দুই বোন তো জানে না, আজ যাকে হিংসা করছে ওরা তার কি করুন, নির্মম দিন ওর জীবণের চারিপাশে পরিখা করে রেখেছে ওরই জন্য।
তারা চলে যাবার পরই ছন্দ পতন শুরু হয় ওদের। টাকা সাকলায়েন অনেক কামাই করে। টাকার অভাব হয় না ওর, সংসারের খরচ, নিজের জন্য কেনাকাটা, ঘরদোর নতুনভাবে সাজানো। ওর যার অভাব হয় তা হচ্ছে সঙ্গ। রাজিব ছায়ার মতো সবসময় ওর পিছনে থেকেছে। প্রায় সন্ধ্যায় ওরা বেড়াতে বেরুতো৷ রাতের খাবারটা বাইরেই খেতো। নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, হোটেল এক্সপ্লোর করাই যেন একত্রে সময় কাটানোর বাহানা একটা। দু’জনেই দুজনের সঙ্গ ভালোবাসতো। আর সাকলায়েন? বিয়ের পর কেমন যেন বদলে গেছে ও। আগে রাজিবের অনুপস্থিতিতে যতটুকু কদর ওর করতো এখন ওর পুরো দখলদারি পেয়েও ওর তৃষ্ণা যেন উবে গেছে। রাতে এসব বিষয়ে কথা বললে রেগে যায় ও, ক্রুদ্ধ স্বরে বলে-
: “এই বা*লের প্যাচাল ভাল্লাগে না বুঝছো?”
সাথী কেমন যেন হয়ে যায় ওর আচরণে। প্রমিক সাকলায়েন আর স্বামী সাকলায়েনকে যেন মিলাতে পারে না। দু’জন দু’দিকে ফিরে শুয়ে থাকলেও সাকলায়েনের শেষ রাতের আদরে বিগলিত হয়ে সব ভুলে যায় সাথী।
————————-
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাজেদা খালাকে কিছু টাকা দিয়ে দরকারী জিনিস কিনতে পাঠায় মীরা। দোকানের স্টাফদের দিয়ে মালপত্র সরিয়ে বড় ঘরটা ফাঁকা করে ওদের থাকার জন্য। মাসের অর্ধেক তার উপর ঘর খোঁজার মানসিককাতাও নেই ওর। আপাততঃ চলার জন্য যা না হলেই নয় তা আনার দায়িত্ব দেয় ওদের। এগুলো বুঝিয়ে কি এক কাজে বাইরে যায় মীরা। টুম্পা ও যায় ওর সাথে। ঘরের এত কাজ দেখে মাজেদা খালা তার বোনকে ফোন করে ডেকে পাঠায় নূহার খেয়াল রাখতে। তিনি প্রায়ই আসেন এ নূহাকে দেখতে।
মীরার চলে যাবার পর পরই ওয়ার হাউজের এ বাসাটায় আসেন মোখলেস চাচা। তিনি মীরার কারখানা নিলামের খবর পেয়ে মীরাকে কল করেছিলেন , মীরা রিসিভ করেনি। উপায় না দেখে ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে কেও গেইট না খোলায় আউটলেটের ম্যানেজার ফাহাদকে কল দিয়ে জানতে পারে ওরা ওয়ার হাউজে শিফট করেছে গত রাতে৷ কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারেন না মুখলেস সাহেব , তবে ঘোর অমানিশায় যে মীরা রয়েছে তা বুঝতে বাকী থাকে না এ মানুষটার। খবর পাওয়া মাত্র ঠিকানা নিয়ে তিনি এসেছেন এখানে। কিন্তু মীরা ততক্ষণে বারিয়ে গেছে। মাজেদা খালাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি সবটা খুলে বলেন। কারন মাজেদা খালা তাকে ইরার বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার সময় থেকে চিনেন।
সবটা শুনে কেমন থমকে যান ভদ্রলোক । মেয়েটাকে অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যা ওর লিখনে ছিলো তা তো খন্ডানো যাবে না। তা না হলে এত বুঝদার একটা মেয়ে সব ওর হাতে ছেড়ে দেয়ার মতো ভুল কেন করব? দুটো মেশিন দিয়ে শুরু করা ব্যাবসার আজ অর্ধ কোটি টাকার থেকে ডাক শুরু হবে। তিনি এসেছেন ওর সহায় হতে৷ কিন্তু মীরা তার সাহায্য নিবে না, তাও তিনি ভালে করে জানেন। তাইতো মীরা ফোন ধরছে না তার। ঠিক এ মূহুর্তে দোয়া করা ছাড়া কোন পথ খোলা রাখেনি মীরা। মাজেদা খালা চা এনে দেখেন লোকটা রুমাল দিয়ে তার চোখ মুছছেন। মাজেদা খালা চায়ের কাপ সামনে রাখলে উঠে পরেন তিনি।
——————–
বিকাল পাঁচটা,
উইল পাওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ এর মেইন ব্রাঞ্চে “মীরা ফ্যাশন” এর কারখানা, ওয়্যার হাউজ, গোডাউনের সকল মালপত্র, ফেসবুক পেইজ, সমস্ত কিছু বিক্রির উদ্দেশ্য নিলামের ডাক বসিয়েছেন। সম্ভাব্য ক্রেতারা যথাসময়েই উপস্থিত হয়েছে। সবচেয়ে করুন বিষয় হচ্ছে এ নিলামের সভাপতি পর্ষদের দায়িত্বে থাকা তিনজনের একজন মার্কেট সমিতির সভাপতি মোখলেসুর রহমান ওরফে মোখলেস চাচা। তার জন্য আজ অনেক কষ্টের দিন। অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও কিছুই করার নেই তার। এমনকি এখানে না এসেও উপায় ছিলনা তার। তিনি অসুস্থতার বাহানায় এড়িয়ে যেতে চাইলে ডেট পরিবর্তনের কথা জানায় তারা। এতে এই দীর্ঘ ঝামেলা আরো দীর্ঘায়িত হবে ভেবে শেষমেশ এসে উপস্থিত হন তিনি। কিন্তু তার দৃষ্টি অবনত। তিনি মনে মনে চাচ্ছেন কোনমতে এই দু-এক ঘন্টা কেটে যাক, আর উনি বাড়ি ফিরে যান।
সম্ভব্য ক্রেতাদের প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন এর দাম কত অবধি উঠতে পারে তা নিয়ে। এমন সময় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকে মালিক পক্ষের রাজিব আর ওর বন্ধু মিলন। এদের অপেক্ষায়ই দেরি করছিলেন তারা। রাজিব বেহুশ হয়ে পরে থাকার দরুন এত দেরি, তা তাদেরকে জানালেন মিলন। মিলন রাজিবকে বসিয়ে বাইরে যায়। রাজিব যেন অন্য গ্রহের কেও, আসা অবধি মাথা নিচু করে দুহাতের আঙুল খুঁটছে। কোথাও একটা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
মিলন বাইরে গিয়ে কল করে কাকে যেন। রাগান্বিত কন্ঠে গালাগাল করে এখনো না পৌঁছানোয়। অবশেষে একটা ব্যাগ হাতে পৌঁছয় তার ছোট ভাই সুমন। সুমনকে যা বলার তা গত রাতেই তোতাপাখির মতো পড়িয়েছে মিলন। “যে করেই হোক মীরা ফ্যাশন আমার চাই” – কথাটা বলে কাঁধে সাহসদায়ী চাপড় দিয়ে হাসি মুখে ভাইকে ভিতরে যেতে পথ দেখায় মিলন। দু-হাত দুই পকেটে ঢুকিয়ে এদিকওদিক দেখে সে । কেও আবার দেখলো কি-না তার পরখ করলো আড়চোখে। তারপর ভিতরে ঢুকলো।
অবশেষে নিলামের ডাক শুরু হয়। নিলাম শুরু হয় ৫০ লক্ষ ১ হাজার থেকে। মিনিট পাঁচের ব্যাবধানে তা নানা হাত ঘুরে চলে যায় ৭০ লাখের ঘরে। সেই অংকটাও মিলনের ভাই সুমনেরই দেয়া৷ সুমন এসব ব্যাবসাপাতির কিছুই বুঝে না, ভাইয়ের খাতিরে অফেিস হতে ছুটি নিয়ে এখানে আসা।
মিলনের মুখে হাসি। এরচেয়ে বেশি দামে কোন গাধা কিনবে এটাকে? মিলন তো টাকার দামের জিনিস কিনতে আসে নি, এসেছে ইমোশন কিনতে, মীরার ব্র্যান্ড কিনতে, ধ্বংস করতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
নিলাম ঘোষণাকারী ডাক দেন-
৭০ লক্ষ্য এক
৭০ লক্ষ্য দুই
এমন সময় নাটকীয়ভাবে হলরুমে প্রবেশ করে মীরা।
৭০ লক্ষ্য তিন বলার আগেই মীরা বলে উঠে-
৭৫ লক্ষ।
পুরো ঘরভর্তি মানুষ মেয়েলি গলার স্বরে পেছন ফিরে তাকায়। এতক্ষণে মোখলেস চাচাও মাথা তুলে দেখেন সেই কন্ঠস্বরের উৎসের দিকে। ঘরভর্তি সকলের দৃষ্টি মীরার দিকে, কেবল একজন ছাড়া, আর সে হচ্ছে রাজিব। মিলনের কপালে বিরক্তির ভাজ পরে মীরাকে দেখে। মনে মনে বলে- “এ আবার এলো কোত্থেকে? ”
৭৫ লাখের বেশী আর দাম কে দিবে?
নিলাম ঘোষণাকারী আবারো ডেস্কে চাপড় দিয়ে বলে –
৭৫ লক্ষ্য এক
৭৫ লক্ষ্য দুই
এমন সময় সুমন বলে উঠে ৭৭ লক্ষ।
মীরা এক মূহুর্ত না ভেবে বলে ৮০ লক্ষ। এবার সুমন
বলে ৮৫ লক্ষ্য। মীরা আবারো ক্ষণকালও ব্যায় না করে বলে ৯০ লক্ষ। পুরো হল ভর্তি মানুষ অবাক হয়ে একবার সুমনকে দেখে তো আরেকবার মীরাকে৷ সুমন বিরক্ত হয়, এই ছাতার কারখানা কিনতে ৯০ লক্ষ? হুহ্ ৯০ লক্ষ দিয়ে এমন কারখানা তিনটা দেয়া যাবে। এসব ভেবে চেপে যায় সুমন।
নিলাম ঘোষনাকরী বলেন-
৯০ লক্ষ্য এক
৯০ লক্ষ্য দুই
৯০ লক্ষ্য তিন
অভিনন্দন আপনাকে, আজ থেকে মীরা ফ্যাশনের মালিক হচ্ছেন, নাম কি আপনার? মীরার হাত থেকে আসা আবেদনপত্র তার কাছে পৌঁছালে নাম দেখতে কাগজে চোখ বুলায় সে। তারপর একবার কাগজ দেখে তো আরেকবার মীরাকে। তারপর বিষ্ময় চেপে তিনি আবারো বলেন-
আজ থেকে মীরা ফ্যাশনের মালিক হচ্ছেন “জিনিয়া আবেদীন মীরা”
মুখলেস চাচা অস্ফুটস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে চোখের পানি ছেড়ে দেন। আর মীরা দাঁড়ানো থেকে বসে পরে একটা চেয়ার টেনে। টুম্পা ওর বসে পরার ভাঙ্গি দেখে বলে- “অভিনন্দন আপা”
মীরা ফ্যালফ্যাল করে টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে- “আলহামদুলিল্লাহ”
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
নিলাম সম্পন্ন হওয়ার পর ধীরে ধীরে সকলে চলে যায়। সভাপতি পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে। বাম দিকের কলামে থাকা মিলন, রাজিব বসে আছে, ওদের দুই সারি পেছনে বসে সুমন। মিলন বারবার অস্থিরতার মধ্যে উঠছে আর বসছে, দুএকবার চোখ রাঙানিও দেখিয়েছে সুমনকে। সেই চোখ রাঙানি দেখার পর হতে অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে বসে আছে সুমন, ব্যাপারটা দূর থেকে লক্ষ্য করে টুম্পা। এদিকে রাজিব এখনো চেয়ারের দুই পাশে দুই হাত দিয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে অবনত মস্তকে। জীর্ণ শরীর মন মাথাটুকু তুলে রাখার শক্তি সরবারহে ব্যার্থ আজ।
ডানদিকের কলামে থাকা মীরা বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। “মীরা ফ্যাশন” – এর নিলাম ডাকার খবর শোনার পর থেকে গত কয়েকটা দিন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে ওর। কেবলমাত্র একটা দিকেই ফোকাস ছিলো ওর- বেদখল যেন না হয় ওর পরিশ্রম, রক্ত, ঘামে তৈরি “মীরা ফ্যাশন”। চারপাশে কি হচ্ছে তার কোন হুশ ছিলোনা ওর। একটা তুমুল ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে এ কয়দিনে, ডি*ভো*র্সের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন কিছু ছিলো না ওর জন্য, কঠিন যা ছিলো তা হচ্ছে রাজিবের মুখোমুখি হওয়া। যাকে ভালোবেসে সাঁতার না জানা মীরা জীবণ সমুদ্র পাড়ি দিতে ঘর ছেড়েছে, ঝড়, ঝাপটা বিপদ মোকাবিলা করে আগলে রেখেছে রাজিবকে, প্রতিকূলতায় অকুল সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ভেবেছে ওকে নিয়েই এই অকূল পাথার পাড়ি দিয়ে তীরে উঠবে একদিন। সে কিন্তু ওকে মনে রাখেনি, সে মীরার বিশ্বাস ভেঙে মিথ্যে মরিচীকার লোভে অকূল সমুদ্রে মীরার হাত ছেড়ে ধরেছে অন্য হাত, অন্য ঠাঁই।
জীবণ মীরাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। সবগুলো পরিস্থিতিই মীরা সামাল দিয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে, কিন্তু বিশ্বাস ভাঙা এই মানুষটার মুখোমুখি হয়ে ঐ সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্তের মতো মানসিক চাপ এর আগে ও কখনো ফেইস করেনি। কিন্তু এবারও মীরা পেরেছে দৃঢ়তার সাথে সেটা করতে। কিন্তু ভিতর থেকে কতটুকু গুড়িয়ে গেছে তা কেও জানবে না। কেও জানবে না মুখের হাসির নিচে লুকানো আছে কান্না, কেও জানবেনা ঐ কাজল দেয়া চোখের নিচে সেই কান্নারই জল শুকানোর রেখা লুকিনো আছে। বুকের বা পাশে যে হৃদয়টা তাকে যে কত কত বার রিফুর সূচের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়াটা আজ বড্ড কষ্টের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঝড় ওকে সামাল দিতে হয়েছে একা হাতে, কারন ওকে জানার পথ ও নিজে মুছে দিয়েছে অনেক আগে, আর যতদিনে হুশ ফিরেছে ওর ততোদিনে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ভুলের রাজ্যে।
——–
বসুন্ধরা শপিং মলে নতুন দোকান নেবার জন্য কিছু টাকা ওর ক্যাশ ছিলো। দোকান না নেয়ায় সে টাকাগুলো ক্যাশই ছিলো। তবে সেখান থেকে বেশ কিছু টাকা ফ্ল্যাট বন্ধকীদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট ফিরিয়ে আনতে খরচ হয়েছিল। ওর নিজের যত গহনা ছিলো সব বিক্রি করে দিয়েছিলো একদিনের মধ্যে। দাম ভালোই পেয়েছে তাঁতীবাজারে পরিচিত লোক থাকায়। অর্ধেকের বেশী টাকার টান ছিলো তখনো।
কার কাছে চাইবে ও এতগুলো টাকা?
কে পারবে দিতে? এই প্রশ্ন মনে আসতেই বেশ কয়েকজনের কথা মাথায় এসেছিলো। খবর পেয়ে
সেদিন রাতে পাভেল ওর নিজের তাগাদায় পাওয়া সব টাকা দিয়েছিলো, সবমিলিয়ে সাত লক্ষ টাকা ছিলো ওখানে। মাজেদা খালার তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি বিক্রির আড়াই লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিলেন মীরার হাতে। তারপরও অনেক টাকা বাকী। মীরা প্রথমেই ভেবেছে তারা যেহেতু কোটির কাছাকাছি টাকা পাওনা হয়েছে রাজিবের কাছে, তাই কারখানার সম্ভাব্য দাম কোটি পর্যন্ত উঠবে৷ সে হিসেবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু বিকাল অবধি সবার সব টাকা মিলিয়ে যা হয়েছিলো তাতেও ঐ অংক পূরণ হয় নি। মোখলেস চাচা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। মীরা বলেছে একটু চেষ্টা করি চাচা, না পারলে আপনি তো রইলেনই, পরে নাহয় জানাবো আপনাকে।
মীরা কোন মতোই মুখলেস চাচার থেকে টাকাটা নিতে চায়নি, কারন তিনি এখন কেবল ওর ব্যাবসয়িক প্রতিবেশী , প্রতিদ্বন্দ্বীই না, তিনি এখন ইরার শ্বশুরও।
উপায় না দেখে মীরা কল করে লোরাকে। মীরার রাহাতের সূত্রে পরিচিত হয়েছিল লোরার সাথে, কিন্তু রাহাতের চেয়ে লোরা এখন বেশী ক্লোজ ওর, এত বছরের জানাশোনায় দুজনেই দুজনের নাড়িনক্ষত্র সব জানে। এমনকি সাথীদের গ্রামের বাড়িতে যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিলো লন্ডন থেকে সেই ফেইক সম্বন্ধের পাত্রও লোরার ভাই রাকিন ছিলো। ওদের প্ল্যান ছিলো লন্ডনি পাত্রের লোভে পরা সাথীর আসল চেহারা উদ্ঘাটন করা। কিন্তু ও যে আগেই উদ্ঘাটিত হয়ে বসে আছে সাকলায়েনের কাছে তা তো আর ওরা জানতো না। সাকলায়েন জাত গুন্ডা, রাজিবকে ছেড়ে দেয়া সহজ হলেও সাকলায়েনের চোখে ফাঁকি দিয়ে রাকিনকে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না ওর জন্য। ওদের প্ল্যান এটা হলে কি হবে, ইশ্বরতো এরচেয়ে নিখুঁত প্ল্যান সাজিয়ে রেখেছিলেন সৃষ্টির শুরুর দিন থেকেই। তাইতো হাতে-নাতে নিজ গৃহেই উন্মোচিত হলো প্রিয়তমা স্ত্রীর আসল রূপ।
তো মীরা লোরার কাছে ধার চায়নি। সবটা খুলে বলে নিজের ধ্বংসপ্রায় বিজনেসের জন্য ইনভেস্টর হতে বলেছিলো লোরাকে। লোরা মীরাকে পছন্দ করে ওর সৎ, পরিশ্রমী আর কর্মঠ, গুণের জন্য। লোরা বলেছে আমি এসব বিজনেসের কিছু বুঝিনা, কত লাগবে বলো সবটা আমার কাছে না থাকলেও দেশ থেকে ম্যানেজ করে দিচ্ছি। মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে টাকাটা তুমি ধার হিসেবে দিলেও আমি ইনভেস্টর হিসেবেই নিবো।
পরে লোরা রাহাতের সাথে কথা বলে জানাবে বলে ফোন রেখে দেয়। মীরা ভাবে ঠিক কাজটাই করেছে ও। যারা না চাইতেই অনেক দেয়, তাদের কাছ থেকে হাত পেতে নিতে সংকোচ হয়।
একঘন্টা পর কল আসে লোরার। টাকা পাঠাবে ও মীরার একাউন্টে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টাকাটা ঢুকবে দুদিন পর। কিন্তু টাকাটা আগামীকালই লাগবে। উপায়ন্তর না পেয়ে লোরা কোনভাবে বাংলাদেশ থেকেই ম্যানেজ করে টাকাগুলো। কিছু টাকা মীরাও ধার করে পরিচিত জনদের থেকে। সবমিলিয়ে পুরো টাকার জোগাড় রীতিমতো হুলুস্থুল একটা কান্ড ছিলো ওদের জন্য। কারো নাওয়া নাই খাওয়া নাই একটাই টেনশন শেষ পর্যন্ত পারবে তো। সেদিন রাতেও মীরা শেষ পর্যন্ত পারবে কি না এমন দোটানা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিল। রাজীব নামের মানুষটা তো আটপৌরে অসুখ ওর। নতুন এই চাপ নিয়ে বেঁচে যে ছিলো এই এক আচ্শর্যের বিষয়। সব কাগজপত্র নিয়ে চেক দিয়ে মীরা আর টুম্পার বেরুবার সময় মীরা মিলনের কাছটায় থমকে দাঁড়ায়। টুম্পা বুঝতে পারে না ওর দাঁড়ানোর কারন। একটু যেন অবাক হয় মীরার এমন থমকে যাওয়ায়। মিলনের চোখে চোখ রেখে মীরা বলে
: “আমি আসলে একজনের সাথে জিততে এসেছিলাম, ফিরলাম দুজনের কাছে জিতে। আমার বাবা বলতেন- ‘প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়’ ছোটবেলায় এ কাথার অর্থ না বুঝলেও আজ এই কথার মর্ম আমার কাছে পরিষ্কার। আপনাকে আমার মনে থাকবে মিলন ভাই, সাবধানে থাকবেন”
বলেই গটগট করে বেরিয়ে পরে মীরা, রাজিব তখনো অবনত মস্তকে নিচে তাকানো৷ এত বছর ধরে অবহেলা করা মীরার দিকে তাকানোর শক্তি, সাহস কোনটাই ওর নেই আজ। আর মিলন মুষ্টিবদ্ধ হাত দেয়ালে আঘাত করে, মিলনের কানে বাজতে থাকে মীরার শেষ কথাটা “আপনাকে আমার মনে থাকবে মিলন ভাই, সাবধানে থাকবেন”। এত বড় সাহস ওর, একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে বলে গেলো এ এমন কথা!
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সমিতির অফিস থেকে বেড়িয়ে সবগুলো কাগজপত্রের ফটোকপি করে মীরা। এদিকটায় কমার্শিয়াল স্পেস হওয়ায় প্রচুর ভীড় হয় দোকান গুলোতে। টুম্পা পরে করার কথা বললেও মীরা ওর কথা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কাজ শেষ হতে বেশ কিছু সময় চলে যায়। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ধরে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাসায় ফিরবার পথে রিকশায় বসে টুম্পা মীরার সাথে কথা বলার ফুরসত পেলো যেন। ও মীরাকে জিজ্ঞেস করলো-
: “আপা মিলন ভাইয়ের সাথে এভাবে কেন কথা বললেন আপনি? “দুজনের কাছে জিতে যাওয়া”
আর “প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মানে কি এসব কথার?
টুম্পার এমন জিজ্ঞাসায় কোন হেলদোল নেই মীরার। ও যেন টুম্পার এতগুলো কথার কিছুই শুনেনি। টুম্পা মীরার হাতটা ধরে। দেখে মীরা কাঁপছে। চকিত কন্ঠে টুম্পা বলে-
: আপা! আপনার কি খারাপ লাগছে?
বেশ কিছু সময় মৌন থাকে মীরা। টুম্পা ওর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর দিকে মুখ ফিরায় মীরার, ধ্যান ভঙ্গের মতো দৃষ্টিতে তাকায় ও টুম্পার দিকে। তারপর স্মিত হেসে বলে-
: নারে, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
টুম্পা ওর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে ওর কোলে এনে বলে-
: জানি আপা কিসের ভিতর দিয়ে যে গেলেন আপনি, আল্লাহ সহায় ছিলো বলে। এমন অবস্থায় আমি থাকলে ফিট হয়ে যেতাম।
মীরার অধরে বক্র হাসি ফুটে উঠলো।
টুম্পা বললো-
: “সত্যি! ”
মীরা নিজের হাত নিজের কাছে ফিরিয়ে এনে বললো –
: আমি সবটা ওকে কেন দিয়ে এসেছিলাম জানিস? শুধু ওকে বোঝানোর জন্য আমি কত শক্ত, আর ও কত্ত ভঙ্গুর!
কিছু সময় মৌন থেকে মীরা, তারপর আবারও বলে-
: তুই জিজ্ঞেস করলি না- “দুজনের কাছে জিতে যাওয়া” আর “প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মানে কি এসব কথার?
অবাক হয় টুম্পা, ও ভেবেছিলো মীরা অন্যমনস্কতায় শুনতে পায়নি এসব। তারপর মীরা বলে-
: মুখলেস চাচা নিলামে জমা হওয়া পেপারস্ দেখে আমাকে আগেই জানিয়েছিল মিলনের অভিসন্ধির কথা। প্রথমটায় তিনিও বুঝতে পারেন নি, মিলনের ভাই সুমনের নামে কাগজপত্র থাকার দরুন। পরে সিকিউরিটি পার্সন আর নমিনির নাম দেখে অবাক হন মুখলেস চাচা, তিনি সুমনকে জিজ্ঞেস করে মিলন ওর কে হয়? সুমন গর্বের সঙ্গে মিলনের পরিচয় দেয়। প্রথম ধাক্কাটা সামলে তিনি ব্যাবসায়িক অভিজ্ঞতার আলাপ সূত্রে জানতে পারে সুমন একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সরল সুমন এখানে যে ভায়া হয়ে নিলামে এসেছে তাও চাচাকে বলে অকপটে। বেচারা!
মুখলেস চাচা কে? তা মিলন জানলেও সুমনের তা জানার কথা না। ও কর্পোরেট ভুবনের বাসিন্দা। ঐ যে একটা কথা আছে না “মানুষ যতই পা ধরে টেনে নিচে নামাতে চাক, খোদা যদি মাথা ধরে উপরে উঠায় কারো সাধ্য নাই ক্ষতি করার”
তখন আমার কাছে পরিষ্কার হয় মিলনের ওর প্রতি হঠাৎ এমন উদার হওয়ার কারন। সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হলে মাথায় রক্ত উঠে যায়, যে ব্যাবসাটাকে এলেবেলে ভাবে রক্ষা করতে চাইলাম, সেটা হয়ে গেলো জীবণ ম*র*ণের ব্যাপার। মরিয়া হয়ে গেলাম এটাকে বাঁচাতে। এজন্যই তখন বলেছিলাম-
“প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মিলনের ব্যাপারটা না জানলে হয়তো এতটা মরিয়া হতাম না এটাকে রক্ষা করবার, আর “দুজনের কাছে জিতে যাওয়ার ব্যাপারটা তো বুঝেছিস-ই”
টুম্পা এসবের কিছুই জানতো না, তবে কাছ থেকে যখন মীরাকে দেখেছে বেশ কয়েকবার ও বলতে চেয়েছে – “অনেক হইছে আপা, বাদ দেন। আল্লাহ চাইলে এরচেয়ে বড় কারখানা হবে ভবিষ্যতে
আমাদের” কিন্তু এমন দৃঢ়তা, চেষ্টা, “মীরা ফ্যাশন”-এর প্রতি অপত্য আবেগ দেখে বলার সাহস হয়নি টুম্পার। এমন ভাবনার ছেদ পরলো মীরার কথায়-
: জীবণে কষ্ট তো খোদা কম দিলো না, এ কয়দিনে আমি কেবল একটাই দোয়া করেছি- ” আমার কষ্টে গড়া সম্পদ রক্ষার সামর্থ্য তুমি আমাকে দাও”
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আমাকে তা দিয়েছেন।
ভাঙা রাস্তায় বর্ষার বৃষ্টির দরুন আরো নাকাল অবস্থা। ওদের রিকশাটা একটা গর্তকে পাশ কেটে পেরুতে গিয়ে ডান দিকে ওভারটেকিং করলো। সরু গলিটায় উল্টোদিকের ব্যাটারি চালিত রিকশার দ্রুত আগমনে ড্রাইভার ভড়কে সাইড করতে গিয়ে ঐ রিকশার সাথে খেলো ধাক্কা। মীরা পরে যেতে লাগলো। ও শক্ত হাতে রিকশার হুড ধরে কোনমতে বসলো। দুই রিকশার সংঘর্ষে অপর রিকশাওয়ালা গালাগাল শুরু করলো ওদের ড্রাইভারের। মীরা বুঝলো দোষ ওদের রিকশার ড্রাইভারেরই । তাই কোন মতে কাটিয়ে দিতে লাগলো ড্রাইভারের হয়ে ক্ষমা চেয়ে। অপর রিকশার ভদ্রলোক তার ড্রাইভারকে বুঝিয়ে চালাতে বললেন। তার দুটো কথা শোনানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা এড়িয়ে গেলেন। এমনকি তাকালেন না পর্যন্ত ওদের রিকশার দিকে। মীরার লোকটার এমন অগ্রাহ্য করার ব্যাপারটা কেমন যেন বুকে বিঁধলো, কি মনে করে যেন মনে পরলো আবীরের কথা। আবীরও তো এমনি ভাবে অগ্রাহ্য করেছে মীরার অপরাধকে। ডি*ভো*র্সের দিন সামনাসামনি আসেনি পর্যন্ত। সেদিন ওর মুখ খুলে কিছু বলা লাগতো না, সেদিন ওদের মুখোমুখি হওয়াটাই অনেক কিছু বলা হতো মীরাকে।
মীরা কী শক্ত? এমন মানুষগুলো ওর চেয়ে ঢের শক্তিশালী। ভাবনার ছেদ পরে রিকশা থামলে। বাসায় পৌঁছে গেছে ওরা, রিকশা থেকে নেমে অল্প বয়সী ড্রাইভারকে মীরা বলে-
: “দেখেশুনে গাড়ি চালাবে, তুমি রাস্তায় বেরুলে বাড়িতে পরিবার তোমার ফিরবার অপেক্ষায় থাকে”
ছেলেটা লাজুক হাসি হেসে মাথা চুলকায়, এ হাসিতে ওর করা অপরাধের স্বীকারক্তি লুকানো যেন। । মীরা ভাড়া দিয়ে নেমে গেলো বাড়ির সামনে।
বাসায় ফিরে মনে পরে রান্নাবান্নার কোন খবর নাই, মীরা ভুলেই গেছে বাসায় গ্যাস কেটে নিয়ে গেছে আজ সকালে। “অভগা যেখানে যায় দড়িয়া শুকায়ে যায়” দ্রুত ব্যাগ থেকে খুচরা টাকা বের করে মাজেদা খালাকে বলেন বাইরে থেকে খাবার আনতে। মাজেদা খালা ভাবলেশহীন ভাবে হাম তুলে বলেন-
: “মুখলেস চাচা দিয়া গেছে খাওন, আপনে ফেরেশ হন, আমি খাওন দেই” মীরা যখন ঐ অফিস থেকে বের হয় তখন সন্ধ্যা সাতটা, মুখলেস চাচা তখনো ওখানে ছিলো। এখন রাত নয়টা বাজে, এরিমধ্য তিনি বাড়ি ফিরে খাবার নিয়ে, তা পৌঁছেও দিয়েছেন এ বাড়িতে! মীরা একটুও অবাক হয় না লোকটার এমন ম্যাজিকে।
গোসল সেরে খাবার খায় মীরা, তারপর ফোনগুলো বন্ধ করে ঘুমাতে যায় ও। নূহাও যেন ওর মায়ের ক্লান্তি টের পেলো। কোন রকম বিরক্ত না করে আজ দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরলো মায়ের পাশে। এত দ্রুত ঘুম এসে পরলো যে ঘরের বাতি জ্বালানো তা টেরই পেলো না মীরা। টুম্পা বাথরুমে যেতে এসে বাতি নিভিয়ে দিয়ে যায় অনেক পরে।
যখন মীরার সেই গভীর ঘুম ভাঙে তখন ভোর পাঁচটা। মীরার সারা শরীর ব্যাথায় অবশের মতো মনে হয়, মুখে কেমন সিদ্ধ সিদ্ধ ভাব, পানি মুখে দিলে পানির স্বাদ ও অন্যরকম লাগে। গায়ের তাপ না পরখ করেও মীরা বুঝলো ওর গায়ে ভীষণ জ্বর! এতদিনকার চিন্তা, পেরেশানি, দৌড়াদৌড়ির সমষ্টি যেন এ জ্বর। বাথরুমে যেতে উঠতে চেষ্টা করে দেখে ও মাথাই তুলতে পারছেনা। অনেক কষ্টে, বাথরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পরে। বিছানায় যাওয়ার পরপরই ভীষণ জ্বরে কাবু হয়ে কেমন অচেতন হয়ে যায় ও।
———-
পরদিন শুক্রবার,
এ বাড়িতে শুক্রবার মানে রান্নার তোরজোর। সপ্তাহের একটা দিন দুপুরে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ পায়। অন্যান্য দিন গুলোতে খাবার পৌঁছে যায় যার যার ঠিকানায়। ওদের আগের বাড়ির দারওয়ান যে ছিলো, বাড়ি মেট্রোরেলের জন্য সরকারকে দিয়ে দিলে তার চাকরীটা চলে যায়, বাড়িই নেই, দারওয়ান দিয়ে কি হবে? কিন্তু এ বুড়ো মানুষাটর গতি কি হবে ভেবে মোখলেস চাচা রেখে দেন তাকে, তবে তার এখনকার কাজ হচ্ছে চাচা আর তার চার পুত্রের দুপুরের খাবার পৌঁছে দেয়া, বাড়ির বাজার সদাই করা, আর সপ্তাহে একদিন গ্রাম থেকে খাঁটি দুধ আর সরিষার তেল আনা।
আজও রান্নার তোরজোর, তবে চাপটা একটু বেশী। মোখলেস চাচার এক মেয়ে আছে, তার বাড়িতে গ্যাস লাইন কেটে যাওয়ায় খাবার দিতে হবে সেই বাড়িতে। ইরা রান্নার সময় শ্বাশুড়ির কাছেকাছে থাকে। এটা-ওটা করে দেয়, রান্না শিখে, এটা কেন হলো, ওটা কেন করলেন, এটা কিভাবে করলেন এসব প্রশ্নে মাতিয়ে রাখতো। এখন প্রশ্নের পরিমান একটু কমেছে৷ শ্বাশুড়ি কোন কাজে এদিকসেদিক গেলে ও চুলোর সামনে দাঁড়ায়। ভারপ্রাপ্ত গিন্নী সাজা আরকি!
এমনি ইরাকে রান্নাঘরে একা পেয়ে মুরসালিন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখ ঘঁষে ওর ঘাড়ে। এমন অতর্কিক আক্রমণের চোটে ইরার হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিতলের খুন্তিটা পরে যায়। ঝনঝন শব্দে মুরসালিনের মা ঘর থেকেই পান মুখে হাঁক দেন- “কি হলো বৌমা?”
মুরসালিন ইরার ঘাড়ে একটা চুমু খেয়ে ভদ্রলোকের মতো গটগট করে নিজের ঘরে চলে যায়। ইরা খুন্তি তুলে সিঙ্কে ধুতে ধুতে বলে -“কিছু না মা বিড়াল আসছিলো”
ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকা ঘরে বসা অবস্থায় মুখ বাঁকিয়ে বলেন- “বিড়াল!?”
মুরসালিন ‘বিড়াল’ কথাটা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইরার দিকে, ইরা খুন্তি উঁচিয়ে ওকে মার দেয়ার ভঙ্গি করে হেসে দেয়। মুরসালিন এদিকে আবার আসবে ভাবতেই ওর মাকে দেখে নিজের ঘরে চলে যায়। তিনি রান্নাঘরে পৌঁছে বলেন-
:”বিড়াল আসলো কোত্থেকে? হ্যা, এ বাড়িতে তো বিড়াল আসে না কখনো”
ইরা কি বলবে ভাবতেই মোখলেস সাহেব রান্নাঘরে আসেন তার গোসলের গরম পানি চাইতে। ইরা তার গরম পানি দিতে বাথরুমে যায় বালতি আনতে। এ যাত্রায় গরম পানি ইরাকে মিথ্যা বলা থেকে বাঁচালো।
ঘরে এসে মুরসালিনের দিকে তেড়ে যায় ও, আর মুরসালিন ওকে জাপটে ধরে বলে-
: ” আমি বিড়াল?”
: “বিড়াল তা নয়তো কি? কেমন স্বভাব খোদা খোদা, সময় নাই অসময় নাই এসব কি হুম? ”
: “এসব হচ্ছে বৌকে আদর করা, কিপ্টা তুমি এসবের কি বুঝবা?”
: “আমি কিপ্টা না?”
: “না তো কি? আমার দিকে তোমার কোন খেয়াল আছে? সারাদিন সারা বাড়ি ঘুরো, একটা দিন বাড়ি থাকি একটু স্বামী সেবা করবা কি উল্টো আমি স্ত্রী-সেবা করলে বিড়াল, টিড়াল কি সব হাবিজাবি বলো”
: ” ওরে আমার বৌ-সেবক স্বামীরে। আপনার সেবা পেয়ে আমি ধন্য। যখন তখন জাপটে ধরা, এদিক সেদিক চুমু খাওয়া, চুলের খোঁপার কাঠি টেনে চুল খুলে ফেলা, ওড়না ধরে টান দেয়া এগুলো কি স্ত্রী-সেবার নমুনা?”
মুরসালিন ওর ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ফিসফিস করে বলে-
: “এগুলো তাহলে কি?”
: ” এগুলো সেবা না, এগুলো হচ্ছে আমাকে পাগল করার নমুনা”
তড়াক করে তাকায় মুরসালিন ইরার দিকে, বলে-
: “পাগল হও তুমি? হুহ্ পাথর গলে তবু তুমি গলো না”
ইরা হেসে বলে-
: “সত্যি তো?”
: “সত্যি নয়তো কি?, এই যে যখন সুযোগ পাই
এত ভালোবাসা দিই, তুমি তার শোধ দাও? সব পাওনা রাতের খাতায় তুলে রাখো”
ইরা ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাটে বসায় ওকে। তারপর হঠাৎ মুরসালিনের দুই কানে দুই হাত রেখে কিছু বলবার ভঙ্গি করে মুখ কাছে নিয়ে – গভীর এক চুমু আঁকে মুরসালিনের ঠোঁটে। তারপর মুরসালিনকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালায় ঘর থেকে।
ইরা রান্নাঘরে গেলে দেখে শাকগুলো কুটা বাকী। সেগুলো নিয়ে বসে পরে ও। হাইডোজ ওষুধ পরেছে মুরসালিনের উপর, এখন আর এদিকে আসবে না। তাই কাজে মন দিলো ও। এমন সময় ইরাকে দেখে মুখলেস সাহেব রান্নাঘরের কাছটায় টুল নিয়ে শাক বেছে দিতে বসেন। এ কাজটা তিনি বরাবর যত্নের সাথে করেন। ইরা প্রথম যখন এ বাড়িতে এলো তখন তো জানতোনা যে তিনি এ কাজটা তার স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে করেন। ও আসার পর থেকে দুজন মিলে করে এ কাজটা। শাক এ বাড়ির সকলের পছন্দের খাবার৷ এমন কোন দিন নাই যে শাক রান্না হয় না এ বাড়িতে। শাক কাটতে কাটতে শ্বশুর পুত্রবধূ গল্প করে। আজ ইরার কৌতুহল ওর শ্বশুরের মুখ বোলা মেয়েকে নিয়ে। মোখলেস সাহেব প্রথমটায় ভেবেছিলো এড়িয়ে যাবে ব্যাপারটা। পরে কি মনে করে যেন একেবারে শুরু থেকে শুরু করে মেয়ে না থাকা মোখলেসের পাতানো মেয়ের গল্প-
তিনি শুরু করেন-
সেই মেয়ের বাড়ি পালানো,
বিয়ে করা স্বামীকে ডিভোর্স না দিয়ে আরেকজনের হাত ধরে বেরিয়ে পরা।
প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স।
দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সংসার শুরু।
এ পর্যন্ত শুনে অবাক হয় ইরা, এতো ওর বোন মীরার গল্পের সাথে পুরো মিল। ইরার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় এ পর্যন্ত শুনে। তারপর ওর গল্পবাজ শ্বশুর নাটকীয় ভঙ্গিতে গল্পের পরের অংশ বলে যান। ইরার সন্দেহ সঠিক হলেও এ গল্পের দ্বিতীয় অংশ ইরার অজানা থাকায় ফ্যাকাশে ভাব দ্রুত মুছে যায়।
তারপর মোখলেস সাহেব –
তার মেয়ের দ্বিতীয় স্বামীর কাজ না থাকায় গায়ের গয়না বিক্রি করে সংসার চালানো, হঠাৎ ঝড়ের মতো আসা ওর স্বামীর অসুখ, শূন্য হাতে কোন পরিবারের সাহায্য ছাড়াই ব্যায়বহুল সেই চিকিৎসায় ঐ মেয়ের ভূমিকা, অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করা, পায়ের নিচে মাটি করার জন্য পরিশ্রম শুরু করা, জীবণে পানি ঢেলে না খাওয়া মেয়ের এতগুলো মানুষকে রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো, কারখানার দেখাশোনা করা। দুটো মেশিন থেকে বিরাট কারখানায় রূপান্তর সবটা বলে যায় ক্রমানুসারে। এ যেন কোন রূপকথার গল্প। দুঃখের পরে সুখের প্রতিচ্ছবি। এমনটাই তো হয় গল্পে।
এরপরে কি হতে পারে? মোখলেস সাহেব প্রশ্ন ছুড়ে দেন পুত্রবধূ ইরার কাছে-
ইরা হাসিমুখে বলে- “তারপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিলো….”
মোখলেস সাহেব ম্লান মুখে মাথা নিচু করে ফেলেন। তাকে দেখে ইরা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে মন খারাপ হওয়ার মতো এমন কিছু তো ও বলেনি। তাহলে…
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে ইরা। শাক বাছা শেষের দিকে তখন। তারপর তিনি শুরু করেন এ গল্পে তৃতীয় অংশ। যে অংশে দায়িত্বহীনতা, অবি*শ্বাস, প্র*তা*রণা, জা*লি*য়াতি, নোং*রা*মিতে ভরপুর। ওর স্বামীর সংসারের কোন দায়িত্ব পালন না করা, দেরি করে বাড়ি ফেরা, ম*দ, জু*য়া, মেয়ে মানুষ নিয়ে মেতে থাকার গল্পগুলো বলে যান একে একে। ইরা স্তব্ধ হয়ে শুনে সবটা। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো যখন মোখলেস সাহেব ঐ মেয়ের স্বামীর গোপনে ২য় বিয়ের কথা শোনে ইরা চোখের পানি যেন আর বাঁধ মানে না, কেঁদে ফেলে ইরা৷ এই প্রথম বার মুখ খুলে বলে-
” ঐ জা*নো*য়ারটাকে গু*লি করে মা*রে না কেন সে? ”
এটা শুনে বক্র হাসি হাসেন তিনি, বলেন এখানেই শেষ না মা-জননী। গল্প আরো অনেক বাকী। মেয়ে হওয়ার পর মেয়েটা ওর স্বামীকে ব্যাবসার পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। তখনো তো জানতো না ওর এ কাহিনি, আর ওর অ*মা*নুষ স্বামী – এ সুযোগে নিজের নামে সব লিখে নেয় বৌর কাছ থেকে। দুইদিকেই সংসার মেন্টেইন করে চলে সুন্দর মতো। স্বামীর ২য় বিয়ের আড়াই বছর পর সবটা জানতে পারে ও। তারপর ধীরে ধীরে গুছাতে থাকে নিজেকে। সবটা মেনে নিয়েছে ও, দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা, খারাপ চ*রিত্র, অমিতব্যায়ীতা সব, কিন্তু ওর ২য় বিয়ে মেনে নেয়াটা কষ্টের ছিলো ওর জন্য। এরপর ওর ঘুরে দাঁড়ানো, নিজের ব্যাবসা শুরু করা, ঐ প্রতারকের প্রতারিত হওয়া, জেলে যাওয়া সবটা বলেন তিনি। এমনকি দেনার দায়ে কারখানার নিলাম ডাক, সে নিলামে ঐ মেয়ের নিলামে জিতে হারানো ব্যাবসা নিজের অধিনে ফিরিয়ে আনা মোটকথা গতকাল অবধি সবটা সারমর্ম করে বলেন তিনি।
এ পর্যন্ত শুনে ইরার মুখে হাসি ফুটে। তারপর বলে-
: “ঐ হা*রা*মীটা*কে ডিভোর্স দেয় নি এখনো? ”
: “হুম, গতকাল নিলাম ছিলো তার আগেরদিন ডি*ভো*র্স দেয় ও তাকে। ”
মাশাল্লাহ এই মেয়ের মনের জোর আছে বাবা, তার জন্য দোয়া রইলো মন থেকে।
: “মেয়েটা এখন বড় একা, আপনজন বলতে আড়াই বছরের মেয়ে ছাড়া কেও নেই”
: “কেন তার বাবা মা?”
: “তারা ওকে মেনে নেয় নি, এমনকি বাবার লা*শ*টাও দেখতে দেয়া হয়নি ওকে”
: “এত কঠোর মানুষ হয়! আহারে মেয়েটা তো তাহলে জনম দুঃখী”
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন মোখলেস সাহেব, বলে- একবার ভাবো তো আত্মীয়পরিজনহীন একটা মেয়ে আর ওর আড়াই বছরের বাচ্চা, কিভাবে ও পাড়ি দিবে বাকী জীবণ”
: “বাবা আমি ভাবতেই পারছি না, ঐ মেয়ের পরিবারের উচিত ওকে ক্ষমা করে দেয়া, ভুল যা করেছে তার শাস্তি উনি পেয়েছেন”
কথাটা মনপুত হয় মোখলেস সাহেবের। তারপর ম্লান হেসে বলেন- “পরিবার ওকে মানবে না কখনো, অথচ মেয়েটা আড়ালে আবডালে ওর পরিবারকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছে। বোনের ভালো বিয়ে দিয়েছে, ছোট ভাইটাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করছে”
: ” আমার মনে হয় না সবটা জানলে কারো পক্ষে তার উপর এখনো অভিমান করা সম্ভব”
: “কি জানি কি আছে কপালে”
: “তাকে একদিন আসতে বলেন না আমাদের বাড়িতে, কাছ থেকে তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ”
মুচকি হেসে তিনি বলেন-
: “ও এ বাড়িতে আসবে না কোনদিন, তুমি যাবে ওকে দেখতে? ”
ইরা এমন দাওয়াতে অপ্রস্তুত অনুভব করে, মনে মনে বলে- “কেন আসবেন না উনি এ বাড়িতে?”
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সেদিন দুুরের খাবার দিতে গিয়ে মোখলেস সাহেব দেখেন মীরা অসুস্থ। জ্বরে কাতর মেয়েটা অচেতন অবস্থায় পরে আছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে টুম্পা বলে-
: “বিকেলে ডাক্তারের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে”
মোখলেস সাহেব মীরার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলায়, চোখ মেলে মীরা, অচেতন অবস্থায়ই ডেকে উঠে-
: “বাবা!”
জীর্ণ শরীরের জীর্ণতা চোখ অবধি পৌছে গেছে যেন। ফ্যাকাশে, পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে মীরা মোখলেস চাচার দিকে। প্রাণশক্তিপূর্ণ মেয়েটার এমন দৃষ্টিতে কেমন যেন মুষড়ে পরেন তিনি, একটু পরে পানি এসে পরে তার চোখে। অচেতন মীরা ভাবছে বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মীরা আবারো ডাক দেয়-
: “বাবা, তুমি এসেছো? ”
চোখ মুছে মোখলেস সাহেব বলেন-
: “হ মা, আমি আইছি, কোন ডর নাইক্কা তোমার”
তারপর আবারো তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো নিশ্চুপ হয়ে যায় মীরা”
চোখ মুছে মোখলেস সাহেব মাজেদা খালাকে বলেন-
: ” ওর যা অবস্থা, বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হইবো না”
মাজেদা খালা উদ্বেগের সাথে বলেন-
: “শুক্রবার তো সবার ছুটি, আমরা দুইটা মাইয়্যা মানুষ হেরে কমনে নিমু হাসপাতালে? ”
মোখলেস সাহেব ফোন করে মুরসালিনকে এ বাসায় আসতে বলে। ও এসে এম্বুলেন্স ডেকে মীরাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শুক্রবার হওয়ায় হাসপাতালে ডাক্তার ছিলো না। পরে মোখলেস সাহেব কাকে যেন ফোন করে ডাক্তার আনায়। অল্পবয়সী ডাক্তারের চোখেমুখে বিরক্তি। সামান্য জ্বরে ভোগা রোগী নিয়ে এত হম্বিতম্বি? পাওয়ারফুল লোক এদের সাথে বাড়াবাড়ি চলে না। তাই তিনি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে মীরার। নার্সকে বলা হলো সারা শরীর স্পঞ্জ করে দিতে। সবার আগে গায়ের তাপটা কমানো দরকার তারপর বাকী চিকিৎসা। খাওয়া ঔষধ আর শরীর স্পঞ্জ করানোয় শরীরের তাপটা কমে এলো মিনিট পনেরোর মধ্যে। এরপর স্যালাইন দেয়া হলো রোগীকে, কারন রোগীর শরীর ডিহাইড্রেট। অচেতন থাকায় মুখে খাবার দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে মীরার মেয়ে নূহা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়৷ খুব সম্ভবত হাসপাতালে ওর ভালো লাগছে না। ওর মায়ের শরীরে স্যালাইন আর শ্বাসকষ্টের জন্য অক্সিজেন দেয়ায় ও ভয় পেয়েছে। মাজেদা আর টুম্পা দু’জনেই হসপিটালে। তাদের কারোরই নূহাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া কিংবা ওকে নিয়ে একা থাকা সম্ভব না। উপায়ন্তর না পেয়ে মোখলেস চাচা বললেন-
: “ওরে নাহয় আমি আমাগো বাড়িত নিয়া যাই”
টুম্পা আর মাজেদা খালা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেও আপত্তি করে না। এটাই ভালো হবে, রোগী নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে হাসপাতালে নূহাকে নিয়ে ঝামেলা হবে। ওর সময় মতো খাওয়া, ঘুম, পটি এখানে থেকে এগুলো মেইনটেইন করা কষ্ট হবে ভেবে ওরা আপত্তি করে না, তাছাড়া তাদের বাড়িতে মোখলেস সাহেবের স্ত্রী, ছেলের বৌ রয়েছে, তারা নূহাকে দেখে রাখতে পারবে।
মোখলেস চাচা মুরসালিনকে থাকতে বলে ফিরে যেতে লাগলো বাড়িতে। মাজেদা খালা বলেন-
: “সমস্যা নাই, থাকন লাগবো না ভাইয়ের, আমরা তো আছিই, কোন সমস্যা হইলে ফোন দিমুনি আপনেগো”
মোখলেস চাচা কিন্তু কিন্তু করে, টুম্পা ভরসা দিলে তিনি কিছু টাকা মাজেদা খালার হাতে দিয়ে বেরিয়ে পরেন।
আসার পথেই নূহা মোখলেস সাহেবের কাঁধে ঘুমিয়ে পরেছে। বাসায় ফিরে দেখে কেওই খাওয়াদাওয়া করেনি। মোখলেস সাহেবের স্ত্রী রেবেকা বেগম নূহাকে নিজের ঘরে শুইয়ে দিতে বললেও মোখলেস সাহেব নূহাকে ইরার ঘরে শুইয়ে দেয়। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে চোখ সরু করে তাকন তিনি স্বামীর দিকে। এ তাকানের উত্তর দেন তিনি স্মিত হেসে। যার মধ্যে লুকানো ছিলো কোন অভিসন্ধির আভাস। ওকে রেখে বাইরে এসে জিজ্ঞেস করে তারা খেয়েছে কিনা? মিসেস রেবেকা জানায় তারাও না খেয়ে বাড়িতে বসে চিন্তা করছে রোগীর জন্য। মোখলেস সাহেব ফ্রেশ হতে যান খাবার বাড়বার অনুরোধ করে। অবশেষে সবাই চারটার দিকে একসাথে দুপুরের খাবার খায়৷ খাবার খেতে খেতে আলাপ হয় রোগীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
খাওয়া শেষে বিশ্রামের জন্য যে যার ঘরে যায়। ইরাদের মায়ের পরিবারে বাচ্চাকাচ্চা নেই বললেই চলে। তাই বাচ্চাকাচ্চার প্রতি তেমন টান নেই ওর। কিন্তু ঘুমন্ত এই শিশুটিকে দেখে কেমন যেন মায়া লাগে ওর। মায়া লাগার কারন লুকিয়ে থাকা সম্পর্কের টান না, মায়া লাগছে এই ভেবে যে-
এত বড় পৃথিবীতে এক মা ছাড়া কেও নেই মেয়েটার। কাত হয়ে শুয়ে এক হাতে মাথার ভার রেখে মনোযোগ দিয়ে দেখছে এই অপূর্ব মানব শিশুটিকে। ছোট কপাল, পাতলা ভ্রু, সরু নাক, গোলাপি ঠোঁট, সুঠাম স্বাস্থ্যের গুলুমুলু বাবু। যারা বাচ্চা পছন্দ করে না, তারাও একবার ছুঁয়ে দিতে চাইবে।
ইরা ঘুমন্ত বাবুটার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে পরম মমতায়। এত মায়ায়ই যদি দিলো খোদা মায়া করার লোক কেন কেড়ে নিলো এই অবুঝের কাছ থেকে? -মনে মনে ভাবে ইরা। মাথার চুলে হাত বাড়ানোর দরুন জেগে উঠলো সে, ইরার চোখে চোখ রেখে একটা মুচকি হাসির বিনিময় করেই পাশ ফিরে শুয়ে পরলো বাবুটা। যে কুশল বিনিময় করলো ও। ইরার কেমন ধাক্কা লাগে ঐ বাবুটার চোখ আর হাসি দেখে। এই চোখ, এমন হাসি যেন ওর খুব চেনা। মাথাটা বালিসে দিয়ে মনে করতে লাগলো কোথায় দেখেছে এমন চোখ, এমন হাসি? মনে করতে পারছেনা। এমন সময় মুরসালিন এসে ওর পাশে শোয়, তারপর বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে-
: তারপর আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
ইরার চিন্তায় ছেদ পরে এমন কথা শুনে, মুরসালিনকে ধাক্কা দিয়ে ও একটা লাজুক হাসি হাসে। বলে-
: “আগে আমি বড় হয়ে নিই”
: “মানে? তুমি ছোট?”
: ” শিশ্……. আস্তে, ঘুম ভেঙে যাবে ওর, মুরসালিন ওর নাক চেপে বলে ভালোবাসাবাসিতে তো বড়দের ও ফেল করে দাও, এখন আবার বলো ছোট? ”
: আপনার কথার কোন মাথামুণ্ডু নাই, এই বলেন আমি কৃপণ, এই বলেন ভালোবাসাবাসিতে বড়দেরও ফেল করে দিই, মাথা কি ঠিক আছে?”
: “মাথা আমার ঠিকই আছে, ঐসব তো বলি তোমাকে ক্ষেপিয়ে দিতে। ভরদুপুরে ওমন আদর পেতাম বলো যদি তোমায় না-ই ক্ষেপাতাম?”
ইরা কুশন দিয়ে একটা বারি দেয় মুরসালিন কে। মুরসালিন তা ধরে ফেলে ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে বলে-
: ” শিশ্……. আস্তে, ঘুম ভেঙে যাবে ওর”
ওর কথা ওকে ফিরিয়ে দেয়ায় হেসে দেয় ইরা। মুরসালিন এ ফাঁকে একটা চুমু খাওয়ার চেষ্টা চালায় ইরা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলায় চুমু আর ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছায় না। এটা দেখে মুরসালিন ওর দুই হাত পিছমোড়া করে তারপর বলে-
: “বেশী চালাক হয়ে গেছো না? এখন বাছাধন কি করবে তুমি? ”
ইরা উসখুস করতে থাকে হাত ছাড়ানোর জন্য। ও কি আর পারে বলিষ্ঠ মুরসালিনের সাথে? তারপর এক হাতে চুলে গোঁজা কাঠিটাকে টেনে খুলে ফেলে ও, ইরাবতীর দীঘল কালো চুল সবদিকে ছড়িয়ে যায়। তারপর সেই চুলে নাকমুখ ডুবিয়ে হাত ছেড়ে দেয় ইরার। ইরাও বশীভূতের মতো জাপটে ধরে মুরসালিনকে। কানেকানে ফিসফিস করে মুরসালিন বলে-
: “আমাদের বাড়িতে মা একমাত্র মেয়েমানুষ ছিলো, তারপর তুমি এলে, এখন যদি আমাদের একটা মেয়ে আসে মন্দ হবে না কিন্তু! ”
: “এসব কি আমার হাতে? যদি ছেলে হয়?
: “আল্লাহ চাইলে মেয়েই হবে, আগে তো খেলা শুরু করতে হবে নাকি? ফলাফল তো পরের বিষয়”
: “আপনি একটা অসভ্য ”
: “তোমার কি মনে হয় আমি এমনিভাবে বাইরের লোকেদের সাথে কথা বলি? বৌর সাথেও যদি রাখঢাক করে কথা বলতে হয় তাহলে…”
: “অনেক ভদ্রলোক ভাবছিলাম আপনাকে”
: “আমি কি অভদ্র নাকি?”
মুখ বাকিয়ে ইরা পাশ ফিরে শোয়। মুরসালিন শোয় নূহার ঐপাশে। ইরার হাত নূহার শরীরে। মুরসালিন ইরার হাতের ওর আলগোছে নিজের হাতটা রেখে বলে-
: “মেয়েটা এমন ছবি না দেখেই বড় হবে, বাবা মায়ের ভালোবাসা না দেখে বড় হবে, ব্যাস্ত মাকে ছাড়া একা-একাই বেড়ে উঠবে। মপয়েটার কি সুন্দর মায়াবী মুখ, কিন্তু ভাগ্য? ততোটাই মন্দ”
মুরসালিন নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়,পাছে বাবুটা উঠে যায়। নড়ে উঠতে দেখে একটু দূরে সরে মুরসালিন। ইরা কথা বলতে নিষেধ করে ইশারায়। উপায়ন্তর না পেয়ে মুরসালিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে ও। আর ইরা যেন ফুরসত পায় ঐ চোখ, আর হাসির রহস্য উদ্ধারে। এমন চোখ আর এমন হাসি…….
চলবে….