#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
[কপি নিষিদ্ধ। শেয়ার দিতে পারেন ]
সালাম আব্বাজান। আপনার শরীর কেমন আছে?
দুটো চঞ্চল যুবতী মেয়ে ছুটে এল শাহজাহান সাহেবের কাছে। একজন দেখতে স্বাস্থ্যবান গায়ের রঙ উজ্জ্বল, অন্যজন লম্বাটে কিন্তু গায়ের রঙ শ্যামা। দুজনেরই চেহারায় অসম্ভব মায়া।
শাহজাহান সাহেব মেয়েদের মাথায় হাত রাখে।
আলহামদুলিল্লাহ। আমার কন্যারা ভালো আছে? মহলের সবাই কেমন আছে?
জ্বি আব্বাজান সকলেই ভালো আছেন।
কৌতূহলবিষ্ট চোখে অপরূপার দিকে তাকায় মেয়েদুটো। পায়ের আঙুল থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে আব্বাজানকে বলতে শুরু করে,
মা বেগম চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। মেয়েটির পরিচয় জানালে আমরা মা বেগমকে গিয়ে বলতে পারি।
কথাটা বলার সময় নাদুসনুদুস দেখতে মেয়েটি চোখ নত করে। শাহজাহান সাহেব উনার বেগমের পাগলামির কথা মনে করে হাসেন। অপরূপার দিকে তাকিয়ে বলে,
বড়ই অদ্ভুত। আমি তোমার নামটাই জানিনা। কি নাম তোমার?
অপরূপা।
রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে মেয়ে দুটি আবারও তাকায় তার দিকে।
ও অপরূপা। আজ থেকে তোমাদের সই। ও বিপদে পড়েছে। আমি তাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি। ওর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। ওর যত্নআত্তির করবে। ও আমাদের মেহমান।
মেয়েদুটির চেহারা এবার পরিষ্কার হয় । এতক্ষণে আঁধারে নিমজ্জিত ছিল। তাদের ঠোঁটে হাসি ফুটে।
শাহজাহান সাহেব এবার অপরূপার সাথে মেয়ে দুটোকে পরিচয় করিয়ে দেন।
অপরূপা এখানে আমার দুইকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। একজন নিজের কন্যা, অপরজন ভাইকন্যা।
অপরূপা জানতে পারলো লম্বাটে শ্যামলা মেয়েটির নাম সায়রা, নাদুসনুদুস ফর্সা খাটো মেয়েটির নাম সোহিনী। দু’জনের মাথার দু’পাশে বেণী করা। একই রঙের সেলোয়ার-কামিজ।
ও বধূসাজে কেন আব্বাজান? ওর কি আজকেই নিকাহ হয়েছে?
তাদের কন্ঠে কৌতূহল ঝড়ে পড়ে। অপরূপা দৃষ্টি নত করে। শাহজাহান সাহেব হেসে বলেন
ওর বর হারিয়ে গেছে। ওকে এসে নিয়ে যাবে। ততদিন ও তোমাদের সাথে থাকবে। ও খুব ক্লান্ত এবং আহত। ওর পায়ে রক্ত ঝড়ছে।
অপরূপা ওদের সাথে যাও। ভয় পেও না।
অপরূপা মাথা দোলায়। ডানে-বামে চোখ বুলাতে বুলাতে অন্দরমহলে প্রবেশ করে। মহলের ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখজোড়া আপনাআপনি তার আটকে গেল দেয়ালে । সোনালিরঙের কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে বিরাট বিরাট তৈলচিত্র। যুদ্ধ বিগ্রহের ছবি। বড়বড় রাজাদের সিংহাসনের ছবি। প্রবেশের সাথে সাথেই বিশাল বড় কক্ষটিতে বসার আসন। সভার আয়োজন করলে কয়েকশ মানুষ সেখানে অনায়াসে বসতে পারবে। সারি সারি কাষ্ঠাসন বসানো, সম্মুখে প্রকান্ড একটি সিংহাসনের আসনের মতো কেদারা রাখা। মাথার উপর কনকময় একটি দীপাধার।
চক্ষুদ্বয় খানিকটা উপরে তুলতেই দ্বিতল কামরাটির চ্বতরের পর্দা নড়ে উঠলো। কপাল অব্দি ঘোমটাপরা কয়েকজন মহিলা তৎক্ষনাৎ সরে গেল সেখান থেকে।
ছোট্ট একটা কাষ্ঠাসনে অপরূপা বসে থাকে। শাহাজাহান সাহেব এসে তার পাশে আরাম করে বসে। কপাল অব্দি ঘোমটা পড়া একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা এসে অপরূপার হাতে জলের গ্লাস দিয়ে অপরূপার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দ্রুত পরমগতি লাভ করে সেখান থেকে। অপরূপা ধীরগতিতে পানি খায় তারপর অস্থিরভাবে চোখ বুলায় চারপাশে।
আকস্মিক এক মহিলা ছুটে আসে অন্দরমহল থেকে। তার আগমন সবার লক্ষ না হলেও বিস্ময়ে সবাই হা হয়ে গেল । ক্রুদ্ধ হয়ে অপরূপার কবরীবন্ধ চুলে হাত দিয়ে টেনে ধরে ভয়ংকরভাবে চেঁচিয়ে উঠে বলল
আমার মহলে এসবের জায়গা হবে না। বুড়ো বয়সে আপনাকে ঢংয়ে ধরেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই নড়েচড়ে উঠতে ভুলে যায়। মহিলা অপরূপার চুল ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলে সদর দরজার চৌকাঠে। ঠোঁট ফেটে তাজা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় অপরূপার ওষ্ঠপুট। ক্রন্দনবিহীন কৌতূহল নিবিষ্ট চোখে চেয়ে থাকে অপরূপা। মাথার রগ দপদপ করছে চুলের গোঁড়ায়।
সায়রা এসে টেনে ধরে খোদেজাকে। বলে,
আম্মাজান কি করছেন? মেয়েটা আশ্রিত হয়ে এসেছে। আপনি যা ভাবছেন তা ভুল।
শাহজাহান সাহেব এবার হতবুদ্ধিভাব ছেড়ে এগিয়ে আসে। খোদেজার দিকে ক্ষেপা চোখে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল
বেগম একটা অসহায় মেয়ের উপর জুলুম করছো তুমি? কেন ওকে এভাবে আঘাত করলে? ও তোমার মেয়ের বয়সী।
খোদেজা মতিভ্রষ্ট হয়। ক্ষেপাটে চোখজোড়া তার শীতল হয়ে আসে। নিজ কন্যার বয়সী মেয়েটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার পর মনে হয় অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার পীড়িত বদনের দিকে তাকিয়ে নিজের উপর রাগ হয়। কিন্তু সরূপ প্রকাশ করে না। হনহনিয়ে ভেতরে গিয়ে গা ঢাকা দেয় সে।
সোহিনী গিয়ে অপরূপাকে তুলে। অপরূপা গায়ের ভর ছেড়ে দিয়ে কেঁদে উঠে উচ্চৈঃস্বরে।
কাবুলি পাঞ্জাবি পরিহিত একটা পাঁচ কি ছয় বছরের বাচ্চা এসে অপরূপার শাড়ি আঁকড়ে ধরে। জানতে চায়
সুন্দর বউ কাঁদছো কেন?
ধূসরবর্ণের শাড়ি পরিহিত একটা মহিলা এসে ধমক দিয়ে ছেলেটার হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে চলে যায়।
বাচ্চাটাকে দেখার পর পরই অপরূপার কান্না থেমে যায় কি এক অদৃশ্য ভোঁজবাজিতে। কার সাথে যেন খুব মিল পেল সে।
______________
স*ন্ত্রা*সদল পড়ছে যাত্রাপালায়। শিল্পীগুলা মঞ্চ ছাইড়া পলায়ছে। যেখানে যাকে পায়ছে সবার কাছ থেইকা টাকাপয়সা হাতায় নিছে। মেলা মাইনষের গায়ে চা*কু মারছে সাহেব। আমাগো সাহেব বাবুরেও মারছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা পাড়লো কালু মিয়া।
শাহজাহান সাহেব ও উনার বড় ভাই শেরতাজ সাহেব চিন্তিত বদনে বসে ছিলেন মহল চত্বরে। কালু মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলে ধপাস করে বসে পড়ে।
শাহজাহান সাহেব খেঁকিয়ে উঠে বলে,
কোথায় এখন সে?
তন্মধ্যে ধপধপ্ বিভ*ৎস পায়ের আওয়াজ আর ক্রন্দনের আওয়াজে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করলো সবাই। উনাদের পায়ের কাছে এসে হুমড়ে পড়লো একজন কালো বেঁটে মোটা কুদর্শন লোক। পড়নের কালো বোরকার মতো বস্ত্র। নাক ফেটে ইতোমধ্যে রক্ত ঝড়ছে।
আমারে মাফ কইরা দেন সাহেব। আমি পেটের ধান্দায় ওদের লগে যোগ দিছি।
পিঠের উপর ধরাম করে পরপর তিন-চার বার লাতি পড়তেই তার আর্তনাদে কেঁপে উঠলো গোঁটা সুলতান মহল। লাতি দিতে থাকা লোকটার গায়ের বাদামী রঙের পাঞ্জাবি। চোখেমুখে অসম্ভব হিংস্রতা। যেন এ যাত্রায় সে মেরেই ফেলবে স*ন্ত্রাস লোকটিকে।
দোতলার চত্বরে দাঁড়িয়ে গোটা দৃশ্যটি অবলোকন করে অপরূপা। তার বুক কাঁপতে থাকে। এ কোথায় এসে পড়েছে সে? এরা এতটা নির্মম কেন?
লোকটার আর্তনাদে অপরূপার কোমল হৃদয় কেঁদে উঠে। বুকে হাত রেখে মারতে থাকা লোকটার মুখপানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই লোকটার চোখ পড়ে তার দিকে। সাথে সাথেই সে আড়াল করে দাঁড়ায়।
চোখ সরিয়ে আবারও একেরপর এক লাতি দিতে থাকে লোকটা।
মার খাওয়া লোকটা যখন নিস্তেজ হয়ে পড়লো। আর কোনো শব্দ করলো না মুখ দিয়ে ঠিক তখনি সদর দরজা পার হয়ে হয়ে আসতে আসতে একটি নির্মল, সুধীর, শান্ত অথচ ক্রোধিত গমগমে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এল।
আহা থামো সাফায়াত। এভাবে মেরো না। এভাবে মারলে তো মরে যাবে। পালের গোদাকে খুঁজে বের করারা আগে জরুরি।
হালকা চালে হেঁটে আসা ঘর্ম ও র*ক্তভেজা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার কাঁধ বেয়ে তরল র*ক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে। ললাটের ডানপাশ ক্ষ*তবিক্ষ*ত। শ্বেত পাঞ্জাবি ধারণ করেছে র*ক্তের লাল রঙে।
শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেব উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়। শাহজাহান সাহেব দাঁড়িয়ে পড়ে। উৎকন্ঠিত গলায় জানতে চায়..
এসব কি শেহজাদ ?
আসসালামু আলাইকুম আব্বাজান।
পুত্রের হাতে হাত মিলিয়ে শাহজাহান সাহেব বলে উঠেন।
ওয়ালাইকুমুস সালাম পুত্র। কি করে হয়েছে এসব?
চিন্তিত হবেন না। বসুন। আগে বলুন আসার পথে আপনার কোনো অসুবিধে হয়নি তো?
না কোনো অসুবিধে হয়নি। কেন জিজ্ঞেস করছ?
পলাশপুরের দক্ষিণা ঘাটে ডাকাত হামলা হয়েছে বেলা দুটো ঘটিকার সময়। আপনি সেই পথেই আসছিলেন তাই জানতে চাইলাম।
কি বলো? আসার পথে তো শুনলাম না।
শুনবেন কি করে? পুলিশের হুশিয়ারিতে সবাই পালিয়েছে দলবল সহ। আমরা তখন বেশদূরে জাহাজে নিরাপদ অবস্থান রত ছিলাম। দূরবীন দ্বারা দেখছিলাম।
আর এ বল*দ কি করেছে?
গোঙাতে থাকা লোকটার দিকে দৃষ্টি পাত করে প্রশ্ন ছুঁড়ে শাহজাহান সাহেব। শেহজাদ বলে,
এরা ছিঁচকে ডা*কা*ত। যাত্রাপালে গিয়ে পয়সা হাতাচ্ছে আর না দিলে চা*কু মারছে। নারীশিল্পীর গায়ে চা*কু মেরে দিয়েছে। আমার সব পরিকল্পনা জলে গেল। কাল মঞ্চে তার কাজ ছিল। আমি এখন এই অল্প সময়টুকুর জন্য নারীশিল্পী কোথায় পাব?
বলা শেষ হতে না হতেই কাঁধের ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে অষ্ফুট শব্দ করে সে। সাফায়াত মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে বন্ধুর পাশে এসে বসে। স্বাভাবিক হয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
মহলে মনে হয় নতুন মেহমান এসেছে।
শেহজাদ কপাল ভাঁজ করে তাকায়। বলে,
সুলতান মহলে অতিথি আসবে যাবে এ আর নতুন কি?
চলবে……………