প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪৭+৪৮

0
533

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৭
জাওয়াদ জামী জামী

তাহমিদ বেরিয়ে গেলে রাশেদ কুরাইশি আরেকবার সেই বয়স্ক মেইডের কাছে যান। তাকে মনে জমে থাকা কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। মেইডও সব প্রশ্নেরই সত্যি উত্তর দেয়। এরপর তিনি ফোন করলেন শাহানা আক্তারকে। তাকেও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন।

রাশেদ কুরাইশি রুমে এসে দেখলেন তাদের ফ্যামিলি ডক্টর ডেইজি কুরাইশির চিকিৎসা করছেন। ডেইজি কুরাইশি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা সে ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে।
বিছানার পাশে রায়ান, জাহিয়া বিরসবদনে বসে আছে। ডক্টর মনোযোগ দিয়ে ডেইজি কুরাইশির চিকিৎসা করছেন। রাশেদ কুরাইশিকে দেখে তিনি মৃদু হাসলেন।

” ডক্টর, ডেইজির শারিরীক অবস্থা এখন কেমন? ”

” দেখুন মিস্টার কুরাইশি, আজ যেটা ম্যাডামের সাথে ঘটেছে, খুব ভালো কিছু ঘটেনি। আর মিনিট খানেক গেলেই তার মৃ’ত্যু হতে পারত। তবে আমি ঠিকঠাকমতই ম্যাডামের চিকিৎসা করেছি, ইভেন এখনও করছি। এখন তিনি আগের থেকে কিছুটা ভালো আছেন। আশা করছি রাতের মধ্যেই তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ”

” আপনি কি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন? নাকি এখনই চলে যাবেন? ”

” এখন এখানে আমার কোন কাজ নেই। আমি আমার চিকিৎসা দিয়েছি, কেউ একজন প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে ঔষধ এনেছে। এখন ম্যাডামের পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। কাল সকালে একবার এসে দেখে যাব। ”

ডক্টর বেরিয়ে গেলে, রাশেদ কুরাইশি ডিভানে গিয়ে বসলেন।

” পাপা, তুমি তোমার বড় ছেলেকে এমনিতেই ছেড়ে দিলে? এতবড় অন্যায়ের পরও সে পার পেয়ে যাবে? তুমি না মাম্মার হাজবেন্ড! তবে মাম্মার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেনা কেন? ” জাহিয়া আক্রোশের সাথে জিজ্ঞেস করল।

” ডেইজি যেমন আমার স্ত্রী, তেমনি তাহমিদও আমার সন্তান। আমার প্রথম সন্তান। যার মুখে আমি প্রথমবার বাবা ডাক শুনেছি। আজ যদি তোমার মাম্মার সাথে কোন অন্যায় হয়, তবে তার জন্য দায়ী তোমার মাম্মাই। বউমা তার সাতেপাঁচে থাকেনা। তবুও তোমার মাম্মা তাকে কারনে-অকারনে অপমান করেছে। আজ তার জন্যই এতকিছু ঘটেছে। ” রাশেদ কুরাইশি কাটকাট জবাব দিলেন।

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে ডেইজি কুরাইশি চোখ বড় করে তাকায়। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা, তার স্বামী আজ তার ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। আজ যদি সে সুস্থ থাকত, তবে অবশ্যই রাশেদ কুরাইশির এই কথাগুলোর জবাব দিত।

” কি বলছ পাপা! এতকিছুর পরও তুমি মাম্মাকেই দোষী করছ? তুমি কি আসলেই মাম্মার হাজবেন্ড? ” রায়ান হতভম্ব হয়ে গেছে।

” আমি আসলেই তোমার মাম্মার হাজবেন্ড। তবে আজ সবকিছু শোনার পর এই পরিচয় দিতে ঘৃণা হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে, তাকে বিয়ে করা আমার জীবনের বড় ভুল ছিল। সে আমার জীবনে না আসলে, আমার সংসারটা বরবাদ হতোনা। আমার ছেলেটা সব থাকার পরও নিঃস্ব হতোনা। তোমার মাম্মা আমার জীবনে এসেছে আমাকে শেষ করতে। যেদিন থেকে তার সাথে আমার জীবন জড়িয়েছি, সেদিন থেকেই আমার আব্বা-আম্মার সাথে আমার দূরত্ব বেড়েছে। তারা আমাকে ঘৃণা করেছে। মিথিলা সংসার ছেড়েছে। তোমার মাম্মা আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার প্রাপ্তির খাতায় শুধু শূন্য যোগ হয়েছে। ” রাশেদ কুরাইশি ভগ্ন গলায় বললেন।

ডেইজি কুরাইশি সব শুনে উঠে বসল। সে রা’গে ফুঁসছে। কিন্তু শরীরে তিল পরিমান শক্তি না থাকায় কিছু বলতে পারছেনা।

” পাপা, তুমি আমাদের সামনে মাম্মাকে এভাবে ইনসাল্ট করতে পারনা। সেই অধিকার তোমার নেই। তোমার ঐ ইডিয়ট ছেলের জন্য তুমি মাম্মাকে ইনসাল্ট করছ? তবে একটা কথা শুনে রাখ, তুমি মাম্মার পাশে না থাকলেও আমরা তার পাশে আছি। তবে আজ হঠাৎ করে, ঐ ইডিয়টের জন্য তোমার দরদ দেখে আমরা অবাক হচ্ছি। ”

” মুখ সামলে কথা বল। তাহমিদ ইডিয়ট নয়। ও হলো খাঁটি সোনা। বরং তোমরাই ইডিয়ট। ও ছোট থেকেই নিজের পরিশ্রম, মেধায় এতদূর এসেছে। যেখানে ওর পাশে বাবা-মা কেউই ছিলনা। কিন্তু তোমরা? তোমাদের কাছে সবাই থাকার পরও পেরেছ ভালো কিছু করতে? আমার টাকা দিয়ে বছর বছর সার্টিফিকেট কিনছ, আমার টাকায় বিলাসিতা করছ। একা একা কিছু করার যোগ্যতা আছে তোমাদের? কিন্তু তাহমিদের এই পর্যন্ত আসতে কাউকে লাগেনি। এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখ, কে আসলে সত্যিকারের ইডিয়ট। ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে রায়ান, জাহিয়া দুজনেরই মুখ কালো হয়ে গেছে। ওরা তাদের বাবার কথার যুৎসই জবাব খুঁজছে।

” পাপা, প্লিজ। এবার থাম। আজ তুমি বেশি বেশি করছ, সেটা কি তোমার একবারও মনে হচ্ছেনা? আমরা তোমার ঐ ইডিয়ট ছেলের নামে কোন গুনগান শুনতে এখানে বসে নেই। আমরা তার করা অন্যায়ের শাস্তি চাই। তাকে তুমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে এই মুহূর্তে বের করে দিবে। তুমি যদি এটা করতে পার, তবে আমরাই এটা করব। এই বাসায় ওর আর কোন জায়গা নেই। ”

” সাট-আপ। তাহমিদকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার তুমি কে? মনে রেখ, তুমিও আমার বাসায় থাক। আমার প্রপার্টিতে তোমার আর জাহিয়ার যেমন অধিকার আছে, তেমনই তাহমিদেরও অধিকার আছে। এই বাড়ি যতটুকু তোমার, ততটুকু তাহমিদেরও। তবে তোমার সাথে ওর পার্থক্য কোথায় জানো? তুমি একটা স্বার্থপর, লোভী। আর ও নির্লোভ। সেজন্যই বোধহয় নিজ থেকে সব অধিকার ছেড়ে, এই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে ও যেখানেই যাক না কেন, সময়মত ওর প্রপার্টি ওকে বুঝিয়ে দেব।”

” না পাপা, তুমি এটা করতে পারনা। তুমি ওকে কিছুই দিতে পারবেনা। এটা আমরা হতে দেবনা। তোমার প্রপার্টির অংশীদার শুধু আমরাই। প্রয়োজনে ওকে খু’ন করব। তবুও ওকে কিছুই দিতে দেবনা। ”

রায়ানের কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির কপাল আপনাআপনিই কুঁচকে আসে। তার ছেলে এসব কি বলছে! এতটা লোভ বাসা বেঁধেছে ওর মন-মস্তিষ্কে!

” ভুলেও একাজ করতে যেওনা। আমি আমার সব প্রপার্টির উইল করে রেখেছি। আমার এবং তাহমিদের অস্বাভাবিক মৃ’ত্যু হলে সব প্রপার্টি, ব্যাংক-ব্যালেন্স ট্রাস্টের কাছে চলে যাবে। তোমরা শুধু মাস শেষে ভরণপোষণের জন্য কিছু টাকা পাবে। এবার তুমি ভেবে দেখ তোমাদের জন্য কোনটা ভালো হবে? স্বেচ্ছায় আমার প্রপার্টির ন্যায্য ভাগ নিবে, নাকি মাস শেষে কিছু টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, আর নাকি বাকিটা জীবন গরাদের পেছনে কাটাবে? ” রায়ানকে থামাতে রাশেদ কুরাইশি মিথ্যা বললেন। তিনি যদি তার প্রপার্টি ট্রাস্টে দেয়ার কথা না বলতেন, তবে রায়ান হয়তো সত্যি সত্যি তাহমিদের কোন ক্ষতি করে দেবে। তিনি কখনোই চাননা, তার এক সন্তান আরেক সন্তানের খু’নি হোক৷ তিনি ডিভানে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন, এই জীবনে তাহমিদ যা যা পায়নি, তার সবগুলোই ফিরিয়ে দেবেন । হয়তো তিনি এটা করতে পারবেননা, তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তারা কখনো ভাবতেও পারেনি তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিবেন। রায়ানের এতদিনের সব পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যেতে দেখে, সে নিজেও কম অবাক হয়নি। ও বুঝতে পারছে বাবা যেটা বলেছে, সেটাই করবে।

তাহমিদ কুহুকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেছে। ও আগামী তিনদিনের জন্য রুম বুকিং দেয়। তিনদিনের মধ্যে বাসা না পেলে প্রয়োজনে আরও কয়েকদিন এখানেই থাকবে।

এভাবে বাড়ি ছাড়ায় কুহুর মন খারাপ হয়ে গেছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য সে-ই দায়ী। সে যদি ডেইজি কুরাইশির মুখে মুখে তর্ক না করত, তবে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা।

” কি ভাবছ, বউ? আমাকেও সঙ্গে নাও। তোমার ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনার মিলন ঘটাই। ”
কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ।

” ভাবনার সঙ্গী আবার করা যায় নাকি! আপনিও না। শুধু আবোলতাবোল কথা বলেন। ”

” আমার মত করে একবার ভালোবাসতে শেখ, তবেই বুঝবে ভাবনার সঙ্গী হয় কিনা। তখন দেখবে শুধু ভাবনার নয়, স্বপ্নেরও সঙ্গী হয়। ”

কুহু তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে ওর বুকে নিজের শরীর এলিয়ে দেয়। তাহমিদ শক্ত হাতে তার রমনীকে নিজের মাঝে জড়িয়ে রাখে।

চলবে.….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী জামী

দুই দিন পর সকালে তাহমিদ কুহুকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠল। ওর ভার্সিটির কাছাকাছি হওয়ায় ভাড়া বেশি হলেও ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া করলনা। তাহমিদ ফ্ল্যাটে ওঠার আগেই কয়েকটি ফার্নিচারের অর্ডার দিয়েছে। সেগুলো সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছানোর কথা আছে। কিছুক্ষণ পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে টুকটাক জিনিসপত্র কেনার উদ্দেশ্যে বের হয়। ওরা দুপুর পর্যন্ত গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে।

বাসা গোছগাছ করতে কুহুর দুইদিন লেগে যায়। এদিকে ওর রাজশাহী ফেরার সময়ও হয়ে গেছে। তবে তাহমিদের মনোভাব ও বুঝতে পারছে। বেচারা খুব করে চাচ্ছে, কুহু যেন আর কয়েকটা দিন এখানে থেকে যায়। কিন্তু কুহু নিরুপায়। ওর পরীক্ষা সামনে মাসে। অথচ এখানে আসার সময় শুধু একটা বই-ই নিয়ে এসেছে। আবার তাহমিদের দিকে তাকালে ওর নিজেরও এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করেনা। এখন ও কি করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।

তাহমিদ বেশ রাত করেই বাসায় ফিরছে। ও ভার্সিটির ক্লাস শেষে কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে তবেই বাসায় আসে। সারাদিন কুহুকে একাই থাকতে হয়। তাহমিদ শাহানা ফুপুকে এখানে আসার জন্য কয়েকবার ফোন করেছে। তবে তিনি এখন চিটাগং তার এক ভাগ্নীর বাসায় আছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগামী একমাস তিনি ঢাকা আসতে পারবেননা। কারন তার ভাগ্নীর বেবি হয়েছে। আর সে ভিষণ অসুস্থ। তাই তাকে দেখাশোনার জন্য আপাতত শাহানা আক্তারকে সেখানেই থাকতে হবে। তাহমিদ আর কোন কথা বাড়ায়নি। তবে সে শাহানা আক্তারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এরপর থেকে তার অন্য কোথাও থাকা চলবেনা। শাহানা আক্তারও তাহমিদের কথা মেনে নিয়েছেন।

দরজা খুলেই ক্লান্ত তাহমিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মানুষটা ওকে ভালো রাখতেই কত পরিশ্রম করছে। ওর পাশাপাশি সৃজনের যাবতীয় খরচ সে-ই দিচ্ছে। এছাড়াও বড় ফুপুর কাছে প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠায়। রাজিয়া খালাকেও কিছুনা কিছু সাহায্য করে। একটা মানুষের পক্ষে এটাই অনেক কিছু। যদিওবা রাজিয়া খালা, কুহুর বড় ফুপু তাহমিদের কাছ থেকে কিছুই নিতে চাননা। কিন্তু নাছোড়বান্দা তাহমিদের কাছে তাদের যুক্তি টিকলে তো! পরিশ্রান্ত তাহমিদকে দেখে কুহু দ্রুতই একটা সিদ্ধান্ত নেয়। ও পরীক্ষার আগের দিন রাজশাহী যাবে। সৃজনকে ফোন দিয়ে ওর সব বইগুলো কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিতে বলবে। তার আগে কথা বলতে হবে বড় ফুপুর সাথে। আগামী একমাস ফুপুকে রাজশাহী থাকতে রাজি করাতে হবে। ও কিছুতেই এই মানুষটাকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। তার কাছাকাছি থাকার জন্য দুনিয়া সুদ্ধ মানুষের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। যদিও সেটার কোনই দরকার পরবেনা।

তাহমিদ ভেতরে এসেই কুহুকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটার কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল।

” আমাকে মিস করছিলে বুঝি, বউ? ” তাহমিদের প্রশ্নের জবাবে কুহু হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়।

” কতটা মিস করেছ শুনি? ” তাহমিদ মৃদু হেসে বলে।

” যতটা মিস করলে তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। লোকলজ্জার ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে ইচ্ছে করে। তার আদরীনি হয়ে তারই বুকে অনন্তকাল থাকতে ইচ্ছে করে। চুপটি করে তার ভালোবাসার পরশ শরীরে মাখতে আজন্মের সাধ জাগে। ”

কুহুর জবাব শুনে তাহমিদের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটল। শরীর থেকে নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সে অনেক আগেই বুঝে গেছে, তার ভালোবাসার পোষা পাখিটিও তাকে অনেক ভালোবাসে। আজ আরেকবার নতুনভাবে বুঝতে পারল, এ যে শুধু তারই পাখি। যাকে পোষ মানাতে কোন খাঁচার প্রয়োজন হয়নি। শুধু ভালোবাসা পেয়েই সে তাহমিদের একান্ত আপন হয়ে উঠেছে।

কুহুর ফোন পেয়ে ওর বড় ফুপু দুইদিনের মধ্যেই রাজশাহী আসলেন। সৃজনও কুহুর কয়েকটা বই কুরিয়ারে পার্সেল করেছে। এবার কুহু নিশ্চিন্তে একটা মাস কাটাতে পারবে। কুহুর কাজকর্ম তাহমিদ মনে মনে ভিষণ খুশি হয়। মেয়েটা যে ওর কাছে থাকার জন্য এত আয়োজন করেছে, ভাবলেই ওর কুহুকে দিনরাত বুকে জরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।
তাহমিদ বড় ফুপুর সাথে কথা বলে, তাকে আগামী একমাসের খরচ পাঠিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ভাড়াও পাঠিয়েছে। আগামী একমাস সৃজন আর আর ফুপুর যাতে কোন কষ্ট না হয়, তার সব ব্যবস্থাই করেছে।

রাতে তাহমিদের বুকে মাথা রেখে কুহু মনযোগ দিয়ে পড়ছিল। আর তাহমিদ ফোনে ব্যস্ত আছে। হঠাৎই কুহুর ফোনের শব্দে ওদের দু’জনেরই মনোযোগ ছিন্ন হয়। কুহু ফোন হাতে নিয়েই দেখল রাশেদ কুরাইশির নম্বর। ও আঁড়চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। ততক্ষণে তাহমিদের চোখেও পরেছে কে ফোন দিয়েছে।

” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আপনি কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি ভালো আছি, মা
তুমি কেমন আছো? আমার উজবুক ছেলেটা ভালো আছেতো? ” রাশেদ কুরাইশির তার ছেলের প্রতি সম্ভাষণ শুনে কুহু হেসে উঠল।

” আমরা দুজনেই ভালো আছি , বাবা। আপনি।বাসায় আছেন এখন? রাতে খেয়েছেন? ”

” আজকাল তারাতারিই বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। আর তারাতারি খেয়েও নিই। তোমাকে একটা প্রশ্ন করব, মা? ” রাশেদ কুরাইশি ইতস্তত করছেন।

” আপনি এভাবে বলবেননা। মনে যা প্রশ্ন আসবে সরাসরিই বলবেন, বাবা। ”

” কোথায় বাসা নিয়েছ? আমাকে ঠিকানা দেয়া যাবে? ” রাশেদ কুরাইশি শুধু শুনেছেন ওরা নতুন বাসায় উঠেছে। কিন্তু সাহস করে বাসার ঠিকানা জানতে চাননি। তবে আজ তিনি না জিজ্ঞেস করে পারলেননা।

” আপনার ছেলের বাসার ঠিকানা জানার অধিকার আপনার আছে, বাবা। আমরা বসুন্ধরায় বাসা নিয়েছি। আপনি সময় করে আসবেন। ” এরপর কুহু বাসার এ্যাড্রেস জানিয়ে দিল।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর কুহু রুমে প্রবেশ করল।

তাহমিদ রুমে থেকেই কুহুর কথা শুনতে পাচ্ছিল।

” আসুন সম্মানিতা গুপ্তচর, ভেতরে আসুন। আপনি কি জানেন রাজরাজাদের সময় আপনার জন্ম হলে, উচ্চ মাপের একজন গুপ্তচর হতে পারতেন আপনি? ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু আকাশ থেকে পরল!

” কিসব সর্বনাশা কথা বলছেন! আমি রাজরাজাদের যুগে জন্ম নিতে যাব কেন! আর সেই সময় আমার জন্ম হলে, আপনাকে কিভাবে পেতাম? আপনি নিশ্চয়ই রাজসভার ভাঁড় হতেননা। তাই এসব কুচিন্তা বাদ দিয়ে বলুন, আমি গুপ্তচর কিভাবে হলাম? ”

” যে মেয়ে একই সাথে দুইজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাকে কি বলা যায়? সে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে তার শ্বশুরের সাফাই গায়। আর শ্বশুরের কাছে মিষ্টিস্বরে ঘরের কথা জানায়, জামাইয়ের দুর্নাম করে। তাকে কি বলে? ফাজিল মেয়ে। তুমি শুধু গুপ্তচর নয়, প্রধান গুপ্তচর হওয়ার যোগ্যতা রাখ। ”

” মোটেও আমি আপনার দূর্নাম করিনি। এভাবে আমাকে অপবাদ দেবেননা। ”

” বাবা, আপনি জানেনইতো আপনার ছেলে কেমন। তার আকাশ ছোঁয়া রা’গের কাছে আমি পাত্তা পাই বলুন, তাকে কিছু বলার সাহস আমার নেই। এসব কথা বুঝি দূর্নাম নয়! ” তাহমিদ চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল।

” কারও অনুপস্থিতিতে তার নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলিলে তাহাকে দূর্ণাম বলে। আমি আপনার উপস্থিতিতেই আপনার বাবাকে, আপনার মনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানিয়েছি। তাই ইহাকে কোনভাবেই দূর্নাম বলা চলিবেনা। ইহা খাঁটি সত্য কথা। আর আমি মোটেও মিথ্যা কিছু বলিনাই। বুঝিয়াছেন জনাব? ” কুহু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল।

তাহমিদ কুহুর অভিনয় দেখে হেসে উঠল। এরপর আচমকাই ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল।

” আমাকে কুপোকাত করার সকল অস্ত্রই দেখছি আমার রানীর কাছে মজুদ আছে! সে ভালো করেই জানে তার ওপর রা’গ আমি কোনকালেই করতে পারবনা। তাই সে-ও সুযোগের স্বদ্যবহার করতে পিছপা হয়না! ”

” একে বলে যার অস্ত্রে তাকেই কাৎ করা। আপনার সাথে বাস করে, আপনাকেই চিনবনা এটা কি করে হয়! এখনতো আমি নিজের থেকে আপনাকে ভালো চিনি। তাই আপনাকে কপোকাত করতে আমাকে বেগ পেতে হয়না। ”

” তুমি যেমন আমাকে কপোকাত করার সকল টেকনিক আয়ত্ত করেছ, ঠিক তেমনি তোমাকে কপোকাত করার নিঞ্জা টেকনিক আমার হাতের মুঠোয় আছে। আমি ভালো করেই জানি, আমার পাখিটা কিসে কুপোকাত হতে ভালোবাসে। আর আমিও আমার পাখির ভালোবাসাকে সব সময়ই প্রাধান্য দিয়ে তাকে কুপোকাত করতে প্রস্তুত। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু ঠোঁট কামড়ে হাসল। তাহমিদের ইঙ্গিত বুঝতে ওর মোটেও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ও সহজেই ধরা দিতে চায়না। এই মানুষটাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে কুহুর খারাপ লাগেনা।

এদিকে তাহমিদের হাতের বাঁধন একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। কুহুও সুযোগের অপেক্ষায় আছে তাকে ফাঁদে দেয়ার। ও এক হাতে নিজের ফোন নিয়েছে তাহমিদের অগোচরেই।

তাহমিদ কুহুর গলায় মুখ গুঁজে দিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। বেচারা চমকে বিছানা হাতড়ে ফোন সামনে এনে রা’গী চোখে কুহুর দিকে তাকায়। ততক্ষণে ওর হাত ফসকে কুহু বেরিয়ে গেছে।

” আমার নিষ্ঠুর বউ, এভাবে আমার রোমাঞ্চে বাঁধা দেয়ার অপরাধে তোমার শাস্তি দ্বিগুণ করা হল। ফলশ্রুতিতে কাল আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছিনা। তোমার শাস্তি আগামী দুইদিন অব্যাহত থাকবে। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তাহমিদও বিছানা ছেড়ে ওকে ধরতে যায়।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে