#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ১৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সেদিনটা তুমুল ব্যাস্ততায় কাটে মীরার। অনলাইনে পাঁচটা অর্ডার আসে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে। সামনে ইদ হওয়ায় প্রচুর মালামাল স্টক করা হচ্ছে কারখানায়। কারন যে কোন উপলক্ষ সামনে করে সব মেটেরিয়ালের দাম বেড়ে যায়। স্টাফরা তাই ব্যাস্ত সেগুলো আনলোড করায়। তখনকার সময়ে প্রোডাক্ট ডেলিভারির ব্যাপারটা এত সহজ ছিলো না। এখনকার মতো এত ডেলিভারি কোম্পানি ও ছিলো না। তাই কারখানার দুজন স্টাফকে দুপুরের পর সাইকেল দিয়ে পাঠানো হতো অর্ডার পৌঁছে দিতে। ওদের সেদিন মালপত্র আনলোডের কাজ থাকায় মীরা ওর স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পরে ডেলিভারিগুলো পৌঁছে দিতে। যাওয়রা আগে ডিরেকশন গুছিয়ে নেয় মাথায়। একে একে ডেলিভারি দেয় ওয়ারী, মতিঝিল, বেইলী রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, ধানমন্ডি এরিয়াতে। সেদিনের চতুর্থ ডেলিভারিটা ছিলো বেইলি রোডে। মেরুন রঙের একটা পার্টি গাউনের অর্ডার ছিলো সেটা।
আসপাশের লোকের থেকে জিজ্ঞেস করে বাসাটা খুঁজে বের করে মীরা। বেইলী রোড চিনলেও এ জায়গাটায় আগে আসে নি মীরা। তাই সবসময়ই ও ডেলিভারি দিতে এলে এমনি সাহায্য নেয় লোকেদের। বাড়ি নম্বর ১২৭/এ, ফ্ল্যাট নং ৩০২। ফোন করে তাকে নামতে বললে তিনি রিকুয়েষ্ট করে উপরে আসার। তার বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মীরা সবসময় বাড়ির বাইরেই ডেলিভারি দেয়। ভিতরে যায় না কখনো। বাচ্চার কথা শুনায় আর দ্বিমত না করে মীরা সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে। কলিং বেল দিয়ে অপেক্ষা করে মীরা। তিনতলায় উঠে একেবারে ঘেমে কাঁদা হয়ে যায়। ওড়না দিয়ে সে ঘাম মুছে মীরা। দ্বিতীয়বার বেল চাপে না, পাছে বাচ্চাটা উঠে পরে।
বেশ কিছু সময় পর গেইট খুলে একটা মেয়ে। গেইট খুলে সরি বলে এত সময় অপেক্ষা করানোর জন্য, আর ধন্যবাদ দেয় দ্বিতীয়বার বেল না চাপার জন্য। দ্রুত কথাটা শেষ করে মীরাকে আপাদমস্তক দেখে ভীষণ অবাক হয় সে। বলে-
: ” আরে মীরাপু যে ! ”
যদিও মীরার কিছুটা সময় লাগে তাকে চিনতে। যা মাথায় নিয়ে ঘুরছে বেচারী না চিনবারই কথা। তার উপর এত বছর পর দেখা। দুই দেখার মধ্যে সময়ের পার্থক্যের চেয়ে মেয়েটার ওজনের পার্থক্য বেশী হওয়ায় মীরার ওকে চিনতে বেশী অসুবিধা হয়। তবে যখন চিনতে পারে মীরার মাথায় আকাশ ভাঙে যেন। সংক্ষিপ্ত কুশলাদি বিনিময় করে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসতে চায় ও। কিন্তু মেয়েটি ওকে ছাড়ে না। হাত টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করে কেমন আছো আপু? উত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না মীরা।
আচমকা মীরার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে সে। মীরা যেন এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচে। ওর দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে। কারন ওর সামনের সোফায় বসে রয়েছে আবীরের ছোট বোন ফিওনা। সেই আবীর যাকে বিয়ে করে পরদিনই পালিয়ে এসেছিলো মীরা। নিরপরাধ এক ছেলের জীবণের সাদা পাতায় কালো দাগ এঁকে দিয়ে চলে এসেছিলো ও।
মীরার কেমন অস্বস্তি লাগে। কেন দেখা হলো এর সাথে। এমনিই কি কষ্ট কম ওর জীবণে। নিশ্চয়ই কথা শুনাতে ঘরে এনে বসিয়েছে ওকে ফিওনা।
ফিওনা ওকে বসিয়ে রেখে জুস আর বিস্কুট নিয়ে এলো। তারপর মীরাকে স্বাভাবিক হতে সময় দিলো কিছুটা।
বেশ কিছু সময় পিনপতন নীরবতা। তারপর ফিওনা বললো-
: ” তারপর কেমন আছো মীরাপু? ”
: ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তোমরা সবাই কেমন আছো? ”
: ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি সবাই। আমার বিয়ে হলো চার বছর। বাবুর বয়স আটমাস। আলহামদুলিল্লাহ শ্বশুর বাড়ির লোকেরা খুব ভালোবাসে আমাকে।
: “যাক ভালো হলেই ভালো, খালা-খালু? ”
: ” মা মা’রা গেলো তিনবছর হলো। বাবা প্যারালাইজ হয়ে বিছানায় তার পর থেকেই। বুঝলা খুবই হার্ড টাইম যাচ্ছে আমাদের ”
মীরার খুব ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করে আবীর কেমন আছে? কিন্তু জিজ্ঞেস করবার মুখ ওর নেই।
মীরা কি ভেবে যেন জিজ্ঞেস করলো –
: ” খালুকে দেখাশোনা করে কে?”
: ” পার্মানেন্ট বুয়া রাখা আছে, সেই দেখাশোনা করে”
তোমার খবর বলো-
: ” এই তো ভালোই আছি আলহামদুলিল্লাহ। ”
: ” বিজনেস উমেন বনে গেছো। তুমি ডেলিভারি দিতে আসবে ভাবি নি, এর আগেও ড্রেস নিয়েছি তোমার পেইজ থেকে”
: ” তুমি জানতে এটা আমার পেইজ?”
: “হুম, জানতাম তো ”
: “আচ্ছা আসি ফিওনা, কারখানায় আজ বড় শিপমেন্ট এসেছে, তা আনলোড করায় ব্যাস্ত সবাই, তাই আমি ডেলিভারি দিতে বেরিয়েছি, আরো একটা ডেলিভারি রয়েছে”
ক্ষণকাল চুপ থেকে ফিওনা বলে-
: ” তুমি চলে যাওয়া দিয়ে সেই যে দুঃসময়ের শুরু হলো এখনো তা পিছু ছাড়ে নি আমাদের। তুমি তো দিব্যি ভালো আছো সংসার, ব্যাবসা নিয়ে আমার ভাইটা এখনো বিবাগী। মেয়ে দেখতে গেলেই শুনতে হয়- “নিশ্চয়ই ছেলের কোন সমস্যা আছে, তা না হলো বৌ কেন বিয়ের পর দিনই পালায়? ”
অসহায় দৃষ্টিতে মীরা তাকায় ফিওনার দিকে। বলে-
: ” ভাইয়া বিয়ে করেন নি এখনো? ”
কিছু সময় কেমন একটা অসহায় দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে থাকে ফিওনা। সে দৃষ্টি যেন অনেক কিছু বলছে মীরাকে। কিছু সময় পর ফিওনা হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে-
: ” না, মা থাকতে বলতো আমাকে বিদায় করে বিয়ে করবে, কিন্তু মা চলে যাবার পর কেও তাকে এ কথা বলে সুবিধা করতে পারে না, কেও জোর করলে বলে-
‘বিয়ে একটা করতে হয় জীবনে, করেছিলাম, ব্যাস এসব নিয়ে আমাকে কেও যন্ত্রণা দিও না ‘
কথাটা বলে আরো কিছু সময় চুপ দুজনেই। মীরার খুব কষ্ট হয়, নিজের সিদ্ধান্তের জন্য। আবীর নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ, স্বামী হিসেবেও ভালোই হতো। ওর মনে পরে বিয়ে পড়ানোর পর দুজনকে এক রুমে রেখে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলো যখন আবীর মীরাকে বলেছিলো-
” আমি খুবই কৃতজ্ঞ খোদার প্রতি, যে তুমি আমার স্ত্রী ”
উত্তরে মীরা ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলো। অল্পভাষী আবীরের এ কথাটাকে ন্যাকামী মনে হয়েছিলো তখন। লাজুক আবীর মীরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, মনে হয়তো নববধূকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা লুকিয়ে ছিলো। কিন্তু আকদের পর দু’জন দুই বাড়ি ফিরে যায়। তাছাড়া ওদের অনুষ্ঠানের তারিখও দেয়া ছিলো। তাই আবীরও সংযত করেছিলো নিজেকে। বাইরে থেকে আবীরের ফেরার ডাক পরলে হাতে একটা বক্স দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল সে। আর বলে গিয়েছিল –
” আজ যাই আমি, খুব দ্রুত আমাদের দেখা হচ্ছে ”
ও বের হতেই বাক্সটাকে ছুড়ে ফেলে ব্যাঙ্গ করেছিলো ওর কথাগুলোকে। সত্যি ভালেবাসা চিনতে না পারাটা ভুল ছিলো। এসব ভাবতেই নিঃশব্দের এই আবরণ ভাঙে ফিওনার বাচ্চার কান্নায়। কান্নাটাকে বড় মধুর মনে হলো ওর। কারন এ কান্না ওদের অস্বস্তিকর কথার তার কেটে দিয়েছে। সুযোগ করে দিয়েছে মীরার প্রস্থানের।
বাচ্চা কোলে নিয়ে ফিওনা এসে বললো-
দেখো মেয়ের কান্ড, কতক্ষণ হলো ঘুমিয়েছে? ঘুম এত কম এর, জানো না।
মীরা বাচ্চাটালে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
: ” নাম কি ওর? ”
: ” উমাইজা”
: ” বাহ্ মিষ্টি নাম”
আদর করে বললো-
: “উমাইজা ওর বাবার মতো হয়েছে দেখতে”
: “হুম, বাবা বলতে অজ্ঞান, সারাদিন আমি রাখি, বাবা এলে আমি কে?”
: ” সব মেয়েরাই বাবাদেরকে বেশী ভালোবাসে”
কথাটা বলে অপরাধের পাল্লাটা যেন আরো বাড়ে।
কিছু অনুভূতি গলার কাছে পাক খাচ্ছে, চোখের পানি
মীরার অনুমতির অপেক্ষায় বের হাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। মনে মনে বলে- ” ভালো থাকুক সব বাবারা”
: “আচ্ছা আসি, ভালো থেকো তোমরা। আমাদের বাসায় এসো” বলে উঠে পরে মীরা।
কথাটা শুধু বলার জন্য বলা। বাসায় আসতে বললো কিন্তু কোন ঠিকানা দিলো না। ফর্মালিটি আর কি। ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বাবুর হাতে দিয়ে দ্রুত চলে আসে সেখান থেকে মীরা । ফিওনাকে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, শেষ সিঁড়ি কাছে আসার সময় বললো-
: ” দোয়া করো আমাদের জন্য ”
: ” তুমিও”
দ্রুত পায়ে চললো মীরা। মাথায় ঘুরছে কেবল ফিওনার কথা গুলো।
জীবণ…!
একটা সিদ্ধান্ত সব কেমন এলোমেলো করে দেয়।
আবীর বিবাগী, মীরা আছে অশান্তিতে, রাজিবের অধঃপতন।
ভাবনার জালে ঘিরে থেকেই অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে কারখানায় আসে মীরা। রাজিবকে সেখানে পায় না ও । এক হিসেবে ভালোই হয়েছে দেখা হয় নি। সব কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরে মীরা। ঘরদোর গুছগাছ করে রাতের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে যায় । আজ রাজিবের পছন্দের খাবার তৈরি করে ও। সরিষা ইলিশ, চিংড়ির দোপেয়াজা, লাউশাক ভাজি, আর ভুনা ডাল। সব তৈরি হলে টেবিলে বসে অপেক্ষা করে রাজিবের। ওর হাতে বই-
” নিঃসঙ্গতার একশো বছর ” গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা অমর সৃষ্টি এ উপন্যাস। একটা উক্তি রয়েছে উপন্যাসটিতে ” দুজনের মধ্যে যার ভালোবাসা কম সে-ই সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে ”
বেশ রাতে বাড়ি ফিরে রাজিব। মনকে শান্ত রাখতে বইয়ে ডুব দেয়া মীরার সময়ের খেয়াল নেই। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে গেইট খুলতেই ভিতর থেকে গেইট খুলে দেয় মীরা। রাজিব ভরকে যায় মীরাকে দেখে। বলে-
: ” ঘুমাও নি তুমি?”
: ” না ”
কোন কথা না বলে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয় রাজিব। এ ফাঁকে রান্নাঘরে যায় মীরা। খাবার গরম করতে গিয়ে ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই মীরার খেয়াল হয় দেড়টা বাজে।
ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খেতে আসে রাজিব। মীরা ওকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের জন্য ও খাবার নেয় প্লেটে। রাজিব মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” এখনো না খেয়ে জেগে আছো কেন? ”
কোন উত্তর দেয় না ও, না শোনার ভান করে ।
সুন্দর করে খাবার খাওয়ায় মীরা রাজিবকে। রাজিব মনে মনে ভীত গত রাতের ঘটনায়। এজন্যই এত রাত করে বাড়ি ফেরা। ভেবেছিলো মীরা ঘুমিয়ে থাকবে। কিন্তু মীরার এই স্বাভাবিকতা রাজিবকে কনফিউজড করে। মীরাকে কি তাহলে কিছু বলে নি টুম্পা? মীরার দিকে তাকিয়ে মীরার মন পড়ার চেষ্টা করে রাজিব। কিন্তু ইন্দ্রজালে ঢেকে রাখা মীরাকে পড়বার ক্ষমতা হারিয়েছে রাজিব বহু আগেই।।আজকাল তাই আর বৃথা চেষ্টা করে না সময় নষ্টের কথা ভেবে । স্বাভাবিক ভাবে খাবার খেয়ে রুমে ঢুকে রাজিব। মীরা বাসনপত্র গুছিয়ে ঘরে এসে দেখে রাজিব মশারী টানিয়ে মাত্র শুয়ে পরেছে। বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মীরা রাজিবকে বলে-
: ” বের হও তো, কথা আছে তোমার সাথে।”
রাজিবের হার্টবিট থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো এ কথা শুনে। চোখেমুখে স্বাভাবিকতা টেনে রাজিব বলে-
: ” লাইট অফ করে বিছানায় এসে বলো”
: ” না, ড্রাইংরুমে এসো ”
বলে ড্রইংরুমে চলে যায় মীরা। অগত্যা রাজিব মশারীর ভিতর থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে যায়। গিয়ে দেখে মীরা বসে আছে। রাজিব ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি ব্যাপার? ”
: “ব্যাপার কি তা তো আমার চেয়ে ভালো তোমার জানার কথা, তুমিই বলো কি ব্যাপার? ”
: ” মানে?”
: ” গতরাতে তুমি টুম্পার ঘরে কেন গিয়েছিলে? ”
: ” টুম্পার ঘরে? ”
: ” এখন আবার বলো না কোন টুম্পা? ”
: “মানে?”
: ” মানে বুঝতে পারছো না তুমি?
টুম্পা…! টুম্পা…!”
: ” আরে ওকে কেন ডাকছো?”
: ” তুমি বুঝতে পারছো না তো, তোমাকে বোঝাতে ওকে ডাকছি, এদিকে আয় তো টুম্পা…
রাজিব বুঝে গেছে ওর জারিজুরি শেষ”
একটু পর টুম্পা এসে ওদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরা টুম্পাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হয়েছিল গতরাতে বল”
রাজিব রেগে টুম্পাকে বলে –
: “তুমি যাও এখান থেকে। অভদ্র মেয়ে কোথাকার”
: ” অভদ্র কি ও না তুমি? রাতের বেলা একটা মেয়ের ঘরে ঢুকে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়াটা কি ভদ্রতা?”
: “আমি কথা বলছি তোমার সাথে আগে ওকে যেতে বলো”
: ” না, ও এখানেই থাকবে?”
দুজনের কথা কাটাকাটি শুনে টুম্পা চলে যায় সেখান থেকে। রাজিব ও চলে যাবার সাথে সাথেই মীরার কাছে এসে হাত চেপে ধরে বলে-
: ” আমার ভুল হয়ে গেছে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ভুল করে ফেলেছি আমি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও”
: ” ছিঃ রাজিব তোমার এত অধঃপতন হয়েছে। দাওয়াতের ঐ মহিলা আমার মায়ের বয়সী, টুম্পা কি দেখতে আমার চেয়ে বেশী সুন্দর? আমি সব ছেড়ে তোমার ভালোবাসার জন্য তোমার কাছে চলে এসেছি, আর তুমি?
রাজিবের কাধে ঝাঁকুনি দিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –
” কেন করলে তুমি এমন? ”
রাজিব দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে রাখে।
মীরা কান্না করতে থাকে। আজ সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে বড় ঘৃণা হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছিল ছাঁদ থেকে লা’ফ দিয়ে জীবণ যন্ত্রণা শেষ করে দেয়।
মীরার পায়ের কাছে বসে ক্ষমা করে দিতে বলে। আমি কেন ক্ষমা করবো, ক্ষমা করবে টুম্পা। রাজিব মীরাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
মীরা কোন কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে জীবণের হিসেব নিয়ে। বাবা, মা, আবীর, একটা ভুল, আর রাজিব এ শব্দ গুলো মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় দপদপ করছে ওর। শরীর জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি, তবুও ঐ শব্দ গুলো ঘুমাতে দিচ্ছে না ওকে। অসহ্য এ যন্ত্রণা সে রাতে জাগিয়ে রেখেছিলো মীরাকে।
মীরা পরদিন টুম্পার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলো ওর স্বামীর হয়ে। হাত ধরে অনুরোধ করেছিলো যাতে এ ব্যাপারটা কোনদিনও পিয়াসাকে না জানায় ও। টুম্পা ও কথা দিয়েছে এ কথা কাওকে কোনদিন বলবে না ও। মীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো টুম্পা ওকে ভুল না বুঝায়।
এ ঘটনার পর ছয়মাস দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো না। কথাবার্তা হতো টুকটাক। এ ব্যাপারটার পর মীরা অনেক চিন্তা ভাবনা করেও টুম্পাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নি। কারন টুম্পা ভালো তাই ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে মীরাকে খুলে বলেছে সব, অন্য কেও যে বলবে তার গ্যারান্টি কি?
তাছাড়া টুম্পা মীরার দুনিয়ায় অবিচ্ছেদ্য একজন হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনহীন এই দূর্গম পৃথিবীতে টুম্পাই একমাত্র সহায় ওর।
সময়ের আবর্তনে রাজিবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে, বিছানা ভাগ করেছে দুজনে ঠিকই কিন্তু ঐ ঘটনার পর সম্পর্কের কোথায় যেন একটা তার ছিড়ে গেছে। তা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত মীরা। আর রাজিবের কোন দায় নেই যেন ছেড়া তার জুড়তে….
চলবে…
#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ২০ ( সদ্য রান্নাকৃত ধোঁয়া উঠা নতুন পর্ব 😅)
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
মীরার ডেলিভারির ডেট এগিয়ে এসেছে। এবারকার চেক-আপের সময় আরেক দফা আলট্রাসাউন্ড করে সম্ভাব্য ডেট দিয়েছে ডাক্তার, এর আগে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে চলে আসবে আর না হলে সেই ডেইট অনুযায়ী আসবে হসপিটালে এডমিট হতে। আর হ্যা ডাক্তার এও বলেছেন- মীরা রাজিব দম্পতির ঘর আলো করে রাজকন্যা আসছে।
খবরটা শুনে খুবই খুশি মীরা, খুশি রাজিবও। তাদের অসম্পূর্ণ জীবণকে কোন একজনের আগমনে পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এই খুশি ভাগ করে নেবার মতো সেই টুম্পাকেই পেলো। টুম্পা বললো-
: ” মন থেকে মেয়ে চেয়েছিলেন, আল্লাহ আপনার বাসনা পূর্ণ করেছেন”
: ” ও আমাদের জন্য পয়মন্ত বুঝলি। ওর উছিলায় আল্লাহ আমাদের সব ঠিক করে দিক।”
: “আমীন ”
: ” আমীন”
দিন চলছে তার নিজস্ব গতিতে,একই সাথে জীবণ নদীও। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ছোট্ট এই পরিবারের মানুষের জীবণে। মসলা কষানোর গন্ধ সহ্য হয় না মীরার, ভাত রান্নার ঘ্রাণেও বমি হয়। প্রেগন্যান্সির শুরুতে নাকি সবার এমন হয় কিন্তু ওর বেলায় হলো উল্টো। শেষের দিকে এসে এমন অবস্থাটা ওর জন্য ভারী হয়ে গেছে। রাজিব রান্নাঘরে তাই থাই গ্লাস লাগিয়ে দিয়েছে। রান্নার সময় নতুন রান্নার খালা মাজেদা দরজা আটকে নেয়। মসলা কষানোর পরিবর্তে মেখে তরকারি রান্না হয়, প্রথম যখন রান্নার কাজে যোগ দিলেন তিনি মীরা তাকে দেখে বলেছিলো –
: “পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে খালা। মাছ, মাংস ভালো করে ধুয়ে নিবেন, আর নাগা দিতে পারবেন না, দেখছেনই তো আমার অবস্থা।
উত্তরে তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেছেন-
: “খালা আমারে কাম শিখাবেন না, আমি উচ্চ বংশের মাইয়্যা । নিজের পছন্দে জামাই হারামজাদারে বিয়া কইরা আজ আমি মাইনষের বাড়িত কামে ভর্তি হইছি”
ভর্তি হওয়ার কথা শুনে হেসে দেয় টুম্পা। রেগে গিয়ে বলেন আফা আপনি হাসলেন ক্যান? মীরা টুম্পাকে ধমক দিয়ে ভিতরে চলে যেতে বলে। আর মাজেদা খালাকে বলে-
: ” কবে থেকে কাজে আসবেন? ”
: ” আপনে কইলে এহন থেইক্যাই, তয় খালা আমার একটা কথা”
: ” কি কথা?”
: ” একমাসের বেতন এডবান্স লাগবো ”
: ” এটা কি শর্ত নাকি প্রয়োজন? তাছাড়া আপনাকে কাজে রাখবো কি না….”
কথাটা শেষ করতে দেয় না মাজেদা খালা, মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে আজকের রান্না খাইয়্যা পছন্দ হইলেই ট্যাকাডা দিয়েন। ট্যাকাডা আমার বড় দরকার।
: ” আজ তো বাজার নেই বাসায়”
: ” সমস্যা নাই, যা আছে তাই রানমু”
বাসায় শাক সবজি দিয়ে ভর্তি ছিলো ফ্রিজ। মাছ মাংস সব শেষ আছে কেবল একটা কাতল মাছের মাথা। মীরা সবকিছু বের করে তার সমনে দিতেই পান খেয়ে কালো করে ফেলা দাঁত বের করে তিনি বলেন –
: “নাই মানে এগুলান দিয়া আমি দশ পদ রানতে পারমু। আপনে কয় পদ খাইবেন কন”
: ” এত পদ কে খাবে, আমরা মানুষ মোটে তিনজন, আপনাকে নিয়ে চারজন, চারজনের খেতে যতটুকু লাগে ততটুকু রাঁধেন”
তাকে মসলা পাতি সব দেখিয়ে দিয়ে মিরা বসেছে ল্যাপটপ নিয়ে। নতুন জামার ডিজাইন করছে ও। কাজ করলে সময়-জ্ঞান থাকে না ওর। তবুও একবার উঁকি দিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। গিয়ে দেখে রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত তিনি। সব কিছু পরিপাটি করে কেটে বেছে আলাদা আলদা পাত্রে রেখে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ছবি তোলার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন। আর নিচে বসে ইয়া সাইজের মাথা কাটছেন তিনি। তার মাছের মাথা কাটা দেখে হতবাক মীরা। এতবড় মাথা মীরা জীবণেও কাটে না। সিদ্ধ করে রান্না করে নয় তো কাজের আপা রেবেকাকে দিয়ে দেয়। বড় মাছের মাথা সাধারণত রাজিব বাজার থেকেই কেটে আনে। পাঁচ কেজি ওজনের এই মাছটা টুম্পার ভাই গত সপ্তাহে গ্রাম থেকে এনেছিলো। মাছটা টুম্পা কাটতে পারলেও মাথাটা কাটতে পারে নি। তাই এটা এভাবেই পরে ছিলো। ভেবেছিলো রেবেকাকে দিয়ে দিবে। কিন্তু তিনি অনায়াসে মাথাটা কেটে ফেললেন।
মীরা ঘরে ফিরে এসে আবারও কাজে ব্যাস্ত হয়ে যায়। একটু পর মাজেদা খালা ওর ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে-
: ” আফা মুগের ডাল আছে”
ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে মীরা বললো-
: “নিচের কাবার্ডের বামে দিকে বড় হরলিকসের বয়ামে আছে”
একটু পর আবার দেখতে গেলো কি করছেন মাজেদা খালা। গিয়ে দেখেন হাত দিয়ে ধনেপাতা ছিড়ে তরকারিতে দিচ্ছে। এটা দেখে মীরা বললো-
: ” ঐ যে খালা চপিং বোর্ড আর চাকু আছে ঝুলানো, ঐটা দিয়ে কাটেন”
: ” খালা হাত দিয়া ছিড়া দিলে ঘ্রাণ কইব বেশী”
মীরা মনে মনে ভাবে একটু আগে বললো আপা, এখন আবার খালা, এর মাথায় সমস্যা আছে কি। ভাবতে ভাবতে গোসলে গেলো ও।
গোসল সেরে এসে দেখে টেবিলে ধোঁয়া উঠ গরম ভাত, কাতল মাছের মুড়িঘণ্ট, একটা বাটিতে মিষ্টি কুমড়া, পটল, সিম, মূলা, বেগুন, লাউ শাক দিয়ে নিরামিষ টাইপ তরকারি, আলু টমেটো দিয়েও কাতল মাছের মাথা রেঁধেছে। শশা, টমেটোর সালাদ, কাগজি লেবু। দেখে মীরার ক্ষুধা যেন বেড়ে গেলো। টুম্পা আর মাজেদা খালাকে ডাকলো টেবিলে। টুম্পা টেবিলে বসলেও মাজেদা খালা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো, বললো-
: ” আইজ আমার পরীক্ষা, পাশ না ফেল সে খবর না হুইন্যা খাওয়া নামবো না গলা দিয়া”
মীরা তাকে বসাতে ব্যার্থ হয়ে শুরু করলো খাওয়া। প্রথমে নিলো নিরামিষ মতো তরকারিটা। পাতে নিতেই দেখে মাছের মাথা টুকরো করে দেয়া। খেতে খেতে বলে-
: ” আমি তো ভেবেছিলাম এটা নিরামিষ”
: ” না, না এটারে আমাগো গায়ে ছ্যাচড়া কয়”
: ” একটা মাথা দিয়ে কয় পদ রেঁধেছেন? ”
: ” কইলাম না এত বড় মাথা দিয়ে কম কইরা হইলেও দশ পদ রানতে পারতাম, আপনে চাইরজনের কথা কইলেন তাই….”
অনেকদিন পর পেট ভরে ভাত খেয়েছিলো সেদিন মীরা।
মাজেদা খালার হাতের রান্না এত চমৎকার যে যাই রাঁধে তাই অমৃতসম মনে হয় খেতে। বাজার কি আছে তা নিয়ে ভাবনা নেই। যেদিন মাছ-মাংস না থাকে সেদিন খাওয়াটা আরো যুত হয়। শাক,ভর্তা, ভাজি।
প্রেগ্ন্যাসির এই সময়টাতে আগের মতো এত দৌড় ঝাঁপ শরীরে কুলোয় না। মীরার শরীরে নতুন করে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডায়েবিটিস ধরা পরেছে, সাথে থাইরয়েডের কিছু সমস্যার ও উদ্ভব হয়েছে। ওজন বেড়ে ৬৩ থেকে দাঁড়িয়েছে ৮৯ তে । যদিও নিয়ম করে কারখানায় যায় ও। তবে খুব কষ্ট হয় খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠতে। মাঝপথে কয়েকবার জিরিয়ে নিতে হয়। আগে দিনের মধ্যে কতবার যে সিঁড়ি বইতো মীরা তার কোন ইয়াত্তা নেই। কিন্তু এখন একবার উঠনামা করতেই জান যায় যায় অবস্থা। রাজিব যদিও নিষেধ করে ওকে আসতে। কিন্তু মীরা শোনে না।
হসপিটালে যাবার জন্য সবকিছু গোছগাছ করছে মীরা আর টুম্পা। কিছু কেনাকাটা ও বাকী রয়েছে। টুম্পা তার লিস্ট করে রেখেছে বলেছে ভার্সিটিতে যাবার সময় নিউমার্কেট থেকে কিনে আনবে।
কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে হসপিটালে থাকবে কে? যদিও টুম্পা পাশে আছে সব সময় কিন্তু টুম্পা নিজেই তো বাচ্চা মেয়ে। মাজেদা খালা বলেছেন চিন্তা করবেন না আফা, আমি থাকবো আপনার সাথে। তার ভরসায় কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে মীরা। আসলে বিপদের এ সময়টা কোনমতে কেটে যাক তাই মনে মনে প্রার্থনা করে ও।
এই টোটাল প্রেগ্নেন্সির জার্নিটাই মীরার জন্য ভীষণ চ্যালেন্জিং। কারন রাজিবের সব কিছুতে এমন গা ছাড়া ভাব, দায়িত্ব জ্ঞানহীণতা, ওর বহুমুখীতা, সম্পর্কটাকে কেমন ভঙ্গুর করে দিয়েছে। সবাই বলে একটা বাচ্চা হলে এমন বাউণ্ডুলে ছেলেরা সন্তানের দিকে চেয়ে বদলে যায়, ঘরমুখো হয়।
এই যে এমন বেখেয়ালি, দায়িত্ব জ্ঞানহীন রাজিবের বাচ্চার মা হওয়া, এটা ওদের ভাঙাচোরা সম্পর্ক মেরামতের একটা চিকিৎসা ও বটে। অনেক ভেবে চিন্তে মীরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সাথে নিয়েছে আরো কঠিন এক সিদ্ধান্ত।
এ সিদ্ধান্তটা নিয়েছে এক্কেবারে সন্তর্পণে। ও ব্যাতিত কেও জানে না এই সিদ্ধান্তের কথা, আর তা হলো- “এটাই রাজিবের শেষ সুযোগ। এর পরও যদি রাজিব না শুধরায় তবে মীরা ত্যাগ করবে রাজিবকে৷ জীবনে ভুল করে সেই ভুলকে ভুল জেনেও বয়ে যাবার মতো ভুলটাকে আর দীর্ঘায়ীত করবে না মীরা। আট বছর অনেক সময়।
কিন্তু মীরার সব হিসাব কিতাব উল্টে দেয় ওর অসুস্থতা আর দীর্ঘ সময় ব্যাবসা থেকে দূরে থাকা। প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় ডায়েবিটিস হাওয়ায় সিজারিয়ান অপারেশন বেশ কিছু জটিলতার ভিতর দিয়ে শেষ হয়। সিজারের ঘা শুকাতে আরেক বিপত্তি। ঘা তো শুকায়ই নি উল্টো দুই দু’বার ইনফেকশন হয়। দ্বিতীয় বার এমন অবস্থা হলো যে সেলাই কেটে পরিষ্কার করে আবার সেলাই করাতে হলো। এ ব্যপারটা আরেকবার সিজার হওয়া চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। ড্রেসিং করার সময় যে কি কষ্ট! যারা এ যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছে একমাত্র তারাই বুঝবে। সবকিছু মিলিয়ে মীরা একেবারে ঘরবন্দী। নিজের জীবণই বাঁচে না, আবার ব্যবসা।
এদিকে রাজিবের আবির্ভাব হয়েছিল মীরার আদর্শ স্বামী রূপে। মীরার যত্ন, মেয়ের যত্ন, রাত জেগে মেয়েকে দুধ খাওয়ানো, ডায়াপার বদলানো এসব নিজ দায়িত্বে করতো ও, আবার দিনে কারখানায় সময় মতো চলে যেতো। পুরো সময় দিতো কারখানায় । মীরা রাজিবের এমন পরিবর্তনে গোপনে আপ্লূত হয়। কৃতজ্ঞতা জানায় খোদার প্রতি। সদ্যজাত নূহার নরম, তুলতুলে আঙুল স্পর্শ করে মনে মনে ভাবে দিন ঘুরলো আমার।
উল্টো দিকে রাজিব যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। মীরার এ অসুস্থতাকে পুঁজি করে ব্যাবসার একছত্র আধিপত্যে অধিষ্ঠিত হয় রাজিব। ইদের ছুটির পর কাজে যোগ দেয়া পুরাতন সকলকে ছাঁটাই করে সে। মীরা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে রাজিব বলে- ” বুঝলা মীরা, স্টাফ বেশী পুরাতন হলে তাদের শিকড় গজিয়ে যায়। তাই তাদের বাদ দিলাম। তাছাড়া আগের চেয়ে কম বেতনে নতুন কর্মচারীদেরকে পাওয়া গেছে। ইদানীং বেতন বাড়ানো নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল”
ব্যাবসা মীরার চেয়ে কোন অংশে কম বোঝে না রাজিব,তা জানে মীরা। তবে এতদিন মীরার অধিপত্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলো সে। বাইরের টুকটাক কাজ তখন করতো। মীরা রাজিবের কাজের প্রতি এমন সিরিয়াসনেস দেখে খুশি হয় ভীষণ। ও এসব টাকা পয়সা, ব্যাবসায়ীক আধিপত্য কিছুই চায় না। ও চায় যত্নবান, দয়িত্বশীল, একজন স্বামী। যে সব সময় ওকে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখুক। যাতে ওদের সম্পর্কের বিষয়ে সবার করা ভবিষ্যৎ বানী যে ভুল তা প্রমাণ করতে পারে। আর কিচ্ছু চায় না ও।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয় মীরা। সুস্থ হয় ওদের জরাজীর্ণ সম্পর্ক। যদিও রাজিবের মনের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কি ছিলো তা অজানাই রয়েছে মীরার কাছে। দিন মাস বছর চলছে, ছোট্ট মেয়ে নূহা এখন হাঁটতে শিখেছে। মীরা এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ওর দিন কাটে মেয়ের জন্য নতুন রেসেপির এক্সপেরিমেন্ট করে। একা হাতে বাচ্চা পালা সোজা কথা? তারপর ও নতুন নতুন ডিজাইন গুলো কাস্টমাইজড করার ব্যাপারগুলো এখনো চেক করে মীরা। ইন্টারনেটের সুবাদে ওয়ার্ক ফ্রম হোম যে ব্যাপারটা কোভিড থেকে প্রচলিত, তার বহু আগেই এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নতুন ড্রেস গুলোর ডিজাইন এডিট এবং ফাইনাল করতো ও। মেয়ের ছয় মাস হওয়ার পর ও অফিসে গিয়ে কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রাজিব অনেক যত্ন করে নিষেধ করেছে, হাতে হাত রেখে বলেছে – “অনেক তো করলে, ঋণের বোঝা এমনিতেই অনেক বাড়িয়ে ফেলেছো তুমি। এবার আমাকে কিছু করতে দাও, একটু রেস্ট নাও”
খুশীতে কেঁদে দিয়েছিল ও, রাজিবকে জড়িয়ে ধরে।
মীরা এখন ভীষণ সুখী। যত কাজই থাকুক রাজিবের সময় মতো বাসায় খেতে আসতেই হতো ওকে। রাজিব প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে মধুর এ যন্ত্রণাটাকে সাদরে মেনে নেয়। যত কাজই থাকুক ফ্যামেলী লাইমটা ও খুব ভালো করে মেন্টেইন করতো। যতো রাত-ই হোক বাড়ি ফিরতে, মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতো, এটুকু মেয়েও বাপ বলতে অজ্ঞান। সন্ধ্যা হলেই মটকা মেরে ঘুমিয়ে থাকে। বাপ যেই ঢুকে ঘরে ওমনিই তিনি সজাগ হয়ে ঝাপিয়ে পরে বাবার কোলে। এটাকেই হয়তো বলে রক্তের টান। ইদানীং এ জিনিসটা খেয়াল করে মীরা, ছোট্ট মেয়ের এমন টান দেখে বাবাকে ভীষণ মিস করে। ওর বাবার বেলাও কি এমনটাই হতো। ছোট্ট মীরা এমনি করেই কি ঝাঁপিয়ে পরতো ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত বাবার কোলে?
আর বাবা…..
ওর বাবা ওর জীবণের শ্রেষ্ঠ পুরুষ৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে-
” কেমন আছো তুমি বাবা ?”
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
গ্রাম থেকে মেহমান এসেছে মীরাদের বাড়ি। ভদ্রলোক মীরার বড় মামা শ্বশুর। এর আগেও দুই বার এসেছিলেন তিনি। দুইবারই ছেলেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। সেই ছেলে নাকি গতমাসে দেশে ফিরেছে তার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন এবার, অথচ গত মাসে যে সে ছেলেকে নিতে এসেছে এসবের কিছুই জানে না ওরা। ব্যাপারটা নিয়ে মীরা কিছুটা বিরক্ত। কারণ এ বাড়িটা রাজিবদের গ্রামের সকল আত্নীয়ের স্টপিজ। আত্নীয় স্বজন আল্লাহর রহমত তা জানে মীরা কিন্তু এদের কথাবার্তা কেমন জানি। একবার এক খালা শ্বাশুড়ি এলেন, তিনি রাজিবের মায়ের ফুফাতো বোনে। সেবার এসে একটানা আঠারো দিন ছিলেন। আদরযত্নে কোন ত্রুটি করে নি মীরা। একদিন বিকেলে তিনি মীরাকে তেল দিয়ে দিতে বললে মীরা তাকে সুন্দর করে তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেন। চিরুনীর চুল পরিস্কার করতে করতে ভদ্র মহিলা ওকে প্রশ্ন করেন –
: ” আগের জামাই তোরে ছাইড়া দিছিল ক্যান মা? ”
মীরার কান দিয়ে ধোঁয়া উঠা অবস্থা, ওর মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে যেন। কোন কথা না বলে মীরা চলে গিয়েছিলো সেখান থেকে। রাতে রাজিব বাসায় এলে মীরা রাজিবকে কথাটা বললে রাজিব বলে-
: ” এ কথা উনি পেলো কই? ”
: ” এটাতো তোমার জানার কথা ”
: ” দাঁড়াও এক্ষুনি জিজ্ঞেস করছি”
: ” না, না এখন জিজ্ঞেস করতে হবে না, বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করবে ”
সেই যাত্রায় এ কথার উৎস্য জানা না গেলেও অনেক পরে জেনেছে এ কথাগুলো গ্রাম অব্দি পৌঁছে দিয়েছেন রাজিবের সৎ মা।
ভদ্রলোক এসেই রাজিবকে বলেছিলো আসার কারন। রাজিব তা জানিয়েছিলো মীরাকে। মীরা তাই অফিসিয়ালি দাওয়াতের অপেক্ষায় আছে। পরদিন বিকালে চা নাশতা দিয়ে মীরা ফাহিমা খালাকে বললো পোলাও গোশত রান্না করতে৷ রাতের লঞ্চে তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। ভদ্রলোক মীরাকে ডেকে পাঠালেন। কিছু না জানার ভঙ্গিতে বসলেন তার সামনে। ভদ্রলোক গলা পরিস্কার করে বললেন-
: ” বৌ, গত মাহে আসাদ দ্যাশে ফিরছে, তিন মাহের ছুটিতে আইছে দ্যাশে ”
মজা করার ভঙ্গিতে মীরা বললো-
: ” ও আচ্ছা, এমনি তো হয়। এখান থেকে বিদেশে যায় সবাই, আর ফিরার সময় যখন লাগেজ ভরে নিয়ে আসে সোজা ঢাকা টু বরিশাল চলে যায়, এখানে আসলে যদি ভাবী কিছু রেখে দিই ”
: ” না, মা এবার সত্যি তাড়া আছিলো। পাত্রী দেখে রেখেছি মোরা বিয়ে আগামী হপ্তায়। তোমাগো দাওয়াত করতে আইছি। তোমরা কিন্তু দুইদিন আগেই চইল্যা যাবে”
: ” দেখি মামা, গ্রামের বিয়ে তো, এতদূরের পথ, চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ ”
এ কথাটা রাজিব শিখিয়ে দিয়েছে মীরাকে। রাজিবের এ মামাকে খুব বেশি পছন্দ না। ভদ্রলোকের সম্পদ, টাকাপয়সার কোন অভাব নেই। গ্রামে যথেষ্ট নামডাক রয়েছে তার। বিশাল চালের মিল রয়েছে, কয়েকশো লোক কাজ করে সেখানে। এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভদ্রলোক রাজিবের মায়ের সম্পাত্তি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয় নি। যতটুকু ও দিয়েছিলো তাও হাতছাড়া হয়ে যায়।
রাজিবের বাবার একবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তখন ওর মা কোন উপায় না পেয়ে ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলো সাহায্যের জন্য। ভাই তাকে নিজে সাহায্য করতে না পারলেও অন্য ভাবে সাহায্য করেছিলেন সেবার। একদিনের মধ্যে তার ভাগের জমিটা ন্যায্য দামে নগদ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এজন্য রাজিবের মায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ ছিলো না। ভাগ্যিস ভাই ছিলো, তা না হলে কি হতো এ অসময়ে। ফিরবার সময় ভাই প্রতিবারের চেয়ে বেচী করে চাল, ডাল, সরিষার তেল, সব তুলে দিয়েছিলেন লঞ্চে। বিদায় বোলায় যে পানি এসেছিলো রাজিবের মায়ের চোখে তা কেবল ভাইয়ের থেকে বিদায়ের শোকেই না তাতে অসীম কৃতজ্ঞতা ও মিশে ছিলো। বাড়ি ফিরবার সেই পুরো পথটাতে রাজিবের মা ওকে শুধু বলেছিলো দূর্দিনে মামার এমন ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর কথা। এবং এও বলেছিলো- ” সবসময় এ কথাটা মনে রাখিস্” রাজিব সত্যি মনে রেখেছে সে কথা।
ওর বিয়ের আগে বড় মামার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলো ওরা বরিশাল। একাই গিয়েছিলো রাজিব, বাবার শরীর ভালো না থাকায় ওকেই পাঠিয়েছিলো তারা। অনেক বছর পর এলো এখানটায়, সেই যে মাকে রেখে গিয়েছিলো। আর আসা হয় নি। এ কারনে পথঘাট চিনতে কেমন অসুবিধা হয় ওর। কিন্তু একটু এগুতেই পুকুর পাড়ের নারকেল ঝাড়, আর তার পাশেই খোলা জমি দেখে দাঁড়িয়ে পরে ও। একটা পূর্ণ ছবির খন্ড খন্ড চিত্র মিলিয়ে নিচ্ছে মস্তিষ্ক। মানসপটে পুরো ছবিটা তৈরী হলো যখন, ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
যেন অনেক বছর পর মা’কে দেখলো। সেখানটায় দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো ও। জংলা মতো জায়গাটা একেবারে সমান হয়ে গেছে। সময়ের আবর্তে ভালোবেসে মাটি আর উঁচু কবরটা নিজেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে সমান হয়ে গিয়েছে। কবরের কোন চিহ্ন নেই এখানে। ছোট ছোট পশুদের অভয়ারণ্য হয়েছে এখন জায়গাটা। একটা বিড়াল কি যেন খুঁজছে। থুম মেরে দাঁড়িয়ে পরে রাজিব।
কালের অনেক কিছু ঝাপসা মনে পরে রাজিবের।
রাজিবের মা মা’রা গিয়েছিল হার্ট অ্যাটাক করে। তখনকার সময় এ জিনিস কি অনেকে তা বোঝেও না। হসপিটালে না পৌঁছাতেই দমটা বেবীর মধ্যেই বেড়িয়েই গেলো। কত বয়স ওর তখন দশ কি এগারো। বন্ধুদের সাথে নাক্কিমুট খেলছিলো ও। মা মা’রা গেছে কোন হেলদোল নেই। যেন এমন ঘটনা সূর্য উঠা আর ডোবার মতো প্রাত্যহিক ব্যাপার।
পড়শীরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলো-
: ” মা’টারে শেষ বারের মতো দেখে আয় বাবা”
কেও মারা গেলে যে কাঁদতে হয় তা ও জানতো না ও।
বোনের মৃ”ত্যু’র খবর পেয়ে চার ভাই দৌড়ে এলো ঢাকায়। যদিও তারা পৌছাল পরদিন বিকেলে। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বড় মামা ঘোষণা করলো- “মোগো বইনেরে মোরা বাড়িত ক’ব’র দিমু”
রাজিবের বাবা ছিলো ছাপোষা মানুষ। তাদের কথার বিপরীতে যে কিছু বলবে তার সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনটাই ছিলো না। কারন স্ত্রীকে যে দাফন করবে তার টাকাটাও ছিলো না তার কাছে। সেদিক বিবেচনায় চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।
আধঘন্টার মধ্যে কফিন, বরফ, চা-পাতা দিয়ে তারা তাদের একমাত্র বোনকে লঞ্চে করে নিয়ে গেলো বরিশাল।
দীর্ঘ পথের যাত্রা আর তাদের অপেক্ষায় দেরির জন্য অর্ধগলিত হওয়া লা’শ’টা বহন করতে চাইলোনা কোন লঞ্চই। উপায় না পেয়ে পুরো লঞ্চ ভাড়া করে ঢাকা থেকে বরিশাল নেয়া হলো রাজিবের মায়ের লা’শটাকে। মধ্যে খানে লা”শ”টাকে রেখে চারদিকে ঘিরে রয়েছে পরিচিত জনেরা। যেন মহোৎসবে কোন মেয়ে যাচ্ছে তার বাবার বাড়ি নাইওরে।
ভাইয়ের শোকে গাছের পাতা পর্যন্ত ঝড়ে পরে। চার ভাইয়ের একমাত্র বোন যে ছিলেন তিনি। সেই সব দিনের কথা আর এই কবরের বর্তমান হাল যেন মিলে নি। এত আদরে যাকে এতদূর বয়ে নিয়ে আসা তার আজ এমন বেহাল অবস্থা। তবে কবেরের এই বেহাল দশা বড় মামাকে অপছন্দ করার কারন না, সে গল্প ভিন্ন।
সেবার বিয়ে খেয়ে কিছুদিন ছিলো ও বরিশাল। ঘুরে ফিরে দেখবে বলে। সমবয়সী মামাতো ভাইদের সাথে ঘুরলো এদিক সেদিক। একদিন বিকেলে চোখ পরে বাড়ির ঠিক অপরদিকে বিশাল এক স্কুল হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে রাজিব স্কুলের নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করে। তখন বড় মামার সবচেয়ে ছোট যে ছেলে সে বলে-
: ” মোর আব্বায় এ জমি স্কুল তৈয়ারের লেইগ্যা দান করছে”
কথাটা জেনে গর্বে বুকটা ভরে উঠে রাজিবের। মা ঠিকই বলেছিলো। তার বড় ভাই মানুষ না ফেরেশতা। সত্যি! এখনকার দিনে ঐ জমির বাজার মূল্য কল্পনাতীত। এতগুলো জমি স্কুল তৈরির জন্য দান করা চারটে খানি কথা!
রাজিবের ফিরবার দিন নতুন বৌ নাইওরে এসেছিলো, রাজিব তাদের থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখে নতুন বউ তার ননদ-দেবরদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত। রাজিব স্মিত হেসে বলেছিলো-
: ” যাই বু, ঢাকায় গেলে জামাই নিয়া ঘুরে আইসো আমাগো বাড়িত্তে”
হাস্যজ্জল মুখে রাজিবের বু বলেছিলো-
: “মোর শ্বশুর বাড়ি বেড়াবি না ভাই, বোনডারে কই বিয়া দিলি দেখতে যাবি না”
: ” পরেরবার অবশ্যই যাবো বু, এবার না”
কথা বলতে বলতে অনভ্যস্ততায় নতুন বৌয়ের মাথার ঘোমটা পরে যায়। রাজিবের চোখ কেন জানি তার গলার সোনাদানার দিকে গেলো। কেমন জানি চেনা চেনা লাগলো সেগুলো। ঘর থেকে বের হতে বের হতে ভাবে ঠিক এমন দেখতে সোনাদানা ছিলো ওর মায়ের। মারা যাবার আগের বছর বাবার চিকিৎসার টাকা নিতে বরিশাল আসার সময় পথে হারিয়ে যায় সেগুলো।
মনে মনে ভাবে দেখতে একরকম হলেই তো জিনিস এক হয় না। বু-র থেকে বিদায় নিয়ে একে একে সব মামীদের ঘরে যায় ও তাদের থেকে বিদায় নিতে। সবশেষে মেঝো মামীদের ঘর, তারা সবচেয়ে নিরীহ এই বিশাল বাড়িতে। এই বাড়ির এত জৌলুশ এদিকটায় এলে ফিকে মনে হয়। তবে রাজিবের এ মামা সৎ একজন মানুষ। কারো সাতেপাঁচে নেই নিজেদের মতো থাকেন। মেঝো মামীর সাথে দেখা করতে গেলে সে বলে-
: ” আইলা, আবার চইল্যাও যাইতাছো, মোরা তো গরিব তাই মোগো ঘরে বেড়াইলি না, যারা তোগো আগে পাছের সব খাইছে তারাই তোগো আপন”
মেঝো মামা মামীকে ধমকের সুরে বললেন –
: ” আহ্ কি শুরু করলা, খ্যাম দেও তো ”
: ” আপনে চুপ থাকেন, হারা জীবন তো থামায়াই রাখলেন মোরে। ওর মা মোর ননই ছিলো না, মোর সইও ছিলো। হ্যার লগে যে বেইনসাফ হইছে তা ওরে না কইলে মোর পাপ হইবো।
বিপদে পরা বইন আইছে সাহায্য চাইতে, বিপদে পরলে মানুষ কই যায় আপনজনের কাছেই তো? বড় মিয়া কি করলো- চালাকি কইরা জমিডা কিন্না লইলো, আর হ্যার বৌ কিনলো সোনাদানা। এই জিনিস আমার বাপের বাড়ি থইক্যা বিয়াতে ওর মায়রে দিছিলো আমার বাপে। এতদিন হেয় পিন্দছে ফাঁকে ফাঁকে। এহন মাইয়্যারে বিয়াত লগে দিয়া দিছে।
এসব শুনে রাজিব আহত গলায় বলে-
: ” থাক মামী, সব জিনিস কপালে থাকা লাগে”
: ” আরে আল্লা ত আছে একজন, তর মার তে কাইড়া নিছে, হের তে নিছে আল্লায়, ফান্দে পইরা জমি দান করছে স্কুল করতে। জনদরদী! হ্যাহ্ বুনের সম্পদ মারি খাইয়্যা এহন জনদরদী হইছে।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ২২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বড় মামার এ কাহিনী মীরার জানা আছে বেশ আগে থেকেই। তবুও ওরা দু’জনই সাধ্যমতো সমাদর করে তাদের। কখনো খরাপ চোখে দেখেন না। তিনি যা করার করেছে, তার হিসেব তিনি দিবেন। কিন্তু দাওয়াতে যাবে না বলে আগেই সিদ্ধান্ত নেয় ওরা দুজনে। তবে বিয়ের উপহার হিসেবে মীরা বৌয়ের জন্য ওদের কারখানার সবচেয়ে দামী লেহেঙ্গাটা টুম্পাকে জলদি বাড়ি নিয়ে আসতে বলে। টুম্পা আধ ঘন্টার মধ্যে কাজ শেষ করে লেহেঙ্গা সুন্দর করে প্যাক করে বাসায় নিয়ে আসে। মামা কোন মতেই এটা নিবে না তার সাথে। তিনি বলেন-
: ” তোরা ভাইর বিয়াত উপহার দিবা, যাওয়ার সময় লগে করি নিয়া আসিও, মোক কেন দিচ্ছ”
ভদ্রলোককে শেষ পর্যন্ত দেওয়ায়ই গেলো না লেহেঙ্গা টা। দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতের লঞ্চে তিনি রওনা দিলেন নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
এদিকে মীরার মনে খুঁতখুঁত ছিল লেহেঙ্গাটা না দিতে পারায়। রাজিব মীরাকে বলে –
: ” লেট ইট গো, তার টাকাপয়সা কম নেই । তিনি এরচেয়ে ভালোও কিনে দেবার সামর্থ্য রাখেন। আমরা যখন যাচ্ছি না, এত প্যারা খাচ্ছ কেন?”
মীরা রাজিবের কথার যুক্তির কাছে ধরাশায়ী হয়ে চুপ হয়ে যায়। প্রসঙ্গে বদলে রাজিব বলে-
: ” তারচে বরং চলো দূরে কোথাও ঘুরে আসি ”
মীরার চোখেমুখে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। মন পড়তে কবে শিখলো এই লোকটা? মনের উচ্ছাস খুব কষ্টে চেপে মীরা বলে-
: ” না থাক”
: ” সত্যি থাকবে?”
: ” না, মানে…”
রাজিব সোফা থেকে উঠে মীরার কাছ ঘেঁষে বসে, তারপর ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “কোথায় যাবা? সমুদ্রে নাকি পাহাড়ে?”
মীরা আর কোন রাখঢাক করে না, ওর কাঁধে মাথা রেখে বলে-
: ” ভালোবেসে যেখানে নিয়ে যাবা তুমি”
: ” সবকিছু গোছগাছ করো, আগামীকাল রাতে আমরা রওনা দিবো”
মীরা রাজিবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে-
: “ওকে”
পরদিন মহা ব্যাস্ততায় কাটে মীরার প্যাকিং নিয়ে। প্রথমে সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা থাকলেও নূহার কথা ভোবে তা স্কিপ করা হয়। ওরা যাচ্ছে সিলেট। কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করবে। ব্যাবসা, ব্যাস্ততা থেকে দূরে থাকা মানেই হ্যাপিনেস। তার উপর দূরে ট্যাুর। উপচে পরা খুশি সবার চোখেমুখে।
ওরা দুই রুম আগে থেকেই রিসার্ভ করে রাখে ফোন করে। সময় মতো পৌঁছে যায় ওদের ছোট্ট পরিবারটা। দুই রুমের একটাতে থাকে রাজিব, আরেকটাতে মীরা আর টুম্পা।
যথারীতি রাজিব ওর পছন্দের জায়গায় ঘুরিয়ে আনে ওদেরকে। প্রথম দিন ওরা যায় শাহজালালের মাজারে, আর জাফলং হয়ে ফিরবার পথে লালা খাল হয়ে । পরদিন মালিনীছড়া চা-বাগান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, সহ অনেক জায়গায় ঘুরে ওরা। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলো ওরা সকলেই, সাতটায় হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে রুমে এসে পরে সবাই। প্ল্যান পরদিন হয় এখানকার কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে দেখবে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমে ঢলে পরে সকলে। নূহা এমনিতেই অনেক লক্ষ্মী একটা বাচ্চা। তেমন জ্বালাতন করে না। সে রাতে নূহাও ঘুমিয়ে পরলো জলদি। হঠাৎ রাত সাড়ে এগারোটায় কল করে রাজিব মীরাকে। তন্দ্রালু মীরা ফোন রিসিভ করতেই রাজিব বলে-
: ” নূহা ঘুমিয়েছে?
: ” হুম”
: ” তুমি ঘুমিয়ে গেছো?”
: ” বলো সমস্যা নেই ”
: ” বের হবে? তোমাকে নিয়ে রাতের শহর দেখতে বেরুবো ভাবছি”
: ” দশ মিনিটের মধ্যে আসছি ”
বলেই খুব সাবধানে নামলো খাট থেকে। নাইট গাউন খুলে সুন্দর একটা সাদা ড্রেস পরে মীরা। সাজগোজের সময় নেই তাই হাতে পাউডার নিয়ে ঝটপট মুখে মেখে নেয় ক্লান্তির কারনে তৈরী হওয়া ডালনেস লুকাতে। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ভ্রু জোড়া একে একটা নুড লিপগ্লস দেয় ঠোঁটে। ব্লু-লেডি পারফিউমটা মাখে গায়ে, ব্যাস। বের হওয়ার আগে টুম্পাকে ডাকবে কি ডাকবে না তা ভেবে শেষমেষ না ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে পরে।
রুমের দরজা খুলতেই দেখে রাজিব দরজার সামনে অপেক্ষা করছে। কাকতালীয় ভাবে রাজিবও একটা সাদা পাঞ্জাবী পরে আছে। ওকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দেয় রাজিব। কি একটা খোঁজার বাহানায় কিছু না বলেই নিজের রুমে ঢুকে রাজিব। মীরাও কি হলো? বলতে বলতে ওর পিছু পিছু গেলে রাজিব ঘুরে দরজা আটকে মীরাকে জাপ্টে ধরে চুমু খায়। রাজিবের এমন কান্ডে তব্দা খেয়ে যায় মীরা। তারপর ও নিজেও যোগ দেয় সে কর্মযজ্ঞে। ভালোবাসার উষ্ণ আদানপ্রদান শেষ হলে মীরা বলে-
: “আমার সব লিপগ্লস খেয়ে ফেললে তুমি”
রাজিব ওর কথার ওজন আর বিপরীতে তার সিরিয়াসনেস দেখে হেসে বলে-
: ” আমার তো তোমাকেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, সবসময়ই খুব অল্পতে বেঁচে যাও তুমি”
মীরা রাজিবের পাঞ্জাবীর হাতা খামচে ধরে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলে –
: ” বাইরে যাওয়ার কথাটা কি তাহলে বাহানা ছিলো?”
: “আরে নাহ্, তোমাকে দেখতে হট লাগছিলো তাই নিজেকে একটু পুড়িয়ে নিলাম ”
: ” হেহ্, চলো, নাকি আরেকটু পুড়ার শখ হয়েছে? ”
মাথা দুপাশে নেড়ে না বলে রাজিব।
জামা, ওড়না ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে রাজিব, দুজন মিলে নিচে নামে ওরা। মীরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা টেক্সট করে টুম্পাকে। ওরা নেমে দেখে রাত অনেক হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর মানুষ রাস্তায়। মীরা রাজিবকে বললো-
: ” চা/কফি কিছু দরকার এ মুহূর্তে”
একটু হাঁটতেই একটা কফিশপ পেলো ওরা। দুজনেই কোল্ড কফি নিলো। হাঁটতে হাঁটতে বেশ সময় নিয়ে শেষ করলো কফিটা। ততক্ষণে অনেক দূরে এসে পরেছে ওরা হাঁটতে হাঁটতে। অনেক কথা হয় দু’জনে। জীবণের পাওয়া – না পাওয়ার, আনন্দ-বেদনার, সুখ-দুঃখের হিসেব কষে দুজনে, কথা বলতে বলতে নির্জন এক রাস্তার বাঁকে পৌঁছে যায় ওরা। মীরা বসতে চায় কিছুক্ষণ। রাস্তাটা খুব সুন্দর প্রকৃতি এবং আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয় করে তৈরী করা। পাশাপাশি দুজন বসে গল্প করলো কিছুক্ষণ। এদের টপিকের অভাব নেই গল্প করার। যে টপিকেই গল্প শুরু হোক না কেন শেষের দিকে তা ঘুরেফিরে বিজনেসেই টার্ন নেয়। ব্যাবসার প্রসারে করনীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় দুজনে।
বেশকিছু সময় পর ওরা উঠে উল্টোদিকে রওনা দিলো। পুরো রাস্তায় মীরা রাজিবকে ধরে হাঁটছিলো। রাজিবও উপভোগ করছিলো সময়টাকে। ক্ষুধা লাগায় দুজন মিলে স্ট্রিট সাইড বিক্রি করা পিৎজা খায় দুজনে। কোল্ড ড্রিংকস হাতে ফিরে আসে হোটেলে। রুমের কাছে এসে বিদায় নিতে নিলে মীরাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে নেয় রাজিব। মীরার অবাক হওয়ার শেষ নেই যেন। ঠিক তার এক ঘন্টা পর মীরা ওর রুমে ফিরে এসে ছিলো।
রুমে এসে দেখে নূহা আর টুম্পা এখনো ধুমছে ঘুম। ম্যাসেন্জারের ম্যাসেজও চেক করে নি টুম্পা। তাই সেটা রিমুভ করে দেয় ও নিজের ফোন থেকে। বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে চুলগুলো মুছে বারান্দায় কাপড় শুকাতে গিয়ে দেখে কেও একজন দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। জলন্ত সিগারেটের আগুনের উঠানামা ছাড়া কিছুই দেখে না মীরা। দ্রুত কাপড় মেলে চলে যাবে এমন সময় এগিয়ে আসে সেই জলন্ত আগুন ধরে রাখা ব্যাক্তি। প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় ও, পরে অভয় দিয়ে লোকটা বলে-
: ” আরেহ্ আমি”
কন্ঠ শুনে মীরার ধরে প্রাণ ফিরে পায়। কাপড় শুকাতে দিয়ে চলে যেতে নেয় মীরা, রাজিব ওকে দাঁড়াতে বলে রুম থেকে ফোন নিয়ে আসে। সেটার টর্চের আলো ফেলে মীরার উপর। সদ্যস্নাত সুন্দরী মীরাকে দেখে রাজিব বলে-
: ” মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না তুমি আমার বউ”
বলতে বলতে মীরার ঘরের বারান্দায় চলে আসে রাজিব। জড়িয়ে ধরে মীরার কাঁধে নাকমুখ ঘষতে থাকে ও।
: ” তোমার কি হইছে বলো তো? হঠাৎ এত প্রেম উৎলে উঠলো তোমার”
: নূহা হওয়ার পর তুমি আরো বেশী সুন্দর, বেশী আবেদনময়ী হয়ে গেছো, নদী বর্ষায় যেমন কানায় কানায় পূর্ণ হয়, মা হওয়ার পর তুমিও তেমনি…”
: ” হইছে, আমি এখন যাই”
: ” একটু দাঁড়াও ”
বলেই আবারও মীরাকে জড়িয়ে ধরে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিতে থাকে রাজিব । মীরা কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে রাজিবকে বলে ওর বারান্দায় চলে যেতে। রাজিব নাছোড়বান্দা ও ছাড়েও না, যায় ও না। মীরা রাজিবকে বলে-
: ” কিছুই বুঝলাম না ব্যাপারটা”
রাজিব বলো-
: ” একটু সময় দাও বুঝিয়ে দিচ্ছি ”
দু’জন একটা সময় দরজার কাছে এসে পরে, ভিড়ানো দরজাটা খুলে যায় হাট করে। শব্দে রুমে শুয়ে থাকা টুম্পা জেগে বলে-
: ” কে?”
মীরা রাজিবের হাতে একটা কামড় দিয়ে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। রাজিবকে চলে যেতে বলবার সুযোগও হয় না মীরার। রাজিব বেচারা হাতটা অন্য হাত দিয়ে ডলতে ডলতে মুচকি হেসে সাবধানে নিজের বারান্দায় চলে যায়।
খাটে শুয়ে মিটিমিটি হাসে মীরা। রাজিব সবসময়ই একটু বেশী এগ্রেসিভ। কপট রাগ দেখালেও ব্যাপারটা মীরার ভালোই লাগে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মীরা বলে-
: ” আল্লাহ সবসময় এমনি ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখো আমাদের। কারো নজর লাগতে দিও না”
চলবে….