#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী জামী
” এভাবে কি দেখছ! আমাকে কি আগে কখনো দেখনি? ” কহু তাহমিদের রুমে এসে আরেক দফা অবাক হয়ে তাহমিদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। কহুকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয় তাহমিদ।
” দেখছিনা, ভাবছি। ”
” কি ভাবছ! ”
” যে মানুষটা এত বড় বাড়ির ছেলে, রাজকীয় যার রুম, সে আমাদের গ্রামের বাড়ির এক সাদামাটা রুমে কিভাবে কাটিয়েছে! তার কি কোনও কষ্ট হয়নি! ”
” মেয়ে, তুমি কি তোমার মুখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখবে? তোমাকে আগেই বলেছি, এটা আমার বাড়ি নয়। আর এই রুমের মালিকও আমি নই। তাই এসব আজেবাজে চিন্তা করে আয়ু কমানোর কোন মানেই হয়না। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো চলে আসবে। খেয়েদেয়ে জম্পেশ ঘুম দেবে। যাও ফ্রেশ হয়ে এস। ” তাহমিদ কুহুকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়।
কুহু ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল তাহমিদ বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। মনযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। তাহমিদকে এই অবস্থায় দেখে ওকে বিরক্ত করার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কুহুর। এ ওয়াশরুমে গিয়ে দু হাতের আঁজলায় পানি নিয়ে এসে তাহমিদের শরীরে ছিটিয়ে দিল।
হঠাৎই শরীরে পানি পরতেই কুহু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কুহুর দিকে তাকাতেই দেখল, মেয়েটার ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির হাসি।
” বউ দেখছি আমার সাথে দুষ্টুমি করতেও শিখে গেছে! অথচ আমি আমার বউটাকে নাদান বালিকা ভেবে, পারলে সারাদিন-রাত কোলে নিয়ে বসে থাকার চিন্তায় বিভোর থাকি! আর এই মেয়ে কিনা আমাকেই ঘোল খাওয়ানোতে পটু। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিল করে হাসতে থাকে। ও তাহমিদের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।
” তবে রে মেয়ে, আমাকে বিপর্যস্থ হতে দেখে মজা নিচ্ছ! ওয়েট, আমিও এখন মজা নিব। তার আগে তোমাকে বাথটাবে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখব। ” তাহমিদ বিছানা থেকে নেমে কুহুকে ধরতে গেলেই মেয়েটা দৌড়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
” আপনি আর এক ধাপ সামনে এগোলে আমি দরজা খুলে বাহিরে চলে যাব। সোজা আমার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে গল্প করতে বসে যাব। গল্প করতে করতে সারারাত কাটিয়ে দেব। বিষয়টা খুব একটা খারাপ হবেনা তাইনা? ”
কুহুর হুমকিতে তাহমিদ মোটেও ভয় পায়না। তবে এই মুহুর্তে ওর মেয়েটাকে ধরতে হবে। তাই কায়দা করে কুহুর কথা শোনার ভান করল। একবার ওকে ধরতে পারলেই কেল্লাফতে। ওকে আর পায় কে।
” তুমি এইভাবে আমাকে হুমকি দিচ্ছ, বউ? আমার মত এমন ইনোসেন্ট জামাইকে তুমি এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারনা। এটা অন্যায়। শুধু অন্যায়ই নয় মহাঅন্যায়। আর একজন পতিব্রতা রমনী হিসেবে এটা তোমার আচরণের পরিপন্থী হয়ে যায়। এই অসহায় মানুষটার ওপর তোমার কি একটুও দয়া হয়না? যদিও তুমি তোমার নামমাত্র শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে পাত্তা পাবেনা। তবুও তোমার কথা শুনে আমার কেমন যেন কষ্ট কষ্ট ফিল হচ্ছে। ” তাহমিদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল।
” হয়েছে আর অভিনয় করতে হবেনা। সাধে তো আর বলিনা, অভিনয়ের জন্য আপনি কয়েকটা অস্কার ডিজার্ভ করেন। এতে অস্কারও ধন্য হয়। অস্কারও আপনাকে মনেপ্রাণে কামনা করছে। ”
” তুমি আমাকে বিশ্বাস করলেনাতো, বউ! এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। তাহমিদ ভাই, তুই সত্যিই হতভাগা। বউ তোকে বিশ্বাস করেনা। ” তাহমিদ কথা বলত বলতে গুটিগুটি পায়ে কুহুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কুহু সেটা বুঝতে পেরে দরজা খুলতে চাইলেই কেউ বাহির থেকে দরজায় নক করল।
” তাহমিদ , আব্বা, তুমি ফ্রি আছ? ” বাহিরে শাহানা আক্তারের গলা শুনতে পেয়েই কুহু থেমে যায়। ও দরজা খোলার অনুমতি নিতে তাকায় তাহমিদের দিকে।
তাহমিদ ইশারা করলে কুহু দরজা খুলে দেয়।
” ভেতরে এস, ফুপু। ”
” আব্বা, আজকে তুমি আর বউমা তোমার বাবার সাথে খাবে। রাশেদ তোমাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে যেতে বলেছে। ” শাহানা আক্তার ভেতরে এসে বললেন।
” ফুপু, তুমি সবকিছুই জানো। তারপরও কেন এমন আবদার করছ! এমন আবদার কেন কর, যেটা আমি রাখতে পারবনা। আর আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। ডেলিভারি বয় রাস্তায় আছে। কয়ে মিনিটের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে। ”
” আব্বা, রাশেদের ইচ্ছে সে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। এটা তার আবদার, আমার নয়। আসুক ডেলিভারি বয়। খাবার আমি রিসিভ করব। আমরা সবাই মিলে সেগুলো খাব। ” শাহানা আক্তার বায়না করলেন।
” আজ হঠাৎ তার এমন ইচ্ছের কারন কি? তার স্ত্রী-সন্তানেরা আছে। তাদের পাশে আমার স্ত্রী বেমানান। নাকি আমার স্ত্রী’ কে অপমান করতেই এই আয়োজন? ”
” তাহমিদ, তুমি রাশেদের প্রথম সন্তান। আজ তুমি নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসেছ। সে কিন্তু বিনাবাক্যে বউমাকে মেনে নিয়েছে। বউমাকে দেখার পর থেকেই ওকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। ওর তো ইচ্ছে করতেই পারে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। তুমি আর না করোনা, আব্বা। ”
” না গেলে হয়না, ফুপু ? তুমি তো জানো, কত বছর আমি তার সাথে খাইনা। ”
” আমার কথা শোন। আজকে রাতে একসাথে খাও। তুমি যদি দেখ, তোমাদের সামান্যতমও অসম্মান হচ্ছে, তবে আর খেওনা। আর তখন তুমি প্রতিবাদ করলেও আমি কিছুই বলবনা। আমার এই অনুরোধ রাখ, আব্বা ”
” তুমি আমাকে অনুরোধ নয়, আদেশ করবে, ফুপু। তোমার আদেশ মেনে আজ তোমার ভাইয়ের সাথেই খাব। তবে সে যেন আমাকে না খোঁ’চা’য়। তাকে বলে দিও। ”
” আমি এখনই রাশেদকে গিয়ে বলছি। তোমরা তারাতারি নিচে এস। বউমা , আমি গিয়ে তোমার শ্বশুরকে বলছি। তোমরা দেরি করোনা কেমন? আমার রান্নাও শেষের দিকে। ” শাহানা আক্তার হেসে রুম ত্যাগ করলেন।
আরও আধাঘন্টা পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে নিচে আসল। ততক্ষণে রাশেদ কুরাইশি ডাইনিং টেবিলে এসেছেন। তিনি একা বসে আছেন। চোখের সামনে ফোন নিয়ে মনযোগ সহকারে কিছু দেখছেন। অনেকদিন পর ডাইনিং এরিয়ায় এসে তাহমিদের সংকোচবোধ হচ্ছে। ও চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসল। শাহানা আক্তার কুহুকে বসতে বললেই, রাশেদ কুরাইশি তাকালেন কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদের পাশের চেয়ারে বসতে গেলেইস, রাশেদ কুরাইশির ডাকে ও থমকে দাঁড়ায়।
” বউমা, তুমি আমার পাশে এসে বস। ” রাশেদ কুরাইশি কুহুকে চেয়ার দেখিয়ে দিল কুহু সেখানে গিয়ে বসল।
তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে রাশেদ কুরাইশির দিকে। ওর বাবা হঠাৎ কেন এমন নমনীয় আচরণ করছে, সেটা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা।
শাহানা আক্তার এসে একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন করেছেন। তবে তাহমিদের বাঁধায় তাকে থামতে হল। তাকেও ওদের সাথে খেতে বসতে হল।
এভাবে সবার সাথে খেতে কুহুর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আচরণে ও মুগ্ধ। তিনি নিজ হাতে এটাসেটা কুহুর পাতে তুলে দিচ্ছেন। কুহু খেতে না চাইলেও তিনি জোর করে দিচ্ছেন।
শাহানা আক্তার খাওয়ার ফাঁকে তাহমিদের প্লেটে রুই মাছের মাথা তুলে দিতে গেলেই রাশেদ কুরাইশির কথায় তিনি থেমে যান।
” আপা, তুমি ওকে সর্ষে ইলিশ দাও। ও মাছের মাথা খেতে পারেনা। ও রুই মাছ অতটা পছন্দও করেনা। সর্ষে ইলিশ খাওয়া হলে, চিংড়ির মালাইকারি দিও। ” রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে শাহানা আক্তার হেসে তাহমিদের প্লেটে সর্ষে ইলিশ তুলে দিলেন।
তাহমিদ বাবার কথা শুনে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ওর পছন্দ-অপছন্দ ওর বাবা জানে! সে কিভাবে জানল, তাহমিদের সর্ষে ইলিশ পছন্দ? আবার চিংড়ির মালাইকারি কথা সে জানল কিভাবে!
হঠাৎই তাহমিদ অনুভব করল ওর চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। যেই বাবা কখনো তার ছেলের ভালোমন্দ খেয়াল রাখেনি, সে-ই বাবাই আজ তার ছেলের পছন্দের কথা বলছে! তাহমিদ অতি সন্তর্পনে চোখ মুছে খাবারে মনযোগ দেয়।
” বাবা, আপনাকে একটু মালাইকারি দেই? আপনিতো শুধু করলা ভাজি দিয়েই খাচ্ছেন। ” কুহু সাহস করে রাশেদ কুরাইশিকে বলল।
” বউমা, আমার ডায়বেটিস আছে। তাই তিন বেলাই করলা খাই। ইচ্ছে থাকলেও এসব খেতে সাহস হয়না। ”
রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও মৃদুস্বরে বলল,
” একবেলা খেলে কিছুই হবেনা, বাবা। আমি আপনার প্লেটে অল্প একটু তুলে দিচ্ছি। আপনি খান। ” কুহু ওর শ্বশুরের প্লেটে চিংড়ির মালাইকারি তুলে দিলে রাশেদ কুরাইশি আগ্রহ নিয়ে খেতে থাকলেন।
কুহুরা বেশ কিছুক্ষণ হয় খেতে বসেছে। এরমধ্যে ডেইজি কুরাইশিকে সে কোথাও দেখেনি। ও বুঝতে পারছে ওরা খেতে এসেছে জন্যই বোধহয় সে এখানে আসেনি। বিষয়টা কুুহুর কাছে ভালো লাগলনা। নিজেকে কেমন উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আন্তরিকতায় কোন কৃত্রিমতা নেই। যেটা কুহুকে আকৃষ্ট করেছে।
” তুমি রান্না করতে পার, বউমা? ” খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ কুরাইশি।
” জ্বি, বাবা। সব রান্নাই মোটামুটি পারি। ”
” কালকে দুপুরে আমি বাসায় খাব। তুমি কালকে আপার সাথে রান্না করতে পারবে? আমি কিন্তু ভোজনরসিক। কিন্তু ডায়াবেটিস শরীরে আক্রমণ করার পর থেকে খাওয়াদাওয়া সব শিকেয় তুলেছি। কিন্তু তুমি যদি রান্না কর, তবে রিস্ক একটা নেয়াই যায়। ”
” ঠিক আছে বাবা, আমি রান্না করব। আপন শুধু বলুন কি কি খাবেন? ”
” আমি সবই খাই। তুমি তোমার পছন্দমত রান্না কর। তবে এই ভদ্রলোক কি খাবে সেটাও জিজ্ঞেস নিও। তার পছন্দের খাবারও রান্না কর। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদকে ইংগিত করে বললেন।
” ধন্যবাদ। আমি কাল ভার্সিটি থেকে কোচিং-এ ক্লাস নিতে যাব। তাই দুপুরে বাসায় আসতে পারবনা। আপনিই বরং কবজি ডুবিয়ে খেয়েন। ”
” আমিতো খাবই। বউমা প্রথমবার আমার জন্য রান্না করবে। আমি প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই খাব। ”
শাহানা আক্তার বাবা-ছেলের কথপোকথন শুনে হাসলেন। তবে রাশেদ কুরাইশিকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে তার খুব শান্তি লাগছে। তবে কি বাবা-ছেলের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে?
বিঃদ্রঃ গত তিনদিন ধরে আম ভিষণ অসুস্থ। ফোনের দিকে তাকানোর অবস্থায় ছিলামনা। তাই লিখতেও পারিনি। তিনদিন থেকে স্লিপিং পিল খেয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছি। আজ একটু সুস্থ হওয়ায় এতটুকু লিখতে পেরেছি। আপনারা কষ্ট করে এতটুকুই পড়ুন। ভালোবাসা পাঠকমহলকে।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী জামী
” ছেলে আর ছেলের বউকে সাথে নিয়ে ডিনার করে খুব শান্তি পেয়েছ তাই না? এখন কি মনে হচ্ছে, এতদিন এত সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলাম কেন? যতসব লো ক্লাস মেন্টালিটি। এক দেখাতেই ছেলের বউ তার আপন হয়ে গেছে। এখন আমি যেন আর কেউনা। ড্যাং ড্যাং করতে করতে ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে ডিনার করল। ঐ থার্ড ক্লাস মেয়ের সামনে নিজেকে দ্বায়িত্বশীল শ্বশুর হিসেবে পরিচিত করল। ” ডেইজি কুরাইশি রা’গে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলল।
স্ত্রী ‘র কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলার জন্য কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছেননা। কি অবলীলায় তার স্ত্রী এসব বলছে, ভেবেই তিনি বিস্মিত হচ্ছেন। অথচ ডিনার করতে যাওয়ার আগে তিনি ডেইজি কুরাইশিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করেছেন। কিন্তু সে তার কোন কথাই শোনেনি।
” কয়দিন পর দেখব আমার ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে সব প্রপার্টি ঐ অসভ্য, ছোটলোক ছেলেকে দিয়ে বসে আছে। এখন ছেলেই সব। আমার রায়ান আর জাহিয়া কিছুই নয়। সব ঐ অসভ্যটার অবদান। ” রাশেদ কুরাইশিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ডেইজি কুরাইশি তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে।
এবার আর রাশেদ কুরাইশি চুপ করে থাকলেননা। তিনি রে’গে উঠলেন।
” তুমি চুপ করবে? আমার কাছে আমার তিন সন্তানই সমান। তাহমিদ রায়ান, জাহিয়ার থেকে আমার কাছে কোনও অংশেই কম নয়। আমার সব প্রপার্টি ওদেরকে সমান ভাগে ভাগ করে দেব। এই নিয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। ” রাশেদ কুরাইশি আর কথা না বাড়িয়ে একটা বই হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে বসলেন।
রুমে এসে কুহু মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। এতক্ষণ ঘোমটার আড়ালে থেকে ওর হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। তাহমিদ রুমে এসে বেলকনির দরজার খুলে পর্দা সরিয়ে দেয়। পর্দা সরিয়ে দিতেই হু হু করে বাতাস রুমে ঢুকল। হঠাৎই ঠান্ডা বাতাসের পরশ পেতেই কুহু বাহিরে তাকায়। রাতের কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত এই বাড়ির এরিয়া। কৃত্রিম আলোরছটায় চাঁদের আলোর দেখা পাওয়া মুশকিল। তবুও ধীর পায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। একটু যদি চাঁদের আলোর পরশ শরীরে নেয়া যায়। কুহুকে বেলকনির দিকে যেতে দেখে তাহমিদও ওর পিছু পিছু যায়।
মেয়েটা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি দূর ছায়ালোকের দিকে। যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো তারকারাজি। গায়ে মেখেছে চাঁদের আলোর রূপালী ঝর্ণা।
তাহমিদ পেছনে দাঁড়িয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল কুহুর কোমড়। তাহমিদের স্পর্শে কুহু কেঁপে উঠল। তাহমিদ ধীরে ধীরে ওর হাত কুহুর উন্মুক্ত পেটের দিকে নিয়ে যায়। থুতুনি রাখে কুহুর খোলা কাঁধে। তাহমিদের দাড়ির ঘষাষ শিরশিরিয়ে উঠল কুহুর তনু। অসার হয়ে আসে ওর সর্বাঙ্গ। এদিকে পেট জুড়ে তাহমিদের ছোঁয়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। কুহু ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে তার একান্ত পুরুষের ভালোবাসার অত্যাচার। যে অত্যাচারে নেই কোনও দুঃখ, কষ্ট। তাহমিদের হাত এতক্ষণ কুহুর পেটে বিচরণ করছিল, এবার সে কুহুর খোলা কাঁধে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর কুহুর হুঁশ হয় ওদেরকে এই অবস্থায় কেউ যদি দেখে! ও হুট করেই তাহমিদকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। কুহুর ধাক্কায় তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
” এভাবে রোমাঞ্চের চৌদ্দটা না বাজালেই কি হচ্ছিলনা! নিষ্ঠুর রমনী। নিজেও ভালোবাসবেনা, আবার আমি ভালোবাসতে গেলেই দূরে সরিয়ে দেয়। আমার কপালে বউয়ের আদর নেই। ”
” ছিহ্ এসব কি বলছেন! আপনার দেখছি লজ্জা শরমের বালাই নেই। আশেপাশে কত বিল্ডিং। কেউ আমাদের এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে বলুনতো? ”
তাহমিদ কুহুর কথা পাত্তা না দিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। এরপর বেলকনির মেঝেতে পাতা বিছানায় ওকে নিয়ে বসল। তাহমিদ কুহুকে কোলে নিয়েই বসেছে। ওর নড়াচড়ার কোন উপায় রাখেনি।
” কেউ দেখলে দেখবে। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি আমার বউকে আদর করছি। এতে লজ্জার কিছুই নেই। এত কম কম আদর করলে দুই ডজন ছানাপোনা কেমন করে আসবে! ”
” কিহ্, দুই ডজন! আপনার মাথা ঠিক আছে? নাকি মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু খেয়েছেন? ”
” বউ, তুমি ভালো করেই জানো আমি আজেবাজে কিছু খাইনা। তোমার বর একদম বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ আর অসহায়। ”
” জানিনা আবার। ”
” কি জানো? ” তাহমিদ কুহুর গলায়, কাঁধে গাল ঘষে বলল।
” আপনি একদম খাঁটি মানুষ। ”
” গুড। একমাত্র জামাইয়ের জন্য সব সময়ই এমন ভালো ধারনা পোষণ করবে। এতে আমার ছানাপোনারাও তাদের বাবাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে এবং বাবার ভক্ত হবে। তাদের সামনে বেশি বেশি আমার সুনাম করবে। ”
” হুম করব সুনাম। ”
” গুড। ”
” শুনুন। ”
” বলুন। ”
” বাবাকে আমার বেশ লেগেছে। তিনি আমাকে কত যত্ন করে খাওয়ালেন। আবার আপনারও খেয়াল রাখলেন। এতদিন আপনি শুধু শুধু তার ওপর রা’গ করেছেন। ”
” এক বেলাতেই পটে গেছ! কয়েকদিন এখানে থাক। তার স্বরূপ তোমার সামনে উন্মোচিত হোক। তারপর বল তিনি কেমন। আগে পটে গেলে মানুষ চেনার পর কষ্ট পাবেতো। আর আমি চাইনা তুমি কষ্ট পাও। ”
” আবারও? আপনি এমন কেন! কি হয় বাবার সাথে ভালো করে কথা বললে? ”
” কিছুই হয়না। তার সাথে ভালো করে কথা বললে আমি কি একটা সুস্থ শৈশব, কৈশোর কিংবা স্বাভাবিক যৌবন ফিরে পাব? ”
” জানি, সেসবের কিছুই পাবেননা। কিন্তু আপনার স্বাভাবিক কথাবার্তায় যে বাবা খুশি হবেন। আমি লক্ষ্য করেছি, বাবা আপনার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়ান। একজন বাবাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেননা। আমি জানি আপনার কাছে বিষয়টা অনেক কঠিন। তবুও একজন বাবাকে খুশি রাখতে এতটুকু করাইতো যায়। ”
” সারাজীবন শুধু অন্যকে খুশ করে যাব? তবে আমি কেন একটু খুশির স্বপ্ন দেখতে পারিনা? আমার চারপাশ কেন আঁধারে ছাওয়া? কি দোষ ছিল আমার? ”
” আপনার কোনই দোষ ছিলনা। আপনি দু’জনের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েনে পিষ্ট হয়েছেন। যার প্রভাবে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। আপনার চারপাশ আঁধারে ছাওয়া ঠিকই। কিন্তু আপনি নিজে একজন আলোর দিশারি। যার আপাদমস্তক আলোয় ঝলমল করে, ঝলমলে রোদ্দুরের ন্যায়। থাকুকনা তার চারপাশে আঁধার। সেই আঁধার কভু আপনাকে ছুঁতে পারবেনা। ঝলমলে রোদ্দুরের তেজোদ্দীপ্ত বর্ণচ্ছ্বটায় আঁধার কি তার পাখনা মেলতে পারে? ”
” তুমি সবটা জানোনা তাই এভাবে বলতে পারছ। ” তাহমিদ বিষাদ মাখা গলায় বলল।
” আমি সবই জানি। খালা একদিন আমাকে অনেককিছুই বলেছেন। আপনি জীবনে যা যা সহ্য করেছেন, তারপরও যে আপনি নিজেকে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তা কয়জন পারে? আপনি অনেকের অনুপ্রেরণা হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ”
” কি ব্যাপার বউ, আজ আমার এত প্রশংসা করছ কেন? আমিতো দেখছি খুশিতে পা’গ’ল হয়ে যাব। বউয়ের প্রশংসা পেতে ভাগ্য লাগে। আজকে আমার ভাগ্য দেখছি সুপ্রসন্ন! ” তাহমিদ একটু হেসে ভরাট কন্ঠে বলল।
” চুপ করবেন? টিটকারি মা’র’ছেন কেন! আমি যা কিছু বলেছি, সবটাই সত্য। ” কুহু অভিমানে মুখ ফোলায়।
” আমি কখন বললাম, তুমি মিথ্যা বললে! আমিতো নিজের প্রশংসা শুনে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছি। আরেকটু প্রশংসা করলে প্লেন ছাড়াই অন্য মহাদেশে উড়াল দেব। ”
” আবার? আপনি সত্যিই একটা বদ লোক। ”
” এইতো সত্যি কথা বের হয়েছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই আরও কিছু শুনতে পাব। তাইতো বলি, বউ করবে জামাইকা প্রশংসা! বউ জাতির সৃষ্টিই হয়েছে জামাইয়ের পেছনে কাঠি নাড়তে। ”
” এই আপনি আমাকে এখনই ছাড়ুন। আপনার সাথে কোন কথা নেই। জীবনেও আপনার প্রশংসা করবনা। আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আমি তার সাথে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করতে চাইলাম, আর সে আমার সাথে মজা করে। আসলে সে চায়না, তার জীবনের গল্প আমার সাথে শেয়ার করতে। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও তাহমিদের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের কোলেই থাকতে হয়।
” যে ছেলে ছোট থেকেই বাবা-মা ‘র মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। নয় বছর বয়সে যাকে তার মা ফেলে রেখে অন্য কারও হাত ধরে চলে যায়, যার বাবা অন্য নারীতে মত্ত সেই ছেলের জীবন কি এতই সহজ? প্রতিনিয়ত তাকে মানুষের কটুকথা শুনতে হয়েছে। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। ভ্যাগাবন্ডের ন্যায় এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। যার জীবন নানিমা আর রাজিয়া খালা নামক মানুষ দুটো ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব ছিলনা। তবে মাঝেমধ্যে শাহানা ফুপু এসে আদরে ভরিয়ে দিত। একটা সময় সে সংসার না করার পণ করে। কিন্তু একদিন হঠাৎই এক কান্নাভেজা চোখে সে আটকে যায়। আটকে যায় শ্যামাঙ্গীনি এক কিশোরীর মায়াময় মুখে। তার হৃদয়মাঝে আটকে থাকা ভালোবাসা উছলে পরে। সে বহু বছর পর জানতে পারল, তার ভেতরও ভালোবাসা বাস করছে। যে ভালোবাসার জোয়ারে সে সবকিছু ভাসাতে প্রস্তুত। সেইদিনই তার সকল পণ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই কিশোরী কন্যাকে নিজের করে পেতে চায়। একটা সময় সে পেয়েও যায় তার কিশোরী কন্যাকে যতটা আপন করে পেলে দু’জনের মাঝে কোন লজ্জার বালাই থাকেনা, যতটা আপন করে পেলে দুনিয়াকে তুচ্ছ করতে ইচ্ছে করে। সেভাবেই সে পেয়েছে তাকে। আজ এই মধুর রজনীতে সেই কিশোরী কন্যা তার নিজস্ব পুরুষের কোলে বসে সেই কথাই শুনছে। আর কিছু শুনতে চাও আমার শ্যামাঙ্গীনি? ” তাহমিদের দরদ মাখানো কথা শুনে কুহু বিমোহিত নয়নে তাকায়।
তার কথাগুলো কুহুর বুকে আছড়ে পরল বাঁধভাঙা ঢেউয়ের ন্যায়। যে ঢেউয়ের তোড়ে কুহু যেকোন পরিস্থিতিতে ভাসতে রাজি। হারাতে রাজি মধুমাখা প্রেমহিল্লোলে। কোথায় থেকে একরাশ আবেগ এসে কুহুকে জড়িয়ে নেয়। সে-ও স্থান কাল ভুলে তাহমিদের গলা জড়িয়ে ধরে, তার পানে চায় নেশাক্ত চোখে। ওর ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।
তাহমিদ হেসে তার রমনীর ঠোঁট ঠোঁট ডুবায়।
চলবে…