প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৯+৩০

0
522

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী জামী

” চাচি, চলুন খেয়ে নিন। আপনি দুপুরেও খাননি। আবার এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে আছেন। আপনার শরীর খারাপ করবে। ” কুহু ভয়ে ভয়ে নায়লা আঞ্জুমের রুমে এসে তাকে খেতে ডাকল।

” মজা নিচ্ছ? আমার অপমানে খুব শান্তি পেয়েছ? হাভাতের দল, লজ্জা করেনা আমার বাবার বাড়িতে থেকেই আমাকে জ্ঞান দিতে? বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। ” খেঁকিয়ে উঠল নায়লা আঞ্জুম।

কুহু অশ্রুসজল চোখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকল। তাহমিদ বাসায় নেই, চাচাও নেই। চাচাকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, তিনি বাসা দেখছেন। তার ফিরতে দেরি হবে। রিশা আর নিশো দুপুরের ঘটনার পর থেকে মন খারাপ করে আছে। নায়লা আঞ্জুম খায়নি, সেজন্য কুহু আর রাজিয়া খালাও না খেয়ে আছে। ও রিশা, নিশোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছুক্ষণ আগে খাইয়ে দিয়েছে।

” আমাকে গালি দেয়ার অনেক সুযোগ পাবেন, চাচি। কিন্তু এখন আপনার খাওয়া জরুরী। চাচাও বলেছে আপনাকে খেয়ে নিতে। ”

” তোমার চাচা আসলে তাকে বেশি করে খেতে দিও। আজ তার খুশির দিন। আমাকে অপদস্ত করতে পেরে সে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে। তাই তাকে আমার খাবারটুকুও দিও। সে খুশিতে খেয়ে নিবে। ”

কুহু বুঝল চাচির সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। এখানে থাকলেই ওকে আরও কথা শুনতে হবে। তাই আর ও রুমে দাঁড়ায়না। আজ রাতে ওর আর খাওয়া হবেনা।

রাত বারোটার কিছু আগে রায়হান আহমেদ বাসায় আসলেন। কুহু চাচাকে দেখে এগিয়ে এসে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান খেয়ে এসেছেন। তাই কুহু নিজের রুমে চলে যায়। এরপর ও আর রাজিয়া খালা মিলে তাহমিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সাড়ে বারোটা নাগাদ খালা ঘুমিয়ে পরলে, কুহু অপেক্ষা করছে তাহমিদের জন্য।

একটার দিকে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু দরজা খুলতে যায়।

” দশ মিনিট পর ছাদে এস। ” তাহমিদ সোজা রুমে চলে যায়। ও কুহুর প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করলনা।

কুহু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও ভেবে পায়না মানুষটা এমন কেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাকে হয়তো কুহু চিনতে পেরেছে। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় লোকটা অচেনা কেউ। আজও তার মন পড়া হয়ে উঠলনা কুহুর।

দশ মিনিট পর ছাদে এসে দাঁড়ায় কুহু। তাহমিদ রেলিংএ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ও কোন কথা খুঁজে পায়না।

” তোমার চাচির কি অবস্থা? মনে তো হয়না সে আজ খেয়েছে। আর নিশ্চয়ই তুমিও খাওনি? সে আবার নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা৷ মানুষ। ” তাহমিদের গলায় চাপা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।

” চাচি কিন্তু আপনার খালামনি হয়। আমার আগে থেকেও তার সাথে আপনার সম্পর্ক। ” কুহু মুখ ভার করে বলল।

” সেই সম্পর্ক চুকাতে পারলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হতোনা। কিন্তু আমি হতভাগ্য একজন, এমন এক সম্পর্কের বেড়াজালে আটকা পরেছি, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ নেই। ” তাহমিদের চোখে টলমল করছে অশ্রুবিন্দু।

” রাতে খেয়েছেন কিছু? নাকি দেবদাস হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন? ”

” তোমাকে কে বলেছে আমি দেবদাস! আমি হলাম গিয়ে প্রেমিক পুরুষ। অল টাইম ফুল ফর্মে থাকি। আমাকে দেবদাস বলে দুনিয়ার প্রেমিক সকলকে কষ্ট দিওনা। প্রেমিকরা দেবদাস হতে নয়, প্রেমিকাদের হিয়ার অধিপতি হয়ে তাদের হৃদকোঠরে আধিপত্য করতে চায়। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু নীরবে হাসল। ও উসখুস করছে। তাহমিদকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছেনা। কথাগুলো কিভাবে বলবে সেটা ভাবতেই ওর ঘাম ছুটে যাচ্ছে।

” আজকে নানিমা অনেক খুশি হয়েছে। তিনি দুপুর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত একবারও তার ছেলেকে কাছ ছাড়া করেননি। নানিমার মুখ থেকে হাসি যেন সরছিলইনা। ”

” সবার মা তো আর আমার মা’য়ের মত নয়। নানিমা গত আট বছর ছেলের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তারই মেয়ে হয়ে মিথিলা আরজুমান্দ উনিশ বছর যাবৎ ছেলেকে ভুলে ছিল। একই দুনিয়ায় কত রকম মানুষ। কতইনা তাদের রূপ-রং। কত তাদের ছলা কলা। ”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরল কয়েক ফোঁটা তরল। যার প্রতিটি বিন্দুতে লুকিয়ে রয়েছে শত শত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস। চোখের পানি লুকাতে তাহমিদ উল্টো ঘুরল। কিন্তু তার আগেই কুহু দেখে নিয়েছে সেই অশ্রুকনাদের। তাহমিদের চোখের পানি ওর বুকের গহীনে আঘাত করল। খোলসের আবরনে ঢেকে রাখা মানুষটাকে দেখে ভেঙে পরছে ওর ধৈর্যের বাঁধ।

” আপনি কিন্তু এখনো আমার কথার উত্তর দেননি। নাকি আমার কথার জবাব দিতে আপনার ভালো লাগেনা। ” কুহু কপট রাগে বলল। ও তাহমিদের মন ভালো করার চেষ্টা করছে।

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও মনে করতে পারছেনা কুহুর কোন কথার উত্তর দেয়নি। ও ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছে। অনেকক্ষন ভাবার পরও বেচারা বুঝতেই পারলোনা ওর অপরাধ কোথায়। বাধ্য হয়েই কুহুকে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেইনি আমি! এক্সকিউজ মি, তুমি কি আমাকে আদৌ কোন প্রশ্ন করেছিলে! তুমি দেখছি দিনকে দিন বড্ড সেয়ানা হচ্ছ! শোন মেয়ে, আমার সাথে সেয়ানা গিরি করে পার পাবেনা। তুমি বুনো ওল হলে, আমি কিন্তু বাঘা তেঁতুল। ”

” অযথাই আমাকে অপবাদ দেবেননা। আমি আপনাকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি এখন পর্যন্ত উত্তর দেননি। ”

কুহুর গোমড়ামুখ দেখে তাহমিদ হাসল।

” সজলের বাসায় গিয়েছিলাম। মায়া না খেয়ে আসতেই দিলনা। শোন, যেকারনে তোমাকে ডেকেছি। আমি কালকেই ঢাকা ফিরছি। ঠিক দুইদিন পর আমি এস্তোনিয়া যাচ্ছি। সেখানকার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা কোর্সের জন্য ডাক পেয়েছি। দুইমাস থাকতে হবে সেখানে।দুইমাস পর দেশে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দেব। ততদিন তুমি সাবধানে থেক। তালুকদার সাহেব খুব তারাতারি বাসা ঠিক করে ফেলবেন। আমিও তার সাথে গিয়ে কয়েকটা বাসা দেখেছি।”

” কালকেই চলে যাবেন! ”

” হুম। তবে তারাতারি ফিরব। এটা নিয়ে রুমে যাও। খালাও নিশ্চয়ই খায়নি। তাকে ঘুম থেকে তুলে, দু’জন একসাথে খেয়ে নিবে। এতক্ষণে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম করে নিও। এখন রুমে যাও। অনেক রাত হয়ে গেছে। ” তাহমিদ কুহুর হাতে খাবারের প্যাকেট দিল।

কুহু হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নিল। কিন্তু কোন কথা বললনা। ওর বুকটা ভারি হয়ে গেছে। মানুষটা আসতে কি না আসতেই চলে যাবে। অথচ কতদিন পর রাজশাহী এসেছে।

কুহু কিছু না বলে চুপচাপ নিচে চলে যায়।

পরদিন সকালে তাহমিদ ঢাকা রওনা দেয়। রায়হান আহমেদ অফিসে চলে গেছেন। সৈকত আহমেদ তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেশিরভাগ সময় ফাতিমা খানমের রুমে কাটাচ্ছে। অনেকদিন পর সে তার মা’কে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু নায়লা আঞ্জুম রুম থেকে একবারও বের হয়নি। না সে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে , না তার স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কথা বলেছে। সে বাসায় খায়নি। খাবার অর্ডার দিয়েছিল। সেই খাবারই সন্তানদের নিয়ে খেয়েছে। সৈকত আহমেদ তার সাথে কথা বলতে গেলেই, সে তার ভাইকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে কয়েকবার।

কুহু বিপদে পরেছে। ওকে দেখলেই নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠছে। নানা ধরনের কথা বলছে। কুহু আর সহ্য করতে পারছেনা। গতরাতে সে তাহমিদকে জানাতে চেয়েছে, ও আলাদা বাসা নিতে চায়। কিন্তু তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সাহস করে উঠতে পারেনি।

কুহু বিকেলে কোচিং-এ গিয়ে সেখানকার কয়েকজন শিক্ষককে আরেকবার করে একটা বাসা দেখার কথা বলে দেয়। তারাও জানায় কুহুর জন্য একটা নিরাপদ বাসা খুঁজে দেবে। তবে একজন শিক্ষিকা জানায়, তার ফুপুর বাসায় দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে। ফুপুর ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাহিরে থাকে। বৃদ্ধা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। বাকি পাঁচতলা ভাড়া দেয়া হয়েছে। বৃদ্ধা কথা বলার কোন সঙ্গী পাননা। তার স্বামী কয়েক বছর আগে মা’রা গেছেন। তাই তিনি ফাঁকা দুই রুম ভাড়া দিয়ে গল্প করার একটা সঙ্গী চান। তিনি এ-ও বলেছেন, নামমাত্র টাকায় তিনি ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেবেন। কুহু সব শুনে কোচিং শেষে সেই বাসায় গিয়ে বৃদ্ধার সাথে কথা বলেছে।

সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ বাসায় এসে জানালেন, তিনি একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করেছেন। আগামীকাল থেকেই তারা ফ্ল্যাট গোছাতে শুরু করবেন। তিনি কুহুকে ডেকে সব গোছগাছ হরতে বললেন। এবার আর নায়লা আঞ্জুম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। সে নিজের সমস্ত রাগ, জেদ ঢেলে দেয় কুহু৷ ওপরে।

” খুব বাড় বেড়েছে তোমার? আমার কাছ থেকে না শুনেই তুমি বাসা দেখেছ! এতবড় সাহস তুমি কোথায় থেকে পেয়েছ? তোমার নতুন বাসায় তুমিই যেও। আমি এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবনা। তোমার যেখানে খুশি তুমি সেখানে যাও। ”

” ঠিক আছে, তুমি না গেলে যেওনা। আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠব। তোমার অহংকার নিয়ে তুমি থাক। আমাদের জীবনে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। কুহু মা, তুই গিয়ে গোছগাছ করে নে। এই মহিলাকে ছাড়াও আমাদের চলবে। ”

” হ্যাঁ, এখনতো ঐ হাভাতে, ফকিন্নিই তোমার সব। যেদিন থেকে তোমার ভাই ম’রে’ছে সেদিন থেকেই যেন ওরা তোমার আপন হয়ে গেছে। আর যখন তোমার ভাবি ম’র’ল তখন এই হাভাতে দুটো তোমার আপন হয়ে গেল? এখন এই হাভাতেদের ছাড়া তোমার চলছেইনা? কিসের এত দরদ? যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই রাখতে হয়। তুমি পায়ের জুতাকে মাথায় তুলছ। ভুলে যেওনা আমি তোমার স্ত্রী। আমি চাইলেই নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে তোমাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াতে পারি। তাই যা করার ভেবেচিন্তে করবে। ”

নায়লা আঞ্জুমের করা আজকের অপমান কুহু কিছুতেই সহ্য করতে পারলনা। ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। কিন্তু ও মুখ খোলার আগেই রায়হান আহমেদের গলা শুনতে পায়।

” খবরদার নায়লা, আমার ভাই-ভাবী কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন কথা তুমি বলবেনা। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। তোমার মত স্ত্রী’কে আমার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব। তোমার…

রায়হান আহমেদ কথা শেষ করতে পারলেননা। তার আগেই কুহু কথা বলল।

” চিন্তা করবেননা চাচি, আমি কালকেই সৃজনকে নিয়ে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। এই হাভাতেদের মুখ আপনার আর দেখতে হবেনা। আপনি বরং মন দিয়ে সংসার করবেন। চাচা, তুমি আমাদের জন্য কেন নিজের সংসারে অশান্তি ডেকে নিয়ে আসছ! আমি আজই একটা বাসা দেখেছি। তবে কোন কথা দিইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কথা দিলেই ভালো হত। আমি এক্ষুনি বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলব। কাল সকালেই সৃজনকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। ”

” কুহু মা, এসব তুই কি বলছিস? তুই কোথাও যাবিনা। তুই আমার সাথে আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠবি। দেখি কে তোকে আটকায়। ”

” না চাচা, তা আর হয়না। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর যাইহোক নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি তোমার সাথে নতুন বাসায় যাবনা । আমাদের বাবা-মা নেই বলে কি যে কেউ আমাদের পায়ে মাড়াবে? এটা আমি কখনোই হতে দেবনা। এছাড়াও অনেক আগেই আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতাম। শুধু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাটি কামড়ে পরে ছিলাম। কিন্তু আর নয়। আমি রাজশাহীতে থেকেই সৃজনকে পড়াশোনা করাব আর নিজেও পড়ব। চিন্তা করোনা, এখন দুইটা কোচিং-এ পড়াচ্ছি। সামনে অন্য কোথাও কাজ নিব। আর বাবার যে কয়টা টাকা আছে, সব মিলিয়ে আমাদের দুই ভাইবোনের ভালোই চলে যাবে। তুমি আর আমাদের আটকাবেনা প্লিজ। আমাদের জন্য দোয়া করবে। ” কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না। দৃঢ় পায়ে রুমের দিকে হেঁটে যায়।

এতক্ষণ রাজিয়া খালা রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি সৈকত আহমেদের ছেলের জন্য নুডলস বানিয়ে এনেছিলেন। সৈকত আহমেদের রুমে যাওয়ার সময় কথাগুলো তার কানে যায়।

কুহুর এমন সিদ্ধান্ত শুনে খালার চোখে পানি জমেছে। তিনি তাহমিদকে কি বলবেন? এখন যদি এসব কথা তাহমিদের কানে যায়, সে আবারও রাজশাহী ফিরে আসবে। তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবে। হয়তো তার আর বিদেশ যাওয়াই হবেনা। অনেক কিছু ভেবে খালা এখনই তাহমিদকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেন। তার আগে কুহুর সাথে আলোচনা করতে হবে।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন সকালে কুহু সৃজনকে তৈরী হতে বলে নিজেও তৈরী হয়ে নেয়। রাজিয়া খালা ছলছল চোখে ওর কাজকর্ম দেখছে। রাতেই কুহু ওদের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখেছিল এবং বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে রেখেছিল। ও বৃদ্ধাকে জানিয়েছিল, সকালেই ওরা বাসায় উঠবে।

” মাগো, না গেলে হয়না? তোমার চাচার বাড়িতেই যাইয়া থাইক। তুমি একা মাইয়া, ছোট ভাইরে নিয়া নতুন জায়গায় কেমনে থাকবা! আমার চিন্তা হইব গো, মা। ” রাজিয়া খালা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

” আমার যেতেই হবে, খালা। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। আজ যদি আমি না যাই, তবে আজীবন আমাকে পরাধীনতার শেকলে আটকে থাকতে হবে। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই, খালা। ”

” বাপজানরে আমি কি কমু? তুমি তো তারে জানোই। ”

এবার থমকায় কুহু। সত্যিইতো ও তাহমিদকে কি জবাব দেবে! আর সেই বা বিষয়টা কিভাবে নেবে? কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। ততক্ষণে ওর আঁখিদ্বয় জলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। ও চোখ মুছে ভাঙ্গা গলায় বলল,

” তাকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই, খালা। সে যেমন মানুষ, এসব শোনার পর দেখা যাবে, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছে। আগে সে এস্তোনিয়া যাক। তারপর বল। ”

রাজিয়া খালা এই কুহুকে যেন চিনতে পারছেননা। মেয়েটা একরাতেই হঠাৎ করে কেমন অচেনা হয়ে গেছে! ওর চেহারায় প্রতিজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। তার মুখে আর কোনও কথা জোগায়না।

আরও আধাঘন্টা পর সৃজনকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় কুহু। তার আগে অবশ্য নানিমা, চাচা, রিশা, নিশোর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। ওর এভাবে চলে যাওয়ার কথা শুনে রিশা কাঁদছিল। নানিমাও খুব কেঁদেছেন। সৃজন এখনও বুঝে উঠতে পারেনি ওর আপু হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল। কুহুও ছেলেটাকে কিছুই জানায়নি। রায়হান আহমেদের সাথে ওরা দুজন ওদের নতুন ঠিকানার পথে পা বাড়ায়।

দুরুদুরু বুকে, ভীতু পায়ে কুহু সৃজনকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় নতুন বাসার সামনে। দারোয়ান প্রথমে ওদের ভেতরে যেতে দিতে চাচ্ছিলনা। ও বুদ্ধি করে বাড়ির মালিককে ডাকার কথা বলেছিল। পরে বাড়ির মালিক সেই বৃদ্ধা এসে ওদের ভেতরে নিয়ে যায়।

বৃদ্ধা ওদের দুই ভাইবোনের কাছে তিনটা ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে গেছেন।

” তোমাদের আসবাব কই? কখন আসবে সেগুলো? ”

” দাদু, আমাদের এখন পর্যন্ত কোন আসবাব কেনা হয়নি। শুধু কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছি। ধীরে ধীরে প্রয়োজনিয় আসবাব কিনে নেব। ” প্রথমদিনই বৃদ্ধা তাকে দাদু ডাকতে বলেছিলেন। তাই কুহুও তাকে দাদু ডাকল।

বৃদ্ধা আগেই কুহুর কাছ থেকে জেনেছিলেন ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। তাই তখনই ওর ওপর বৃদ্ধার মায়া জন্মেছিল। আজ আরেকবার ওদের দুই ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ভিজে উঠে।

” শোন মা, আপাতত কোন আসবাব কেনার দরকার নেই। আমার স্টোর রুমে তোমার প্রয়োজনিয় সকল কিছু পেয়ে যাবে। তুমি শুধু দেখিয়ে দাও কি কি লাগবে। আমি দারোয়ানকে বলে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ”

” আন্টি, আপনি এসব কি বলছেন! আমার কিছু লাগবেনা। আমি ধীরে ধীরে সবকিছু কিনে নিতে পারব। ”

” সেটা পরে দেখা যাবে। আগে বাসাটা থাকার উপযোগী করে নাও। শোন, এসব আমি এমনিতেই তোমাদের জন্য করছিনা। এগুলোর বিনিময়ে আমাকে একটু সময় দিও তোমরা। এত বড় বিল্ডিংয়ে কত মানুষ বাস করে। কিন্তু কারও আমার কাছে এসে গল্প করার সময় হয়না। আমি বড্ড একা। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই, স্বামী নেই। এই বয়সে নাতি-নাতনীদের নিয়ে আনন্দ করার বদলে আমি একা একা গুমরে ম’র’ছি। আমাকে দেয়ার মত সময় কারও নেই। ছেলেমেয়েরা টাকা দিয়ে, ভিডিও কলে কথা বলে নিজেদের দ্বায়িত্ব পালন করে। তারা বুঝতে চায়না আমি কতটা একা। ” বৃদ্ধা হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

বৃদ্ধার কান্না দেখে কুহুর চোখেও পানি জমেছে। ও ভাবছে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে কেউই আসলে পরিপূর্ণ নয়। কোননা কোন কিছুর অভাব সকলকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।

রায়হান আহমেদ বৃদ্ধার একটু কাছে এগিয়ে গেলেন।

” খালাম্মা, আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দুটো একেকটা রত্ন। ওরা সুযোগ পেলেই দেখবেন আপনাকে সঙ্গ দেবে। তবে এরা দু’জন বড্ড অসহায়। আজ তাদের কাছে চাচা থেকেও নেই। কতবড় দুর্ভাগা হলে কারও সাথে এমনটা ঘটতে পারে বলুন! আমিও এক অর্থে দূর্ভাগাই। এমন রত্নকে নিজের কাছে রাখতে পারলামনা। তাদের প্রতি কোনও দ্বায়িত্ব পালন করতে পারলামনা। ” রায়হান আহমেদের গলায় ক্ষোভ, হতাশা সুপ্ত থাকলনা।

” চাচা, এভাবে বলোনা। তুমি আমাদের জন্য যা করেছ, তা কোন বাবা-মা ‘ র থেকে একটুও কম নয়। তুমি এভাবে বললে আমার কষ্ট হয়। ” কুহু রায়হান আহমেদের হাত ধরে বলল।

বৃদ্ধা ওদের কথপোকথন শুনে বুঝতে পারছেন, তার ন্যায় এরাও কোন অপ্রাপ্তিতে ভুগছে। তিনি ম্লান হেসে কুহুর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের কাছে নিলেন।

” তুমি দেখছি খুব দয়ালু একটা মেয়ে। তোমাকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তুমি এবার শেফালির সাথে স্টোর রুমে যাও। কি কি প্রয়োজন সব ওকে দেখিয়ে দাও। দেখবে দুই ঘন্টার মধ্যে তোমার ফ্ল্যাটকে বসবাসযোগ্য করে দেব। ” তিনি শেফালি নামক কাজের মেয়েটির সাথে কুহুকে স্টোর রুমে পাঠিয়ে দিলেন।

রায়হান আহমেদ বৃদ্ধার ড্রয়িংরুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছেন মাতৃসমা এই বৃদ্ধার সাথে। অনেকদিন পর কেউ তাকে এভাবে মায়ের মত স্নেহ করছেন। আজ হঠাৎ করেই তার মা’য়ের কথা ভিষণভাবে মনে পরছে।

কুহু স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে আসলে বৃদ্ধা শিউলিকে দিয়ে সিকিউরিটিকে ডেকে পাঠালেন। সিকিউরিটি আসলে তাকে শেফালির সাথে পাঠিয়ে দিলেন স্টোর রুমে। সৃজনও তাদের পিছুপিছু স্টোর রুমে যায়।

কুহু সময় কাটানোর জন্য বৃদ্ধার সাথে কথা বলতে থাকে।

দুই ঘন্টার ভেতর কুহুর ফ্ল্যাটে প্রয়োজনিয় আসবাব সেট করে দেয় সিকিউরিটি, দারোয়ান আর মালি মিলে। বৃদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতায় কুহুর মন ছেয়ে যায়। এভাবে যে নতুন কাউকে ভালোবাসা যায় আজ ও প্রথম দেখল।

রায়হান আহমেদের বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে। তিনি কুহুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, কুহুর সাথেই বৃদ্ধার কাছে আসলেন।

” খালাম্মা, আমি এবার বের হব। আপনি আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে রাখবেন। আমরা ভাইবোনেরা ওদেরকে মাঝেমধ্যেই দেখতে আসব। এছাড়া আমার ছেলেমেয়েরাও আসবে। আর আসবে কুহুর একটা খালা। যিনি কুহুর কাছে মা’য়ের মতই। কুহু মা, তুই প্রতিদিন সময় করে এসে খালাম্মার সাথে গল্প করবি, কেমন? ”

কুহু চাচার কথার প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

” কারা কারা ওদের কাছে আসবে সেটা সিকিউরিটির কাছে বলে দিয়ে যেও, বাবা। এখানকার নিয়ম খুব কড়া। আগে থেকেই বলে না রাখলে কাউকে ঢুকতে দেবেনা। ”

” চাচা, তোমরা সবাই আসবে, কিন্তু তাহমিদ ভাইয়া আসবেনা? সে তো মাঝেমধ্যে রাজশাহীতে আসে। ভাইয়া রাজশাহীতে আসবে, কিন্তু আমাদের কাছে আসবেনা? ভাইয়াকে না দেখলে আমার খুব খারাপ লাগবে। ” হঠাৎ করেই সৃজন বলে উঠল। ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেছে তাহমিদকে দেখবে না জন্য।

কুহু আহত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সৃজন উনাকে এত ভালোবাসে! কুহু ঠোঁট কামড়ে হাসল। আসলেই মানুষটা ভালোবাসার মতই। যাকে সব সময়ই ঘিরে থাকে একরাশ মুগ্ধতা আর স্নিগ্ধতা। এতক্ষণ ও তাহমিদকে দিব্যি ভুলে ছিল। হঠাৎই সৃজন তার কথা মনে করিয়ে দেয়ায়, কুহুর বুক ধুকপুক করছে। সে যখন জানবে ওরা বাড়ি ছেড়েছে, তখন সে কি প্রতিক্রিয়া দেবে? কিভাবে নেবে সে এই সবকিছু?

” আচ্ছা আব্বা, আমি তাহমিদের কথাও বলে যাব সিকিউরিটির কাছে। ও রাজশাহী আসলেই তোর সাথে দেখা করবে। আমি তাহমিদকেও বলে দেব। ” কুহুর ভাবনার মাঝেই কথা বললেন রায়হান আহমেদ।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে অশ্রুমাখা নয়নে বিদায় নিলেন রায়হান আহমেদ।

এদিকে দাদু কুহুকে বলেছেন, আগামী কয়েকদিন কুহুকে রান্না করতে হবেনা। এই কয়েকদিন ওরা দাদুর বাসাতেই খাবে। কুহু অনেক জোড়াজুড়ি করেও কোন লাভ হলোনা।

আরও তিনদিন পর কুহুর ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসল। কুহু তখন সবেমাত্র বই বন্ধ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে। ও ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাত এগারোটা দশ বাজে। অপরিচিত নম্বর তাও আবার এত রাত। তাই কুহু ফোন রিসিভ করলোনা। পরপর কয়েকবার ফোন বাজলেও কুহু রিসিভ করলনা।

টুং করে শব্দ হতেই কুহু ফোন হাতে নিয়ে দেখল একটা ম্যাসেজ এসেছে সেই অপরিচিত নম্বর থেকে। কুহু ম্যাসেজ ওপেন করে দেখল ছোট্ট করে লিখা আছে, ” ফোন রিসিভ কর। ” ব্যাস ও বুঝে যায় তাহমিদের ম্যাসেজ।

প্রায় সাথে সাথেই ফোন বেজে উঠল। কুহু দুরুদুরু বুকে ফোন রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। এতক্ষন তো ফোন রিসিভ করছিলেনা, এখন আবার জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি! যাহোক আমি ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো? সৃজন কেমন আছে? কি করছে ও? ”

” আমরা সবাই ভালো আছি। সৃজন ঘুমিয়েছে। আপনি কি করছেন? ”

” আমি মাত্রই রুমে আসলাম। রাতে খেয়েছ? ”

” জ্বি খেয়েছি। আপনি? ”

” আরেকটু পর খাব। কোচিং-এ গিয়েছিলে? সব ঠিকঠাক আছে? ”

” জ্বি সব ঠিকঠাক আছে। ”

” অনেক রাত হয়েছে। আর জেগে থেকোনা। সকালেতো আবার কোচিং-এ ছুটবে। নিজেদের খেয়াল রেখ। আর হ্যাঁ, আমি প্রচুর ব্যস্ত থাকব। রেগুলার ফোন দিতে পারবনা। মাঝেমধ্যেফোন করব। নম্বরটা সেইভ করে রেখ। রাখছি। ” তাহমিদ তারাহুরো করেই ফোন রাখল। ওকে আবার বেড়োতে হবে। কয়েকদিন দৌড়ের ওপর থাকতে হবে।

সকাল থেকে রাজিয়া খালার মন ভালো নেই। চিন্তায় তার বুক শুকিয়ে আছে। তাহমিদ সকালে ফোন দিয়েছিল। যদিওবা কুহুর কথা কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। তবে তিনি জানেন এরপর ফোন করলে অবশ্যই সে তাকে কুহুর কথা জিজ্ঞেস করবে। তিনি কি উত্তর দেবেন? আর সত্যিটা বলার পর তাহমিদ কি করবে? খালা আর কিছু ভাবতে পারছেননা। আজকে তিনি কাজেও মন দিতে পারছেননা।

কয়েকদিন কুহুর বেশ ভালোই কেটেছে। সাতদিন ওরা দাদুর বাসাতেই খেয়েছে। কাজের ফাঁকে গিয়ে দাদুর সাথে গল্প করে আসে। দাদু আরও কয়েকদিন ওদের তার কাছে খাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কুহু রাজি হয়নি। ও দুইদিন আগে সংসারের টুকটাক জিনিসপত্র কিনে এনেছে। এরমধ্যে আর তাহমিদ ফোন দেয়নি। তবে কুহু জানে দুই-এক দিনের মধ্যেই সে ফোন দেবে। তাকে কিভাবে বলবে তারা ঐ বাসায় নেই, এই চিন্তাই এখন কুহুকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

রাজিয়া খালা রান্নাঘরে কাজ করছেন। তার পাশে আরও দুইজন মেয়ে যে যার কাজ করছে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন হাতে নিয়ে বুঝলেন আরেকদিন তাহমিদ এই নম্বর দিয়েই ফোন দিয়েছিল। শুকনো মুখে তিনি ফোন রিসিভ করলেন।

” কেমন আছো, বাপজান? কি করতাছো এখন? ”

” আমি ভালো আছি, খালা। নানিমা কেমন আছে? বাসার সবাই ভালো আছে? আমি কিছুক্ষণ আগে রুমে এসেছি। এখন রেস্ট করছি। সারাদিন খুব খাটতে হয়। সেজন্যইতো তোমাদের সাথে কথা বলতে পারিনা। ”

” আমরা সবাই ভালো আছি, বাপজান। তুমি খাইছো? এখন তোমার ঐ দেশে কয়ডা বাজে? ”

” খেয়েই তবে রুমে এসেছি। এখন এখানে সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু তুমি কি করছ? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছেনা তুমি ঘুমিয়েছ। এখন বাংলাদেশে এগারোটা বাজছে। তুমি এখনও জেগে আছ কেন? ”

” বাপজান, আইজ বাসায় অনেক আত্মীয় আসছিল। সৈকত তার বউ পোলাপান নিয়া আসছে। তাই তাদেরকে দেখবার জন্য সবাই আসছিল। সবাই রাতের খাবার খাইয়াই গেছে। তাই আমরা এখনো জাইগা আছি। রান্নাঘর গোছগাছ কইরাই তবে ঘুমাইতে যাব।”

” খুব ঝামেলায় আছ দেখছি। আচ্ছা খালা, কুহু কই? ওকে ফোনটা দাও। এই সুযোগে ওর সাথেও কথা বলে নেই। ”

রাজিয়া খালার হাত থেমে গেছে। তিনি এখন কি উত্তর দেবেন। সেই সাথে শুকিয়ে এসেছে গলা। তার পাশে দুইজন মেয়ে এখনও কাজ করছে। তাই তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে আজ সত্যিটা বলতেই হবে, এটা তিনি বুঝে গেছেন।

” বাপজান, তুমি এখন ঘুমাও। পরে কথা কইও কুহু মায়ের সাথে। ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল খালা।

” আমি আগে ওর সাথে কথা বলে নিই। তারপর ঘুমাব। তুমি ওকে দাও। ”

” হেয় বাড়িতে নাই। ” এক নিঃশ্বাসে বললেন তিনি।

” কোথায় গেছে! ও গ্রাম থেকে কয়দিন আগেই না বেড়িয়ে এসেছে। এখন আবার কোথায় গেছে? ”

” বাপজান, তুমি মাথা ঠান্ডা কইরা আমার কথা শুনবা কও? আমারে কথা দেও। ”

” বল, খালা। আমি শুনছি। ” কাঠকাঠ গলায় বলল তাহমিদ।

” কুহু মা সৃজনরে নিয়া বাড়ি ছাইড়া ভাড়া বাড়িতে গেছে আজ আটদিন হয়। ” এরপর খালা একে একে সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললেন।

সব শুনে তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর অজান্তেই এত কিছু হয়ে গেছে, অথচ ওকে কেউই কিচ্ছু জানায়নি! অবশ্য ও এই কয়দিন রায়হান আহমেদের কাছে ফোন করেনি। তাই কিছু জানতেও পারেনি। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সব কথাগুলো তাহমিদের কন্ঠায় এসে আটকে গেছে। সে এখন খালাকে কি বলবে! সেই সাথে এটাও অনুভব করছে, হুট করেই ওর রা’গ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ও ফোন কেটে দেয়।

কুহু কেবলই বই রেখে শুয়েছে। সেই সময়ই ফোন বেজে উঠল। ও ভয়ে ভয়ে রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। তুমি এখন কোথায়? “কুহুর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজনবোধ করলনা।

তাহমিদের গলা শুনে কুহু বুঝে গেছে সে সবটাই জেনে গেছে। এখন আর লুকোচুরির কোন সুযোগ নেই।

” আমি এখন সাহেব বাজার থাকি। ” মৃদু গলায় বলল মেয়েটা। এরপর কি প্রশ্ন আসবে সেই চিন্তায় ও চোখে অন্ধকার দেখছে।

” বাহ্। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখেছ। খুব বড় হয়ে গেছ দেখছি! আজ মনে হচ্ছে তোমার সাথে মিথিলা আরজুমান্দের বড্ড মিল। সে-ও তার নিজের প্রয়োজনে সংসার ছেড়েছিল। আর তুমিও নিজের প্রয়োজনেই ঐ বাড়ি ছেড়েছ। অথচ আমাকে একটিবার জানানোর প্রয়োজনই মনে করনি! আর আমি কিনা এদিকে সর্বদাই তোমার চিন্তায় অস্থির থাকি। নতুন বাসায় খুব শান্তিতে আছ তাইনা? তবে থাক শান্তিতে। আমাকে যখন তোমার প্রয়োজনই নেই, তবে মিছেমিছি আমি কেন তোমার চিন্তা করব। তুমি যদি আমাকে ছাড়াই নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পার, তবে আমি কেন তোমার জন্য ভালোর জন্য ভাবব? তুমি তোমার মতই থাক। ” তাহমিদ রা’ গ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

” আপনি রা’গ করবেননা, প্লিজ। একটিবার আমার কথা শুনুন। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমাক..

” কি শুনব হ্যাঁ? তুমি একবারও ভেবে দেখেছ, একা একটা মেয়ে সম্পূর্ণ আত্মীয় স্বজন ছাড়া, নতুন জায়গায় থাকতে গেলে, এতে কত সমস্যা হতে পারে? তোমার প্রটেকশনের জন্য সেখানে কেউই নেই। আল্লাহ না করুন, কোন বিপদ হলে কে এগিয়ে আসবে। এসব ভেবে দেখেছ? আরে দুনিয়াটা কত খারাপ সে সম্পর্কে কোন ধারনা আছে তোমার? তুমি একা একটা মেয়ে। লোকজন সুযোগ পেলেই যে তোমার ক্ষতি করতে চাইবেনা, সেটা তুমি বলতে পারবে? ” কুহুকে কথা বলতে না দিয়েই তাহমিদ কথা বলল।

তাহমিদের গলা শুনে কুহু বুঝতে পারছে সে ভিষণ রে’গে গেছে। এই মুহূর্তে কোন কথাই তাকে শান্ত করতে পারবেনা।

” আপনি একটু শান্ত হোন। আমার কথা একবার শুনুন। ” ভয়ে কুহুর শরীরের সাথে গলাও কাঁপছে।

” এই মুহূর্তে তোমার কোন কথা শোনার ইচ্ছেই আমার নেই। তুমি থাক তোমার মত। নিজের মত করে শান্তিতে দিন কাটাও। কেউ তোমাকে বাঁধা দিতে যাবেনা। ” তাহমিদ কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দেয়।

পরমুহূর্তেই কুহু তাকে ফোন দিলে বিজি দেখায়। পরপর কয়েকবার ফোন দিয়েও তাকে পায়না। পুরো রাত কুহু তাহমিদকে ফোনে পায়না। সেই রাতে আর কুহুর ঘুম হলোনা। পরদিন সকালেও তাহমিদকে ফোনে পায়না। এভাবে পরপর কয়েকদিন ট্রাই করেও তাহমিদকে পায়না। এরইমধ্যে রাজিয়া খালার সাথে কথা বলে জানতে পারে তাহমিদ তাকে গতকাল ফোন দিয়েছিল। কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ ওর নম্বর ব্লক লিষ্টে রেখেছে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে