#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী
” নানিমা, তারাতারি খেয়ে নিন। আজকে আমি চিংড়ির মালাইকারি করেছি। খেয়ে আমাকে ইশারায় বলুন কেমন হয়েছে। ” কুহু ফাতিমা খানমকে খাইয়ে দিচ্ছে আর কথা বলছে।
ফাতিমা খানম তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছেন। তার চোখেমুখে তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ দেখে কুহুর বেশ ভালো লাগছে।
” নানিমা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। অনুমতি দেবেন? ” কুহু নানিমার অনুমতির অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ফাতিমা খানম মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিলেন।
” আপনার ঐ হ্যাংলা, ছ্যাঁচড়া নাতি আর কতদিন থাকবে বলুনতো? নির্লজ্জ, বেহায়া লোক একটা। আমার সাথে শুধু অসভ্যতামি করার তালেই থাকে। তাকে দেখলে মনে হয় কোন গহীন জঙ্গল থেকে শেকল পরা উজবুক উদয় হয়েছে। ” বৃদ্ধা ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছেন কুহুর দিকে।
এদিকে কুহু বৃদ্ধাকে খাওয়াচ্ছে আর কথা বলছে।
” আপনার দুই নাতিই চিজ মাইরি। একজন ছ্যাঁচড়া, আর আরেকজন খোঁ’চা কুমার। এই যে আমি কত যত্ন করে চিংড়ির মালাইকারি রান্না করলাম। আর সে কিনা আমাকে বলে টেস্ট করে দেখতে! আমি যদি লবন দিয়ে তরকারি তিতা করে ফেলি! আমি কি ইচ্ছে করে তরকারি নষ্ট করব, বলুন? আবার আমাকে গা’ধা, গা’ধী বলে ডেকেছে। কথায় কথায় আমাকে ধমকায়। যার নিজের স্বভাব শাখামৃগের ন্যায়, আর সে কিনা আমাকে গা’ধা বলে! আমি নেহাৎ ভদ্র মেয়ে তাই ঐ খোঁ’চা কুমারকে কিছু বলিনা। তাই বলে কিন্তু ঐ ছ্যাঁচড়া, লালমুখো হ’নু’মা’ন’কে ছেড়ে কথা বলবনা। সে আমাকে বলে তার সাথে ডেটিংএ যেতে! ”
কুহুর কথা শুনে ফাতিমা খানম চমকে তাকান। কুহু যে শেষের কথাগুলো যে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলেছে, সেটা তার বুঝতে বাকি থাকেনা।
তাহমিদ রা’গে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। জয়ের সাহস দেখে ও অবাক হয়ে গেছে। এতক্ষণ ও দরজার বাহিরে হেলান দিয়ে কুহুকে পাহারা দিচ্ছিল। ও যখন দেখল কুহু খাবার নিয়ে নানিমার কাছে যাচ্ছে, তার কিছুক্ষণ পরই ও এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। জয় এখন বাসায় আছে। কুহুকে এই রুমে দেখলেই ও নিশ্চয়ই এসে মেয়েটাকে বিরক্ত করবে। তাই নিজের অস্তিত্ব কুহুকে বুঝতে না দিতে চুপচাপ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে কুহু নানিমাকে খাওয়ানোর সময় কথাগুলো বলছিল।
তাহমিদ উঁকি দিয়ে দেখল নানিমার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। এবার মেয়েটাকে জব্দ করাই যায়।
” নানিমা, তোমার এই টেপরেকর্ডার সময়ে-অসময়ে এভাবে বাজে কেন বলত? তার মুখ যদি এভাবে মেশিনগানের মত চলতে থাকে, তবে যে কোন সময় সার্কিট ডাউন হয়ে যেতে পারেনা কি? তাকে দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। কিন্তু এখন দেখছি, ভাজা মাছ উল্টে না খেয়ে সরাসরি চিবিয়ে খায়। আমাক যেন কি উপাধি দিয়েছে? ও হ্যাঁ, শাখামৃগ আর খোঁ’চা কুমার। এই টেপরেকর্ডার তোমার মাথার উকুন বাছতে হবে নাকি? শাখামৃগ কিন্তু এই কাজটা খুব ভালো পারে। তবে নড়াচড়া করা চলবেনা মোটেও। একটু নড়েছ তো ফ্রিতে মিলবে কা’ম’ড় আর আঁ’চ’ড়। লাগবে নাকি কা’ম’ড়? ” তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে বাম চোখ টিপল।
হঠাৎ রুমে তাহমিদের আগমনে কুহু চমকে গেছে। তারপর আবার ওর উল্টাপাল্টা কথা শুনে বেশ ভড়কে যায়। দ্রুত হাতে নানিমার মুখ মুছে দেয়। ও বেশ বুঝতে পারছে, তাহমিদের কাছে ও আচ্ছামত ধরা খেয়েছে।
” নানিমা, আমি এখন যাই। ” ও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।
” কোথায় যাচ্ছ, ভদ্র মেয়ে! খোঁ’চা কুমারের খোঁ’চা শরীরে না মেখেই পালাই পালাই করছ কেন? আগে তার খোঁ’চায় নিজেকে জর্জরিত কর। তারপর যাও। ”
কুহু আপাতত তাহমিদের কথা শোনার মুডে নেই। ও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে হুড়মুড় করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
কুহুর এভাবে পালানো দেখে তাহমিদ হো হো করে হেসে উঠল।
” কি বুঝলে, নানিমা? ভীতু মেয়ে। ওকে জ্বা’লি’য়ে মজা আছে। তবে জয় ওর সাথে বাড়াবাড়ি করছে। ওকে থেরাপিতে দিতেই হবে। আমার কাছে ওর লাঠি থেরাপি পাওনা হয়েছে। দুই একেই ওর পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। ওর কতবড় সাহস আমার শখের নারীর দিকে নজর দেয়! ঐ ভীতু হরিণীর ভীতু চোখ, কম্পমান ঠোঁট, ওর ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, ভয়ে চুপসানো মুখ শুধুই আমি দেখব। আমি ওর হাজার রূপে মুগ্ধ হতে চাই। এমনকি ওর সাথে ফ্লার্টও আমিই করব। কিন্তু মাঝখানে জয় এসে আমার সব স্বপ্ন ভেস্তে দিচ্ছে। আমার সব অধিকারগুলো ও কেড়ে নিচ্ছে। ”
ফাতিমা খানম এক দৃষ্টিতে তার নাতির দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটার চোখের দ্যুতি তার নজর এড়ায়নি। ঐ স্বচ্ছ চোখের ভাষা তিনি পড়ত পারছেন। কুহুর কথা বলার সময় ছেলেটার চোখেমুখের আলাদা উজ্জ্বলতাও তার দৃষ্টি কেড়েছে। ছেলেটা সত্যি কুহুকে ভালোবাসে। তারও কুহুকে বেশ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা যেমন নম্র, শান্ত তেমনি মিষ্টভাষী। তার নাতির সাথে কুহুকে বেশ মানাবে। তার আজ হঠাৎ করেই আর কিছুদিন বাঁচার সাধ জাগল। এতদিনে ছেলেটা মত পাল্টেছে। কাউকে কাছে পেতে চাইছে। তিনি নিজের তার নাতির প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ দেখতে চান। এই নাতি তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। নিজের সন্তানদের থেকেও প্রিয় এই ছেলেটা। এই ছেলের সুখ দেখে ম’র’তে পারলে, তার সব চাওয়া পূর্ণ হবে। তিনি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন।
তাহমিদ ওর নানিমার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে। বৃদ্ধা মাঝেমধ্যে হাত নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইছেন। তাহমিদ সেটা দেখে হাসল।
” ধৈর্য্য ধর, নানিমা। আগে সে বুঝুক আমি তাকে কতটা ভালোবাসি। তারপর সে আমার ভালোবাসায় ধরা দিক। তাকে আগে বুঝতে হবে আমার ভালোবাসার গভীরতা। আমি ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা আদায়ে বিশ্বাসী। যে ভালোবাসার মাঝে কোন খাঁদ থাকবেনা, সে ভালোবাসা আমি দিতে চাই আবার নিতেও চাই। ”
বৃদ্ধার চোখে খুশিতে পানি এসেছে। তিনি নাতির মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
কুহু তাহমিদের কাছ থেকে লুকিয়ে আছে। ও তাহমিদের সামনে পরতে চায়না। আর না শুনতে চায় লোকটার খোঁ’চা মা’রা কথা। সেদিন রাত, পরদিন সকাল, দুপুর তাহমিদের কাছ থেকে লুকিয়ে রইল। বিকেলে যথারীতি কোচিং-এ গেছে। এরমধ্যে জয় ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু রাজিয়া খালার হস্তক্ষেপে ওকে থেমে যেতে হয়।
কোচিং থেকে বেরিয়ে অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে কুহু। এমন সময় কোথায় থেকে ওর সামনে উদয় হয় তাহমিদ। ও রিক্সায় এসেছে।
” উঠে পর, ভদ্র মেয়ে। ”
” আমি একাই যেতে পারব। ” কুহু গোমড়ামুখে উত্তর দেয়।
” ওহ্ বুঝেছি। তোমার জয়ের সাথে যাওয়ার সাধ জেগেছে। ওকে, আরেকটু সামনে যাও। ওকে পেয়ে যাবে। এরপর দু’জন একসাথে রিক্সা বিলাস কর। এমনিতেই তোমার পাশে ওকে ভালো মানায়। ”
জয়ের কথা শুনে কুহু ভয় পেয়ে গেছে। ও আর কোন কথা বাড়ায়না। রিক্সায় উঠে বসল। জয়ের সামনে পরার থেকে এই মানুষটার সাথে যাওয়া নিরাপদ।
রিক্সা উল্টাদিকে ঘুরতে দেখেই কুহুর পিলে চমকে যায়। বাসার রাস্তা তো এদিকে নয়!
” একি! কোথায় যাচ্ছেন! বাসাতো এদিকে নয়? রিক্সা পেছনে ঘোরাতে বলুন। আমি বাসায় যাব।”
” কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক। ”
” আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ”
” বিক্রি করে দিতে। ”
” কিহ্! মামা, রিক্সা থামান। আমি নেমে যাব। ” কুহু এবার উপায় না দেখে রিক্সাওয়ালার শরণাপন্ন হয়।
” তোমার মামাকেসহ রিক্সা আমি ভাড়া করেছি, তাই তোমার মামা শুধু আমার কথাই শুনবে। তাই চুপচাপ কোন কথা না বলে বসে থাক। অযথা চিৎকার করে গলা ব্যথা করার প্রয়োজন নেই। ”
তাহমিদের এহেন কথা শুনে কুহু এবার ভয় পেয়ে গেছে। ও আকুতি নিজেকে তাহমিদের দিকে তাকায়। কিন্তু তাহমিদকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর রিক্সা এসে একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ায়। তাহমিদ ভাড়া মিটিয়ে কুহুকে নামতে বললে কুহু গাঁট হয়ে বসে রয়।
” আপনি যান। আমি এই রিক্সাতেই বাসায় যাব। ”
” ওহ্ বুঝেছি, আমার কোলে উঠতে ইচ্ছে করছে। আগে বললেই পারতে। মামা, একটু সাইড দিন আর আমার দিকে নজর রাখুন। ম্যামকে কোলে নিই। এই কাজে আমার আবার অভিজ্ঞতা নেই। আপনার ভাগ্নীর ওজন সম্পর্কেও আমার ধারনা নেই। পরে যেতে লাগলে ধরবেন, কেমন? ” তাহমিদ শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যায় কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদকে এগোতে দেখে এক লাফে রিক্সা থেমে নেমে যায়।
” চলুন, আমি হেঁটেই যাচ্ছি। ”
তাহমিদ কুহুর চুপসানো মুখ দেখে মজা পায়। রিক্সাওয়ালাও ওদের কান্ড দেখে হেসে ফেলে।
দোতলায় এসে কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে ওরা। কুহু এতক্ষণে লক্ষ্য করল তাহমিদের হাতে তিনটা প্যাকেট।
দরজা খুলে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে সজল। তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে ওর সাথে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে।
” দোস্ত তুই! আমাকে চমকে দিয়েছিস কিন্তু । আয় ভেতরে আয়। ” সজল দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।
তাহমিদের পেছন পেছন কুহুও ভেতরে ঢোকে।
তাহমিদ সজলের হাতে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিতেই সজল খেঁকিয়ে উঠল।
” শা’লা, এসব কি নিয়ে এসেছিস? তোর জিনিস তুইই নিয়ে যাস। রাতে বসে বসে খাবি। এতে তোর খাওয়ার খরচ কমবে। আমার সাথে তোর ফর্মালিটির সম্পর্ক তাইনা? শা’লা ঘাড়ত্যাড়া পাব্লিক। ”
” নতুন একটা মানুষের সামনে আমাকে এভাবে বলিসনা। এই মেয়ে এমনিতেই আমাকে ইজ্জত দেয়না। এখন তোর কথা শুনে আমাকে আর জীবনেও দাম দেবেনা। একে দেখতে যতই বোকাসোকা লাগুকনা কেন, আদতে এই মেয়ে কিন্তু তা নয়। ”
এবার সজল একটু শান্ত হয়। কুহুর দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করল।
” তা এই বাচ্চা মেয়েকে কোথায় থেকে ধরে এসেছিস? আজকাল অন্যকোন ব্যবসাও শুরু করেছিস নাকি! কই আমিতো জানতামনা। ”
” তুই চুপ করবি নাকি আমি বেরিয়ে যাব? শোন এই বাচ্চা মেয়ে তালুকদার সাহেবের ভাতিজী। তবে এ দেখতে যতই বাচ্চামত হোকনা কেন মেয়ে কিন্তু সেয়ানা। ”
এবার কুহুর চরম রা’গ হয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
” আপনি যতই যাই বলুন না কেন, মেয়েটা কিন্তু কিউট আছে। তোমার নাম কি কিউটি? ” সজলের বউ মায়া এসে দাঁড়ায় ওদের মাঝে।
” আমার নাম কুহু। ”
” বাহ্ সুন্দর নাম। দাঁড়িয়ে আছ কেন বস। আর ওদের কথায় কান দিওনা। ওরা এমনই। তাহমিদ ভাই, আপনি মানুষ কিন্তু সুবিধার নন। কালকে আমি কতগুলো রান্না করলাম কিন্তু আপনি আসলেননা। আর আজ সাথে করে এই কিউটিকে নিয়ে আসলেন কিন্তু খবর দিলেননা। ”
” তোমার এই কিউটিকে নিয়ে আসব জন্যই কাল আসিনি। তোমার খাবার নিয়ে এত টেনশন করতে হবেনা। শুধু চা খাওয়ালেই চলবে। দুপুরে পেটপুরে খেয়েছি। তাই এখন অন্যকিছু না খেলেও চলবে। ”
” দুপুরে কি খেয়েছিস, দোস্ত? আগে কখনোই শুনিনি তুই পেটপুরে খাস। ” সজলের চোখে সন্দেহ। যে ছেলে মেয়েদের আশেপাশে ভিড়েনা হঠাৎ সেই ছেলে একটা বাচ্চা মেয়েকে সাথে করে ওর বাসায় এসেছে। বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে সজলকে।
” বিফ বিরিয়ানি, ভাত, রোস্ট, ইলিশের দোপেঁয়াজা সবই খেয়েছি। এখন কি তোর এসব খেতে ইচ্ছে করছে? তবে অফ যা। তোকে কিছুই দেয়া হবেনা। এই যে ভদ্র মেয়ে? এটাকে দেখ। এটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের মাস্টার। ভালো করে চিনে রাখ। তুই একে চিনে রাখ, মাস্টার। তোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যই এ কোচিং করছে। ”
এবার সজল কুহুর সাথে কথা বলতে শুরু করে। কুহুও কিছুক্ষণ পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মায়াকে ওর ভিষণ পছন্দ হয়েছে। সেই সাথে সজলকেও। ওরা বেশ মিশুক।
মায়া সজল ওদের রাতো খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেও ওরা থাকলনা। কারন তাহমিদ জানে কুহুর ফিরতে দেরি হলে ওর খালা কি করতে পারে। তবে ওকে কথা দিতে হল আরেকদিন কুহুকে নিয়ে আসতে হবে।
বাসায় ফেরার পথে কুহু কোন কথা বললনা। চুপচাপ রাস্তার চারপাশ দেখতে থাকল।
তাহমিদ গতকালের মত আজকেও রিক্সার পেছনে হাত রেখে বসেছে। বিষয়টা খেয়াল করে কুহু আনমনে হেসে ফেলল।
” মামা, রাজশাহীতে কোন পা’গ’লা গারদ আছে? থাকলে রিক্সা সেদিকে নিন। আমার পাশে বসা মেয়েটা একা একা হাসছে। এর ভাবগতিক সুবিধার লাগছেনা। ” রিক্সাওয়ালা তাহমিদের ইয়ার্কি বুঝতে পেরে জোরে হাসল।
কুহু কটমটিয়ে তাহমিদের দিকে তাকাতেই, তাহমিদ বুকের বাঁ পাশ চেপে ধরে পরে যাওয়ার ভান করল।
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী
রাত এগারোটা। জয় কানে হেডফোন গুঁজে, গান শুনতে শুনতে বাসায় ফিরছিল। বাসা থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা একটা জায়গায় হঠাৎই একজনের সাথে ধাক্কা লাগল।
” কি রে মামুর ব্যাটা, ধাক্কা দিলি কেন বে? ”
” সরি ব্রো, আমি বুঝতে পারিনি। ” কান থেকে হেডফোন খুলে বলল জয়।
” চুপ শা’লা। আগে বল ধাক্কা দিলি কেন? ” ছেলেটা তেড়ে আসল জয়ের দিকে।
জয় কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও চারজন ছেলে সেখানে হাজির হয়। তারা একজোট হয়ে জয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে। একপর্যায়ে একটা ছেলে জয়কে থা’প্প’ড় দেয়। জয়ও তেড়ে গিয়ে সেই ছেলেকে থা’প্প’ড় দেয়। সেই সাথে আজেবাজে গালিও দেয়। এতে ছেলেরা রে’গে গিয়ে জয়কে থা’প্প’ড় মা’র’তে থাকে।
পাঁচজনের সাথে একা পেরে উঠলনা জয়। ও নেতিয়ে গেছে। হঠাৎই পেছন থেকে একটা শক্তপোক্ত হাত ওকে পেঁচিয়ে ধরল। পিঠমোড়া করে বাঁধল ওকে। এরপর চোখও বেঁধে দেয়। হঠাৎই জয় অনুভব করল ও রাস্তায় হুটোপুটি খাচ্ছে। ওর বাম গাল, কান অসার হয়ে গেছে। এবার জয় ভয় পেয়ে গেছে। ও কোন অনুভূতি ব্যক্ত করার আগেই কেউ ওর পায়ে হকিস্টিক দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। পাঁচজন ছেলে তখন নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রাস্তায় অসহায়ের মত পরে থাকা জয়কে। ওর মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে আসছে। মা’রে’র কারনে ওর জ্ঞান প্রায় লুপ্ত হয়েছে। তবে পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে কারও কয়েকটা তেজদ্বীপ্ত বাক্য ওর কুর্নকুহরে প্রবেশ করল। ওর কানে কথাগুলো পৌঁছালেও মস্তিষ্ক ধরতে পারলনা গলাটা কার। সেই ব্যক্তি বেদম পেটাচ্ছে আর বলছে,
” তুই কার সম্পদে হাত দিয়েছিস, একবারও ভেবে দেখেছিস? আমার সম্পদে হাত বাড়ানো দূরের কথা, কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি সেই চোখ উপড়ে ফেলব। আমার জিনিস দেখার অধিকার শুধু আমারই আছে। তুই নরকের কীট নরকেই থাকবি। সেটা না করে, আমার সম্পর্কের মাঝে থার্ড পারসন হতে এসেই অকালে হাত-পা ভাঙতে হচ্ছে। এটা ফার্ষ্ট এ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর তোর ছোঁকছোঁক স্বভাব দেখলেই মাটিতে পুঁতে দেব। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবেনা। ”
পুরো কথা শোনার আগেই জয় জ্ঞান হারায়।
রাত একটা পঁচিশে শায়লা হাসান তাহমিদের রুমের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
তাহমিদ দরজা খুলে চোখ কচলে তাকায়।
” তাহমিদ, আমাকে নিজেকে মেডিকেলে চল। তারাতারি রেডি হয়ে নাও। ” শায়লা হাসানের ব্যাকুল গলায় বলল।
” কেন খালামনি! এই রাতে মেডিকেলে যাবে কেন? কি হয়েছে তোমার? ”
” আমি ঠিক আছি। জয়ের নাকি কিছু হয়েছে। ওর ফোন থেকে একজন আমাকে ফোন দিয়ে জানাল, জয়কে নাকি মেডিকেলে এডমিট করা হয়েছে। এখন কথা বলার সময় নেই। তুমি রেডি হয়ে এস। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেছি। ”
তাহমিদ একটা হাই তুলে হেলতে দুলতে ওয়াশরুমে ঢুকে, চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে আসল।
শায়লা হাসান ছেলেকে দেখা মাত্রই কেঁদে উঠল। ভাঙ্গা ডান হাত আর বাম পা নিয়ে বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে জয়। ওর পুরো শরীরে মা’রে’র কালসিটে দাগ দেখে শিউরে উঠেছে শায়লা হাসান ও নায়লা আঞ্জুম।
বেডের একপাশে নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। ওর পাশে রায়হান আহমেদ দাঁড়িয়ে ঘন ঘন হাই তুলছেন।
শায়লা হাসান তোড়জোড় করছে জয়কে এখান থেকে নিয়ে যেতে। সে তার ছেলেকে ভালো কোন ক্লিনিকে এডমিট করতে চায়। সে ইতোমধ্যে ফোনে বেশ কয়েক জায়গায় কথা বলেছে।
” তাহমিদ, এসব কি! মেডিকেলে কি মানুষের চিকিৎসা হয়না? জয়কে একটা রাত এখানে রাখলে কি হবে। কাল সকালেই না-হয় কোন ক্লিনিকে নিত। আমি এখানে আসতেই চাইনি। শুধু তোমার খালার খ্যাঁচখ্যাঁচানির জন্য আসলাম। এমনিতেই এই জয়কে আমার পছন্দ হয়না। কেমন একটা লাফাঙ্গা টাইপের ছেলে। ”
” আপনাকে চাচাশ্বশুর বানাতে সে তৎপর হয়ে গেছে। এটা আপনি জানার পর কি প্রতিক্রিয়া দেখান, সেটা দেখার বড় সাধ হচ্ছে। ” বিরবিরিয়ে বলল তাহমিদ।
” কিছু বললে? ”
” হুম? বললাম, সবই কর্মফল। ”
রায়হান আহমেদ এই বিষয়ে কথা বলার আগ্রহবোধ করলেননা। তিনি বাহিরে গিয়ে সিগারেট ধরালেন।
রাত তিনটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেন রাজিয়া খালা। তিনি জয়কে দেখে আৎকে উঠেছেন। ওকে স্ট্রেচারে করে বাসায় নিয়ে এসেছে! কুহু একপাশ থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। জয়ের এই অবস্থা দেখে ওর খারাপ লাগলেও, ওর ইচ্ছে করছেনা জয়ের কাছে যেতে। তাই ও নিজের রুমে চলে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুকে দেখে মৃদু হাসল।
সকাল থেকে শায়লা হাসান ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলের দেখাশোনা করছে। দুইজন ডক্টর এসেছে জয়ের চেক-আপ করেছে। শায়লা হাসান চাচ্ছে ছেলেকে নিয়ে যত তারাতারি সম্ভব খুলনা ফিরে যেতে। জয়ের বাবা খালেদ হাসান ছেলেকে চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবেন। তিনি ইতোমধ্যেই সব ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। এটা তিনি খুলনা থেকে ফোনেই জানিয়েছেন।
কুহু অবাক হয়ে এদের কাজকর্ম দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত ও জয়ের আশেপাশে যায়নি। আর ওর সেখানে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে সেই।
সেদিন শায়লা হাসানের খুলনা যাওয়া হলোনা। ডক্টর তিন-চার দিন জয়কে কোথাও নিতে বারণ করেছেন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী পাঁচদিন তারা রাজশাহীতেই থাকবে।
কুহু সকালে খালাকে যতটা সম্ভব কাজে সাহায্য করেছে। নানিমাকে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর টুকিটাকি কাজ সেড়ে ও বেরিয়ে পরে কোচিং-এর উদ্দেশ্যে। একসাথে দুইটা কোচিং করে বাসাটা আসবে।
আজকে বাসা থেকে বেরিয়ে কুহু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজকে জয়ের ভয় ওকে তাড়া করছেনা। কিন্তু ছেলেটার জন্য ওর সত্যিই খারাপ লাগছে। কুহু একটা মানুষকে যতই অপছন্দ করুক, তাই বলে তার খারাপ চাইতে ও কখনোই পারেনা। সেই শিক্ষা ও পায়নি।
আজ আশেপাশে তাহমিদকেও দেখলনা। কুহু জানতেই পারেনি, তাহমিদ আরও আগে বাসা থেকে বেরিয়েছে।
কোচিং শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই কোথায় থেকে তাহমিদ এসে হাজির। আজও সে রিক্সা নিয়ে এসেছে। কুহু তাহমিদকে দেখে চোখ ছোট করে তাকায়।
” এভাবে তাকিয়ে না থেকে রিক্সায় উঠো। তোমার জন্য মামার সময় বসে থাকবেনা। ” বরাবরের মতোই খোঁ’চা দিল তাহমিদ।
কুহুর খুব করে ইচ্ছে করলো লোকটাকে বলতে, ও তার সাথে যাবেনা। সেই সাথে কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর সব কথা কন্ঠায় এসে আটকে গেল। কুহু ভেবে পায়না জয়কে কিছু বলার সময় ওর তো এমন হয়না! কিন্তু এই লোকের সামনে আসলেই কথারা কেন এভাবে বেইমানী করে?
” চিন্তাবতী, রিক্সায় উঠেও তো চিন্তা করা যায়? তুমি রিক্সায় উঠে যত খুশি চিন্তা কর। ”
কুহু কিছু না বলে রিক্সায় চড়ে বসে। ও গতদিনের মতই জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। তাহমিদও ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু ওর হাত ঠিকই পেছনে রেখেছে, যাতে কুহু ব্যথা না পায়।
আজও উল্টোদিকে রিক্সা যেতে দেখে কুহু কিছু একটা ভেবে তাহমিদের দিকে তাকায়।
” আজও কি আমাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন? ”
হঠাৎ কুহুর এমন কথা শুনে তাহমিদ ভড়কে যায়। পরক্ষনেই ওর গতকালের বলা কথাগুলো মনে হয়। সে-ও কম যায়না। কুহুকে খোঁ’চা দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
” হুম। কালকের মত তিড়িংতিড়িং করছনা যে? ভয় কি তবে কেটে গেছে! ”
” যা পাবেন তার আধাআধি ভাগ হবে কিন্তু। অর্ধেক আপনার, অর্ধেক আমার। ”
তাহমিদ এবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও কুহুর কথার মানে বুঝতে পারেনি। তাই সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায় কুহুর দিকে।
কুহু সেটা বুঝতে পেরে অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,
” ঐ যে আমাকে বিক্রির টাকার আধাআধি ভাগের কথা বললাম। ”
তাহমিদ কুহুর এমন কথা শুনে রে’গে উঠল।
” ফাজিল মেয়ে, কতবড় সাহস আমার কাছ থেকে টাকার ভাগ চায়। আগে বুঝতে শিখ, আমার টাকা মানেই তোমার টাকা। তারপর ভাগ চাইবে। না বুঝেই অযথা লাফালাফি আমি পছন্দ করিনা। চুপচাপ বসে থাক। নইলে এক ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দেব। ”
তাহমিদের প্রচ্ছন্ন হুমকি শুনে কুহু সত্যিই ভয় পায়। ও আর কোন কথা না বলে বসে থাকে। রিক্সা গিয়ে থামল একটা মার্কেটের সামনে। কুহু ভাবছে, তাহমিদ ওকে এখানে কেন নিয়ে আসল!
কিন্তু ও তাহমিদকে প্রশ্ন করার সাহস পায়না। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের পিছুপিছু যেতে হয়।
” তোমার চাচাতো ভাই-বোনের জন্য ড্রেস সিলেক্ট কর। বিশেষ করে রিশার জন্য। ও কিসব জামাকাপড় পড়ে, সেসবের নাম আমার জানা নেই। ওর সাইজ অনুযায়ী দুইটা ড্রেস সিলেক্ট কর। এরপর নিশোর জন্য দেখবে। ”
কুহু তাহমিদের কথামত দুইটা ড্রেস সিলেক্ট করল। নিশোর জন্যও করল। এরপর তাহমিদের ধমক হজম করে সৃজনের জন্য টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পছন্দ করল। এরপর ওকে নিয়ে তাহমিদ মার্কেটের বাহিরে একটা রেস্টুরেন্টে বসল।
” কি খাবে, অর্ডার দাও। ”
” আমি কিছু খাবোনা। বাসায় যাব। ”
” তুমি না খেলেও আমি খাব। আর তুমি চুপচাপ বসে থেকে দেখবে। আমার খাওয়া শেষ হলেই তবে তুমি বাসায় যেতে পারবে। ”
কুহু আর কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকল।
তাহমিদ খাবার অর্ডার দিয়ে, কুহুকে রেস্টুরেন্টে রেখে কোথাও বেরিয়ে যায়। কুহু বিরসবদনে বসে বসে চারপাশ পর্যবেক্ষন করতে থাকল।
প্রায় বিশ মিনিট পর তাহমিদ হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসল। এরইমধ্যে খাবার আসলে নীরবে দুইজন খেয়ে নেয়। কুহু একটু আঁইগুঁই করলে, তাহমিদের ধমক খেয়ে চুপসে যায়।
কুহুর আজ ভিষণ ভয় করছে। আজকে বাসায় আসতে একটু বেশিই দেরি হয়েছে। চাচি ওকে কি বলবে সেটা ভেবেই ওর হাত-পা কাঁপছে। তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কোথাও চলে গেছে। যাবার আগে ওর কাছ থেকে সব প্যাকেট নিজের কাছে নিয়ে, শুধু দুইটা প্যাকেট কুহুকে দেয়। কুহু দেখল একটাতে সৃজনের জন্য কেনা পোশাক। অপরটাতে কি আছে তা সে জানেনা। তাহমিদকে প্রশ্ন করেও লাভ হলোনা। ও শুধু বলল, এটা কাউকে না দেখাতে। রুমে গিয়ে যেন প্যাকেট খোলে। কুহু আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে বাসায় প্রবেশ করল।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে নায়লা আঞ্জুমকে আঁড়চোখে খুঁজল কুহু। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পেলনা। ও হাঁফ ছাড়ল। এক দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে।
চলবে…