প্রিয়াঙ্গন পর্ব-২৩+২৪

0
570

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” সাবধানে চলাফেরা করবে। রিক্সাওয়ালা চাচার সাথেই কেবল কোচিং-এ যাবে। কালকেই তোমার রেজাল্ট দেবে। চিন্তা করবেনা একদম। রেজাল্ট যেটা আসবে, সেটাই মেনে নিয়ে মন দিয়ে এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেবে। ” তাহমিদ ড্রইংরুমে বসে কুহুর সাথে কথা বলছে। ওর পাশে খালাও বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাহমিদ রওনা দেবে। আগেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।

” বাপজান, আজকে রাতটা থাইকা গেলেই পারতা। কুহু মা’য়ের রেজাল্ট কি হয় শুইনাই যাইতা? ”

” না খালা, কালকে এগারোটার মধ্যে আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। কযেকটা ইমারজেন্সি কাজ পরে গেছে। কয়েক জায়গায় এ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম। সেসব জায়গা থেকে ডাক এসেছে। নয়তো কালকে থেকেই যেতাম। ”

” আচ্ছা, তোমার যেইটা ভালো মনে হয়, সেইটাই কইরো। তবে কাহ শেষ হইলে আইসা পরবা। দেরি করবানা কিন্তু। ”

” খালা, তোমার মা’কে দেখে রেখ। পড়াশোনায় যেন ফাঁকি দিতে না পারে, সেটা দেখবে। ”

তাহমিদ খালার সাথে কথা বলছে দেখে কুহু রুমে যায়। খালার সাথে তার কোন জরুরী কথা থাকতেই পারে। তাই ড্রয়িংরুমে থাকলনা মেয়েটা।

” খালা, এই টাকাগুলো রাখ। কুহুকে দিলে ও কিছুতেই নিবেনা। ওর, সৃজনের যেকোন প্রয়োজনে টাকাগুলো ওদের দিবে। নিজের প্রয়োজনেও খরচ করবে। ”

” বাপজান, আমার কাছে টাকা আছে। তোমার দেওন লাগবোনা। কুহু মা’য়ের টাকার দরকার পরলে আমি তাকে টাকা দিমুনে। ”

” তোমার টাকা যত্ন করে রেখে দাও। যখন কোন ইমারজেন্সি পরবে, তখন খরচ করো। এখন টাকাগুলো লুকিয়ে রাখ। কুহু যেন কিছুতেই দেখতে না পায়। আর শোন, নায়লা আঞ্জুমের কথা থেকে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখ। সে যেন কুহুকে কোন আজেবাজে কথা বলতে না পারে। ”

” তুমি এত চিন্তা কইরোনাতো, বাপজান। তারে যখন আমি মা ডাকছি, তখন তারে দেইখা রাখার দ্বায়িত্বও আমার। তোমার বাস কয়টায়? ”

” সাড়ে বারোটায়। আমি বারোটায় বের হব। আর দশ মিনিট আছি। তুমি একবার ওকে ডাকবে, খালা? ”

তাহমিদের কথা শুনে খালা কুহুকে ডাকলেন। কুহু ড্রয়িংরুমে আসতেই খালা রান্নাঘরে গেলেন কাজের ছুঁতোয়।

” সৃজনকে বাহিরে যেতে দিওনা। এই মহল্লার কয়েকজন উঠতি বয়সী ছেলে আছে, যারা খুবই খারাপ। ওদের সাথে যেন ও মিশতে না পারে। স্কুল, কোচিং ছাড়া ওকে বাহিরে থাকতে দিওনা। যদিও আমি ওকে বলে দিয়েছি। তারপরও তুমি একবার বল। ”

” ঠিক আছে। আমি ওকে বলে দেব। আপনি সাবধানে থাকবেন। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবেন। কাজ না থাকলে অযথাই বাহিরে থাকবেননা। ” কুহু মৃদুস্বরে বলল।

তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে হাসল। মেয়েটা বরাবরের মত মাথা নিচু করে বসে আছে। তবে অন্যদিনের মত আজ মাথায় ওড়না নেই। ওর লম্বা কেশরাশি পিঠে লুটোপুটি করছে। পেলব আঁখিপল্লবে মাঝে মধ্যে এসে আছড়ে পরছে কিছু অবাধ্য ছন্নছাড়া মেঘবরণ কেশরাশি। মেয়েটা ওদেরকে মৃদু হাতে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই ওরা আবারও হানা দিচ্ছে।

” একবার মুখ তুলে চাইবেনা? আড়াই মাস দেখবোনা ঐ স্নিগ্ধ মায়ায় জড়ানো মুখখানি। অন্তত দশটা মিনিট এই কুসুমের ন্যায় প্রস্ফুটিত মুখখানি দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটাই। চোখের তারায় এঁকে নিই ঐ মুখাবয়বের প্রতিটা বিন্দু। যাতে আগামী আড়াই মাস নিজের মনকে লাগাম দিতে পারি। প্রবোধ দিতে পারি নিজের মনকে। ”

তাহমিদের আদুরে গলা শুনে কুহুর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওর চোখের কোনে জমেছে বিরহের অশ্রু। সত্যিই মানুষটা অনেকদিন এমুখো হবেনা? ওর দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবেনা? কিংবা সময়ে-অসময়ে ছুটে আসবেনা ওর বিপদে!

” তাকাবেনা আমার দিকে? অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই কি আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে! নাকি তুমি চাইছ আমি এখানে আর না আসি? ”

তাহমিদের এহেন কথায় কুহু এক ঝটকায় মাথা তুলে তাকায়। চোখ রাখে তাহমিদের চোখে। মেয়েটার চোখে টলমল করছে অশ্রকনারা। যে কোন মুহূর্তে তারা টুপ করে ঝরে পরবে।

তাহমিদ কিছুই না বলে তাকিয়ে থাকল ঐ কাজল দীঘির জলে। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে জলের অতল তলে। আজ কিছু অবাধ্য ইচ্ছেরা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে তাহমিদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ও নিজের সামনে বসা মেয়েটার মন জিততে চায়।

” বারোটা বেজে গেছে। এবার আমাকে বেড়োতে হবে। তুমি সাবধানে থাকবে। কোন সমস্যা হলে খালাকে জানাবে। খালা, আমি বেড়োব। ”

তাহমিদের ডাক শুনে খালা বেরিয়ে আসলেন রান্নাঘর থেকে। চোখের জলে বিদায় দিলেন সন্তানসম তাহমিদকে।

কুহু দরজায় দাঁড়িয়ে তাহমিদের চলে যাওয়া দেখল। মানুষটা যেতে যতে কয়েকবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে।

পরদিন সকাল থেকেই কুহু মনমরা হয়ে আছে। আজকে ওর রেজাল্ট দেবে। সকালেই বড় ফুপু একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। ছোট চাচাও ফোন দিয়েছেন। তারা বারবার কুহুকে সাহস জুগিয়েছেন। এমনকি রায়হান আহমেদও অফিসে যাওয়ার সময় কুহুকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছেন। খালাও একটু পরপর কুহুকে এটাসেটা বলছেন। তিনি মেয়েটার মন ভালো করতে অনেক কিছুই করছেন।

তাহমিদ কিছুক্ষণ আগেই খালার সাথে কথা বলেছে। সে অনেক আগেই বাসায় পৌঁছেছে। বাসায় পৌঁছেই সে খালাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। তারপর দুইবার খালাকে ফোন করে কথা বলেছে। কিন্তু কুহুর সাথে একবারও কথা বলেনি।

ড্রয়িং রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে কুহু। মেজো চাচা ফোন করে জানিয়েছেন তিনি রেজাল্ট শুনে বাসায় জানিয়ে দেবেন। রেজাল্ট আউট হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখনো কুহুর কাছে রেজাল্ট আসেনি। ওর কাছে স্মার্ট ফোন নেই তাই অনলাইনে খবরও নিতে পারছেনা। রিশা স্কুলে গেছে। ওর ফোনও এখন নিতে পারবেনা। অবশ্য ও স্কুলে যাওয়ার সময় কুহুর কাছে ফোন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কুহু নায়লা আঞ্জুমের কথা ভেবে রিশার কাছ ফোন নেয়নি।

অনেকক্ষণ পর রাজিয়া খালার ফোন বেজে উঠল। খালা কাজের ফাঁকেই ফোন রিসিভ করলেন। খালার কথা শুনে কুহু বুঝতে পারল তাহমিদ ফোন দিয়েছে।

” কুহু মা, বাপজান তোমার সাথে কথা বলবে। ধর কথা কও। ”

কুহু কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে কানে ঠেকায়।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কাছে কেউ আছে? থাকলে তার কাছে টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাও। আর পছন্দের মিষ্টি কিনে আনতে বল। এরপর পেট পুরে সেগুলো খাও। আমি রাজশাহী থাকলে মিষ্টি কেনার দ্বায়িত্ব আমিই নিতাম। এবং খেতামও আমিই। ”

তাহমিদের উদ্ভট কথা শুনে কুহুর চোখ কপালে উঠল। এই লোকটা সব সময়ই এমন হেয়ালি করে কথা বলে কেন!

” আমি মিষ্টি খাব কেন? মিষ্টি খেতে আমার ভালো লাগেনা। ”

” ভালো না লাগলেও খেতে হবে। শুধু আজকের জন্য। জেলার টপার বলে কথা! বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়! এমন রেজাল্ট করলে মিষ্টির দোকান কাছে এসে বলবে, আমাদের খাচ্ছেননা কেন ম্যাম? ”

তাহমিদের কথা বলতে কুহুর মনে হচ্ছে ও মাথা ঘুরে পরে যাবে।

” আপনি সত্যি বলছেন? আমার রেজাল্ট আপনি জানতে পেরেছেন? কিন্তু কিভাবে? আমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর পেলেন কোথায় থেকে! ”

” শোন মেয়ে, আমি জীবনে খুব কমই মিথ্যা বলেছি। লাস্ট মিথ্যা বলেছি গত দুইদিন আগে। তা-ও তোমার জন্য। আর রইল তোমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর। সেটা আমি তুড়ি মেরে জোগাড় করেছি। এবার খালাকে, নানিমাকে গিয়ে রেজাল্ট জানিয়ে এস। আমি রাখছি। ”

তাহমিদ ফোন রাখলে কুহু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ও তাহমিদের কথা বিশ্বাস করবে কিনা সেটা ভেবে পাচ্ছেনা। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ এই বিষয় নিয়ে ওর সাথে মজা করবেনা। কিন্তু ও এত ভালো রেজাল্ট করেছে সেটা ভাবতে পারছেনা।

ওর ভাবনার মাঝেই বেজে উঠল ফোন। কুহু দেখল মেজো চাচা ফোন দিয়েছে।

কুহু ফোন রিসিভ প্রথমেই চাচাকে সালাম দিল।

” কুহু মা, তুই একবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস। জেলায় টপার হয়েছিস। আর বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়। আমরা সবাই তোর এই রেজাল্টে ভিষন খুশি হয়েছি। দোয়া করি জীবনে অনেক বড় হ, মা। ” রায়হান আহমেদ খুশিতে কেঁদে দিলেন।

আজ সারাদিন কুহুর ফোন রিসিভ করেই কাটল। বিকেলে কোচিং-এ গিয়ে রেজাল্টের কথা বলতেই সবাই খুশি হয়। সজল কোচিং-এ এসেছে কুহুর সাথে দেখা করতে। তার সাথে মায়াও আছে।

কুহু এখানে সজল আর মায়াকে আশা করেনি। ও ওদের দুজনকে একসাথে দেখে অবাক হয়ে গেছে। মায়া এসে জড়িয়ে ধরল কুহুকে।

” কনগ্রেচুলেশন কুহু। তোমার রেজাল্ট শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেও বোঝা যায়না, তোমার মাথায় এত বুদ্ধি। এমনিতেই তাহমিদ তোমাকে ছুপা রুস্তম বলেনা। এই নাও তোমার জন্য চকলেট এনেছি। তুমি তো আবার মিষ্টি খাওনা। তাই কয়েকরকম চকলেট এনেছি। এগুলো খেতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? ”

কুহু মায়ার কথা শুনে বুঝল ওর মিষ্টি না খাওয়ার কথা নিশ্চয়ই তাহমিদ মায়া আপুকে বলেছে। অজান্তেই কুহুর ঠোঁটে খেলে যায় হাসির রেখা। লোকটা পারেও।

কুহু হাসিমুখে মায়ার কাছ থেকে চকলেটের প্যাকেট নিল।

পরদিন বিকেলে কোচিং-এ ক্লাস করছে কুহু। ক্লাসের মাঝেই ওর ফোন বেজে উঠল। কুহু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল আননোন নম্বর। অচেনা নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করলনা। পরপর দুইবার বাজল ফোন। কিন্তু ও রিসিভ করলনা।
কিছুক্ষণ পর টুং শব্দ করে ম্যাসেজ আসল। পরপর তিনটা ম্যাসেজ আসল। কুহু কৌতুহলবশত ম্যাসেজ ওপেন করল। সেই অচেনা নম্বর থেকেই ম্যাসেজ এসেছে। কুহু ভ্রু কুঁচকে ম্যাসেজগুলো পড়তে শুরু করল।

” এইযে মেয়ে, আমি একটা অসহায় মানুষ কতবার ফোন করলাম। কিন্তু তুমি ভীতু কুমারী রিসিভ করছনা। ”

” ফোন রিসিভ কর, মেয়ে। নইলে আমি রাতেই রাজশাহী এসে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। ”

” এই বেয়াদব মেয়ে, ফোন রিসিভ কর। তোমার ভাগ্য ভালো আমি তোমার সামনে নেই। এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে ঠাঁটিয়ে থা’প্প’ড় মা’র’তে। ”

ম্যাসেজগুলো পড়তে পড়তেই কুহুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। তাহমিদ যে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে এটা বুঝতে ওর বেগ পেতে হলোনা। তখনই আরেকবার ফোন বেজে উঠল। সেই নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। শুকরিয়া চিনতে পারার জন্য। ”

কুহু উত্তর না দিয়ে হাসল।

” এবার টিচারকে বলে একটু বাহিরে যাও। দেখবে একটা পার্সেল নিয়ে বাহিরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সোজা গিয়ে পার্সেলটা রিসিভ কর। ”

” পার্সেল! কিসের পার্সেল? ”

” কথা কম বল। আর বাহিরে যাও। এক সেকেন্ড দেরি করলে তোমার কপালে খারাবি আছে। ” কুহু তাহমিদের ধমকে ভয় না পেয়ে বসেই রইল।

” আগে বলুন কিসের পার্সেল। তবেই আমি বাহিরে যাব। ”

” তোমার বিয়ের দেনমোহর আছে। খুশি? এবার যাও। ”

ক্লাসের কয়েকজন কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। এমনকি স্যারও তাকিয়ে আছে। কুহু আর কথা না বাড়িয়ে স্যারকে বলে বাহিরে যায়।

ক্লাসে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কুহু। এতবড় পার্সেল নিয়ে বাসায় যাওয়া অসম্ভব। চাচি দেখলে ওকে আস্ত রাখবেনা। প্যার্সেল খুলে দেখল প্রায় পঞ্চাশটা বই, থ্রি পিস আর সৃজনের জন্য টি-শার্ট, প্যান্ট। কুহু আর কিছু ভাবতে পারছেনা।

সমস্যার সমাধান দিল তাহমিদ। ও বইগুলো কোচিং-এ রেখে যেতে বলল। কাপড়গুলো ব্যাগে তুলতে বলে দিল। কুহু তাহমিদের কথামত কাজ করল। কোচিং-এ বই রাখতে কোনও সমস্যা হলোনা। কয়েকদিনে ও বইগুলো বাসায় নিয়ে যাবে।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন। কুহু নিয়মিত কোচিং-এ যাচ্ছে, বাসায় মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। রিক্সাওয়ালা চাচা প্রতিদিন সময়মত এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে
আবার ক্লাস শেষ করে বাহিরে এসেই চাচাকে দেখতে পায়। প্রতিদিন ওকে নিয়ে যাওয়াআসা করলেও সে একদিনও কুহুর কাছ থেকে ভাড়া নেয়না। কুহু জোর করে ভাড়া দিতে চাইলে সে বলে, ” আপনার কাছে থেকে টাকা নেয়া বারন আছে, মা। আব্বা বিশ্বাস করে আপনাকে পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে চাই। ”
এই কথা শোনার পর কুহু আর কিছু বলতে পারেনা।

তাহমিদ প্রতিদিনই খালার কাছে ফোন দিয়ে কথা বলে। তবে কুহুর সাথে প্রতিদিন কথা বলেনা। দুই-তিন পর কুহুকে ফোন করে। তাও আবার রাত এগারোটার পর। ফোন করে সে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেনা। এতে অবশ্য কুহুর মোটেও খারাপ লাগেনা। কারন ও জানে, তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের জন্যই ওকে সব সময় ফোন করেনা। নায়লা আঞ্জুম জানতে পারলে বিষয়টা অনেক দূর গড়াবে।

কুহু প্রতিদিনের ন্যায় কোচিং-এ এসেছে। এখনো ক্লাস শুরু হয়নি।

” কুহু, একটু অফিসে এস। তোমার সাথে দরকারী কথা আছে। ” কোচিং-এর ফিজিক্সের টিচার এসে কুহুকে ডাকলেন।

কুহু স্যারের কথা শোনার জন্য অফিসে যায়।

” আসব স্যার? ” দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইল কুহু।

” এস। ”

কুহু ভেতরে আসলে স্যার আবারও কথা বললেন,

” কুহু, তুমি টিউশনির ব্যাপারে আমাকে বলেছিলে। আমি কয়েক জায়গায় কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন কেউই সাড়া দেয়নি। কিন্তু এখন তাদেরকে যখন তোমার রেজাল্টের কথা বললাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন চেয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের তুমি পড়াও। এছাড়াও দুইটা কোচিং-ও চেয়েছে, তুমি তাদের সাথে কাজ কর। এজন্য অবশ্য তারা তোমার প্রাপ্য বেতন দিতে রাজি আছে। এখন তুমি কি করবে, সেটা ভেবে দেখ। ”

স্যারের কথা শুনে কুহু হাঁফ ছাড়ল। ও খুব করে চেয়েছিল যেন দুই-একটা টিউশনি পায়। এতে ওর সুবিধা হত।

” স্যার, আমি কালকেই আপনাকে জানাব। এই এলাকার ভেতর কোচিং কিংবা টিউশনি যাই হোকনা কেন আমি করব। ”

কুহু স্যারের কাছ থেকে কোচিং আর যেখানে ছাত্র পড়াতে হবে তার ডিটেইলস নেয়। এবার বাসায় গিয়ে খালা আর চাচার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা।

রায়হান আহমেদ রাতে বাসায় আসলে, রাতের খাবার পর কুহু তার সাথে কথা বলতে চায়।

” চাচা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ” রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। তখন সেখানে আসল।

” কি বলবি, মা? আমার কাছে এসে বস। তারপর তোর যা যা বলার বল। ”

কুহু ওর চাচার পাশে বসে চিন্তা করছে কিভাবে কথা শুরু করবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুক ভরে শ্বাস নেয় মেয়েটা।

” চাচা, আমি কোচিং-এর স্যারকে টিউশনির কথা বলেছিলাম। তিনি আজকে বললেন, কয়েক জায়গায় কথা বলেছেন। এখন তুমি রাজি থাকলে আমি স্যারের সাথে কথা বলব। ”

কুহুর কথা শুনে রায়হান আহমেদ ওর দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে চাইছেন কুহুর মনের কথা। কিন্তু তার সামনে বসে থাকা চাপা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে তিনি অক্ষম হলেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” তোর কি টিউশনি করা খুব জরুরী, মা? টিউশনি করতে গেলে অ্যাডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিবি কেমন করে? আমি চাইনা তুই এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনদিকে নজর দিস। এসবের জন্য অনেক সময় পরে আছে। ”

চাচার কথা শুনে কুহুর চোখে পানি আসল। চাচা যে ওর ভালো চায়, সেটা ওর বুঝতে বাকি থাকেনা। কিন্তু এই মুহুর্তে কুহুর একটা কাজ দরকার। চাচির চোখ রাঙ্গানি কিংবা অপমান, অসম্মান ওকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। একটা কাজ ওর ভিষণই দরকার। যাতে ওদের দুই ভাই-বোনের খরচ জোগাতে সমস্যা না হয়। তাই ও খুব সাবধানে মুখ খুলল। চাচার সামনে চাচির বিষয়ে মুখ খোলা যাবেনা।

” চাচা, আমি পড়াশোনাকে প্রায়োরিটি দিয়েই যা করার করতে চাই। টিউশনি কিংবা কোচিং-এ ক্লাস নিলে সকাল সাতটা থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্তই নিতে হবে। রাতে আমি সম্পূর্ণ ফ্রি থাকব। রাতে পড়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পাব। আমি জানি চাচা, তুমি ছোট চাচা, ফুপু আমাদের জন্য চিন্তা কর। তোমাদের চাওয়া আমি অবশ্যই পূরণ করব। কিন্তু এই সুযোগে আমি নিজেকেও ঝালাই করে নিতে চাই। তুমি আর না করোনা, চাচা। ”

রায়হান আহমেদ বুঝলেন কুহু খুব করে চাচ্ছে কিছু একটা করতে। সেই সাথে তিনি এ-ও বুঝলেন মেয়েটা রোজগার করে তার কাঁধ থেকে বোঝা সরাতে চাইছে। এই বাসায় যে কুহু আর সৃজন প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকে, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি অনেকবার ওদেরকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। হঠাৎ করেই কষ্টে তার বুক ভারি হয়ে আসে। বড় ভাই-ভাবী বেঁচে থাকলে ছেলেমেয়ে দুটো এমন ভয়ে ভয়ে বাঁচতনা। ওরা নিজেদের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচত।

” আমি সম্মতি দিতে পারি এক শর্তে। পড়াশোনা ঠিক রেখে টিউশনি কিংবা কোচিং যা করার করবি। যদি আমি শুনি ওসব করতে যেয়ে তোর পড়াশোনায় সামান্যতমও সমস্যা হচ্ছে, তবে সাথে সাথেই তোকে সবকিছু থেকে ইস্তফা দিতে হবে। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স তোকে পেতেই হবে। ”

চাচার কথায় কুহু প্রান ফিরে পেল। ও প্রানখুলে হেসে জবাব দিল,

” তুমি চিন্তা করোনা, চাচা। আমার কাছে পড়াশোনাই সব। লেখাপড়া করার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আর পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স আমি পাবই। সেই বিশ্বাস আমার আছে। ”

রাতে খালাকে সবটা বললে তিনিও রাজি হয়ে যান। তবে রাতে তিনি তাহমিদকে জানাতে পারেননি বিষয়টা। পরদিন সকালে তাহমিদ ফোন দিলে তিনি তাহমিদকে সব জানান। তাহমিদ মনযোগ দিয়ে খালার সব কথা শোনে।

পরদিন কোচিং-এ গিয়ে কুহু স্যারের সাথে কথা বলল। ও সকাল সাতটায় একটা কোচিং-এ পড়াবে। সেখানে ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীদের অংক আর ইংরেজি ক্লাস নেবে। আর বাকি দিন ওর কোচিং-এর ফাঁকে আরেকটা কোচিং-এ ক্লাস নিবে। ও রাতে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন বাসায় আপাতত পড়াতে যাবেনা। এই দুইটা কোচিং থেকে ওদের দুই ভাই-বোনের চলার মত খরচ হয়ে যাবে। ও সামনের মাস থেকেই কোচিং-এ জয়েন করবে। এই মাসের আর তিনদিন আছে। এই তিনদিন ও ফ্রি থাকবে। তারপর আরেকবার নতুনভাবে শুরু হবে বেঁচে থাকার লড়াই।

রাত এগারোটা চল্লিশ। কুহু মনযোগ দিয়ে পড়ছে। সৃজন খাটে ঘুমাচ্ছে। ও আর খালা মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়। খালাও ওর পাশে ঘুমিয়েছে। ফোনের শব্দে পড়ায় ব্যঘাত ঘটল। বই বন্ধ করে ফোন হাতে নিতেই দেখল স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে ‘ খোঁ’চা কুমার ‘ লেখাটা।
কুহু মৃদু হাসল। মানুষটা তিনদিন পর ফোন দিয়েছে। কুহু ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরের শেষ মাথায অবস্থিত ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে ফোন বাজতে বাজতে একবার কেটে গেছে। কুহু ধৈর্য্য সহকারে আরেকবার তাহমিদের ফোনের অপেক্ষা করছে। এবার ফোন বাজতেই কুহু রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? ” কুহু উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

” কি ঘটনা! তুমি বোধকরি আমার চিন্তায় শুকিয়ে গেছ? কন্ঠ এমন ব্যাকুল শোনায় কেন? Something is fishy? ”
এবার তাহমিদের কথা শুনে কুহুর মাথা ঘুরছে। ওর মন বলছে, এই মানুষটা কি সব সময়ই এমন খোঁ’চা দিয়ে কথা বলবে! একে থামাতেই হবে।

” একটা জরুরী কথা ছিল। আপনি কি শুনবেন? নাকি আমি ফোন কেটে দেব। ” কুহু সরাসরি হুমকি দেয় তাহমিদকে।

” জ্বি বলুন, শুনছি আপনার জরুরী কথা। অযথা ফোন কাটবেন কেন! আপনি ফোন কাটলে আমার বিরাট লস হয়ে যাবে। কারও মধু মাখানো গলা শুনতে পাবোনা। কাঁপা কাঁপা সেই গলায় কি যে নেশা সেটা কেবল আমিই জানি। আমার কান সেই গলার আওয়াজ না পেলে বধির হয়ে যাবে। ”

” আমি ফোন রাখছি। ” এবার কুহুর হুমকিতে কাজ হল।

” এই খবরদার ফোন রাখবেনা। নেহাৎ আমি অসহায় পুরুষ, তাই কারনে-অকারনে তোমার এমন হুমকি সহ্য করি। এই আমাকে অসহায় পেয়ে তুমি। বারেবারে সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। ”

তাহমিদের মিইয়ে যাওয়া গলা শুনে কুহু হাসল। মানুষটাকে জব্দ করার উপায় পেয়েছে ও।

” আমি একটা কোচিং-এ জয়েন করছি আর তিনদন পরই। আসলে একটা নয় দুইটা কোচিং-এ সুযোগ পেয়েছি। ” কুহু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল।

” কনগ্রেচুলেশন। তুমিও স্বাবলম্বী নারীর তালিকায় নাম লিখালে! কে বলেছে তালুকদার সাহেবের ভাতিজী অসহায়! তবে দুইটা কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা ঠিকমত চালাতে পারবেতো? আশা করছি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ”

” দিনে আমি খুব একটা পড়িনা। দিনে ক্লাস নিয়ে রাতে পড়তে কোন সমস্যা হবেনা। শুধু এক জায়গায়ই পরীক্ষা দেব, তাই খুব একটা টেনশন করছিনা। ”

” সমস্যা না হলেই ভালো। পড়াশোনায় কোন ত্রুটি যেন না হয়। এক জায়গায় পরীক্ষা দেবে মানে? অ্যাডমিশন কোন কোন ভার্সিটিতে দিবে? ”

” শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেব। ”

” কেন? অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কি দোষ করল? ”

” আমি যদি অন্য কোথাও চান্স পাই, তবে সৃজনকে এখানে রেখে আমাকে সেখানে থাকতে হবে। আমি সৃজনকে কোথাও একা রাখতে চাইনা। সে-ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। ”

এবার তাহমিদ কুহুর কথায় বিরক্ত হয়। কিন্তু ও কুহুকে বুঝতে দেয়না। ও নিজের বিরক্তি চেপে রেখে কথা বলল।

” কেন, রুয়েট কি দোষ করল? সেখানেও তো একটা সুযোগ নিতে পার। ”

” আমিতো রুয়েটের জন্য প্রস্তুতি নেইনি। শুধু পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ”

” আমি সাজেশন জোগাড় করেছি। এই কয়দিন ঝামেলার কারনে পাঠাতে পারিনি। কালকে পাঠিয়ে দেব। ডেলিভারিম্যান কোচিং-এ গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সাজেশনগুলো ফলো করলে আশা করি নিরাশ হবেনা। তবে রুয়েটের জন্যও একটু আধটু পড়াশোনা কর। যেখানে চান্স পাবে, সেখানেই ভর্তি হবে। ”

” আচ্ছা। আমি কালকেই স্যারের সাথে কথা বলব। স্যার যদি সাজেশন জোগাড় করে দিতে পারে, তবে ভালো হবে। ”

” আমি রুয়েটের সাজেশনও জোগাড় করেছি। তারপরও তোমার স্যারের সাথে কথা বলে দেখ। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে নিরবে হাসল। মানুষটা দূরে গিয়েও ওর সাথে ছায়ার মত রয়ে গেছে
আগলে রাখছে কুহুকে।

” আপনি রাতে খেয়েছেন? কোথায় আছেন এখন? ”

” এখনও খাইনি। বর্তমানে একটা পার্কের ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি। দেখছি আকাশের গায়ে তারারা কেমন করে লেপ্টে থেকে, আকাশের ভালোবাসা নিজেদের শরীরে মেখে নিচ্ছে। বুঝলে মেয়ে, আকাশের সাথে তারাদের গভীর প্রনয় রয়েছে। ওরা একে-অপরকে ছাড়া শূন্য। যেমন আমি শূন্য এক শ্যাসাঙ্গীনিকে ছাড়া। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর হিয়ার মাঝে দোলা দেয় প্রশান্তির মৃদুমন্দ মলয়। মন বাগিচায় পাখনা মেলে উড়তে থাকে রংবেরংয়ের প্রজাপতি। ওর মন বলছে, তোর জীবনে সে এসেছে সুখের পরশ নিয়ে। তোর জীবনকে পরশপাথরের ছোঁয়ায় পাল্টে দেবে সে। তুই তার, তুই একান্তই তার। তুই তার শ্যামাঙ্গীনি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে