প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪৩+৪৪

0
562

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৩
জাওয়াদ জামী জামী

নিজের রুমে গিয়ে নায়লা আঞ্জুম কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থাকে। ম্মৃতির করা অপমান সে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। রায়হান আহমেদও তাকে কখনোই এভাবে বলেনি। কিংবা শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোও ওকে কখনো কটু কথা বলেনি। অথচ সে নিজেই তাদেরকে বিভিন্নভাবে অপমান করেছে। কিন্তু তারা কখনোই নায়লা আঞ্জুমের সাথে খারাপ আচরণ করেনি। বরং সব সময়ই তাকে ভয় কিংবা সমীহা করেছে। অথচ তার আদরের ভাইয়ের সামনেই ভাইয়ের স্ত্রী এভাবে তাকে অপমান করেছে, কিন্তু তার ভাই কোনও প্রতিবাদ করলনা! কিন্তু সে তো ভাইকে সত্যিই ভালোবাসে। ছোট থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। একটামাত্র ভাই হওয়ায় ওর জন্য কি করেনি তারা তিন বোন! তবে কি তার আদরের ভাই সব ভুলে গেছে? সে কি ভুলে গেছ, সে তার তিন বোনের প্রাণ ছিল! অনেককিছুর হিসেব-নিকেশ নায়লা আঞ্জুম এক লহমায় কষল। সে আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে মেয়েরা রাজকন্যা হয় তার বাবার কাছে। তার রানী হয়ে থাকে তার স্বামীর কাছে। হোকনা সেই বাবা কিংবা স্বামী গরীব, নিঃস্ব কিংবা অসহায়। তাদের ভালোবাসা থাকে অফুরন্ত। শ্বশুর বাড়িতে তাদের যতটুকু সম্মান কিংবা গুরুত্ব থাকে, সেটা ভাই কিংবা তাদের বউদের কাছে থাকেনা। নায়লা আঞ্জুম চোখের পানি মুছে জীবনের কঠিনতম এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। আজ তার কাছে স্পষ্ট কারা তাকে ভালোবাসে, সম্মান করে।

তখনও স্মৃতি ড্রয়িংরুমে চিৎকার করেই চলেছে। আজ সে তার হিতাহিতজ্ঞান হারিয়েছে। কোন কথাই তার মুখে আটকাচ্ছেনা।

” কতবড় সাহস, আমার বাবা-মা’ কে ফকিন্নি বলে! আজ মন চাচ্ছে তোমার বোনকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাসা থেকে বের করে দিই। নিজে একটা ফকিন্নি জন্য এখানে বসত গড়েছে। তার স্বামীও যে সুবিধার নয়, সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল। সেয়ানাগিরি করেই বউকে এখানে ফেলে রেখেছে। এখন তো মনে হচ্ছে এসব তার চাল ছিল। শ্বশুরের সম্পত্তি বাগাতেই এত আয়োজন করেছে সে। নিজে কিছু না বলে বউকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। মতলববাজ সেও কম নয়। আর তার ছেলেমেয়েদেরকেও দেখ, তারা এই বাসায় আসবে, ধেই ধেই করে নাচবে কিন্তু মা’কে সাথে নেয়ার কথা বলবেনা! ”

সৈকত আহমেদ চুপচাপ তার স্ত্রী’র কথা শুনছে। কোন উচ্চবাচ্য সে করছেনা।

রায়হান আহমেদ কেবলই তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছেন। ঠিক তখনই বাসার এক মেইডের সাথে দেখা হয়। রায়হান আহমেদ তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে, সে কথার ফাঁকেই সকালের ঘটনা তার কাছে প্রকাশ করে। কারন আজ স্মৃতির কথাগুলো তারমত বাড়ির অন্য মেইডদেরও খারাপ লেগেছ। তারা নায়লাকে নিয়ে এসব কথায় অভ্যস্ত। কিন্তু আজ স্মৃতি নায়লার সাথে সাথে তার স্বামী-সন্তানদের নিয়েও বলেছে, যেটা কারও ভালো লাগেনি। তার মুখে সব শুনে রায়হান আহমেদের মুখটা ছোট হয়ে যায়। রিশা, নিশোরও চোখে পানি এসেছে। হাজার খারাপ হলেও নায়লা আঞ্জুম তাদের মা। আর বাবা-মা’য়ের অপমান কোন সন্তানই সহ্য করতে পারেনা।

কুহু সৃজনকে নিয়ে গেইট পাড় হতেই বাগানে চাচাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ও লক্ষ্য করল রিশা বারবার চোখ মুছছে। কুহু দ্রুত পা চালিয়ে রিশার কাছে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? কিন্তু রিশা কোন জবাব দেয়না। তখন সেই মেইড কুহুকে একে একে সব কথা বলল। সবটা শুনে কুহুর মনও খারাপ হয়ে যায়। ও রায়হান আজাদ দিকে তাকাতেই দেখল ওর চাচারও চোখে পানি। এই মুহুর্তে ওর কি করা উচিত তা বুঝতে পারছেনা।

রায়হান আহমেদ নিজেকে ধাতস্থ করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। অগত্যা কুহুও সৃজনকে নিয়ে তাদের পিছু নেয়।

অন্যদিনের মত আজ কেউই এই বাসায় হৈহল্লা করলনা। সবাই কেমন চুপচাপ আছে। রায়হান আহমেদ স্মৃতি আর সৈকতের সাথে কথা বলে শ্বাশুড়ির কাছে গেলেন। কুহু, সৃজন আর রিশা নিশোও তাই করল।

নায়লা আঞ্জুম স্বামী-সন্তানদের দেখে হাঁফ ছাড়ল। সে তার রুম থেকে বেরিয়ে তার মা’য়ের কাছে যায়। সেখানে সবাই বসে ছিল। নায়লা আঞ্জুম কারও দিকে না তাকিয়ে মা’য়ের পাশে গিয়ে বসে। মা’য়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গালে ঠেকায়। সেভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে।

নায়লা আঞ্জুমকে রুমে আসতে দেখে রায়হান আহমেদ সেখান থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন।

” আম্মা, আমি আজ এই বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। এখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হয়তো কোনদিন আমার কোন প্রয়োজন ছিলইনা। আমিই শুধু মিছেমিছি সবকিছু আঁকড়ে ধরে ছিলাম। ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি, আমি কারও প্রিয়জন নই। স্বামীর সবকিছু থাকা স্বত্বেও এখানে থেকেছি। ছোটবেলা থেকেই আব্বার ন্যাওটা ছিলাম। এই বাড়িকে হৃদয়ের একটা অংশ বলে মনে করেছি। তাই বিয়ের পরও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। এমনকি স্বামীকেও এখানে এসে থাকতে বাধ্য করেছি। এত বছর যে এখানে আছি, আমরা কিন্তু নিজেদেরটাই খেয়েছি। এটা তুমি ভালো করেই জান। সৈকতের কত শখ তোমার জামাই পূরণ করেছে, সেটা আর কেউ না জানুক আমি জানি। প্রতিমাসেই সৈকতের হাতে নির্দিষ্ট একটা এ্যামাউন্ট দিত রায়হান। ওকে নিজের খরচে বিদেশে ঘুরতে পাঠিয়েছে। আজ যখন স্মৃতি আমাকে কথা শোনাচ্ছিল, সেই সৈকতও চুপচাপ ওর বউয়ের কথা শুনছিল। আজ স্মৃতির আমাকে বলা কথা শুনে যতটানা কষ্ট পেয়েছি, তার থেকেও বেশি কষ্ট হয়েছে রায়হানের নামে কথাগুলো বলায়। আমি একজন স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, পূত্রবধূ হিসেবে খারাপ হতে পারি। কিন্তু আমার স্বামীকে ঠিকই ভালোবাসি। তাই স্বামীকে অপমানিত হওয়ার আর কোন সুযোগই দিতে চাইনা। ”

মেয়ের কথাগুলো শুনে ফাতিমা খানম কেঁদে উঠলেন। সন্তান যতই অন্যায় করুক, বাবা-মা তাদের ওপর সাময়িক অভিমান করে থাকে ঠিকই। কিন্তু তাকে একেবারে দূরে ঠেলে দেয়না।

ফাতিমা খানমের চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। নায়লা আঞ্জুম মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। এরপর আবারও বলতে থাকে।

” আম্মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি মাঝেমধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব। তবে আগামী চার-পাঁচ দিন তোমার কাছে আসতে পারবনা। আমাকে আরও কয়েকজনের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এই কয়দিন আমি নিজেকে শুদ্ধ করতে চেষ্টা করব। তারপর এসে তোমাকে দেখে যাব। তোমার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে আসব। ”

আরও কিছুক্ষণ মা’য়ের সাথে কাটিয়ে নায়লা আঞ্জুম রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রায়হান আহমেদের মুখে আজ কোন কথা নেই। রিশা, নিশোও চুপচাপ বসে আছে।
রাজিয়া খালা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। আজ স্মৃতির কথায় তিনিও কষ্ট পেয়েছেন। এই বাসায় এত বছর থাকার সুবাদে তিনি জানেন, রায়হান আহমেদ কি কি করেছেন এদের জন্য। আজ স্মৃতি তাকেও ছাড়লনা।

কুহু এক পা দু পা করে খালার কাছে যায়। খালা ওকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার মুখে হাসি ফুটলনা।

” খালা, আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। চাচার মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। রিশা কাঁদছে। আজ এই মুহুর্তে উনার অভাববোধ করছি। ”

” এত চিন্তা কইরোনা গো, মা। আল্লাহ সব ঠিক কইরা দিবেন। তুমি গিয়া রায়হান ভাইয়ের কাছে বস। তার সাথে গল্প কর। দেখবা তার মন ভালো হইয়া যাব। এইবার বাপজান আসলে আমি তারে সব কমুনে। যা করার সেই করব। ”

কুহু কিছু বলতে গেলেই কলিং বেল বেজে উঠল। একজন মেইড গিয়ে দরজা খুলে দিলে অচেনা কয়েকজন প্রবেশ করল বাসায়। তাদেরকে দেখে স্মৃতি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়। কুহু বুঝল এরাই আজকের মেহমান।

স্মৃতি রায়হান আহমেদের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা কিছুক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে রায়হান আহমেদের সঙ্গে কথা বলে। এরপর স্মৃতি সবাইকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
সৈকত আহমেদ রায়হান আহমেদের সাথে টুকটাক কথা বলছে। রায়হান আহমেদ শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছেন। কিছু বলছেননা।

নায়লা আঞ্জুমকে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে রায়হান আহমেদ সেদিকে তাকালেন। নায়লা আঞ্জুমের হাতে বড় ব্যাগ দেখে তিনি কপাল কুঁচকালেন।

” এভাবে কি দেখছ! বাসায় যাবেনা? অনেকক্ষণ হয় এখানে এসেছ, এবারতো যেতে হবে নাকি? ” নায়লা আঞ্জুম এগিয়ে এসে রায়হান আহমেদেকে বলল।

” এসব কি বলছ, ছোট আপা? এখন দুলাভাই কোথায় যাবে! আর তুমিইবা কোথায় যাচ্ছ? দুলাভাই, রিশা, নিশো এখন পর্যন্ত কিছুই মুখে দেয়নি। ”

” আমরা নিজের বাসায় যাব। আমার মনে হয় ওরা সকালে খেয়েই এসেছে। আমাদের জন্য তোমার এত চিন্তা করতে হবেনা। বাসায় গিয়ে আমি রান্না করব। তুমি পারলে তোমার স্ত্রীকে একটু ডেকে দাও। ওর কাছ থেকে বিদায় নেই। রাজিয়া আপা, আমি চলে যাচ্ছি বুঝলে? তুমি আম্মাকে দেখে রেখ। আর মাঝেমধ্যে আমার বাসায় গিয়ে বেরিয়ে এস। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে রায়হান আহমেদের বিস্ময়ের সীমা রইলনা। তিনি তার স্ত্রীকে দেখছেন, কত নির্বিকার সে কথাগুলো বলল!

” কি কও, নায়লা! তুমি এখনই যাইবা? রান্না শেষ, খাইয়া তারপর যাও। বাচ্চাদের পছন্দের খাবার রানছি। ”

” আপা, আমার ছেলেমেয়েরা বাবার বাড়িতে তাদের পছন্দের খাবারই খায়। আজ ওদের না খেলেও চলবে। তবে তোমার যদি ওদের খাওয়ানোর একান্তই ইচ্ছে হয়, তবে তুমি আমার বাসায় গিয়ে ওদের পছন্দের খাবার রান্না করে দিও। তুমি এক কাজ কর স্মৃতিকে ডেকে নিয়ে আস। আর রুমে আমার আরও তিনটা ব্যাগ আছে, সেগুলো কাউকে বের করে আমাদের গাড়িতে রাখতে বল। ”

রাজিয়া খালা বুঝলেন আজ নায়লা আঞ্জুম কোন কথাই শুনবেননা। তিনি নায়লার সিদ্ধান্তে মন থেকে খুশি হলেন। হাসিমুখে ডাকতে গেলেন স্মৃতিকে।

কুহু এতক্ষণ সব শুনছিল। চাচির সিদ্ধান্তে সে-ও খুশি হয়।

” কুহু, তুমিও চল আমাদের সাথে। আজ না-হয় চাচার বাড়িতে গিয়ে চাচির হাতের রান্নাই খাবে। যদিও তোমার রাজিয়া খালার মত এত ভালো রান্না আমি করিনা। তবে চলার মত করতে পারব। আর দেরি করোনা, চলে এস। রিশা, নিশো তোমার মামার কাছে বিদায় নাও। ”

স্মৃতি ড্রয়িংরুমে আসলে নায়লা তার দিকে তাকিয়ে হাসল।

” আমরা চলে যাচ্ছি। তবে মাঝেমধ্যে আম্মাকে দেখতে আসব। এবং তখন বেলকনির দরজা দিয়ে আম্মার কাছে আসব। আম্মা যে কয়দিন বেঁচে আছে সে কয়দিন আমাকে আসতেই হবে। তবে তখন এই ড্রয়িংরুমে আমাদের পা পরবেনা। আশা করব আম্মার কোন অযত্ন হবেনা। আর সৈকত, এই যে আম্মার ব্যাংকের পেপারস। এখানে আমি নমিনি আছি। আব্বা আম্মাকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল, তার সব টাকাই এখনও আছে। আম্মার চিকিৎসায় সেসব টাকা খরচ করিনি। মানে আমার মতলববাজ স্বামী খরচ করতে দেয়নি। আম্মার চিকিৎসার সব খরচ সে-ই বহন করেছে। সৈকত, তুমি সময় করে একদিন ব্যাংকে যেও, আমি তোমাকে নমিনি করতে পারি কিনা দেখব। ”

” ছোট আপা, তুমি আমাকে তুমি করে বলছ কেন? তুমি না আমাকে তুই বলতে! আর নমিনি তুমিই থাক, আমার এসবের দরকার নেই। আব্বা আমাকে যথেষ্ট দিয়ে গেছে। ”

” তুই তাকেই বলা যায়, যে আপন হয়। যখন তোমার পেছনে রায়হান আহমেদ লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে, তখন আমি আপন ছিলাম। আমার এখন একটাই কাজ আম্মার টাকার নমিনি পাল্টানো। সে তুমি চাও বা না চাও। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সৈকত আহমেদ মাথা নিচু করল।

” কুহু, সৃজন তোমরা চল। রিশা নিশো তোমরাও সবার কাছ থেকে বিদাও নাও। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। রায়হান এবার যেতে হবে। ”

রায়হান আহমেদ স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আজকে তার সামনে অন্যরকম এক নায়লা দাঁড়িয়ে আছে।

কুহু চাচির কথা অমান্য করলনা। কারন এটাই ওর কাছে ঠিক মনে হয়েছে। এই বাড়ির মেয়েই তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, তার কাছে যাওয়াই উচিত, এটা কুহু মনে করছে। এই বাড়ির সাথে কুহুর থেকে নায়লা আঞ্জুমের সম্পর্কই ঘনিষ্ঠ।

একে একে সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী জামী

নায়লা আঞ্জুম বাসায় ঢুকেই রান্নার জোগাড় করতে শুরু করল। কুহুও তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সাহায্য করল। এরপর রান্না শেষ হলে সবাইকে খেতে ডাকল।

কুহুরা সেদিন বাসায় ফিরতে চাইলেও নায়লা আঞ্জুম ওদের যেতে দিলনা। রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে নাস্তা করেই তবে ওদের ছেড়ে দেয় নায়লা আঞ্জুম।

নায়লা আঞ্জুমের এমন পরিবর্তনে সবাই খুশি হয়। কুহু তাহমিদকে ফোনে সবটা জানালে সে-ও ভিষণ অবাক হয়। সেই সাথে খুশিও হয়।

প্রতি বৃহস্পতিবার তাহমিদ রাজশাহী আসে। আজও সে রাজশাহী আসবে। কুহু তাহমিদের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সে কখন আসবে।

” আমার বউকে দেখছি আগের থেকেও বেশি এট্রাকটিভ লাগছে! ঘটনা কি? তাহমিদের অপেক্ষাই কি তাকে এমন আকর্ষনিয় করে তুলেছে? মন্দ নয়। এমন বউ ক’জনের ভাগ্যে জোটে! ”

কুহু দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেছে। কোন সম্ভাষণে না যেয়েই সে এমন উদ্ভট কথা বলতে শুরু করেছে!

” ছিহ্ এসব কি কথা! ভেতরে আসুন। আপনার দেখছি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নেই। আশেপাশে কতজন যাতায়াত করছে। তারা যদি এসব কথা শোনে, তবে কি ভাববে বলুনতো? ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে টেনে বাসায় ঢোকায়।

” যার ইচ্ছে হয় সে শুনুক। আমি আমার বউয়ের সাথে কথা বলছি। পাশের বাড়ির ভাবির সাথে ফ্লার্ট করছিনা। যদিও পাশের বাড়ির ভাবিদের বিষয়টাই আলাদা। তাদের সাথে কথা বলে আলাদা আনন্দ পাওয়া যায়। ”

” কিহ্! আপনার দেখছি চরিত্র বলে কিছুই নেই। অথচ সবার সামনে কেমন ফেরেশতা সেজে থাকেন! ” কুহু গাল ফুলিয়ে রুমে যেতে চাইতেই তাহমিদ ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

” সুন্দরী এভাবে দূরে যেওনা। শেষে দেখবে তোমার বিরহে পাশের বাড়ির ভাবিদের কাছেই আশ্রয় নিয়েছি। বিষয়টা কি খুব ভালো হবে? তোমার একটামাত্র জামাই থাকবে তোমার বাহুডোরে। কিন্তু তুমি সেই চেষ্টা না করে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ! নিষ্ঠুর রমনী। ” কথা বলতে বলতেই তাহমিদ টুপ করে কুহুর গালে চুমু দেয়।

” আপনি দেখছি দিনকে দিন চরম নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন! বাসায় সৃজন আছে। ও যদি এভাবে আমাদের দেখে তাহলে কি ভাববে? ”

তাহমিদ কুহুর কথা পাত্তা না দিয়ে ওকে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।

” শালাবাবু, কোথায় তুমি? নতুন বউয়ের মত রুমে মুখ লুকিয়ে বসে আছ কেন! বিয়ে করার শখ জেগেছে নাকি? তাহলে সরাসরি আমাকে বলতে পার। ”

তাহমিদের কথা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সৃজন।

” ভাইয়া, এসব কি বলছ তুমি? আমি ছোট বাচ্চাই আছি। বিয়ে করতে এখনও অনেক দেরি আছে। ”

সৃজনের কথা শুনে তাহমিদ হা হা করে হেসে উঠল।

শুক্রবার সকালে নায়লা আঞ্জুমের ফোন পেয়ে তাহমিদ অবাকই হয়। আরও বেশি অবাক হয়, যখন শুনল ছোট খালামনি ওদের দাওয়াত দিচ্ছে।
সেদিন সকালেই তাহমিদ কুহু আর সৃজনকে নিয়ে রায়হান আহমেদের বাসায় যায়। নায়লা আঞ্জুমের অনুরোধে সেখানে সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাসায় ফিরে। তবে বিকেলে তাহমিদ সবাইকে নিয়ে নানিমাকে দেখতে যায়।
নায়লা আঞ্জুম তার কথা রেখেছে। সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেলকনির দরজা দিয়ে মা’য়ের কাছে যায়।

তাহমিদ কুহুকে নিয়ে সরাসরি বাসায় গিয়ে মামির সাথে কথা বলে। এরপর সে নানিমার কাছে যায়।

স্মৃতি শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে নায়লা আঞ্জুমকে বাসার ভেতরে যেতে বললে, নায়লা আঞ্জুম রাজি হয়না। সে অনেকক্ষণ মা’য়ের পাশে বসে থাকে। এরপর তাহমিদকে নিয়ে বেরিয়ে যায় নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।

দুইদিন পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরল। এবার সে কুহুকে ঢাকায় নিতে চায়নি। কিন্তু রাশেদ কুরাইশি বারবার কুহুকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বাবার কথা ফেলতে পারেনি তাহমিদ। তাই সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কুহুকে নিয়ে ঢাকায় যায়। এবার ওরা সৃজনকে রায়হান আহমেদের বাসায় রেখে এসেছে।

প্রতিবারের মত এবারও কেউ এই বাসায় কুহুকে মন থেকে গ্রহন করলনা। ডেইজি কুরাইশি এবারও কুহুকে দেখে মুখ কালো করল। তাতে অবশ্য কুহুর কিছুই যায় আসেনা। কারন এই ছয়মাসে ও ভালো করেই বুঝে গেছে ঐ মহিলা বদলানোর নয়। তাই কুহু মনে মনে তাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রাশেদ কুরাইশি বাসায় এসে কুহুকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন। কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন পরম মমতায়।

” এতদিন পর তুমি আসলে, বউমা? গত একমাস আমার কথা তোমার মনে হয়নি? একবারও মনে হয়নি তোমার এক বাবা তার মেয়ের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে? ” রাশেদ কুরাইশির হৃদয় নিংড়ান কথা শুনে কুহু আপ্লুত হয়ে গেছে। এই বয়োবৃদ্ধ যে তাকে মন থেকে ভালোবাসে এটা কুহু এই বাসায় আসার পরই বুঝতে পেরেছে।
আজ আরও একবার তার কথা শুনে কুহুর মনে একটা কথাই গেঁথে যায়, এক বাবাকে হারিয়ে ও আরেক বাবাকে পেয়েছে। যে বাবা ওকে মেয়ের মত আগলে রাখতে চান সর্বদাই।

” আপনাকে ভোলার মত দুঃসাহস আমার নেই, বাবা। আমি প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসতে চাই। কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে আসতে চায়না। ” মুখ ফসকে কুহু সত্যি কথাই বলল।

” তুমি ওর কোনও বারণ শুনবেনা। ও তো চাইবেই তোমাকে এই বাড়ি থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু এটা হতে দেয়া যাবেনা। তোমার যখন ঢাকা আসতে ইচ্ছে করবে, তখন শুধু আমাকে একবার জানাবে। তোমার এখানে ব্যবস্থা আমি করব। মনে থাকবে? ”

শ্বশুরের কথায় কুহু হেসে মাথা নাড়ায়।

ডেইজি কুরাইশি রাশেদ কুরাইশির এমন আদিখ্যেতা কিছুতেই মানতে পারছেনা। সে এই বাড়িতে নিজের আধিপত্য ব্যতিত আর কারও আধিপত্য মানতে নারাজ। কিন্তু দিনকে দিন কুহুকে এই বাড়িতে জেঁকে বসতে দেখে সে একটু ভয়ই পায়। শুধু বারেবার মনে হতে থাকে, এই বুঝি তার রাজত্ব শেষ হতে চলল। সে নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করে মনে মনে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। আর যাইহোক, এই বাড়ির রাশ তাকেই ধরে রাখতে হবে। সেই সাথে রাশেদ কুরাইশির লাগামও একটু টেনে ধরতে হবে। তাকে হাত ফসকে বেড়োতে দেয়া ঠিক হবেনা।

পরদিন সকালে তাহমিদ ভার্সিটিতে গেলে কুহু রান্নাঘরে এসে রুনু নামক এক মেইডকে সাথে নিয়ে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করছে। রান্নাঘরে আরও দুইজন মেইড এটাসেটা করছে। শাহানা আক্তার তার এক বোনের বাসায় গেছেন। তাই কুহু আজ নিজের ইচ্ছেতেই খাবার তৈরী করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারন ও জানে ডেইজি কুরাইশি ওকে কখনোই বলবেনা, কি রান্না করতে হবে।

” রুনু, আজ দুপুরে কি রান্না হবে সেটা কি জানিস? ” হঠাৎই ডেইজি কুরাইশি রান্নাঘরে এসে রুনুকে জিজ্ঞেস করল।

” আজকে স্যারের পছন্দের খাবার রান্না করতে চাচ্ছে ভাবী। আপনি কি খাবেন বলুন, ম্যাম। আমি সেগুলো তৈরী করব। ” রুনু মৃদুস্বরে বলল।

” আমার ছেলেমেয়েও তো এই বাসায় থাকে নাকি? তারা কি না খেয়ে থাকবে! নাকি নিজ বাড়িতেই তারা পরবাসী জীবন কাটাচ্ছে? তাদের কি পছন্দের খাবার খেতে ইচ্ছে করেনা। শোন রুনু, তোর স্যারের পাশাপাশি আমার রায়ান, জাহিয়ার জন্যও ওদের পছন্দের খাবার বানাবি। আর সবাই ভুলে গেলেও তুই মনে রাখিস ওরা রাশেদ কুরাইশির সন্তান। এই বাড়িতে ওদের পছন্দের খাবার প্রয়োজনে এক হাজারবার রান্না করবি তোরা। অন্য কারও কথায় প্রাধান্য দিয়ে আমার ছেলেমেয়েকে কখনোই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবিনা। মনে রাখবি তারাই রাশেদ কুরাইশির যোগ্য সন্তান। অন্য কেউ এখন পর্যন্ত রাশেদ কুরাইশির কাছে পাত্তা পায়নি। যতটা গুরুত্ব সে রায়ান জাহিয়াকে দিয়েছে। ”

” জ্বি ম্যাম, মনে থাকবে। রায়ান স্যার, জাহিয়া ম্যামের জন্য তাদের পছন্দের ডিস তৈরী করে ফেলব। আপনি কি খাবেন? ”

” আমার জন্য ফ্রুট স্যালাড আর মিক্সড ভেজিটেবল করবি। ”

ডেইজি কুরাইশি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কুহু হাঁফ ছাড়ল। ও স্পস্টই বুঝতে পারছে ডেইজি কুরাইশি কথাগুলো ওকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। এই ভদ্রমহিলাকে সে এজন্যই ভয় পায়। সে যে কাউকে আঘাত দিতে সিদ্ধহস্ত। তার চালচলন, কথায় বড়লোকিভাব স্পষ্ট। যা সহজেই যে কারও নজরে পরে যায়। সে নিজেকে জাহির করার কোনও সুযোগই ছাড়তে চায়না। সুযোগ পেলেই যে কাউকে হেয় করতে পিছপা হয়না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে