প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩১+৩২

0
533

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী জামী

কুহু তাহমিদের সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু গত পনেরদিন থেকে তাহমিদের কোনও খবর নেই। এদিকে কুহু রাজিয়া খালার কাছ থেকে জানতে পেরেছে তাহমিদ এরইমধ্যে দুই দিন খালার কাছে ফোন দিয়েছে। এই কথা শোনার পর কুহু আরও ভেঙে পরেছে। সেই সাথে ভয়ও হচ্ছে। তবে কি সে কুহুর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! এখন কুহুর নিজের ওপর রা’গ হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, কেন সে আগে তাকে নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার আগে জানালনা। সে সবকিছু শোনার পর রা’গ করত, তারপর একসময় ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু এখন কুহু কিভাবে সবকিছু ঠিক করবে? কষ্টের তীব্রতায় কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তবে কি ওর না বলা ভালোবাসা সমূলেই বিনাশ হতে চলেছে! কুহু দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে তাহমিদকে ফোন করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে নিরাশ হতে হয়।

হঠাৎ করেই বড় ফুপুকে বাসায় দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। সোহানী পারভিন সাইদ আহমেদের সাথে কুহুর কাছে এসেছেন। এতদিন তাদের ভাতিজা-ভাতিজী ছোট ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকায় তারা সেখানে যেতে পারেননি। কারন তারা জানতেন, নায়লা আঞ্জুম তাদের পছন্দ করেনা। সোহানী পারভিন অনেক জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন ওদের জন্য। এই দুঃসময়ে আপনজনদের কাছে পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল কুহু। সোহানী পারভিন পরম আদরে ভাইয়ের মেয়েকে বুকে জরিয়ে নিলেন।

সাইদ আহমেদ পরদিন সকালে বড় বোনকে কুহুদের কাছে রেখে গ্রামে ফিরে গেলেন। সোহানী পারভিন কয়েকদিন এখানে থাকবেন।

সেদিন বিকেলে রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে কুহুদের বাসায় আসলেন। মুহূর্তেই বাসাটা যেন চাঁদের হাটে পরিনত হয়েছে। কুহু গিয়ে পাশের ফ্ল্যাট থেকে দাদুকে নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধাও আজকে ভীষণ খুশি হয়েছেন। তার ছেলেমেয়েও থাকার পরও তিনি সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত। আজ তিনি এদের সাথে আনন্দ করে, নিজের অপূর্ন স্বপ্নকে পূরন করছেন।

চারদিন পর সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেলেন। সৃজন কুহু চেয়েছিল তাদের ফুপু আরও কয়েকটা দিন থেকে যাক। কিন্তু বাড়িতে কাজ পরে যাওয়ায় তাকে চলে যেতে হয়।

একদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ কুহুর কাছে আসলেন। তিনি ওদের জন্য কিছু ফলমূল এনেছেন। সেগুলো কুহুর হাতে দিয়ে তিনি কুুহুর রুমে গিয়ে বসলেন।

” কুহু মা, আজকে একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি। তুই মনযোগ দিয়ে আমার কথা শোন। ”

” কি হয়েছে চাচা? কিছু হয়েছে? ”

” তেমন কিছুই হয়নি, আবার অনেক কিছুই হয়েছে। যেহেতু ভাই-ভাবী বেঁচে নেই, এখন তোর অভিভাবক বলতে আমরা তিন ভাইবোনই আছি। তাই যে কথা তোকে ভাবীর বলা দরকার ছিল, সেই কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। ”

কুহু চাচার কথার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে রায়হান আহমেদ একমনে কথা বলেই চলেছে,

” বুঝলি মা , মেয়েরা বড় হলে বাবা-মা’ র দুশ্চিন্তা হয়। তেমনি আজকাল আমাদেরও তোর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুই সব ছেড়ে একা সৃজনকে নিয়ে থাকছিস। এটা আমাদেরকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে। ”

” চাচা, তুমি কি বলতে চাইছ! আমি বুঝতে পারছিনা। আমাদের জন্য এত চিন্তা করতে হবেনা, চাচা। ” কুহু ভ্রকুটি করে বলল।

” মা রে, তুই বুঝবিনা আমাদের দুশ্চিন্তা। যতদিন তোকে একটা ভালো পরিবারে, একজন সৎ মানুষের হাতে তুলে দিতে না পারছি, ততদিন আমাদের স্বস্তি নেই। আর সেই ভালো পরিবার আর সৎ মানুষের সন্ধান আমরা পেয়েছি। ”

চাচার কথা শুনে কুহুর পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। চাচা কার কথা বলছে? এবার ও কি করবে!

” তু..তুমি ক..কি বলছ, চাচা? ” কুহু মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে যাবে। এসব কি শুনছে ও!

” আমি ঠিকই বলছি, মা। আমার কলিগের ভাইয়ের ছেলে আশিক। সে কানাডা থাকে। মন্ট্রিল ইউনিভার্সিটিতে পিএচডি করছে। আমার কলিগ একদিন তোকে কোচিং-এ দেখেছিল। তখনই তোকে পছন্দ করেছিল। সে-ই তার ভাতিজার সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি তখন তাকে কিছুই বলিনি। গোপনে ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলাম। এবং রেজাল্ট পজিটিভ। সবাই তাদের পরিবারকে ভালো বলেই আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু আমি তোর কাছে না জেনে তাদেরকে কিছুই বলতে পারছিনা। অবশ্য তোকে এখন কিছুই জানাতে হবেনা। তুই দুইদিন সময় নে। এরপর আমাকে জানাস। ”

কুহু চাচার কথার প্রত্তুত্যরে কিছুই বলতে পারলনা। ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করার বৃথা চেষ্টা করল।

রায়হান আহমেদ আরও কিছুক্ষণ সৃজন কুহুর সাথে গল্প করে বিদায় নিলেন।

পরদিন ফজরের নামাজের পর কুহু নাশতা তৈরী করছে। তখনই বড় ফুপুর ফোন আসল। কুহু মলিন হেসে ফুপুর সাথে কথা বলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর, সোহানী পারভিন জানালেন তিনি ও সাইদ আহমেদ কুহুর বিয়ের ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের সাথে একমত হয়েছেন। ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে সবকিছু শোনার পর তারাও চান সেখানেই কুহুর বিয়ে হোক। এছাড়া সাইদ আহমেদ নিজে গিয়েছিলেন ছেলের গ্রামে। তিনিই সবকিছু শুনে এসেছেন।

এবার কুহু যেন অকুল পাথারে পরল। ওর শেষ ভরসাটুকুও কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ও ভেবেছিল, বড় ফুপুকে বুঝিয়ে চাচাকে ওর বিয়ে নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে নিষেধ করবে। কিন্তু ও এখন দেখছে বড় ফুপু আর মেজো চাচাও ছোট চাচার সাথে বিয়েতে মত দিয়েছে!

কুহু দিশেহারা হয়ে গেছে। ও এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। চোখ দিয়ে আপনাআপনিই শ্রাবনের ধারার ন্যায় অশ্রু ঝরতে থাকল।

আরও তিনদিন কেটে গেছে। কুহু অনেকবার তাহমিদের কাছে ফোন দিয়েছে, কিন্তু ওকে এবারও হতাশ হতে হয়। বাধ্য হয়ে ও দাদুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে, লাজলজ্জা ভুলে তাহমিদকে ফোন দেয়। কিন্তু এবার ফোন সুইচড অফ দেখায়। পরপর দুইদিন দাদুর ফোন দিয়ে তাহমিদকে ফোন দেয়, এবং দুইদিনই ফোন সুইচড অফ দেখায়।
কুহু এবার রাজিয়া খালাকে ফোন করে সবটা জানায়। খালা সব শুনে বললেন, তিনদিন থেকে তাহমিদ তার কাছেও ফোন দেয়নি। তিনিও তাহমিদের কোনও খোঁজ জানেননা।

পরবর্তী কয়েকদিন কুহু উন্মাদের মত আচরণ করেছে। এদিকে বড় ফুপু প্রতিদিনই ওকে ফোন দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। ওর মত আছে কিনা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কুহু কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকেছে। যেখানে তাহমিদেরই কোন খোঁজ নেই, সেখানে সে কিভাবে সবাইকে তার কথা বলবে! যদি তাহমিদ ওর সাথে যোগাযোগ করত, তবে ও অবশ্যই চাচা-ফুপুকে বিয়ে বন্ধ করতে বলত।
কিন্তু তাই বলে ও নিজের জীবনে তাহমিদ ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারেনা।

সেদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ আসলেন কুহুর সাথে কথা বলতে। কুহু নত মস্তকে বসে আছে। ও জানে চাচা কি বলতে চায়।

” মা, কি সিদ্ধান্ত নিলি? আশিকের বাবা আর অপেক্ষা করতে চাইছেননা। তিনি চাইছেন এখনই বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে। আপাতত ফোনে বিয়ে হবে। আর তিন বছর পর আশিক দেশে আসলে বড় আয়োজন করে তারা পুত্রবধূকে ঘরে তুলবেন। এবার তোর ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। তবে আমরা করছি তুই আমাদের নিরাশ করবিনা। ”

” চাচা, আমি সৃজনকে ছেড়ে থাকতে পারবনা। আর সৃজুও সেটা পারবেনা। ও এখনও অনেক ছোট। নিজের ভালো এখনো বুঝতে শেখেনি। ওকে এই অবস্থায় একা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

” সৃজনের চিন্তা তোকে করতে হবেনা। আগামী তিন বছর তোরা এখানেই থাকবি। শুধু মাঝেমধ্যে আশিকের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসবি। তিন বছর পর আশিক তোকে আর সৃজনকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। ”

ধীরে ধীরে যেন কুহুর সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে কি ও কোন অচেনা আগন্তুকের সাথে বাঁধা পরতে চলেছে!
যাকে কভু বলা হয়নি ‘ ভালোবাসি ‘ তবুও প্রতিনিয়ত যে ওকে বুঝিয়েছে ভালোবাসা না বললেও হয়ে যায়। মুখে বলতে হয়না। মনের সাথে মন মিলে গেলেই ভালোবাসা নীরবেই ধরা দেয়। তবে কি সেই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ আসন্ন!

পরদিন সকালেই সোহানী পারভিন রাজশাহী আসলেন। তাকে দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। আজ ফুপুকে দেখে ওর মনে খুশির দোলা লাগলনা। মুখের ভেতর তিক্ত স্বাদ অনুভব করছে।
সোহানী পারভিন প্রতিটা কথায় কুহুকে বুঝিয়ে দিলেন তারা সবাই চাচ্ছে এখানেই কুহুর বিয়ে হোক। তিনি কুহুকে অনেক বোঝালেন। সেই সাথে তিনি আজ কুহুকে কোচিং-এ যেতে নিষেধ করে দিলেন। কারন আজ বিকেলে আশিকের বাবা-মা, দুই বোন কুহুকে দেখতে আসবে। সেরকম হলে আজকেই তারা বিয়ের দিন ঠিক করবেন।

এবার কুহু ফুপুর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সোহানী পারভিন ভাবলেন বাবা-মা হারা মেয়েটা মৃ’ত বাবা-মা’কে স্মরণ করেই কাঁদছে। তিনি নানানভাবে কুহুকে শান্তনা দিলেন। ওকে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কুহু কিছুতেই কান্না থামায়না। ও যেন আজ নিজের সব কষ্টকে অশ্রুবিন্দুতেই উজার করে দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর কুহু ফোন নিয়ে লনে এসে দাঁড়ায়। ফোন করল রাজিয়া খালার কাছে। একটাবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায়।

চলবে..

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী জামী

” বাহ্ মামনির দেখছি দীঘল কালো চুল! আমার দুই মেয়ের কারও চুল এত বড় নয়। ” কুহুর হাঁটু সমান চুল দেখে আশিকের মা আয়িশা নার্গিস সবিস্ময়ে বললেন।

” কি আম্মু, তুমি এখানে পাত্রী দেখতে এসেও আমাদের দূর্নাম করবে! এটা কিন্তু ভারি অন্যায়। তোমার দুই মেয়ের চুল লম্বা না হলেও, তৃতীয় মেয়েরতো চুল লম্বা হবে। এটা নিয়েই আপাতত খুশি থাক। এখন আবার জিজ্ঞেস করোনা এই তৃতীয় মেয়ে আবার কে। ছেলের বউকে মেয়ের চোখে দেখলেই কিন্তু তুমি আরেকটা মেয়ের মা হয়ে যাবে। ” আশিকের বড় বোন তিশা হাসিমুখে বলল।

তিশার এমন আন্তরিক কথাবার্তা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে ভিষণ খুশি হয়েছে। সোহানী পারভিন বুঝতে পারছেন কুহু এই পরিবারে বউ হয়ে গেলে সুখী হবে। এরা মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। রায়হান আহমেদ এবং সাইদ আহমেদের মুখেও হাসির রেশ। অবশেষে তাদের মেয়ে একটা ভালো পরিবারে যাবে, একথা ভাবতেই তাদের চোখ ভিজে উঠছে।

আশিকের পরিবার বিদায় নেয়ার আগে জানিয়ে যায়, কুুহুকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তারা বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করবে। তবে সেটা আগামী সাতদিনের মধ্যেই হবে। তারা চাচ্ছেন যত তারাতারি সম্ভব কুহুকে ছেলের বউ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।

আশিকের পরিবার বিদায় নিলে কুহু ফোন নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। ও কাঁদতে কাঁদতে রাজিয়া খালাকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়। সব শুনে খালাও ভিষণ চিন্তিত হয়ে গেছেন। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত তাহমিদ তাকে ফোন দেয়নি।

কুহু দিনরাত কান্নাকাটি করছে। সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের আগেরদিন তিনি রাজশাহী আসবেন।

কুহু নিয়মিত ক্নাস নিচ্ছে। ওর ও ক্লাস শুরু হতে দেরি নেই। সৃজন মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। তবে ওর মনটা খুব ভালো নেই। বাবা-মা’ কে হারানোর পর এই বোনই ওকে আগলে রেখেছিল। এখন সেই বোনেরও বিয়ে হয়ে যাবে! ও যে বড্ড একা হয়ে যাবে। কিভাবে থাকবে সে বোনকে ছাড়া! যখনই ছেলেটার এসব কথা মনে হয়, তখনই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কখনোই কুহুকে বুঝতে দেয়না।

রাজশাহী থেকে যাওয়ার পর আশিকের পরিবারের সবাই কুহুর সাথে ফোনে কথা বলেছে। আশিকের বড় বোন কুহুকে বলেছিল, আশিক ওর সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু কুহু তার প্রস্তাবকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। ওর আশিক নামক মানুষটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। যে রমনীর হিয়ার মাঝে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তার একান্ত পুরুষটির নাম সগৌরবে বিরাজ করছে, তার মন কিভাবে চাইবে এক অচেনা মানুষের সাথে বাক্যবিনিময় করতে!

কুহু প্রতিদিন তাহমিদের ফোনে ট্রাই করে, কিন্তু সে তাকে পেতে ব্যর্থ হয়েছে বারবারই। এদিকে আশিকের পরিবার থেকে জানিয়েছেন তারা আগামী শুক্রবার বর ছাড়াই বরযাত্রা নিয়ে হাজির হতে চায়। কুহু এবার সচকিত হয়ে বড় ফুপুর কাছে আঁইগুই করে জানায়, সে এখনই বিয়ে করবেনা। কিন্তু সোহানী পারভিন ওর কথায় পাত্তা দেননি। কারন তারা মন থেকে চান তাদের মেয়েটা সুখী হোক। কুহুর ইচ্ছে থাকলেও তাকে তাহমিদের কথা জানাতে পারলনা। কারন ও যেখানে তাহমিদের খোঁজই পাচ্ছেনা, সেখানে কিভাবে তার কথা জানাবে! এরপর সব লাজলজ্জা ভুলে রায়হান আহমেদকে জানায়, ও এখন বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু রায়হান আহমেদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নানানভাবে বুঝালেন। তারা মন থেকে কুহুর ভালো চাইছেন।

কুহু অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। ও সত্যি কথা না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সহ্য করতে। এদিকে আজ সোমবার। মাঝখানে আর তিনদিন সময় আছে। এরইমধ্যে যদি তাহমিদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে, তবে ওকে চিরদিনের জন্য অন্য কোন সংসারের অংশ হতে হবে।

সেদিন বিকেলে রাজিয়া খালা আসলেন কুহুর সাথে দেখা করতে। কুহু এই অবস্থায় খালাকে কাছে পেয়ে কিছুটা আশার আলো দেখল। ও খালার ফোন দিয়ে বারবার তাহমিদকে ট্রাই করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে হতাশ হতে হয়।

রাজিয়া খালা বুঝতে পারছেননা তাহমিদের কি হয়েছে। তার ফোন বন্ধ কেন! তিনি কুহুকে খুব করে বোঝালেন। তিনি বুঝতে পারছেননা এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। তবুও তিনি কুহুকে চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি কুহুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মঙ্গলবারও পেরিয়ে যায়। কুহুর সব আশা যেন নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ও আর নতুনকরে কিছুই ভাবতে পারছেনা। কয়েকদিন থেকে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে পারেনি মেয়েটা। কান্নারা দলা পাকিয়ে বারবার হানা দিচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে এই কয়দিনে। শুকিয়েও গেছে বেশ কিছুটা। ফজরের আযান দিতেই বিছানা ছাড়ল সে। গত কয়েকদিন থেকে রাতে ঘুমাতে পারছেনা। তাই মাথা থেকে থেকেই ব্যথা করছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। গত রাতেই বড় ফুপু জানিয়েছেন তিনি আগামীকাল সকালেই আসবেন। তিনি কুহুকে কোচিং থেকে কয়েকদিন ছুটি নিতে বলেছিলেন। তিনি চাননি বিয়ের আগে মেয়েটা দৌড়াদৌড়ি করুক। কিন্তু কুহু ফুপুকে অনেক বুঝিয়ে আজ বুধবার পর্যন্ত ক্লাস নেয়ার অনুমতি নিয়েছে।

কিছুক্ষণ বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। নামাজ আদায় করে, সকাল-দুপুরের খাবার তৈরি করতে হবে।

জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। কুহু অবাক হয়ে কলিংবেলের আওয়াজ শুনছে। এই অসময়ে কে আসল! এ সময়তো কারও আসার কথা নয়! এবার একটু ভয় পায় মেয়েটা। এদিকে কলিং বেল বেজেই চলেছে। ও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। পিপ হোলে চোখ রেখেও কাউকে দেখতে পায়না। আগন্তুক বোধহয় একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোটানায় ভুগতে থাকে মেয়েটা। ওর এখন কি করা উচিত সেটা ভেবে পায়না। হঠাৎই মনে হল নিশ্চয়ই বিল্ডিংয়ের কেউ এসেছে। হয়তো জরুরী কোন দরকার আছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, বিল্ডিংয়ের কারও ওর কাছে কি দরকার থাকতে পারে? এবার ভয়ের চোরা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। ভিষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। এদিকে নিয়মিত বিরতিতে কলিং বেল বেজেই চলেছে।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস করে দরজা খুলে দেয়। চিন্তা করে রেখেছে খারাপ কিছু হতে দেখলেই চিৎকার দেবে। দরজা খোলার সাথে সাথে ওর নিঃশ্বাস আটকে যায়। এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সে দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখদুটোয় রাজ্যের ক্লান্তি। গায়ে লেপ্টে থাকা টি-শার্ট কুঁচকে আছে। এত অসামঞ্জস্যতার মধ্যেও তার ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি দেখে অশান্ত মন নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই মানুষটাও ওকে পরম ভালোবেসে বুকে জরিয়ে নেয়।

” এই মেয়ে, এভাবে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমার কলিজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলে কেন! তোমার দুই মন ওজন আমার মত অসহায় মানুষ কিভাবে সামাল দেবে? ছাড়ো দেখি। আর এভাবে কেঁদেকেটেই বা কেন আমার বুক ভাসাচ্ছ ? ” মৃদু ভৎর্সনা খেলে যায় মানুষটির কন্ঠায়।

কুহু তার কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। তাহমিদ আর কিছু না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখে। যে আজ স্বেচ্ছায় ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে দূরে ঠেলে দেয়ার মত বোকা সে নয়।

কুহুর কান্না কিছুতেই থামছেনা। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে, এই মুহূর্তে তাকে পাওয়ার আনন্দে কাঁদছে। আর হারানোর ভয়ে ওকে কাঁদতে হবেনা।

” কান্না না থামালে এই মুহুর্তে আমি চলে যাব। তোমার চোখের পানি দেখার জন্য আমি পা’গ’লে’র মত দেশে ছুটে আসিনি। ”

” আপনি খুব খারাপ। খুব নিষ্ঠুর। ”

” সেকথা আজ জানলে! ”

” আমার নম্বর ব্লক করেছিলেন কেন? ”

” মনের সুখে। খুব শান্তিতে ছিলাম কয়েকদিন। ”

” আপনি সত্যিই খুব খারাপ। ”

” নতুন কিছু বল। ”

” চাচারা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। ” কুহু ফুঁপিয়ে উঠল।

” কনগ্রেচুলেশন। তা সৌভাগ্যবানটি কে? ”

” আমি বিয়ে করবনা। ”

” কেন! তুমি কি এখনও নাদান বাচ্চা আছ, যে বিয়ে করবেনা? সময়মত বিয়ে হলে, আজ তিন বাচ্চার মা থাকতে। সুযোগ যখন এসেছে বিয়েটা করেই নাও। আমিও তোমার বাচ্চাদের মুখে মামা ডাক শুনে কলিজা জুড়াই। ”

” ভালোবাসি। ” তাহমিদের কথা পাত্তা না দিয়ে বলল কুহু।

” কাকে? বাচ্চাদের বাবাকে? ”

” উহু, বাচ্চাদের মামাকে। ”

” তাহলে সত্যিই বিয়েটা করছ! সংসার করবে বাচ্চাদের বাবার সাথে, আর ভালোবাসবে বাচ্চাদের মামাকে? বেয়াদব মেয়ে, ঠাঁটিয়ে কানের নিচে দেব। ছাড় আমাকে। সরে যাও আমার কলিজার ওপর থেকে। ”

” আমি বাচ্চাদের বাবাকেই ভালোবাসিতো। ” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল কুহু। আবেগের বশে কি ভুলটাই না করল সে!

” তো আমার কলিজায় এমন হুমড়ি খেয়ে পরে আছ কেন? যাও বাচ্চাদের বাবার কাছেই যাও। তাকে গিয়ে সেকেন্ডে দশবার ভালোবাসি বল। এই দুইমাসে নিজের চরিত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! আমার মত অসহায় মানুষের কলিজায় চেপে বসেছে! মানুষজনের দেখে ফেলার ভয় করছেনা। ”

” সরি। এভাবে রাগবেননা। ভালোবাসি তো। ”

” আমি কি কখোনো বলেছি ‘ ভালোবাসি ‘? কখনো বলিনি বলবওনা। এবার ছাড়ো। তুমি তোমার ঐ আশিক বানায়া আপ্নেকে ভালোবাসি বল।” তাহমিদ মৃদু গলায় বলল।

” আমার বয়েই গেছে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে। তিনি নিজেই আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আবার ধমকায়ও আমাকেই। আর আমার যাকে ‘ভালোবাসি ‘ বলার তাকেই বলে দিয়েছি। কোন আশিক ফাশিককে আমি চিনিনা। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলেই, তাহমিদ দু’হাতে ওর কোমড় ধরে নিজের সাথে আরেকবার জড়িয়ে নেয়।

” তার কাছ থেকে কি কখনো ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা শুনেছ? না শুনেই এতদূর! ”

” কিছু না বলা কথা বুঝতে হলে কোনও শব্দের দরকার হয়না। শুধু বুঝে নিলেই কাজ হয়ে যায়। আমি অনেক আগেই সবটা বুঝে নিয়েছি। এখন আপনি অস্বীকার করলেও আমি কিছুতেই মানবনা। ”

” এই সাতসকালে আমাকে বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? কাল সারাদিন খাওয়া হয়নি, গোসল হয়নি আবার রাতে ঘুমও হয়নি। তোমার কি একটু দয়া হবে, এই অসহায়ের ওপর?”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু চমকে উঠে তার মুখের দিকে তাকায়। তাহমিদের হাত ধরে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, তাহমিদ দু’হাতের আঁজলায় কুহুর মুখটা তুলে ধরল। গলায় রাজ্যের ভালোবাসা এনে বলল,

” এমন ভালোবাসা অস্বীকার করার সাধ্য কার? তোমার একজীবনের ভালোবাসা দূরে ঠেলার সাধ্য, আমার সাতজন্মেও হবেনা। তুমিই আমার ভালোবাসার সাতমহল। ‘ভালোবাসি’ মেয়ে অনেক ‘ ভালোবাসি ‘তোমাকে। এক অতলস্পর্শী ভালোবাসায় তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই আজীবন। এতটা ভালোবাসতে চাই তোমাকে, যে ভালোবাসার তল খুঁজে পাবেনা হাজার জনমেও। হবে কি আমার? ”

তাহমিদের আবেগে জড়ানো কথা শুনে কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওর চোখ ছলছল করছে।
ওকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ আবারও কথা বলে।

” আমার কথা আমি বলে দিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি যদি চাও তবে আমাকে বাচ্চাদের বাবা বানাতে পার। আর না চাইলে অগত্যা আমাকে মামা হয়েই নিজেকে শান্তনা দিতে হবে। তবুও কিছু একটা হতেই হবে। এতেই পুরুষ জনমের স্বার্থকতা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফিক করে হেসে উঠল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে