প্রিয় ভুল পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭+৪৮

0
405

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার বোন ইরার বিয়ে। পিয়াসার কাছ থেকে কথাটা জেনেছে মীরা। মীরার মা মিসেস জাহানারা চাচ্ছেন স্বামীর মৃ’ত্যুর পর হাতে টাকাপয়সা থাকতে থাকতে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। যদিও ইরার বয়স এখন সতেরো, ও নিজে বিয়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরী না। কিন্তু জাহানারা মেয়েকে একপ্রকার জোর করেই বিয়েতে রাজি করিয়েছেন । পাছে বাবা-ছাড়া মেয়েটা বড় জনের মতো কোন ভুল না করে বসে। এ বয়সেই তো মীরা ভুল মানুষের সাথে ঘর ছেড়েছিলো। ঘর ছাড়ার পর মীরা কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে তা তো তাদের অজানা ছিলো না। মীরার সেইসব কষ্টের কথা শুনে গোপনে চোখের পানি ফেলেছেন তিনি। তবুও মেনে নেন-নি মেয়েকে। এখন যে মীরা প্রতিষ্ঠিত, ভালো অবস্থানে আছেন সে কথাও লোকমুখে শুনেছেন জাহানারা। মীরার মনের জোর ভালো তাইতো পরিশ্রমে ঘুরিয়েছে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু তার ছোট্ট মেয়ে ইরা একেবারে আত্মভোলা। পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বোঝেন না৷ যতটা না আর্থিক অসঙ্গতি তারচে বেশী অন্য চিন্তা। দিনকাল ভালো না। একটা কিছু খারাপ হওয়ার আগেই মান-সম্মানের সাথে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচেন তিনি। কিন্তু ইরা তাকে একটা কথাই বোঝাতে চেয়েছে, যে ও মীরা না, এবং এমন কিছু ও কক্ষণো করবে না। কিন্তু জাহানারা মেয়ের কথা কানে তোলেনি। তিনি ইমোশনালি জব্দ করেছেন মেয়েকে। মেয়ে রাজিও না আবার অমতও না। ইরা মনে মনে তাই ভীষণ রাগ বড় বোনের প্রতি। মীরার করা ভুলের শাস্তি পেতে হচ্ছে ওকে। ছোটবেলা থেকেই দু’বোনের মধ্যে কেমন একটা শীতল সম্পর্ক। পাখা ছাড়া থেকে শুরু করে বাতি নেভানো। দু’জনের পছন্দ বিপরীত। একজন উত্তরে তো আরেকজন দক্ষিণে৷ এ পর্যন্ত কোন একটা বিষয়ে মতের মিল ছিলো না ওদের। তার উপর মীরার এমনি করে চলে যাওয়া, এরপর বাবা-মায়ের সমাজের চোখে ছোট হওয়া এসব ব্যাপার খুব কাছ থেকে দেখে বোনের প্রতি বিরূপ ধারণাটা কমে নি বরং তা দিনেদিনে পরিণত হয়েছে ঘৃণায়। সেই ঘৃণার ইমারতে শেষ ইটটা যুক্ত হলো মীরার কৃতকর্মের ভয়ে মায়ের তড়িঘড়ি করে ওর বিয়ে ঠিক করর বিষয়টা। ইরা ভালো ছাত্রী, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এমনটাই ওর ইচ্ছে ছিলো৷ কিন্তু জীবণ হঠাৎ ওকে কোথায় এনে দাঁড় করালো৷ এরজন্য ও দায়ী করে মীরাকে। ও এমনটা করেছিলো তাই মা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভয় পাচ্ছেন ওকে ভরসা করতে। মীরার সার্টিফিকেট দিয়ে বিচার করছে ইরাকে। এজন্য ওর মন ভয়াবহ খারাপ। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কেবল কাঁদে। এত কষ্টের পড়াশোনা, সব নষ্ট হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন ছিল, কিছু করার। সব আজ ভেসে যাচ্ছে।

যদিও জাহানারা ওকে যথাসম্ভব বুঝিয়েছেন কেন ওর বিয়েটা এখন হওয়া জরুরি। ওদের পরিবারে বলতে গেলে এখন কোন গার্জিয়ান নেই, তার উপর বাপম’রা মেয়েদের বিয়ে দেয়া একটু কষ্টসাধ্যও বটে। হাতে এখন টাকাপয়সা রয়েছে। দুদিন বাদে তাও ফুরাবে। সংসারের দায়িত্ব নিবে সেরকম বড় তো হয়নি ওদের ছোট ভাই নাজিব। মেয়ের জামাই জাহানারাদের সংসার দেখবে এমন আশা করেন না তিনি। বাড়ি ভাড়া আর গ্রামের জমিজিরাত যা আছে তাতে ছেলে নিয়ে ঠিক চলে যাবে তার। কিন্তু যুবতি মেয়ে ঘরে রাখা আর তাকে চোখে চোখে রাখার মতো সাহস, শক্তি কোনটাই নেই তাঁর। মীরা তাকে আছাড় দিয়ে গিয়েছিল সেই কবে, স্বামীর মৃ’ত্যু’র পর ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেছেন তিনি। গত মাসে তিনতলা থেকে একটা মেয়ে পালিয়ে গেলো। দিনকাল খুবই খারাপ। আজ কালকার ছেলে মেয়েদের মতিগতি বোঝার উপায় নেই। তাই তিনি আর মানসিক চাপ নিতে পারছেন না। ভালো ছেলে পেয়েছেন। গত মাসে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলে ইরাকে দেখেছে। অকপটে জানিয়েছে মাকে। মা মিসেস রেবেকা খোঁজখবর নিয়ে নিজেই এসেছেন ইরাদের বাড়িতে। ইরাকেও পছন্দ হয়েছে তারা ও।

ইরা ওর বড় বোন মীরার মতো অনিন্দ্য সুন্দরী না হলেও ওর সৌন্দর্য ও ফেলনা নয়। দুই বোনের মধ্যে পার্থক্য গায়ের রঙে। ইরার গাত্রবর্ণ মীরার মতো দুধে আলতা নয়, ওর গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, ইরা গায়ের রঙ পেয়েছে ওর দাদীর মতো। এছাড়া ওরও মীরার মতো কাটা নাক, পাতলা ঠোঁট, দীঘল কালো চুল আর অতিরিক্ত যা আছে তা হচ্ছে ইরার গভীর দুটি চোখ। এত মায়া চোখ দুটোয়, চোখের বিচারে ইরাও কম যায় না মীরার চেয়ে । কিন্তু এত যত্ন করে, সময় নিয়ে সমাজ দেখে না। তারা সৌন্দর্যের বিচার করে গায়ের রঙ দিয়ে। সেই সুবাদে মীরা এগিয়ে।

কোন দাবী দাওয়া নাই, মা মিসেস রেবেকার চারটি ছেলে, মেয়ে নেই কোন। তিনি তার বড় ছেলের জন্য বউ না তার কন্যাহীন বাড়ির জন্য একটা মেয়ে চেয়েছেন জাহানারার কাছে। তাদের বিনয়ী কথাবার্তা, পরিবার, সব পছন্দ হয়েছে জাহানারার। ছেলেও কম বয়সী। মানুষ পড়ার পাশাপাশি ব্যাবসা করে আর এ ছেলে ব্যাবসার পাশাপাশি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবে। আত্নীয় স্বজন সবাই খুশি এমন সম্বন্ধ পেয়ে। এমন কর্মঠ, শেলফমেইড, সোনার টুকরো ছেলে জামাই হিসেবে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের। সবই ঠিক আছে কিন্তু ছেলেদের বাড়ি না থাকায় একটু আমতা আমতা করেছিলেন জাহানারা। কিন্তু ওর খালা পারভীন বলেছেন- ” ওরা তো ঢাকার স্থানীয়ই, বাড়িও ছিলো আগে, মেট্রোরেলের জন্য সরকার জায়গাটা নিয়ে নিলো, এখন ভাড়া এপার্টমেন্টে থাকে, জায়গা খুঁজছে বাড়ি করার জন্য। বিরাট ব্যাবসা একা দেখে। ছেলে কর্মঠ বড়ি করা তো সময়ের ব্যাপার মাত্র, তুমি অমত করো না। দিনকাল খারাপ, পাছে ও না মীরার মতো…” কথাটা শেষ না করলেও শেষটা যে কি তা তার অজানা না। তাই তিনি খোঁজখবর নিতে বলেন ওদেরকে।

একমাসের মধ্যেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। খুব সাধারণ ভাবেই বিয়ের আয়োজন করবে বলে ঠিক করেন জাহানারা। বাবা মা’রা যাবার পর এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করা অনুচিত। খোদার অশেষ রহমতে মীরা বর্তমানে ইরার বিয়ের খরচ বহন করতে সামর্থ্য। এই তো কিছুদিন আগের কথা ঐ যে ব্যাংকের টাকার মিশনে যে সাহায্য করেছে মজিদ, ওর বিয়ের বৌয়ের যাবতীয় কেনাকাটা করে দিয়েছে মীরা। বিয়ের শাড়ি থেকে লেহেঙ্গা, কানের দুল থেকে চুড়ি, মেকআপ থেকে আইল্যাশ, এমনকি বিয়ে আর বৌ-ভাত দুই অনুষ্ঠানের জন্য দুটো আলাদা হ্যান্ড ব্যাগ ও কিনে দিয়েছে মীরা।

ওমন বিয়েতে এমন কেনাকাটা ওদের ভাবনার অতীত, তবুও কিছু কিছু জায়গায়, পরিস্থিতিতে টাকার হিসেব করে না মীরা। জীবনে চলতি পথে কিছু মানুষ থাকা লাগে চারপাশে , যারা যে কোন পরিস্থিতিতে আপনার প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় হাজির হবে। ওর জীবণে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যার জন্য এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।

কিন্তু বোনটার এমন বিয়ে হচ্ছে ভেবে কষ্ট পাচ্ছে ও। গোপনে কিছু করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারবে কি কিংবা গ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে মীরা। ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি কথা বলেন পিয়াসার সাথে। যদিও পিয়াসা কোন সমাধান দিতে পারে না।

দেখতে দেখতে ইরার বিয়ের দিন এগিয়ে এলো৷ ঘরেয়া আয়োজনে বিয়ে হবে ঠিক করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়ির ছাদে ছোট্ট করে আয়োজন করা হয়েছে। আত্নীয়দের মধ্যে যাদের না বললেই না তাদেরকে দাওয়াত করলেন জাহানারা। পিয়াসারাও গেলো সে দাওয়াতে। মীরার মন ভয়াবহ খারাপ, একমাত্র ছোট বোনটার বিয়ে তবুও যেতে পারছে না, কিছু করতে পারছে না।

অবশেষে বিয়ে হয়ে গেলো ইরার, মেয়েকে তেমন কিছুই দেন নি তিনি, সত্যি বলতে দিতে পারেন নি। তারা কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন এ ব্যাপারে। তাই বলে তো মেয়েকে একেবারে খালি হাতে দিতে পারেন না তিনি। বড় মেয়ে মীরার জন্য কিছু গহনা তৈরি করেছিলেন মীরা ছোট থাকতে। মীরা তো নিজের কপাল নিজেই পুড়ালো৷ জাহানারার ছোট বোন পারভীন এই গহনা দিয়েই ইরাকে বিদায় করার পরামর্শই দিয়েছেন তাকে, কিন্তু এত ঘৃণা কষ্ট থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ইরাকে দিতে পারলেন না তিনি। শত হলেও তিনি তো মা। নতুন করে গহনা গড়লেন ইরার জন্য, মেয়ে জামাইয়ের জন্য গড়ালেন আংটি, আর চেইন। এসবেই বেরিয়ে গেলো অনেকগুলো টাকা। ছেলে পক্ষও তাদের তরফ থেকে গহনা দিলো আরো একসেট, স্বর্ণের পুরো ছড়াছড়ি অবস্থা। ইরাকে সবগুলো গহনাই পরানো হলো। রানীর মতো লাগছে ইরাবতীকে। বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে এসেছে ছেলে পক্ষ। তাদের সাজ পোশাক আর বহর দেখে এলাকা সুদ্ধ মানুষের মুখে মুখে সে বিয়ের গল্প। কত বড় বাড়ির লোক এরা তা যেন না বলেই বলে দিচ্ছে তাদের সাজ পোশাক বহরে। মীরাদের তিনতলা ছোট্ট বাড়ি। এমন বাড়ির মেয়ে এত ভালো জায়গাতে বিয়ে হচ্ছে। সকলে মন থেকে দোয়া করছে, এবার বুঝি এ বাড়ির বড় মেয়ের করা কৃতকর্ম ঢাকবে। সবাই ভুলেই যাবে এ বাড়ির বড় মেয়ের কেলেঙ্কারির কথা, সবার মুখে থাকবে কেবল ইরার ইরাবতী হয়ে উঠার গল্প। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দোয়া করে মীরা। ইরাবতী সুখি হোক। কোন দুঃখ ওকে না ছুঁক।

পরদিন থেকে সবকিছু আগের মতোই চলতে শুরু করে। মীরাদের দুঃখ করে সময় নষ্ট করার সময় কই? বাসা থেকে বেরিয়ে মীরা সোজা গেলো গাড়ির শো-রুমে। পাভেলও এলো কিছু পরে। গত সপ্তাহে পাভেল দেখে, ফাইনাল করে গেছে গাড়ি। আজ মীরা এসে পেমেন্ট কম্পলিট করে গাড়ি পাঠানোর ঠিকানা দিয়ে দিলো তাদেরকে । এরপর মীরা গেলো নিজের অফিসে। গাড়ি দুপুরের আগে পৌঁছে গেলো ঠিকানা মতো।

দুপুরের পর মীরার ফোনে একটা কল এলো। ফোনটা দেখে রিসিভ করলো না মীরা। সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো ও। একটু পরে অফিসের টেলিফোন বেজে উঠে। অভ্যস্ততায় সেটাকে রিসিভ করে মীরা। ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: এইডা যে তোমার কাম তা আমি জানি, কেন এমন করতে গেলা তুমি? – কথাটা বললেন ওদের পুরাতন কারখানার মার্কেট কমিটির সভাপতি
“মুখলেস চাচা”। যিনি ফোনে না পেয়ে টেলিফোনে কল করেছেন মীরাকে৷ তিনিনসেই মুখলেস চাচা, যিনি মীরাকে যে মেয়ের মতো ভালোবেসে রাজিবের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন বহু আগেই। কিন্তু মীরা তা মনে রাখে নি, মিথ্যে ভালোবাসায় তার পরামর্শ কাজে লাগায় নি। একটু পর আবার ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: কি গো মা, কথা কও না ক্যা?

উত্তরে কেবল মুচকি হাসে মীরা। এরপর বলে-
: এটা আমার পক্ষ থেকে ওদের জন্য গিফট চাচা।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুপুরের পর মীরার ফোনে একটা কল এলো। ফোনটা দেখে রিসিভ করলো না মীরা। সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো ও। একটু পরে অফিসের টেলিফোন বেজে উঠে। অভ্যস্ততায় সেটাকে রিসিভ করে মীরা। ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: এইডা যে তোমার কাম তা আমি জানি, কেন এমন করতে গেলা তুমি? – কথাটা বললেন ওদের পুরাতন কারখানার মার্কেট কমিটির সভাপতি
“মুখলেস চাচা”। যিনি ফোনে না পেয়ে টেলিফোনে কল করেছেন মীরাকে৷ তিনিনসেই মুখলেস চাচা, যিনি মীরাকে যে মেয়ের মতো ভালোবেসে রাজিবের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন বহু আগেই। কিন্তু মীরা তা মনে রাখে নি, মিথ্যে ভালোবাসায় তার পরামর্শ কাজে লাগায় নি। একটু পর আবার ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: কি গো মা, কথা কও না ক্যা?

উত্তরে কেবল মুচকি হাসে মীরা। এরপর বলে-
: এটা আমার পক্ষ থেকে ওদের জন্য গিফট চাচা।

: মা-গো, আমারে আল্লাহ ট্যাকা,পয়ছা, ইজ্জত বহুত দিছেন, কিছুরই কমতি নাই। গাড়ি কি আমি কিনা দিবার পারতাম না?

: চাচা আমি কিন্তু কোনভাবে আপনাকে হেয় করতে গাড়িটা পাঠাই নি, আপনি তো সবই জানেন আমার ব্যাপারে। আমি আসলে একটা কিছু করতে পারার লোভ সামলাতে পারি নি। সম্ভব হলে আরো বেশী ই দিতাম। আমার বোন-বোন জামাইর জন্য এটা কোন গিফট ই না। ওরা আরো বেশী কিছু ডিজার্ভ করে। কিন্তু আমি আমার সাধ্য মতো…

: হইছে, হইছে তোমার লগে কথা পারমু আমি! যাক গা দিছো ভালোকথা ছব ভুইল্যা বোনেরে কই বিয়া দিলা আগুনে নাকি পানিতে আইয়্যা দেইখা যাইও।

: ছি চাচা, আমি জানি না আপনারা কেমন?
আপনি এত বড় ব্যাবসায়ী, চাচী কত্ত ভালো মানুষ। আপনার ছেলেরাও সোনার টুকরো ছেলে। আপনার এত থাকা সত্ত্বেও নিজেরা নিজেদের যোগ্যতায় যে যার পথে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকাইয়্যা ছেলেরা তো বেশীরভাগই বাবার সম্পদ নেড়েচেড়ে আর বাড়ি ভাড়ার টাকায় চলে। সেদিক থেকে ভাবলে আপনার চারটি ছেলেই ব্যাতিক্রম, আর আপনারা স্বার্থক বাবা মা। আপনারা এত উঁচু মনের আর ধন-সম্পদের মালিক হয়েও আপনাদের বড় ছেলের জন্য আমার বোনকে পুত্রবধূ করে এনেছেন। খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে যাচ্ছে।

: আরে ধূর, কি যে কও। একটা কথা ছুন মা, আমি তোমার কথা মতো তোমার বোনেরে দেখবার গেছি, এটা কথা ছত্যি, তয় মাইয়্যা, পরিবার, বাপ মা পছন না হইলে আমি কইলাম ছমন্দ করবার মানুছ না। আমারে তো তুমি চিনো-ই, আমি নিজে যা ভালা মনে করি তাই করি। কাওরে খুছি করবার লাইগ্যা আমি আমার পোলার জীবণ গুটিতে লাগামু, এইটা তোমার মনে হইলো? আমি ছব খোঁজ খবর নিয়া আগে বাড়ছি, তোমাগো পরিবারে বড় মাইয়্যার অকালে এক পোলার হাত ধইরা ভাইগা যাওয়া ছাড়া আর কোন কেলেম নাই, আর যে বড় মাইয়্যা ভাইগা গেছে হেরে আমার চেয়ে ভালো চিনে কেডায়? তার উপর তোমার বাবা সাঁচ্চা দিলের মানুছ, ব্যাবসা করছে৷ ট্যাকা কামাইছে হক উপায়ে। মানুছটা মইরা গেছে মাগার তারে এখনো মানুছে ভুলে নাই। ছোন মা খোদায় দিল দেইখ্যা বিচার করে। আমি মানুছ বিচার করি এলেম দেইখ্যা। আমাগো পরিবার ট্যাকা পয়ছা দিয়া আগায়া আছে আর তোমরা আগায়া ছিক্ষা দিয়া। আমাগো বংছে আমার বড় পোলায়ই পয়লা গ্রেজুয়ট না কি জানি কয় হেইটা, আর তোমাগো বংশে তোমরা তিন পুরুছ ছিক্ষিত। তুমিও তো কত কিছুর ভিতর দিয়া পড়ালেখাডারে চালায়া গেছো।

তোমার চাচী বহুত আগে পোলার বউ হিছাবে দুইটা শর্ত দিছিলো পোলারে, যদি নিজে পছন কইরা থাকে হেল্ল্যাইগা। এক হইলো- মাইয়্যার বয়ছ হইতে হইবো কম, যাতে নিজের মেয়ের মতো কইরা বড় করবার পারে।

আর দুই হইলো- মাইয়্যা পড়লােখায় হইতে হইবো ক্ল্যালাসের ফাস্ট। যাতে বিয়ার পরও পড়ালেখা কইরা ভালো কিছু হইবার পারে।

ছৌন্দর্য হইলো গিয়া তিন নম্বরে। সেদিক বিবেচনায় তোমার বইন পাশ। তাছাড়া আমার পোলারও পছন হইছে তোমার বইনেরে। আর কি চাই কও? আমরা পোলার বউ না ঘরে মাইয়্যা আনবার চাইছি । যে ঘর ভইরা গুরগুর কইরা হাঁটবো। লেখাপড়া কইরা বড় কিছু হইবো। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছে। আমরা তো মা কিছু হইবার পারি নাই, পোলারাও ব্যাবছার হাল ধরতে গিয়া পড়ালেখাটারে ২নম্বরে জায়গা দিছে। এহন আল্লার কাছে দোয়া করবা নাতি-নাতকুরগো জানি ছিক্ষায় বড় করা পারি।

(কথাগুলো শুনে আনন্দে চোখের পানি এসে পরে মীরার৷ সত্যি ওর বোন ভাগ্যবতী৷ মেয়েরা কেন যে শ্বশুর শ্বাশুড়ি পছন্দ করে না! বিয়ের পর কত অযুহাত দাঁড় করিয়ে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু যৌথ পরিবারে থাকাটা যে কি আনন্দের, কি সুখের তা ওরা জানে না)

অপর পাশে চুপ থাকতে দেখে মোখলেস চাচা ভাবে লাইন কেটে গেছে, তাই তিনি বলেন-
: কিগো মা আছো? নাকি লাইন কাইটা গেছে?
নাক মুছে মীরা বলে-
: না চাচা, আছি। আমি জানি আপনাদের কাছে আমার বোন অনেক ভালো থাকবে৷ তাই তো চাচীর কাছে আপনাদের ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন জেনে নিজের বোনের কথা বলেছিলাম চাচীকে।
: হ মা, ইরার সবচেয়ে বড় পরিচয় হইলা তুমি। আমি বুদ্ধিমান কিছু মানুছের চারপাছে থাকবার চাই।
: কি যে বলেন চাচা,
: না, মা একটুও বাড়ায়া কই নাই। কই থেইকা কই আইছো তোমরা, একমাত্র বুদ্ধি ছম্বল কইরা। জীবণে জ্ঞানডাই হইলো আছল। তাইতো আমি এলেমেরে ছম্মান করি।
: চাচা এসব আপনার বিনয়। আরেকটা কথা চাচা গাড়িটা যে আমি পাঠিয়েছি তা ওদেরকে বলবেন না প্লিজ৷ বলবেন আপনি নতুন বৌ-মাকে উপহার দিলেন।
: ছরি মা, মিছা কথা আমি কইতে পারমু না মা।
: আমি দিয়েছি জানলে ইরা এটা ব্যবাহারই করবে না হয়তো, প্লিজ চাচা সময় হলে না হয় বলবেন সত্যিটা। প্লিজ…
: আইচ্ছা তবে আমারো শর্ত আছে, তুমি আমাগো বাড়িতে আইছা দেইখা যাইবা।
: আসবো ইনশাআল্লাহ, ওরা যখন নাইওরে যাবে আমি এসে দেখে যাবো৷
: আইচ্ছা মা, ভালো থাকো, রাখি
: আপনিও ভালো থাকবেন তালই, আসসালামু আলাইকুম। -বলেই একটা হাসি হাসে মীরা। জবাবে মোখলেস চাচাও সালামের উত্তর দেয় হেসে৷

ফোনটা রেখে রিভলভিং চেয়ারটায় শরীরের ভর ছেড়ে বসে মীরা। নিজেকে অনেক হালকা লাগে ওর। পিয়াসর কাছে যখন শুনেছিলো ও যে ইরাকে বিয়ে দিতে ভালো ছেলের খোঁজ করছেন ওর মা। তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল সবটা জেনে। আজ ওর করা ভুলের খেসারত দিতে হবে ওর বোনকে। এত অল্প বয়সে বিয়ে, তার উপর কেমন না কেমন পরিবারে গিয়ে পরে ও। এসব ভাবনায় ও বুদ।
একটা ভুল কিভাবে একটা পরিবার একটা প্রজন্ম বয়ে বেড়ায় তারই যেন সাক্ষী ও নিজে। ভুলের মাসুল পরিবার হিসেবে ইরা ভোগ করছে আর প্রজন্মের হিসেবে নূহা।

এরই সপ্তাহ খানিক পরে মোখলেস চাচার স্ত্রী রেবেকা নিজেই ফোন করেন মীরাকে। ওর তো বেশ জানাশোনা আছে। পরিচিতদের মধ্যে তার ছেলের জন্য ভালো মেয়ে খুঁজে দিতে৷ তিনি ঘটক দিয়ে ছেলের বিয়ে দিবেন না৷ ঘটকরা একটা সত্য বললে তিনটা বলে মিথ্যা৷ তাই জানাশোনার মধ্যে কাওকে খুঁজছেন। কেমন মেয়ে চাই প্রশ্ন করলে তিনি তা ছেলের বৌয়ের জন্য নিজের ইচ্ছার কথা জানান মীরাকে। অল্প বয়সের, পড়ালেখায় ভালো সুন্দরী মেয়ে খুঁজছেন তিনি। মীরা তখন নতুন আউটলেট নিয়ে ব্যাস্ত। ওর বোনের কথা তখন মনেই হয় নি। মীরা ওদের এপার্টমেন্টের নয় তলার এক মেয়েকে দেখিয়েছে রেবেকা চাচীকে৷ পরিবার পছন্দ হলেও মেয়ে তাদের পছন্দ হয় না। এত সুন্দর মেয়ে পছন্দ না হওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- “মেয়ের বয়স নাকি একটু বেশী”

এরপর কেটে যায় অনেক দিন। মীরা এক প্রকারে ভুলেই যায় এসব কথা৷ হঠাৎ একদিন পিয়াসার ফোন কলে জানতে পারে ওদের পাশের বাড়ির জিকুর জন্য নাকি ইরার প্রস্তাব এসেছে। জিকু একসময় মীরার পিঁছু পিঁছু ঘুরতো, আর এখন ইরার জন্য সম্বন্ধ! কথাটা শুনে গা রিরি করে ওর। জিকু যেন নাম বদলানো আরেক রাজিব। অর্থসম্পদ ওদের অনেক আছে কিন্তু ও নিজে ফালতু একটা ছেলে৷ আজ এই মেয়ে তো কাল অন্য মেয়ে। সমবয়সীদের কাছে সমবয়সীদের আসল খবর থাকে। মীরা আর জিকু সমবয়সী। তাই ও জিকুর আসল চেহারাটা চেনে। ভয় হয় ওর, ওর মতামত জানাবে এমন কোন উপায় নেই, আর ওর মতামত তারা শুনবেনই বা কেন?

এক রাতে কি ভেবে হঠাৎ রেবেকা চাচীর কথা মনে হয় ওর। আবার ভাবে নয়-তলার রেহনুমা কত সুন্দরী, তাকেই পছন্দ হলো না তার, ইরার গায়ের রঙতো একটু ময়লা। তার উপর ওর বাবাও নেই। তারা কি বাবা হীন এক পরিবারে ছেলে বিয়ে দিবেন?
পরপর দুটো দিন এ ভাবনাই কেবল ভাবতে থাকে ও।
তাকে কি বলবে ইরার কথা?

অবশেষে “বললেই দেখি কি হয়” ভেবে ইরার কথা বলেন তাদের। তারা মীরার বোন বলে আগ্রহ দেখায়৷ যদিও মীরা আগেই বলেছিলো আমার বোনের গায়ের রঙ…। কথাটা শেষ করতে দেন না রেবেকা চাচী। বলেন ঠিকানা দাও দেখে আসি। দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাবে না।

এরপরের গল্প সবার জানা। আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই তো মীরার কথা গোপন রেখে বিয়েটা হয়েই গেলো ইরাবতীর। আল্লাহ ওর মাকে চিন্তামুক্ত করেছেন। ভালো ছেলের কাছে সসম্মানে মেয়েকে তুলে দেওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোন শব্দই যেন উপযুক্ত না। এমন ঘর, এমন বর, শ্বশুর শ্বাশুড়ির ভালোবাসা। এত ভালোবাসা সত্যি কপাল লাগে।

এদিকে বিয়ে বাড়িতে পুরো হুলস্থুল কান্ড নতুন গাড়ি নিয়ে। মোখলেস চাচা গাড়ির চাবি হাতে আগে যান তার স্ত্রীর কাছে। সব খুলে বলেন তাঁকে। তারপর তিনি নতুন বৌয়ের কাছে গিয়ে বললেন-
: মা তুমি আমাগো বউ না আমাগো মইয়্যা। এটা তোমার জন্য উপহার…
তিনি সচতুর ভাবে এড়িয়ে যান কে দিয়েছে সে কথাটা। তিনি কিন্তু বলেন নি “এটা তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার”। বলেছেন-
এটা তোমার জন্য উপহার…
কার তরফ থেকে তা উহ্য করে রেখেছেন।

ইরা যেন একটু বেশীই চমকিত হয়েছিলো। একে তো বিয়ের ঘোর কেটেই বের হতে পারে নি মেয়েটা তার উপর এত দামী গাড়ি। বেশ কিছুটা সময় লাগে ওর ব্যপারটা বুঝতে৷ তারপর তিনি যখন ওর হাতে গাড়ির চাবিটা গুঁজে দেন, ইরা তখন তার হাত ধরে কেঁদে ফেলে তার এমন ভালোবাসা দেখে।

ঘরসুদ্ধ মানুষ অবাক হয়ে দেখে বৌ-শ্বশুর বনাম বাবা-মেয়ের ভালোবাসা। ইরা যেন ওর বাবার হাত ধরেছে আর মোখলেস চাচা তার সদ্যজাত কন্যাকে।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দেশের স্বনামধন্য পোশাক ব্র্যান্ড নতুন উদ্দ্যোক্তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে উদ্দ্যোক্তা মেলার আয়োজন করেছেন বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানকার আয়োজকেরা দেশের বৃহৎ, মাঝারী, ক্ষুদ্র পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এক ছাদের নিচে করতে এ আয়োজন করেছেন। এখানে তারা নিজেদের তৈরী পন্য নিয়ে অংশ গ্রহণ করবে। যাতে তারা তাদের আইডিয়া, মতামত একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারে, এখান থেকে নতুন আইডিয়া জেনারেট করতে পারে। টুম্পার এক বান্ধবী ঐ অনুষ্ঠানে ভলেন্টিয়ারের কাজ করছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছে ও এ কাজটা করতে চায় কি না। টুম্পা যাবে কি না তা মীরাকে জিজ্ঞেস করতে মীরা বললো –
: অবশ্যই যাবি, এ ধরনের প্রোগ্রামে কত বড় বড় লোকের আগমন হয়, নতুন নতুন মানুষ নতুন নতুন আইডিয়া, নতুন অভিজ্ঞতা তুই অবশ্যই যাবি।
: কিন্তু আপা এক সপ্তাহ টানা যেতে হবে, তাই…
: আমার একটু কষ্ট হবে তুই না থাকলে, তবে তোর ঐখানে যাওয়াটাও জরুরী। নতুন নতুন আইডিয়া আমার সাথে শেয়ার করবি, তাই না তোকে দিচ্ছি যেতে।

টুম্পা হেসে দেয় মীরার বলার ভঙ্গি দেখে। যেন মীরা তার নিজের লাভেই টুম্পাকে যেতে দিচ্ছে, তা নাহলে দিতোই না।

পরের সপ্তাহে টুম্পা নিয়মিত যাওয়া শুরু করে ঐ ইভেন্টের প্রস্তুতির কাজে। দ্বিতীয় দিন বাসায় ফিরে মীরাকে টুম্পা বলে-
: আপা আপনি কেন অংশগ্রহণ করছেন না?
: আমি! আমি কিভাবে পারটিসিপেট করবো? আমার তো নিজস্ব কোন প্রেডাক্ট নাই, পরের মালামাল এনে বিক্রি করি।
: আপনি কি মেন্টালি মেনে নিয়েছেন যে “মীরা ফ্যাশন” আপনার কিছু না? ওটার মালিক এখন রাজিব ?
টুম্পার মুখে রাজিব কথাটা শুনে কেমন যেন ঘাবড়ে যায় মীরা। টুম্পা সবসময় রাজিবকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে। আজ রাজিব বলাতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ব্যাপারটা টের পেয়ে টুম্পা বলে-
: কি অস্বস্তি হচ্ছে রাজিব বলায়?
মীরা সোজা হয়ে বসে ওর প্রশ্নের বিপরীতে। যা স্পষ্ট করে কথাটার ওর মনের ঘরে আঘাত করার ব্যাপারটা। স্মিত হেসে টুম্পা বলে-
: আপনার মানসিক স্থিতি দেখতেই কথাটা ইচ্ছে করে বলেছি আমি। বাদ দিন আপনাকে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া যাবে না।
এবার মীরা নড়েচড়ে বসে বলে-
: শোন চিন্তাভাবনা ছাড়া জীবণে আমি একটা কাজই করেছিলাম, যা আমার জীবণটাকে উলোট পালোট করে দিয়েছে। এখন যা কিছু আমি মানসিক ভাবেই বল বাস্তবিক ভাবেই বল ভাবি বা করি তা অনেক চিন্তা ভাবনা করেই করি। প্রতিটা কাজের আমার নিজস্ব কিছু প্ল্যান রয়েছে।
: কি প্ল্যান আছে শুনি? বললাম তার অবর্তমানে কারখানার মালামাল গুলো চুরি করার কথা, শুনলেন না, বললাম আগুন লাগিয়ে দেন কারখানায়, তাও শুনলেন না। আমার নিজেরই তিতা লাগে এসব এখন।
এত ধৈর্য আপনার আসে কোত্থেকে? এসব কিচ্ছা কাহিনি শেষ করে নতুন করে জীবণ শুরু করুন।
: আমার গল্পে নতুন করে শুরু করা বলতে কোন অধ্যায় নেই। রজিব আর মীরার গল্প একই সাথে শেষ হবে।
: তাহলে নূহা? ওর কি হবে? নাকি আপনি ভুলেই গেছেন যে আড়াই বছর বয়সী আপনার একটা মেয়ে আছে?
মীরা উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে টুম্পার দিকে৷ সত্যি যেন ও ভুলে গেছে নূহা নামে একটা মেয়ে আছে ওর। সেই উদ্ভ্রান্ত ভাব লুকাতে ব্যাস্ত ভাবে বললো-
: কেন তোরা দেখবি না ওকে?
: আপা এগুলো গা ভাসানো কথাবার্তা, এসব কথাবার্তা আপনার সাথে যায় না। প্লিজ আপনার মনে কি আছে আমাকে বলুন। আমি শুনতে চাই।
: তুই অনেক করেছিস আমার জন্য, এ বয়সে জীবণের অনেক রঙ ও দেখে ফেলেছিস। আমি এসব আমার মধ্যে রেখেছি যদি কোন ঝামেলা হয় তুই যাতে না ফেঁসে যাস।

কথাটা বলেই এমন ভাবে হাসলো মীরা যেন খুব মজার কিছু বলেছে ও। টুম্পা মীরার বিপরীতের চেয়ারটা টেনে বসে হাতদুটো ধরে ওর, মাথাটা ওর দিকে ঝুঁকিয়ে বলে-
: আপনি খু*ন-খারাবি কিছু ভাবছেন কি?
উত্তরে মুচকি হাসে মীরা, কিছুসময় মৌণ থেকে বলে-
: মাজেদা খালা এত হাইপার মেজাজের, এত বেশী কথা বলেন তিনি, তবুও তাকে কেন রেখে দিলাম আমি জানিস? রান্না তিনি মজার রাঁধেন এটা সত্যি তবে স্ট্রং পয়েন্ট হচ্ছে তার মাছ কাটা। তিনি যেদিন প্রথম এলেন মনে আছে তোর ভাইয়ের গ্রাম থেকে আনা পাঁচ কেজি ওজনের কাতলার মাথা তিনি কেটে ফেলেছেন অবলীলায়। অথচ তার হাতের থাবা আমার চেয়েও ছোট। কথাটা বলে মীরা ওর থাবাটা এগিয়ে দেয় টুম্পার দিকে৷ টুম্পা মীরার থাবা দেখে কেমন যেন ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে আরেকটু পিছিয়ে যায়। ওর মনে পরে ইদানীং মীরা বাজার থেকে বড় বড় মাছ আনায় মাজেদা খালাকে দিয়ে। নিজ হাতে কাটে সেগুলো। এমনকি মস্ত বড় ব*টিও তৈরী করে এনেছে করবানীর ঈদে কামাড়ের দোকান থেকে। দোকানি বলেছিলো-
: “এমুন বড় বডি বানায় না আজকাল মানুষ, এইডা দিয়া মানুষও কাইট্টা লাইতে পারবেন আফা”-বলে অট্টহাসি হেসেছিলেন দোকানি। কোরবানির ঈদ হওয়ায় ব্যাপারটা গায়ে মাখে নি টুম্পা। কিন্তু এখন যেন সবগুলো ডট মিলে যাচ্ছে একেরপর এক।

টুম্পা আবারো মীরার কাছে এসে বলে, এসব ভাবনা বাদ দেন আপা, মশা মারতে কামান দাগা কেন। ওকে ফাইন্যান্সিয়ালি পঙ্গু করে দেন ব্যাস, লাথি মেরে বের করে দিয়ে নিজে নতুন করে শুরু করুন। ব্যাংকে সেদিন আবীর ভাই তো ….

কথাটা শেষ করতে দেয় না মীরা দাঁড়িয়ে পরে রাগান্বিত গলায় বলে, আমার গল্পে আবীর নেই টুম্পা। এ কথা আর যেন তোর মুখে না শুনি। বলেই বেরিয়ে পরে বসার ঘর থেকে।

তারপর দুইদিন যায় যার যার মতো করে। রাজিব ব্যাস্ত টাকা ম্যানেজ করতে। ব্যাবসার ডাল সিজন চলছে এখন। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসাটা চালিয়ে রাখাটাই বড় চ্যালেন্জ।

ট্রেনিং এর চতুর্থ দিন টুম্পা মীরার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। মীরা দেখেও না দেখার ভান করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ধুলো ঝাড়তে থাকে। টুম্পা মনে মনে ভাবে রাতের বেলা কেও ধুলো ঝাড়ে?

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সাহস সঞ্চয় করে বলে-
: একটা কথা বলতে এসেছিলাম,
: কি কথা? -রাগান্বিত কন্ঠে বলে মীরা
: পাাপাশি দুটো স্টল খালি আছে, আমার মনে হয় আপনার নিজের সেখানে অংশ নেয়া উচিত।
: কি নিয়ে যাবো সেখানে? আলু, পটল?
: ভাইয়াকে বলে…
তড়াক করে তাকায় মীরা ভাইয়া কথাটা শুনে। যেন রাজিব সম্বোধনটাই আশা করেছিলো ও।
: ভাইয়াকে বলে কি?
: আপনি মনে মনে সব যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন তা তো তিনি জানেন না। আপনি আপনাদের প্রোডাক্ট নিয়ে যাবেন সেখানে, স্পেশালি গাউন গুলো নিয়ে।

নরম চাহনিতে তাকায় মীরা, টুম্পা কথাটা বলে চলো যায় ওর ঘরে। রাতে রাজিবকে মীরা টুম্পার আইডিয়াটা শেয়ার করে। রাজিবের পছন্দ হয় আইডিয়া। ব্যাবসার যা অবস্থা যাচ্ছে। এতে করে পরিচিতিটা যদি বাড়ে একটু। রাতের বেলা মোটামোটি ফাইনাল হয় কথাবার্তা। পরদিন সকালে স্টল না দেখেই টুম্পার কাছে বুকিং মানি দিয়ে দেয় মীরা। যদিও স্টলটা একটু পেছনের দিকে, তবুও দুপুরের দিকে ওরা বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখতে যায় ওরা৷ স্টলটা পেছনে হাওয়ায় আয়োজকেরা স্পেস একটু বেশী দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। তবে পেমেন্টটা বেশী বলে মীরার কাছে ফিসফিস করে বলে রাজিব, বাকী সব ঠিকঠাক। বাকী সব ঠিক থাকলে আসছে সপ্তাহে হতে যাচ্ছে মূল ইভেন্ট।

সেদিন রাতেই রাজিব এসে গাইগুই শুরু করে দিচ্ছে, ও ইনিয়েবিনিয়ে বলছে নিজের জন্য আলাদা স্টল বুকিং করতে। বলে-
: শোন তোমার এখন নিজের গ্রো করার সময়, তুমি কেন আলাদা স্টল নিয়ে নিচ্ছো না, আলাদা পরিচিতি পাবে তোমার বিজনেসটা।
মীরা হেসে বলে-
: কেন ‘মীরা ফ্যাশন’ কি তোমার একার নাকি, তুমি বরং কেও না এ বিজনেসের। এটার পরতে পরতে আমার জ্ঞান, শ্রম, ঘাম, মিশে আছে। আর সেটা এমন ভাবে মিশেছে যে চাইলেও তা মুছে ফেলতে পারবে না তুমি।

কথাটা শুনে কেমন একটা অট্টহাসি হেসে রাজিব বলে-
: আরেহ্ আমি কি তা বলেছি?
কৃত্রিমতা মিশানো সে হাসিটায় বিশ্রী দেখালো ওকে।

মীরা রাজিবের আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে। রাজিবের প্রতি ঘৃণাটা যেন শক্তপোক্ত হলো ওর এমন আচরণে। মীরা এমনিতেই যে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে তা মেনে নিতে পারছে না রাজিব। তারউপর এই ব্র্যান্ড আর মীরা একজায়গায় পরিচিতি পাক সেটা ও চাচ্ছে না।

রাতটা ভেবে মীরা সিদ্ধান্ত নেয় নিজে একটা স্টল নেয়ার। কিন্তু অলরেডি সব স্টল বুকিং হয়ে গেছে। শুনে ভেঙে পরে ও এখন কি করবে মীরা তাই কেবল ভাবছে। বেহায়ার মতো যাবে মীরা ফ্যাশনের প্রতিনিধি হয়ে নাকি যাওয়াটা স্থগিত করবে।

এদিকে ইরা নতুন গাড়িতে করে নাইওরে গিয়েছে বাবার বাড়ি। ইরার বর ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওর কাজে গেছে। জাহানারা বললো-
: “আজ না গেলে হয় না বাবা?”
লজ্জিত ভঙ্গিতে ইরার বর মুরসালীন বলে-
: “ভীষণ জরুরী কাজ মা, না গেলেই নয়”
বরকে বিদায় করে ইরা গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসলো সবার সামনে। মিমিক্রি করে দেখালো বাড়ির কে কিভাবে হাঁটে, কথা বলে, আরো বললো ওর শ্বাশুড়ি শ্বশুড়ের ওকে আদর করার গল্প, সবশেষে গাড়ি উপহার পাবার গল্পটা। সকলেই মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনছে ওর কথা। জাহানারা এসবে পাত্তা দিচ্ছে না এমন একটা ভাব বজায়ে রেখে সকলকে নাশতা দিচ্ছে। তিনি বরাবরই এসব আবেগকে বাক্সবন্দি করে রাখতে পছন্দ করেন, পছন্দ করেন আড়াল থেকে গোপনে ভালেবাসতে।
যেটা প্রকাশ পেয়েছে ইরার বিয়ের গয়না তৈরীর সময়। এত কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গাঁটের পয়সা থেকে নতুন গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন ছোট মেয়েকে। মীরার জন্য যা রেখেছিলো তাতে হাত দেন নি। তবে দূর থেকে দাঁড়িয়ে মেয়ের এই গল্পটা, গল্প বলার ধরনটা উপভোগ করছেন তিনি। গোপনে চোখও মুছছেন ওড়নায়। কে বলবে এই মেয়েই বিয়ে করবে না বলে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলো দুদিন আগে?

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

তুমুল ব্যাস্ততায় উদ্দ্যোক্তাদের ঐ মেলা শেষ হয় সেবার। বেচা বিক্রি তেমন না হলেও অনেক পরিচিতি পায় ওদের বিজনেসটা । মীরার আপন করা, সহজে মিশতে পারার গুণে নানান মানুষের সাথে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব ও হয় অনেকের সাথে, অনেকের সাথে হয়েছে পরিচয়ের চেয়ে বেশী কিছু। ফোন নম্বর, ঠিকানা আদানপ্রদান, বাড়ির তৈরী খবার শেয়ারিং সহ আরো কত কি। শিখেছে পরিস্থিতি মোকাবিলা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা সহ আরো কত কি। বাড়তি পাওনা হিসেবে বহু দিন পর যেন আনন্দের অন্য রূপ দেখতে পেয়েছে ও এখানে এসে। সকলেই এত আন্তরিক, দিলখোলা যেন সকলে মিলে একটা পরিবার।

এক একটি উদ্দ্যোক্তা এক একটি গল্প। ভেঙে যাওয়া মীরা এখানে এসে সবচেয়ে বেশী যা শিখেছে তা হচ্ছে হার না মেনে এগিয়ে যাওয়া। দৌড়াতে না পারো হাঁটো, হাঁটতে না পরো হামাগুড়ি দাও, তবুও থেমে থেকো না। সবমিলিয়ে ভালোই কাটে তিন তিনটা দিন। মীরা রাজিবের ঐ স্বার্থপর মার্কা আচরণে ভেবেছিলো যাবে না প্রোগ্রামে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভেবে যেন মন স্থির করে যাওয়ার। যদিও টুম্পা অনেক ইনসিস্ট করেছে অনেক।

মীরা আর মীরা ফ্যাশন একসাথে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারটা অনেকেই জানতো না। সকলকে তো আর ধরে ধরে বলা যায় না যে আমিই মীরা, মীরা ফ্যাশনের ওনার। তবে শেষের দিন পুরস্কার আর সার্টিফিকেট বিতরণের সময় নাম ঘোষণা করায় সকলে দেখে মীরাকে। সঞ্চালিকা ঘোষণা করে- ‘মীরা’ দা ওনার অফ মীরা ফ্যাশন”। সকলের করতালিতে মুখরিত হয় পুরো হল ঘরটা। মীরার পাশে বসা রাজিবের দিকে তাকায় মীরা। যেন বিশাল কোন অর্জন বুঝিয়ে দিতে ডাক এসেছে তার, এমনি ভাব তার চোখমুখে। রাজিব খুব কষ্টে হেসে ওকে ইশারায় যাওয়ার জন্য বলে। মীরা যাওয়ার আগে রাজিবের হাতের উপরে হাত রেখে আলতো করে চাপ দেয় একটা৷ এটা উদযাপনের আনন্দ শেয়ারিং না ওনারশীপ কেড়ে নেয়ার উদযাপন তা বুঝতে পারে না রাজিব। মীরা রাজিবের পাশ থেকে উঠে রওনা দেয় স্টেজের দিকে। পার্পল রঙের ফ্লোর টাচ গাউন পরা মীরাকে রানীর মতো দেখাচ্ছিলো তখন। সকলেই তাকিয়ে দেখছে মীরা ফ্যাশনের ওনার অনিন্দ্য সুন্দরি মীরাকে৷

ও খুব সাধারণ কিছু আনতে যাচ্ছে, পুরস্কার হিসেবে একটা কাচের ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট নামের কাগজের একটা টুকরো। কিন্তু এগুলোর চেয়ে বেশী যা আনতে যাচ্ছে তা হলো ওর হারিয়ে ফেলা কর্তৃত্ব, মুছে ফেলা সম্মান। যে ব্যাবসা গড়ে তুলেছিলো ও রক্ত পানি করে, তারই মালিকানা যেন ফিরে এলো এই ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেটের মাধ্যমে, তাও হল ভর্তি মানুষের সামনে৷ অসাধারণ কিছু ফিরে পাবার সুখ কাজ করছে ওর ভিতরে। চোখে ভেসে উঠছে কষ্টের সেই এক একটি দিন। মনে মনে টুম্পাকে কৃতজ্ঞতা জানায় ও এ অনুভূতির স্বাদ নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

টুম্পা স্টেজে ছিলো ভলেন্টিয়ার হিসেবে, ওখান থেকে লক্ষ্য করে সকলে করতালি দিলেও রাজিব গা এলিয়ে বসে বৃদ্ধাঙ্গুল কামড়ে কি যেন ভাবছে। কি আর ভাববে ও, হাত কামড়াচ্ছে এই ভেবে যে কি ভুলটা করলো ও মীরাকে এখানে আসতে দিয়ে। এখন আর ভেবে কি হবে? যা ও কেড়ে নিয়েছো তা ওরি হাত ধরে প্রকৃতি মীরাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে হল ভর্তি মানুষের সামনে। ব্যাপারটা হজম করা সত্যি কষ্টের রাজিবের জন্য।

রাজিব কাজ আছে বলে চলে যায় অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই। মনে মনে ভাবে না এলেই ভালো হতো। আবার ভাবে না এলে কি ওর পরিচয় এনাউন্সমেন্ট কর বন্ধ করতে পারতো ও? ওর উচিতই হয় নি মীরাকে এখানে আনা। এদিকে ওরা বাড়ি ফিরে আসে অনুষ্ঠান শেষে। ফিরবার পথে দুজনে আলাপ হয় রাজিবের মনের বর্তমান স্থিতি নিয়ে। বাড়ি ফিরে তিনদিন পর দুপুরে বাড়িতে ভাত খায় মীরা। এ তিনদিন বাইরেই খেতে হয়েছে। আজ খালা রেঁধেছেন চিংড়ির দোপেয়াজা, কলমি শাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা, কুমড়ার বিঁচি ভর্তা, চ্যাপা শুঁটকির বাগার দেয়া ভর্তা আর বোম্বাই মরিচ দিয়ে পট শাকের ডাল, এসব খাবার পোলাও গোশতোরে বলে ঐদিকে থাকো। কোথাও গেলে নাকি ঐখানকার স্থানীয় খাবার ট্রাই করতে হয়, কিন্তু মীরা যেখানেই যাক সবার আগে খুঁজে ভাত আর ডাল। তরকারির ব্যাবস্থা না থাকলেও হবে। ও হচ্ছে ডালে ভাতে বাঙালি। একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে ও বাঙালি হোটেল খুঁজে ডাল ভাত আর করলা ভাজি দিয়ে ভাত খেয়েছে। ইন্ডিয়া গেলেও ও মুসলিম হেটেল খুঁজে সবার আগে। চাইনিজ কি সুইডিশ কোন খাবারই মুখে রুচলেও পেট ভরেনা ওর। অনলি ডাল ভাত ইজ রিয়েল। খেতে বসে সেই গপ্পই হয় মীরা আর টুম্পার।

মীরার ব্যাবসা ভালোই চলছে। তবে ঐ প্রোগ্রাম থেকে ফিরে মীরার মনে একটা ব্যাপার খচখচ করে। পরের তৈরী জিনিস বিক্রি করার চেয়ে নিজের উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করা বেশী লাভজনক। ইন্ডিয়া থেকে প্রোডাক্ট এনে বিক্রি করায় লাভের অংকটা ছোট হয়ে আসে। যার থেকে মাল গুলো কিনে তাকে একটা লাভ দিতে হয়, ওগুলো দেশে আনতে সরকারকে দিতে হয় ট্যাক্স তার উপর পরিবহন খরচ তো আছেই। তাই মীরা ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করে। যদিও হিউজ সেল হওয়ায় ওর তা পুষিয়ে যায়। সেদিক থেকে নিজে কিছু করা চ্যালেন্জিং। কিন্তু পাভেল আর টুম্পা এ বিজনেস শুরু করার কথা আগেই বলেছিলো। ওরা পরামর্শ দিয়েছিলো নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর, আগের মতো করখানা দিতে৷ কিন্তু মীরা রাজি হয় নি কারন তখন ওর কাছে ব্যাবসা শুরু করার মতো ক্যাশ ওর কাছে ছিলো না, বিশ লাখ টাকা যেটা ছিলো তা দিয়ে শুরু করলেও বিপদ ছিলো, টাকা কোথায় পেলাম তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরী হতো রাজিবের মনে। কিন্তু এখন ও চাইলেই শুরু করতে পারবে৷ বিশ লাখ টাকা যদিও ইরার বিয়েতে গাড়ি উপহার দিতে খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু ওর কাছে যা আছে তা দিয়ে ছোট পরিসরে হেসে খেলে শুরু করা যাবে।

সেটা নিয়েই আলেচনা হয় টুম্পার সাথে। টুম্পা কিছুই বলে না এবার, যেন খাবার খাওয়ায় মনযোগী সে, মীরা কি বলছে ও শুনতেই পাচ্ছে না। টুম্পার এমন অগ্রাহ্যেরও শক্ত কারণ আছে। আর সেই কারনটা হচ্ছে – ও বহু আগে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলো মীরাকে, মীরার ব্যাবসা শুরু করার পুঁজি না থাকার বাহানায় টুম্পা বুদ্ধি ও দিয়েছিলো রাজিবের কারখানায় ডাকাতি করতে৷ ব্যাবসা শুরু করার কথা মনে ধরলেও ডাকাতির ব্যাপারটা হাস্যকর লেগেছিল ওর। টুম্পার অল্প বয়স, শরীরের রক্ত গরম, সবকিছু সহজ ভাবে তাই। কিন্তু মীরা তো আর ভুল করতে পারে না, তাই প্রতিটি কদম ওকে ফেলতে হয় পরিস্থিতির যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করে। নিজে বড় হওয়াই তো একমাত্র লক্ষ্য না ওর, রাজিবকে গুড়িয়ে দেয়া, ওকে নিঃস্ব করে রাস্তায় নামানোটাও ওর লক্ষ্য। কাজ যা পারে, অভিজ্ঞতা যা হয়েছে তা দিয়ে খেয়ে পরে সুন্দর ভাবে নূহাকে নিয়ে ঠিক জীবণ পার করতে পারবে।

এদিকে প্রোগ্রামের ব্যাপারে মনে মনে রাজিব বিরক্ত। তবে আশার কথা এই যে ওদের অনলাইন সেল বেড়েছে ইদানীং। পরিচিতদের মধ্যে অনেকের খুচরা অর্ডার আসতে শুরু করে। এই ডাল সিজনেও অনলাইনের বিক্রি দিয়ে একটু যেন দাঁড় হতে পারে কারখানাটা। অনলাইন সেলে বিক্রি কম হলেও লাভ বেশী। তাই রাজিব মন্দের ভালে হিসেবে মেনে নেয় ওখানে যাওয়াটা। মনকে স্বান্তনা দেয় “যতই ওড়ো তুমি মীরা, নাটাই কিন্তু আমার হাতেই আছে, এসবের মালিক তুমি, সবাই তা জানলেও কাগজপত্র কিন্তু অন্য কথা বলবে” নিজেকে ওয়ার্ন করে মনে মনে বলে “এরপর সতর্ক থাকতে হবে, ব্যাবসার ক্রেডিট ওকে আর নিতে দেয়া যাবে না”

এদিকে ইরাবতীদের হানিমুনে পাঠিয়েছে ওর শ্বশুর। সে কাহিনি হার মানাবে থ্রিলার গল্পকে। ইরাকে ওর শ্বশুর জিজ্ঞেস করেছিলেন হানিমুনে কোথায় যেতে চায় ও। ইরা বলেছে “সবাই মিলে যেখানে গেলে ভালো হয় সেখানে” মোখলেস সাহেব হেসে বলেছিলেন- “আরে সে তো কত্ত যামু আমরা, অহন তো তোমরা যাইবা মা” ও তাঁকে বলেছে- সবাই না গেলে ও কোথাও যাবে না” ওর কথার ধরনে মনে হয় যেন কোন ছোট্ট মেয়ের আবদার তার বাবার প্রতি। হুট করে বিয়ে হওয়ায় স্বামীর সাথে তেমন শখ্যতা গড়ে উঠেনি এখনো ওর যতটা শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে হয়েছে। দেবররা শুনে হাসে, বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে বড় হওয়ায় ওরা ইরাকে সম্মান করে ওরা। মেঝো দেবর মুস্তাকীম বলে- ভাবী এটা পারিবারিক ট্যাুর কিংবা বনভোজন না, যে সবার যেতে হবে” টেবিলের সবাই হেসে দেয় ওর কথা শুনে। ইরার চোখে পানি এসে পরে সকলের এই অট্টহাসি দেখে। চোখের পানি লুকিয়ে ও অভিমানি সুরে বলে- ” সবাই না গেলে লাগবে না আমার হানিমুন ” বলেই খাবারের প্লেট হাতে ওর ঘরে চলে যায় ও।

মুরসালীন পরে বিপদে, বৌ টেবিল ভর্তি মানুষের সামনে রাগ করে চলে গেলো। এমন সময় ওর যাওয়া উচিত ঘরে বউকে স্বান্তনা দিতে কিন্তু তা ঠিক হবে কিনা তা ভেবে কিনারা করতে পারে না ও। এই মেয়ের হাবভাব কিছুই বুঝে না ও। শ্বশুর বাড়িতেও ইরা ওকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলো। ঐ বাড়িতে চলে আসার দিন রাতের খাবারের সময় চিংড়ি রান্না করেছিলো ইরার মা, না বললেও ইরা জোর করে মুরসালিনের পাতে দেয় সেটা, ওর এলার্জির সমস্যা হওয়ায় খেতে আপত্তি জানায় ও। নিজের পাত থেকে তুলে ইরাকে দেয়, রেগে ইরা বলে ” জানেন আপনি? আপনার জন্য বড় চিংড়ি আনতে মা এখানে না পাওয়ায় কারওয়ান বাজারে লোক পাঠিয়েছে? না খেলে মা কষ্ট পাবে না, বলুন?

উপায় না দেখে চিংড়ির কারিটা খায় মুরসালীন, রাতের বেলা চিংড়ি তার ম্যাজিক দেখানো শুরু করে। শরীরে জায়গায় জায়গায় ফুলে উঠে লাল হয়ে যায়। এটা দেখে ইরা ভয় পেয়ে যায়, মুরসালীন বলে- “এবার বুঝেছো চিংড়ি কেন খেতে চাই নি” এসব দেখ কেঁদে ফেলে ইরা, ভাইকে ডেকে ফার্মেসি হতে এলার্জির ঔষধ আনায়। মুরসালিন ওর ব্যাস্ততা দেখে বলে- “আরে এত হাইপ হচ্ছো কেন? ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে” ওর কান্না থামেই না, বাড়িসুদ্ধ লোক মুখটিপে হাসি শুরু করে দিয়েছে ওর এই কান্ড দেখে কি যে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার লজ্জায় ওর কান লাল হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে বিয়ে করার ঠেলা যাকে বলে। এজন্যই ও ইরাকে বিয়ে করতে চায় নি। জ্ঞান বুদ্ধি যা সব ঐ বিদ্যায়। এই যে এখন উঠে গেলো টেবিল থেকে, হিতাহিত জ্ঞান থাকলে করতো এ কাজ? এখন না পারছে থাকতে টেবিলে না যেতে পারছে ঘরে ওকে স্বান্তনা দিতে।

ইরার শ্বাশুড়ি মিসেস রেবেকা মুরসালিনকে এ যাত্রায় রক্ষা করেন, তিনি ধমক দেন ছেলেদেরকে, বলেন “ওর অজ্ঞতাটাই দেখলি তোরা, ওর সরলতাটা তোদের চোখে পরলো না? গাধা পোলাপান যত্তসব” বলে ইরার ঘরের দিকে যান।

মুরসালিন চা খেতে খেতে মুচকি হেসে ভাবে ঠিকই তো, এভাবে তো ভেবে দেখিনি। টেবিল থেকে উঠে মুরসালিনও যায়, ওর পিছু পিছু যায় বাকী সকলে। কন্যাহীন এ বাড়িতে ইরা যেন হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালা। যেখানেই যায় ও বাকী সব ওর পিঁছু পিঁছু। কাজের কাজ না পরলেও সকলের খেয়াল রাখে খুব যত্ন করে। শ্বাশুড়ির মাথায় তেল দিয়ে দেয়া, শ্বশুরের বারোমাস গরম পানি লাগে গোসলে। প্রতিদিন নিয়ম করে বালতি ভর্তি গরম পানি বাথরুমে রেখে ডাকতে যান তাকে। রাতের ঔষধ খাওয়ানো, ঘুমের জন্য বিছানা তৈরি, মশারী খাটানো এমন টুকিটাকি কাজ ও খুব যত্ন নিয়ে করে দেয় ও । যদিও এ বুদ্ধিটা ওর খালামনি শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ঐ বাড়িতে সবাইকে এমন ভাবে ভালোবাসবি, সকলের যত্ন করবি যাতে সকলে তোকে চোখে হারায়। কাজ করার লোক বেতন দিয়ে পাওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা খুব দামী জিনিস এর কেন মূল্য হয় না, তোকে তরা ভালোবেসে গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেই তার দাম দিস তুই”

সত্যি কথাগুলো খুব কাজে লেগেছে ইরার। কাজের কাজ কিছুই পারে না এক ভালোবাসা ছাড়া। কাজ শিখতে তো পুরো জীবণই পরে আছে সামনে তাই ভালোবাসাটাকেই অস্ত্র বানায় ও।

এদিকে ঘরে গিয়ে আলাপ আলোচনা করে সকলে মিলে যাওয়া ঠিক হয়। মুখেলস সাহেব ছেলেকে বলেন “ওর পাসপোর্টটা বানাইতে দিয়া দিছ, পাসপোর্ট হইয়্যা গেলে ছবাই মিল্লা কাশ্মীর ঘুরবার যামু” আপাততঃ যাওয়া ঠিক হয় বাঙালীর জাতীয় ঘুরবার জায়গা কক্সবাজারে। তবে মোখলেস চাচা একটু চালাকি করলো ইরার সাথে। যাওয়সর দিন বের হওয়ার জন্য ব্যাগপত্র সব গুছানো হয়েছে। রাতের বাস রওনা হবে সকলেই তৈরী। এমন সময় একটা নাটক ফাঁদলেন তিনি। তার বোন অসুস্থ বলে রয়ে গেলেন তারা। ইরা, মুরসালিনকে বললেন- “তোমরা যাও আমরা নাহয় কাল-পরছু আহি” কি আর করবে বেচারী ইরা, অসুস্থ বোনের খবর শুনে তার তো এমন যাওয়াটা শোভন না,এটুকু ঠিক বোঝে ও, তাই সে যাত্রায় স্বামীর সাথেই রওনা দেয় ও৷

মুখলেস সাহেব এ চালটাই চেলেছেন, ইরার কথা তিনি শুনলেন আবার শুনলেন না। ছেলে আর ছেলে বৌয়ের মধ্যে জড়তা এখনো আছে। ওদের সহজ হওয়ার একটু সুযোগ দেয়া দরকার ভেবেই এ গল্পটা ফাঁদলেন তিনি। আর ইরাকে আজ আসি কাল আসি করে ওদের যাওয়ার চতুর্থ দিন সপরিবারে হাজির হলেন ওদের হোটেলে। সকলকে একসাথে দেখে ইরার চোখে পানি চলে আসে। শ্বাশুড়ি ইরাকে জড়িয়ে ধরেন, বলে “কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে?”

সকলে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেতে হোটেলে গেলেন সকলে। নাশতা অর্ডার দিতে গেলো মুরসালিন।
খাওয়ার সময় মুখলেস সাহেব লক্ষ্য করলেন ইরা মুরসালিনকে তুমি করে বলছে। ওদের সম্পর্কের এমন উন্নতি দেখে মুচকি হেসে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিলেন তিনি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে