প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৫+২৬

0
544

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী

” শুনলাম তুমি নাকি কোচিং-এ জয়েন করেছ? ” কুহু ড্রয়িংরুমে বই নিয়ে বসেছিল। তখনই নায়লা আঞ্জুম সেখানে এসে দাঁড়ায়।

কুহু চাচির আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকায়। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়,

” জ্বি, চাচি। পরশু থেকে ক্লাস নিতে হবে। ”

” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কখনো না কখনোতো নিজের রাস্তা দেখতেই হত। কতদিন আর এভাবে হাভাতের মত অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে চলবে! অবশ্য তোমাদের তো লাজলজ্জা নেই। দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে থেকেও বিবেকবোধ জাগ্রত হয়না। ”

নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে কুহুর বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। এত অপমানও ওর ভাগ্যে ছিল! চোখের কোনে জমে থাকা অবাধ্য অশ্রুকনারা ঝরে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কুহু কোনক্রমেই ওর চোখের অশ্রুকনাদের ঝরতে দিতে চায়না। নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায়না অন্যের সামনে। ও বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” চিন্তা করবেননা চাচি, আমি খুব তারাতারি এখান থেকে বেরিয়ে যাব। আপনাকে আর কষ্ট দেবনা। ”

” সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল হবে। অনেক সহ্য করেছি তোমাদের এই বাসায়, আর নয়। সকালে, সন্ধ্যায় তোমাদের দুই ভাইবোনের মুখ দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। রায়হান আহমেদের কথা আর মানতে আর রাজি নই আমি। প্রয়োজনে তোমাদের সাথে তাকেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে বের করে দেব। আমার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রেখে তাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেব। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের থেকে তার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দর ওপর দরদ বেশি! দরকার নেই আমার এমন স্বামী। যে স্বামী একটাবারও চিনি করেনা এদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে তার সংসারে টান পরছে। খরচ বাড়ছে। ঢং করে ভাইয়ের ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে! সাধারণ একটা হাইস্কুলে ভর্তি করালে তার সম্মান যেত! আর এই ভিখারির দলও নাচতে নাচতে চাচার কথায় সায় দিয়েছে। ”

চাচির এমন ঘৃণায় ভরা কথা শুনে কুহু এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলনা। ও হু হু করে কেঁদে উঠল। কি দোষ ছিল ওদের? মৃ’ত মা’য়ের কথা রাখতেই চাচার কথায় এখানে এসেছিল। ও-তো চাচাকে নিষেধ করেছিল প্যারামাউন্ট স্কুলে সৃজনকে ভর্তি না করাতে। কিন্তু চাচা শুনলোনা।

রাজিয়া খালা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলেন। তিনি আঁচলে চোখ মুছলেন। তাহমিদকে দেয়া কথা তিনি রাখতে পারলেননা। তিনি এই বাসায় অসহায় একজন কাজের মানুষ মাত্র।
রাজিয়া খালার সাথে আরেকজনও শুনল নায়লা আঞ্জুমের বিষবাক্য। সে হল এই বাসারই আরেকজন মেইড রেখা আক্তার। তার চোখেও পানি।

পরদিন থেকে শুরু হয় কুহুর কর্মজীবন। ও কোচিং-এ ক্লাস নিচ্ছে। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ক্লাসে পড়াতে থাকে। সেই সাথে নিজের লক্ষ্য পূরনের দিকে এগোতে থাকে একটু একটু করে। তাহমিদের পাঠানো সাজেশনগুলো ওর হাতে এসেছে। ও সেগুলো এমনভাবে পড়েছে যে মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। যদিও রুয়েটের জন্য সাজেশন ও অল্পই পড়েছে। ওর টার্গেট পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়। কারন ও জানে রুয়েটে চান্স হয়ে গেলে নিজের পড়াশোনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে। কোচিং কিংবা টিউশনি তেমন একটা করতে পারবেনা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেলে পড়ার ফাঁকেও যথেষ্ট সময় পাবে কোচিং, টিউশনি করানোর। ওদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনার জন্য অনেক টাকা দরকার। আর সেই টাকাগুলো আসবে কোচিং, টিউশনি থেকেই।

আরও একমাস পেরিয়ে গেছে। কুহু দুই কোচিং থেকেই বেতন পেয়েছে। ও এই সামান্য বেতন থেকেই রিশা, নিশোর জন্য পোশাক কিনেছে। খালার জন্যও একটা শাড়ি কিনেছে। তবে সৃজনের জন্য এখন কিছুই কেনেনি। ওকে বলেছে, সামনের মাসে বেতন পেয়ে কিনে দেবে।

এই একমাসে তাহমিদ ওকে দশদিন ফোন করেছে। পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেনি সে। সে জানিয়েছে রাজশাহী আসতে তার আরও কিছুদিন দেরি হবে। কুহুর অ্যাডমিশনের দিনও এগিয়ে আসছে। তাই সে কুহুকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বারবার তাগিদ দেয়।

” চাচা, একটা কথা ছিল। ” রায়হান আহমেদ বাগানে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। আজ শুক্রবার হওয়ায় তিনি বাসায় আছেন।

কুহুর গলা শুনে তিনি পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন,

” কি কথা বলবি, বলে ফেল। সব সময় এমন কুঁকড়ে থাকিস কেন, মা! আমি তোকে বলেছিনা, তোরা তোদের চাচার অধিকারে এখানে থাকছিস। রিশা আর নিশোর ন্যায় আমার টাকা, ভালোবাসায় তোদের সমান অধিকার আছে। মনে রাখবি তোর চাচা সামান্য কেউ নয়। ”

চাচার কথা শুনে কুহু একটু হাসল। চাচা যে ওদের সত্যিকারের ভালোবাসে তা কুহু বেশ বুঝতে পারে। তাই সে নায়লা আঞ্জুমের আচরণগুলো কখনোই চাচার কাছে তুলে ধরেনা। ও চায়না ওদের জন্য চাচার সংসারে অশান্তি হোক।

” চাচা, আমি এখানে যথেষ্ট ভালো আছি। তাই তোমাকে আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। আমি তোমার কাছে অন্য একটা দরকারে এসেছিলাম। ”

রায়হান আহমেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন কুহুর দিকে।
কুহু চাচার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আবারও কথা বলল,

” চাচা, অনেকদিন হয় রাজশাহী এসেছি। সেই কবেই চারমাস পেরিয়ে গেছে। কতদিন বাড়িতে যাইনি। কতদিন বাবা-মা’কে দেখিনি। সৃজনও বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। একবার আমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে? ” কুহু ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গত কয়েকদিন থেকে ও মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বারবার বাবা-মা’ র কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রতিনিয়ত চাচির করা অপমানে ওর মন ভঙ্গুর হয়েছে। হারাচ্ছে ধৈর্য্য। সেই সাথে প্রকট হচ্ছে এই বাড়ি থেকে দূরে যাওয়ার ইচ্ছে।

ভাতিজীর কান্না দেখে রায়হান আহমেদের চোখেও অশ্রু জমেছে। তিনি একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে কুহুর কাছে বসলেন। সস্নেহে হাত রাখলেন কুহুর মাথায়। কুহু তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

” কাঁদিসনা, মা। তোদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু জানিসইতো, আমি একরাতের বেশি সেখানে গিয়ে থাকতে পারবনা। এছাড়া বড় আপাও এখন বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারবেনা। দুলাভাই অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে। আগে দুলাভাই সুস্থ হোক। তারপর গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবি। একা একা তোদের বাড়িতে রাখার রিস্ক আমি নেবনা। আর তাছাড়া অ্যাডমিশনের আগে তুই কোথাও যাস সেটা আমি চাইনা। অ্যাডমিশন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে, আমি তোদের গ্রামে রেখে আসব। ”

কুহু চাচার কথা বুঝতে পারছে। তিনি মনেপ্রাণে চাইছেন কুহু ভার্সিটিতে চান্স পাক। তাই নিজের কষ্ট মনে রেখেই কুহু চাচার কথায় রাজি হল। আর কিছুদিন মাত্র। এই বাড়িতে থাকার মেয়াদ দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। ও কোচিং-এর কয়েকজন স্যারকে বলে রেখেছে একটা বাসা দেখার জন্য। একটু নিরাপদ বাসা পেলেই ও এই ছাড়বে।

গভীর রজনী। নিস্তব্ধ চারপাশ। মাথার ওপর ফ্যানের শব্দ বৈ কোন আওয়াজ নেই চারপাশে। রুমের একটিমাত্র জানালার কাঁচ খুলে রেখেছে কুহু। আকাশে রুপালী চাঁদ আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে ধরনীকে। খোলা জানালা পেরিয়ে এক চিলতে আলো এসে আলোকিত করেছে জানালার পাশটা।
জানালার বাহিরে চোখ যেতেই কুহুর বুকের ভেতর দামামা বাজতে শুরু করল। ওর বাহিরে যেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। চাঁদের আলো গায়ে মাখার সাধ জেগেছে। কিন্তু ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দুইটা বিশ বাজছে। হাতে থাকা বই বন্ধ করে অপলক নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আকাশ পানে। এত রাতে বাহিরে যাওয়া ঠিক হবেনা ভেবে আবার বই খুলতেই বেজে উঠল মোবাইল। নৈশব্দকে ভেদ করে ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ রুমের ভেতর বজ্রের ন্যায় আছড়ে পরল। কুহু চমকে উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখল তাহমিদের নাম জ্বলজ্বল করছে। ও মৃদু হেসে ফোন রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন যে! ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কাউকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়, সে ভালো আছে কিনা। কিন্তু তুমি বেয়াদব মেয়ে আগেই আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছ? আর আমি সহজসরল মানুষ কিনা তোমার চিন্তা করছি! আজ আবারও প্রমানিত হল, দুনিয়ায় ভালো মানুষের মূল্য মেয়েরা দিতে জানেনা। ”

কুহু এতরাতে এসব কথা আশা করেনি। ও নিরাশ হয় তাহমিদের কথা শুনে।

” ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবেনা। আপনি কেমন আছেন? ” দাঁতে দাঁত পিষে বলল কুহু।

” এভাবে রেগে জিজ্ঞেস করছ কেন! ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলেই তবে উত্তর পাবে। আর যাইহোক আমিতো আর মেয়াদোত্তীর্ণ পাতা সেবনকারী নই যে আমার সম্মান ঠুনকো হয়ে গেছে। সমাজে আমি সম্মানিত ব্যাক্তি বুঝলে? তাই তুমিও আমাকে সম্মান দেবে। ”

এবার কুহু সত্যিই রেগে যায়। এই মুহুর্তে তাহমিদ ওর সামনে থাকলে নিশ্চয়ই কুহু তার মাথা ফাটাত।

” জনাব স্যার, আপনি কেমন আছেন? আপনার শরীর ভালোতো? আর আজেবাজে মেয়াদোত্তীর্ণ পাতা সেবন করবেননা। এসব পাতা স্বাস্থ্যের জন্য হানি কারক। এসব পাতা সেবন করলে বুদ্ধি লোপ পায়। ” অনেক কষ্টে স্বর নরম করে বলল কুহু।

” কি বললে তুমি? তুমি আমাকে সরাসরি গঞ্জিকাসেবী উপাধি দিচ্ছ? ননসেন্স, তোমার এতবড় দুঃসাহস! খালি একবার তোমাকে সামনে পাই। এই মেয়ে, এতরাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন? নিশ্চয়ই বাগানে যাওয়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করছে? ভুল করেও যদি রুম থেকে বেরিয়েছ, তবে আমি কালকেই রাজশাহী গিয়ে তোমার দুই পা ভেঙে ফেলব। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ রে’গে উঠল। ও রা’গ’কে প্রশমিত করতেই কুহুকে ঝাড়ি দিচ্ছে।

এই মুহূর্তে কুহু তাহমিদকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। কারন ও জানে তাহমিদ এসব মন থেকে বলছেনা। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এসব বলছে। কুহু তাহমিদকে আর একটু রাগিয়ে দেয়ার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারলোনা। ও নীরব হেসে আরেকবার মুখ খুলল,

” আমি এই মুহূর্তে বাগানেই দাঁড়িয়ে আছি। কতবড় চাঁদ উঠেছে দেখেছেন? ভাবছি আজ সারারাত এখানেই বসে কাটাব। তার ওপর আবার উপরি পাওনা হিসেবে পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায় একজনকে দেখতে পাচ্ছি। তার সাথে ইশারায় গল্প করতে মন্দ লাগবেনা। ”

কুহু ফোন কানে চেপে চোখ বন্ধ করে তাহমিদের ঝাড়ি শোনার অপেক্ষা করছে।

তাহমিদ কুহুর কথায় শিওর হয়ে যায় ও রুমেই আছে। আর যত যাই হয়ে যাক না কেন, পাশের বিল্ডিংয়ের কাউকে এখন বারান্দায় দেখলে মেয়েটা যে বাগানে থাকবেনা, এটা তাহমিদ ভালো করেই জানে। ও বুঝতে পারল, মেয়েটা ওকে একটু নাচাতে চাইছে। তাহমিদও কম যায়না। তার শ্যামাঙ্গীনি যখন একটু নাচাতে চাইছে, তবে ওর এখন নাচতে দোষ কোথায়? আর নাচাতেই বা সমস্যা কি। ও মুখ দিয়ে নিঃস্বাস ছেড়ে বলল,

” ভালো করে দেখ, বারান্দার ভদ্রলোক ইয়াং নাকি ওল্ড। ওল্ড হলে জমবেনা। রাত জেগে চোখাচোখি, ইশারা করতে হলে ইয়াং গাইজের প্রয়োজন। এইযে যেমন ধর আমি এই মুহূ্র্তে একটা অষ্টাদশী রমনীর কোলে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করছি। এর মজা কি আমি কোন বয়োবৃদ্ধা নারীতে পাব? তুমি চাইলে তাকে ডেকে বয়স জেনে নিতে পার। তারাতারি তার বয়স জেনে নাও। হারি আপ। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কোঠর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কি বলছে এই লোকটা! সে অন্য নারীর কোলে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করছে! বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারলোনা, ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা ওর সাথে মজা করছে। হঠাৎই ওর কান্না পায়। কিন্তু ও প্রতিজ্ঞা করল কাঁদবেনা। নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করবেনা। ফোন কানে চেপে রেখে নিশ্চুপ থাকল।
এতটুকুতেই তাহমিদ যা বোঝার বুঝে গেছে।

” তার সাথে ইশারায় কথা বলা হলে আমাকে একটু সময় দেবে? আমার অষ্টাদশী রমনীও যে চাঁদের আলোয় মিশে গেছে। কেবল শ্যামাঙ্গীনি কথা বললেই কেবল সে আবার আবির্ভূত হবে। আবার তার কোলে মাথা রাখব আমি, তার বাহুডোরে নিজেকে সমর্পন করব। কাকতালীয়ভাবে আমার শ্যামাঙ্গীনির সাথে এই অষ্টাদশীর ভিষণ মিল খুঁজে পাই। ”

” আপনি আসলেই খুব খারাপ মানুষ। আপনার সাথে আর কথা নেই। বদের হাড্ডি একটা। ”

কুহু ফোন কেটে দিয়ে হাসল। ও তাহমিদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছে,মানুষটা ওর সাথে মজা নিয়েছে।

কয়েক সেকেন্ড পর আবারও ফোন বেজে উঠল। কুহু দ্বিতীয়বার না ভেবেই রিসিভ করল।

” আমি এই রাতে মাটিতে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি, আর তুমি আমাকে বদের হাড্ডি বললে! আমি জানতাম আজ তোমার মন বাগানে যেতে উস্কানি দেবে। তাই ভাবলাম তোমাকে সঙ্গ দেই। আর তুমি হিটলারের নাতনি কিনা আমাকে বদ বলছ! এখন থেকে দেখছি মেয়াদোত্তীর্ণ পাতাই সেবন করতে হবে, তা-ও যদি কারও কাছে ভালো হতে পারি। তাহমিদ তুই ভালো থাকতে চাইলে কি হবে, কেউ একজন তোর ভালো সহ্য করতে পারেনা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। এই মুহূর্তে ওর মন থেকে সব দুশ্চিন্তা আর নায়লা আঞ্জুমের অপমানগুলো উবে গেছে।

তাহমিদ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মুগ্ধ হয়ে কুহুর হাসি অনুভব করছে। মেয়েটার হাসির ঝংকারে ওর তনু-মন ভালোলাগায় ছেয়ে যায়।

” এভাবে হেসোনা শ্যামাঙ্গীনি। তোমার হাসিমাখা মুখ না দেখতে পেরে আমার হিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। সে আমার বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। সে তোমার মাঝে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিতে তৎপর হয়েছে। আমি এক অসহায় , নিঃস্ব মানুষ। যে তার শ্যামাঙ্গীকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে এই প্রেমপূর্ণ হিয়াকে জোর করে নিজের কাছে বেঁধে রেখেছিল। এখন যদি সে-ও উড়াল দেয় তবে আমি বাঁচব কি নিয়ে? আমার বাঁচা-ম’রা সব শ্যামাঙ্গীনির হাতে। ”

তাহমিদের কথা শোনামাত্রই কুহুর হাসি থেমে যায়। ওর আঁখি পূর্ণ হয় সুখের অশ্রুতে। সুখপাখি অবশেষে কি তার কাছে ধরা দিয়েছে! সে কি এবার পূর্ণ হতে চলেছে মানুষটার প্রেমের ছায়ায়?

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী

কোচিং-এ ঢোকার সময় ছোট চাচাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে কুহু। সাইদ আহমেদ কোচিং-এর গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কুহু চাচাকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলল। চাচার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” আসসালামু আলাইকুম, চাচা। তুমি এখানে? কেমন আছো তুমি? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি ভালো আছি, মা। তুই কেমন আছিস? আর সৃজন ওর কি খবর? ”

” আমরা ভালো আছি, চাচা। কিন্তু তুমি বাসায় না গিয়ে এখানে এসেছ কেন? চাচি, সাদমান আর সিহা কেমন আছে? ”

” ওরা সবাই ভালো আছে। আমি ব্যাংকের কাজে রাজশাহী এসেছিলাম। তারাতারি কাজ শেষ হওয়ায় ভাবলাম তোদের সাথে দেখা করে যাই। বাসায় গেলে দেরি হয়ে যাবে, তাই এখানেই আসলাম। ”

কুহু বুঝল ওর চাচা ঐ বাসায় যেতে চায়না। তাই এমন বাহানা দিচ্ছেন।

সাইদ আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ কুহুর সাথে কথা বললেন। তিনি সৃজনের সাথে দেখা করতে ওর কোচিং-এ যাবেন। তারপর তিনি গ্রামে ফিরবেন। যাবার আগে তিনি কুহুর হাতে কয়েকটা প্যাকেট দিলেন। তিনি ছেলেমেয়েদের জন্য ফলমূল এনেছেন। কুহু হাসিমুখে প্যাকেটগুলো হাতে নেয়। এরপর তিনি কুহুকে টাকা দিতে গেলেই, কুহু নিমরাজি হয়ে মানা করে দেয়। কিন্তু সাইদ আহমেদ ভাতিজীর কোন কথাই শুনলেননা। তিনি জোর করে কুহুর হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। তার গন্তব্য এখন সৃজনের কোচিং।

কুহু নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে আবার নিজের পড়াশোনাও মন দিয়ে করছে। মাঝেমধ্যেই নায়লা আঞ্জুম ওকে দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। কুহু কোন প্রত্যুত্তর না করে নীরবে চোখ ঝরায়।

আরও কিছুদিন কেটে যায়। আর চারদিন পরই কুহুর অ্যাডমিশন। ও কোমড় বেঁধে পড়াশোনা করছে। খালা ওকে রান্নাঘরে যেতে দিচ্ছেনননা কয়েকদিন আগে থেকেই। তাই কুহু পড়াশোনার যথেষ্ট সময় পাচ্ছে। তাহমিদও নিয়মিত ওর সাথে ফোনে কথা বলছে। বড় ফুপু, ছোট চাচা প্রতিদিনই ফোন করে ওদের খোঁজ নেয়। কিন্তু কুহু আশ্চর্য হয়ে যায়, এতদিনে একবারও ছোট ফুপু ওদের কোনও খোঁজ নেয়নি! কুহু দু-একবার তাকে ফোন দিয়েছে, কিন্তু সে রিসিভ করেনি। কুহু ভাবে যখন ওর বাবা সুস্থ ছিল, ওদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল, তখন ছোট ফুপু ঠিকই ওদের খোঁজ নিত। বাবাও তাকে দুহাত ভরে জিনিসপত্র দিত। ওদের দুই ভাইবোনকেও ছোট ফুপু কতকিছু দিত। আজ কুহু সম্পর্কের সমীকরণ বুঝতে শিখেছে। ও বুঝে গেছে, স্বার্থপরেরা সম্পর্ক বলতে শুধু টাকাকেই বুঝে। টাকা আর অর্থ সম্পদকেই তারা প্রাধান্য দেয়। তাদের কাছে টাকা, অর্থসম্পদই সম্পর্কের চাবিকাঠি। এসব ভাবলে কুহুর হাসি পায়। কত সহজে মানুষ তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়!

তাহমিদ বারবার কুহুকে অভয় দিচ্ছে। কুহু অ্যাডমিশন নিয়ে বেশ চিন্তায়ই আছে। তাহমিদের সান্তনা বাণী ওকে স্থিরতা এনে দিতে পারছেনা।

ফজরের নামাজ আদায় করে বই নিয়ে বসেছে কুহু। আজকে থেকে অ্যাডমিশন শুরু। চিন্তায় ওর বুক শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পড়ে বই বন্ধ করে, বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এখন ওর ঘুমালে চলবেনা। আবার বই হাতে নিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনে তাকিয়ে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার অবস্থা কি? বেশি চিন্তা হচ্ছে? ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল।

” হুম। ”

” চিন্তার কিছুই নেই। দেখবে ভালোভাবে উৎরে যাবে। মনকে এখন চিন্তামুক্ত রাখ। প্রথমে এক কাপ কড়া লিকারের চা পান কর। তবে অবশ্যই খালি পেটে নয়। আগে হালকা কিছু খেয়ে নিবে। ভার্সিটিতে তুমি কি একা যাবে? নাকি তালুকদার সাহেব তোমার সাথে যাবে? ”

” চাচা যাবে আমার সাথে। ”

” এখন আর কোন কথা নয়। তুমি খালার কাছে যাও। আমি কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দেব। ”

তাহমিদ ফোন কাটতেই রাজিয়া খালা ট্রে-তে করে একটা সেদ্ধ ডিম, কয়েক টুকরা আপেল আর এক কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে রুমে হাজির হলেন। খালার কান্ড দেখে কুহুর চোখ কপালে উঠল। এই মানুষটা ওর জন্য যা করছে তা নিজের আত্মীয়রাও করেনা। তিনি নিজের টাকা খরচ করে ডিম এনেছেন, দুধ কিনছেন। এসব শুধু তিনি কুহুর জন্য করছেন। কুহু এসব খেতে না চাইলেও তিনি প্রতিদিন এসব জোর করে কুহুকে খাওয়াচ্ছেন।

বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তাহমিদ আরেকবার ফোন করল। কুহু রিসিভ করতেই ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাহমিদ কথা বলল,

” টেনশন ফ্রি থাকবে। মনে রাখবে, আজ থেকে তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে পা বাড়াচ্ছ। আজকে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখবে তুমি। যা তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম ধাপের অর্জনই তোমাকে শেষ অব্দি নিয়ে যাবে। পৌঁছে দেবে সিঁড়ির শেষ ধাপে। যেখান থেকে তুমি অনায়াসেই তোমার স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে। মনে থাকবে? ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর মনে সাহস সঞ্চার হয়। এই মানুষটা ওকে কতভাবে সাহস দিচ্ছে ভাবতেই ওর ভালো লাগছে। এমন একটা মানুষের স্বপ্ন দেখে সব মেয়েরাই।

” এই যে মেয়ে, কোথায় হারালে? ”

তাহমিদের ডাকে চমকে উঠে কুহু। চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। মৃদু হেসে কোমল স্বরে বলল,

” বাসায়ই আছি। কোথাও হারাইনি। আপনার কথা মাথায় রাখব। কোন টেনশন করবনা। ”

” গুড গার্ল। এবার বেরিয়ে পর। নইলে দেরি হয়ে যাবে। বেস্ট অফ লাক। ”

” ধন্যবাদ। ”

কুহু ফোন কেটে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

কুহু ড্রয়িংরুমে বসে অঝোরে কাঁদছে। ওর পাশে খালা হাসিমুখে বসে আছেন। রায়হান আহমেদ ফোনে ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন। সাইদ আহমেদের সাথে কথা শেষ করে তিনি ফোন করলেন বড় বোনকে।

রিশা, সৃজন, নিশো কুহুর সামনের সোফায় বসে মনযোগ দিয়ে ওর কান্না দেখছে। সৃজন ভাবছে, আপু বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে তবুও কাঁদছে কেন! নিশোও একই কথা ভাবছে।

” মাগো, এবার কান্না থামা। এভাবে কাঁদলে চলবে? আজকে তোর আনন্দ করার সময়। কত কষ্ট করেছিস এতদিন। আজ আর কাঁদিসনা, মা। ” রায়হান আহমেদ সস্নেহে কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

” ও মা, এবার চোখ মুইছা লও। এম্নে কাঁন্দেনা। তুমি গিয়া তোমার নানিমারে খুশির সংবাদ দিয়া আসো। সে শুইনা খুব খুশি হইব। ”

” কুহুপু, তুমি কেমিস্ট্রিতে পড়বে! ওয়াও। কনগ্রেচুলেশনস আপু। তুমি পেরেছ। এবার কান্না থামিয়ে আমাদের নিয়ে বাহিরে চল। আজকে আমরা চার ভাইবোন মিলে ফুচকা খাব। তোমার কোন বারণই শুনবনা। এক্ষুণি চল। ”

রিশা কুহুকে টেনে তুলল। আজকে কুহু ওদেরকে না করলনা। তৈরী হয়ে ভাইবোনদের নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে গেল।

কুহু অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে। সৃজন ঘুমিয়েছে। খালাও নিচে বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। কুহু ওর হাতে থাকা ফোনের বারবার তাকাচ্ছে। আজ সারাদিন মানুষটা ওকে ফোন করেনি। কুহু তাকে কখনোই ফোন করেনা। সে কখন ক্লাসে থাকে কিংবা কাজে ব্যস্ত থাকে, তা কুহু কিছুই জানেনা। তাই ও তাহমিদকে ফোন করে বিরক্ত করেনা। কিন্তু আজকে কুহুর মন কোন বারণ মানছেনা। বারবার তাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে। মনকে বশ মানাতে না পেরে রাত এগারোটা দশে ও তাহমিদকে ফোন করল। কিন্তু ওর মন খারাপ করে দিয়ে দুইবার বাজতেই ফোন কেটে যায়।

অবশেষে কুহুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোন বাজল রাত বারোটা পঁচিশে। কুহু তখনও ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল। একবার ফোন বাজতেই কুহু রিসিভ করল। আর সাথে সাথেই ওকে তাহমিদের খোঁ’চা’র সম্মুখীন হতে হলো।

” কি ব্যাপার, ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলে নাকি! আজকাল বুঝি ফোনই তোমার ধ্যান জ্ঞান হয়েছে? নাকি আমার সাথে কথা বলার তর সইছিলনা? ”

কুহু আজ তাহমিদের কোন খোঁ’চা গায়ে মাখলনা। সে সরাসরি তাহমিদকে জিজ্ঞেস করল,

” আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আপনি শুনেছেন? ”

” নাহ্। তুমি কি আমাকে বলেছ যে আমি শুনব। ” তাহমিদ অকপটে মিথ্যা বলল। অথচ ও আগেই কুহুর রেজাল্ট জেনেছে।

” আপনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, তাই আমি ফোন দেইনি। আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ” কুহু ম্লান গলায় বলল।

” কনগ্রেচুলেশন, ফিউচার কেমিস্ট। তুমি সিঁড়ির প্রথম ধাপ পেরিয়ে দ্বিতীয় ধাপে সফলভাবে পদার্পন করেছ। আশা করব সামনে এভাবেই সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ দৃঢ় পদক্ষেপে পেরিয়ে যাবে। ”

” আপনি জানেন, আমি কেমিস্ট্রিতে চান্স পেয়েছি! তবে যে বললেন, জানেননা? ” কুহুর গলায় বিস্ময় খেলে যায়।

” আমি আরও অনেক কিছুই জানি। এখানেও তুমি সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছ। আরেকবার শুভকামনা রইল তোমার জন্য। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে হাসল।

ভর্তির ঝামেলা মিটিয়ে কুহু চাচার কাছে বায়না করল গ্রামে যাওয়ার। রায়হান আহমেদও রাজি হলেন। তবে তিনি এখন গ্রামে যেতে পারবেননা। তাই নিজের গাড়িতে করে সৃজন আর কুহুকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। তার আগে অবশ্য তিনি বড় বোনকে ফোন করে গ্রামে যেতে বলেছেন। সোহানী পারভিনের স্বামী আগের থেকে সুস্থ থাকায়, তিনিও ভাইয়ের ফোন পেয়ে দেরি না করে গ্রামে চলে যান।

গাড়ি থেকে নেমে কুহু তাকিয়ে থাকল তার অতি প্রিয় বাড়িটার দিকে। এই যে ওর প্রিয় অঙ্গন। যেখানে কেটেছে ওর শৈশব, কৈশোর। এখানেই একসময় রচিত হয়েছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। এই প্রিয়াঙ্গনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কত মায়া, ভালোবাসা। আজ কতদিন পর ও পা রাখছে ওর এই ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকা প্রিয়াঙ্গনে।

সোহানী পারভিন কুহুকে দেখে দৌড়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন কুহুর চোখেমুখে। সৃজনও বাদ গেলনা।

তিনদিন গ্রামে কেটে যায়। সাইদ আহমেদ প্রতিদিন কুহুদের সাথে দেখা করেছেন। তিনি বাজার করে দিয়েছেন বোনের কাছে। শিরিন এই কয়দিনে একবারও এদিকে পা মাড়ায়নি। কুহু গিয়েছিল তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু শিরিন তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। সে এক প্রকার অবহেলাই করেছে ওকে। তাই কুহুও আর তাকে বিরক্ত করতে ও বাড়িতে যায়নি।

প্রায় তিনমাসের বেশি সময় পর তাহমিদ রাজশাহী এসেছে। ও জানত কুহুরা গ্রামে গেছে। তাই বাসায় ওদেরকে না দেখে অবাক হয়না। ও বাসায় ঢুকে রাজিয়া খালার সাথে কথা বলে নিজের রুমে যায়।

” ভাইয়া, তুমি কখন এসেছ? ” রিশা স্কুল থেকে এসে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” দুই ঘন্টা আগে এসেছি। তোর কি অবস্থা? পড়াশোনা কেমন চলছে? এসএসসি পরীক্ষার তো আর দেরি নেই। নিশো আসবে কখন? ”

” আমার পড়াশোনা ভালোই চলছে। নিশোর আসতে দেরি হবে। জানো ভাইয়া, আমরা কাল গ্রামে যাচ্ছি। সেখানে এবার গিয়ে দুইদিন থাকব। তুমি যখন এসেছ, এবার কিন্তু আমাদের সাথে তোমাকে গ্রামে যেতে হবে। তোমার কোন কথাই শুনবনা। ” তাহমিদ রিশার কথার উত্তর না দিয়ে নানিমার কাছে যায়।

পরদিন রায়হান আহমেদের জোড়াজুড়িতে তাহমিদকে তাদের সাথে গ্রামে যেতে হল। তাহমিদের মনটা আজ বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। কতদিন পর সে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখবে। কতদিন ও মেয়েটার চোখের গভীরতায় হারায়না। মেয়েটার হাসির ঝংকারে হৃদয় ভেজায়না। আজ ওর বহুদিনের পিপাসিত নয়ন তৃষ্ণা মেটাবে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখে। ওর শুকনো হিয়ায় এক পশলা বৃষ্টি নামবে তার শ্যামাঙ্গীনিকে দেখে।

গাড়ির শব্দ পেয়ে সৃজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কুহু ফুপুর সাথে রান্নাঘরে ছিল। সে-ও গাড়ির শব্দ পেয়ে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সাথে সাথেই ও থমকে যায় সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে। কতদিন পর তাকে দেখছে। অফ হোয়াইট টি-শার্ট আর কালো জিন্স পরিহিত সুদর্শন যুবকটি ওর দিকেই নিনির্মেষ চেয়ে রয়েছে। তার চোখে একরাশ মুগ্ধতা। কিছুক্ষণের জন্য কুহুর হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। শরীর-মন জুড়ে দোলা দেয় মৃদুমন্দ মলয়। সুশীতল মলয়ে প্রনয়ের ঘ্রান স্পষ্ট।
ধুকপুক বুকে কুহু এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। সামনের মানুষটা নয়ন বিচরণ করছে ওর মুখাবয়বে। কুহুর ভয় হচ্ছে, এই বুঝি চাচার সামনে ধরা পরে যায়। কিন্তু ওর নয়নও যেন আজ বাঁধা মানছেনা। বারবার দেখতে চাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষকে। যেন কতদিন ওর আঁখিদ্বয়ে তাকে না দেখার তৃষ্ণা।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে