#প্রিয়_বালিকা |৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
পুকুর পাড়ে বঁড়শি ফেলে বসে আছে অভয়।পাশেই রৌদ্র উদাসীন মুখে এক দৃষ্টিতে পুকুরের পানির দিকে চেয়ে আছে।রৌদ্রের চোখে বার বার আভার সেই ভেজা চোখের ভেজা পাপড়িগুলো ভেসে উঠছে।আর ভেসে উঠছে আভার তার দিকে নিক্ষেপ করা ঘৃণা মিশ্রিত চাহনি।অভয় পাশ তাকিয়ে রৌদ্রকে একপলক দেখল।চোখ ফিরিয়ে পুকুরে দৃষ্টি রেখে বলল,
– তোর সেই রেন্টেড গার্লফ্রেন্ডকে মিস করছিস বুঝি?
সহসা এমন প্রশ্নে ঘোর কেটে গেল রৌদ্রের।অভয়ের দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– হুম?
অভয় খুব স্বাভাবিকভাবেই রৌদ্রকে একই প্রশ্ন করল,
– তোর রেন্টেড গার্লফ্রেন্ডকে মিস করছিস বুঝি?
ক্ষেপে গেল রৌদ্র।রাগি স্বরে বলল,
– একদম বাজে কথা বলবি না।আর তোর কি আমাকে নিজের মতো মনে হয়?যে সবসময় এসব মেয়ে মানুষ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবো?
অভয় রৌদ্রের দিকে দৃষ্টি ফেলল।অবাক সুরে বলল,
– মানেহ্?আমি সব সময় মেয়ে মানুষ নিয়ে চিন্তা করি?
– তা নয় তো কি?মেয়ে মানুষ নিয়ে না ভাবলে আমাকে মেয়ে মানুষ এর কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?
অভয় নাক কুঁচকে বলল,
– রৌদ্র তুই দেখি দিন দিন মেয়ে মানুষের মতো খিট খিট করে ঝগড়া করা শিখছিস।
রৌদ্র তেড়ে এলো অভয়ের দিকে।ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
– তোকে বলেছিনা আমার সামনে মেয়েদের বিষয়ে কোনো কথা বলবি না।মেয়ে মানুষে আমার এলার্জি আছে।মেয়ে মানুষ মানেই হলো ত..তপো..তপোভঙ্গকারিণী।আর একটা আজেবাজে কথা বললে তোকে এই পুকুরে ফেলে দিবো।
অভয় চোখ কপালে তুলে অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
– আরেহ্ ব্যস!তোকে এতো কঠিন বাংলা কে শেখাল?বাংলাদেশে এসে তো দেখছি তোর বাংলার খুব ভালো উন্নতি হয়েছে।সামার ভ্যাকেশন শেষ হওয়ার আগে তোকে কয়েকটা বাংলা গালি শিখিয়ে দিবো।
– গালি মিনস স্ল্যাং?
– হ্যাঁ স্ল্যাং।যেমন ধর বেয়াদ’ব,শা’লা,বা’ল ইটিসি।গালি দিলে রাগের বহিঃপ্রকাশটা নিখুঁত হয় বুঝলি?
কথাটা শেষ করে রৌদ্রের কাঁধে চাপড় দিলো অভয়।রৌদ্র কপাল কুঁচকে বলল,
– এগুলোর মিনিং কি?
– মিনিং জেনে কি করবি?শত্রুরা কি তোর কাছে ওয়ার্ড মিনি শুনতে চায়বে নাকি ভোকাবুলারি টেস্ট নিবে?
রৌদ্র উঠে দাঁড়ালো।নিজের হাত থাপ্পড় দিতে দিতে বলল,
– এখানে অনেক মশা।আর বসতে পারছি না চল বাড়িতে।
অভয় রৌদ্রের প্রস্তাব নাকচ করে বলল,
– আরে না এখন একটা পুঁটিমাছও পেলাম না এতো তাড়াতাড়ি যাবো না।
রৌদ্র বিরক্ততে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।পুকুরের দিকে এক ঝলক চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
– তোর মনে হয় এখানে মাছ আছে?জীবনভর বসে থাকলেও মাছ উঠে না।কিন্তু ম্যালেরিয়ায় তোর মৃত্যু ঠিকই হয়ে যাবে।তাই টাইম ওয়েস্ট না করে ভিতরে চল।
অভয় তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে রৌদ্রের উদ্দেশ্য বলল,
– রৌদ্র তুই ভিতরে যা আমি আসছি কিছুক্ষণের ভিতর।
রৌদ্র আর কথা বাড়ালো না।ধীর পায়ে বিড় বিড় করতে করতে বাগান থেকে বেরিয়ে এলো।”দুইদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে একবারের জন্য চোখেও পড়ল না।গেল কোথায়?খাওয়ার সময়ও দেখলাম না!” বিড় বিড় করতে করতে বাগান থেকে বের হতেই আভাকে বাড়ি প্রধান গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখা গেল।রৌদ চোখ বড় বড় করে আনমনেই বলল,”এই তো!”
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভা পাড়ার মুদি দোকানে গিয়েছিল মায়ে আদেশে।প্রেমা ছেলেকে না পেয়ে আভাকে সামনে দেখে আভাকে পাঠায় মুদি দোকানে পাঁচ ফোঁড়ন আনতে।সেটা নিয়েই বাড়ি ফিরছিল আভা।হঠাৎই রৌদ্রের মুখোমুখি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।দুইদিন সে রৌদ্রের থেকে গা বাঁচিয়ে চলেছে।এই লেকটার চেহারাটাও সে দেখতে চায় না।এই লোকটার জন্য তাকে তার ভাই ভ্যানওয়ালার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে।আভা কপাল কুঁচকে রৌদ্রকে এড়িয়ে ভিতরে ঢুকতে গেল।কিন্তু রৌদ্র দ্রুতগতিতে এসে আবারও আভার পথ আঁটকালো।বিরক্ত হলো আভা।চোখ তুলে রৌদ্রের মুখের দিকে চায়লো।তবে দৃষ্টি স্থীর করতে পারল না।রৌদ্রের শিকারী চাহনিতে তার আত্মা কেঁপে ওঠে।তাই ঐ চোখে দৃষ্টি ফেলার সাহস নেই তার।মাথা নিচু করে ফেলল আভা।রৌদ হাসফাস করতে লাগল কিছু বলার উদ্দেশ্য।বার বার উচ্চারণ করল,
– স..স..সর..স!
কিন্তু কিছুতেই পুরো কথাটা বলতে পারল না সে।নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো মনে মনে বলল,”ছোট্ট একটা সরিও বলতে পারিস না আফসিন রৌদ্র।তোর জীবনে কিছু হবে না।ধুর বাবা!বিরক্ত লাগছে।”
আভা বিরক্তির চোখে তাকাল রৌদ্রের দিকে।রাগে কটমট করে বলল,
– কি সমস্যা আপনার?আমার পিছনেই কেন হাত ধুয়ে পড়েছেন আপনি?আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা?ভাইয়াকে দিয়ে তো এতোগুলো কথা শোনালেন এখন কি ভ্যানওয়ালার সাথে আমার বিয়েটাও দেখতে চান?আপনি এসেছেন এক সপ্তাহও হয়নি এই এক সপ্তাহে আমি ঠিক করে দু’টো ভাতও খেতে পারিনি আপনি আমার পিছনে এমনভাবে পড়েছেন।আমার সাথে আপনার কিসের এতো শত্রুতা?আমাকে বাড়ি ছাড়া করতে চান এখন?কি চান আপনি আমার থেকে?বলুন কি চান?
চিৎকার করে কথাগুলো বলল আভা।আভার কথা বলার ধরণ একদম পছন্দ হলো না রৌদ্রের।মাথাটা চট করেই গরম হয়ে গেল।চোখের ভিতর থাকা চিকন সূক্ষ্ম শিরাগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করলো।কেনোকিছু না ভেবেই আভার গাল চেপে ধরল সে।রাগে কিড়মিড়িয়ে বলল,
– আই ওয়ার্নিং ইউ ফর দ্য ফার্স্ট টাইম এন্ড অলসো লাস্ট টাইম ডোন্ট টক টু মি লাইক দ্যাট।নেক্সট টাইম আই’ল নট টলারেট দিস টোন ওফ ইউর ওয়ার্ডস।ডু ইউ গেট ইট?
আভা টলমল চোখে চেয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।সহসা তার মনে রৌদ্রের জন্য জন্মানো ঘৃণা দৃঢ় হলো।আভার ভেজা চোখের দিকে চেয়ে ঘোর কেটে গেল রৌদ্রের।ছেড়ে দিল আভার গাল।ডান চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে চোখের নিচের তিল ছুঁয়ে গেল।রৌদ্রের দৃষ্টি সেই তিল ছুঁতেই থমকে গেল সে।ধীরে ধীরে দৃষ্টি কোমল হয়ে এলো।আনমনেই উচ্চারণ করল,
– সরি!
আভাও বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলল।আচমকা রৌদ্র তাকে সটি বলবে তা সে ভাবতে পারিনি।তাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে।নাক টেনে মাথা নত করে ফেলল।চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই রৌদ্র বলল,
– আমি তোমাকে ম্যাথমেটিক্সে সাহায্য করতে পারি।
পা থেমে গেল আভার।তবে সে পিছন ফিরল না।কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে নাক টানতে টানতে মুখ ফুলিয়ে বলল,
– কিভাবে?আপনি কি এখানের ম্যাথ পারেন নাকি?
রৌদ্র মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– কজ,থিটা,সাইন সব দেশেই সেম।আর অন্যান্য ম্যাথ আমি ইংলিশে করেছি আর তুমি বাংলায় করো।এটাই পার্থক্য।বাংলা বুঝতে আমার একটু প্রবেলম হবে বাট ব্যাপার না আমি ট্রান্সলেট করে নিবো।
আভা কোনো উত্তর দিলো না।আভার উত্তর না পেয়ে রৌদ্র সামান্য অপমানিত বোধ করল।তবে পরমুহূর্তেই মনে একটা প্রশান্তি বয়ে গেল।ফাইনালি সে সরি বলতে সক্ষম হয়েছে।ভাবতেই মুখে ফুটে উঠলো কোমল হাসি।যে হাসির দরুণ ঠোঁটের দুইপাশে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত সুন্দর দু’টি সূক্ষ্ণ ভাঁজ।যা সচারাচর সবার দেখার সৌভাগ্য হয় না!
রাতে ঘুমের ঘোরে ফুসুরফাসুর শব্দে ঘুম ছুটে এলো অভয়ের।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো সে।এতো রাতে কানের কাছে কারা এমন ফুসুরফাসুর করছে ভেবে দাঁত কিড়মিড় করল সে।ঘুম কেঁটে যেতেই চোখ খুলল।পাশ ফিরে কাউকে দেখতে পেল না।পূর্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখতেই বুঝতে পারল সে তার রুমে নেই।পরক্ষণেই মনে পড়ল রৌদ্রের জনয় বরাদ্দকৃত ঘরে রৌদ্রের সাথে অনলাইন গেইম খেলতে খেলতে সে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।পাশে তাকিয়ে রৌদ্রকে না দেখে ভ্রুকুটি করল সে।এতো রাতে রৌদ্র কোথায় গেল?উঠে বসতেই দেখতে পেল তার ডান পাশেই কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে।অভয়ের কপালে আরো একটি অতিরিক্ত ভাঁজে সৃষ্টি হলো।কিছুক্ষণ খেয়াল করতেই বুঝতে পারল চাদরের ভিতরে আলো জ্বলছে এবং ফুসুরফাসুর শব্দটাও ওখান থেকে আসছে।অভয় চোখ ফেড়ে তাকিয়ে রইলো চাদর মুড়ি দেওয়া ব্যক্তির দিকে।বিড়বিড়িয়ে বলল,”রৌদ্র এখনও ঘুমায়নি?এতো রাতে চাদর মুড়ি দিকে কি দেখছে ও?ভুলভাল কিছু না তো?ছিঃ!ছিঃ!” নাক মুখ কুঁচকে ফেলল অভয়।নিচের ঠোঁট কামড়ে জাপ্টে ধরল চাদর মুড়ি দেওয়া ব্যক্তিকে।বলল,
– এই তো আজকে হাতে নাতে ধরেছি।ছিঃ!ছিঃ! রৌদ্র তুই এসব দেখিস আমি ভাবতেও পারিনি।গজব পড়ুক তোর উপর।
চাদরের ভিতর থেকে শোনা গেল রৌদ্রের রাগি কন্ঠস্বর,
– এই কি করছিস ছাড়।অভয় ছাড় আমাকে।কি বলছিস এসব হাবিজাবি?
অভয়ের প্রতিহত স্বরে বলল,
– না না আজকে তোকে হাতে নাতে ধরেছি এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।ছিঃ!ছিঃ! গার্লফ্রেন্ড চলে গিয়েছে বলে তুই এসব দেখবি?ইউ ডার্টি মাইন্ড আজকে তোকে ছাড়ছি না।
রৌদ্র এবার কিছুটা জোরে ধমক দিয়ে বলল,
– অভয়!স্টপ টকিং লাইক বুল’শিট এন্ড লিভ মি রাইট নাও!
দমে গেল অভয়। রৌদ্রকে ছেড়ে দিতেই নিজের উপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলল রৌদ্র।তাকে দেখা গেল একটি খাতা আর কলম হাতে।অন্য হাতে ফোন।ফোনটা অভয়ের দিকে এগিয়ে দিলো।স্ক্রিনে অভয় নবম দশম শ্রেণির গণিত বিষয়ের কিছু ভিডিও দেখতে পেল।ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে।রৌদ্র একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
– হেডফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
চলবে…
#প্রিয়_বালিকা |৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
– ভাইয়া তুমি এই অবস্থায় একদম ঘরে ঢুকবে না।সারাঘর নোংরা হবে।
আভার নাক মুখ কুঁচকে বলা কথায় ভ্রুকুটি করল অভয়।সামান্য রাগও হলো তার।নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে শক্ত কন্ঠে বলল,
– তাহলে কি এখন আজীবন আমাকে এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি?
অভয়ের বেচারি অবস্থা দেখে এমনিতেই রৌদ্রের হাসি থামছে না।তারপর অভয়ের এমন কথা যেন তার হাসি আরো বাড়িয়ে দিলো।সে ফিক করে হেসে ফেলল।অভয় কটমট চোখে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে আঙুল দিলো সে।গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে বলল,
– শোন আমি বলছি যে তুই পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে আয়।হ্যাঁ এটাই বেস্ট হবে।বুঝেছিস?
অভয় শুঁকুন দৃষ্টি ফেলল রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,
– আমি তো তোর ভালোর জন্য বললাম।এতে ঘরও অপরিষ্কার হবে না আবার তুইও পরিষ্কার হয়ে যাবি।ঐ একটা প্রবাদ আছে না কি কি যে এ এক ঢিলে!হোয়াট এভার ঐটা হবে।
আভা নিচু স্বরে রৌদ্রকে সংশোধন করে দিয়ে বলল,
– এক ঢিলে দুই পাখি।
তৎক্ষনাৎ আভার কথায় জোর সম্মতি জানালো রৌদ্র,
– হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটাই।
আভাও রৌদ্রের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল,
– হ্যা ভাইয়া তুমি এটাই করো।ভালো বুদ্ধিই দিয়েছেন উনি।
অভয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল।আর কোনো উপায় না পেয়ে সে রৌদ্রের কথা মতো পুকুরে চলে গেল।এই বিকেলে পুকুরে গোসল!বিষয়টা একদমই মনে ধরলো না অভয়ের।ঠান্ডা লেগে যাওয়ার শঙ্কা আছে।তবু কি আর করার!এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই।
পুকুরে পর পর দু’টো ডুব দিলো অভয়।পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আভা এবং রৌদ্র।আভা নিজের ভাইয়ের জন্য গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে।আভা চারপাশটা ভালোভাবে চোখ বুলালো।এদিকটা তেমন আসা হয় না।হঠাৎ জোড়া বটগাছটা দিকে চোখ যেতেই ভাইয়ের কাছে একটি আবদার করে বসলো সে,
– ভাইয়া আমাকে এই গাছে একটা দোলনা বেঁধে দিবে?
আভার আদুরে কন্ঠের আবদার শুনে চোখের মণি ঘুরিয়ে আভার দিকে চায়লো রৌদ্র।কি সুন্দর সে চাহনি!পরমুহূর্তেই মুখ তুলে তাকালো।অভয় পুকুর থেকে উঠতে উঠতে মশকরা করে বলল,
– বুড়ি বয়সে এখন দোনলা ঝুলার শখ হয়েছে?হ্যাঁ আমি বেঁধে দিই তারপর পড়ে গিয়ে ট্যাং ভেঙে আমাকে বাবার বকা খাওয়াও।
আভা ঠোঁট উল্টিয়ে কিছুটা আহ্লাদী স্বরেই বলল,
– না ভাইয়া একটা দোলনা বেঁধে দাও না।
অভয় বোনকে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
– এহ্!এখন তোর দোলনা ঝুলার বয়স আছে?সামনে না এসএসসি পরীক্ষা যা গিয়ে পড়তে বস।পড়ালেখায় তো ডাব্বা।গণিত পাও তিন লজ্জা করে না এখন এই কথা বলতে?
মুখটা চুপসে গেল আভার।রৌদ্রের সামনে তার ভাই এমনভাবে বলায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলো।রৌদ্রের শিকারী দৃষ্টি আভাতে স্থির।মুখে এই মুহুর্তে উল্লেখযোগ্য কোনো ভঙ্গি দেখা গেল না।তবে কিছুটা অনুভূতিশূন্য দেখাল।
সন্ধ্যার পর রৌদ্র তার ঘরে বসে।খাতায় গণিত তুলছে।হাতের লেখা এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।প্রথম প্রথম লিখতে গিয়ে তো তার হাত ভেঙে খুলে পড়ার যোগার হয়েছিল।এখন তাও হাত চালু হয়েছে।গতিও কিছুটা বেড়েছে।রৌদ্র খুব যত্নের সাথে গণিতগুলো খাতায় তুলছে।পাশে বিস্তারিত লিখছে কিভাবে কি হয়েছে।কোন সমীকরণ কিভাবে মিলেছে।সে বর্তমানে দিনের বেলাতে অভয়ের সাথে বাড়ির বাইরে থাকে। আর রাত হলে নিজের ঘরে এসে ঢোকে আর বের হয় না।এর একটাই কারণ সেহরিন থেকে লুকিয়ে চলা।একবার মুখোমুখি হয়ে গেল তো রৌদ্র নিজের রাগের নিয়ন্ত্রণ হারালো।এমনভাবেই কেঁটেছে এ কয়েক দিন।সেহরিন দুইদিন যাবৎ রৌদ্রের নাগাল না পেয়ে নিজেই রৌদ্রের ঘরে এলো।কোনো সাড়াশব্দ না করেই ঘরে প্রবেশ করলো সে।পা টিপে টিপে রৌদ্রের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।কিছুক্ষণ তার লেখা খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
– ভাউউউ…!
হঠাৎ চিৎকার করায় নড়ে উঠলো রৌদ্র।তবে ভয় পেল না।বরং খাতার দিকে তাকিয়ে তার রাগটা তির তির করে মাথায় চড়ে বসলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শকুনি দৃষ্টিতে তাকালো সেহরিনের দিকে।রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– ইউ বাস্টার্ড!কি করলে এটা?
সেহরিন গোল গোল চোখে খাতার দিকে তাকিয়ে দেখল খাতায় কলমের বড় লম্বা একটি দাগ পড়ে গিয়েছে।তবে তাতে আফসোস হলো না সেহরিনের।সে প্রসঙ্গ পাল্টে আহ্লাদী স্বরে বলল,
– তুমি ইদানীং কোথায় থাকো বলো তো?তোমার কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না!তোমাকে কত মিস করি জানো?
রৌদ্র চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।বিরক্ততে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।শক্ত কন্ঠে বলল,
– আমি কোথায় থাকি না থাকি সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো নাকি?আর আমি তোর কত বড় আমাকে আপনি আপনি করে বলবে।
সেহরিন নাক সিটিয়ে বলল,
– নো নো এটা অনেক ওল্ড।আমি তোমাকে তুমি করেই বলবো।তোমার জন্য একটা দুঃখের খবর আছে জানো!
ভ্রুকুটি করে ফেলল রৌদ্র।জিজ্ঞেস করল,
– কি?
– আমরা আগামী সপ্তাহে শহরে চলে যাচ্ছি।আমি জানি আমাকে তুমি অনেক মিস করবে।বিশ্বাস করো আমিও তোমাকে অনেক মিস করবো।কিন্তু কিছু করার নেই কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়।তেমন আমি তোমাকে ছাড়ছি।কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার!
কথাটা বলেই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো সেহরিন।রৌদ্র রাগে কর্কশ গলায় বলল,
– আর ইউ ম্যাড ওর হোয়াট?আর তুমি আমার রুমে ডুকেছ কোন সাহসে তাও আবার আমার পারমিশন ছাড়া?এখনই বের হও।
সেহরিন তবু দাঁড়িয়ে রইলো।ন্যাকা কান্না করে বলল,
– আমি বুঝতে পেরেছি আমি চলে যাচ্ছি বলে তুমি এতো রেগে যাচ্ছো তাই না।প্লিজ তুমি এভাবে আমার সাথে রেগে থেকো না তা নাহলে আমি যে যেতে পারবো না।
রৌদ্র চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো।রাগে তার শরীর সকল রগগুলো ফুলে উঠেছে।গলার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শিরাগুলোও ফুলে ফেঁপে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়ছে।রৌদ্র হাত মুঠো করে আবার একটি শ্বাস নিলো।চোখ খুলেই আচমকা সেহরিনকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে বের করে দিয়ে দরজা আঁটকে দিলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিড় বিড় করে বলল,” মেয়েটা কি পাগল নাকি?অসভ্য ম্যানারলেস মেয়ে একটা।কই অভয়ের বোন তো এমন করে না।এই মেয়েটা এমন এবনরমালের মতো বিহ্যাব করে কেন?ইরিটেটিং!”
স্কুলের পথে হাঁটছে আভা।তবে ক্ষণে ক্ষণেই থেমে বিরক্তি ভঙ্গিতে পিছন ফিরছে সে।কারণ সে একা স্কুলের পথে হাঁটছে না।তার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে কিছুটা দুরত্বে রৌদ্রও হাঁটছে।বলা চলে তাকে অনুসর করেই পা ফেলছে বিদেশি যুবকটি।দু একবার পিছন ফিরে দেখার পর কদম থেমে গেল আভার।ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে পিছন ঘুরে রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।সহসা আভাকে এগিয়ে আসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রৌদ্র।মাথার ক্যাপ ঠিক করে উল্টো হাঁটা শুরু করলো সে।আভার কপাল কুঁচকে এলো।সে গলা উঁচিয়ে বলল,
– এই যে শুনুন।
রৌদ্র দাঁড়ালো না।বরংচ পায়ে গতি বাড়িয়ে দিলো।নিজের মাথায় নিজেই বারি দিলো সে।দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়িয়ে বলল, “ড্যাম ইট!কি করছিস তুই আফসিন রৌদ্র?একটা মেয়ের পিছু নিয়েছিস তুই?তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে?যে কিনা এখনও স্কুলটাও পাড় করতে পারেনি।কিভাবে?আফসিন রৌদ্র কিভাবে পারলি তুই এটা করতে?একবারও বিবেকে বাঁধলো না তো?বুড়ো বয়সে এখন তোর আবেগ কাজ করতে শুরু করেছে নাকি?”
হাজারো প্রলাপ বকতে বকতে জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রৌদ্র। আভার এবার রাগ হলো।সে কপাল কুঁচকে দৌড়ে এসে দুইহাত প্রসারিত করে রৌদ্রের পথ আঁটকালো।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
– এই যে আপনাকে ডাকছি না?কানে কালা নাকি আপনি?
আভা আচমকা পথ আঁটকে দিতেই থতমত খেয়ে গেল রৌদ্র।তবে সে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হলো না।উল্টো কপাট রাগ দেখিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
– বাজে কথা বলবে না একদম।আর পথ আঁটকেছো কেন?পথ ছাড়ো আমার।
আভা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বলল,
– আপনি আমাকে ফলো করছিলেন?কেন?
রৌদ্র চোখে মণি ঘুরিয়ে জোর কন্ঠে বলল,
– ফলো?তোমাকে?তাও আবার আফসিন রৌদ্র?হাও ফানি?
– তাহলে আমার পিছু পিছু আসছিলেন কেন?এটা কি?
আভার রৌদ্রের হাতে থাকা খাতাটি ইশারা করে জানতে চায়লো।রৌদ্র খাতাটি নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেলল।আমতা আমতা করে বলল,
– ক কই কিছু না।পথ ছাড়ো আমার।
আভা মুখ বাঁকিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। রৌদ্র আঁড়চোখে আভাকে একপলক দেখে চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল।পিছন ফিরে শীতল কন্ঠে ডাক দিলো আভাকে,
– আভা!
ভারি কন্ঠে এমন শীতল ডাকে কেঁপে উঠলো আভা।হঠাৎই গলাটা মরুভূমিতে পরিণত হলো।ঢোক গিলে সে মরুভূমিতে সামান্য পানির ছোঁয়া দিতে চায়লো আভা।নিভু নিভু কন্ঠে সাড়া দিলো,
– হুম
তবে তা উপস্থিত দু’জনের একজনও শুনতে পেল না।রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আভার দিকে।আভার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের খাতাটির দিকে তাকিয়ে ছোট ঢোক গিলল।হাজারো সংকোচ নিয়ে খাতাটি ধীরে ধীরে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে মোটা কন্ঠস্বর কোমল করে বলল,
– এটা তোমার জন্য।বলেছিলাম তোমাকে গণিতে সাহায্য করতে পারি।যদি চাও তাহলে এটা নিতে পারো আশা করি উপকৃত হবে।
চলবে…
#প্রিয়_বালিকা |৯|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
আভা বাকরুদ্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে খাতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আভার কোনো নড়চড় না দেখে ঢোক গিলল রৌদ্র।শক্ত কন্ঠে বলল,
– ওকে না নিলে সমস্যা নেই।আমি নিয়ে যাচ্ছি।
খাতাটা আভার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার আগেই আভা খাতাটি এক টানে কেঁড়ে নিলো।চমকে উঠলো রৌদ্র।পর পর কয়েকটা পলক ফেলে আবার ছোটো ঢোক গিলল সে।আভা খাতাটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে।ছাড়া ছাড়া বাংলা বর্ণে গণিতের খুঁটিনাটি সকলকিছু বিস্তারিতসহ লেখা। যুক্তবর্ণগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট।যুক্ত বর্ণগুলো দেখে মৃদু হাসে আভা।আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে রৌদ্রও যুক্তবর্ণগুলোকে দেখে মুখ কালো করে বলল,
– এগুলো দেওয়া খুব কঠিন।তাও যেমন আছে তেমন আঁকানোর চেষ্টা করেছি।জানি খারাপ হয়েছে বাট আই থিংক তুমি বুঝতে পারবে।
আভা চোখ তুলে তাকালো ছেলেটির দিকে।তবে প্রতিবারের মতো দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলো না।দৃষ্টি সরিয়ে মাটিতে নিবদ্ধ করলো।চিকন স্বরে বলল,
– বাঙালি না হয়েও তো ভালোই বাংলা লিখেছেন।আমার হাতের লেখা তো এর থেকেও খারাপ।জানেন মৃণাল কান্তি দ্য অশান্তি স্যার কি বলে?আমি নাকি পরীক্ষার হলে তেলাপোকার পায়ে কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিই।
কথাটি বলে মুখে হাত দিয়ে আলতো হাসলো আভা।রৌদ্র আভাকে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা ম্যাথমেটিক্সে তুমি এতো কম পেলে কেন?ম্যাথমেটিক্স কি বুঝতে পারো না?
শীতল বাতাস বয়ে গেল আভার হৃদয়ে।আফসোসের সুরে বলল,
– জানেন এভাবে কেউ কখনো জানতে চায়নি কেন আমি এতো কম পাই?কেন আমি মাধ্যমিকে ওঠার পর থেকে গণিতে পাশ করতে পারিনি?যেখানে অন্যান্য সকল সাবজেক্টে আমি লেটার মার্ক নিয়ে আসি সেখানে গণিতে কেন আমি এতো কম পাই?সকলে শুধু দেখে আমি কম পাই!আমি ফেল করি!কেন করি কেউ জানতে চায়না।
ভিতর থেকে একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো আভার।রৌদ্র কিছু বলল না।ইচ্ছা করেই কোনো শব্দ খরচ করতে করলো না সে।মাঝে মাঝে শব্দ খরচ না করে নীরব দর্শক হয়ে থাকার মধ্যেও এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে।আভা কিছুক্ষণ থেমে ভীত স্বরে বলল,
– আমি না বাসা থেকে সব অংক ঠিকঠাক মতো করে যাই।কিন্তু!
– কিন্তু?
– পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখার পর আমার মাথা আর কাজ করে না।সবকিছু কেমন যে গুলিয়ে যায়।মনে হয় সবকিছু আমার অজানা।আর এই জন্য আমি যেগুলো পারি সেগুলোও ভুল করে আসি।আবার অংক করলেও মাঝ পথে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায় আর শেষে উত্তর মেলে না।
হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল আভা।রৌদ্র সূক্ষ্মভাবে পরখ করল তার বাচনভঙ্গি।চাহনি তার স্থির এবং শান্ত।কোনো অনুভূতি নেই এ চহনিতে।পলকহীন চাহনি চক্ষুগোচর হলো না আভার।হবে কিভাবে সে তো এই চাহনির ভয়েই দৃষ্টি নত করে রেখেছে।কখনো এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করার সাধ্য বোধহয় তার হবে না।অথবা এই চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করতে তাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে!
রৌদ্র গম্ভীর ও বিচক্ষণ কন্ঠে বলল,
– বুঝলাম।তুমি এক কাজ করবে, তুমি মানুষের সাথে মিশবে বেশি করে।বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলবে।তুমি যত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবে কথা বলবে ততই তুমি নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।এতে করে তোমার এই নার্ভাসনেসটাও কেঁটে যাবে।আর পড়ার সময় বেশি করে পানি খাবে।পানি খেলে ব্রেইনে অক্সিজেন সঞ্চলন ভালো হয়।যার ফলে ব্রেইন সবসময় সক্রিয় থাকে।ব্রেইন দ্রুত পড়াটা ক্যাচ করতে পারে।
আভা মুচকি হেসে বলল,
– ধন্যবাদ আপনাকে।
রৌদ্র এতক্ষণে আভার থেকে দৃষ্টি সরালো।মাথা নিচু করে ক্যাপ ঠিক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– ইটস্ ওকে।যাও স্কুলে দেরি হচ্ছে না?
সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে আভা রওনা হলো স্কুলের পথে।সেদিকে অকারণেই পলকহীন চেয়ে রইলো রৌদ্র।হয়তো তার মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে তার নিয়ন্ত্রণে নেই।থাকলে হয়তো এভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের বাহিরে বেরিয়ে পলকহীন এই বালিকার দিকে চেয়ে থাকতো না।ব্যক্তিত্ব? ব্যক্তিত্বের কথা ভাবতেই থমকে যায় রৌদ্র।কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই এই দুহিতার সামনে সে তার নিজের কঠিন ব্যক্তিত্ব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন এক ব্যক্তিত্বের মাঝে যার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
প্রসারিত ঠোঁটে হাতের খাতাটি উল্টেপাল্টে দেখছে আভা।হৃদয়ে তার শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে।তবে এই অনুভূতির সাথে সে পূর্বপরিচিত নয়।তাই অনুভূতিটি ঠিক সফলভাবে কাবু করতে পারছে না তাকে।তার পাশেই পূর্ণতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।আভা একমনে খাতাটি দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।বিরক্ত বোধ করলো পূর্ণতা একটানে আভার সামনে থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
– কি ব্যাপার বল তো তোর?
– কি আবার ব্যাপার হবে?
– অংকের ভয়ে অংক বইটাও কখনো খুলে বসে দেখিনি।এখন হঠাৎ এই অংকে ঠাঁসা খাতাটার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে এমন চোরা হাসি দিচ্ছিস কেন বল তো?
মুখ কালো করে ফেলল।আভা নিজেকে স্বাভাবিক করে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আরে কি বলিস না তুই খাতার দিকে তাকিয়ে চোরা হাসি দিবো কেন আমি?খাতা কি কোনো দেখার জিনিস হলো?নাকি ওটা আবার বর যে ওকে দেখে আমি লজ্জায় চোরা হাসি দিবো।
– আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে।
পূর্ণতার কথায় আভা বড় একটা হা করে অবিশ্বাস্য সুরে বলে উঠলো,
– মানে তোর মনে হচ্ছে ওটা আমার বর?
– খাতাটা তোর বর না কিন্তু মনে হচ্ছে খাতাটা দিয়েছে তোর বর।
থমকে গেল আভা।পাথরের মুর্তির মতো স্থির হয়ে গেল সে।খাতার মালিক তার বর?এও কি আদৌ সম্ভব? কল্পনাতেও এ দুর্লভ!কোথায় হাই ক্লাস সোসাইটির বিদেশি রৌদ্র! কোথায় গাঁও গ্রামের আভা!কোথায় আগুন আর কোথায় জল!না না এ ভাবলেও তার মস্তিষ্ক কলংকিত হবে!
আভাকে ঘোরের মধ্যে চলে যেতে দেখে পূর্ণতা একটি ধাক্কা দিলো।বলল,
– কি হয়েছে?হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলি?
আভা মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল,
– কি যে বলিস না তুই?তোর কথার আঁগা মাথা কিছু নেই।
আভা পূর্ণতার হাত থেকে খাতাটি টেনে নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।পূর্ণতা ভাবুক দৃষ্টিতে আভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো,
– আমি আবার আঁগা মাথা ছাড়া কথা বললাম?
—————
– এই যে ক্যাপ ওয়ালা শুনো…
হঠাৎ এমন সম্বোধনে ভ্রু কুঁচকে এলো রৌদ্রের।পিছন ফিরে দেখল তার সামনে অভয়ের ছোট চাচার জমজ দুইজন দাঁড়িয়ে আছে।রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো,
– আমাকে বলছো?
মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে বড়দের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– এখানে তুমি ছাড়া মাথায় ক্যাপ কে পড়ে আছে?আমরা?
রৌদ্র চোখের মণি উঁচিয়ে নিজের ক্যাপটি এক নজর দেখে থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি বলবে বলো।
মেয়েটি কোমর থেকে ডান হাত সরিয়ে রৌদ্রকে তর্জনির ইশারায় নিজের কাছে ডাকল।রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে রেখেই এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে এলো তার সামনে।রৌদ্র লম্বা হওয়ায় মেয়েটিকে ঘাড় তুলে কথা বলতে হচ্ছে।মেয়েটি সেই কষ্ট লাঘব করতেই রৌদ্রকে চোখ গরম দেখিয়ে মাথা নিচু করতে বলল।রৌদ্র হাঁটু ভেঙে তার সামনে বসলো।মেয়েটি কোনো কিছু না ভেবেই রৌদ্রের গালে হাত রাখল।রৌদ্র ভড়কে গেল অবাকও হলো কিছুটা।মেয়েটি রৌদ্রের গালে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল,
– তোমার গাল কত নরম।তোমার গালে চুল নেই কেন?তুমি কি কেটে ফেলেছ?
হাসলো রৌদ্র।মেয়েটির হাত নিজের হাতের ভিতর আবদ্ধ করে মিষ্টি হেসে আদুরে কন্ঠে বলল,
– নাম কি তোমার?
– মিন্নি।
রৌদ্র পাশে তাকিয়ে মিন্নির মতো দেখতে মেয়েটিকেও জিজ্ঞেস করল,
– তোমার নাম?
মেয়েটি একটু চুপচাপ স্বভাবের।বেশি কথা বলে না।এতক্ষণ সে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল।রৌদ্র নাম জিজ্ঞেস করায় গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
– তিন্নি।
রৌদ্র দুজকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো।দু’জনে মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে না পেয়ে আহত স্বরে বলল,
– তোমরা তো দেখতে একদম একই।তাহলে আমি বুঝবো কি করে কোনটা মিন্নি আর কোনটা তিন্নি?
মিন্নি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– শোনো মনে রাখবে মিন্নি খুব চঞ্চল আর তিন্নি খুব শান্ত। তাহলেই তুমি আমাদের সহজেই চিন্তে পারবে বুঝেছ?
রৌদ্র উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।মিন্নি ভ্রু কুঁচকে রাগি ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি তো বললে না তোমার মুখে চুল নেই কেন?
রৌদ্র ভ্রুযুগল উঁচিয়ে ঠোঁট মেলে মিষ্টি হাসি দিলো।আফসোসের সুরে টেনে বলল,
– দাড়ির স্বপ্ন তো আমারও আছে বোন।কিন্তু কি করবো আমি যেখানে থাকি সেখানের আবহাওয়ার কারণে আমার দাড়ি ওঠে না।তাছাড়া সেখানের খাদ্যভাস, আবহাওয়া,লাইফস্টাইলে সবকিছু আলাদা।যার জন্য আমার হরমোন সেভাবে ডেভেলপ হচ্ছে না।বুঝেছো?
– হরমোন কি?
রৌদ্র পড়লো বড় বিপাকে।এখন এই পাঁচ বছরের মেয়েটাকে সে কিভাবে বোঝাবে হরমোন কি?রৌদ্র সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো।আমতা আমতা করে বলল,
– হরমোন হলো দাড়ি ওঠার মেশিন।
– আচ্ছা।তাহলে আব্বুকে বলবো তোমাকে একটা হরমোন কিনে দিতে।তুমি কোথায় যাচ্ছো?
– আমি একটু হেঁটে আসি।
মিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে তিন্নির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।রৌদ্র সেদিকে চেয়ে মৃদু শব্দ করে হাসলো।বরাবরের মতোই ঠোঁটের দুইপাশে দেখা গেল ছোট্ট ছোট্ট দু’টো টোল।একদম ঠোঁট ঘেঁষে আছে তারা।পিছন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ।অনবরত সে শব্দ কানে আসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার।পিছন ফিরতেই দেখতে পেল সাইকেলে বসা ছোট চুলের মেয়েটি।রৌদ্র সাইকেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– এটা ঠিক করে দিয়েছে অভয়?
আভা কড়া কন্ঠে জবাব দিলো,
– ঠিক না করে দিলে ওর একটা হাড্ডিও আস্তো থাকতো?
আভার কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল রৌদ্রের।আজ কোণা চোখে সেই হাসি দেখার সাহস করলো আভা।তবে সেই চোরা দৃষ্টিও স্থির রাখতে পারলো না।গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে চড়ে বলল,
– আসুন আপনাকে গ্রাম দেখায়।
– এ কয়েকদিনে অনেকবারই গ্রাম চষে ফেলেছি।
– আজকে নাহয় আরেকবার দেখবেন।আপনার রিটার্ন গিফট এটা।চলে আসুন।
রৌদ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
– সাইকেলে?
– হ্যাঁ আসুন।
কি মনে করে রৌদ্র আর না করতে পারলো না।এগিয়ে গেল আভার পিছনের ছিটে বসার জন্য।ঠাট্টা করে বলল,
– তোমার ভাইয়ের মতো আবার আমাকে পঁচা ডোবায় ফেলে দিও না।
– যদি দিইও তাহলে কি আপনি আমাকে মারবেন?
চলবে…