প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩৭+৩৮

0
547

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী

” অনেক বেলা হয়েছে, এবার তো আমাকে ছাড়ুন। চাচার বাসায় যাবেননা? এখন যদি না উঠি, তবে ঐ বাসায় যেতে দেরি হবে। ”

তাহমিদ কুহুকে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। কুহু অনেকক্ষণ থেকে ওকে ছাড়তে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। কিন্তু তাহমিদের কানে কুহুর সেসব কথা পৌঁছলে তো। ও দিব্যি কুহুর গলায় মুখ গুঁজে ঘুম দিচ্ছে।

” উম বউ, এত কথা বলছ কেন? তুমিও চুপচাপ ঘুমাও, আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। চাচা শ্বশুরের বাসায় যেতে দেরি হবে। ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল।

” আপনি ঘুমান। কে মানা করেছে। আমাকে ধরে রেখেছেন কেন! আমাকে ছাড়ুন। নাস্তা বানাতে হবেনা? ”

” শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছেনা। সেখানেই গিয়ে নাস্তা করব। আমার চাচা শ্বশুর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি সকাল সকাল তার বাসায় যেতে বলেছেন। যেহেতু নাস্তা তৈরীর ঝামেলা নেই, সেহেতু আরও এক ঘন্টা ঘুমানোই যায়। ”

কুহু চোখ পাকিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার কোনও হেলদোল নেই। অনেক চেষ্টার পরও কুহু তাহমিদের হাতের বাঁধন ঢিলা করতে পারলনা। বাধ্য হয়ে ওকেও শুয়ে থাকতে হয়।

রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের এগারোটা বেজে যায়। ওদেরকে দেখেই রায়হান আহমেদ এগিয়ে আসলেন। তিনি সরাসরি তাহমিদে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলেন। তাহমিদের খাবেন জন্য তিনি এখনও না খেয়ে আছেন।

বিকেলে কিছু সময়ের জন্য তাহমিদ বাহিরে যায়। ও কোথায় যাচ্ছে, সেটা কাউকেই জানায়না।

” নানিমা, তুমিও কি খালামনির মত আমাকে দোষী ভাব? আমিতো শুধু চেয়েছি তোমার মুখে হাসি ফোটাতে। মামাকে ছাড়া তুমি যে কতটা কষ্টে ছিলে, সেটা আর কারও চোখে না পরলে আমার চোখে পরেছে। কিন্তু কালকে যেটা হল, সেটার জন্যও কি আমিই দায়ী? ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত নিজের দু হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে করুণ স্বরে কাতরতার সাথে বলল।

তাহমিদের করুণ স্বর ফাতিমা খানমের বুকে আঘাত হানে। তিনি সজোরে মাথা নাড়িয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। তিনি একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন নাতির দিকে। এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন তার প্রানপ্রিয় নাতিকে।

” বাপজান, তুমি রাইতে খাইয়া যাইবানা? ” রাজিয়া খালা জিজ্ঞেস করলেন।

তাহমিদ নানিমার সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। সেখানে সে মামা-মামীর সাথে কথা বলছে। তখনই রাজিয়া খালা এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন।

” না খালা, আজ এখানে খেতে পারবনা। আরেকদিন এসে তোমার হাতে খেয়ে যাব। তা তুমি কি রান্না কর, নাকি মামী করে? ”

” না তাহমিদ, এখনো আমি রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিইনি। রাজিয়া আপা সবকিছুই সামলাচ্ছে। ” তাহমিদের মামী স্মৃতি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল।

” মামী, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। রাজিয়া খালা রান্নাবান্নায় পটু। তার হাতের রান্না খেলে অন্য খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনা। আপাতত আপনি খালার রান্না খেয়ে রুচি বাড়ান। ”

” তুমি কিন্তু রাতে খেয়ে যেও। বউমাকেও সাথে নিয়ে আসতে। কালকে ওর সাথে গল্প করতেই পারলামনা। ”

” আজ খেতে পারবনা, মামী। আজকে আমরা চাচা শ্বশুরের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছি। সেখান থেকেই এখানে এসেছি। রাতে সেখানেই খাব। ”

নায়লা আঞ্জুম তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতেই তাহমিদের কথা তার কানে পৌঁছে যায়। সে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তাহমিদের কথা যেন কানে বি’ষে’র ন্যায় আছড়ে পরল। তার অনুপস্থিতিতে তারই বাসায় রায়হান আহমেদ মেলা বসিয়েছে সেকথা ভেবেই তার রা’গে শরীর চিরবির করছে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের বাসায় ফিরে গেলেই এসবের প্রতিদান রায়হান আহমেদকে হাড়েহাড়ে টের পাইয়ে দেবে। সে ধুপধাপ পা ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল।

” বউ, শ্বশুর বাড়িতে যেতে চাও? তোমার দেখতে ইচ্ছে করেনা তোমার এই অসহায় জামাই কোথায় থাকে? ” কুহুকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ। মেয়েটা কয়েকদিন পর আজ কোচিং-এ গিয়েছিল। কোচিং-এ আজ পরীক্ষা ছিল। কুহু সেই খাতাগুলোই দেখছিল। হঠাৎ তাহমিদ ওকে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে চমকে উঠেছিল। পরে তাহমিদের গলা পেয়ে মৃদু হাসল মেয়েটা।

” কে বলছে আপনি অসহায়! আপনি যদি অসহায় হন, তবে আমি কি? সারাদিন যে আমাকে আঙুলে নাচাচ্ছেন, আর আমি অসহায় বালিকা নেচে যাচ্ছি। আমি কি অসহায় নই? ” কুহু ঠোঁট টিপে হাসল।

” আচ্ছা, আমি তোমাকে আঙ্গুলে নাচাই! সত্যিই! দেখেছ আমি কত বড় অসহায়, এই যে তুমি আমার নামে মিছেমিছিই অপবাদ দিলে, আর আমি বিনাবাক্যে মেনে নিলাম? সারাজীবন এমনটাই চলতে থাকবে। এরথেকে বড় অসহায় ব্যক্তি তুমি দুনিয়া খুঁজলেও পাবেনা। ” তাহমিদ চোখমুখ অসহায়ের ন্যায় করল।

কুহু ওর দিকে তাকিয়ে না হেসে পারলনা। মানুষটা ওপরে ওপরে নিজেকে যতটা কঠোর দেখায়, আদতেই সে তা নয়।

” সত্যিই কি আমাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাবেন! আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা। কবে যাবেন ঢাকা? ”

” তুমি বললে এখনই যেতে পারি। ”

” দূর ইয়ার্কি করবেননাতো। সত্যি করে বলুন না কবে আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। ”

” বাব্বাহ্ শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেখছি তর সইছেনা। আগেই বলে রাখছি, সেখানে তোমাকে আপ্যায়ন করার জন্য কেউ কিন্তু থাকবেনা। ”

” আপ্যায়ন করা লাগবেনা। সেই আশাও করিনা। কিন্তু ভয় হয়, যদি তারা আমাকে মেনে না নেয় । একে-তো আপনি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছেন। তার ওপর আমি আমার শ্বাশুড়ির বোনের শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়। ”

” তাদের মেনে নেয়া না নেয়ায় আমার কিছুই আসে যায়না। সংসার করব আমি। তারা করবেনা। তাই আমার ভালো আমাকেই বুঝতে হবে। তুমি কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখ। কাল দুপুরেই আমরা রওনা দেব। আমি ফুপুর সাথে কথা বলেছি, তিনি কয়েকদিন এখানেই থাকবেন। আসলে আমি সৃজনকে এখনই আমার বাবার বাড়িতে নিতে চাচ্ছিনা। সেখানে তোমাকে কিভাবে ট্রিট করা হবে, সেটা আমি জানলেও সৃজন কিন্তু জানেনা। তাই আপাতত ছেলেটাকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে চাই। ”

” আপনি এত কিছুর খেয়াল রাখেন কিভাবে! সব দিকে নজর রাখার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আপনার ভেতর রয়েছে, সেটা কি আপনি জানেন? আপনাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। ”

” মেয়ে, এভাবে দেখোনা। প্রেমে পরে যাবে। একবার আমার প্রেমে পরলে আজীবন আমাতেই আটকে থাকতে হবে। আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারবেনা। ”

” আমি কি আপনার প্রেমে পরিনি বলতে চাচ্ছেন? আপনাতে আটকে যাইনি? ”

” তাই কি? কই আমিতো জানিনা। ”

” আবারও ইয়ার্কি করছেন! আমি আপনাতে আটকাইনি? আটকেছি বুঝলেন, ভিষণভাবে আটকে গেছি। আজ থেকে চারদিন আগেই স্থায়ীভাবে আপনাতেই আটকে গেছি। এতদিন মনে মনে আটকে ছিলাম। এখনতো দুনিয়াকে জানিয়ে আপনার বুকের মধ্যে আটকে গেছি। যেখান থেকে আমাকে সরানোর সাধ্য কারও নেই। সো এই নিয়ে কোন কথাই হবেনা। ”

কুহুর কথায়, চোখেমুখে কনফিডেন্স দেখে তাহমিদ অবাক হয়। এই মেয়েটা কত সহজে মনের গোপন কথা প্রকাশ করে দিল, ভেবেই ওর গর্ব হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে ভালোবেসে ও ঠকেনি। এই মায়াবী কন্যা ওর জীবনে সুখের বার্তা নিয়ে এসেছে। ওকে ভাসাতে এসেছে প্রনয়ের সাগরে।

” এবার সরুন দেখি। আমাকে আবার গোছগাছ করতে হবে। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি। তাই প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে। ” তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় কুহু।

কুহুর আচমকা ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পরে যায় তাহমিদ। মেয়েটা যে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে সেটা ও ভাবতেই পারছেনা।

” চারদিন হতে না হতেই নির্যাতন শুরু করেছ! এখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছ? আমার হাত-পা ভেঙে গেলে কিংবা মাথা ফেটে গেলে তোমার কি কোন কষ্টই হতোনা! নিষ্ঠুর বউ, হিটলারের নাতনি। অত্যাচারী রমনী। ” তাহমিদ ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

” আর কিছু? একে তো পরেছেন বিছানায়, তার ওপর এমন ভাব করছেন, যেন কেউ আপনাকে দশতলা থেকে ফেলে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে! অভিনয় ভালোই জানেন দেখছি। অস্কার আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে। ”

” হাহ্ ভাই তাহমিদ, ভবিষ্যতে তোর কপালে দুঃখ আছে বুঝলি? তুই তো বিয়ে করে বউ পাসনি, পেয়েছিস হিটলারের উৎকৃষ্ট বংশধর। যে তোকে উঠতে বসতে নাকানিচুাবানী খাওয়াবে। তার ডিকশনারিতে আদর বলে কোন ওয়ার্ড নেই। আছে শুধু অত্যাচার আর অত্যাচার। এভাবে চলতে থাকলে তোর বংশে লালবাতি জ্ব’ল’বে। তোর আর ফুটবল টিমের হওয়া হলোনা। এমন কাটখোট্টা বউয়ের ভয়েই তোকে আজীবন তটস্থ থাকতে হবে। ”

কুহু তাহমিদের কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। তবে ওর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি তাহমিদের চোখ এড়ায়না।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন দুপুরে ওরা বড় ফুপু আর সৃজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।
কুহু আগে বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছে। বেড়াতে এসেছে মাত্র তিনবার। তবে বাবাকে নিয়ে বেশি আসা হয়েছে। কয়টা বছর বাবাকো নিয়ে কতইনা টানাহ্যাঁচড়া করতে হয়েছে। এ হসপিটাল থেকে ঐ হসপিটাল করতে হয়েছে। সবকিছুই ও আর ওর মা সামলেছে। সেই দুঃসময়ে বড় ফুপু ছাড়া কেউই ওদের পাশে ছিলনা। শেষ পর্যন্ত বাবাও বাঁচলোনা। দুই ভাইবোনকে এতিম করে বাবা চলে গেল। আর মা তো ওদেরকে অনাথই করে গেল। ওর এমন একটা দিনও কাটেনা যেদিন বাবা-মা’ কে মনে পরেনা। সৃজনকে বুঝতে না দিয়ে গোপনে চোখের পানি ঝরায়। কখনোই কাউকে দেখতে দেয়না ওর গোপন বেদনা। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি গোপন করতে পারলনা। সেই দুর্বিসহ দিনগুলি, আর বাবা-মা’ র কথা মনে হতেই ও হু হু করে কেঁদে উঠল।

আচমকা কুহুকে কাঁদতে দেখে তাহমিদ ভড়কে যায়। ও একহাতে কুহুকে আগলে নেয়। সেই সাথে মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। ও কি কোনভাবে কুহুকে কষ্ট দিয়েছে!

” বউ, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? কি হয়েছে আমাকে বল। আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? ” তাহমিদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

তাহমিদকে এভাবে উদগ্রীব হতে দেখে কুহু ঝটপট চোখের পানি মুছে নেয়। ও যে স্থান, কাল ভুলে গিয়ে এভাবে কাঁদছিল ভাবতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

” বাবা-মা’ র কথা মনে হচ্ছিল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে অনেকবার ঢাকা এসেছি। আমি আর মা কত কষ্ট করেছি জানেন? কোথায় যাব, কোথায় কি করব, কিছুই জানতামনা। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করেছি, কতজনের হাতেপায়ে ধরেছি। সেসব কথাই মনে হচ্ছিল। ” কুহু তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

তাহমিদ কুহুর কথার কি প্রত্তুত্যর করবে! কিছু কষ্টের কোন শান্তনা হয়না। বরং শান্তনাতেই সেই কষ্ট আরও বাড়ে। এই মেয়েটা সব হারিয়ে কিভাবে যে বেঁচে আছে, সেটা ভাবলেই হাঁসফাঁস শুরু হয় ওর। মনোবল কত দৃঢ় হলে এই পরিস্থিতিতে কোন মেয়ে নিজে লেখাপড়া চালিয়ে ভাইকেও পড়াতে পারে, সেটা কুহুকে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতনা।

ওরা সন্ধ্যার পর পরই বাসায় পৌঁছে যায়। সিএনজি থেকে নেমে কুহু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদসম বাড়ির দিকে। এই বাড়ির ছেলে ওর স্বামী! কুহু অবাক হয়ে একবার তাহমিদের দিকে তাকায়, পরক্ষণেই আবার বাড়ির দিকে তাকায়। ওর সারাদিনের ক্লান্তি ততক্ষণে উধাও হয়েছে। তার বদলে চোখমুখে ফুটে উঠেছে প্রশ্নের রেখা।

” এভাবে আমার দিকে কি দেখছ! আমাকে কি আগে কখনো দেখনি? ” কুহুর তাকানোতে তাহমিদ অপ্রভিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” আপনি এই বাড়ির ছেলে! এত ধনী পরিবারের ছেলে হয়ে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? ”

কুহুর প্রশ্নে তাহমিদ বিরক্ত হয়। ও কিছু না বলে কুহুর হাত ধরে গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল।

দারোয়ান তাহমিদের সাথে একটা মেয়েকে দেখে বোধহয় একটু অবাকই হয়েছে। তাহমিদও সেটা বুঝতে পেরে হাসল।

” চাচা, এই যে আপনার বউমা। প্রতিদিন বিয়ে কর, বিয়ে কর বলে আমার কানের পোকা নাড়িয়ে দিতেননা? তাই বিয়েটা করেই ফেললাম। এবার অন্তত আপনার মুখে প্রতিদিন বিয়ের কথা শুনতে হবেনা। ভালো করেছিনা? ”

” খুব ভালো করেছ, বাবা। দোয়া করি তোমরা সুখী হও। এবার আমার চিন্তা একটু কমল। তোমাকে শাসন করার জন্য কেউতো এসেছ। আমাদের কথা তো তুমি শুনতেই চাওনা। ”

কুহু এগিয়ে গিয়ে দারোয়ান চাচাকে সালাম দেয়।

” চাচা, রাশেদ কুরাইশি কি বাসায় আছে? সকাল থেকে তার মন মেজাজ ঠিক আছে তো? ”

” সকালে যখন স্যার বেরিয়ে যায়, তখন তাকে হাসিখুশিই দেখেছি। সন্ধ্যায় যখন বাসায় আসল তখনও ভালোই ছিল। তবে হঠাৎ করেই ছেলের বউকে দেখে সেটা তুমি আমি কেউই যেহেতু জানিনা, সেহেতু যেকোন পরিস্থিতিতে তুমি চুপচাপ থাকবে, কেমন? এবার ভেতরে যাও। ”
দারোয়ান চাচা হেসে জবাব দিল।

তাহমিদ কুহুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে যায়।

” দারোয়ান চাচা আপনাকে বোধহয় খুব ভালোবাসে? ”

” হুম। সে আমার সব অপরাধের দোসর বলতে পার। ”

” কিহ্! আপনি অপরাধী নাকি? ”

” এই যে রাত-বিরেতে বাসায় আসলে সে ঘুম থেকে উঠে গেইট খুলে দেয়। মাঝেমাঝে আমার রুমের বেলকনির সামনে বড় মই রাখে, আমার ভেতরে যাওয়ার সুবিদার্থে। এবং এটা বছরের পর বছর ধরে করে আসছে। এখানে মূল অপরাধী আমি, আর সে আমার দোসর। অন্তত আমার কাছে এমনই মনে হয়। ”

কথা বলতে বলতে ওরা বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল কাঠের দরজায় রাজকীয় নকশা আঁকা রয়েছে। দরজার একপাশে বড় করে লিখা আছে ‘ আশ্রয় ‘। কুহু লক্ষ্য করল, তাহমিদ একটু দম নিয়ে কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়াল।

এতক্ষণে কুহুর হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। ওর ভিষণ ভয় হচ্ছে। ভেতরে না জানি ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে।

বেশ খানিকক্ষণ পর খুলে যায় বিশাল দরজার খানিকটা অংশ। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একজন মাঝ বয়সী নারী। যার মুখের আদল অনেকটাই রাজিয়া খালার সাথে মিলে যাচ্ছে। রাজিয়া খালার মত তার মুখেও মমতার ছাপ দেখতে পাচ্ছে কুহু।

” তাহমিদ, তুমি আসছ আব্বা! আস ভেতরে আস। তুমি আসবে সেটা কিন্তু জানাওনি। ”

তাহমিদ কুহুর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করল।

ভেতরে পা রাখতেই কুহুর মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। ও বিশাল ড্রয়িংরুমের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ডুপ্লেক্স বাড়ির ছাদ থেকে ঝুলে রয়েছে বড়সর ঝাড়বাতি। বাসার ভেতরে পা রাখলেই যেটা সবার নজরে পরবে। ভিষন সাজানো-গোছানো ড্রয়িংরুম। নানান এ্যাক্টিক জিনিসপত্র শোভা পাচ্ছে ড্রয়িংরুম জুড়ে।

” কেমন আছো, ফুপু? আমি ব্যাস্ত ছিলাম। তাই তোমাকে ফোন দিইনি। ”

ভদ্রমহিলার এবার নজর যায় কুহুর দিকে। তাহমিদ মেয়েটার হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে দেখে তিনি একটু ভ্রুকুটি করলেন।

” আমি ভালো আছি, আব্বা। এই মেয়েটিকে তো চিনলামনা। তোমার পরিচিত? ”

” ও তোমার আব্বার বউ। দেখতো পছন্দ হয় কিনা। ফুপু তোমার ভাই কোথায়? তাকে দেখছিনা যে। ”

এবার ভদ্রমহিলা বড়সড় ধাক্কা খেলেন। তিনি চোখ বড় করে তাহমিদের দিকে তাকালেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেননা, তাহমিদ বিয়ে করেছে।

” তুমি সত্যিই বিয়ে করেছ! বাসায় কাউকে না জানিয়েই তুমি বিয়ে করেছ? রাশেদ শুনলে কি হবে বুঝতে পারছ? আব্বা, তুমি না এস্তোনিয়া গিয়েছিলে? সেখান থেকেই বউ নিয়ে এসেছ! ”

” আমি এস্তোনিয়া থেকে পাঁচদিন আগেই ফিরেছি। এই কয়দিন রাজশাহী ছিলাম। আর সেখান থেকেই বউ নিয়ে এসেছি। এবার বল তোমার ভাই কোথায়? ”

” রাশেদ, লাইব্রেরীতে আছে। ওকে ডাকব? ”

” দরকার নেই। তুমি বরং আমার বউকে দেখ। ভালো করে দেখে বল, তোমার আব্বার বউ কেমন হয়েছে। ”

কুহু ভদ্রমহিলাকে সালাম দিলে তিনি কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন।

” কে এসেছে, শাহানা আপা? কার সাথে কথা বলছ? ”

হঠাৎই গুরুগম্ভীর আওয়াজ শুনে কুহু চমকে উঠে। ও মাথা নিচু করে রেখেছে। তাই দেখতে পাচ্ছেনা কে কথা বলল।

” তাহমিদ এসেছে, রাশেদ। ওর সাথেই কথা বলছি। ” মৃদুস্বরে বললেন শাহানা আক্তার।

” তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা তোমার ভাতিজার সাথে কে এসেছে? নতুন বলে মনে হচ্ছে। ”

” এদিকে এস। তোমার বউমাকে দেখে যাও। তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। আমার ভাতিজা বড় হয়ে গেছে। সে বিয়ে করেছে। তুমি শ্বশুর হয়ে গেলে। ”

” হোয়াট? সে বিয়ে করেছে! কিন্তু আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি? ওর এতবড় সাহস! ”

এবার কুহুর ভয় হচ্ছে। ও মাথা তুলে তাকায় তাহমিদের দিকে। কিন্তু তাহমিদকে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায়।

” আহ, রাশেদ, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? নতুন বউ বাড়িতে এসেছে। ওকে প্রথমদিনই ভয় পাইয়ে দিওনা। এদিকে এস। ” শাহানা আক্তার আবারও মৃদু গলায় বললেন। কুহু বুঝতে পারছে তিনিও বোধহয় ভয় পাচ্ছেন।

” শাহানা আপা, আপনার এমন দ্বিচারিতা নীতি বিরক্ত লাগে। আপনি রাশেদকেও হাতে রাখেন আবার ঐ ছেলেকেও হাতে রাখেন। আপনি দুইদিক থেকেই ফায়দা লুটতে চান। ” কোথায় থেকে ডেইজি কুরাইশি এসে ফোঁড়ন কাটল।

ডেইজি কুরাইশির কথা শোনামাত্রই শাহানা আক্তার মাথা নিচু করলেন।

” এই মেয়ে, তোমার বাসা কোথায়? কোথায় থেকে এস এর গলায় ঝুলে পরেছ? যেই দেখছ কুরাইশি বাড়ির ছেলে, তখনই টুপ করে ঝুলে পরেছ? দেখে তো মনে হচ্ছেনা কোন ভালো বাড়ির মেয়ে। ” ডেইজি কুরাইশি কুহুর সামনে এসে নাক সিটকিয়ে বলল।

” আপনি ভুলে যাবেননা, কার সম্পর্কে কথা বলছেন। ও আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রী’র সম্পর্কে কিছু বলতে হলে অবশ্যই ভেবেচিন্তে বলবেন। এই প্রথমবার এবং শেষবার আপনাকে সাবধান করে দিলাম। ” তাহমিদের গলা শুনে কুহু চমকে যায়। তাহমিদকে এমনভাবে কথা বলতে ও আগে কখনোই শোনেনি।

” হোয়াট ননসেন্স, তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ? তুমি বাসায় যে কাউকে ধরে এনে বউ বলে পরিচয় দেবে, আর আমি মেনে নেব? মনে রেখ এটা আমার বাড়ি। এখানে আমার ইচ্ছাতেই সব হয় এবং হবে। ”

” ওহ্ এতদিন জানতাম এটা রাশেদ কুরাইশির বাড়ি। তাহলে বোধহয় ভুল জানতাম। তো মিষ্টার কুরাইশি, বাড়িটা কি আপনার শ্বশুরের টাকায় বানানো হয়েছে? এখন কি এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে? ”

” তাহমিদ, তুমি চুপ করবে? একেতো হুট করে বিয়ে করে এনেছ, তারওপর এভাবে চোটপাটও করছ! তোমার বাবা এখনও বেঁচে আছে। তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে তুমি কি ঠিক করেছ? আর তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনও বা কেমন, তারা পাত্রপক্ষের সাথে কথা না বলেই মেয়েকে বিয়ে দিল! ”

” বিয়ে করব আমি, বউ দরকার আমার, এখানে আপনার কাজ কি? শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখবে জামাই কি করে। জামাইয়ের বাবা কি করে সেটা জেনে তারা কি করবে? ”

এদের কথা শুনে কুহুর মনে হচ্ছে সে যেন অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাবা, মা, ছেলে কেউই কারও চাইতে কম যায়না, সেকথা ও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।

রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন, ছেলের সাথে কথা বললেই কথা আরও বাড়বে। তাই তিনি তাহমিদকে কিছুই বললেননা। তিনি এগিয়ে এলেন কুহুর দিকে।

” এই মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথায়? ”

” নাটোর। ”

” বাবা কি করে? কয় ভাইবোন তোমরা? ” ধমকে উঠলেন রাশেদ কুরাইশি।

” বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমরা একভাই এক বোন। ”

” শিক্ষক ছিলেন! এখন আর শিক্ষকতা করেননা? ” রাশেদ কুরাইশি এবার যেন থমকালেন।

” বাবা বেঁচে নেই। ”

” ওহ্। তোমার ভাই কি করে? আর তোমার মা? সে কি জব করে? ”

” আমার ভাই ক্লাস ফাইভে পড়ে। মা-ও বেঁচে নেই। ”

কুহুর কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি কুহুকে কঠিন কিছু কথা শোনাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ওর বাবা-মা বেঁচে নেই শুনেই তিনি থেমে গেলেন। এই বয়সে মেয়েটা বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে ভেবেই তার বুক ভারি হয়ে আসে।

” তুমি কি পড়াশোনা কিছু জানো? ”

” এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ”

” কোন কলেজে? কোন সাবজেক্ট? ”

” রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। ”

এবার রাশেদ কুরাইশি যেন সন্তুষ্ট হলেন।

” আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমার বউ ভর্তি পরীক্ষায় টপ স্কোর করেছিল। এবং এইচএসসিতেও জেলায় টপার হয়েছিল। আর ওর নাম কুহু। যদি ডাকতে ইচ্ছে করে তবে নাম ধরে ডাকবেন। এই মেয়ে কোন ডাক নয়। ”

” শাহানা আপা, তুমি ওদের নাস্তার ব্যবস্থা কর। তোমার ভাতিজার সাথে কথা বলা মানে নিজের সম্মান নষ্ট করা। আর আমি সেটা করতে চাইনা।”

” ফুপু, আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। তুমি কষ্ট করে কিছু করতে যেওনা। ” তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ওপরে যেতে যেতে বলল।

” ঢং দেখে গা জ্বা’ লা করে। থাকবে এই বাড়িতেই, কিন্তু এই বাড়ির খাবার গলায় দিতে চায়না। সব লোক দেখানো অভিনয়। ” ডেইজি কুরাইশির কথা শোনামাত্র দাঁড়িয়ে যায় তাহমিদ।

” আমি কি করব আর না করব, সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে শুনে করবনা। এই বাড়িতে যতটুকু আপনার অধিকার আছে, তার থেকে বেশি অধিকার আমার আছে। নেহাৎই আমি অধিকার খাটাতে যাইনা। আমি অধিকার খাটালে আপনার চাপার জোর এতটা থাকতনা। এরপর থেকে কিছু বলার আগে দুইবার চিন্তা করবেন। আরেকটা কথা, ফুপু তার ভাইয়ের বাড়িতে থাকে। তার ভাইয়ের খায়। আপনার কিংবা আপনার বাবার খায়না সে। তাই তাকেও কথা বলার সময় হিসেব করে বলবেন। জানেনতো পঁচা শামুকেও পা কাটে? ”

তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না। কুহুকে নিয়ে ওপরে চলে যায়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে