#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৩৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
ঘাটে কোনো জাহাজ নেই। ডিঙি নৌকাও দেখা যাচ্ছে না। জনশূন্য নদীর ঘাটে জল থৈ থৈ করছে। চাঁদের কিরণে যতটুকু দেখা যাচ্ছে ততটুকুতে একটা নৌকারও দেখা মিলছে না। শেহজাদ অস্থিরচিত্তে পায়চারি করে পুনরায় ঘোড়ায় চেপে বসলো। কামীল বলল,
‘ সাহেব আমরা কি মহলে ফিরব? ‘
‘ হ্যা। ভাইজান জানে রূপা কোথায়। দ্রুত ফিরতে হবে। ‘
টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এল কাশীম। এসেই ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে নতচোখে বলল,
‘ সেখানে আরেকটা বিপদ ঘটে গিয়েছে সাহেব। তটনী মাহমুদাকে শেরহাম সুলতান বন্দি করেছেন মোল্লা বাড়ির দোকানের গুদামে। সেখানে শেরহাম সুলতানও ছিলেন। কি হয়েছে কিছু বুঝতে পারা যাচ্ছে না। তটিনী মাহমুদা সবার ধিক্কার শুনে আত্মাহুতি করতে যাচ্ছিলেন। সেখানে ভয়ংকর অবস্থা। আপনার ফুপুজানও কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘
শেহজাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। নিজের বোনতুল্য মেয়েটার সাথে ভাইজান। ছিঃ! সেই মেয়েকেই যার সাথে একসময় তার নিকাহ হওয়ার কথা ছিল! এবার সে আর কোনো সুযোগ দেবে না শেরহাম সুলতানকে।
অগ্নিতূল্য হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শেহজাদ মহলে ফিরে গেল। সদর কক্ষে মহলের মহিলারা সবাই জটলা পাকিয়ে আছে। পাড়াপড়শিরাও এল। তারা উঠোনে দাঁড়ানো। ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতেই সকলেই ঘাড় ফিরাতেই সিংহদ্বার পেরিয়ে শেহজাদকে ঢুকতে দেখলো। সকলেই সরে পড়লো। শেহজাদ সদর কক্ষে প্রবেশ করতে করতে হাঁক ছেড়ে বলল,
‘ এত ভীড় কিসের? সমস্যা কি? ‘
ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো সকলে। সে প্রবেশ করতেই শাহানা ছুটে এসে বলল,
‘ তুমি এই অপবাদ থেকে ওকে বাঁচাও। শেরহাম কি করে এই কাজ করতে পারলো? ওর মধ্যে কি মনুষ্যত্ব এতটুকুও বেঁচে নেই? দেখো ওর কি অবস্থা! ‘
শেহজাদ আহত চোখে তাকালো। খোদেজার বুকে গুটিসুটি মেরে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছে তটিনী। চাদরে ঢাকা থাকায় তার মুখ দেখা গেল না। সায়রা সোহিনীরা এমন দুর্দশায় একসাথে কাঁদছে। সকলের আর্তনাদে শেহজাদের হাতের মুষ্ঠি শক্ত হয়ে এল। বাইরে শেরহামের কন্ঠস্বর শোনা গেল। ভীড় দেখে সে চিল্লাপাল্লা করছে। মানুষজন পালিয়েছে তার গর্জন দেখে। সকলেই মহলের এমন অবস্থা দেখে দুরছাই করছে।
শেহজাদ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। আজ হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। তাকে অমনভাবে বেরোতে দেখে সকলের বক্ষ কেঁপে উঠলো। শেরহামও বুঝে উঠতে পারেনি আচমকা সে আক্রমণ করে বসবে। একনাগাড়ে পরপর দু চারটে ঘুষি বসাতেই শেরহাম ছিটকে পড়লো। উঠে বসতে না দিয়ে সেভাবেই তার গলা চেপে ধরলো শেহজাদ। তার মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। হাতের গলার নীল রঙের রগ গুলি ভেসে উঠেছে প্রবল চাপে। সে প্রবল আক্রোশে বলল,
‘ আজকে তোমাকে খুন করেই তবে শান্তি আমার। কি করেছ তটিনীর সাথে? ‘
সাফায়াত আর কামীল টেনে নিয়ে গেল শেহজাদকে। শেরহামের চোখ উল্টে আসছিল দম নিতে না পেরে। আর কিছুক্ষণ থাকলে অক্কা পেত। শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাশতে কাশতে বলল,
‘ আমি তটিনীকে কিছু করিনি। ফালতু কথা বলবি না। সব দলিলপত্র দিয়ে দে। তার আগে রূপার খোঁজ পাবি না। ‘
শেহজাদ সাফায়াতের জন্য তেড়ে আসতে পারলো না। চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ রূপার যদি কিছু হয় তোমার জিন্দেগী এখানে শেষ। তুমি সীমা পেরিয়ে গিয়েছ। তটিনীর গায়ে কলঙ্ক লাগানোর জন্য তোমাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব। ‘
‘ আগে তোর বউকে খুঁজে বের কর। তারপর বাকি কাজ করিস। ‘
শেহজাদ বিকট গর্জন করে বলল,
‘ আবারও সাবধান করছি তোমাকে। রূপাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছ বলো। ‘
শেরহাম গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘ আমি বেশি কথা বলতে পছন্দ করিনা। যা বলেছি তাই করব। নয়ত তটিনীর মতো তোর রূপারও একই অবস্থা হবে। ‘
সাফায়াত আর কামীলকে সরিয়ে দিয়ে ধারালো চকচকে তলোয়ার নিয়ে ফের ছুটে এসে শেরহামকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল শেহজাদ। তলোয়ার উপরে তুলে কোপ বসাতেই সায়রা ছুটে এসে শেহজাদকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। কেঁদে ওঠে বলল,
‘ ভাইজান শান্ত হোন। রাগের বশে বড় ভাইজানকে মারবেন না। পরে আপনি অনুতপ্ত হবেন। ‘
সোহিনী পা জড়িয়ে ধরলো। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
‘ না না এমনটা করোনা ভাইজান। ‘
শেহজাদের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেল। ক্রোধের উন্মত্ততায় হাঁপাতে লাগলো সে। ঘাম ঝড়ে পড়লো তার গাত্রবেয়ে, কপাল ছিঁড়ে। শ্বেতবর্ণ মুখটা রক্তিম।
সোহিনী শেরহামকে তুলে পোশাক টেনে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ তুমি এমন কেন? তুমি আমার ভাইজান নও। অন্য একটা মানুষ। তুমি আমার ভাইজান হতেই পারো না। আমার ভাইজান এমন ছিল না। তুমি এমন পশুর মতো হয়ে গেলে কি করে ভাইজান? তুমি তোমার আদরের বোনদেরও ভুলে গিয়েছ। তোমার পরিবারের সাথে দিনের পর দিন জুলুম করে যাচ্ছ।
শেরহাম ওকে ঠেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। শেহজাদকে রুক্ষস্বরে বলল
‘ আমাকে মারবি? মার। মেরে ফেল। তোর বউয়ের খোঁজও জীবনে পাবি না। কি মনে করেছিস ওকে নিকাহ করে নিয়ে শান্তিতে সংসার করবি? আমি থাকতে তা জীবনেও হতে দেব না। ‘
শেহজাদ ঝাঁজালো কন্ঠে বলল, তোমার কি মনে হয়? আমি তোমার হাতে সব তুলে দিলেও নগরের মানুষ তোমাকে গ্রহণ করবে? তোমার অভিষেকে আসবে? আজকের পর তো তা একদমি হবে না। তুমি তটিনীর সাথে যা করেছ তা সবাই জেনে গেছে। তুমি তাদের কাছে একজন পশুতুল্য মানুষ।’
শেরহাম খ্যাঁক করে বলল,
‘ মুখ সামলা। আমাকে মেয়েঘটিত ব্যাপারে একদম জড়াবি না। একদম ফালতু কথা বলবি না। তটিনীকে জিজ্ঞেস কর ও আমার সাথে কি করেছে?’
সকলের চোখে বিস্ফোরণ। সাফায়াত বলল,
‘ কিসব বাজে কথা বলছেন? ও কি করবে আপনার সাথে?’
‘ ও আমার মাথায় আঘাত করেছে। আমি কিছু করিনি। না করে ভুল করেছি। তোদের শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ নোংরা লোক। রূপাকে আমার হাতে তুলে দাও। তটিনীর কাছে ক্ষমা চাও। তাহলে তুমি যা চাচ্ছ সব দেব তোমাকে।’
শেরহাম উৎসুক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কি বললাম শুনতে পাসনি? আগে দলিলপত্র বুঝিয়ে দে। সেখানে স্বাক্ষর দে। তারপর রূপার খোঁজ পাবি। না দিলে তোর ক্ষতি। আমি আজ না হয় কাল ঠিকই সব নিয়ে নেব। এবার তোর সিদ্ধান্ত। ‘
শেহজাদ প্রখর দৃষ্টিতে শেরহামের মুখপানে চেয়ে থাকলো। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রূপা ওই পশুগুলোর হাতে আছে। এখন সর্বপ্রথম কাজ রূপাকে উদ্ধার করা। সে বলল,
‘ বেশ। সব তুলে দেব তোমার হাতে। আগে রূপার খোঁজ দাও। যদি আমি রূপার খোঁজ না পাই তখন? তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনা। ‘
‘ আমিও তোকে বিশ্বাস করিনা। ওকে পেয়ে গেলে তুই তোর সৈন্য নিয়ে সবার উপর আক্রমণ করবি। আগে স্বাক্ষর দে। মহল, মজুতঘর, কোষাগারের তালা চাবি দে। নিজ হাতে অঙ্গীকার পত্র লিখে দে। ভবিষ্যতে তুই কোনোকিছুই তোর বলে দাবী করতে পারবি না। ‘
শেহজাদ চরম মতদ্বৈধতায় ভুগলো। শেরতাজ সাহেব আর শাহাজাহান সাহেব তার তীব্র বিরোধী। উনারা কিছুতেই স্বাক্ষর করবেন না। খোদেজা, শাহানাও শেরহামের কথায় রাজী না হওয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছে শেহজাদকে। ঠিক ততবারই রূপার চেহারাটা ভেসে উঠছে মানসপটে। না রূপাকে সে হারাতে পারবে না। তাদের এখনো মনের মিলন না হোক, একে অপরকে ছাড়া থাকা যাচ্ছেনা এমন সময়টাও দেরীতে আসুক, স্বামী স্ত্রীর মতো সেই গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেরী হোক, একে অপরকে গভীরভাবে চিনতে,জানতে দেরী হোক, বুঝাপড়ায় অমিল হোক তারপরও রূপাকে সে হারাতে পারবে না। তার জীবনের একচ্ছত্র জায়গাজুড়ে রূপার বাস। সে হাসায়, ব্যথিত করে, ভাবায়, আনন্দ দেয়। সেই মেয়েটিকে ছাড়া তার পথচলা অসম্ভব। সে আসন ছাড়বে কিন্তু দায়িত্ব নয়। ক্ষমতা তার দরকার নেই। রূপা পাশে থাকলে সে শক্তি পাবে। রূপাকে নিয়ে সে নগর কেন বিশ্বজয় করতে পারবে। সব যাক কিন্তু রূপা সুস্থরূপে তার কাছে ফিরে আসুক। খোদাবান তাকে হেফাজত করুক। গায়ে একটা আঁচড়ও না লাগুক। আজ শুধুমাত্র তারজন্য মেয়েটা প্রতিটা পদে পদে বিপদে পড়ছে। জীবনমৃত্যুর খেলায় লড়ছে একা একা। তাকে কাছে পেলে আর একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করবে না সে। প্রয়োজন পড়লে মহলে রাখবে না। আলাদা রাখবে তাও নিজের কাছে রাখবে। খুবই যত্নে।
সবকিছুর মীমাংসা হতে হতে এশার আজান পড়ে গেল। শেরহামের হাতে মহলের চাবি, কোষাগারের চাবি, মজুতঘরের চাবি, জমিজমার কাগজপত্র, অঙ্গীকার পত্র লেখা, আর তাতে স্বাক্ষর দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই অপরূপার খোঁজ পেল শেহজাদ। কাল অভিষেকে শেরহাম নিজেকে এই নগরের সম্রাট বলে নিজেকে ঘোষণা করবে। যদিও নগরবাসীর কাছে সে ইতোমধ্যে আতঙ্কসরূপ। তারপরও ঢাকঢোল পিটিয়ে সে উল্লাস করতে চায়।
শাহজাহান সাহেব, আর শেরতাজ সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। শেহজাদ উনাদের স্বাক্ষর নিয়েছেন এই বলে সে তার দায়িত্ব ভুলবে না। দাদাজানের দেওয়া কথা সে কখনোই ভুলবে না। সে আসন ছাড়ছে, ক্ষমতা ছাড়ছে কিন্তু দায়িত্ব নয়। নিজের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি সে নগরের মানুষের পাশে থাকবে।
তার দলবল নিয়ে সে বেরিয়ে গেল পলাশপুরের উদ্দেশ্যে। এক পুরোনো বাসভবনে অন্ধ কুঠুরিতে অপরূপাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
জাহাজ নিয়ে দ্রুত পাড়ি দিল তারা।
এদিকে জ্ঞান ফেরার পর তটিনী কান্নাজুড়ে দিল সবটা শুনে। সে জানতো রূপা কোথায় আছে। যদিও শেরহাম গতরাতে তটিনীকে দেখার পরই রূপাকে সিন্ধিপুরে না নিয়ে পলাশপুরের একটা বাসভবনে রাখতে বলেছে। তাও তটিনীর অনুশোচনা যাচ্ছে না। সাথে মানুষের বিষাক্ত কথাগুলো তার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাও একটা জঘন্য মানুষের সাথে তাকে জুড়ে।
শাহানা শান্ত করে বলল,
‘ কারো কথায় কিছু যায় আসে না। তুমি তো নিজেই বললে ও তোমার সাথে জোরাজোরি করেনি। ‘
‘ তাতে কি? ওই জঘন্য লোকটা তো আমাকে ইচ্ছে করে বন্দী করেছিল। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই ওই কুঠুরিতে এসেছিল। আমার গা গুলাচ্ছে। ঘেন্না হচ্ছে। আমি মরতে চাই। শেহজাদ ভাই তাকে কেন শাস্তি দিচ্ছে না? কেন তাড়িয়ে দিচ্ছে না? আমি ওই নোংরা লোকটার আশেপাশেও থাকতে চাই না। ‘
শেরহাম সদর কক্ষে প্রবেশ করে উৎফুল্লচিত্তে। আজ তার খুশির দিন, আনন্দের দিন। আজ বাকিরাত টুকু সে আনন্দ উল্লাস করবে। তটিনীর কান্নাকাটি শুনে তার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। এই মেয়ের কারণে সে ফেঁসে গিয়েছে। কাল অভিষেকে যখন নগরের বড়বড় মান্যগন্য মানুষরা তাকে অভিনন্দন জানাতে আসবে তখন সে এই কথাগুলোর মুখোমুখি হবে। সে সবার কাছে নিকৃষ্ট প্রদর্শিত হবে। তাই সামাদ তাকে পরামর্শ দিল এই মেয়েকে নিকাহ করতে। তাহলে তার চরিত্রের উপর আর আঙুল উঠবে না। সবাই বিষয়টাকে অতটা নোংরামো ভাববে না। তাছাড়া এই মহলে তার অবস্থান শক্তপোক্ত করার জন্য তটিনী একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে। এতে পরবর্তীতে কেউ সহজেই তাকে দুর্বল পেয়েও আঘাত করতে পারবে না। তাজ্যপুত্র হোক, তাজ্য জামাতা তো হতে পারেনা। তাই সামাদের পরিকল্পনা তার খারাপ লাগেনি। তাছাড়া তটিনী অপাকে পছন্দ করেনা। সেক্ষেত্রে তটিনী তার একমাত্র গুটি যে তাকে জিতিয়ে দিতে পারে সবক্ষেত্রে।
সে সদর কক্ষে পা রাখতেই সকলেই তার দিকে ভীত চোখে তাকালো। তার শক্তি এখন দ্বিগুণ। তটিনী তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। শেরহাম সবাইকে চমকে দিয়ে, হতবাক করে দিয়ে নিজের প্রস্তাব পেশ করলো,
‘ আমি তটিনীকে আজই নিকাহ করতে চাই। কিছুপর কাজী আসবে। কেউ এর বিরোধিতা করলে সোজা মহলের বাইরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবো। সাবধান। সায়রা, সোহিনী ওকে সাজিয়ে দে। ‘
সকলেই মূক হয়ে চেয়ে রইলো। কিছু বলার বাকি রাখলো না শেরহাম। শাহানা গালে হাত দিয়ে বলল,
‘ না না এ হতে পারে না। এমন অমানুষের হাতে আমি আমার কন্যা দেব না। ‘
তটিনী ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো দ্রুতগতিতে উঠে দাদাজানের সেই সিংহাসনে গেঁথে রাখা তলোয়ার খাপ থেকে বের করে প্রবল গতিতে ছুঁড়ে মারলো শেরহামের দিকে। উপস্থিত সকলেই হতভম্ব, বাকহীন। শেরহাম সরে পড়লো সেখান থেকে। ঝনঝন করে ছিটকে পড়লো তলোয়ারটি। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে গর্জে তটিনীর দিকে তেড়ে গিয়ে সিংহাসনের সাথে লাগিয়ে গলা চেপে ধরে শেরহাম বলল,
‘ এত স্পর্ধা আসে কোথাথেকে তোর? এত তেজ, এত জেদ সব বের করে দেব আমার সাথে লাগতে আসলে। ওই শেহজাদ সুলতান আমার কাছে হার মেনেছে। তুই কোথাকার ছাই। ‘
কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। কারণ সাফায়াত, শেহজাদ তার সৈন্যদল কেউই নেই। যারা ছিল তারা শেরহামের সৈন্যদের হাতে আটক। শেরতাজ সাহেব তার কলার ধরে টেনে এনে কষে গালে চড় বসালো। শেরহাম উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল গর্জে উঠে । সায়রা শবনম উনাকে গিয়ে ধরলেন। তটিনী কাশতে কাশতে সিংহাসনের পায়ার কাছে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো।
শেরতাজ সাহেব বললেন,
‘ অমানুষ! কার গায়ে হাত তুলেছিস তুই? ‘
‘ মানুষের গায়ে হাত তুলেছি। আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হয়? বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখনি ঘাড়ধরে সবকটাকে বের করে দেব। কেউই ভুলে যাবেনা আজ থেকে আমি সম্রাট, আমি রাজা। সবকিছু আমার নখদর্পনে। সেখানে একটা নখসমান মেয়ে আমার দিকে তলোয়ার ছুঁড়ে মারলো?’
‘ তুমি ওকে বন্দি করেছ কেন? কোন সাহসে? কতবড় বেয়াদব তুমি ওকে বন্দী করে ওর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়েছিলে? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার। তুমি ওকে কলঙ্কিত করেছ। ওর কাছে ক্ষমা চাও। কি করে নিকাহ’র প্রস্তাব দাও? তোমার মতো মানুষের সাথে নিকাহ হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া উত্তম। ‘
‘ তাহলে মরে যেতে বলো। আমি বসে বসে দেখি। ‘
‘ তুমি ক্ষমা চাও ওর কাছে। ও তোমার কোনো ক্ষতি করেনি। ‘
যেন ঠাট্টা করলো তার সাথে সেভাবেই হাসলো শেরহাম। হাসতে হাসতে তটিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বসা থেকে তুলে সিংহাসনে বসিয়ে শক্ত করে বাহু চেপে ধরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল,
‘ তোর জন্য আমার দিকে আঙুল উঠেছে। যা করিনি সবাই তা বলছে। তোর জন্য আমি আমার এই বহুকষ্টে অর্জিত সম্মানে আঘাত হানতে দেব না। আজই তোকে নিকাহ করব। নইলে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যাহ আমার মহল থেকে। একদম আশেপাশেও থাকবি না। ‘
তটিনী নিস্তেজ হয়ে পড়লো শেরহামের চোখে চোখ রাখতে গিয়ে। ঘৃণা ছুঁড়ে বলল,
‘ তুমি পশুর চাইতেও অধম। সম্রাট একজনই ছিল আর সে-ই থাকবে। তুমি তার নখের যোগ্যও হতে পারবে না। আজ অসহায় পেয়ে তুমি আমার সাথে যা অন্যায় করছো তা উপরওয়ালা কোনোদিনই ক্ষমা করবেন না। তিনি তোমাকে সুযোগ দিয়েছেন আজ। সুযোগ একদিন আমাদেরও আসবে। ‘
শেরহাম ওর গালের দুপাশে আঙুল দ্বারা চেপে ধরে বলল,
‘ চুপ। একদম ফটর ফটর করবি না। তৈরি হয়ে নে। যা অপবাদ আমার গায়ে লেগেছে তোর জন্য তা আজ রাতেই সত্যি সত্যি করে দেব। ‘
তটিনী ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল।
শাহাজাহান সাহেব বললেন,
‘ আমরা বেরিয়ে যাব। তারপরও তোমার হাতে আমাদের মেয়েকে দেব না। তুমি রূপার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছ। এখন তটিনীর দিকে নজর দিয়েছ। তোমার খুব খারাপ হবে। ‘
শেহজাদ তটিনীকে ছুঁড়ে ফেলে সিংহাসনে আসন গ্রহণ করে হো হো করে হাসতে হাসতে বলল,
‘ এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। শেহজাদ সুলতান পলাশপুর থেকে আসবে কাল-পরশু। ততদিন বাইরে থাকো। সমস্যা কি? সুলতান মহলের সবাই পথে নেমেছে দেখলে মানুষ খুশিই হবে। ‘
সিভান সমস্ত ঘটনা চুপচাপ দেখছিল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে। বিরক্ত হয়ে শেরহামকে বলল,
‘ তুমি খুব খারাপ। সুন্দর বউকে কোথায় নিয়ে গিয়েছ? আবার তনী আপুর সাথে এমন করছো কেন? শেহজাদ ভাইজান তোমাকে মেরে ফে*লবে।’
শেরহাম ধমক দিয়ে বলল,
‘ এই চুপ। একদম তুলে দেব এক আছাড়। ‘
সিভান আঁতকে উঠে। হামিদা তাকে নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ে।
শেরতাজ সাহেব বলেন,
‘ ও তোমার ছোট ভাই। অন্তত তার সামনে নিজের সরূপ ঢেকে রাখো। লজ্জা হলো না যখন ও তোমাকে খারাপ বললো?’
‘ কিসের ভাই? ও কি আমার মায়ের পেটের ছেলে?’
‘ মায়ের পেটের বোন তো আছে। তার সাথেও তো অবিচার করছো। আসলে তুমি একেবারে অমানুষে পরিণত হয়েছ। এতটুকুও মনুষ্যত্ব তোমার মাঝে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তুমি এত নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারতে না। এই সবাই বের হও। আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমাদের জায়গা হয়ে যাবে। চলো সবাই। ‘
শেরহাম গা এলিয়ে বসলো। দেখলো সত্যি সত্যি সবাই চলে যাচ্ছে। না এ হতে পারেনা। কাল তার অভিষেক। এদেরকে হাতে রাখতে হবে। নিকাহও সাড়তে হবে। সে তার সৈন্যদের ডাক দিয়ে বলল শবনম আর আয়শাকে বন্দী করে নিয়ে যেতে। সৈন্যরা তাই করলো। শবনম আর আয়শা চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো। সৈন্যরা তাদের নিয়ে উদাও হয়ে গেল। শেরতাজ সাহেব আর শাহাজাহান সাহেবকে অন্ধ কুঠুরিতে বন্দী করলো। তটিনী বলল,
‘ কি হচ্ছে এসব? তুমি আমার বোনদের নিয়ে টানাটানি করছো কেন? কি করেছে ওরা? ‘
শেরহাম সিংহাসনে গা এলিয়ে বসতেই সদর দরজার কাছে এসে থামলো কাজী। উনার পেছনে শেরহামের সৈন্য দুজন বন্দুক হাতে দাঁড়ানো। উনি নতচোখে বলল,
‘ শেরহাম সুলতান ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ‘
শেরহাম তটিনীকে বলল,
‘ কাজী চলে এসেছে। রাজী হয়ে যাও। নইলে তোমার বোনদের অবস্থা হবে তোমার চাইতে করুণ করুণ করুণ। ‘
হৈচৈ পড়ে গেল। খোদেজা বলল,
‘ তুমি বাচ্চা মেয়েদুটোকে কোথায় পাঠিয়ে দিলে? খোদা এত অন্যায় সইবেন না। ‘
শাহানা ছুটে সদর কক্ষের বাইরে যেতে যেতে মুখ থুবড়ে পড়লো। কান্নায় ভেঙে পড়লো। তটিনী বলল,
‘ দয়া করো। আমার বোনদের ফিরে আনো। আমি তোমাকে নিকাহ করতে রাজী। ওদের কোনো ক্ষতি করো না। তোমার সৈন্যদের ফিরে আসতে বলো। ‘
শেরহাম পায়ের উপর পা তুলে বসে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে বলল,
‘ আগে নিকাহ। তারপর ওদের মুক্তি। রাজী না হলে তোমাকে জোর করে নিকাহ করতেই পারি। আমি কিন্তু অতটা অমানুষ না তাই শান্তিতে নিকাহ করতে চাইছি। রাজী? নাকি আদেশ দেব ওদের দুজনকে..
তটিনী না না করে বলল, ‘ আমি রাজী। ওদের কোনো বদনাম করো না দয়া করে । ওরা সইতে পারবে না। আমি রাজী। ‘
শেরহাম প্রসন্ন হেসে বলল,
‘ কাজীসাহেব মিয়াবিবি রাজী। নিকাহ পড়ানো শুরু করুন। এককাপড়ে নিকাহ হবে। এত রঙচঙের দরকার নেই। রঙচঙ করে একজনকে নিকাহ করতে চেয়েছিলাম সে আমাকে রঙচঙ দেখিয়ে পালিয়ে আমার ভাইকে নিকাহ করলো। এরও বিশ্বাস নেই। এক্ষুণি পড়ান। ‘
কাজী ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ জোরপূর্বক নিকাহ করা গুনাহ। ‘
শেরহাম ধমক দিয়ে বলল,
‘ যেটা বলেছি সেটা করুন। আপনার বকরবকর শুনতে এত পয়সা দিইনি। ‘
কাজী নিকাহ পড়ানো শুরু করলো। শেরহাম নিকাহ কবুল করলো। তটিনী ওর দিকে শক্তমুখে তাকালো তার গালবেয়ে গড়াচ্ছ স্বচ্ছ জলের নহর। জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর ঝড়ের মুখোমুখি তটিনী নিজেকে শক্ত রেখে কুপিত স্বরে বলল,
-‘কবুল, তোমার ছলনা, প্রতারণা আর বর্বরতা কবুল। তুমি আমার জীবনের সবচাইতে নিকৃ*ষ্ট, জঘ*ন্য, অপ্রিয় একটা মানুষ। ‘
শেরহাম ক্রুর দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ ভালোই। আমার ব্যাপারে নাক গলাবি তো লাতি দিয়ে বের করে দেব আমার মহল থেকে। ‘
তটিনী চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমার বোনদের ছেড়ে দাও। নইলে আমি মৃত্যুকে পরোয়া করব না। ‘
শেরহামের আদেশে শবনম আর আয়শাকে কাঁধে করে নিয়ে এল দুজন সৈন্য। মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। তারা অজ্ঞান নাকি কিছু হয়েছে তা বুঝতে পারলো না তটিনী। শাহানা চিৎকার করে কেঁদে ছুটে গেল তাদের কাছে। তটিনী শেরহামের দিকে তাকিয়ে গর্জে বলল,
‘ কি করেছ ওদের সাথে? কি হয়েছে ওদের?’
‘ ওরা তোর মতো নয় তাই ভয়ে মূর্ছা গেছে। নাকি মারা গেছে কে জানে? ইন্না-লিল্লাহ। ‘
তটিনীর চিৎকারে,আক্রোশে মহল কেঁপে উঠলো।
সায়রা আর সোহিনী ছুটে গিয়ে শবনম আর আয়শার হাতে পায়ে মালিশ করতে লাগলো। শেরহাম হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল মহল থেকে।
তটিনী বোনদের মাথার পাশে জড়পদার্থের মতো বসে রইলো।
এদিকে পলাশপুরের সেই বাসভবনে রূপার কোনো খোঁজ পেল না শেহজাদ। শেরহামের
সৈন্যদের সাথে পথিমধ্যে মুখোমুখি হয়ে গেল। দুজনকে আটক করা গেল। বাকিরা পালিয়ে গেল। আটককৃত সৈন্যরা জানালো অপরূপা তাদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। তারা চারপাশ থেকে বন্দি করেছিল। পেছনে নদী থাকায় অপরূপা আর পথ খুঁজে না পেয়ে নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে।
তারা বলা শেষ করতে পারলো না। শেহজাদ খাপ থেকে তলো*য়ার খুলে হা**মলা করতেই রক্ত ছলকে এসে র*ক্তে ছেয়ে গেল তার সারা মুখ, পোশাক। সাফায়াত আর তার সৈন্যরা হতভম্ব। তাদের মৃ**ত্যু ঘটতেই শেহজাদ প্রবল আক্রোশে হুংকার ছেড়ে তলো*য়ারটি ছুঁড়ে মারলো দূরে। রক্তে মাখা তলোয়ারটি সামনের বড় গাছটির ডালে গিয়ে গেঁথে গেল। তলো*য়ারটি হতে র*ক্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তে লাগলো মাটিতে।
চলবে….