প্রিয় বালিকা পর্ব-৯+১০+১১+১২

0
404

#প্রিয়_বালিকা |৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

আভা বাকরুদ্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে খাতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আভার কোনো নড়চড় না দেখে ঢোক গিলল রৌদ্র।শক্ত কন্ঠে বলল,
– ওকে না নিলে সমস্যা নেই।আমি নিয়ে যাচ্ছি।

খাতাটা আভার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার আগেই আভা খাতাটি এক টানে কেঁড়ে নিলো।চমকে উঠলো রৌদ্র।পর পর কয়েকটা পলক ফেলে আবার ছোটো ঢোক গিলল সে।আভা খাতাটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে।ছাড়া ছাড়া বাংলা বর্ণে গণিতের খুঁটিনাটি সকলকিছু বিস্তারিতসহ লেখা। যুক্তবর্ণগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট।যুক্ত বর্ণগুলো দেখে মৃদু হাসে আভা।আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রৌদ্রও যুক্তবর্ণগুলোকে দেখে মুখ কালো করে বলল,
– এগুলো দেওয়া খুব কঠিন।তাও যেমন আছে তেমন আঁকানোর চেষ্টা করেছি।জানি খারাপ হয়েছে বাট আই থিংক তুমি বুঝতে পারবে।

আভা চোখ তুলে তাকালো ছেলেটির দিকে।তবে প্রতিবারের মতো দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলো না।দৃষ্টি সরিয়ে মাটিতে নিবদ্ধ করলো।চিকন স্বরে বলল,
– বাঙালি না হয়েও তো ভালোই বাংলা লিখেছেন।আমার হাতের লেখা তো এর থেকেও খারাপ।জানেন মৃণাল কান্তি দ্য অশান্তি স্যার কি বলে?আমি নাকি পরীক্ষার হলে তেলাপোকার পায়ে কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিই।

কথাটি বলে মুখে হাত দিয়ে আলতো হাসলো আভা।রৌদ্র আভাকে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা ম্যাথমেটিক্সে তুমি এতো কম পেলে কেন?ম্যাথমেটিক্স কি বুঝতে পারো না?

শীতল বাতাস বয়ে গেল আভার হৃদয়ে।আফসোসের সুরে বলল,
– জানেন এভাবে কেউ কখনো জানতে চায়নি কেন আমি এতো কম পাই?কেন আমি মাধ্যমিকে ওঠার পর থেকে গণিতে পাশ করতে পারিনি?যেখানে অন্যান্য সকল সাবজেক্টে আমি লেটার মার্ক নিয়ে আসি সেখানে গণিতে কেন আমি এতো কম পাই?সকলে শুধু দেখে আমি কম পাই!আমি ফেল করি!কেন করি কেউ জানতে চায়না।

ভিতর থেকে একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো আভার।রৌদ্র কিছু বলল না।ইচ্ছা করেই কোনো শব্দ খরচ করতে করলো না সে।মাঝে মাঝে শব্দ খরচ না করে নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্যেও এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে।আভা কিছুক্ষণ থেমে ভীত স্বরে বলল,
– আমি না বাসা থেকে সব অংক ঠিকঠাক মতো করে যাই।কিন্তু!

– কিন্তু?

– পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখার পর আমার মাথা আর কাজ করে না।সবকিছু কেমন যে গুলিয়ে যায়।মনে হয় সবকিছু আমার অজানা।আর এই জন্য আমি যেগুলো পারি সেগুলোও ভুল করে আসি।আবার অংক করলেও মাঝ পথে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায় আর শেষে উত্তর মেলে না।

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল আভা।রৌদ্র সূক্ষ্মভাবে পরখ করল তার বাচনভঙ্গি।চাহনি তার স্থির এবং শান্ত।কোনো অনুভূতি নেই এ চহনিতে।পলকহীন চাহনি চক্ষুগোচর হলো না আভার।হবে কিভাবে সে তো এই চাহনির ভয়েই দৃষ্টি নত করে রেখেছে।কখনো এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করার সাধ্য বোধহয় তার হবে না।অথবা এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করতে তাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে!
রৌদ্র গম্ভীর ও বিচক্ষণ কন্ঠে বলল,
– বুঝলাম।তুমি এক কাজ করবে, তুমি মানুষের সাথে মিশবে বেশি করে।বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলবে।তুমি যত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবে কথা বলবে ততই তুমি নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।এতে করে তোমার এই নার্ভাসনেসটাও কেঁটে যাবে।আর পড়ার সময় বেশি করে পানি খাবে।পানি খেলে ব্রেইনে অক্সিজেন সঞ্চলন ভালো হয়।যার ফলে ব্রেইন সবসময় সক্রিয় থাকে।ব্রেইন দ্রুত পড়াটা ক্যাচ করতে পারে।

আভা মুচকি হেসে বলল,
– ধন্যবাদ আপনাকে।

রৌদ্র এতক্ষণে আভার থেকে দৃষ্টি সরালো।মাথা নিচু করে ক্যাপ ঠিক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– ইটস্ ওকে।যাও স্কুলে দেরি হচ্ছে না?

সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আভা রওনা হলো স্কুলের পথে।সেদিকে অকারণেই পলকহীন চেয়ে রইলো রৌদ্র।হয়তো তার মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে তার নিয়ন্ত্রণে নেই।থাকলে হয়তো এভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের বাহিরে বেরিয়ে পলকহীন এই বালিকার দিকে চেয়ে থাকতো না।ব্যক্তিত্ব? ব্যক্তিত্বের কথা ভাবতেই থমকে যায় রৌদ্র।কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই এই দুহিতার সামনে সে তার নিজের কঠিন ব্যক্তিত্ব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন এক ব্যক্তিত্বের মাঝে যার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।

প্রসারিত ঠোঁটে হাতের খাতাটি উল্টেপাল্টে দেখছে আভা।হৃদয়ে তার শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে।তবে এই অনুভূতির সাথে সে পূর্বপরিচিত নয়।তাই অনুভূতিটি ঠিক সফলভাবে কাবু করতে পারছে না তাকে।তার পাশেই পূর্ণতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।আভা একমনে খাতাটি দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।বিরক্ত বোধ করলো পূর্ণতা একটানে আভার সামনে থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
– কি ব্যাপার বল তো তোর?

– কি আবার ব্যাপার হবে?

– অংকের ভয়ে অংক বইটাও কখনো খুলে বসে দেখিনি।এখন হঠাৎ এই অংকে ঠাঁসা খাতাটার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে এমন চোরা হাসি দিচ্ছিস কেন বল তো?

মুখ কালো করে ফেলল।আভা নিজেকে স্বাভাবিক করে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আরে কি বলিস না তুই খাতার দিকে তাকিয়ে চোরা হাসি দিবো কেন আমি?খাতা কি কোনো দেখার জিনিস হলো?নাকি ওটা আবার বর যে ওকে দেখে আমি লজ্জায় চোরা হাসি দিবো।

– আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে।

পূর্ণতার কথায় আভা বড় একটা হা করে অবিশ্বাস্য সুরে বলে উঠলো,
– মানে তোর মনে হচ্ছে ওটা আমার বর?

