প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
উদ্দ্যোক্তাদের ঐ সম্মেলন থেকে আসার পর থেকে মীরার মাথায় কেবল বিজনেস শুরু করার পোকা কিলবিল করতে থাকে। কিন্তু বিজনেস শুরু কর তো মুখের কথা না। প্রচুর ক্যাশ টাকার দরকার। এ মুহূর্তে ওর কাছে কোন ক্যাশ নেই। মাল এক স্লট আসছে তো আরেক স্লটের অর্ডার করে রাখতে হচ্ছে। সেটা বিক্রি হতে হতে পরবর্তী স্লট মাল কিনবার টাকা গোছগাছ করতে হচ্ছে। আশার কথা এই যে ওদের আউটলেটে সারা বছরই টুকটাক ভালোই বেচাকেনা চলে। ইন্ডিয়ার প্রোডাক্ট বেচা বিক্রি তো চলছেই, সাথে যুক্ত হয়েছে থাইল্যান্ড আর চায়না থেকে প্রোডাক্ট আনা। এসবের মধ্যে ব্যাগ, জুতা, কসমেটিক প্রোডাক্টও রয়েছে।
বাংলাদেশে ফেসবুক লাইভ ফিচারটা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। অধিকাংশ ফেসবুক ব্যাবহারকারীই এটাকে আড্ডা দেবার কাজে ব্যাবহার করছে। একদিন “বিভা ফ্যাশনের” ফেসবুক গ্রুপটাতে লাইভে এসে আড্ডা দিলো মীরা। কিছুটা সাই ফিল করে বেশী রাতে লাইভ হয়েছিল সেদিন। তবুও বেশ ভালো রেসপন্স পাওয়া গেলো। লজ্জা ভাঙার পর থেকে সময় পেলেই লাইভে আসতো ও। গ্রুপের মেয়েদের নানান গল্প, কথায় ভালোই সময় কাটতো । গ্রুপটা যেন ওর সেকেন্ড হোম। আস্তে আস্তে লাইভে সাজগোজের টিউটোরিয়াল দেখাতো মীরা । ও কোন মেকআপ আর্টিস্ট না, তবে নিজে যা পারতো তাই শেয়ার করতো সকলের সাথে। ওদের ফ্ল্যাটে যে রুমটা ডেকোরেশন করেছিলো অফিস আর ফটোবুথের জন্য সেটা এখন গোডাউনের মতো ব্যাবহার করে৷ সেখানে বসেই লাইভে গ্রুপের মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতো ও। কোন কোনদিন হিজাব টিউটোরিয়াল তো কোনদিন মেকআপ। সারাদিন ব্যাস্তসময় পার করে প্রতিদিনের ঐ এক-আধ ঘন্টাই যেন মীরার রিফ্রেশমেন্ট। ঘিন্জি এ জীবণটায় বেঁচে থাকার টনিক । আগে সময় পেলে লাইভে আসতো মীরা আর এখন শত কাজ থাকলেও সময় বাঁচিয়ে রাখে ও লাইভের জন্য। লাইভ চলাকালীন সময়ে একেক জন ওর পেছনের সেলফে থাকা প্রোডাক্টের ডিটেইল জানতে চায়। এরপর থেকে লাইভ আড্ডায় জানিয়ে দেয়া হতো আপকামিং প্রোডাক্ট সম্পর্কে।
সেই থেকে দুই একটা প্রোডাক্ট দেখানো ও স্টার্ট হয় লাইভে। সকলের থেকে ভালো রেসপন্স পেয়ে লাইভ হওয়া নিয়মিত করে মীরা। ওদের কাছে যে হিউজ আইটেম আর ভ্যারিয়েসনের প্রোডাক্ট রয়েছে যে প্রতিদিন লাইভ হলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখান থেকে এত মাল দেখানো পসিবল হয় না। কারন মালপত্র এখানে বস্তা , কিংবা বাক্স বন্দি। তাই রাতের গেডাউন থেকে লাইভ করার বদলে লাইভ শুরু হলো দিনের বেলা আউটলেটে। আর ফেসবুক গ্রুপ থেকে মুভ হলো ফেইসবুক পেইজে । পেইজে তেমন রেসপন্স পাওয়া যায় নি শুরু থেকে। তবুও ওরা চালিয়ে রাখে নিয়মিত ফেসবুক লাইভ হওয়া। আর এই কনসিসটেন্সিটাই হয়েছিল মীরার ব্যাবসা সম্প্রসারণের তুরুপের তাস।
এর সব ক্রেডিট আউটলেটের স্টফ ফাহাদের। ও আগে দামী একটা ব্র্যান্ডের বসুন্ধরা আউটলেটে জব করতো। মালিকের ছেলের সাথে ঝামেলা করায় চাকরি থেকে ওকে বিদায় করে দিয়েছেন তারা।
প্রথম যখন এসেছিলো ও ছোটখাটো ছেলেটাকে দেখে কেমন যেন ভরসা পায়নি মীরা, তবে ফাহাদের উপর ভরসা না থাকলেও পাভেলের উপর মীরার ভরসা আছে শতভাগ। মীরা একজন ম্যানেজার খোঁজায় পাভেলই ফাহাদকে এখানে দিয়ে গেছে। ও নিশ্চয়ই বুঝে শুনেই ওকে পাঠিয়েছে।
ফাহাদ ক্লাস টেন পাশ একটা ছেলে। মধ্যম গড়নের ছেলেটার হাসি ভুবন ভোলানো। মুখে একটুকরো হাসি যেন লেগেই থাকে সবসময়। খুব ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল ওকে। স্ট্রাগল করা ছেলে কাজ দেখলেই বোঝা যায়৷ আউটলেটের ম্যানেজার হওয়া সত্ত্বেও যখন সামনে যে কাজ পরে দ্বিধা না করে করে ফেলে। মীরার ভালো লাগে ব্যাপারটা।
ফাহাদের বড় ব্র্যান্ডের সাথে বিভিন্ন জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় ও। ভরসা না করতে পারা ফাহাদ তার খেলা দেখাতে শুরু করলো কিছুদিনের ভিতরে। ওর পরামর্শে প্রোডাক্টের প্যাকেজিং, ট্যাগ, দাম ইত্যাদিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হলো মীরাকে। মনে মনে মীরা বিরক্ত হলেও মেনে নিচ্ছিলো সব, ওর কাজের পরিধি বুঝতে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে একটা মালের ক্রয় খরচ+পরিবহন খরচ+ট্যাক্স মিলিয়ে যা হয় তার বিক্রিও প্রায় সেইম। এক পয়সাও লাভ হয় না সেখান থেকে। কিন্তু এটা যে ওর একটা পলিসি ছিলো তা মীরা বুঝতে পেরেছিলো কিছুদিন বাদে৷ ওদের মেইন ফোকাস থাকে বেশী বিক্রির উপর। বাজার দখল যাকে বলে। মার্কেটে এখন প্রচুর কম্পিটিশন, সেখানে নতুন একজনের জায়গা করে নেয়া চাট্টি খানি কথা না। ফাহাদের কথা হচ্ছে আগে সব কাস্টমার ক্রিয়েট করো, তারপর সময়বুঝে পুরাতন হিসাব বুঝে নেয়া৷ মীরা কেমন যেন চোখে দেখতো ফাহাদকে। মনে মনে ভাবতো – “এ ছেলে আমাকে ডুবাতে আসে নি তো?” ওর এমন তাকানো দেখে মিষ্টি করে হাসতো ফাহাদ, বলে-
: ” এখান থেকে যে লাভ টুকু আপনি আশা করেছিলেন বা যে পরিমান টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে আপনি তা হিসেব করে রাখুন। এর দুইগুণ তিনগুণ টাকা যদি ফেরত না আনতে পারি আমি আমার নাম বদলে ফেলবো”
মীরা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে-
: “না পারলে তোমার হিসেব সোজা দুটো মাত্র খাসির মামলা, আর আমার মামলা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা শেষ সম্বলের ”
ফরহাদ বলে-
: “দুটো খাসি! মানে?”
: “আরে বুঝলে না? নাম বদলাতে ছেলেদের দুটো খাসি জ’বা’ই দিলেই হয়”
এবার ফরহাদ হেসে দেয়। বলে-
: “আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন”
: ” ঠিকাছে করলাম ভরসা, ছয় মাসের মধ্যে যদি পরিবর্তন না দেখি আমি ভিন্ন কিছু ভাববো”
: ” ছয় মাসও অনেক সময়” বলে উঠে পরে ফাহাদ।
একে একে বেশ কিছু সিগনেচার আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে “মীরা ফ্যাশন”। ফেসবুক গ্রুপ আর পেইজে দশহাজার টাকার কনটেস্ট ঘোষনা করে। এই কনটেস্টের পেস্টটি হিউজ রিচ পায়। অর্গানিক ওয়েতেই পেইজটা বাড়তে থাকে ধুপধাপ করে। এর সাথে যুক্ত হয় নির্দিষ্ট এমাউন্টের কেনাকাটার উপর ফ্রি শিপিং। এরপরের কাহিনি পুরো গল্পের মতো। সেল এত পরিমানে বাড়লো যে প্রি-অর্ডার নিতে হলো। আউটলেটে মাল ঢোকার দুএকদিনের মধ্যেই আউটলেট প্রায় ফাঁকা৷ শিপমেন্ট পৌছুতে দেরি হওয়ার কারনে প্রি-অর্ডার নেয়ার ধারনাটা যোগ হয়৷ অধিকাংশ কাস্টমাররা এ ব্যাপারে সাপোর্ট করে মীরাকে।
এদিকে রাজিব ব্যাস্ত ওর ব্যাবসা নিয়ে। ব্যাবসার যখন ডাল সিজন চলে মালিকরা তখন বেশী ব্যাস্ত থাকে। মীরাও ব্যাস্ত সবকিছু মিলিয়ে। রাতে এখন দুজন দুই ঘরে ঘুমায়। আগে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরেই বেশ রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করতো মীরা। রাজিবের ঘুমের সমস্যা হওয়ায় মীরা এখন গেস্ট রুমে আস্তানা গেড়েছে। এটা শুধু কাজের বাহানা না, রাজিবের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরীর একটা উপায়ও। এ ব্যাবস্থা বেশ কিছু দিন থেকে। তা প্রায় বছর খানেক তো হবেই। এতে অবশ্য কোন আপত্তি ছিলো না রাজিবের। ওর যা শারীরিক চাহিদা তা তো বাইরে থেকে পূরণ করেই বাড়ি আসছে। কিন্তু মীরা ভুলে গেছে ও যে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আবেগ,অনুভূতি, ভালোবাসা, কাম এগুলোকে একটা বাক্সে ভরে সেটাতে তালা দিয়ে চাবিটা ফেলে দিয়েছে বাস্তবতার সাগরে । ওর মনে পরে না শেষ মিলনের কথা, মনে পরে না শেষ চুমু খাওয়ার কথা কিংবা রাজিবের শক্ত সামর্থ্য বাহু দিয়ে মীরার নরম শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলার স্মৃতি। এগুলো ভাবলেই গা রি-রি করে ঘেন্নায় মনে হয় আগাগোড়া কাম মোড়া ছিলো তাতে, এতটুকু ভালোবাসাও ছিলো না সেখানে। রাজিব কখনোই কোনকিছুতে মীরার বারন মানতো না, কষ্ট হোক কি যন্ত্রনা তা দেখার সময় তার থাকতো না কখনোই, বরাবরই এগ্রসিভ ও। এটাকে মীরা ভালোবাসা প্রকাশের একটা ধরন ভাবতো। এভাবেই রাজিব ট্রেইন করেছে ওকে। যে এ যন্ত্রণা মধুর যন্ত্রণা। আমাকে তৃপ্ত করার এ কষ্টেই লুকিয়ে রয়েছে সুখ। এটাই ব্রত হওয়া উচিত প্রতিটি স্ত্রীর, স্বামীকে তৃপ্ত করা। কিন্তু মীরা ভেবে পায় না ও কবে তৃপ্ত হয়েছে। চোখ বন্ধ করে ভাবে মীরা দু-চোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে যায়। গত নয় বছরে তৃপ্ত ও হয়েছিল একবার – “নুহাকে প্রথম কোলে নিয়ে” এটাই মনে হয় ওর জীবণের প্রথম এবং শেষ তৃপ্তি।
টুম্পা প্রায়ই বলে এখনো কেন ওর কাছেই রয়ে গেছেন আপনি। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, পায়ের নিচের মাটি এখন শক্ত। তবুও কেন ঐ নর্দমার কীটটার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা। উত্তর দেয়নি মীরা। কারন ওর নিজের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু ইশ্বরের পরিকল্পনা ছিলো অন্য।
আমি জানি আপনাদেরও নিশ্চয়ই এমন কখনো কখনো হয়েছে যে আপনি কোন একটা ব্যাপারে কিছু ভেবে রেখেছেন, কিন্তু পুরো প্লট উল্টে ঘটে গেছে ভিন্ন কিছু। আপনি কি পরিকল্পনাকারী নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা এরচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। মীরারও হয়েছিলো তাই।
ফাহাদের পরামর্শে বসুন্ধরা সিটিতে বিভা ফ্যাশনের দ্বিতীয় আউটলেট খোলার কথা চিন্তা করে মীরা। সে হিসেবেই সবকিছু গোছগাছ করে ও। কিছু টাকা ক্যাশ ছিলো বাকীটা ব্যাংক লোন। ওর নামের বাড়ির ব্যাংক লোন তো এখনো পরিশোধ হয় নি, তাই বাধ্য হয়ে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র রেখে লোন নেয় ও। রাজিব সেটা জানে। মীরা বসুন্ধরায় দোকান নেয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছিলো রাজিবের সাথে।
যেদিন দোকানের কাগজপত্র ফাইনাল করার কথা সেদিন সকালে কিছু লোক আসে ওদের বাসায়। লোকগুলোকে ভদ্রলোক আর রাজিবের পরিচিত হওয়ায় ভিতরে বসতে দেন তিনি।
মীরা তাদেরকে জানান – গতকাল রাতে রাজিব একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। লোকগুলো এ কথা শুনে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়৷ তাদের চেহারায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ঠিক কি তা বুঝতে পারছে না মীরা। তিন’জনের মধ্যে সবচেয়ে যে বয়স্ক সে বলে- “আপনার স্বামী আমাদের থেকে মোটা অংকের লোন করেছেন। আজ দিই কাল দিই করে দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে কেবলি ঘুরাচ্ছে। সুদ আাসলে সে টাকা এখন কোটি ছুঁইছুঁই। আমরা তিনজনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকালের মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আমদের না দিলে আমরা আপনার স্বামীর এগেইন্সটে মামলা করবো” কথা যা বলার ঐ একজনই বললো৷ বাকী দুজন বিরক্তি মাখ দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কথা শেষ হলে বেশ কিছু সময় বসে ভদ্রলোক উঠে পরেন, আরো কিছু বলবেন ভেবেছিলেন হয়তো, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে পারছেন না, তার উসখুস করছেন।
তার দেখাদেখি বাকী দুজনও উঠে পরলো। তারপর চলে গেলেন তারা।
মীরা সকালটা খুব সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিলো আজ। কারন আজ ওর বিজনেসের ইতিহাসে একটা বিশেষ দিন। কিন্তু লোকগুলোর কথা শুনে ওর খুশি মুহূর্তেই উবে গেলো। কি করলো ও এত টাকা নিয়ে৷ আর বেছে বেছে তাদের আজকেই আসতে হলো। কান্না চলে আসে মীরার। পরোক্ষণেই মীরার মনে পরে রাজিব জানে যে ওর কাছে এখন ক্যাশ টাকা আছে। ও কি ভেবেছে আমি ওকে বাঁচাবো এদের হাত থেকে এই টাকাগুলো তাদেরকে দিয়ে?
মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে মীরা। এমন সময় ফোন আসে ফাহাদের। দশটার সময় যাওয়া কথা। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে। মীরা ফোন রিসিভ করে ফাহাদকে বলে- ” ফাহাদ একটা সমস্যা হয়ে গেছে, আমি দোকানটা এখন নিতে পারবো না, তাদেরকে তুমি না বলে দিও” -ফাহাদকে কিছু বলতে সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে কাঁদতে থাকে মীরা। সেখানে যাওয়রা জন্য তৈরী টুম্পা ভয়ে দৌড়ে এদিকে আসে মীরার কান্না শুনে, দেখে মীরা মেঝেতে বসে মুখ চেপে কাঁদছে।
চলবে……
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
মীরাকে কাঁদতে দেখে টুম্পা ভীষণ অবাক হয়। “কি হলো আবার” ভাবে মনে মনে। মীরার কাছে বসে টুম্পা ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে – “কি হয়েছে আপা?”
মীরা তখনো কাঁদছে। টুম্পাকে যেন দেখছেই না ও। কিছুটা সময় মীরাকে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে, মীরা ওড়ানা দিয়ে মুখ চেপে সোফার উপরে থাকা পেপারস গুলো এগিয়ে দেয় ওর দিকে। টুম্পা কিছুই বুঝতে পারে না। কাগজগুলো নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে ও। কাগজগুলো দেখে টুম্পাও স্তম্ভিত। কাগজ গুলোর একসেট মীরার কারখানার দলিলের ফটোকপির আর আরেক সেট ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে টাকা ধার নেয়ার চুক্তিপত্র। যেটাতে কয়েকটা লাইন নিয়ন রঙের হাইলাইটার দিয়ে হাইলাইট করা, যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে “যদি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত না দেয়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকবে”
টুম্পা স্তম্ভিত এসব দেখে। ভাবে “একটা মানুষ এত নীচ কিভাবে হতে পারে!” টুম্পার এবার রাগ উঠে মীরার উপর, রাজিবকে এসব জানাতে না বলেছিলো ও। কিন্তু মীরা ওকে সব জানিয়েছে। দোকানের বায়নাপত্র, ব্যাংক লোনের ব্যাপর সব। কারন জিজ্ঞেস করলে বলেছে – “ওর প্ল্যান হিসেবে আরো মাস ছয়েক ওর এ বাড়িতে থাকা লাগবে। এত বড় একটা ব্যাপার ওকে না জানালে ও কোন না কোন ভাবে ঠিকই জানবে, পরে দেখা যাবে অন্যের কাছে শুনে ঘরে এসে ঝামেলা করতে পারে” কিন্তু কি তার প্ল্যান তাই আজও জানলো না টুম্পা। এসব ভাবতেই ফাহাদ কল করে টুম্পাকে। জিজ্ঞেস করে –
: “কি হলো হঠাৎ করে? ”
: ” ভাইয়ার একটা ফাইন্যান্সিয়ালি প্রবলেম হ’য়েছে, তাই…”
টুম্পার কথা শুনে তড়াক করে তাকায় মীরা। বস থেকে উঠে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে একটা চড় মারে টুম্পার গালে। টুম্পা এক্কেবারে ‘থ’ বনে যায়। এটা কি করলো মীরা আপু! টুম্পা অবশ্য কথাগুলো তাকে খোঁচা মেরেই বলেছে, পরোক্ষ ভাবে বোঝাতে যে তিনি আবার ভুল করতে যাচ্ছেন। চড় মেরেই শেষ হয় নি, রেগে কাঁদতে কাঁদতে মীরা বলে-
: “তোর কি মনে হয় আমি পাগল? আমার এত কষ্টের টাকা আমি ঐ জানোয়ারকে বাঁচানোর জন্য খরচ করবো? হুহ্, আর নাহ্, অনেক খেলেছে রাজিব আমাকে নিয়ে ভেবেছিলাম ওকে মে’রে টুকরো টুকরো করে আমি কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবো। কিন্তু নাহ্ খোদা আমাকে সে সুযোগ দিবে না, তিনি তিল তিল করে বিছিয়ে রাখা জাল কেটে বের করে নিলো ওকে। আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখলো ঐ সৌন্দর্যের মোহ দিয়ে আরো না জানি কতজনের জীবণ নিয়ে খেলার সুযোগ দেয়ার জন্য”
টুম্পা স্তম্ভিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে, হাত দিয়ে গাল ঘষছে। চড়টা মীরা জোরেই দিয়েছে। এ মুহূর্তে ওর কষ্ট পাওয়া কথা, রাগ হওয়ার কথা মীরার আচরনে।
ওর নিজেরই কত রাগ বিরক্তি রাজিবের উপর, যে রাজিব ওর নিজের কেও না, আর মীরা? মীরা রাজিবের স্ত্রী, একজন নীতিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, চরিত্রহীন পুরুষের স্ত্রী ও। যাকে ভালোবেসে ও ঘর ছেড়েছে, নিজের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে তৈরী ব্যাবসা ছেড়েছে, বাপটাকেও শেষ বারের মতো দেখতে পায় নি, ওর তাহলে কষ্ট কতটা।
কথাগুলো শুনে টুম্পা মীরার কাছ ঘেঁষে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে-
: “আপা আমি সরি, আসলে আমি ভেবেছিলাম আপনি আবার ওর ফাঁদে পা দিচ্ছেন”
মীরার কান্নার বেগ যেন বেড়ে যায় টুম্পার আলিঙ্গনে৷ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। যেন তাদের পরম কারো মৃ’ত্যু খবর এসেছে।
ওদের কান্নার শব্দে নূহার ঘুম ভেঙে যায়। নূহা ঘুম থেকে উঠে কান্নার উৎস্য খুঁজতে খুঁজতে বসার ঘরে এসে পরে। নূহাকে দেখে আলিঙ্গন ছেড়ে ওকে কোলে নেয় টুম্পা। মীরা চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। মেয়েটা ওকে কাঁদতে দেখলে ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে যায়। টুম্পা মীরার কাছে এলে নূহা ঝাঁপিয়ে পরে মায়ের কোলে। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে-
: “তোমাল কি হয়েছে মা?”
আড়াই বছরের নূহা এখন আধো আধো বুলিতে শব্দ জুড়ে বাক্য তৈরী শিখেছে। মীরা ওড়ানায় মুখ মুছে হাসি হাসি মুখে বলে- ” কিচ্ছু হয়নি মা”
মুখ কালো করে নূহা মাকে দেখে কিছুক্ষণ, তারপর বলে
: ” তোমাকে কে মেলেছে?”
এ কথা শুনে আবারো কান্না আসে ওর। এটুকু মেয়েকে ওর কষ্ট ছুঁতে পারলো কিন্তু এত্ত বড় রাজিব কখনো ওর দুঃখ বোঝে নি। অনেক কষ্টে কান্না আটকে মীরা বলে-
: “কেও মারে নি মা, চোখে পোকা পরেছে”
এর উত্তরে নূহা বলে-
: ” আমি পোকাকে মেলে দিবো এ্যা”
নূহার কপালে চুমু খেয়ে মীরা বলে আচ্ছা মেরে দিও। এমন সময় মাজেদা খালা ঘরে ঢুকে। তিনি নিচে গিয়েছিলেন কি যপন কিনতে। এসে ঘরে থমথমে পরিবেশ দেখে কাওকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, নূহাকে ডেকে বললো-
: “আসো নানু, চলো আমরা নাশতা খাই”
খালা নূহাকে কোলে নিয়ে বাসার ঐ দিকটাতে চলে গেলো। কি হয়েছে তার কোন কিছু জানতে খালার কোন তাড়া নেই। এটা তার একটা ভীষণ ভালো দিক। এ মুহূর্তে মীরা যে কি হয়েছে তা বর্ণনা করার মতো অবস্থায় নেই তা তিনি বুঝে নূহাকে নিয়ে ওকে একটু একলা থাকতে সুযোগ করে দিয়েছে। এই বুঝটাও অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ও নেই।
খালা আলে গেলে মীরার কাছের মেঝেটায় বসে ওর হাতদুটো ধরে টুম্পা। তরপর বলে-
: ” জীবন আপনাকে যে-ভাবে টেনে হেঁচড়ে সামনে নিয়ে গেছে তাতে এমন খু’ন খারাবির কথা আপনার চিন্তা করাটা, এমন কিছু ভাবা দোষের কিছু না। কিন্তু দেখেন তা করলে কি হতো? কোন না কোন ভাবে ধরা পরে জেলে যেতেন আপনি, তারপর? মেয়েটার বাবা থাকতেই তো নাই, আর মা? বাবাকে খু’নের অভিযোগে জেলে। কি পরিস্থিতি ফেস করতে হবে ওকে? বড় হওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে ও ধাক্কা খাবে এটা শুনে শুনে। ট্রমার ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা যে কি পেইনফুল তা আমার চেয়ে ভালে কে জানে?”
কথাগুলো বলে কেঁদে দেয় টুম্পা। মীরা ওর কান্না দেখে সোজা হয়ে বসে৷ এতদিন ধরে একসাথে থাকা, কোনদিন টুম্পাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি ওর কষ্টের কথা, ওর যে কষ্ট থাকতে পারে তা তো কখনো ভাবেই নি মীরা। মীরা মেঝেতে ওর মুখোমুখি বসে। বলে –
: “আমি অনেক স্বার্থপররে টুম্পা। নিজের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তোর কষ্টের খোঁজ নেই নি কখনো, এতদিন তো খুব শুনলি আমার দুঃখ গাঁথা, আজ তুই বলবি আমি শুনবো, বল বোন আমার তোর সব কষ্টের কথা আমাকে বল আজ”
টুম্পার কান্নার বাঁধ যেন আলগা হয়েছে আজ, কান্না পরিণত হয়েছে হেঁচকিতে। দৌড়ে গিয়ে পানি আনে মীরা। টুম্পাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ও। কান্না থামিয়ে পানিটা পান করে টুম্পা৷ শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বলে- আমার দুঃখ গাঁথা শোনার সময় এটা না আপা, শুধু এটুকু জানুন বাবা মায়ের করা ভুলের জন্য জীবণের প্রতিটি পদে পদে মানুষের কাছে লাঞ্চিত হতে হয়েছে আমাকে৷ কেও কোনদিন সুস্থ ভাবে বাঁচতে দেয় নি আমাকে, ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও মানুষ আমাকে মনে করিয়ে দিতো ঐ সব কুৎসিত অতিতের কথা।
তাই তো আমি সবসময় কঠিন নজরে রাখি আপনাকে, আপনি যাতে এমন কিছু না করেন যার খেসারত আমার মতো নূহাকে জীবণভর বয়ে যেতে হয়।
টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে মীরা। বলে-
: তুই আগের জন্মে আমার বোন ছিলিরে টুম্পা। তা না হলে কেন আমার জন্য এতটা ভাববি তুই? আমাকে মাফ করে দে বোন। আমার মাথা ঠিক ছিলো না তখন৷ তাই তোকে….
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কলিংবেল বাজে। বেসিনে চোখ মুখ ধুয়ে গেইট খুলতে যায় টুম্পা৷ মীরা যায় ওর রুমের বাথরুমে। গেইট খুলে দেখে ফাহাদ এসেছে বাসায়৷ আসলে কি হয়েছে তা জানতে দৌড়ে এসেছে ও। মীরা এসে ওকে দেখে বলে- তুমি এসেছো? ভালোই হয়েছে এসেছো, তুমি মুরসালীন ভাইকে গিয়ে বলো “আমদের এ স্পেসে হবে না, আরো বেশী স্পেস লাগবে, তাদের বড় যে দোকানটা খালি হবে চারমাস পর, আমরা ওটা নিবো, তুমি যাও গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলো ব্যাপারটা। আমার শরীরটা ভালোমনা, তা না হলে আমিই গিয়ে তাকে বলে আসতাম”
কথাটা শুনে তাকিয়ে থাকে ফাহাদ কারন ঐ দোকানটার এডভান্স, ভাড়া এখনকার ঠিক করা দোকানের চেয়ে তিনগুণ বেশী। এত টাকা কোথায় পবেন তিনি চার মাস পর? ফাহাদ অবাক হলেও, টুম্পা কিন্তু একটুও অবাক হয় না, কারন এত বছরে ও ঠিক বুঝেছে মীরা না ভেবেচিন্তে কিছু বলে না।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
চিন্তা ভাবনার অথৈ সাগরে পরে যায় মীরা। এতদিন ধরে সাজানো পরিকল্পনা অনুযায়ী একটু একটু কাজ করে যাচ্ছিল ও। এখন তো পরিস্থিতি পুরোই বদলে গেছে৷ ও নিজেও ভেবে পাচ্ছেনা কি করলে কি হবে?
সকাল থেকে সেসবই ভেবে যাচ্ছে ও। রাজিবের এসব নোংরামী ভাবতেই কান্না পায় ওর। একটা মানুষ এত খারাপ কি করে হয়? কত বড় বদের বদ টাকার ঘ্রাণ পেয়েই পাওনাদারদের বাড়ি দেখিয়ে
সটকে পরেছে৷ হারামজাদা! ও কি ভেবেছে টাকা গুলো রয়েছে আমার কাছে, লোকগুলো এলেই তাদেরকে দিয়ে দিবো টাকা? হুহ্, ওকে যদি ঋণ খেলাপির অভিযোগে পুলিশ নিয়েও যায় তবুও একটা কানাকড়িও বের করবো না আমি- মনে মনে ভাবে মীরা৷
এদিকে ইরাবতীরা সাত দিনের দিন ঢাকায় ফিরেছে। মুরসালিনের শরীর সামান্য অসুস্থ, তেমন কিছু না সামান্য সর্দি-জ্বর। তাই তড়িঘড়ি করে ঢাকায় ফিরছে তারা। যাবার সময় বাসে করে গেলেও ওরা ফিরছে প্লেনে করে। এটা যে ইরার প্রথম প্লেনে চড়া তা এক ফাঁকে ও জানালো ওর শ্বাশুড়িকে। ওর শ্বাশুড়ি মিসেস রেবেকাও ইরার মতোই হেসে বললেন- “পাসপোর্ট হোক, তারপর আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো” ইরা ওর শ্বাশুড়ির কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়৷ কারন তিনি হুবহু ইরার কথা বলার ধরনে ইরাকে মিমিক্রি করেছেন। রেবেকা চোখ পাকিয়ে বলে- “কেন হয় নি?” ইরা হাসতে হাসতে বলে- “হয়েছে, হয়েছে! ”
মুরসালিন দূর থেকে দেখছে তাদের এসব, ইরা মুরসালিনের স্ত্রী কম, ওর বাবা-মায়ের পুত্রবধূ-ই বেশী। তারা আসছে থেকে ইরার দখল তাদের হাতে৷ তারা যে ওকে আগলে রেখেছে তা না, তারা চাচ্ছে ওরা দুজন আলাদা করে সময় কাটাক। কিন্তু ইরার সে খেয়াল নেই৷ ও ঘুরে ফিরে সেই তাদের সাথেই।
দেখা গেলো বীচে হাঁটার সময় ওদের দুজনকে পিছনে রেখে সবাই সামনে হাঁটছে, একটা সময় মুরসালিনের খেয়াল হয় ও একা৷ ইরা হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তাদের দিকে চলে গেছে তা টেরও পায় নি । মুরসালিন ইরার হাত ধরে পিছন থেকে সটকে পরতে চেয়েছিলো একবার। ইরাকে একবার বললো- চলো আমরা ঐ দিকটাতে যাই, গাধা মেয়েটা বলে- “দাঁড়ান বাবাকে বলে আসি” রেগে মুরসালিন বলে- ” যাও গিয়ে বলে আসো” মনে মনে বলে “গাধা একটা, ওকে ধরতে গেলেও মনে হয় বলবে দাঁড়ান বাবাকে বলে আসি” ইরা ওর রাগ দেখে সেখানেই চোখ-মুখ কালে করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুনিয়ার কিছুই বুঝে না সে রাগ দেখানোয় অভিমান করাটা ঠিকি-ই বুঝেন। মুরসালিন ওর তপ্ত মেজাজ সামলাবে নাকি বৌর মান ভাঙাবে তাই বুঝে না। এ কোন ফ্যাসদে ফেললো ওর বাবা-মা ওকে। প্রেম ভালোবাসা, স্বামী, স্ত্রী এসব সম্পর্ক যেন ওর জানার সীমানার বাইরে। সব কথা ঘুরে ফিরে শেষ হয় ওর পড়াশোনায় গিয়ে৷ বাসে থাকার সময় হঠাৎ ব্রেক ধরায় বাসটা সামনে ঝুঁকে যায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইরা তখন গম্ভীর ভাবে ওকে জিজ্ঞেস করে – “এমন কেন হলো জানেন? ” ঠিক যেন মুরসালিনের স্কুলের জাফর স্যার। মুরসালিন মাথা নেড়ে না বলে, ইরা সহজভাবে বলে- ” এটা হচ্ছে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের চমৎকার একটা উদাহরণ। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে……. ” এর পর শুরু হয় তার লেকচার, ঐ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু উদাহরণ যোগ করতেও ভুলে না সে। ও বিয়ে করেছে না স্কুলে ভর্তি হয়েছে তাই বুঝতে পারে না।
মুরসালিন ভাবে স্কুলে থাকতে সাইন্স সাবজেক্ট গুলোতে ফাঁকি দিয়েছিলো তাই খোদা ইরাকে ওর জীবণে পাঠিয়েছেন। এসব ভাবনা রেখে মুখে হাসি টেনে বলে-
: “যাও বলে আসো, না হলে আমাদের তার আবার খুঁজবে ”
ইরা এবার সহজ হয়ে বলে- ” তাই তো যেতে চাচ্ছি, আমাদের না পেয়ে যদি খুঁজতে থাকেন” মুরসালিন বলে- “যাও যাও, জলদি যাও” ইরা বলে আপনি দাঁড়ান আমি এক্ষুনি বলে আসছি” মুরসালিন হেসে দেয় ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে৷ প্রথমে ভেবেছিলো ঢং করে কথা বলে ইরা। কিন্তু এতদিনে ও বুঝে গেছে ওর কথা বলাটাই এই আদলেরই, একটু আদুরে আদুরে ভাব আছে। এসব ভেবে হাসে ও। বিয়ে, বৌ, বাবা-মা এসব নিয়ে ওর অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। চাচাতো ভাই শুভ, অভি ওরা বিয়ের পরপরই একে একে আলদা সংসারে থিতু হয়েছেন। চাচীর দু’টো ছেলে থাকা সত্ত্বেও একা ঐ বিশাল বাড়িতে থাকতেন। অসুখ বিসুখ, ভালোমন্দ দেখার কেও নেই। যদিও ওর বড় চাচী একটু অন্য ধাতের ছিলেন। সব সময় বউদের সাথে লেগেই থাকতেন। এটা এখানে কেন, ঐটা কোথায় গেলো, এটা এভাবে করে নাকি, দিনরাত কেবল ডাক দিতো কাজে। অথচ তিনি একটা বার বুঝতে চাইতেন না প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা, চেতনা, কাজের ধরনে স্বতন্ত্র । তিনি চাইতেন তার অর্ধেক বয়সের বউরা তার মতো পরিপাটি করে কাজ করুক। অথচ একটা বার ভেবেও দেখে নি যে এই বউরা তার বয়সী হলে তার চেয়ে বেশী এক্সপার্টও তো হতে পারে! সবসময় তুলনা আর কটকট। ছেলেরা এসব বুঝতে পেরে আলাদা হয়ে গেছে। প্রতিদিন ঘ্যান ঘ্যান থেকে একবার কেঁদে কেটে আলাদা হওয়াকে শ্রেয় মনে করেছে। শেষ বয়সে চাচা মারা যাবার পর চাচী
নিদারুণ কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন। মুরসালিনের মা রেবেকা খুব কাছ থেকে দেখেছেন এসব। শিক্ষা নিয়েছেন বড় জা-এর কাছ থেকে। ছেলের বিয়ের জন্য তাই বউ না খুঁজে, মেয়ে খুঁজেছেন। আজকালকার দিনে আনকোরা মনের বৌ পাওয়া খুব টাফ। এখনকার দিনে ছেলেপেলেরা তো কলেজে নাম লিখানোর আগে অন্যের নামে মন লিখে দেয়। এসব দিক থেকে ভাবলে খুব একটা খারাপ হয়নি ওর সাথে। মনের দরজার প্রথম তালাটা খুলতে পারলেই হলো, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঢাকায় ফিরে মুরসালিনের জ্বর আরো বেড়ে যায়। ইরাবতী সব কাজে আকাইম্মা হলেও কাওকে যত্ন করায় ওস্তাদ। বড় বোন যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গলো, হঠাৎ করেই বড় হয়ে যেতে হয়েছিল ওকে। বোনের শোক কাটাতে তার জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো ও। বোন কিভাবে বাবাকে যত্ন করতো, সময় মতো ওষুধের কথা মনে করিয়ে দিতো, অসুখ হলে খাবার খাওয়া নিয়ে জোড় করতো। এসব তখন ও করা শুরু করলো। সেই থেকে ও যত্নের ব্যাপারে খুব পাকা, আর মানুষ তো যত্নেরই কাঙাল। এ বাড়ি আসার পর থেকে সবার সাথে সম্পর্ক সহজ হওয়ার এটা বড় কারন ইরার যত্ন। সেটা হোক মানুষ কিংবা বারান্দার গাছ।
তো বাসায় ফিরে ইরা পুরো দখল নিলো মুরসালিনের। ওর মাথায় পানি ঢালা থেকে শুরু করে জলপট্টি দেয়া, সময়ে সময়ে জ্বর চেক করা থেকে শুরু করে ঔষধ খাওয়ানে সব ও একাই করতে লাগলো৷ আড়াল থেকে ইরার এ কান্ড দেখে হাসেন ওর শ্বাশুড়ি রেবেকা। মাঝরাতে হুট করেই অনেক জ্বর এসেছিলো মুরসালিনের। ইরা বাথরুমে যেতে উঠে ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখে অনেক জ্বর। বাথরুমে যাওয়া রেখে ও জলপট্টি দেয় ওকে। মুরসালিন নিজে উঠে বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি দিয়ে আসে। একটু পাউরুটি খেয়ে ঔষধ খেয়ে শুয়ে পরে। সকাল হলে জ্বরটা কমে মুরসালিনের। ফ্রেশ হয়ে ও অফিসে যেতে নিলে বাঁধ সাজে ইরা৷ যতই বোঝাক ওর জরুরি কাজটা সেরেই ও চলে আসবে, কিন্তু ইরা কিছুতেই মুরসালিনকে যেতে দিবে না। অবশেষে ওর শ্বশুর এসে এর সমাধান করেন। তিনি ইরার সাপোর্ট করে মুরসালিনকে অন্ততঃ আজকের দিনটা রেস্ট নিতে বলেন। উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য ছেলে এবং স্বামীর মতো বাসায় থেকে যান মুরসালিন।
সকালের নাশতা নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে ইরা, ছোটখাটো একটা যুদ্ধ জয় করেছে ও। মুরসালিন খাটে বসে আছে মলিন মুখে। ইরা খাবার সামনে দিলে বলে – ” আমি নিজে খেতে পারবো রাখো তুমি” ইরা ওর রিডিং ডেস্কে রাখে খাবারটা। মুরসালিন উঠে নিজ হাতে কিছুটা খাবার খেয়ে উঠে পরে, ঔষধ এগিয়ে দেয় ইরা৷ বলে – জানেন মায়ের ঘরের ক্যাকটাস গাছটায় ফুল ফুটেছে আজ। গাছটার বয়স নাকি পাঁচ বছর। এ গাছ গুলোতে ফুল ফোটা খুব রেয়ার৷
ইরার দিকে চেয়ে মুরসালিন বলে- ” দুনিয়ার সব বুঝো তুমি, শুধু আমার মন বোঝো না” -বলেই ড্রইং রুমে চলে যায় ও। ইরার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর কথা শুনে। মুরসালিনের বলা কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারে না ও।
এদিকে রাজিব আছে টেকনাফে। ওর এক ব্যাবসায়ী বন্ধু বাংলো বাড়ি করেছে এখানে জায়গা কিনে, সেটা দেখতে এসেছে ও। ওর মধ্যে ঋণ, টাকাপয়সা এসব কোন চিন্তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। গতরাতে সকলে মিলে ড্রিংকস্ করে এখন ম’রার মতে ঘুমাচ্ছে। এদিকে সাথী ওকে ফোন করেই যাচ্ছে, ফোন রিসিভ করার মতো অবস্থায় নেই ও। সাথীর মাথা গরম হয়ে আছে, আজ ওর বান্ধবীর গায়ে হলুদ। অনুষ্ঠানে যেতে শাড়ি, গহনা সব আগে থেকেই রেডি করতে গিয়ে আলমারির ড্রয়ারে হাত দিয়ে দেখে সেখানে সবকিছু কেমন এলেমেলো। কি ভেবে সব গুছাতে গিয়ে দেখে ফ্ল্যাটের পেপারস মিসিং। সেটা কোথায় তা জানতে কল করেই যাচ্ছে সাথী। ওর হাত-পা কাঁপছে কিছুদিন ধরে রাজিবের টাকাপয়সার টানাটানি চলছে, তারমানে কি….?
মনে কেমন কু’ডাক ডাকে সাথীর৷ রাজিবকে বিয়ে করে সাথী না পেয়েছে সম্মান, না পেয়েছে স্বীকৃতি,
পাওয়ার মধ্যে পেয়েছে এই ফ্ল্যাটটাই। এটা নিয়েও যদি রাজিব কোন কাহিনি করে তাহলে ওর কপালে খারাবি ডেকে ছেড়ে দিবে ও। সাথী কি জিনিস তা ও এখনো টের পায় নি। ওকে বিয়ে করেছে বলে পড়ালেখার ছুতো দিয়ে লন্ডনের পাত্রটাকেও না করে দিয়েছে ও, যদিও ছেলেটা প্রায়ই কল করে সাথীকে। সাথীও ছেলেটাকে ব্যাক-আপ হিসেবে হাতে রেখেছে। বলা তো যায় না কাকে কখন কোন কাজে লাগে।
অবশেষে পরদিন শুক্রবার বাড়ি ফিরে রাজিব। সাথী ফ্ল্যাটের কাগজের কথা জিজ্ঞেস করলে কাহিনি ফাঁদতে থাকে রাজিব। ও খুব সমস্যায় পরে ফ্ল্যাটের কাগজ রেখে কিছু টাকা লোন করেছে। এসব শুনে সাথীর মাথা গরম অবস্থা। ও যা ভেবেছিলো তাই!
ও তো মীরা না যে স্বামীর সব দোষ ধুয়েমুছে সাফ করে মেনে নিবে। ও পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এতকিছু বুঝতে চায় না ও, রাতের মধ্যে ফ্ল্যাটের কাগজ ফেরত না এনে দিলে ও মীরার কাছে সব ফাঁস করে দিবে বলে হুমকি দেয় । ও জানে রাজিবের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা মীরা। সারা দুনিয়া নষ্ট করলেও এ জায়গাটা ওর বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কারন মীরা হচ্ছে রাজিবের ঢাল। এসব নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় দুজনে, এক পর্যায়ে রাজিব গায়ে হাত তুলে সাথীর৷ মাথা আর ঠোঁটের কাছটা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়৷ রাগে উন্মাদ রাজিব দরজা জোরে বারি দিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। কত বড় সাহস সাথীর ওকে শাসায়! ওর জন্য কি না করেছে ও! আর ওর দূর্দিনে এমন আচরণ?
আর এদিকে সাথী ভাবে – অনেক সহ্য করেছে ও, আর না, এর একটা কিনারা হওয়া উচিত। এ অবস্থায়ই সাথী কল করে ওর ভার্সিটির এক বড় ভাইকে। সুন্দরী চরিত্রহীনদের তো ভাই ব্রাদারের অভাব হয় না। সেই বড় ভাই এ অবস্থায় ওকে হসপিটালে না গিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দিলেন। সাথী বুঝে গেছে যে রাজিব এখন ফতুর৷ ওর সাথে বাস করাটাকে তাই দীর্ঘ করতে চায় না ও। তাই একজন উকিলের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তী করনীয় ঠিক করে ও। ডিভোর্স দিতে চাইলেও উকিল তাকে এ মুহূর্তে ডিভোর্সের পথে হাঁটতে না বলেন। তার পরামর্শে আপাততঃ ওর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করে সাথী।
সেদিন রাতেই নারী নির্যাতন মামলায় নিজ বাসা থেকে আটক হয় রাজিব, অবশেষে মীরার সামনে উন্মোচিত হলো রাজিব সাথীর বিয়ের রহস্য। মীরা তো ভিতরে ভিতরে আগে থেকেই ভাঙা, নতুন করে এসবের মুখোমুখি হয়ে এবার যেন গুড়িয়ে গেলো ও। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসী চোখে দেখে রাজিবকে৷
রাজিবের হাতে সময় কম, পুলিশের সামনেই তাই হাত জোর করে ক্ষমা চায় রাজিব। মীরা তো আগে থেকেই জানতো সবকিছু, তবুও যেন আরেকবার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো এই রাজিবকে দেখে। অবশেষে পুলিশ ওকে তাদের গাড়িতে করে নিয়ে গেলো হাজতে। আর পরদিন সকালে পাওনাদারদেরা এ খবর পেয়ে ঋণ খেলাপি মামলা করে রাজিবের নামে৷
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
জ্বর কমেছে মুরসালিনের। তবে খওয়া দাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। বিকালে বাইরে বের হতে নেয় ও। ইরা মুরসালিনকে তৈরী হতে দেখে বলে-
: “আমাকে নিবেন সাথে?”
মুরসালিন ওর দিকে তাকিয়ে বলে-
: ” একটা কাজে যাচ্ছি আমি”
: ” আমি কি একবারও বলেছি ঘুরতে যাচ্ছেন আপনি? আপনার কাজ আছে, আমারও একটা কাজ আছে, আমার একটু সুপারশপে যেতে হবে, নিয়ে যাবেন আমাকে?”
: “একজনের কাছ থেকে টাকা পাই, টাকাটা আনতে যাচ্ছি, সেখান থেকে এসে নিয়ে যাবো নি?”
: ” এক কাজ করলে হয় না? আপনি টাকাটা আনতে যেখানে যাবেন সেখানকার কাছাকাছি কোন সুপারশপে আমি নামলাম, আর আপনি টাকাটা রিসিভ করতে গেলেন?”
: ” না, কতক্ষণ না কতক্ষণ লাগে, ছোট মানুষ তুমি পরে কি করতে কি করবে, পথ হারালে বিপদ”
: “কোন সমস্যা হবে না”
: “আমি ব্যাবসায়িক কাজে যাচ্ছি, সেখানে কতক্ষণ না কতক্ষণ লাগে তার কোন ঠিক নেই, আর তোমাকে সুপারশপে রেখে আমি টাকা রিসিভ করতে যাবো এটা কোন কাজের কথা না। তুমি এখনো যথেষ্ট ছোট, তাই অনেক কিছুই বুঝো না, এই যে এখন আমার সাথে যেতে চাইছো এটাও তোমার ছোট হওয়ার পক্ষে একটা উদাহরণ”
: “আমি ছোট মানুষ না? জানেন খালামনি বলে দিয়েছেন যে এখন আমি আর ছোট নই, আমি এ বাড়ির বড় বৌ, এখন আমার অনেক দায়িত্ব। সংসার, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, দেবরদের দেখাশোনা করা, খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব” কেমন চোখে তাকায় মুরসালিন, শান্ত গলায় বলে-
: ” আর যাকে ঘিরে এরা, সেই বরের কথা বলেনি কিছু?”
এবার মুচকি হেসে দিলো ইরা, বললো –
: “হুম, নানু বলেছেন- বরের খেদমত করতে”
: ” তো কি খেদমত করো তুমি?”
: ” করি না বলছেন? কাল জ্বর এলো আমি রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিলাম, সকালে আপনার কাজে যাওয়া পন্ড করলাম, জোর করে খাওয়ালাম, সময় মতো ঔষধ দিলাম তারপরও আপনি এ কথা বললেন?”
: ” আজ যদি মুস্তাকিম কিংবা আমার অন্য কোন ভাইয়ের জ্বর হতো তুমি কি করতে?”
: ” কেন ওনাদেরকেও এমনি টেককেয়ার করতাম”
: “গুড, দ্যাটস মাই পয়েন্ট – আমার অন্য ভাইয়েদের বেলায়ও তুমি তাই-ই করতে। আমার বাকী ভাইয়েরা আর আমি কি এক তোমার কাছে?”
এবার ইরা তব্দা খেয়ে যায় মুরসালিনের কথা শুনে, একটু ভেবে বলে-
: “না”
: ” তো?”
মাথা নিচু করে কেমন আরক্ত হয়ে যায় ইরা, মুরসালিন ইরাকে বলে-
: ” তারমানে আমি সবার চেয়ে স্পেশাল কেও, তাইতো?”
মুখ তুলে তাকায় ইরা, মুরসালিন ওর তাকানো দেখে হেসে দেয়, যা দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় ইরা।।দাঁড়ানো থেকে বসে পরে ওদের ঘরের খানদানি পালঙ্কের এক কোণে। মুরাসলিন ওর কাছে এসে পাশাপাশি বসে, ক্ষণকাল চুপ থেকে বলে-
: ” বিয়ের সম্পর্কটার অলৌকিক একটা শক্তি আছে, কোথাকার তুমি, কোথাকার আমি বাঁধা পরলাম বিয়ে নামের বন্ধনে, এর আগে কিন্তু কেও কারো সাথে কথাও বলি নি কোনদিন, একদিন কেবল দেখিছিলাম, তবুও কবুল বলার পর এক পলকেই কেমন আপন হয়ে গেলাম আমরা তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় ইরা, কিছু সময় মৌণ থাকে ও, ব্যাস্ত হয়ে যায় বিছানায় আঁকা বুকি করায়, তারপর বলে-
: ” আমার এখন আপনাকে খুব ভালো বন্ধু মনে হয়”
এবারো হেসে দেয় মুরসালিন, তারপর বলে –
: ” বিয়ে সম্পর্কটা তৈরী হয় ভালোবাসা থেকে, যত্ন, বন্ধুত্ব এটা ভালোবাসার একটা অংশ, তোমার স্কুলের যে বন্ধুর কথা বলেছিলে, কি যেন নাম? উম… মনে পরেছে রামিন, ও আর আমি কি এক?”
ইরা যেন চিন্তার সাগরে পরে গেলো। ওকে সহজ করতে মুরসালিন বললো-
: ” তুমি আমার সাথে এক বিছানায় শোও, রাতদুপুর যখন তখন বাইরে বেরোও, কত্ত দূরে আমরা একসাথে ঘুরতে গিয়েছি, ওর সাথে কি এমনি সব পরবে?”
ইরা মুরসালিনের গায়ে একটা চাপড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে-
: ” ছিহ্”
মুরসালিন হেসে বলে-
: ” দেখো ওর বেলায় এসব ভেবেই তুমি ছিহ্ বলছো, তার মানে আমরা বন্ধুর থেকে বেশী কিছু, তাই কি? ”
ইরা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে, এর উত্তর জানার ব্যাকুলতা যে ওর চোখেমুখে। আর মুরসালিনের চাহনিতে সেই উত্তর দেওয়ার নেশা। যেন কোন সম্মোহনী দৃষ্টিতে আটকা পরেছে দুজন। ফোন কল এলে ওদের সংবিৎ ফিরে যেন। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মুরসালিন। আর কেমন একটা কাঁপন নিয়ে বিছানায় টলে পরে যেন ইরা। এরপর বিছানায় শরীর এলিয়ে এসব-ই ভাবতে থাকে মুরসালিনের বলা কথাগুলো।
এদিকে রাজিবের ধনাঢ্য বন্ধু মিলন ওর এ খবর শুনে দৌড়ে যায় থানায়। বিপদে বন্ধুর পাশে থাকা যাকে বলে। সেই কলেজে মিলনের সাথে পরিচয় রাজিবের। একসাথে কাজও করেছিলো রাহাতের বাবা বোরহান সাহেবের দোকানে। কাজ ছেড়ে যৌতুকের টাকায় মিলন যখন ব্যাবসা শুরু করলো এক রাজিব ছায়ার মতো ওর পাশে ছিলো, দিন ঘুরেছে আজ মিলন ফর্মে এসে গেছে। মিলনের সুখে দুঃখে সবসময় পাশে ছিলো রাজিব, তা মিলন ভুলে যায়নি। মীরা যখন একা লড়ে যাচ্ছিলো ব্যাবসা নিয়ে রাজিব তখন আড্ডা দিতো মিলনের কারখানায়। রাজিবের খুব কাছ থেকে দাঁড়াতে দেখা “মীরা ফ্যাশন” এর দেখা সকল চালচিত্রের সারাংশটুকু রাজিব মিলনকে পরামর্শ দিতো পরবর্তী করণীয় হিসেবে। মার্কেট ডিমান্ড স্টাডি করা, কোয়ালিটি মেইনটেইন, দাম কমলে মালামাল স্টক করা, পাইকারদের সাথে যোগাযোগ তৈরী করা সহ অসংখ্য পরামর্শ পেয়েছে মিলন ওর থেকে। পরোক্ষভাবে রাজিব ছিলো মিলনের মেন্টর। সে হিসেবে রাজিবকে মিলন দরকারী মনে করেছে। একটা মানুষ তো আর সব জায়গায়, সবার কাছে ওর্থলেস না, তাই না? তবে রাজিবের কিছু খারাপ দিক থাকার পরও মিলন ওর সাথে মিশে কেবল ওর ভালোটা কে-ই গ্রহণ করছে। একই সাথে কত কত বার ওরা ব্যাবসায়িক পার্টিতে, ক্লাবে, বারে, ভ্রমনে, গিয়েছে, নিজ হাতে নেশা ধরানো পানীয় ওকে ঢেলে দিয়েছে ও বহুবার, কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজে তা একবিন্দুও পান করেনি, বহু নারীতে আসক্ত রাজিবের প্রোমোদ ভ্রমণের সময় মেয়ে নিয়ে রাত কাটালেও, পাশের ঘরেই একা ঘুমিয়ে ছিলো মিলন। মিলন ব্যাক্তি রাজিবকে অপছন্দ করলেও ব্যবসায়িক জ্ঞান বুদ্ধির মানুষ রাজিবটাকে বড্ড ভালোবাসে।
থানা থেকে রাজিব অনেক অনুনয় বিনয় করে কনেস্টেবলের ফোন চেয়ে ফোন করে সাহায্য চায় মিলনের থেকে। কারন ওর জানা হয়ে গেছে ওকে এখান থেকে বাঁচাতে আসবে না মীরা। এটা ভাবাও অপরাধ ওর জন্য।
খবর পেয়ে মিলন থানায় এলে সব খুলে বলে ওকে রাজিব । অনুরোধ করে এ বিপদ থেকে ওকে বের করতে। মিলন বড় উকিল ধরে ওকে জামিনে বের করতে। উকিল জানায় ডাবল মামলা হয়েছে ওর নামে, এ অবস্থায় জামিন পাওয়া টাফ। সত্যি টাফ!. তবুও টাকা ঢাললে সবই হয়, তিনদিন লাগলো ওকে জামিনে বের করতে।
থানা থেকে বের হয়ে কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ও, মিলন ওকে ওর বাসায় নিয়ে যায়। এতদিন যত যাই হয়েছে মীরা বলে ছিলো একজন পিছনে ঢাল হয়ে, সব কিছু থেকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই ঢালই নিজ হাতে ভাঙতে শুরু করছিলো ও চার বছর আগে। গত দুই দিন আগে যেটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে, ঘরভর্তি মানুষের সামনে। তাই সেটাও হারাতে বসেছে ও এখন। একে একে সবকিছু ভেবে দিশেহারা ও। ওর জীবণ অপরিনামদর্শীতা, অমিতব্যয়ীতা, বহুগামিতা এই তিন জিনিস ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্ধ ছিলো ও, মিথ্যের পর্দা দিয়ে বাঁধা ছিলো ওর চোখ। যা সাথী খুলে দিয়েছে। কি না করেছে ও সাথীর জন্য? ওর পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে, দামী দামী ড্রেস, ট্রেন্ডি জুতা, ব্যাগ, শাড়ি, কিনে দিয়েছে যখন তখন। নতুন ফোন, দামী ক্যামেরা এসব দিতে হয়েছে মান ভাঙাতে৷ প্রায় প্রতিদিনই বড় বড় রেস্টুরেন্টে চেক ইন করেছে। বছরে দুই থেকে তিন বার ইন্টারন্যশনাল ট্যুর করেছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। যার প্রত্যেকটিতে রাজিবকে গুনতে হয়েছিল অঢেল টাকা। সবশেষে ওর নামে কেনা ফ্ল্যাট! এই অপয়া ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে ছিনতাইকারী নিয়ে গেলো বিশ লাখ, গত ঈদের ব্যাবসা থেকে আয় করা টাকার সবটা খরচ হলো ওকে ফ্ল্যাট দিতে গিয়ে, তাতেও হয় নি, ঐ ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে মোটা অংকের টাকা ধার করতে হয়েছিল ওকে। যা একবছরে সুদ আসলে কোটির অংক ছুঁই ছুঁই। যারা সময় মতো টাকা ফিরত না পেয়ে ঋণখেলাপীর মামলা করেছে ওর নামে। এসব ভাবনায় কেবল বুদ হয়ে ছিলো গত কয়েকটা দিন। এখনো তাই ভাবছে কেবল। কি হলো, কি করলো ওর কার জন্য?
মিলনের স্ত্রী চা-নাশতা দিয়ে গেছে বহু আগে।চা-টাও ঠান্ডা হয়ে গেছে। গোসল থেকে এসে মিলন ওকে গম্ভীর ভাবে বসে থাকতে দেখে বলে-
: ” যা হয়েছে, তা হবারই ছিলো, সব কিছুরই একটা সীমা আছে, তুমি সব কিছুর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলে। এখন এসব ভেবে কোন লাভ নেই, তোমার হিসেবের খাতা পুরোটাই লস”
রাজিব তখনো মাথা নিচু করে বসা, মুখ তুলে তাকানোর শক্তিটাও যেন ওর নেই। মিলন ওর কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে, মুখ তুলে তাকায় ও। এ তিনদিনে যেন ওর বয়স বেড়েছে কয়েক বছর, চিন্তায় চোয়ালের কাছটায় ঝুলে গেছে, চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, তিনদিনের কারাবাস ওর পোশাকে, শরীরে, মনে দাগ কেটেছে গভীর ভাবে। তাই তো জামিনে মুক্তি পেয়েও ওর আচ্ছন্নতা কাটছে না। এখনো যেন ও কারাবাসেই রয়েছে। আচরণের আড়ষ্টতা বলে দিচ্ছে এমন আকস্মিক পট পরিবর্তন সামলে উঠতে পারেনি ও। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে মীরার মুখাপেক্ষীটা বেশী ভাবাচ্ছে ওকে। করন এ মেয়েটা অনেক করেছিলো ওর জন্য। বিনিময়ে ও মীরাকে কি ফেরত দিয়েছে?
এসব হিসেবে মিলাতে গিয়ে দু-হাতে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে রাজিব। মিলন পাশে বসে ওর, এ দিনটার অপেক্ষায়ই ছিলো ও এতদিন ধরে।
চলবে.. :