#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী জামী
ডেইজি কুরাইশি বিভিন্নভাবে কুহুকে অপমান করছে। তবুও কুহু মুখে কুলু পেতে আছে। ওর একটা সত্তা বলছে প্রতিবাদ করতে। কিন্তু অপর সত্তা পরক্ষনেই বলছে, নিশ্চুপ থাকতে। দ্বিতীয় সত্তা ওকে বারবার বলছে, এই বাসায় ও কয়েকদিনের অতিথি হয়েই আসে মাত্র। এই কয়েকদিনের জন্য কারও সাথে বিবাদে জড়িয়ে কি লাভ? এছাড়াও ডেইজি কুরাইশিও তাহমিদের নিজের মা নয়। যেখানে তাহমিদই ডেইজি কুরাইশিকে পাত্তা দেয়না, সেখানে তাকে কথা শোনাতে কুহুর ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে ডেইজি কুরাইশি একটু বেশিই করে ফেলে। কুহুর তখন রা’গ হলেও চুপচাপ সব সহ্য করে। কিন্তু আজকে দুপুরে কুহু চুপ থাকতে পারেনি। ডেইজি কুরাইশির কটুকথার বিপক্ষে ও প্রতিবাদ করেছে। আর তাতেই ডেইজি কুরাইশি রে’গে আ’গু’ন হয়ে যায়। সে দাঁতে দাঁত পিষে কুহুর দিকে অ’গ্নি দৃষ্টি হেনে নিজের রুমে যায়।
” রুনু, রান্না হয়েছে? নাকি গল্প করেই দিন পার করে দিচ্ছিস? ফাঁকিবাজের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে নিজেও ফাঁকিবাজি শিখছিস? তবে জেনে রাখ, এর ফল মোটেও ভালো হবেনা। ”
” রান্না শেষ, ম্যাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করব। ”
” আমরা টেবিলে আসলে তুই থাকবি। এই মেয়েটা যেন না থাকে। ও থাকলে রায়ান, জাহিয়া বিরক্ত হয়। আসলেই তো একটা অসভ্য, জংলীর সামনে বসে কেউ কি শান্তিমত খেতে পারে! কিন্তু এই জংলী মেয়ে সেই কথা বুঝলে তো। সে এসব বুঝবে কেমন করে! সে-তো শ্বশুরের মনোরঞ্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিভাবে শ্বশুরকে হাতের মুঠোয় আনবে সেই চিন্তাই করে দিনরাত। ”
ডেইজি কুরাইশির কথা শুনে কুহুর মাথায় যেস দপ করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠল। রাশেদ কুরাইশিকে ও নিজের বাবার মত মনে করে। অথচ ডেইজি কুরাইশি তাকে নিয়ে এসব কি বলছে! ও এবার আর চুপ থাকতে পারলনা। মুখ খুলতেই হল।
” আপনি যা বলছেন ভেবেচিন্তে বলছেন তো? আপনার হাসবেন্ড আমার শ্বশুর। যিনি আমার বাবার সমতুল্য। আজ সেই পিতৃসম শ্বশুরকে নিয়ে আপনি যে কথাটা বললেন, এটা কি শোভনীয়? আমি নাহয় অসভ্য জংলী। কিন্তু আপনার কথা শুনে আপনাকেতো মোটেও সভ্য বলে মনে হচ্ছেনা। এখনতো আপনাকে পারিবারিক শিক্ষা বিবর্জিত জীব বৈ আর কিছুই লাগছেনা। আপনার থেকে অন্তত আমার পারিবারিক শিক্ষা উঁচু স্তরের বলে মনে হচ্ছে। আমার বয়েই গেছে আপনাদের খাবার সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমি শুধু বাবার জন্য এখানে থাকি। আপনার দু’জন উজবুক মার্কা ছেলেমেয়েকে দেখলেই আমার হাসি পায়। তাদেরকে আপনিই ইচ্ছেমত গেলান। ”
কুহুর কথা শুনে রুনু অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দুইজন মেইড মুচকি মুচকি হাসছে।
ডেইজি কুরাইশি এমন অপমান মেনে নিতে পারলনা। সে কুহুর দিকে তেড়ে আসল।
” তোমার এত বড় সাহস, আমাকে অপমান করছ? তুমি কি জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ? আমি চাইলেই এই মুহুর্তে তোমাকে মাটিতে পিষে ফেলতে পারি। দুই পয়সার মেয়ে আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে। ”
” হোকনা দুই পয়সা, তাও তো আমার দাম আছে। আপনাকে তো আমি গোনার মধ্যেই ধরিনা। মূল্য হিসেব করতে গেলে, আপনার মূল্য জিরো। স্বামী এটা আছে, সেটা আছে ফুটানি দেখানো ছাড়া আরতো কিছুই করতে পারেননা। আর কি যেন বললেন? আমাকে মাটিতে পিষে ফেলবেন! তেমনটা করলে আমার জামাই আপনাকে ছেড়ে দেবে! আমার মনে হয়, আপনার কথা শোনামাত্রই সে আপনাকে ভস্ম করতে চাইবে। আর সেই কাজ করলে তবে সে আপনাকে কি করবে, কথাটা ভাবতেই ভয় করছে আমার। ”
” তুমি আমাকে থ্রেড দিচ্ছ! মনে করছ, তোমার হুমকিতে আমি ভয় পেয়ে রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে বসে থাকব? স্বামীর বড়াই করছ! তবে শুনে রাখ, আমি ইচ্ছে করলেই চরিত্রহীনার ঐ ছেলেকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। তাই এত আকাশে উড়তে যেওনা। কখন যে ধপ করে মাটিতে পরে হাত-পা ভাঙবে সেটা বুঝতেই পারবেনা। ” ডেইজি কুরাইশির চোখে যেন আ’গু’ন জ্ব’ল’ছে।
” আমার স্বামীটাই বড়াই করার মত। এমন স্বামী কয়জনের ভাগ্যে জোটে বলুন? কয়জন মেয়ে তার স্বামীর জীবন প্রথম নারী হতে পারে? যেমনটা আমি হয়েছি? আপনি এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াবেননা। আপনিতো আর আপনার স্বামীর জীবনে প্রথম নারী নন। তাই এই সুখ বোঝার ক্ষমতাও আপনার নেই। সেই হিসেবে আপনি পুরোপুরি ব্যর্থ। আর ব্যর্থদের প্রধান হাতিয়ার ধারালো জিহ্বা। আপনি আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন কি! সে-ই এখানে থাকতে চায়না। ভুলে যাবেননা, সে একজন স্বাবলম্বী পুরুষ। তাই এই ভয় আমাকে দেখাতে আসবেননা। ”
ডেইজি কুরাইশি ভাবতেই পারেনি এই দুইদিনের মেয়ে তাকে চরমভাবে অপমান করবে। এই বাড়ির মালিক হবার সুবাদে যেখানে সবাই তাকে ভয় পায়, মেনে চলে সেখানে এই মেয়ের ঔদ্ধত্য সে কিছুতেই মানতে পারছেনা। সে এই মেয়েকে যতটা বোকা ভেবেছিল, ততটা বোকা যে সে নয়, সেটা ভেবেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। প্রথমেই যদি এই মেয়ের স্বরূপ বুঝতে পারত, তবে শুরুতেই এর একটা ব্যবস্থা করত। তবে এখন আর এতকিছু ভাবার সময় নেই। এখনই মেয়েটার মুখ বন্ধ করতে হবে।
” বেয়াদব মেয়ে, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! আজ রাশেদ আসুক। তোমার মুখোশ যদি আমি তার সামনে না খুলে দেই তবে আমার নামও ডেইজি নয়। ফকিরের মেয়ের গলাবাজি দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! এতদিন শুনেছি,’ ফাঁকা কলসি বাজে বেশি ‘। আজ সেই কথার প্রমান পেলাম। ফকিরের মেয়ের আর কিছু না থাকুক, গলায় জোর আছে।”
ডেইজি কুরাইশির এমন কথা শুনে এবার কুহুও রে’গে উঠল। এতক্ষণ সে ধীরে ধীরে কথা বলেছে ডেইজি কুরাইশির সাথে। তবে এখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলোনা। এবার সে একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখাল।
” আপনাকে আগেই বলেছি, আমার সাথে হিসেব করে কথা বলবেন। ফকিরের মেয়ে কে সেটা তার ব্যবহারেই প্রকাশ পায়। ইনফ্যাক্ট আমি মনে করি একজন ফকিরের মেয়ের যে সম্মান আছে, সেটা আপনার নেই। ফকিরের মেয়েরাও অন্তত কারও ঘর ভাঙ্গার আগে বোধহয় দুইবার ভাবে। ”
” ইউ ব্লাডি বিচ। তোমাকে আজ আমি মে’রে পুঁতে দেব। ঐ অসভ্য, বর্বরও তোমার কোনও খোঁজ পাবেনা। তুমি আমাকে ফকিরের মেয়ে বলছ! ”
ডেইজি কুরাইশি তেড়ে এসে কুহুকে থা’প্প’ড় মারল। ঘটনার আকস্মিকতায় কুহু হকচকিয়ে গেছে। ও গালে হাত দিয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিরব থাকতে দেখে ডেইজি কুরাইশি আরেকটু সাহস পায়। সে ভেবে নেয়, তার থা’প্প’ড়ে কুহু ভয় পেয়েছে। সে এবার কুহুর দুই হাত নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে, বাম হাত দিয়ে কুহুর গালে সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। এবারও কুহু নিশ্চুপ। সে এবার দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে ভয় খেলা করছে।
ডেইজি কুরাইশি কুহুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকিয়েই জমে যায়। সেখানে তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ রা’গে লাল হয়ে গেছে। ডেইজি কুরাইশি নিজের জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই দেখতে পাচ্ছে, তাহমিদ রা’গে দাঁত পিষছে। তাহমিদের এমস রূপ দেখে ডেইজি কুরাইশি ভয় পেয়ে গেছে। সে ঝট করে কুহুর হাত ছেড়ে দেয়।
কুহুও এই অসময়ে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়েছে। ঘটনা যে এতদূর গড়াবে তা ও ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। সে তো শুধু ডেইজি কুরাইশির অপমানজনক কথার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাহমিদ এই সময় বাসায় কেন! কি হবে এখন? ডেইজি কুরাইশির হাতে প্রথম থাপ্পড় খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে গেছিল, সেই সাথে লজ্জাও ওকে গ্রাস করেছিল। এতগুলো মেইডের সামনে থা’প্প’ড় হজম করা সহজ ব্যপার নয়। কিন্তু এবার ওর ভয় হচ্ছে। তাহমিদের মুখ দেখে ওর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী জামী
তাহমিদ কখন যে তার হাতে থাকা ব্যাগ ফেলে দিয়েছে সেটা ও বলতেই পারবেনা। সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ও আশেপাশে যা পাচ্ছে তাতেই লাথি হাঁকাচ্ছে। একসময় দেখা গেল সে ডেইজি কুরাইশির সামনে আসার আগেই ড্রয়িংরুমের দফারফা করে দিয়েছে। তাহমিদের এমন রূপ দেখে কুহু চমকে গেছে। ডেইজি কুরাইশি ভীতু চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ বুঝতে পারছে, আজ তার নিস্তার নেই।
তাহমিদ ডেইজি কুরাইশির সামনে এসে সরাসরি তার গলা চেপে ধরল। এই মুহূর্তে সে কি করছে সেটা তার মাথায় নেই।
” আপনার এতবড় সাহস, আমার কুহুকে থা’প্প’ড় দিয়েছেন? যে ফুলকে আমি সব সময়ই আগলে রাখি। যাকে ভালোবাসতে গেলেও আমি চিন্তা করি, সে যদি ব্যথা পায় । আর আপনি আমার সেই ফুলকে আঘাত করেছেন! খুব খারাপ করেছেন আপনি। এখন যদি আমি আপনাকে মে’রে পুঁতে দেই, তবে কারও ক্ষমতা হবেনা আপনার বডি খুঁজে বের করার। আমি চাইলেই আপনার স্বামীকেও রাস্তায় নামাতে পারি। আপনার ছেলেমেয়েরা শুধু দেখে যাবে। কিছুই করার সাহস ওদের কোনদিনও হবেনা। ”
তাহমিদের হাত ধীরে ধীরে চেপে বসছে ডেইজি কুরাইশির গলায়। ডেইজির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে একটুখানি অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করছে। মাথায় ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। তার চোখের তারায় কোনও আলোর অস্তিত্ব নেই। ধীরে ধীরে অসার হয়ে আসছে তার শরীর। এক পর্যায়ে সে শরীর ছেড়ে দেয়। একটুখানি অক্সিজেনের জন্য ছটফট করলেও তাহমিদের শক্ত হাত থেকে মুক্তি পায়না।
ডেইজি কুরাইশির শোচনীয় অবস্থা দেখে কুহু ভয় পায়। ও দ্রুত পায়ে তাহমিদের সামনে গিয়ে ডেইজির গলা থেকে তার হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে ।
” আপনার দোহাই লাগে, উনাকে ছেড়ে দিন। উনি মা’রা যাচ্ছেন। ” কুহু একপর্যায়ে তাহমিদকে ধাক্কা দেয়।
বাসার সব মেইডরা চোখ বড় করে তাহমিদের কর্মকাণ্ড দেখছে। তাদের চেয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারন তারা তাহমিদের রা’গ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রায়ান, জাহিয়া নিরবে সবকিছু দেখছে। মায়ের জন্য তাদের কষ্ট হলেও, আপাতত নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাই তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। কারন তাহমিদের সামনে ওরা টিকতে পারবেনা কিছুতেই।
” তাহমিদ, তুমি কি করছ? ডেইজিকে মা’র’তে চাইছ কেন? ছেড়ে দাও ওকে। ” কোথায় থেকে যেন রাশেদ কুরাইশি এসে তাহমিদকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।
রাশেদ কুরাইশির ধাক্কা খেয়ে তাহমিদ ডেইজিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ও ছিটকে কয়েক হাত পেছনে চলে যায়।
তাহমিদের হাত থেকে ছাড়া পেতেই ডেইজি কুরাইশি ঢলে পরে মেঝেতে। রাশেদ কুরাইশি এগিয়ে যান স্ত্রী’র কাছে। ততক্ষণে ডেইজি কুরাইশি জ্ঞান হারিয়েছে।
ডেইজি কুরাইশি মেঝেতে পরতেই মেইডরা ছুটে আসে। তারা ধরাধরি করে ডেইজিকে তার রুমে নিয়ে যায়। রায়ান ইতোমধ্যে ওদের ফ্যামিলি ডক্টরকে ফোন দিয়েছে।
তাহমিদ নিজেকে সামলে নিয়ে এদিকওদিক তাকায়। এরপর শুরু করল ধ্বংসযজ্ঞ। হাতের কাছে যা পাচ্ছে ভেঙ্গেচুরে একাকার করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রয়িংরুম একটা আসবাবপত্রের আস্তাকুঁড়ে পরিনত হয়। এতক্ষণ রাশেদ কুরাইশি চেয়ে দেখছিলেন তাহমিদের এই ধ্বংসযজ্ঞ। তিনি আজ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। তাহমিদের এমন রূপ দেখে তিনি যারপরনাই হতাশ হয়েছেন। তিনি তাহমিদকে থামাতে তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলেই, একজন বয়স্ক মেইড তাকে বাঁধা দেয়। এরপর সেই মেইড তাকে একে একে সব খুলে বলল।
সব শুনে রাশেদ কুরাইশির স্ত্রী’র ওপর ঘৃণা হচ্ছে। বাবা-মেয়ের পবিত্র সম্পর্ককে আজ ডেইজি কুরাইশি কলংকিত করেছে। তার এই মুহূর্তে স্ত্রী’র মুখ দেখতে ইচ্ছে করছেনা।
এদিকে তাহমিদ সবকিছু লণ্ডভণ্ড করেও শান্তি পাচ্ছেনা। সে এবার হাতে একটা চেয়ারের ভাঙ্গা হাতল নিয়ে ড্রয়িংরুমে দেয়াল জুড়ে থাকা অ্যাকুরিয়ামে সজোড়ে বারি দেয়। নিমেষেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় অ্যাকুরিয়াম। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পরল কাঁচ। পানিতে ভেসে যায় ড্রয়িংরুমের মেঝে। অনেকগুলো লাল, নীল রঙের মাছ মেঝেতে খাবি খাচ্ছে। ছোট ছোট কচ্ছপের দল পালাতে চাইছে। তারাও যেন হঠাৎ করেই মুক্তির স্বাদ পেয়েছে।
কুহু এসব দেখে ভয় পায়। এখনই যদি তাহমিদকে না থামানো যায়, তবে সে নিশ্চয়ই আরও খারাপ কিছু ঘটাবে। ভাবনাটা মনে আসতেই কুহু পড়িমরি করে তাহমিদের কাছে ছুটে যায়। হুট করেই জড়িয়ে ধরে তার খ্যাপা স্বামীটিকে। সে এই মুহূর্তে স্থানকাল, পাত্র ভুলে বসেছে। ওর মাথায়ই নেই এখানে ওর শ্বশুর দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ কুরাইশি কুহুর দিকে তাকিয়ে হেসে অতি সন্তর্পনে ড্রয়িংরুম ছাড়লেন।
তবে যেতে যেতে তিনি শুনতে পেলেন, তাহমিদ কুহুকে বাড়ি ছাড়ার কথা বলছে।
তাহমিদ রুমে এসেও শান্ত হতে পারছেনা। কুহু তাকে বিছানায় জোর করে বসিয়ে দিয়ে তার বুকে মাথা রেখেছে। তাহমিদও বাধ্য হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে।
” আর সময় নষ্ট করোনা। তোমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। আমাকেও সব গোছগাছ করতে হবে। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবনা। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী’র সম্মান নেই, সেই বাড়িতে আমি থাকবনা। ” তাহমিদ হাঁপাচ্ছে।
” যাবতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নিশ্চয়ই চলে যাব। কিন্তু তার আগে আপনি একটু শান্ত হোন। এমনভাবে কেউ রা’গ করে? যদি উনার কিছু হয়ে যেত, তবে আপনার কি হত, সেই সম্পর্কে কোন ধারনা আছে আপনার? আমার কি হত বলতে পারেন? ”
” তোমাকে ঐ মহিলা অপমান করবে আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখব? এতটাই স্তৈন আমাকে তোমার মনে হয়? ঐ মহিলার জন্য আজ আমার এত দুর্দশা। সে বাবার জীবনে আসার পরই এই সংসারে ভাঙ্গন ধরেছে। মা আমার থেকে দূরে চলে গেছে। আজ আবার সেই মহিলাই তোমার শরীরে হাত তুলেছে, এটা আমি কেমন করে মেনে নেই! তাকে খু’ন করতে পারলে শান্তি পেতাম।”
” না, মোটেও তেমনটা করবেননা। একদিন তারা তাদের কর্মফল ভোগ করবে। আপনাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তিও পাবে। কিন্তু আপনি আর কখনোই নিজ থেকে তাদের আঘাত করবেননা। আমাকে কথা দিন? আপনি একবারও ভেবে দেখেছেন, তাদের সবকিছু আছে। কিন্তু আমার আপনি ছাড়া আর কে আছে? তাদের আঘাত করার বিনিময়ে আমি আপনাকে হারাতে চাইনা। ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
” বউ, তুমি কেঁদনা। আমি কথা দিলাম এরপর কাউকে আঘাত করবনা। কিন্তু কেউ যদি তোমাকে অপমান, অসম্মান করে তবে তাকে ছেড়েও কথা বলবনা। এবার উঠে সবকিছু গুছিয়ে নাও। সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। রাতটুকু হোটেলে কাটিয়ে, কালকে ফ্ল্যাট খুঁজে বের করতে হবে যেকোন উপায়েই। ”
” সত্যিই এই বাড়ি ছাড়বেন? ”
” কেন তোমার কি এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছেনা? তুমি থাকতে চাইছ এখানে! ”
তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কুহু ভয় পায়। তার চোখমুখ আবার র’ক্তবর্ণ ধারন করেছে।
” ন..না। আমিও এখানে থাকতে চাইনা। আমি এখনই সব গুছিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু বাসা পাওয়ার সাথে সাথে শাহানা ফুপুকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে। নতুন বাসায় আমি তাকে চাই। ”
” হুম। ” তাহমিদ ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আলমারির কাছে যায়।
গোছগাছ শেষ করে কুহু তৈরী হয়ে নেয়। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে। তাহমিদ শেষবারের মত আলমারি, ড্রেসিংটেবিলের সব ড্রয়ার চেইক করছে। ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে কিছু ছেড়ে রেখে যাচ্ছে কিনা। কারন ও জানে আজকের পর এই বাড়ির ছায়া ও মাড়াবেনা।দরজায় শব্দ হতেই তাহমিদ মুখ তুলে তাকায়।
” বউমা, তোমাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আমি কি ভেতরে আসব? ”
রাশেদ কুরাইশির গলা পেয়ে কুহু গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
” আসুন, বাবা। ”
” তোমরা সত্যিই চলে যাচ্ছ, মা! ” রাশেদ কুরাইশি মেঝেতে কয়েকটা ব্যাগ দেখে কুহুকে প্রশ্ন করলেন।
” জ্বি, বাবা। ” কুহু ইতস্ততভাবে জবাব দেয়।
” তাহমিদ, না গেলেই কি নয়? ”
” কত বছর পর আপনি এই রুমে এসেছেন, সেটা কি আপনার মনে আছে? ” তাহমিদ বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
ছেলের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননা রাশেদ কুরাইশি। তার শুধু মনে হয়, আসলেই তো, এই রুমে কত বছর আসিনা আমি! তার ছেলেটা সেই ছোট থেকে একা একা থেকেছে এখানে। একা একা বেড়ে উঠেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি তিনি একটাবারের জন্যও এই রুমে আসার প্রয়োজনবোধ করেননি।
” আমারই ভুল ছিল। যা কিছু ঘটেছে, সবকিছুর জন্যই দায়ী আমি। আজ স্বীকার করতে কোন অসুবিধা নেই। তোমরা যেওনা। আম্মার মৃ’ত্যু’র পর বউমা আমার মা হয়ে এসেছে। বউমা যে কয়দিন এখানে থাকে, আমি খুব ভালো থাকি সে কয়দিন। ” রাশেদ কুরাইশির চোখে পানি।
” আপনি যে স্বার্থপর তা আরেকবার প্রমান হয়ে গেল। আমি আমার স্ত্রী’ র নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সব ছাড়তে চাইছি। আর এই মুহূর্তেও আপনি নিজের কথা চিন্তা করছেন! এত স্বার্থপর হতে পারেন কিভাবে? একটুও চক্ষু লজ্জা নেই আপনার? আপনি যেমন সারাজীবন নিজের ভালো বুঝে এসেছেন, তেমনি আমাকেও আমার ভালোটাই বুঝতে হবে। এবং আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি। ”
” আমি হাতজোড় করছি। তোমরা যেওনা। ”
” আপনার কোন কথা রাখতে আমি বাধ্য নই। সেদিন যদি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করতেন, তবে আজ আপনাকে হাতজোড় করতে হতোনা। যদি আমার কথা একটুও চিন্তা করতেন তবে ঐ ভদ্রমহিলার জন্য আমার মা’কে অবহেলা করতে পারতেননা। আমি অনেক আগেই এখান থেকে চলে যেতাম। শুধু দাদুকে কথা দিয়েছিলাম, যাইহোক না কেন এখানেই থেকে যাব। তাই এতদিন অনেক অপমানের পরও এখানেই ছিলাম। এমনকি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী যখন দিনের পর দিন আমাকে টর্চার করেছে তা-ও এখানেই থেকেছি। ঐ ভদ্রমহিলা যখন আমাকে মা’র’ত তখন দাদু এগিয়ে আসত আমাকে রক্ষা করতে। তখন দাদুকেও সে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করত। সেসব কি আপনারা জানা আছে? এতকিছুর পরও আমি দাদুর কথা রাখতেই নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এখানেই থেকেছি। কিন্তু আর নয়। এবার আমার নিজের পথ খোঁজার সময় এসেছে। ”
তাহমিদ রাশেদ কুরাইশিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুই হাতে ব্যাগ তুলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর ইশারা পেয়ে কুহুও রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বেড়োনোর আগে ও শ্বশুরকে সালাম দেয়।
তাহমিদ গেটে এসে কেয়ারটেকারকে বলে রুম থেকে সব ব্যাগ নিয়ে আসতে।
চলবে….