প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪১+৪২

0
572

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪১
জাওয়াদ জামী জামী

রাত বারোটা পঁচিশ। তাহমিদ তখনও কুহুকে নিয়ে বেলকনিতে বসে আছে। কুহু তাহমিদের কোলে বসে বুকে মাথা রেখেছে। ও মনযোগ দিয়ে তাহমিদের প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে। তাহমিদের বুকের প্রতিটি স্পন্দন ওর শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে। নির্দিষ্ট তালে অনবরত বেজেই চলেছে তারা। হৃৎস্পন্দনের সাথে সাথে তাহমিদের বুকের ওঠানামা গভীরভাবে অনুভব করছে কুহু।

” বউ, এভাবেই বেলকনিতে রাত পার করার চিন্তা করছ নাকি। আমার কিন্তু তেমন ইচ্ছে মোটেও নেই। বউয়ের বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসেনা সেটা আগেই বলে রাখছি। ” তাহমিদ ঘোর লাগা গলায় বলল।

” এত বছরও কি বউয়ের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়েছেন! তা আপনার সে বউটি কোথায়? ” তাহমিদের কথার প্রত্তুত্যরে কুহু দুষ্টুমি করে বলল।

” কে বলেছে আমি এত বছর ঘুমিয়ে রাত পার করেছি? সারারাত নিজের জীবনের হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করেছি। ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ ঘুমাতাম। যেহেতু রাতে ঘুমাইনি, সেহেতু তখন ঘুমানোর জন্য বউয়ের বুকের প্রয়োজন পরেনি। এখন এত বছর পর যখন একটা বউ পেয়েছি, তখন তার বুকে ঘুমানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে আমি রাজি নই। ”

কুহু মুখ তুলে তাহমিদের দিকে চাইল। ছেলেটা ওর দিকেই নোশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের তারায় ভালোবাসার হাতছানি। কুহ বুঝতে পারছে তাহমিদের এই ভালোবাসায় সাড়া না দিয়ে কোন উপায় নেই

পরদিন সকালে তাহমিদ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কুহুকে গতরাতের মত আজ সকালেও রাশেদ কুরাইশির সাথে নাস্তা করতে হয়। ডেইজি কুরাইশিকে সকাল থেকে কুহু ড্রয়িংরুমের আশেপাশে দেখতে পায়না।

নাস্তা শেষে রাশেদ কুরাইশি কিছুক্ষণ কুহুর সাথে গল্প করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান।

” বউমা, আসব? ” কুহু রুমে বসে তাহমিদের বুকশেলফ থেকে মাইকেল কলেনির একটা বই নিয়ে পড়ছিল। ওর ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা। বাবা মাঝেমধ্যেই ওকে নানান জনরার বই কিনে দিত। কুহুও সেসব বই উৎফুল্ল হয়ে পড়ত। পড়ার মাঝেই শাহানা আক্তারের আওয়াজ পেয়ে কুহু বই বন্ধ করে।

” ফুপু, ভেতরে আসুন। ”

” কি করছিলে, বউমা? বিরক্ত করলাম নাতো? ”

” একা একা সময় কাটছিলনা, ফুপু। আপনি এসে ভালোই করেছেন। এবার আপনার সাথে মন খুলে গল্প করব। ”

কুহুর কথা শুনে শাহানা আক্তার হেসে কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

” শ্বশুর বাড়ি কেমন লাগছে, বউমা? ”

শাহানা আক্তারের এমন প্রশ্নে কুহু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

” এখনো বুঝতে পারছিনা, ফুপু। শুধু আমার ভালো লাগায় কিছুই হবেনা। একটা বাড়িতে বসবাস করতে গেলে, সেই বাড়ির প্রত্যেকেরই সহযোগিতামূলক মনোভাব ভিষণ জরুরি। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি বাবা আর আপনি আমাকে মন থেকে গ্রহন করেছেন। কিন্তু এটা ভালো না মন্দ সেটা এখনও বোধগম্য হচ্ছেনা। ” কুহু মৃদু গলায় বলল।

” ভালো না মন্দ, একথা বলছ কেন, মা! ”

” গতরাত থেকে আমার শ্বাশুড়িকে একবারও দেখলামনা। বাবার আমাকে মেনে নেয়ার বিষয়টি তিনি হয়তো ভালোভাবে নেননি। এর প্রভাব যদি বাবার ওপর পরে, তবে বিষয়টা কি মন্দ নয়? আবার হয়তোবা আপনাকেও এর মাশুল দিতে হতে পারে। গতকাল আমার শ্বাশুড়িকে যতটুকু দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি প্রতিশোধপরায়ন। আমার ভয়টা এখানেই। ”

” বাব্বাহ্ আমার বউমা দেখছি ভিষণই বুদ্ধিমতি! সে এক বেলাতেই সবকিছু বুঝে গেছে। আমার ছেলেটা তাহলে মানুষ বাছতে ভুল করেনি। তবে শোন মা, প্রত্যেক পরিবারেই কোননা কোন সমস্যা, ঝামেলা থাকবেই। তার ভেতরেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। এবং সুযোগ পেলেই পুরোনো নিয়মকানুন কিংবা পুরোনো মন মানসিকতা একটু একটু করে বদলাতে হয়। আর রইল রা’গ, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, অভিমান সেগুলোও সংসার জীবনে থাকবেই। বুদ্ধিমানরা এগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে চোখকান খোলা রেখে এগুলোর মোকাবিলা করে। প্রথম প্রথম অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা, আঘাত, প্রতিরোধ অনেককিছুই আসবে। কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই মানুষকে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়। এক সময় দেখবে এসব কোন কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকেনা। তখন সংসার জীবন হয়ে ওঠে এক টুকরো স্বর্গ। ”

” আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পেরেছি, ফুপু। আপনার আজকের কথাগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে। ”

” নতুন বউকে দেখে আমি কি দিই বলতো? তোমার ফুপু শ্বাশুড়ি একজন আশ্রিতা। তোমাকে কিছু দিলে সেটা তাহমিদ কিংবা রাশেদের টাকায়ই দেয়া হবে। ”

” কিছুই দিতে হবেনা, ফুপু। শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ”

” কিছু দেবনা মানে! আমার আব্বার বউকে আমি কিছু না দিয়ে পারি? টাকা নেই তো কি হয়েছে এই আংটিতো আছে। এটা আমার মায়ের দেয়া। তাই এক মায়ের দেয়া জিনিস আরেক মা’কে তো দিতেই পারি। ” শাহানা আক্তার কথার মাঝখানেই কুহুর আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। আচমকা এমন কাজ করায় কুহু বাঁধা দেয়ার কোনও সুযোগই পায়না।

” ফুপু, এটা কি করছেন! আপনার মা’য়ের স্মৃতি এভাবে নষ্ট করবেননা।”

” নষ্ট কাকে বলছ শুনি? বললামইতো এক মা’য়ের জিনিস আরেক মা’কে দিলাম। এটা নিয়ে আর কোন কথাই হবেনা। তুমি শুধু এটাকে আগলে রেখ। আমার শূন্য জীবনে মা’য়ের এই শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলাম। ”

কুহু কোন কিছু না বলে শুধু শাহানা আক্তারের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।

” জানো বউমা, এক সময় আমার সব ছিল। বাবার বাড়িতে রাজকন্যার ন্যায় বড় হয়েছি। এস এস সি পাশ করার পর আব্বা ভালো পরিবারে বিয়ে দেয়। সেখানেও সুখের কমতি ছিলনা। বিয়েতে আব্বা দু হাত ভরে জিনিসপত্র দিয়েছিল। কত যে গহনা ছিল তা আমিই জানতামনা। সব শ্বাশুড়ির তত্বাবধানে থাকত।তাতে আমার কোন আপত্তিই ছিলনা। দুই বছর পর ছেলের মা হলাম। ছেলের বয়স যখন দেড়মাস, তখন একদিন জানতে পারলাম আমার স্বামী অন্য কারও প্রেমে মজেছে। খুব কান্নাকাটি করেছি। শ্বশুর শ্বাশুড়ির পায়ে পরেছি তাদের ছেলেকে যেন বোঝায়। স্বামীর পায়ে পরেছি, যেন সেই মেয়েকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা কেউই আমার কথা শোনেনি। পরে জেনেছিলাম, সেই মেয়ে নাকি অনেক ধনী পরিবারের। আমার আব্বার থেকেও চারগুণ বেশি ধনী। তাই আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছেলেকে কিছুই বলেনি। বরং উস্কে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। এক সময় আমার ওপর শুরু হলো অত্যাচার। কত মা’র খেয়েছি জানো? দিনের পর দিন খেতে দেয়নি। যখন আব্বার কানে এসব কথা গেল, আব্বা আমার কাছে ছুটে যায়। আব্বাকেও সে কি অপমান। আমি সেই দিনটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনা। আব্বার অপরাধ ছিল, আমার শ্বশুরের কাছে তার ছেলের নামে বিচার দেয়ার। আব্বা সব অপমান হজম করে আমাকে তার সাথে নিতে চাইলে, আমি মানা করে দিলাম। আমার অসহায় আব্বা সেই অপমান সইতে পারলনা। তিনদিন পর আমার চিন্তায়, নিজের অপমানের জ্বা’লা’য় স্ট্রোক করল। দুইদিন পরেই সে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। দুই বছর পর আমার স্বামী সেই মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসল। সেদিনই জানতে পারলাম সে দেড় বছর আগেই বিয়ে করেছিল। সেদিন অনেক কাঁদলাম, অশান্তি করলাম। কিন্তু কোন ফলই পেলামনা। ঐ বাড়িতে কাজের মেয়ের মত পরে রইলাম। হঠাৎ করেই একদিন ছেলেটার অসুখ করল। সে কি অসুখ! জ্বর ছাড়েনা কিছুতেই। পরপর তিন দিন জ্বর রইল। ওদেরকে অনেক অনুরোধ করলাম ছেলেটার চিকিৎসা করাতে। কিন্তু কেউই আমার কথা আমলে নিলনা। বাধ্য হয়ে শ্বাশুড়ির কাছে আমার আব্বার দেয়া গহনা চাইলাম। সেগুলো বিক্রি করে আমার খোকনের চিকিৎসা করাব। কিন্তু শ্বাশুড়ি অস্বীকার করল, সে বলল, আমার আব্বা আমাকে কোন গহনাই দেয়নি৷ আমি যেন অকুল পাথারে হাবুডুবু খেতে থাকলাম। গলার চেইন, আর কানের দুল বেঁচে খোকনের চিকিৎসা করলাম। কিন্তু পনের দিন পর খোকনও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। রা’গে, দুঃখে, ক্ষোভে ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাবার বাড়িতে যেতেই আমাকে দেখে ভাই-ভাবী মুখ বেজার করল। ততদিনে মা-ও আর বেঁচে নেই। শুরু হল আমার আশ্রিতার জীবন। আজ এখানে তো কাল ওখানে। অবশ্য তাহমিদ চায়, আমি যেন এখানেই থাকি। কিন্তু আমি কেমন করে থাকি বল। যার নিজের ভাইয়েরাই দ্বায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়, সেখানে ফুপাত ভাইয়ের বাড়িতে থাকা কি বেমানান নয়? ” শাহানা আক্তার অঝোরে কাঁদছেন। কুহুও কাঁদছে তার কথা শুনে। শাহানা আক্তারের কষ্টের কাছে নিজের কষ্টকে নেহাৎই শিশু মনে হচ্ছে। একেক মানুষের একেক কষ্ট। আজ কুহু উপলব্ধি করল, দুনিয়ায় কেউই সুখী নয়। কেউই পরিপূর্ণ নয়। একই দুঃখ বিভিন্নভাবে মানুষের মাঝে ফিরে আসে। পৃথিবীর বুকে দুঃখ নামক একটা জিনিসই হাজারো রূপে বিরাজমান।

কুহু কান্না থামিয়ে শাহানা আক্তারের চোখের পানি মুছে দেয়।

” ফুপু, কে বলেছে আপনার খোকন নেই! যাকে আপনি আব্বা বলে ডাকেন, সে-ই আপনার খোকন। আপনি এরপর থেকে কোথাও যাবেননা। আপনার আব্বার কাছেই থাকবেন। আপনার সব দায়-দায়িত্ব এখন থেকে তার। ”

শাহানা আক্তার কুহুর কথার কোনও উত্তরই দিতে পারলেননা। তিনি অঝোরে কাঁদতেই থাকলেন।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী জামী

ঢাকায় সাতদিন কাটিয়ে কুহু তাহমিদের সাথে রাজশাহী এসেছে। ওরা রাজশাহীতে আসার পরদিনই কুহুর বড় ফুপু গ্রামে ফিরে গেলেন।

কুহুর ক্লাস শুরু হয়েছে। ও নিয়মিত ক্লাস করছে। এবং কোচিং এ -ও ক্লাস নিচ্ছে। তবে তাহমিদের হস্তক্ষেপে ও একটা কোচিং-এ যেতে পারে। তা-ও আবার বিকেলে। সেখানে ওকে দুইটা ক্লাস নিতে হয়। তাহমিদ চায়না কুহু পড়াশোনার বাহিরে বেশি পরিশ্রম করুক। ওর একটাই চাওয়া কুহু যেন লেখাপড়া করে জীবনে বড় কিছু হতে পারে।

তাহমিদ নিয়মিত রাজশাহীতে যাতায়াত করে। যে দুইটা দিন রাজশাহীতে কাটায়, সেই দুইটা দিনই যেন কুহুর কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়। ও যেমন কুহুকে ভালোবাসায় আগলে রাখে। তেমনি সৃজনকে ছোট ভাইয়ের মতই ভালোবাসা দেয়। এবং সেই সাথে সৃজনের সকল দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

কুহুর কাছে তাহমিদ একজন আদর্শ স্বামী। এবং সে সন্তান হিসেবেও মোটেই খারাপ নয়। শুধু পারিপার্শ্বিকতার কারনেই ও কঠোর হতে চায়।

ওদের বিয়ের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে। কুহু প্রতি সপ্তাহেই তাহমিদের সাথে নানিমাকে দেখতে যায়। নানিমা আগের থেকে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি যেকোন মুহূর্তে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তাই কুহু সপ্তাহে দুইদিন করেও তাকে দেখতে যায়। তিনি এখন কাউকেই চিনতে পারেননা। শুধু মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

নায়লা আঞ্জুম গত ছয়মাস ধরে বাবার বাড়িতে আছে। রায়হান আহমেদ তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার বাসায় যেন নায়লা আঞ্জুম পা না রাখে। এমনকি তিনি তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই বাসায় আসলেও নায়লা আঞ্জুমের সাথে কথা বলেননা। এটা তাকে যতটা না কষ্ট দেয়, তার থেকেও বেশি কষ্ট দেয় রিশা, নিশো তার সাথে কথা না বলায়। সে অনেকবার তার ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওরা কেউই তাদের মা’য়ের ওপর সদয় হয়নি। এদিকে নায়লা আঞ্জুম এই বাসায় আর থাকতে চাইছেনা। এই সংসার এখন পুরোদমে সৈকতের স্ত্রী স্মৃতির দখলে। তার আদেশ নিষেধেই সংসার চালিত হয়। এটা নায়লা আঞ্জুম মেনে নিতে পারেনা। কিন্তু তার করার কিছুই নেই।

সকাল থেকেই স্মৃতি ব্যস্ত হয়ে আছে। আজকে তার বাবার বাড়ি থেকে মেহমান আসবে। তার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আরও কয়েকজন আসবে। সেজন্য আজ বাসায় আজ নানান আয়োজন করা হয়েছে। কি নেই রান্নার আইটেমে? সেসব দেখেই নায়লা আঞ্জুম ভেতরে ভেতরে জ্ব’ল’ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা৷ কারন এই ছয়মাসে সে বুঝতে পেরেছে, তাই ভাইয়ের বউকে যতটা নিরীহ দেখা যায়, আদতেই সে তা নয়। সে চুপচাপ থাকে ঠিকই কিন্তু মাঝেমধ্যে যেভাবে ফুঁসে ওঠে সেটা অবাক করে নায়লা আঞ্জুমকে।

” রাজিয়া আপা, আপনি শুধু রান্না করবেন। বাকি কাজ অন্যরা করবে। আপনি রান্নাঘরে বসে থেকে তাদের কাজ তদারকি করবেন। ওরা সব জোগাড় করে দিলেই তবে আপনি রান্না করবেন। ” স্মৃতি রান্নাঘরে এসে রাজিয়া খালাকে বলল।

” তুমি এত চিন্তা করবানা কইলাম। আমি যা করার করমুনে। তোমার শরিলডা উম্ সেই ভালোনা। এই শরলে কোন চাপ তোমার নেওনের দরকার নাই। তুমি সোফায় বসে বসে আমাদের কাজ দেখ। ”

রাজিয়া খালার সাথে স্মৃতির সম্পর্কটা বেশ ভালো। স্মৃতি আগে থেকেই রাজিয়ার সম্পর্কে জানত। তাই সে খুব তারাতারিই খালাকে আপন করে নিতে পেরেছে। সে তার ননদদের থেকেও রাজিয়া খালাকে বেশি আদর করে। আপন মনে করে। তার মতে, তার ননদরা একেকটা বড় মাপের বেয়াদব। যারা মানুষকে সম্মান দিতে জানেনা।

রাজিয়া খালাও স্মৃতির আচরণে সন্তুষ্ট। সে এই বাসায় আসার পর সবাইকে আপন করে নিয়েছে। শ্বাশুড়ির সেবা করছে মন দিয়ে। এখন রাজিয়া খালার অনেকটাই ছুটি মিলেছে। তবে মেয়েটা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট হওয়ায় একটু অসুস্থ হয়ে গেছে। তারপরও শ্বাশুড়ির সেবা সে মন দিয়েই করছে।

স্মৃতি ড্রয়িংরুমে বসেই কুহুকে ফোন করল। সে আগেই কুহুকে আজকের দিনের জন্য ইনভাইট করেছিল। যদিওবা কুহুকে সকাল সকাল আসতে বলেছিল। তবে কুহু জানিয়েছে একটা ক্লাস করেই সে এই বাসায় আসবে।

কুহু সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে বাসায় এসেছে। তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল ওর মামীশাশুড়ী ফোন দিয়েছে।

” আসসালামু আলাইকুম, মামী। কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি ভালো আছি, বউমা। তুমি কখন আসছ? এত দেরি করছ কেন? ”

” আমি মাত্রই ভার্সিটি থেকে ফিরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হব। ”

” সৃজনকেও নিয়ে আসবে কিন্তু। ওকে একা রেখে আসবেনা। নাকি ছেলেটাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছ? ”

” আজ ওকে স্কুলে পাঠাইনি। আমার সাথেই যাবে।”

” তারাতারি চলে এস। এখন আমি রাখছি। রায়হান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। দেখি তারা কখন আসে। ”

স্মৃতি ফোন রাখলে কুহু তৈরী হয়ে সৃজনকে নিয়ে বেরিয়ে পরে।

বাসায় এত আয়োজন দেখে নায়লা আঞ্জুম আর কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। তার ভাই শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে মেতে থাকবে এটা সে মানতেই পারছেনা। তার নিজের হাতে গড়া এত বছরের এই সংসার তার ভাইয়ের বউ নিজের দখলে নিয়েছে, এটা সে মানবে না।

সৈকত আহমেদ দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেছে। সে তার অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসা একজনের তত্বাবধানে রেখে, এখন দেশেই ব্যবসা শুরু করেছে। আজ বাসায় মেহমান আসবে জন্য সে অফিসে যায়নি।

সৈকত তার মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে স্ত্রী র পাশে বসল। মেয়ের সাথে খুনসুটির পাশাপাশি স্ত্রী র সাথে টুকটাক কথা বলছে। ঠিক তখনই নায়লা আঞ্জুম তার ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।

” সৈকত, তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”

” কি বলবে বল। ”

” তুই এসব কি শুরু করেছিস? মাসের পনেরদিনই তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এই বাসায় এসে পরে থাকে কেন? তাদের কি মিনিমাম চক্ষু লজ্জাটুকুও নেই! মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কেউ যে এভাবে আসে, তোর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে না দেখলে জানতামনা। আসলে তারা তো আজীবন কুঁড়ে ঘরে থেকেছে, এমন রাজপ্রাসাদ চোখে দেখেনি। তাই এমন ফকিন্নির মত আচরণ করে। তুই ওদেরকে মানা করে দিবি। তারা যেন এত ঘনঘন এখানে না আসে। তাদের সোসাইটি না থাকতে পারে, আমাদেরকে তো সোসাইটি মেইনটেইন করতে হয়। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে সৈকত আহমেদ রা’গে ফেটে পরছে। একই দশা হয়েছে স্মৃতিরও। এবার সে মুখ বন্ধ রাখতে পারলনা। অনেক সহ্য করেছে। আর নয়।

” মুখ সামলে কথা বলুন, ছোট আপা। আপনি এ পর্যন্ত অনেক কথাই বলেছেন। আমি চুপচাপ সহ্য করেছি। এখন দেখছি কথা বলতে বলতে আপনার মুখ বড় হয়ে গেছে। আমি আমার স্বামীর বাড়িতে আমার বাবা-মা আত্নীয় স্বজনদের আসতে বলেছি। আপনার স্বামীর বাড়িতে কাউকে নিয়ে যাইনি। কিংবা আপনার স্বামীর টাকায় আমার আত্মীয় স্বজনদের খাওয়াইনা। যে মেয়ের নিজের চক্ষু লজ্জা নেই, সে আবার অন্যের চক্ষু লজ্জা নিয়ে মাথা ঘামায় কেমন করে! যে মেয়ে নিজের সংসার ফেলে ছয়মাস ধরে ভাইয়ের বাড়িতে পরে আছে, আর যাইহোক তার মুখে চক্ষু লজ্জা কথাটা শোভা পায়না। যে মেয়ে নিজে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তার মুখে এত বড়বড় কথা মানায়না। আমার বাবার বাড়ির আত্মীয়রা আপনার মা’কে দেখতে আসবে। তারা পাত পেরে খেতে আসবেনা। কিন্তু মেয়ে হিসেবে তাদের আপ্যায়ন করার দ্বায়িত্ব আমার। আপনি এসবের কি বুঝবেন? নিজের মা’য়ের শরীরে একদিনও তো হাত দিয়ে ধরে দেখেননি। কিংবা একবেলা মুখে তুলে খাইয়ে দেননি। আপনি ভালোবাসা জিনিসটা বুঝবেননা। আপনি বুঝেন নিজের স্বার্থ। কিসের অহংকার করেন? স্বামী তো ছয়মাস আগেই আপনাকে এখানে ছেড়ে গেছে। যেই মেয়েকে তার স্বামী ত্যাগ করেছে, তার মুখে এত বড়বড় কথা মানায়না। নিজের যদি এক তিল পরিমানও সম্মান থাকত তবে ভাইয়ের বাড়িতে থেকে, তারই খেয়ে পরে তার স্ত্রীকেই এসব কথা বলতেননা। আজকে শেষ বারের মত আপনাকে বলছি ভালোভাবে শুনে রাখেন, এরপর কখনো এই ধরনের কথা বললে, আপনার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেব। ”

আজ সৈকত আহমেদও নীরবে সবটা শুনে গেল। সে তার স্ত্রী র কথা কোনই প্রতিবাদ করলনা।

স্মৃতির এমন আক্রমনাত্বক কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম যেন জমে গেছে। সে স্মৃতির কথার প্রত্যুত্তর করতে ভুলে গেছে। আজ পর্যন্ত বাহিরের কেউ তাকে এভাবে বলেনি, এটা তার বারবার মনে হচ্ছে। স্মৃতির মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বুঝতে পারল সে পুনরায় মুখ খোলা মাত্রই স্মৃতি তাকে আরও কিছু কঠিন কথা বলতে ছাড়বেনা। তাই সে চুপচাপ সবকিছু হজম করে।

এদিকে স্মৃতির রা’গ কিছুতেই কমছেনা। সে হাতের কাছে থাকা একটা শো পিস মেঝেতে ছুঁড়ে মা’র’ল।

” স্মৃতি, এমন পা’গ’লা’মি করছে কেন! তোমার শরীর ভালো নেই, সেটা কি তুমি জানোনা? রিলাক্স, আমি রাজিয়া আপাকে জুস দিতে বলছি। তুমি জুস খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবে, কেমন? ” সৈকত আহমেদ তার স্ত্রীকে নরম গলায় বলল।

” জুস তোমার বোনকে খাওয়াও। তুমি ছাড়া তাকে খাওয়ানোর এখন কেউ নেই। সে কত বড় ফকিন্নি দেখেছ? তোমার বাসায় থাকছে, তোমারই খাচ্ছে পরছে কিংবা অন্যকে ফকিন্নি বলে! আমার তো মনে হয়, তার থেকে বড় ফকিন্নি এই দেশে আর দুইটা নেই। আমার বাবা-মা এখানে তোমার মা’কে দেখতে আসে। তারা এখানে দিনের পর দিন পরে থাকেনা। কিন্তু সে ঠিকই ছ্যাঁচড়ার মত এখানেই থাকছে। আবার গলাবাজিও করছে। ”

এবার নায়লা আঞ্জুম আর সহ্য করতে পারলনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এত অপমান কিছুতেই সহ্য করা যায়না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে