#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী জামী
এই সকালে তাহমিদকে দেখে রায়হান আহমেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। তিনি এত সকালে তাহমিদকে আশা করেননি। তাহমিদ সকাল ছয়টায় যখন তাকে ফোন দিয়ে বাসার সামনের কফিশপে ডেকেছে, তখনই তিনি চরমমাত্রায় বিস্মিত হয়েছেন। এত সকালে কফিশপ খোলা নেই তাই তারা কফিশপের পাশের চায়ের দোকানে বসেছে।
” তাহমিদ, তুমি এস্তোনিয়া থেকে কবে এসেছ! গত কয়েকদিন তোমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ পেয়েছি। এই সকালে হঠাৎ করে আমাকে ডাকলে যে! কোন সমস্যা? ”
” অনেক সমস্যা। তো এই অধমকে মনে করার কারন কি! অধমকে তো আর আপনাদের কোনও কাজে লাগবেনা। এই অধম শুধু নামেই মানুষ। ”
” এভাবে বারবার নিজেকে অধম বলছ কেন! তুমি হলে গিয়ে খাঁটি সোনা। ”
” খাঁটি সোনা হলে, আপনার চোখ কানাডা প্রবাসীর দিকে পড়তনা। খাঁটি সোনাকেই আপন করে নিতে চাইতেন। আপনারা মনে করেন, পাত্র প্রবাসী হলেই সে যোগ্য, ভালো, সৎ ব্লা ব্লা। তাদের দশটা গার্লফ্রেন্ড থাকলেও তারা ভালো। এদিকে আমার মত হতভাগারা সারাজীবন গার্লফ্রেন্ডহীনতায় কাটিয়েও আপনাদের মন পাইনা। তাই চোখের সামনে উপযুক্ত ছেলেকে আপনাদের নজরে পরেনা। আপনারা মেয়েদের জন্য যদি প্রবাসী ছেলেই খুঁজবেন, তবে দেশের বাবা-মা’ দের জানিয়ে দিতেন তাদের ছেলেদের কষ্ট করে পড়াশোনা না করাতে। তাহলে আমার মত বেচারা ছেলেগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত। তাদের সময়ে-অসময়ে এভাবে ছুটে আসতে হতোনা। নির্বিঘ্নে বিদেশে বসে নিজের কাজ করতে পারত। ”
তাহমিদের কথা শুনে রায়হান আহমেদ হা হয়ে গেছেন। সহসাই তার মুখে কোনও কথা জোগায়না। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন তাহমিদের কথার মর্মার্থ। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি ধাতস্থ হয়ে মুখ খুললেন।
” তুমি কি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ নাকি আমাকে থ্রেইড দিছ? ”
” যেটা মনে করবেন সেটাই। থ্রেইড যদি মনে করেন, তবে শুনে রাখুন, আমি আপনার ভাইয়ের মেয়েকে তুলে নিয়ে বিয়ে করব, যদি আপনারা রাজি না থাকেন। আর যদি প্রস্তাব মনে করেন, তবে আমি আপনার সেই মেয়েটিকে রানী করে নিজের ঘরে নিয়ে যাব আপনাদের সম্মতিতে। আমার প্রস্তাব আমি দিয়েছি এবং দুই ভাবেই দিয়েছি। এখন কোনভাবে আপনি রাজি হবেন সেটা আপনার ব্যাপার। ”
” এইভাবে কেউ কখনো বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সেটা আমি বাপের জন্মেও দেখিনি! ”
” কি করব বলুন, আপনার মত একজন অভিজ্ঞ মানুষ যদি ঐ বাচ্চা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে না পারেন, তবে আমাকে এমন উপায়ই অবলম্বন করতে হবে। বাপের জন্মে এমন প্রস্তাব দেখেননিতো কি হয়েছে! নিজের জন্মে দেখেন। যেকোন একজন্মে দেখলেই হল। দুই জন্মেরই শেষ ফলাফল একটাই ‘ বিয়ে ‘। ”
” তবে আর দেরি কেন? সব যখন ঠিক করেই ফেলেছ, তবে ডেইটও তুমিই ঠিক কর। ” রায়হান আহমেদ হেসে বললেন।
” আমি কি আপনার কথা সত্যি বলে ধরে নিব? সেই প্রবাসীর পরিবারকে কি বলবেনে? ”
” চোখের সামনে এমন যোগ্য প্রার্থী রেখে আমি দূর দেশে মেয়েকে পাঠাতে যাব কোন দুঃখে! যাকে অনেক বছর যাবৎ চিনে এসেছি, যার সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করেছি। যে আমার ভাতিজীর জন্য এমন ঝুঁকি নিতে পারে, তাকে না করি কিভাবে! আর রইল আশিকের পরিবার। তাদেরকে আমি এক্ষুনি না করে দেব। কুহুর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। ”
” ওকে, তবে আপনার ভাইবোনকে ডেকে নিয়ে আসুন। আমার বউ তার চাচা-ফুপুর দোয়া নিয়েই নতুন জীবন শুরু করবে। চারঘন্টা সময় দিলাম আপনাকে। চারঘণ্টা পর আমার শ্বশুর জন্য হবার প্রস্তুত হোন। ”
মায়ার ফোন পেয়ে কুহু একটু অবাকই হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটায় মায়া ওকে কেন ফোন দিয়েছে! আর সেই মানুষটাই বা কোথায় হাওয়া হয়েছে! সে সেই যে বেরিয়ে গেল, এতক্ষণ হয়ে গেছে তবু তার দেখা নেই! কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়েই কুহু ফোন রিসিভ করলে মায়া ওকে জানালো, সে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার কথা শুনে কুহু গেইটে গিয়ে দারোয়ান চাচাকে গেইট খুলে দিতে বলল। মায়া হাসিমুখে ভেতরে এসে কুহুকে জড়িয়ে ধরল।
দুই ঘন্টা পর কুহু বসে বসে মায়ার কাজ দেখছে। সে কুহুকে জোড় করিয়ে গোসল করিয়ে নিয়েছে। এরপর ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
আর কিছুক্ষণ পর যখন রিশা, নিশো আসল তখন কুহু শুধু ভাবছে ওরা এখন কেন এসেছে?
সজলকে সাথে নিয়ে তাহমিদ যখন বাসায় আসল, তখন ওর হাতে একটা ন্যাপসাক। সজল কুহুকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।
রাজিয়া খালাকে দেখে কুহু তাকে জড়িয়ে ধরল।এই মানুষটার জন্য আজ ও তাহমিদকে ফিরে পেয়েছে। খালার সাথে সৈকত আহমেদ তার স্ত্রী-সন্তানদের এসেছে। এত বছর পর নিজের বাড়িতে এসে যে বড় ভাগ্নের বিয়েতে থাকতে পারবে একথা সে কল্পনাই করতে পারেনি। সবাইকে দেখে ভালো লাগলেও একটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। চাচারা আর ফুপু যদি রাজি না হয়! কিন্তু ওর বুকের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর সরে গেলে, যখন দেখল বড় ফুপু, চাচা গ্রাম থেকে এসেছে। সাথে সিহা আর সাদমানও আছে। বড় ফুপু তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাসায় এসেই সোহানী পারভিন কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি মুখে কৃত্রিম রা’গ এনে বললেন,
” তাহমিদে কথা আমাকে বললে কি হত? আমরা কি তোর কথা শুনতামনা! আমরা তোকে সুখী দেখতে চাই। তোর সুখ আমাদের প্রথম চাওয়া। ”
ফুপুর কথা শুনে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করল৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুহু নিজেকে দেখছে। পার্লার থেকে কয়েকজন এসে ওকে একঘন্টা ধরে সাজিয়েছে। এখন ও নিজেকে চিনতেই পারছেনা। ও কতবার মায়া আপুকে নিষেধ করেছে, সাজতে চায়না। কিন্তু মায়া সেকথা শুনলেতো।
গাঢ় বেগুনি রঙের বেনারসিতে ওকে যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের ন্যায় লাগছে। মানুষটা এত তারাতারি শপিং করছে ভাবতেই কুহুর মন প্রেমহিল্লোলে ছেয়ে যাচ্ছে। হালকা জুয়েলারিও কিনেছে মানুষটা। কুহুর পোশাকের সাথে মিল রেখে নিজের জন্যও শেরওয়ানি কিনেছে। অবশ্য সে কিনতে চায়নি, সজলের জোরাজুরিতে কিনতো হয়েছে।
অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ‘ কুবল ‘ শব্দটি উচ্চারিত হলো কুহুর কন্ঠা থেকে। ও এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা, আজকে ও অন্য কারো অর্ধাঙ্গীনি হলো! মানুষটা সকাল সকাল ওকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবে তা ওর কল্পনায়ও ছিলনা।
বিকেলেই সাইদ আহমেদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে ফিরে যান। রাজিয়া খালাও সন্ধ্যায় ফিরে গেলেন। তবে সোহানী পারভিন থেকে গেলেন।
রায়হান আহমেদও রাতের খাবার পর রিশা, নিশোকে নিয়ে ফিরে গেলেন।
সৃজন ভাবতেই পারছেনা ওর আপুর সাথে তাহমিদের বিয়ে হয়েছে। তাহমিদ অল্পদিনেই তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। এবার তার সাথেই বোনের বিয়ে হতে দেখে ওর খুশির সীমা রইলনা। ও সারাক্ষণ তাহমিদের সাথে লেপ্টে রইল। তাহমিদ ওর জন্যও শপিং করেছে। সেই পোশাক পরেই ছেলেটা আনন্দ করেছে।
রাতে বাসায় ফেরার পূর্বেই মায়া কুহুকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। কুহু তাদেরকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেছে, কিন্তু সকালে সজলের ক্লাস আছে জন্য তাদের যেতে হচ্ছে।
রাত বারোটা পঞ্চাশ। কুহু ব্যালকোনিতে বসে আছে। ভারি শাড়িতে ওর প্রান যাই যাই অবস্থা। আজকের আগে খুব একটা শাড়ি পরেনি মেয়েটা। সেজন্যই এত অস্বস্তি লাগছে। এদিকে রুমে যাওয়ার ও সাহস পাচ্ছেনা। সেখানে তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সৃজনের রুমে ফুপু শুয়েছে। ও একবার ভাবছে ফুপুকে ডেকে তুলবে কিনা। পরক্ষনেই আবার ভাবছে সারাদিন ফুপু অনেক পরিশ্রম করেছে, এখন তাকে ডাক দেয়া ঠিক হবেনা। নানান চিন্তা করছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে মেয়েটা।
” এভাবে নখ কাটছ কেন! এখন থেকে মাথার একটা চুলও ফেলার আগে আমার হুকুম নিবে। আমি আমার নিঁখুত বউকে চাই। এত চিন্তা কিসের? কাল থেকে যখন চিন্তা করতে ইচ্ছে করবে, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করে নিবে। আমি বললেই তবে চিন্তা করবে। ”
হঠাৎই তাহমিদের গলা শুনে কুহু চমকে উঠল।
” আ..আপনি! আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন! ”
” ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন জেগে গেছি। তুমি এতরাতে এখানে বসে আছ কেন? রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? মায়া তোমাকে কিছু শেখায়নি! ”
কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হাসি আসছেনা। কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ আবারও বলে উঠল,
” আজকের রাতটা কি এখানেই কাটিয়ে দেবে ভাবছ। তবে কি ঐতিহাসিক এই বাসর বারান্দায় হবে? বারান্দায় হোক আর ছাদেই হোক, আমি রাজি। যেকোন এক জায়গায় হলেই হয়। আগেই বলেছি, আমি টাইম ফুল ফর্মে থাকি। তবে দেরি কেন, কাছে এস। ”
তাহমিদের কথা কানে যেতেই কুহু লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল।
” কি..কিসব ব..বলছেন! আমার ঘুম পেয়েছে। ” কুহু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
” তো! আমি কি বলেছি তোমাকে ঘুমাতে দেবনা! বেয়াদব মেয়ে, সকালেতো খুব কলিজার ওপর আছড়ে পরেছিলে। তখন সার্টিফিকেট বিহীন আপনজন ছিলে। কিন্তু তখন ভয় পাওনি। অথচ এখন যখন তুমি আমার সার্টিফিকেটধারী বউ, কোথায় এখন নির্ভয়ে কলিজার মধ্যে ঢুকে যাবে, সেটা না করে ভয়ে তো তো করে তোতলাচ্ছ? যা করার আমাকেই করতে হবে দেখছি। এত সাধনার বউ আমার, এত সাধের বাসর রাত আমাদের। এই সাধের রাত আমি বিনা কাজে কাটাতে রাজি নই। আমি আবার পরিশ্রমি জীব কিনা। ” কথাটা বলেই এক ঝটকায় তাহমিদ কুহুকে কোলে তুলে নেয়।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী জামী
গভীর রাত। ধরাধাম ঘুমের কোলে নিজেকে সঁপেছে। ধরিত্রী নিঃশব্দে জানান দিচ্ছে তার বুক জুড়ে এখন বিভাবরী তার রাজত্ব কায়েম করেছে। সূচিত করেছে প্রেমময় ক্ষণের।
রাত, চাঁদ, জনমানব ঘুমে মগ্ন থাকলেও ঘুম নেই দুটি কপোত-কপোতির আঁখিদ্বয়ে। তারা প্রেম বিনিময়ে মত্ত। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তারা দু’জন দু’জনার হয়েছে। এই রজনী কিছুতেই বৃথা যেতে পারেনা।
তাহমিদের উন্মুক্ত লোমশ বক্ষে মাথা রেখে তার প্রিয় মানুষটির প্রতিটি হৃৎস্পন্দন মনযোগ দিয়ে শুনছে কুহু। নির্দিষ্ট লয়ে দ্রিম দ্রিম শব্দ করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাহমিদ ওর চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটছে। আরেক হাতে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। যেন ছেড়ে দিলেই সে কোথাও হারিয়ে যাবে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। দু’জনেই চুপচাপ অনুভব করছে দু’জনকে। এভাবে কেটে গেছে অনেকক্ষন। কুহু এবার তাহমিদের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে উসখুস করছে। কুহুর এহেন কাজে ভ্রু কোঁচকায় তাহমিদ।
” এমন করে চিংড়ি মাছের মত তিড়িংতিড়িং করছ কেন! আমার বুকে থাকতে কি তোমার ভালো লাগছেনা? কত মেয়ে এই বুকে আসার জন্য পা’ গ’ ল হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তাদের সুযোগ দেইনি। আর তুমি কিনা এমন সুযোগ পেয়েও তিড়িংতিড়িং করছ! আমার এই বুকের মর্ম তুমি এখনো বুঝলেনা, মেয়ে। তাহমিদের বুকে সবার স্থান হয়না। যে একবার এখানে স্থান পেয়েছে, আমি তাকে রাণী করে রাখতে চাই। তুমি দেখছি সেই সুযোগ পেয়েও হেলা করছ! ” তাহমিদের গলায় উষ্মা লুকিয়ে থাকলনা।
” আপনি কত শক্ত করে ধরে রেখেছেন, সেটা একবারও লক্ষ্য করেছেন! আমার পাঁজরের হাড় একটাও আস্ত নেই। ” কুহু মুখ কালো করে বলল।
” কে বলেছে তোমার পাঁজরের হাড় আস্ত নেই! এই যে দেখ দিব্যি তোমার পাঁজরের হাড় বিছানায় শুয়ে আছে। এই পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চির মস্ত হাড় যদি তোমার চোখে না পরে, তবে আমার নিষ্পাপ অদৃশ্য মন তুমি না দেখেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে দেখছি! তখন আমাকে মন বীনা বেঁচে থাকতে হবে! এটা আমি ভাবতেই পারছিনা। কি নিষ্ঠুর রমনী তুমি, বউ। ”
তাহমিদের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনে কুহুর শরীর শিথিল হয়ে যায়। ওর সমস্ত শরীরে সুখের শীতল মলয় এসে দোলা দিয়ে যায়। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে প্রাপ্তির হাসি। ও পেয়েছে, দূরে থাকা আপনজনকে আরও আপন করে পেয়েছে। যে ওর জীবনে এসেছে ধূমকেতু হয়ে। অপ্রাপ্তির বেদনাকে প্রাপ্তিতে পূর্ণ করেছে।
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ” কুহু মিনমিন করে বলল।
” একটা কেন, একশোটা কর। চাইলে হাজারটাও করতে পার। তোমার সব কথা শোনার জন্য , সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এই অধম সব সময়ই প্রস্তুত আছে। ”
তাহমিদের আস্কারা পেয়ে কুহু হাসল। ও তাহমিদের লোমশ বুকে আঙ্গুল চালাতে চালাতে প্রশ্ন করল,
” আপনি ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলেন কেন? আমার ওপর খুব রা’গ হয়েছিল বুঝি? ”
” ফোন ইচ্ছে করে বন্ধ করিনি। হাত থেকে পরে ভেঙে গিয়েছিল। কাজের চাপে নতুন ফোন কিনতে দেরি হয়েছিল। এদিকে কোর্সের সময় শেষ হয়ে আসছে, অথচ তখনও একটা থিসিস জমা দিতে পারিনি। তাই ফোন কেনার কথা মাথা থেকে বের করে দিয়ে থিসিসে মনযোগ দিয়েছিলাম। তারপর থিসিস কমপ্লিট করে যখন ফোন কিনলাম এবং খালাকে ফোন দিলাম, তখন সব শুনে আমার পা’ গ’ ল পা’ গ’ ল লাগছিল। মুহূর্তেই ভুলে যাই আমি তোমার ওপর রে’ গে ছিলাম। যদিও সেটা রা’ গ ছিলনা। শুধু তোমাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখ, শেষ পর্যন্ত ভয়টা কে পেল? আমি এই অসহায়, অবুঝ বালকটি ভয়ের চোটে সময়ের দুইদিন আগেই সব থিসিস জমা দিয়ে উড়াল দিলাম। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু হেসে ফেলল। ওর মনের আকাশের সকল মেঘ কেটে, উঁকি দিল এক ফালি সূর্য।
” সরি। আমি আপনাকে বাসা বদল করার আগে জানাইনি। আমি জানতাম আপনি আমাকে কিছুতেই এখানে আসতে দিতেননা। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আর সেখানে থাকতে পারছিলামনা। আমি জানতাম আপনি কষ্ট পাবেন, রা’গ করবেন তবুও আমি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তাহমিদ কুহুর কান্না দেখে ওকে শক্ত করে বুকে জরিয়ে নেয়। চুমু দেয় ওর ললাটে , অধরে।
ঘুম ভাঙ্গতেই বহু কষ্টে তাহমিদের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল কুহু। দেয়াল ঘড়িতে চোখ পরতেই ওর মাথায় বা’জ পরল। সকাল নয়টা বেজে গেছে! লজ্জায় আপনাআপনি ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এখন ফুপুর সামনে যাবে কেমন করে! এতক্ষণ ওকে বাহিরে না বেড়োতে দেখে ফুপুই বা কি ভাববে।
এদিকে তাহমিদ ওকে আবারও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে।
” এবার আমাকে ছাড়ুন। নয়টা বেজে গেছে। আমি কিভাবে ফুপুর সামনে যাব। সবকিছু আপনার জন্যই হয়েছে। ”
কুহুর মুখে এমন কথা শুনে তাহমিদ উঠে বসল। ও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কুহুর দিকে।
” এই মেয়ে বলে কি! আমি না আসলে তাকে অন্যের বউ হয়ে জীবন কাটাতে হত। আর সে-ই কিনা আমার ওপর অপবাদ দিচ্ছে! আমি কোথায় তাকে ভালোবেসে নিজের বুকে ঠাঁই দিলাম, বিয়ে করলাম, বাসর তা-ও তারই সম্মতিতে। কিন্তু বিয়ের পরদিন সকালেই আমাকে শুনতে হচ্ছে আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী! তোমার জন্য ঐ প্রবাসীই ঠিক ছিল। করতে বিয়ের পর জামাই ছাড়া সংসার। তাহলে সকালে উঠতেও দেরি হতোনা, আর তোমাকে লজ্জাও পেতে হতোনা। অবশ্য তুমি ভুল কিছু বলনি। বিয়ের পর বউ কোথায় স্বামীর ঘরে গিয়ে বাসর করবে। সেটা না করে স্বামীই এসেছে বউয়ের কাছে। মেয়েরা আবার বাবার বাড়িতে লজ্জাবতীর রোল প্লে করে কিনা। শ্বশুর বাড়িতে জামাইয়ের সাথে দিনরাত এক রুমে থাকলেও লজ্জা লাগেনা। কিন্তু বাবার বাড়িতে সকাল নয়টা বাজলেই লজ্জায় নুইয়ে পরে। যদিও এটা তোমার বাবার বাড়ি নয়। তারপরও আমার কথাটা মিথ্যা নয়। ”
তাহমিদের খোঁ’চা মা’রা কথা শুনে কুহু কপাল চাপড়ায়। ও বুঝতে পারছে এখন তাহমিদের সাথে কথা বলতে গেলেই দেরি হয়ে যাবে। তাই ও কিছু না বলে বিছানা ছাড়ল। তাহমিদ কুহুর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও শুয়ে পরল।
তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের শব্দে। সৈকত আহমেদ ওকে ফোন করে জানাল, হঠাৎই ফাতিমা খানম অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাহমিদ ওর মামার ফোন পেয়ে আর দেরি করলনা। কুহুকে ডাকতে থাকে।
কুহু তখন সোহানী পারভিনের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছিল। তাহমিদের ডাক শুনে ও রুমে আসলে তাহমিদ ওকে তৈরী হতে বলে নিজেও তৈরী হয়ে নেয়।
কুহু একটা রানী গোলাপি রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছে। ও নিজে শাড়ি পরতে জানেনা, তাই সোহানী পারভিন ওকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। পাশের রুম থেকে নিজের রুমে আসতেই তাহমিদের নজর যায় কুহুর দিকে। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার রমনীর দিকে। এই শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটিযে তার একান্তই নিজের সেকথা ভাবলেই ওর মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। তাহমিদ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে কুহুকে বাহুডোরে বেঁধে নেয়। ঠোঁট ছোঁয়ায় মেয়েটার ললাটে, আঁখিতে এবং সবশেষে ওষ্ঠদ্বয়ে। তাহমিদের আচম্বিত ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে কুহু। কেঁপে উঠল ওর শরীর।
অনেকদিন পরে এই বাড়ির ভেতরে এসে কুহু আবেগে ভেসে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই বাড়ির মায়ায় জড়িয়েছিল কুহু। একদিন এই বাড়িতে ওকে মাথা নিচু করে থাকতে হয়েছে। এই বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে বের হতে হয়েছে। কিংবা আজ এই বাড়িতেই কুহু স্বসম্মানে উপস্থিত হয়েছে। আজ ওকে কেউ আর অসম্মান করতে পারবেনা। কেউ অপমান করতে পারবেনা। কুহুকে দেখে রাজিয়া খালা দৌড়ে আসলেন। ওকে বুকে জরিয়ে নিয়ে আদর করলেন। খালার সাথে কথা বলে কুহু তাহমিদের সাথে নানিমার কাছে যায়। সেখানে সৈকত আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও আছে। কুহু প্রথমে তাদের সাথে কথা বলে নানিমার কাছে গিয়ে বসল। ওকে দেখেই নানিমা শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তাহমিদ নানিমার কাছে গিয়ে তাকে তুলে বসিয়ে দেয়।
নানিমা কুহুর হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি তার একমাত্র সচল হাত দিয়ে কুহুর হাতে বারবার চুমু খেতে থাকলেন।
কুহু লক্ষ্য করল নানিমা এই দুইমাসে বেশ শুকিয়ে গেছেন। তার চোখমুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভালো নেই। কুহু নানিমার কাছে কিছুক্ষণ বসে।
তাহমিদ গভীরভাবে লক্ষ্য করছে নানিমাকে। তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। তাহমিদ বুঝতে পারছে নানিমা আর হয়তো বেশিদিন তাদের মাঝে থাকবেনা। কথাটা মনে আসতেই তাহমিদের মন হু হু করে উঠল। ওর মমতাহীন জীবনে এই নানিমা’ই ছিল ওর অবলম্বন। এই মানুষটাই ওকে আগলে রেখেছিলেন দুনিয়ার মানুষের কটুবাক্য থেকে। এই মুহুর্তে তাহমিদ আর কিছু ভাবতে পারছেনা। ওর ভিষণ কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকাতে ও লুটিয়ে পরল নানিমার পায়ে। তার পা’ দুটি দু’হাতে জড়িয়ে চুপচাপ মুখ গুঁজে পরে রইল।
কুহু রান্নাঘরে এসে নানিমার জন্য স্যুপ বানাতে শুরু করল।
তাহমিদ নানিমার কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে আছে। নানিমা তার এক হাত দিয়ে তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
কুহু রুমে আসলে তাহমিদ উঠে বসে ওকে বসবার সুযোগ দেয়।
কুহু কোন কথা না বলে নানিমাকে খাইয়ে দিতে থাকে।
” নানিমা, আমার বউ কেমন হয়েছে বললেনাতো? বউ বুঝি তোমার পছন্দ হয়নি। ”
তাহমিদের কথা শুনে নানিমা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন কুহুকে তার খুব পছন্দ হয়েছে।
” আম্মা, তোমার কি হয়েছে? কেমন আছো তুমি? ”
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে ব্যাগ্র গলায় জিজ্ঞেস করল নায়লা আঞ্জুম। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে সে আর রাগ করে থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছে মা’কে দেখতে।
রুমে ঢুকে কুহুকে দেখে কপাল কুঁচকায় নায়লা আঞ্জুম। কুহুকে এই বেশে দেখে সে বেশ অবাক হয়েছে।
তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের দৃষ্টি বুঝতে পেরে হেসে উঠে বলল,
” খালামনি, এস আমার স্ত্রী’ র সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই। কুহু সম্পর্কে ইনি তোমার ছোট খালা শ্বাশুড়ি। তোমার গুরুজন। তাকে সালাম কর। চেয়ার এনে বসতে দাও। ”
তাহমিদ ব্যঙ্গ করে বলল। যা ঠিকিই বুঝতে পারছে নায়লা আঞ্জুম। সে স্তব্ধ হয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। তাহমিদের কথা বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে।
চলবে…