– খাতাটা তোর বর না কিন্তু মনে হচ্ছে খাতাটা দিয়েছে তোর বর।

থমকে গেল আভা।পাথরের মুর্তির মতো স্থির হয়ে গেল সে।খাতার মালিক তার বর?এও কি আদৌ সম্ভব? কল্পনাতেও এ দুর্লভ!কোথায় হাই ক্লাস সোসাইটির বিদেশি রৌদ্র! কোথায় গাঁও গ্রামের আভা!কোথায় আগুন আর কোথায় জল!না না এ ভাবলেও তার মস্তিষ্ক কলংকিত হবে!
আভাকে ঘোরের মধ্যে চলে যেতে দেখে পূর্ণতা একটি ধাক্কা দিলো।বলল,
– কি হয়েছে?হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলি?

আভা মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল,
– কি যে বলিস না তুই?তোর কথার আঁগা মাথা কিছু নেই।

আভা পূর্ণতার হাত থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।পূর্ণতা ভাবুক দৃষ্টিতে আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো,
– আমি আবার আঁগা মাথা ছাড়া কথা বললাম?

—————

– এই যে ক্যাপ ওয়ালা শুনো…

হঠাৎ এমন সম্বোধনে ভ্রু কুঁচকে এলো রৌদ্রের।পিছন ফিরে দেখল তার সামনে অভয়ের ছোট চাচার জমজ দুইজন দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো,
– আমাকে বলছো?

মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে বড়দের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– এখানে তুমি ছাড়া মাথায় ক্যাপ কে পড়ে আছে?আমরা?

রৌদ্র চোখের মণি উঁচিয়ে নিজের ক্যাপটি এক নজর দেখে থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি বলবে বলো।

মেয়েটি কোমর থেকে ডান হাত সরিয়ে রৌদ্রকে তর্জনির ইশারায় নিজের কাছে ডাকল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে রেখেই এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে এলো তার সামনে।রৌদ্র লম্বা হওয়ায় মেয়েটিকে ঘাড় তুলে কথা বলতে হচ্ছে।মেয়েটি সেই কষ্ট লাঘব করতেই রৌদ্রকে চোখ গরম দেখিয়ে মাথা নিচু করতে বলল।রৌদ্র হাঁটু ভেঙে তার সামনে বসলো।মেয়েটি কোনো কিছু না ভেবেই রৌদ্রের গালে হাত রাখল।রৌদ্র ভড়কে গেল অবাকও হলো কিছুটা।মেয়েটি রৌদ্রের গালে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল,
– তোমার গাল কত নরম।তোমার গালে চুল নেই কেন?তুমি কি কেটে ফেলেছ?

হাসলো রৌদ্র।মেয়েটির হাত নিজের হাতের ভিতর আবদ্ধ করে মিষ্টি হেসে আদুরে কন্ঠে বলল,
– নাম কি তোমার?

– মিন্নি।

রৌদ্র পাশে তাকিয়ে মিন্নির মতো দেখতে মেয়েটিকেও জিজ্ঞেস করল,
– তোমার নাম?

মেয়েটি একটু চুপচাপ স্বভাবের।বেশি কথা বলে না।এতক্ষণ সে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল।রৌদ্র নাম জিজ্ঞেস করায় গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– তিন্নি।

রৌদ্র দুজকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো।দু’জনে মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে না পেয়ে আহত স্বরে বলল,
– তোমরা তো দেখতে একদম একই।তাহলে আমি বুঝবো কি করে কোনটা মিন্নি আর কোনটা তিন্নি?

মিন্নি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– শোনো মনে রাখবে মিন্নি খুব চঞ্চল আর তিন্নি খুব শান্ত। তাহলেই তুমি আমাদের সহজেই চিন্তে পারবে বুঝেছ?

রৌদ্র উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।মিন্নি ভ্রু কুঁচকে রাগি ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি তো বললে না তোমার মুখে চুল নেই কেন?

রৌদ্র ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ঠোঁট মেলে মিষ্টি হাসি দিলো।আফসোসের সুরে টেনে বলল,
– দাড়ির স্বপ্ন তো আমারও আছে বোন।কিন্তু কি করবো আমি যেখানে থাকি সেখানের আবহাওয়ার কারণে আমার দাড়ি ওঠে না।তাছাড়া সেখানের খাদ্যভাস, আবহাওয়া,লাইফস্টাইলে সবকিছু আলাদা।যার জন্য আমার হরমোন সেভাবে ডেভেলপ হচ্ছে না।বুঝেছো?

– হরমোন কি?

রৌদ্র পড়লো বড় বিপাকে।এখন এই পাঁচ বছরের মেয়েটাকে সে কিভাবে বোঝাবে হরমোন কি?রৌদ্র সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো।আমতা আমতা করে বলল,
– হরমোন হলো দাড়ি ওঠার মেশিন।

– আচ্ছা।তাহলে আব্বুকে বলবো তোমাকে একটা হরমোন কিনে দিতে।তুমি কোথায় যাচ্ছো?

– আমি একটু হেঁটে আসি।

মিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে তিন্নির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।রৌদ্র সেদিকে চেয়ে মৃদু শব্দ করে হাসলো।বরাবরের মতোই ঠোঁটের দুইপাশে দেখা গেল ছোট্ট ছোট্ট দু’টো টোল।একদম ঠোঁট ঘেঁষে আছে তারা।পিছন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ।অনবরত সে শব্দ কানে আসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার।পিছন ফিরতেই দেখতে পেল সাইকেলে বসা ছোট চুলের মেয়েটি।রৌদ্র সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– এটা ঠিক করে দিয়েছে অভয়?

আভা কড়া কন্ঠে জবাব দিলো,
– ঠিক না করে দিলে ওর একটা হাড্ডিও আস্তো থাকতো?

আভার কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল রৌদ্রের।আজ কোণা চোখে সেই হাসি দেখার সাহস করলো আভা।তবে সেই চোরা দৃষ্টিও স্থির রাখতে পারলো না।গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে চড়ে বলল,
– আসুন আপনাকে গ্রাম দেখায়।

– এ কয়েকদিনে অনেকবারই গ্রাম চষে ফেলেছি।

– আজকে নাহয় আরেকবার দেখবেন।আপনার রিটার্ন গিফট এটা।চলে আসুন।

রৌদ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
– সাইকেলে?

– হ্যাঁ আসুন।

কি মনে করে রৌদ্র আর না করতে পারলো না।এগিয়ে গেল আভার পিছনের ছিটে বসার জন্য।ঠাট্টা করে বলল,
– তোমার ভাইয়ের মতো আবার আমাকে পঁচা ডোবায় ফেলে দিও না।

– যদি দিইও তাহলে কি আপনি আমাকে মারবেন?

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১০|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সাইকেল চালিয়ে বেশ অনেকটা পথ একসঙ্গে পাড়ি দিয়ে ফেলল আভা এবং রৌদ্র।গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সাইকেল।পিছনেই স্নিগ্ধ পুরুষটি মুগ্ধ নয়নে চারপাশ চোখ ঘুরিয়ে চলেছে।সজীব গাছপালায় ঘেরা “সুন্দরী” গ্রামের এক পাশ ঘেঁষে যে একটি ছোট্ট নদী বয়ে গিয়েছে তা সম্পর্কে অবগত ছিল না রৌদ্র।আভা নদীটির সামনে এসেই সাইকেল থামিয়ে দিলো।রৌদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
– নামুন।

রৌদ্র নেমে দাঁড়ালো। অবাক সুরে বলল,
– এখানে নদী আছে?

– হ্যাঁ “সুন্দরী” গ্রামের সৌন্দর্য্যের প্রাণকেন্দ্র এই “শ্যামা” নদী।

রৌদ্র নদীটি পূর্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।নদীর ডান পাশে অনেকটা দূরে ইটের ভাঁটা।প্রথমে লম্বা চওড়া পাইপ থেকে সাদা কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে রৌদ্র ধরতে পারল না সেখান থেকে ধোঁয়া কেন বের হচ্ছে।তাই সে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
– একি ওখানে কি আগুন লেগেছে?ধোঁয়া বের হচ্ছে কেন?ওয়েট ফায়ার সার্ভিসকে এক্ষুনি কল করছি।

রৌদ্র উদ্বিগ্নতার সহিত নিজের ফোন হাতে নিতেই ফিক করে হেসে ফেলল আভা।হাসতে হাসতে বলল,
– ওটা ইটের ভাঁটা।ওখানে ইট তৈরি করে তাই ধোঁয়া বের হচ্ছে।

রৌদ্র থেমে যায়।নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মুখ কালো হয়ে যায় তার।আভা তার উপর হাসছে দেখে আরো বেশি অপমানিত বোধ করে সে।আভা চোখের পাতা এক করে জোরে শ্বাস টেনে বলল,
– সুন্দরী গ্রামে এসেছেন আর শ্যামা নদী দেখবেন না?

রৌদ্র মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।নদীর কাণায় কাণায় জলের ছোঁয়া।বিশালাকৃতি নদীর উঁচু পাড়ের এক কোণায় বড় একটি বকুল গাছ।সে গাছটির দিকে এগিয়ে গেল আভা।বকুল গাছের নিচের মাটিটি বুকল ফুলের চাদরে ঢাকা।আভা সেখান থেকেই মুঠো ভর্তি ফুল নিয়ে এগিয়ে এলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুই হাত ভর্তি ফুল নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা মেয়েটির দিকে।আভা ইশারায় রৌদ্রকে হাত মেলতে বলল।রৌদ্র বুঝলো সে চোখের ভাষা।দুই হাত এক করে মেলে ধরলো আভার সামনে।রৌদ্রের হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো আভা।হাতে কোনো রেখা নেই!সম্পূর্ণ হাত টক টকে লাল বর্ণে।আভা মনে মনে ভাবলো লোকটা কি আলতা মেখেছে হাতে?ভাবনা কাটিয়ে নিজের হাতের ফুলগুলো রৌদ্রের হাতে দিয়ে দিলো।আবার রৌদ্রের হাত থেকে দু’টো ফুল তুলে নাকের সামনে ধরে মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
– আহ্ কি সুন্দর ঘ্রাণ!

রৌদ্র সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আভার ভাবভঙ্গি খেয়াল করল।আভাকে অনুসরণ করে নিজেও ফুলগুলো নাকের সামনে ধরল।সত্যিই এক অসম্ভব সুন্দর জাদুকরী ঘ্রাণ গ্রাস করে নিলো তার নাসারন্ধ্র। এতো সুন্দর সুবাস সে এর আগে কখনো শুঁকেছে কি না সন্দেহ।রৌদ্র পুলকিত স্বরে বলল,
– সত্যিই ঘ্রাণটা সুন্দর।কি ফুল এটা?

– বকুল ফুল।আমার খুব পছন্দ।

– আচ্ছা?

আভা চোখের ইশারায় সায় জানালো।সূর্যহীন আকাশ রক্তিম বর্ণে ছেয়ে গিয়েছে।আভা আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– দেখুন আকাশটা কি সুন্দর লাগছে।

রৌদ্র আভার কথা মতো আকাশ পানে চায়লো।সত্যি আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে সূর্য গলে গিয়ে সারা আকাশে রং ছড়িয়ে গিয়েছে।রৌদ্র নিজের ফোন বের করে আকাশের একটি ছবি ফ্রেম বন্দি করে নিলো।আরেকটা ছবি নিলো যেটাতে আভার পিছন পাশ আর আকাশটা দেখা গেল।দূর থেকে আযানের মধূর ধ্বনি শোনা গেল।সবাইকে আল্লাহর ইবাদত করতে আহ্বান করছে দ্বীন প্রচারে নিয়জিত ইমাম।মাগরিবের আযান পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে টনক নড়ে উঠলো আভার।মাথায় হাত দিকে ভয়ার্ত স্বরে বলল,
– হায় আল্লাহ আযান দিয়ে দিলো?এখন কি হবে?যেতে যেতে তো অন্ধকার হয়ে যাবে।

– আমার ফোনের চার্জও শেষ হয়ে আসছে।তাড়াতাড়ি চলো।সাইকেল কি আমি চালাবো?

– না না আমি পারবো।

– জোরে চালাতে পারবে তো?

আভা সাইকেলের স্ট্যান্ড উঠিয়ে সাইকেলে বসে পড়লো।রৌদ্র আগের বারের মতো পিছনে বসলো।পিছনে বসতে তার একটু কষ্ট হয় বটে।লম্বা মাটিতে বার বার ঘষা খায়।এতক্ষণ আভার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে হয়তো জোর খাঁটিয়ে তাকে পিছনে বসাতো।বা মাথা গরম করে দিতো কানের গোড়ায় দু’টো লাগিয়ে।কিন্তু কেন যে সে আজ ভিষণ শান্ত।কেন যেন আজ বারুদে আগুন লাগছে না!রৌদ্র হাতের ফুলগুলো তার দুই পকেটে পুরে ফেলল।সাইকেলে চালাতে শুরু করলো আভা।
– ওজন কত আপনার?

সহসা আভার এমন প্রশ্নে তৎক্ষণাৎ উত্তর করতে পারল না রৌদ্র।প্রশ্নটি মস্তিষ্কে ধরা দিতে বলল,
– ৭২।কেন?

– না মানে আপনাকে নিতে আমার সাইকেল চালাতে অনেক বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে।

– তুমি কি আমাকে মোটা বললে?

– কখন? না তো।একদম না।শুধু বলছি যে একটু কম কম খাওয়া দাওয়া করবেন।কিসে পড়েন আপনি?

– থার্ড সেমিস্টারের এক্সাম শেষ করে এসেছি।সামার ভ্যাকেশন চলছে।

– থার্ড সেমিস্টার মানে?

– ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কম্পিউটার সায়েন্স সেকেন্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টার।আর তিনটা সেমিস্টার হলেই গ্রাজুয়েট এরপর পোস্ট গ্রাজুয়েট তারপর পিএইচডি।

– ভাইয়া তো পিএইচডি করবে না মনে হয়।দেশে ফিরে আসবো।

– হতে পারে।আমি ঠিক জানি না।

– আপনাদের ইউনিভার্সিটির নাম যেন কি?

– দ্য ইউনিভার্সিটি ওফ সিডনি।আমরা আঞ্চলিক ভাষায় বলি ভার্সিটাস সিডনিসিস।

কথা বলতে বলতে রৌদ্র আনমনেই আভার নরম কাঁধে হাত রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হললো আভার শরীরে।গলা শুঁকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল।হাত পাসহ সম্পূর্ণ শরীর অনবরত থর থর করে কাঁপছে তার।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে সাইকেল চালালো।রৌদ্রের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো।সে হঠাৎ আভার এমন অদ্ভুতভাবে সাইকেল চালানোর কারণ বুঝতে পারল না।আভার শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হলো।শরীরের তাপমাত্রা হু হু করে বেড়ে গেল।আচমকা সে সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলসহ দু’জনেই মাটিতে পড়লো।রৌদ্রের চোখে বিস্ময় নেমে এলো।আভা আচমকা তাকে এভাবে ফেলে দিবে সে ভাবতেও পারিনি।সাইকেল কাঁত হয়ে পড়ার দুইজনই পায়ে এবং কনুইয়ে ব্যাথা পেল।আভার হাঁটুর চামড়া পিষে গেল।রৌদ্র তেমন গুরুতর ব্যাথা না পেলেও আভা বেশ ভালোই ব্যাথা পেল।হাঁটু ধরে মাটিতে বসে রইলো সে।রৌদ্র মাটি উঠে আভার কাছে এগিয়ে এলো।আতংকিত স্বরে বলে উঠলো,
– পা ভেঙেছে নাকি?

করুণ দৃষ্টি আভা মুখ তুলে রৌদ্রের পানে চায়লো।রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসছে।এই বিদ্রুপের হাসি আভার বুঝতে অসুবিধা হলোনা।রৌদ্রের হাতে থাকা ফোনটা অন করল।যেটা দিয়ে সে এতোক্ষণ আলো দিয়ে চলেছিল।কারণ আধার নেমেছে অনেক আগেই।রৌদ্র ক্যামেরা অন করে আভার একটা ছবি তুলে নিলো।এবারও আভার পারমিশন ছাড়া তার ছবি নিজের ফোনে সংরক্ষণ করলো রৌদ্র।ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে আভার হাতে দিয়ে বলল,
– এটা তুমি ধরে পিছনে বসো আমি চালাচ্ছি।এমন সময় এসে তুমি আমাকে ফেলে দিবে আমি ভাবিইনি।

আভা অনেক চেষ্টার পর মাটি থেকে উঠতে সক্ষম হলো।রৌদ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল।এতে আভার অবশ্য একটু সম্মানে আঘাত লাগলো।একটা মেয়ে পড়ে গেল।তাকে টেনে না তুলে ভ্যাবলার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার কি আছে সেটাই ঢুকলো না আভার ছোট মাথায়।আভা গোমড়া মুখে রৌদ্রের হাত থেকে ফোনটা টেনে নিলো।ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীন কি উচ্চারণ করলো বোঝা গেল না।রৌদ্র ঠোঁট একপাশে বাঁকিয়ে হেসে সাইকেলে উঠে পড়লো।কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করল তাড়া।বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল অভয় উদ্বেগ হয়ে কোথাও ছুটছে।রৌদ্রকে সাইকেল নিয়ে ঢুকতে দেখে উত্তেজিত স্বরে বলল,
– এই আভাকে দেখেছিস তুই?কত রাত হয়ে গেল আভার কোনো খবর নেই সেই আসরের আগে বেরিয়েছে।

আভা সাইকেল থেকে নেমে অভয়ের দৃষ্টির নাগালে দাঁড়াল।রৌদ্র ইশারায় বোঝালো,”এই যে তোমাদের আভা।” আভাকে দেখে রাগটা তির তির করে বেড়ে গেল অভয়ের।তেড়ে এসে বলল,
– পাখনা গজিয়েছে তোমার?এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে?

আভা অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে রইলো।রৌদ্র সাইকেল দাড় করিয়ে এগিয়ে এলো।অভয়কে আশ্বাস দিয়ে বলল,
– ভয় পাস না।আমি ছিলাম ওর সাথে।ও আমাকে নদী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।বেলা পড়ে যাওয়ায় একটু দেরি হলো।

অভয়ের দৃষ্টি পরিবর্তন হলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দু’জনের দিকে।সন্দিহান কন্ঠে বলল,
– তোরা একসাথে ছিলি?

আভা অভয়ের এমন কথার কারণ বুঝতে না পারলেও রৌদ্র বুঝতে পারলো। অভয়ের দৃষ্টি ভঙ্গি দেখে ভিষণ আশ্চর্য হলো।অভয় কঠিন সুরে আভাকে বলল,
– আভা ঘরে যা।

আভা নত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে একবার রৌদ্রের মুখ একবার অভয়ের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।হঠাৎ পরিবেশ এমন থমথমে হওয়ার কারণ তার ছোট মস্তিষ্ক ধরতে পারল না।রৌদ্র শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অভয়ের দিকে।আভাকে যেতে না দেখে অভয় এবার হুংকার ছাড়ল,
– ভিতরে যেতে বলেছি তোকে।

আভা কেঁপে উঠলো সে হুংকারে।শুঁকনো ঢোক গিলে ঘরে চলে গেল।ঘরে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে সবাইকে দেখা গেল চিন্তিত ভঙ্গিতে।আভা ঘরে প্রবেশ করতেই বিভিন্ন প্রশ্ন জুড়ে দিলো তারা।সে এতক্ষণ কোথায় ছিলো?কেন এতো দেরি হলো?সবপ্রশ্নের উত্তর নিজের মনে মতো সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে।অভয়ের হঠাৎ এমন গম্ভীর স্বরে তাকে ধমক দেওয়া কেন যপন হৃদয়ে পিড়া দিতে থাকলো তাকে।হঠাৎ এভাবে রেগেই বা গেল কেন সে?

রৌদ্র নিজের শিকারী চোখের শান্ত দৃষ্টি অভয়ে স্থির রেখেছে।আভা চলে যেতেই অভয় কয়েক কদম এগিয়ে এলো।রৌদ্রের কাধে হাত দিয়ে ভারি কন্ঠে বলল,
– দেখ রৌদ্র আভা এখনো অনেক ছোট।বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।আর না ধারণা আছে বাস্তবতা সম্পর্কে।তাই আমি চাইনা ওর মধ্যে এমন কোনো অনুভূতির জন্ম নিক যাতে ওর সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে যাক।তাছাড়া আমি আমাদের বন্ধুত্বটাও শেষ অবধি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

রৌদ্র এখন একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বুকে হাত গুঁজে হিম কন্ঠে বলল,
– কি এমন দেখে নিলি তুই?যেটা দেখে তোর মনে হলো আভার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে।আমাদের বন্ধত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে।কি এমন দেখলি?আমাকেও একটু বল আমি তো এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

অভয় দমে গেল।সত্যিই সে এমন কিছুই দেখেনি যাতে তার মনে এই কথাগুলো আসবে।তবু কেন যেন এতো রাত পর্যন্ত আভা আর রৌদ্রের একসাথে বাইরে নদীর পাড়ে থাকাটা খুব একটা ভালো লাগেনি তার।অভয় আমতা আমতা করে বলল,
– ম মানে তোরা এতোক্ষণ একা একা বাইরে।তাই মনে হলো কথাগুলো আমার বলা উচিত।তুই প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না।

– শোন অভয় আভা ছোট হলেও আমি ছোট নই।আর তাছাড়া আজকে এমন কিছুই হয়নি যার জন্য তুই আমাকে এই কথাগুলো শোনাবি।আমার দিক থেকে এমন কিছুই যে ঘটবে না তা তোর বোঝা উচিত ছিল।বাট এলাস্!আমাকে নিয়ে তোর বিশ্বাস ভরসা আসলে কতটুকু তার ছোট্ট একটা হিন্টস পেলাম আমি।

রৌদ্র আর দাঁড়াল না।চলে গেল ভিতরে।অভয় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।আজ সে নিজের অজান্তেই নিজের বন্ধুকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।রৌদ্র কষ্ট পেলে কখনো প্রকাশ করে না।সবসময় নিজের মধ্যে অনুভূতি গুলোকে দুমড়েমুচড়ে পিষে ফেলে।যার জন্য বন্ধুমহলে তাকে ইমোশনলেসও বলা হয়ে থাকে।কিন্তু একমাত্র অভয়ই বুঝতে পারে।কখন রৌদ্রের মন খারাপ থাকে আর কখন মন ভালো থাকে।

চলবে…

#প্রিয়_বালিকা |১১+১২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সকালের নাস্তা শেষে বাড়ির বড়দের দেখা গেল বসার ঘরে নকশাকৃত সোফায়।শুধু সেখানে উপস্থিত নেই বাড়ির মেঝো ছেলে এবং তার বউ।তিন্নি মিন্নি বড় বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি করে কিসব খেলছে।আইরিন তাদের খাবার হাতে সোফার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে।তিন্নি এবং মিন্নি দৌড়ে এক গলা খাবার নিয়ে আবার নিজেদের আবিষ্কৃত খেলায় মেতে উঠছে।আজ শুক্রবার।তাই সকলে বাড়িতে রয়েছেন।আরাভ মুন্সি গ্রামের পোস্ট অফিসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।ছোট ভাই আহান পুলিশ।অর্থ উপার্জনের দিক থেকে সবার থেকে এগিয়ে আছেন মুন্সি বাড়ির মেঝো ছেলে আহাদ মুন্সি।বিয়ের সময় শ্বশুরের দেওয়া উপহারের টাকা দিয়ে সে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন।সেখান থেকে লাভবান হয়ে মুনাফার টাকায় তার ব্যবসার ক্ষুদ্র একটি অংশ তিনি শহরে স্থানান্তরিত করেন।সে থেকেই তাকে আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি।টাকার মুখ দেখে তার অংহকারের ঝুলি খোলেনি এমন নয়।
আহাদ মুন্সিকে দেখা গেল বসার ঘরে প্রবেশ করতে।পিছনে তার বউ রূপাও আছে।সে অনবরত আহাদ সাহেবকে কিছু বলার জন্য ইশারা করে যাচ্ছেন। আহাদ সাহেব সংকোচ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন বড় ভাই আরাভ মুন্সির সামনে।দৃষ্টি নত রেখে কাচুমাচু মুখ করে নিচু স্বরে বললেন,
– ভাইয়া কাল আমরা চলে যাচ্ছি।

আরাভ সাহেব কথাটা যেন তেমন গায়ে মাখলেন না।তিনি তার মতো থেকে উত্তর দেয়,
– শুভকামনা রইল তোর জন্য।

– ভাইয়া একটা কথা বলার ছিল।

ভ্রু কুটি করে ফেললেন আরাভ মুন্সি।খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি ফেললেন।বসার ঘরের সকলের দৃষ্টিই এখন আহাদ মুন্সির দিকে।আরাভ মুন্সি বলে,
– হ্যাঁ বল কি বলবি?কোনো সমস্যা?

আহাদ মুন্সি কাচুমাচু ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
– আসলে ভাইয়া মানে বলছিলাম।এভাবে তো আর সব সময় একসাথে থাকা যায় না।আমার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে তোমারও বড় হচ্ছে।ছোটোর দু’টো মেয়েও দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে।তাই বলছিলাম জায়গা জমি যা আছে সব ভাগ বাটওয়ারা করে যে যা পাবে তাকে তাই দিলে ভালো হয় না?

থমকে গেলন আরাভ সাহেব।এইদিনটার মুখোমুখি তাকে হতে হবে তা সম্পর্কে সে অবগত ছিলেন তবে এতো তাড়াতাড়ি? আরাভ সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেলে শূণ্য অনুভুতিতে বলে উঠলেন,
– দেখ আহাদ মা এখনো বেঁচে আছে।নিথর শরীরটায় এখনো শ্বাস প্রশ্বাস চলছে।মা পৃথিবীতে থাকতে এই কাজটা আমায় করতে বলিস না দয়া করে!

আরাভের কথা পছন্দ হলো না আহাদ এবং রূপার।আহাদ তবু নিজের অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখলেও চেপে রাখতে পারলো না রূপা।তেজি কিন্তু নিচু স্বরে বলে উঠলেন,
– এটা কেমন কথা বললেন ভাইয়া।এখন মা দেড় মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছে।আর কতদিন থাকবে আমরা কেউ জানিনা।আপনি তো জানেনই শহরে ব্যবসা নেওয়ার পর ওর কত লোকসান গুণতে হয়েছে।তাহলে আপনি এই কথাটা বললেন কিভাবে?

আহাদ নিজের বউকে ধমক দিয়ে নিচু স্বরে বললেন,
– আহ্ রূপা তোমাকে এখানে কথা বলতে কে বলেছে?আমি তো ভাইয়ার সাথে কথা বলছি।তুমি ঘরে যাও।

রূপ দমলো না বরং দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত হয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
– তুমি চুপ করো।এখন তোমার মায়ের জন্য কি আমরা পথে বসবো?

আহাদ চোখ গরম করে তাকালেন নিজের বউয়ের দিকে।তবে সে দৃষ্টিতে কাজ হলো না।রূপা মুখ ভেঙচি দিয়ে সে দৃষ্টি খুব সহজেই উপেক্ষা করে গেলেন।আরাভ সাহেব গুম হয়ে বসে আছেন।আহাদ আমতা আমতা করে বলে,
– ভাইয়া জানোই তো গতমাসে কত লস হয়েছে।তাই এখন আমার টাকা খুব জরুরি সূর্যের পড়াশোনার খরচ আবার সেহরিনের খরচ তাই বলছি কি যার যার ভাগ তাকে দিয়ে দাও আর মা যতদিন আছে ততদিন নাহয় আমরা ভাগ করে দেখবো।

আরাভ শান্ত স্বরে বললেন,
– জায়গা বিক্রি করবি?

করুন স্বরে জবাজব দিলেন আহাদ,
– ভাইয়া টাকাটা আমার এই মুহুর্তে খুব প্রয়োজন।

আরাভের ভিতর থেকে আরো একটি তপ্ত শ্বাস নির্গত হলো।তার সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের চিত্র। যেদিন তার মা তার হাত ধরে করুণ স্বরে বলেছিলেন,”বাপ!আমি কারো ভাগের মা হতে চাই না।তাই আমি যতদিন বেঁচে আছি তোরা কেউ আমাকে ভাগে দেখার কথা ভাবিস না।না পারলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিস তবু আমাকে ভাগের মা বানাস না।”
সেদিন মায়ে এমন করুণ স্বরে বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে না পারলেও আজ সে ঠিকই বুঝতে পারছে তার মা কেন তার হাত জরিয়ে এ কথা বলেছিলেন।
মুহুর্তেই কঠিন শিলার মতো হয়ে গেলেন আরাভ সাহেব।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
– মা যতদিন এই পৃথিবীতে আছেন ততদিন তোদের অপেক্ষা করতেই হবে।আমার মা কোনোদিনও ভাগে মা হবে না।

আচমকা আহাদের রাগটাও যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলল।সেও চোয়াল শক্ত করে ভাইয়ের দিকে তর্জনি তুলে উচ্চস্বরে বললেন,
– এই সব তোমার বাহানা।আমি বুঝিনা ভেবেছ?সব একা ভোগ করবে বলে তোমার দিনের পর দিন যত বাহানা।

চমিকত হলেন আরাভ সাহেব।প্রেমা অসহায় স্বরে বললেন,
– এসব তুমি কি বলছো ভাই?তোমার ভাইকে তোমার এমন মনে হয়?লোকটা নিজের সব আয় উপার্জন নিজের কথা না ভেবে এই সংসারে দেয়।যাতে সকলে একটা ভালো জীবন কাটাতে পারে।নিজের জীবনে শত আফসোস থাকার পরও সে চায় তোমাদের কারো জীবনে কোনো আফসোস না থাকে।তাকে তুমি এ কথাটা কিভাবে বলতে পারলে ভাই?

আহাদ প্রেমার কথার উত্তর দিলো না।দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
– আমি আমার ভাগ চাই ব্যাস!আমাকে আমার ভাগ বুঝিয়ে দিতে হবে না হলে আমি কোর্টে যাবো।

বাড়িতে প্রবেশ করল অভয়।বাড়িতে প্রবেশ করতেই বসার ঘরে মেঝো চাচাকে নিজের বাবার উপর এভাবে চিল্লাতে দেখে দুম করে মাথা গরম হয়ে গেল তার।ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি হয়েছে এখানে?

তবে তার কথারও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।আরাভ সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে আহাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
– নিজেকে সংযত কর।

আহাদ যেন আরো চটে গেলেন।রাগে ক্ষোভে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললেন,
– সংযত তুমি থাকতে দিচ্ছো না ভাইয়া তোমার সব জারিজুরি আমি ধরে ফেলেছি।কিন্তু কি বলো তো তোমার এসব জারিজুরিতে কোনো কাজ হবে না।আমার ভাগ তো আমি আদায় করেই ছাড়বো।তাতে আমাকে যদি তোমাকে জেলেও পাঠাতে হয় তাও করবো আমি।

ভাইয়ের মুখে এমন উক্তি শুনে কন্ঠ নালি শক্ত হয়ে গেল আরাভের।হতভম্ব হয়ে সে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।এ কি তার ভাই?সেই ছোট ভাইটা?যাকে সে নিজের পাত থেকে খাবার তুলে খাইয়েছে?নাহ্!এ তো সে নয়!চাচা কন্ঠে এমন কথা শুনে রক্ত গরম হয়ে গেল অভয়ের।সেও কিছুটা উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
– চাচা কিভাবে কথা বলছেন আপনি বাবার সাথে?ভুলে যাচ্ছেন সে আপনার বড় ভাই?

আরাভ কঠিন স্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– অভয় ঘরে যা।

– বাবা এটা কিভাবে কথা বলছে উনি তোমার সাথে?

– এখান থেকে যা অভয়।

রাগে ফোঁস ফোঁস করে সিঙ্গেল সোফায় একটি লাথি দিলো অভয়।সঙ্গে সঙ্গে সোফাটি উল্টে পড়লো। আবারও বেরিয়ে গেল সে।আরাভ লাল লাল চোখে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন,
– সম্পত্তি চাস না?তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাটিতে মায়ের মৃত্যু কামনা কর।

উপস্থিত সকলে কেঁপে উঠলো আরাভের এমন কঠিন ভাষায়।বসার ঘর প্রস্থান করলেন আরাভ মুন্সি।জীবনে অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে।তবে এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন তা বুঝতে পারেননি।এই শেষ বয়সে তাকে আর কোন কোন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হবে তা নিয়ে শঙ্কিত আরাভ মুন্সি।

—————
উদাস মনে পুকুর পাড়ে বসে আছে রৌদ্র।একা একাই বসে আছে।গতকাল রাত থেকে অভয়ের সাথে দেখা করেনি সে।আর না কথা বলেছে।কি এক অজানা বেদনা তার সর্বাঙ্গ বশ করে নিয়েছে।নিজেকে কোনো এক অন্ধকারের লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে তার।যেখানে তাকে কেউ দেখবেনা।ফোঁস করে একটি শ্বাস ফেলল রৌদ্র।ভোঁতা মুখে রৌদ্রের পাশে এসে দাঁড়াল অভয়।রৌদ্র মুখ তুলে একপলক দেখে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে পুকুরের পানিতে রাখল।অভয় করুণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে রইলো।তারপর দপ করে রৌদ্রের পাশে বসে পড়ে সে।রৌদ্র দৃষ্টি পানিতে রেখেই বলল,
– কি হয়েছে তোর?

– ভালো লাগছে না আমার আর এই বাড়িতে।সামনের সপ্তাহের ফ্লাইটের টিকিট না কাটলে আজকেই এমার্জেন্সি ফ্লাইট ধরে চলে যেতাম।

– কেন কি হয়েছে?

– মেঝো চাচা বাড়িতে অশান্তি শুরু করেছে।

রৌদ্র আর কোনো কথা বলল না।পারিবারিক বিষয়ে তার কথা না বলাটাই ভালো।তাই সে চুপ থাকে।অভয় আহত স্বরে বলে,
– ভাব তো একটা মানুষের মৃত্যু কামনায় সবাই তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!মানুষ কতটা নিকৃষ্ট প্রাণী।

দীর্ঘ শ্বাস পড়লো রৌদ্রের।আসলেই মানুষ খুব নিষ্ঠুর।তাই সে অভয়ের এই উক্তির সাথে একদম একমত।রৌদ্র হাত ঘুরিয়ে অভয়ের কাঁধ চেপে ধরলো।শান্তনার সুরে বলল,
– থাক মন খারাপ করিস না।তোকে গোমড়া মুখে একদম ভালো লাগে না।হাস তো এবার! নাকি এখন তোকে হাসানোর জন্য তোর বড়কে ভাড়া করে আনতে হবে?

– উফ্ বউয়ের কথা বলে তো তুই কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিলি।কি জানি সে এখন কোথায়?

– মরছে মনে হয়!

অভয় এক ধাক্কায় রৌদ্রকে দূরে সরিয়ে দিলো।রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসে।রাগি দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলে,
– গোবর পরুক তোর মুখে।বউ মরুক তোর।আমার বউকে নিজে একটা বাজে কথা বলবি তোকে পুকুরের মধ্যে আটাশ বছর চুবিয়ে রাখবো।

– আহা!এই না হলে মহব্বত!

– চুপ আমার বউকে মরা বলিস?তোর ঘাড় মটকে তোর বউকে বিধবা করে দিবো।

– ছেহ্!মেয়ে মানুষের মতো ঝগড়া করছিস অভয়?থাম এবার।

কটমট চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো অভয়।রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে মিষ্টি হাসি দিলো।জাগ্রত হলো ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে থাকা দু’টি সূক্ষ্ণ ভাঁজ।অভয় আঁড়চোখে রৌদ্রকে দেখে হাঁসফাঁস করছে কিছু বলবে হয় তো।রৌদ্র এক ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে রইলো অভয়ের দিকে।অভয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– চল রৌদ্র তোকে ট্রিট দিবো।

চোখ কপালে উঠলে গেল রৌদ্রের।এ কথা কে বলছে?অভয়?রৌদ্র অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
– অভয় তুই বলছিস এই কথা?তুই?আজ পর্যন্ত এককাপ কফি খাওয়ালি না নিজের টাকা দিয়ে।সেই তুই আজকে ট্রিট দিতে চাইছিস?

– আরে চল না আমার সাথে।আর তোকে না সিডনি থাকতে কফি খাইয়েছি?মিথ্যা বললি কেন?

– ওটা তো কথার কথা বলেছি।

– হয়েছে এবার চল আমার সাথে।

অভয় রৌদ্রকে নিয়ে বাড়ি চলে এলো।দু’জনের গায়ে ক্রিম কালারের নকশা করা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা।রৌদ্র পরতে না চায়লেও অভয়ের জোরাজুরিতে তাকে বাধ্য হয়েই এই পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে।লম্বা মসৃণ চুলগুলো আজ কপাল জুড়ে নেই বরং উল্টিয়ে আঁচড়ানো।কপালের উপর চুলগুলো থাকায় রৌদ্রের বয়স অনেকাংশ কম লাগে।আজ রৌদ্রকে যেন পরিপূর্ণ যুবকের ন্যায় লাগছে।নিজেকে নিজে আয়নায় দেখে অবাক হলো রৌদ্র।সামন্য শীতল হাওয়াও বয়ে গেল হৃদয় জুড়ে।খারাপ লাগছে না দেখতে।বরং মনোমুগ্ধকর লাগছে তাকে দেখতে।পাশেই আরেক সুদর্শন যুবক অভয় দাঁড়িয়ে।উজ্জল শ্যামবর্ণের অভয়ের গায়েও রৌদ্রের মতো ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি।চুলগুলো একপাশে ফেলে রেখেছে। মুখমণ্ডলের নিখুঁত কাটই তার সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র।চাপা চোয়াল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।রৌদ্র আয়না দিয়েই অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এগুলো পরালি কেন?

অভয়ের সোজাসাপটা জবাব,
– একসাথে জুম্মার নামাজ পড়তে যাবো।

– ট্রিট দিবি বললি যে..

– দিবো তো আগে জুম্মার নামাজ পড়বো তারপর ট্রিট।

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অভয় রৌদ্রের কাঁধে হাত দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
– শোন রৌদ্র আগে যা করেছিস করেছিস।এখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে দ্বীনের পথে আয়।আর কখনো এসব গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড রেন্টে নিস না এগুলো পাপ।

কেন যেন অভয়ের কথাটা ভালো লাগলো রৌদ্রের।হৃদয় নরম হয়ে গেল তার।মুচকি হেসে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অভয়ও হেসে আলিঙ্গন করলো প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে।ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই ঘরে প্রবেশ করল আভা।অভয়কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল সে,
– ভাইয়া! ভাইয়া!

সামনে চোখ রাখতে থমকে গেল আভা।রৌদ্রকে পাঞ্জাবিতে দেখে চোখ বেরিয়ে এলো তার।ঠোঁট দু’টো ফাঁক হয়ে গেল।পলক থমকে গেল তার।নিশ্বাস থেমে গেল।আভাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থমকে যেতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রৌদ্র।ব্যাক্তিত্ব সংকটে ভুগলো।গলা ঝেড়ে অভয়ের পিঠে আলতো আঘাত করে বলল,
– আমি বাইরে ওয়েট করছি।

অভয় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।আভার নাকে ভেসে এলো অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধ।এটা তো সেই আতরের গন্ধ যেটা সে অভয়কে ঈদের সময় দিয়েছিল।বাবকেও একটা দিয়েছিল।অভয় এগিয়ে এসে আভার সামনে তুড়ি বাজালো।কেঁপে উঠলো আভা।অভয় ভ্রুকুটি করে বলল,
– এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?মনে হচ্ছে কোনো ভয়ংকর ভুত দেখে ফেলেছিস!কি বলবি বল…

আভা ঘোর থেকে বেরিয়ে বলল,
– আম্মু অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছিল না তাই আমাকে বলল একবার তোমাকে দেখে আসতে।কিছু লাগবে কিনা তোমার বা তোমার বন্ধুর।

– না কিছু লাগবে না।আমরা এখন বাইরে যাচ্ছি।

– কোথায় যাচ্ছো?

– মসজিদে নামাজ পড়তে যাবি?

– আমি কেন মসজিদে যাবো?

– তাহলে ভাগ এখান থেকে।

দৌড়ে বেরিয়ে এলো আভা।ডান হাতটা তার বুক চেপে আছে।হৃৎপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে পাঁজরের সাথে বারি খাচ্ছে। কখন না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।শ্বাস আঁটকে আসছে।এমন হচ্ছে কেন বুঝতে পারল না আভা।নিশ্চয়ই তার বড় কোনো রোগে আক্রমণ করেছে।না হলো একজন সামান্য পুরুষ মানুষকে দেখে তার এমন মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে কেন?পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো সে সকাল থেকে কিছু খায়নি।যাক শান্তনার একটা জায়গা খুঁজে পেল।তাহলে অন্যকোনো গন্ডগোল নেই।আভা দৌড়ে গেল রসুইঘরে।ফ্রিজ থেকে শুঁকানো কিছু খাবার পটাপট মুখে দিয়ে দিলো।চোখগুলো এখনো তার বেরিয়ে আছে।মুখভর্তি খাবার নিয়ে রসুইঘর থেকে বের হতেই আবার মুখোমুখি হলো সেই ভয়ংকর সুর্দশন যুবকের।বড় বড় চোখ আরো বড় হয়ে গেল তার।তড়িঘড়ি দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।রৌদ্র আভার যাওয়ার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বলল,
– কি ব্যাপার? আমাকে কি দেখতে এতোই খারাপ লাগছে যে আমাকে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেল মেয়েটা।স্ট্রেঞ্জ!

মসজিদে নামাজ শেষে সকলের সামনে একটি করে থালা দিয়ে গেল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে থালার দিকে।অভয় দাঁত বেরিয়ে হেসে রসিয়ে রসিয়ে বলল,
– ট্রিট আসছে।

চট করে রৌদ্র বিস্ময় কন্ঠে বলল,
– হোয়াট?

অভয় রৌদ্রের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– আরে আজকে মসজিদে তেহারি দিবে।সেই জন্যই তো তোকে নিয়ে এলাম।

রৌদ্র বড় বড়সড় ধাক্কা খেল।কিছুটা আওয়াজ করেই বলল,
– হোয়াট?

– হোয়াট হোয়াট পরে করিস এখন তেহারি খা।আহ্ কি সুন্দর ঘ্রাণ।পাচ্ছিস?পাচ্ছিস? আমি তো নামাজে দাঁড়িয়েও পাচ্ছিলাম।

রৌদ্র রক্তিম চোখে তাকিয়ে রইলো অভয়ের দিকে।অভয়ের ভাবগতি পরিবর্তন হলো না।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিষয়টায় খুব মজা পাচ্ছে।রৌদ্র দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল,
– ইউ ইডিয়ট।এটা তোর ট্রিট?

অভয় দাঁত বেরিয়ে হাসল।সে খুব মজা পাচ্ছে রৌদ্রের এমন চেহারায়।মুহূর্তেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল,
– তো এর থেকে আর ভালো ট্রিট হয়?তাছাড়া সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা উচিত।সব মুসল্লীদের সাথে বসে একসাথে বসে একবেলা আহার করলে কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না বুঝলি।

– এখানে ক্ষতি হওয়ার কথা বলছিনা আমি।তুই মিথ্যা কেন বললি আমাকে স্টুপিড।

– আরে মিথ্যা বলবো কেন? আমি খবর দিয়েছি মানে আমি ট্রিট দিয়েছি।এখন কথা কম বলে খা তো।

অভয় খেল পেট পুরে।কিন্তু রৌদ্র খেতে পারলো না।একে তো এতো মানুষ তার উপর হাত দিয়ে খাবার খাওয়া।তাই সে উঠে চলে এলো।মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল অভয়ের জন্য।

—————
ভোর পাঁচটা।কেউবা গভীর ঘুমে মগ্ন।কেউবা আল্লাহর ইবাদাতে।আবার কারো চোখে এখনো ঘুমই ধরা দেয়নি।
আভার চোখে ঘুম নেই।একের পর এক অংক করে যাচ্ছে সে।রাত জেগে অংক করাটা এখন তার নেশায় পরিনত হয়েছে।প্রতিদিন একবার করে রৌদ্রের লেখা অংক খাতা না খুললে তার ভালো লাগে না।এখন আর অংকের প্রতি তার অনিহা বোধ নেই।বরং বেশ উৎসাহ নিয়েই সে অংক করে।ভালো লাগে।আজও রাত জেগে অংক করে চলেছে সে।এবার হয়তো সে ফেল ঠেকাতে সক্ষম হবে।পাশেই পানির বোতল।অংক করতে করতে যখন ক্লান্তি অনুভব করে তখন গলা ভিজিয়ে নেয় সে।আবারো ফিরে পায় স্পৃহা।আজ যেন একটু বেশিই রাত হলো।কোনো এক অজানা কারণে হৃদয়ে ক্ষত হচ্ছে তার।কারণটা যে একদম অজানা তা নয়।সকাল হলেই রৌদ্র এবং অভয় সিডনির জন্য রওনা হবে।হয়তো এই কারণেই তার হৃদয়টা ভারি।কিন্তু তা মানতে নারাজ আভা।

সকাল সকাল সারাবাড়িতে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়।বাড়ির ছেলে আবার বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে।সকলের মন ভার।অভয় এবং রৌদ্র তৈরি হয়েই নিচে নামে।অভয় নিজের দাদিকে এক পলক দেখে আসে।দাদির কপালে অধর ছোঁয়াতে ভোলে না সে।দাদির নিথর দেহের দিকে চেয়ে টুপ করে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।সবার অজান্তেই সে জল মুছে নেয় অভয়।এয়ারপোর্টে তাদের ছাড়তে যাচ্ছে আরাভ এবং আভা।আভা অনেকটা জোর করেই যাচ্ছে। সারারাত না ঘুমিয়ে চোখ লাল হয়ে আছে তার।রৌদ্রের মুখটাও কেমন ভার হয়ে আছে।মাথার ক্যাপটা দিয়ে নিজের লাল চোখগুলো ডাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।হয়তো সেও পাড় করেছে এক নির্ঘুম রাত্রি।

এয়ারপোর্টে গাড়ি থামতেই হৃৎপিণ্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় আভার।চোখ ভরে আসে বার বার।বুকটায় কেউ হাজার টনের পাথর বোঝায় হয়ে আছে।আসার পথে একটি কথাও বলেনি রৌদ্র।থম মেরে জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থির রাখে সে।ভাড়া করা মাইক্রোবাসটা থেকে নেমে এলো সবাই।আরাভ সাহেব উত্তেজিত স্বরে বললেন,
– আব্বু তুই একটু দাঁড়া আমি কিছু কিনে নিয়ে আসি।সকালে তো কিছুই খেলিনা।

রৌদ্র এতক্ষণে মুখ খুলল,
– আঙ্কেল দরকার নেই ফ্লাইটে খাবার দিবে।

– আরে আব্বু তা তো দিবে এখান থেকেও কিছু দিয়ে যাও।আমার দিতে মন চাইছে তোমরা দিবেনা আব্বু?

– আব আচ্ছা আঙ্কেল।

আরাভ চলে গেলেন ছেলেদের জন্য কিছু কিনে আনতে।অভয় রৌদ্রকে বলল,
– তুই সুটকেসগুলো দেখে রাখ আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।

– আচ্ছা।

সবার পিছনে মাথা গুঁজে দাড়িয়ে ছিল আভা।সকলে চলে যেতেই রৌদ্রের চোখে পড়লো সে।ফোঁস করে একটি শ্বাস ছাড়লো সে।কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল।রৌদ্রের অনুভূতিগুলো গলায় দলা বেঁধে রয়েছে।সে কিছু বলতে গিয়েও বার বার থমকে যাচ্ছে।তবু জোরে একটি শ্বাস টেনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভা মাথা নত করেই বুঝতে পারলো রৌদ্র তার দিকে এগিয়ে আসছে।রৌদ্রের পা দু’টো তার দিকে এগিয়ে আসতেই শ্বাস থমকে গেল তার।থর থর করে কাঁপতে লাগল সে।রৌদ্র ঠিক আভার সামনে দাঁড়াল। তার শিকারী দৃষ্টি আভায় নিবন্ধ।শীতল কন্ঠে আভার নাম উচ্চারণ করল,
– আভা!

আভা কন্ঠনালি পাথর হয়ে আছে।তাই সে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।রৌদ্র আলতো হাসে।একই স্বরে বলে,
– সুন্দরী গ্রামে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার স্মৃতির পাতায় আজীবন তাজা হয়ে থাকবে।অভয়ের পর তোমার সাথেই আমি এতো বেশি ইজি হতে পেরেছি।আমার বন্ধুর তালিকায় অজান্তেই কখন তোমার নাম উঠে গেল বুঝতেই পারিনি।অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনে সুন্দর সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।সুন্দরী গ্রামে একজন বালিকাবন্ধু রেখে গেলাম।

থামলো রৌদ্র।চোখ ভরে উঠলো আভার।শরীর তাপমাত্রা তির তির করে বেড়ে চলেছে।রৌদ্রের কন্ঠস্বর আরো কোমল হলো।সে আবারও শান্ত স্বরে বলল,
– ভালো করে পড়াশোনা করবে।আর যেন ফেল করে না।লেটার মার্ক নিয়ে এসো।

বোবা কান্না করলো আভা।রৌদ্রের শীতল কন্ঠের প্রতিটি শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠলো আভা।রৌদ্র নিজের মাথার ক্যাপটি খুলে আভাকে পরিয়ে দিলো।কালো ক্যাপ মাথায় আভাকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে সে।শুঁকানো ঢোক গিলে ফ্যাকাশে কন্ঠে বলে,
– আমার তরফ থেকে একটা ছোট গিফট।আমি তো জানতাম না অভয়ের একটা বোন আছে।জানলে হয়তো আসার সময় কোনো উপহার সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।
আপাতত আমার কাছে দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই।আর কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা।তাই আমার তরফ থেকে এটা তোমার জন্য।

রৌদ্র নিষ্পলক চেয়ে আছে তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা পনেরো বছরের বালিকার দিকে।দৃষ্টি স্থির রেখেই সে হিম কন্ঠে বলল,
– তোমাকে অনেক মনে পড়বে আমার “প্রিয় বালিকা”।তবু ধরনীর মঙ্গলে আমাদের আর দেখা না হোক!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে