#প্রিয়_বালিকা |সূচনা|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
হাই বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আয়েশ করে মুখে বরই পুরে চোখ বন্ধ করে ফেলল পনেরো বছরের কিশোরী।চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ এমন কায়দায় ফুটিয়ে তুলল যেন সে অমৃত মুখে পুরেছে।চোখ মুখ কুঁচকে এলো তৃপ্তিতে।তবে সে তৃপ্তির ছায়া মুখে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না।স্কুলের লম্বা বারান্দা থেকে ছুটে এলো এক স্বাস্থ্যবান ছেলে।বোঝা গেল সে পুরোটাই পুষ্টিতে ভরপুর।যার দরুন দৌড়ে আসতেও তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে চোখের সামনে কিশোরীকে হাই বেঞ্চের উপর বসে থাকতে দেখে উদ্বেগ স্বরে বলল,
– এই আভা তাড়াতাড়ি বেঞ্চ থেকে নেমে বস।গণিত স্যার আসছে বগলের নিচে এক বান্ডিল খাতা মনে হয় পরীক্ষার খাতা দেখাবে।
কথাটি কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো কিশোরী।আঁখি যুগল বেরিয়ে আসতে চায়লো কোটর থেকে।লাফিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ায় সে।মুহুর্তেই চোখেমুখে ভর করে একরাশ ভয়।শুঁকনো ঢোক গিলে নিজের কম্পনরত দেহ খানির ভর ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চে বসে পড়লো আভা।স্বাস্থ্যবান ছেলেটির চোখে তার ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।ভীত স্বরে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো,”মৃণাল স্যার আসছে?খাতা নিয়ে?গণিত খাতা?”
আভার কথায় ছেলেটি তার জলহস্তির মতো মাথাখানি উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।আরো একটি শুঁকনো ঢোক গিলে নেয় আভা।করুণ চাহনি স্থীর হয়ে আঁটকে থাকে কালো বোর্ডের উপর।পরপর ঢোক গিলে নিলো নিজের আগামী অবস্থানের কথা মনে করে।পাশে ভাব ছাড়া হয়ে বসে থাকা মেয়েটির যেন এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না কোনো উত্তেজনা!উদ্দীপনা! সে যেন জানে তার খাতায় কত নম্বর দেওয়া হয়েছে।তাই সে নিজের মনে নিজের নোটখাতা থেকে আভার নোট খাতায় গণিত সমাধান তুলছে।পাশে বসা মেয়েটির ভাব ছাড়া আচারণ মটেই মনে ধরলো না আভার।সে ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চন করে মেয়েটির পা থেকে মাথা অবধি একঝলক পরখ করে নিলো।সে গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো।তবু মেয়েটির মনোযোগ ক্ষুন্ন হলো না।সে তার মতো করে চকচকে সাদা খাতায় কালো কালির কলম চালিয়ে যেতে রইলো।আভার চোখে মুখে সামান্য রাগের আভাস পাওয়া গেল।সে খপ করে মেয়েটির হাত থেকে কলমটি কেঁড়ে নিলো।এতক্ষণে মেয়েটির সাড়া পাওয়া গেল।বিরক্তির ছাপ ফেলে আভার দিকে তাকালো মেয়েটি।আভা ঠোঁট একদিকে বাঁকিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটিকে বিরক্ত হতে দেখে আভা বলল,
– কিরে পূর্ণতা মনে হচ্ছে তোর খাতা নিয়ে কোনো চিন্তায় নেই!এতো স্বাভাবিক কিভাবে তুই?তোকে দেখে মনে হচ্ছে এবারও তুই ফার্স্ট হবি!
পূর্ণতা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বুকে হাত গুঁজল।ঘাড় সোজা করে একটু আরাম করে বসে হেয়ালি স্বরে বলল,
– এমন কিছুই হবে তা আমি খুব ভালো করে জানি তাই কোনো চিন্তা আসছে না।আর তোরও তো চিন্তার কোনো কারণ দেখছিনা।তুই যেমন প্রতিবার লোয়েস্ট মার্কের রেকর্ড গড়িস এবারও তো সেই রেকর্ড গড়তে চলেছিস তাহলে এতো চিন্তা করে লাভ কি?
ক্ষিপ্ত হলো আভা কোমরে হাত দিয়ে শরীর ঘুরিয়ে পূর্ণতার দিকে ফিরলো।তেজি স্বরে বলল,
– মজা নিচ্ছিস?যাহ্ কথা বলবিনা আমার সাথে আর!
স্মিত হাসে পূর্ণতা।আড় চোখে আভার ফুলিয়ে রাখা মুখটি একপলক দেখে আহ্লাদী হাতে আভার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে।সে স্পর্শে বিদ্রুপের আভাসও ছিল অবশ্য। যেটা স্পষ্ট অনুভব করে আভা।চোখ মোটা করে পূর্ণতার দিকে তাকাতেই নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ সংকুচিত করে পূর্ণতা।এর মধ্যেই শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করেন নবম শ্রেণীর গণিত বিষয়ের জন্য নির্ধারিত শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাস।নীল সাধা চেক দেওয়া শার্টের সাথে কালো একটি ঢোলাঢালা প্যান্ট।মাথার সামনে এবং পিছনে আধো আধো কয়েক গোছা চুল।সেও যেন শোন পাপড়ির মতো পাতলা এবং তেলে চটচটে। মাথার মাঝখানটায় চকচকে এক উদোম মাঠ।আলোর প্রতিফলন পড়তেই জায়গাটি কেমন ঝলকানি দিয়ে ওঠে।ছোট ছোট একজোড়া চোখের সামনে আবার একজোড়া মোটা ফ্রেমের চশমা।বড় বড় মোটা কালো ফ্রেম মুখের কালো ত্বকের সাথে যেন একদম বেমানান। শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করতেই সকলে উঠে দাঁড়ালো। এক সুরে চেঁচিয়ে উঠলো,
– কেমন আছেন স্যার?
চশমার নিচ থেকে ছোট ছোট মণি দুটো বের করে ক্লাসের শুরু থেকে শেষ অবধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন।হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বললেন।জর্দার কবলে নিহত হওয়া কালো দাঁতগুলো বেরিয়ে একটি কৃত্রিম হাসি দিলেন।চশমাটি নাকের গোড়া থেকে ঠেলে উপরে তুললেন।মুখের পান এক সাইড করে বললেন,
– তোমাদের আজ গণিত খাতা দেখানো হবে।তাই সবাই তৈয়ারি হয়ে যাও নিজের কর্মফলের সম্মুখীন হতে।
বলেই তিনি কাঠের ঘুণে খাওয়া টেবিলের উপর থেকে খাতার বান্ডিলে থাকা রশিটি একটানে গিট ছাড়িয়ে ফেললেন।আর সে দৃশ্য দেখে শরীর নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো আভা।শুঁকনো ঢোক গিলে নিলো কয়েকটি।ডান হাতে বৃদ্ধ আঙুল দিকে অনবরত বেঞ্চে খোঁচাতে লাগলো।ভীত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মৃণাল স্যারের দিকে।বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মৃণাল কান্তি,
কেড়ে নিলো আমার সব সুখ শান্তি!”
তৎক্ষনাৎ বেঞ্চের উপর রাখা হাতে একটি আঘাত পড়লো।পাশ ফিরতেই দেখলো পূর্ণতার সতর্ককরণ চাহনি।ইশারায় চুপ থাকতে বললো।মৃণাল স্যার তার চোখের চশমাটি আবারও এক দফা উপরে ঠেলে দিলেন।বান্ডিলের সর্বপ্রথম খাতাটি হাতে নিয়ে চমশার উপর থেকে মণি বেরিয়ে খাতাটি একবার দেখে নিলেন।খাতাটি উঁচিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
– ৯৬ পেয়েছে।তোমরা কি বলতে পারবে খাতাটি কার?
সকলে একসঙ্গে কন্ঠ উঁচিয়ে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা।
হাসলেন স্যার।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে পূর্ণতার দিকে খাতাটি এগিয়ে দিলেন।পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সহিত খাতাটি গ্রহণ করলো।তার বর্তমান অনুভূতি অপ্রকাশ্য।বোঝা দায় সে কি নম্বরটি শুনে খুশি হলো নাকি অখুশি হলো।পূর্ণতার অনুভূতি বোঝার জন্য সকলে একপলক পূর্ণতার দিকে তাকালো।তবে বরাবরের মতো পূর্ণতাকে অনুভূতিশূণ্য দেখে ঘাড় ফিরিয়ে নিলো সবাই।একে একে সকলের খাতা হস্তান্তর করা হলো।সর্বশেষ পালা এলো আভার।খাতাটি হাতে নিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেললেন মৃণাল কান্তি দাস।চোখ গরম করে দৃষ্টি ফেললেন আভার দিকে।আভা মুখের সামনে হাত দিয়ে নিজে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো।মৃণাল স্যার এগিয়ে এসে খাতাটি একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললেন আভার সামনে।ক্ষিপ্র স্বরে বললেন,
– এটা কি হাতের লেখা?মনে হচ্ছে তেলাপোকার পায়ে কালি মিশিয়ে খাতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।নম্বরটা দেখ একবার কত পেয়েছ।
পিটপিট করে সংকোচের সহিত খাতার দিকে চায়লো আভা।খাতার একদম উপরিভাগের বামদিকে কোণায় লাল কালিতে বড় করে লেখা রয়েছে দুটি সংখ্যা।একটি শূণ্য এবং একটি তিন।শূণ্যের অবস্থান বরাবরের মতো আগে।তার ঠিক পরই তিন লেখা এবং তার পাশেই একটি বড় হাতে এফ লেখা।খাতার এমন বেহাল দশা দেখে আভা নিজেও নাক কুঁচকে ফেলল।আভার ভাবগতি মটেও মনে ধরলো না মৃণাল স্যারের।রাগি স্বরে আবারও বলতে লাগলেন,
– তোমার ভাইও এই স্কুলের ছাত্র ছিল আর তুমিও এই স্কুলের ছাত্রী।একজন স্কুলের নাম রোশন করে গিয়েছে আর একজন নাম ডুবিয়ে দিচ্ছে।তোমার ভাই গণিতে নব্বইয়ের ঘর থেকে কখনো নড়েনি।আর সেখানে তুমি আজ পর্যন্ত নয়টা মার্কও তুলতে পারলে না।
মলিন মুখে মাথা নত করে সবগুলো কথা হজম করে নিল আভা।গণিত স্যারের এসব বকাঝকা তার কাছে নতুন নয়।সকল সাবজেক্টে সে লেটার মার্ক এমন কি খুবই হাই মার্কও নিয়ে আসে।তবে কথা ওঠে তখন যখন সে গণিতে পাশ মার্কটাও তুলতে অক্ষম।সে আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারে না সে গণিতে এতো বেশি দূর্বল কেন?ছোট থাকতে তো ঠিকই নিরানব্বই-আটানব্বই নিয়ে আসতো।তার প্রিয় বিষয় ছিল গণিত।তাহলে এখন কি হলো?এখন গণিত কেন তার একমাত্র ভয়ের কারণ?মৃণাল স্যার সরে গেলেন আভার পাশ থেকে।বোর্ডে একটি অংক তুলে দিয়ে বললেন,
– এটা সবাই করে দাও এখন।আমি দেখবো।
পূর্ণতা স্বভাব সুলভ অংকটি করতে শুরু করলো।আভাকে জ্ঞান হারিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকতে দেখে তাকে একটি ধাক্কা দিলো পূর্ণতা।ধ্যান ভাঙ্গলো আভার।মলিন দৃষ্টিতে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে অংকটি তুলে নিতে খাতায় কলম চালালো আভা।আকস্মিক তার শরীরে শক্ত সাদা একটি বস্তু এসে পড়লো।শরীর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়লো বস্তুটি।সহসা এমন ঘটনায় চমকে উঠলো আভা।পরক্ষণে পায়ের কাছে একদলা কাগজ দেখে হাফ ছাড়ে সে।পিছন ফিরে কাগজটি উড়ে আসার উৎস দেখতে চায়লে দৃষ্টি আঁটকালো তার সারির পরের সারিতে বসা একটি শ্যাবর্ণের ছেলেকে।আভার দিকে নিজের ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে তাকিয়ে আছে।চোখ ছোট করলো আভা।নিচু হয়ে কাগজটি তুলে ভাঁজ খুললো।দেখতে পেলো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা,”ফেল্টুশ”
মাথায় খুন চড়ে গেল আভার।ফোঁসফোঁস শ্বাস ছেড়ে চোখ ফেড়ে তাকালো ছেলেটির দিকে।শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কাগজটি ছুঁড়ে মারলো ছেলেটির দিকে। ছেলেটির গায়ে কাগজটি লাগতেই মৃদু আওয়াজ সৃষ্টি হলো।যে আওয়াজ লক্ষ্য করে ধ্যান দিলেন মৃণাল স্যার।আভাকে ক্ষুব্ধ চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃণাল স্যার যা বোঝার বুঝে গেলেন।হুংকার ছেড়ে আভার উদ্দেশ্য বললেন,
– এই বেয়াদ’ব মেয়ে।ক্লাসের ভিতর কি হচ্ছে এসব?একে তো অংকে করবে ফেল তার উপর অংক করতে দিলেও ক্লাসে তামাশা শুরু করে দেও।যাও বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে।আমার ক্লাসেই আর আসবে না তুমি।যাও বাহিরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।বের হও এক্ষুনি।
উঠলো না আভা ঠাঁই শক্ত পাথর হয়ে বসে রইলো।নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে লাগলো।পূর্ণতা করুণ চোখে চেয়ে রইলো তার পাশে থাকা সোনালি বর্ণের মেয়েটির দিকে।মৃণাল স্যার আভার কোনো হেলদোল না দেখে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললেন,
– এই মেয়ে কথা কানে যায় না?বের হয়ে যেতে বলেছি তোমাকে ক্লাস থেকে।গেট লস্ট ফ্রম মাই ক্লাস রাইট নাও।
স্যারের কথা শেষ হতেই ব্যাগ নিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে এলো আভা।টান টান চিকন চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করলো।অসম্ভব রকম জ্বলতে শুরু করলো তার ঘন কালো পাপড়িতে ঢাকা টানা টানা চোখ দুটি।সরু নাকটির আগাও রক্তিম হয়ে চেয়ে আছে।পাতলা ক্ষীণ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘাড় আগলে থাকা কোঁকড়ানো চুলগুলোর এক অংশ ডান হাতে চেপে ধরলো সে।এমন অপমান তাকে আগেও করা হয়েছে।কিন্তু আজ যেন তার সকল সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেল।আভাকে দাঁতে দাঁত পিশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতর থেকে মৃণাল স্যার বললেন,
– কান ধরে দাঁড়াতে বলেছি না?শিক্ষকের কথা অগ্রাহ্য করো কত বড় বেয়াদ’ব।দাঁড়াও আজই তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো।
মৃণাল স্যারের কথা কানে আভা যেতেই কানে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা উষ্ণ নোনাজল।নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করলো আভা।নিঃশব্দ কান্নায় সারা মুখ ধারণ করলো রক্তিম বর্ণে।তবে গায়ের সোনালীবর্ণের দরুন সে লালিমার সেভাবে বহিঃপ্রকাশ হলো না।লালাভা দুইগালে ছড়িয়ে যেতেই ডান চোখের নিচে থাকা অতি ক্ষুদ্র কুচকুচে কালো তিলটি জাগ্রত হলো দৃঢ়ভাবে।বারান্দা অতিক্রম করার সময় অন্যান্য ক্লাসের কয়েকজন
ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো,”দেখ আফ্রিকান কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।”
“মনে হয় ম্যাথ খাতা দেখিয়েছে”
“আমার মনে হয় ও এই ম্যাথের জন্যই আদুবোন হয়ে আজীবন স্কুলে রয়ে যাবে!”
“যা বলেছিস!হা হা..”
আভা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাদের দিকে তারা বেশ আতংকিত হয়ে একে অপরকে ধরে সেখান থেকে দ্রুত পা চালিয়ে সরে এলো।কিছু সময় পাড় হতেই মৃণাল স্যারের গণিত ক্লাস শেষ হলো।সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।যাওয়ার সময় দরজার পাশে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আঁড়চোখে একবার দেখে গেলেন।আভা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।পূর্ণতা করুণ স্বরে তাকে বলল,
– তুই আমার কাছে একঘন্টা করে গণিত করিস প্রতিদিন।আমি তোকে শিখিয়ে দিবো সব।
মাথা তুলে পূর্ণতার চোখে চোখ রাখে আভা।আলতো হেসে জরিয়ে ধরে পূর্ণতাকে।পূর্ণতা কোমল হাত বুলিয়ে দেয় আভার পিঠে।আভা চট করে পূর্ণতাকে ছেড়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– জানিস আজ কে আসছে?
পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– কে?
– ভাইয়া আসছে আজ রাতে ল্যান্ড করবে।যাবি আমার সাথে এয়ারপোর্টে?
পূর্ণতা আনমনা স্বরে বলল,
– অভয় ভাইয়া আসছে?
পূর্ণতা তার লম্বা দু’টো বেণিতে হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাতে লাগল।আভা তা দেখে মুচকি হাসে।পূর্ণতাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো বল যাবি এয়ারপোর্টে আমার সাথে?গেলে আমি আর তুই একসাথে যাবো আম্মুরা আম্মুদের মতো যাবে।
মুখে কোনো উত্তর দিলো না পূূর্ণতা।ঘাড় ডান দিকে কাত করে বোঝালো সে যেতে ইচ্ছুক।খুশিতে পূর্ণতার সাথে আরো একবার আলিঙ্গন সেরে ফেলল আভা।রওনা হলো বাসার দিকে।
———————————
বাড়িতে বিশাল বড় তোড়জোড় চলছে।বংশের বড় ছেলে আজ দেশে ফিরছে।দুই কাকা-কাকিসহ বাবা-মা সকলের আনন্দ যেন আজ সীমাহীন।মায়ের আনন্দ সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো।সে সবাইকে ধরে ধরে বলছে “আজ আমার ছেলে আসছে!”বাড়িতে এতো তোড়জোড় দেখে বহু উৎসুক জনতাও ভীড় করছে বাড়িতে।বাড়ির বড় বউয়ের এমন বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ দেখে সকলে ঠোঁট চেপে হাসছে।এলাকার লোকও বেশ আগ্রহী প্রবাসী ছেলেটিকে দেখার জন্য।এই গ্রাম থেকে ছেলেটিই প্রথম বিদেশ পাড়ি দিয়েছে।তার করদই আলাদা!তাকে একনজর দেখতে এলাকার মানুষ ভীড় করেছে মুন্সী বাড়িতে।চারবিঘা জমির উপর বিশাল বড় এক দালান বাড়ি।এলাকার সবাই “বাগান বাড়ি” নামে এক নামে চেনে মুন্সী বাড়িকে।এখান থেকে দেড় ঘন্টার পথ অতিক্রম করলেই শহর।সেখানের এয়ারপোর্টেই ল্যান্ড করবে আজ মুন্সী বাড়ির প্রবাসী বড় ছেলে।
বাড়ির সামনে জনসমুদ্র দেখে হতবিহ্বল হলো আভা।কিছুসময়ের জন্য ভাবলো “কি ব্যাপার বাড়িতে এতো ভীড় কেন?কারো কিছু হলো নাকি?” ভাবতেই সবার আগে মস্তিষ্কে এলো দাদির কথা। তার দাদি বেশকিছুদিন ধরে শয্যাশায়ী।আর তার আবদারেরই দেশে ফিরছে বাড়ির বড় ছেলে।শ্বাস ঘন হলো আভার পা চালিয়ে ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।বসার ঘরে ছোট চাচিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ছোট আম্মু দাদি ঠিক আছে?বাড়িতে এতো মানুষ কেন?
আলতো হাসে আভার ছোট চাচি।সহসা ভাসুরকে বসার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে কাতান শাড়ির আঁচল টেনে মাথা আগলে নেয়।আভার বিধস্ত চেহারা দেখে আভাকে আশ্বস্ত করে,
– মা ঠিক আছে।ওরা তো অভয়কে দেখতে এসেছে।তুই ঘরে গিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে খেতে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।
নাক মুখ কুঁচকে ফেলল আভা।বাইরে তাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
– বুঝলাম না এই বাদরটাকে দেখার কি আছে।ও নিশ্চয়ই আমার থেকে সুন্দর না!হুহ্!
কথাটি শেষ করেই নিজের ঘাড় আগলে থাকা কোঁকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে উড়িয়ে মুখ ভেঙচি দিলো।আরাভ মুন্সী মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন মেয়ের কাছে।মেয়ের মাথায় হাত রেখে আদুরে সুরে বললেন,
– ঠিকই তো।আমার মেয়ের মতো সুন্দর কেউ নেই।
বুক ফুলালো আভা।কোমরে হাত দিয়ে অহংকারী স্বরে বলল,
– হ্যাঁ। আমার মতো সুন্দর কেউ নেই।কারো গায়ের রং কি সোনালী হয় বলো বাবা?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো আরাভ মুন্সী।অর্থাৎ কারো গায়ের রং সোনালি হয় না।আভার বাবার সম্মতি পেয়ে আরো অহংকারী হয়ে উঠলো আভা আবার বলতে শুরু করলো,
– আমার গায়ের রং সোনালী।আমার চোখ দেখেছ কত টানা টানা কত চিকন।আর চুল এমন ঘন কালো কোঁকড়া চুল তুমি কোথাও পাবে বলো বাবা?
আরাভ সাহেব একটু ভেবে নিজের মাথা হাত দিয়ে বললেন,
– আমার মাথায়ও তো কোঁকড়া চুল!
দমে গেল আভা।নিজের ভিতর কথা সাজাতে কিছুক্ষণ সময় নিলো।অতঃপর আবার আগের ন্যায় অহংকারী কন্ঠে বলল,
– ওটার ডেট এক্স পেয়ার হয়ে গিয়েছে কিছুদিন পর আর থাকবে না।
মেয়ের কথায় চোখ বড় বড় করে ফেললেন আরাভ।বাবা-মেয়ের কথপোকথনে ফোড়ন কাটলেন আভার মা প্রেমা।বললেন,
– হয়েছে রোজ একবার করে নিজের প্রসংশা করে কি বোঝাতে চাও তা আমি খুব ভালো করেই জানি।
থতমত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো আভা চোখের মণি এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলো।প্রেমা আবারও বললেন,
– বিয়ের শখ হয়েছে সেটা বারবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাদের না বললেও হবে।
আরাভ মুন্সী বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তোমার আম্মু এসব কি বলছে আভামণি?
আভা তড়িঘড়ি দু’হাত নাড়িয়ে বলল,
– এসব মিথ্যা আব্বু।আমার একটুও বিয়ের শখ হয়নি।আম্মু তুমি এসব ভুলভাল কি বকছো?কিসের মধ্যে কি টেনে আনলে তুমি এটা?
– তাহলে তুমি রোজ রোজ নিজের ঢাক নিজেই বাজাও কেন?মানুষের যখন বিয়ের শখ জাগে তখন সে এমনভাবে নিয়ম করে দিনে পাঁচবেলা নিজের ঢাক নিজে পেটায়।পড়াশোনায় তো রসগোল্লা। আজ কি খাতা দেখিয়েছে?কত পেয়েছ?
প্রেমার কথা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত হলো আভার থেকে তিনবছরের বড় একজন তরুণ।সবে আঠারো ছুঁয়েছে।আভাকে টিটকারি করে বলল,
– আরে বড় আম্মু বিয়ের শখ জাগলেই কি হলো নাকি?বিয়ের বয়সও তো হওয়া লাগবে।এখনো নাক টিপলে দু’ধ বের হবে।
বলতে বলতে ছেলেটি এগিয়ে এসে আভার মাথায় একটি গাট্টা মেরে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলো আভা,
– আম্মু….
আভাকে চেঁচাতে দেখে ছেলেটিও আভারকে অনুকরণ করে মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
– হাম্মু..সারাক্ষণ শুধু হাম্বা হাম্বা।যাহ্ গিয়ে কাপড় ছাড়!
উপস্থিত সবাই হাসলো আভা এবং ছেলেটির কর্মকান্ডে। প্রেমা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– খেতে আয় সূর্য…
চলবে…?
#প্রিয়_বালিকা |২|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
আভা ঘরে ঢুকেই সবার প্রথমে ব্যাগ থেকে নিজের গণিত খাতাটি বের করলো।আল্লাহর কাছে মাফ চায়তে চায়তে খাতাটি সুন্দর করে ভাঁজ করে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।কাঁদো কাঁদো মুখে হাত জোর করে আরো একবার মাফ চায়লো আল্লাহর কাছে।চোখ মুখ খিঁচে মোনাজাত ধরলো।মোনাজাতে তার চাওয়াটা ছিল “হে আল্লাহ এবারের মতো মাফ করে দাও।এবারই শেষ। এরপর যে করেই হোক পাশ করার চেষ্টা করবো।অনেক পড়াশোনা করবো।শুধু তুমি এবারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।” নিজের মনের সব আর্তনাদ ঝেড়ে পরিষ্কার হওয়ার উদ্দেশ্যে বাথরুমে প্রবেশ করলো।সে খাতা এভাবে ফেলে দিয়ে নিজের কাছেই খুব অপরাধ বোধে ভুগছে।না জানি কত বড় পাপ করে ফেলল!কিন্তু বাড়ির লোককে খাতা দেখালে তো এর থেকে আরো বড় পাপ হবে!বাড়িতে টেকাই দুঃষ্কর হয়ে যাবে।আল্লাহর কাছে পাপের ক্ষমা পাওয়া সহজ কিন্তু মানুষের কাছে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমা পাওয়া যায় না।আর এই ধারণাকে পোষণ করেই আভা যা পাপ করার আল্লাহর কাছে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুপুর তিন কি সাড়ে তিন।গোসল সেড়ে খাবার ঘরে প্রবেশ করে আভা।খাবার ঘরে কাউকে দেখা গেল না।খাবার ঘরের পাশে থাকা বড় রান্নাঘরেও কোনো জনমানবের হদিস পাওয়া গেল না।ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো আভার।কিছুক্ষণ ভেবে অনুমান করার চেষ্টা করলো সকলে এই মুহুর্তে কোথায় থাকতে পারে।মস্তিষ্ক ক্লান্ত হতেই হাক ছাড়ল আভা,
– মা ও মা?মা?
মেয়ের ডাকে কোথা থেকে ছুটে এলেন প্রেমা।চটজলদি থালা বের করে খাবার সাজিয়ে দিলেন কাঠের টেবিলের উপর।আভা কাঠের চেয়ারগুলোর একটি চেয়ার টেনে সেখানে খেতে বসলো।খাবার মুখে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
– তোমরা কখন যাবে?
প্রেমার সহজ স্বাভাবিক জবাব,
– আমরা তো সন্ধ্যার দিকে বের হবো।
প্রেমার মস্তিষ্কে হঠাৎ কোনো কথা ধরা দিতেই সে কপাল কুঁচকে সন্দিহান স্বরে আভাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– কেন তুই যাবি না আমাদের সাথে?
খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেল আভা।একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল।গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিল।বাম হাত দিয়ে নিজের চুলের এক পাশ ছুঁয়ে দিলো।ঢোক গিলে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
– যাবো।কিন্তু!
কপালের মাঝে আরো দু’টি ভাঁজ বৃদ্ধি পেল প্রেমার।তার গম্ভীর চাহনিতে আভা নিজের পাতলা দুই ঠোঁট ভাঁজ করে নিলো।প্রেমা প্রশ্ন করলেন,
– কিন্তু কি?
আভা আমতা আমতা করে মায়ের কাছে ধরা দিলো,
– আমি ভেবেছিলাম আমি আর পূর্ণতা যাবো।আমি ওকে আসতে বলেছি।
– ভালো। ও যাবে তাহলে আমাদের সাথে তাতে এতো আমতা আমতা করার কি আছে?
আভা চোরা কন্ঠে বলল,
– বলছি যে আমরা একাই চলে যেতে পারবো।
ব্যস!এই একটা বাক্যই প্রেমার রাগ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো।সে চোখ গরম করে কঠিন স্বরে জবাব দিলেন,
– এই কথাটা বলতেও তোমার বুক কাঁপলো না?এটা কি এখান থেকে পাড়ার স্কুল যে তুমি এখনই যাবে আবার এখনই আসবে?দেড় ঘন্টার পথ একা যেতে চাও?কত বড় হয়ে গিয়েছ তোমরা?দাঁড়াও আজই তোমার বাবাকে বলছি তোমার পাখনা গজিয়েছে।
কথাগুলো বলতে বলতে খাবার ঘর ত্যাগ করলেন প্রেমা।আভা মায়ের যাওয়ার দিকে ভীত চাহনিতে চেয়ে একটি শুঁকনো ঢোক গিলল।মনে মনে ভাবল “মা নিশ্চয়ই বাবাকে কথাটা ইনফর্ম করতে গিয়েছে।মা তো আবার বাবাকে কোনো কথা না বলে থাকতেই পারে না।বাবা মায়ের বেস্টফ্রেন্ড কিনা!” চিন্তায় পড়ে গেল আভা।এবার যদি আভার যাওয়াটাই বরবাদ হয়ে যায় তখন কি হবে?আভা নিজেই নিজের মাথায় একটি চাটি মারলো। দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়িয়ে বলল,”ধূর বাবা!এতো পাকামি করতে কে বলেছিল আভা তোকে?এখন যাওয়াটাই না বরবাদ হয়ে যায়।”
আস্তেধীরে খাবার শেষ করে ঘরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইলো আভা।যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর সে ঘর থেকে বের হবে না।একেবারে যাওয়ার সময় জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে বাহিরে যাবে।পরিপাটি হয়ে বের হলে নিশ্চয়ই তাকে ফেলে চলে যাবেনা।এতোটা নিষ্ঠুর নয় তার বাড়ির লোক।ঘরে বসে বসে নিজেকে যত রকমভাবে শান্তনা দেওয়া সম্ভব সবরকম কৌশল প্রয়োগ করছে আভা।
আসরের আযান পড়তেই বাড়ির সদর দরজায় কড়া নড়ে।দরজা খুললেন বাড়ির ছোট বউ আইরিন সুলতানা।খুবই চুপচাপ গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে তিনি।সংসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে তিনি সর্বদা সচল।দরজা খুলে পূর্ণতাকে দেখে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে।হাসির সাথে জিজ্ঞেস করলেন,
– কেমন আছ পূর্ণতা?
পূর্ণতাও আইরিনের হাসির বিনিময়ে এক গাল হাসি উপহার দিলো তাকে।পূর্ণতার কন্ঠে বিনয়ী সুরে জবাব এলো,
– জ্বী আন্টি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?বাসার সবাই কেমন আছে?
– সবাই ভালো আছে,ভিতরে আসো।
ভিতরে প্রবেশ করলো পূর্ণতা।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আভা কি ওর রুমে?
অনিশ্চিত জবাব দিলেন আইরিন,
– হয়তো। দুপুরে খাবার খেয়ে সেই ঘরে গিয়েছে আর বের হয়নি।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
পূর্ণতা কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর আইরিনকে বলে আভার ঘরে চলে এলো সে।আভা খাটে চিত হয়ে মূর্তির মতো শক্ত হয়ে শুয়ে আছে।চোখের মণি উপরে ঘরের ছাঁদে নিবদ্ধ। পূর্ণতা নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো।আভার পাশে বসে ধাক্কা দিলো আভাকে। বলল,
– তুই আমাকে আসতে বলে এখনো শুয়ে আছিস?যাবিনা?সবাই কখন বের হবে?
হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠলো আভা।পূর্ণতাকে দেখে উঠে বসলো।টুকটাক কিছু কথা শেষ করে চলে গেল রেডি হতে।
মাগরিবের আযান দিতে আধ ঘন্টার মতো বাকি।বাড়ির সামনে ভাড়া করে আনা একটি মাইক্রোবাস।পাশেই একটি মোটরসাইকেল।বাড়ির সকলে যাচ্ছে না।শুধু আরাভ মুন্সি এবং তার মেঝো ভাই।সাথে আভা এবং পূর্ণতা।মোটরসাইকেলে যাচ্ছে সূর্য।মোটরসাইকেল চালিয়ে এতোটা পথ যাওয়ার জন্য তাকে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে।বাড়ির সকলের সম্মতি পেতে তাকে নাকের জল চোখের জল এক করতে হয়েছে।দূর থেকে আভা আর পূর্ণতাকে আসতে দেখে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্য নিজের চেহারাটা আয়নায় আরেকবার দেখে নিলো।চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিলো।মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে নিশ্চিত হতে চায়লো তাকে কোন পোজে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।আভা এবং পূর্ণতা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো। আভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তুই যাচ্ছিস কোন দুঃখে?
সূর্য মুখ উঁচু করে ভাবের সহিত বলল,
– দুঃখে যাবো কেন?ভাই আসছে সেই সুখে যাচ্ছি।
আভা কথা বাড়ালো না অপেক্ষা করতে থাকলো তার বাবা চাচার জন্য।সূর্য তার আঁকা বাঁকা দাত বেরিয়ে এক ভুবন ভুলানো হাসি দিলো।পূর্ণতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– পূর্ণতা তুমি চাইলে আমার সাথে আমার বাইকের পিছনের ছিটে যেতে পারো।দু’জনে মিলে চাঁদের দেশে যাবো।
দম ফাটা হাসি ছাড়লো আভা।পেটে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল।হাসতে হাসতে পূর্ণতার শরীরের উপর ঢলে পড়লো সে।পূর্ণতাও ঠোঁট চেপে হাসল।আভা হাসি থামিয়ে সূর্যকে বলল,
– তুই যা চান্দের দেশে আমাদের এখন সময় নেই।আমাদের এখন এয়ারপোর্টে যেতে হবে।তুই গিয়ে খুঁটি বসাতে থাক আমরা ভাইকে রিসিভ করেই আসছি।
সূর্য মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। আভা আর পূর্ণতা হাসি তামাশা করতে করতে মাইক্রোবাসে উঠে বসলো।কিছুক্ষণের মধ্যে মাইক্রোবাস ছেড়ে দিলো নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
একটু আগেই প্লেন ল্যান্ড করেছে।তবে যাত্রীরা এখন এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়নি।মুন্সি বাড়ির বড় ছেলেকে নিতে আসা সকলের দৃষ্টি এই মুহুর্তে এয়ারপোর্টের দরজার দিকে।কখন তাদের ছেলে বেরিয়ে আসবে।সকলে উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে রয়েছে।সবার একটিই উদ্দেশ্য “অভয়কে দেখবে।”প্রায় সাত মাস পর অভয়কে এতো কাছ থেকে দেখবেন তারা।সকলের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আসন পেতে বসে আছে।সকলের দীর্ঘ প্রতীক্ষার বাধ ভেঙে দৃশ্যমান হলো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি।সাদা পোলো শার্টের নিচে কালো প্যান্ট।মাঝারি আকারের শারীরিক গঠন উজ্জ্বল শ্যামলা ছেলেটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।মাথার লম্বা লম্বা সামান্য কোঁকড়া চুলগুলো একপাশ করে আঁচড়ে রাখা।হাসি মুখে নিজের পরিবারের দিকে এগিয়ে এলো সে।প্রথমেই নিজের বাবাকে আলিঙ্গন করল।একে একে চাচা এবং সূর্যের সাথে আলিঙ্গন সেড়ে আভাকে জরিয়ে ধরলো।লম্বা ভাইয়ের বগলের নিচে আদুরে আভা বিড়াল ছানার মতো লুকিয়ে পড়লো।অভয় বোনের মাথায় আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে বলল,
– আমার আভামনিটা কেমন আছে?
আভা আহ্লাদী স্বরে উত্তর দিলো,
– ভালো আছি ভাইয়া তুমি কেমন আছো?
– ভালো আছি।
অভয়ের নজরে পূর্ণতা আসতেই সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
– একিরে তুই এখনো এর সাথে ঘুরিস পূর্ণ?
স্মিত হাসলো পূর্ণতা।বলল,
– কেন? না ঘোরার কথা ছিল নাকি?
অভয়ও হাসলো।আভাকে সরিয়ে বলল,
– আমি তো ভেবেছিলাম তুই হয়তো ফেল্টুশটার সাথে আর মিশবিই না।যে হারে ফেল করে ও।ওর সাথে কেউ মিশলে সেও নির্ঘাত ওর মতো ডাব্বা মার্কা স্টুডেন্ট হয়ে যাবে।
আভা কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
– এসে পারলে না অমনি আমার নামে বদনাম শুরু করে দিলে?
হাসলো অভয়।এতোক্ষণে সকলের নজর আঁটকালো অভয়ের পাশে চুপচাপ গম্ভীর ভঙ্গিতে সকলকে পর্যবেক্ষণ করা বিশাল উচ্চতার ধবধবে সাদা ছেলেটিকে।সাদা ত্বকের সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে মোড়ানো। কালো ক্যাপের নিচ থেকে সকলকে নিজের শিকারি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে সে।অদ্ভুত সে দৃষ্টিতে থমকে গেল সবাই।অভয় সকলকে নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে নজর দিতে দেখে মৃদু হাসল।বলল,
– ও আমার বন্ধু। আমরা একসাথে পড়ি এবং একসাথে থাকি।
এতক্ষণে ছেলেটি তার মোটা কন্ঠস্বরে ধ্বনি তুলে উচ্চারণ করল,
– আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন সবাই?
বিদেশি কোনো ব্যক্তির মুখে সুস্পষ্ট বাংলা শুনে আরো একদফা চমকে উঠলো সবাই।অভয় সকলের চমকানোর কারণ বুঝতে পেরে বলল,
– ওর বাবা-মা বাংলাদেশি।ওর জন্মের আগেই বিদেশে চলে যায়।কিন্তু ও বাংলা পারে।ওরা বাসায় বাংলায় কথা বলে।
সকলের মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক হলো।সকলে অভয়ের বন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় সেড়ে ফেলল।আভা থমথমে মুখে গোল গোল চাহনিতে ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে বিশ্লেষণ করে চলেছে।কালো ক্যাপের নিচ থেকে কপাল জুড়ে থাকা কালো চুলগুলোর কিছু অংশ বোধগম্য। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো তার শিকারী চাহনি।ভয়ংকর সে চাহনিতে গা ছম ছম করে উঠলো আভার।শরীরের সব-কটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।নিজের হাতের দিকে চেয়ে কেঁপে উঠলো আভা।নিজের ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কান ধরে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এলো।অভয়ের ভ্রু কুঁচকে এলো।আভা অভয়ের কানে ফিসফিস করে বলল,
– আচ্ছা ভাইয়া তোমার বন্ধু কি মানুষ খুন করে?
অভয় চোখ গরম করে বোনের দিকে তাকিয়ে তার মতোই হিসহিসিয়ে বলল,
– আজেবাজে কি বলছিস এসব।মুখ বন্ধ রাখ।
অভয়ের বাবার ছেলেটিকে বেশ মনে ধরেছে।হেসে খেলে কত কথা সেড়ে ফেলল ছেলেটির সাথে।হঠাৎই আরাভের কিছু মনে পড়তেই সে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল,
– দেখেছ এতো কথা বললাম অথচ তোমার নামটাই শোনা হলো না।
ছেলেটি আবার তার সেই ভরাট মোটা কন্ঠে জবাব দিলো,
– আফসিন রৌদ্র।
চলবে..?