প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৩+১৪

0
583

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী

” হেই হট বিউটি, কোথায় যাও? ” কুহু সবেমাত্র বাসা থেকে বেরিয়েছে, ঠিক তখনই ওর সামনে এসে দাঁড়ায় জয়।

কুহু জয়কে দেখে মনে মনে ভিষণ বিরক্ত হয়। ওর ঠোঁটের আগায় একটা গালিও চলে এসেছিল। কিন্তু নিজেকে সামলায়। ও কিছু বললে সেটা যদি চাচির কানে যায়, তবে বাসায় একটা অপ্রিয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই দাঁত দাঁত পিষে জবাব দেয়,

” সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আর ভবিষ্যতে এমনভাবে হুটহাট করে আমার আশেপাশে আসবেননা। আমার এসব পছন্দ নয়। ”

” আহ্ রা’গ করছ কেন, কোকিল পাখি? আমিতো শুধুমাত্র তোমাকে সঙ্গ দিতে চেয়েছি। চল কোথায় যাবে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিই। এরপর দু’জন সারা বিকেল একসাথে ঘুরব। তোমার পছন্দের খাবার খাওয়াব, শপিং করে দেব। তুমি যা চাইবে তা-ই দেব। ” জয় চোখ টিপে বলল।

” আমাকে কি আপনি রাস্তার মেয়ে মনে করেছেন ? আপনি লোভ দেখালেন আর আমি নাচতে নাচতে আপনার সাথে চলে গেলাম! এমনটা ভাবলে আপনি ভুল করবেন। এখন সামনে থেকে সরুন। ” কুহু জয়কে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে জয় আবারও ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।

” রা’গ’লে তোমাকে চুড়ান্ত পর্যায়ের হট লাগে দেখছি! যেন অ’গ্নি’স্ফু’লি’ঙ্গ তোমার চেহারায় ঝলকাছে। তোমার ঐ আ’গু’নে আমি ঝাঁপ দিতে চাই সুন্দরী। তোমাকে একান্তে পেতে চাই। ”

জয়ের এরূপ নির্লজ্জতা দেখে কুহু আশ্চর্য হয়ে গেছে। একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এভাবে কোন মেয়েকে প্রপোজ করতে পারে! কুহু বুঝল এর সাথে যতই কথা বলবে, এ ততই কথা বাড়াবে। তাই প্রায় জয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেইন গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখে। কিন্তু জয় ওর পিছু ছাড়েনা।

কুহু রাস্তায় এসে রিক্সার খোঁজ করছে। কিন্তু আশেপাশে একটা রিক্সাও ওর চোখে পরলনা। বাধ্য হয়ে ও হাঁটতে থাকে। ও ভয় পাচ্ছে জয় যদি আবারও ওর পেছনে আসে।

” হেই বেইবি, এভাবে চলে যাচ্ছ কেন? একটু কথা বল আমার সাথে। তোমাকে দেখার পর তোমার আশেপাশে না থাকলে আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গরা বিদ্রোহ করে। এই মুহূর্তেও সবাই বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে। ওদের বিদ্রোহ একমাত্র তুমিই থামাতে পার। ”

এবার কুহু ভয় পায়। রাস্তায় এই লোকটা কোন সিনক্রিয়েট করবে না তো! কুহু জোড়ে পা চালাতে শুরু করল। কিন্তু ওর ভয় বাড়িয়ে দিয়ে জয় ওর পাশে এসে হাঁটতে শুরু করল।

” আপনি এভাবে আমার পেছনে পরে আছেন কেন? আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার? প্লিজ আপনি এখান থেকে যান। ” অনুনয় ঝরে পরল মেয়েটির কন্ঠায়।

” আমার ডেটিংএ গেলে তোমার প্রবলেম কোথায়! তুমি কি জানো আজ পর্যন্ত কোন মেয়েই আমার এই অফার ফিরিয়ে দেয়নি? মেয়েরা জয়ের সঙ্গ পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। জয়ের একটু ছোঁয়া ওদেরকে বিশ্বজয়ের তৃপ্তি দেয়। ” জয়ের চোখ ঘুরতে বেড়াচ্ছ কুহুর শরীরের আনাচকানাচে। ওর দৃষ্টি দেখে কুহু শিউরে ওঠে।

” আমি ঐরকম কোন মেয়ে নই। সব মেয়েকে আপনি তাদের কাতারে ফেলবেননা। ”

” ঐরকম মেয়ে নও, কিন্তু হতে দোষ কি? মজা তুমিও নাও, আর আমাকেও নিতে দাও। বিনিময়ে তোমাকে টাকা দিয়ে ভরিয়ে দেব। চল কোথাও গিয়ে একান্তে সময় কাটাই। ” জয় কুহুর হাত ধরতে গেলেই, কেও ওর হাত আটকে দেয়।

কুহু ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। এদিকে রাস্তায় কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। কুহুর ভয় হচ্ছে এসব কথা চাচির কানে গেলে সে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবে।

” কি রে জয়, এই মাঝ রাস্তায় বাচ্চা মেয়েটার সাথে কি করছিস? ”

পরিচিত কারও গলা শুনে কুহু সাহস ফিরে পায়। ও জয়ের অপর পাশে তাকাতেই চমকে উঠে।
এই মানুষটা আজ রাজশাহীতে কেন!

এদিকে জয়ও অবাক হয়ে ওর পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে।

” তাহমিদ ভাইয়া, তুমি! তুমি না তিনদিন আগেই ঢাকায় গিয়েছিলে? আজ আবার হঠাৎ রাজশাহী আসলে যে? তোমার ভার্সিটি এখনও খোলা আছে। কিন্তু তুমি এখানে কেন? ”

” শুনলাম তোরা এসেছিস। তাই ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। এমনিতেই অনেক ছুটি পাওনা আছে। তাই ভাবলাম এই সুযোগে সেগুলো কাজে লাগাই। তুই আমার কথার উত্তর দিলিনা যে? এই মাঝ রাস্তায় বাচ্চা মেয়েটার সাথে কি করছিস? ও এমন কুঁকড়ে আছে কেন? ” তাহমিদ দৃঢ় গলায় জানতে চাইল।

” ওর সাথে আমার ব্যাক্তিগত কাজ আছে। সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তোমার হাতে ব্যাগ দেখছি। তারমানে বাসায় যাওনি। আগে বাসায় যাও, রেস্ট নাও। তারপর তোমার সাথে কথা বলব। আর ও মোটেও বাচ্চা মেয়ে নয়। ”

” তুই ছাব্বিশ বছরের একটা দামড়া হয়ে এসব বুঝিসনা ! মেয়েটার বয়স আটারো কি উনিশ। মনে হয় উনিশ এখনো হয়নি। তোর সাথে ওর বয়সের পার্থক্য কত জানিস? তোর বয়সের কাছে নেহাৎ ও বাচ্চা। আর নিজের চেহারার কি হাল করেছিস! দেখে তো মনে হচ্ছে তুই সদরঘাটের ব’খা’টে। কানে দুল পরেছিস, হাতে কতগুলো ব্রেসলেট, আবার গলায়ও শেকল ঝুলিয়েছিস! এক কাজ করবি আমার সাথে জেন্টস পার্লারে গিয়ে নাক ফুটো করবি। আমি মোটা দেখে রিং কিনে দেব। প্যান্টের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া কেন! মনে হচ্ছে তোর পোশাককে কেউ রেইপ করে ছেড়ে দিয়েছে। এই তোর বাবা তোর এই উদ্ভট বেশভূষা দেখে কিছু বলেনা? ”

কুহু তাহমিদের কথা বলতে বেশ মজা পাচ্ছে। লোকটা এই ছ্যাঁচড়াকে আচ্ছা জব্দ করছে।

” ভাইয়া, তুমি এসব কি বলছ? এটা ফ্যাশন বুঝলে। তুমি শুধু লেখাপড়াই শিখেছ। মর্ডান হতে পারোনি। ”

” আমি লেখাপড়া করেছি মর্ডান হতে নয়, সমাজের সেবক হতে। কিন্তু তুই লেখাপড়াকেও রেইপ করেছিস। তোর সবখানে এত রেইপ করার স্বভাব কেন বলতো? আমার মনে হয় তোর জন্ম রেইপ লগ্নে। তুই যা কিছু করিসনা কেন, যেখানে যাসনা কেন সবখানেই রেইপ থেকেই যায়। ”

” ভাইয়া, তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলছ। এটা মোটেও ঠিক নয়। ” এবার গর্জে উঠল জয়।

” অপমানবোধ তোর আছে! আমিতো ভেবেছিলাম তুই অপমানেরও রেইপ করেছিস। যাহোক এবার অন্তত নিশ্চিত হলাম, একটা জায়গায় অন্তত রেইপ রেহাই পেয়েছে তোর কাছ থেকে। ”

জয় ভিষণ অপ্রস্তুত হচ্ছে তাহমিদের এহেন কথায়। কুহুর সামনে ও এভাবে চরম অপমানিত হবে সেটা ভাবতেই পারেনি। কুহুকে কিছু একটা বলে বুঝ দিতে গিয়ে, বাম পাশে তাকিয়ে দেখল বামপাশটা ফাঁকা। ওদের কথার ফাঁকে মেয়েটা কখন যেন উধাও হয়ে গেছে! এবার নিজের রা’গ’কে বশে রাখতে পারলনা জয়। খেঁকিয়ে উঠল তাহমিদের ওপর।

” তোমার জন্যই পাখি উড়াল দিল। কেবল একটু পটাতে গেলাম, আর তুমি কাবাবে হাড্ডি হয়ে হাজির হলে। আবার নতুন করে মিশন শুরু করতে হবে। তুমি পুরাই ফালতু। ”

জয়ের কথা শুনে দপ করে জ্ব’লে উঠল তাহমিদের চোখজোড়া। কপালের একপাশের শিরা তিরতির করে কাঁপছে। দু’হাত মুঠোবদ্ধ করে কঠিন চোখে তাকায় জয়ের দিকে। তাহমিদের লাল চোখ দেখে জয় ভয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল।
বেশ খানিকক্ষণ পর তাহমিদ স্বাভাবিক হয়ে হাত দেয় জয়ের শার্টের কলারে। নিঁখাদ হয়ে থাকা কলার আরও একবার আলতো হাতে ঠিক করে দেয়।

” আমি যে কি সেটা তুই আজও জানিসনা। আমাকে তুই এখনো চিনতে পারিসনি। এত বছর যাবৎ আমার যে রূপ তুই দেখেছিস, সেটা পুরোটাই মুখোশ। আর যাই হোক মুখোশে ঢাকা মানুষের ওপরের রূপটাই শুধু দেখা যায়। তাদের ভেতরে যে কি বা কারা বাস করছে, তা কেবল তারাই জানে। বুদ্ধিমানরা কখনোই কারও ওপরের রূপ দেখে কোন কমপ্লিমেন্ট করেনা। আর আমি চাইওনা আমার রূপ কেউ দেখে ফেলুক। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, যেটা আমার সেটা একান্তই আমার। আমার জিনিসের ভাগ হতে কখনোই দেবনা। ” তাহমিদ জয়ের কলার থেকে হাত সরিয়ে একটা রিক্সা ডাকল।

জয় নিখাঁদ বিস্ময়ে তাহমিদের চলে যাওয়া দেখল। ও তাহমিদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি।

তাহমিদকে এই সময় বাসায় দেখে নায়লা আঞ্জুম কপাল কুঁচকে তাকায়। তাহমিদ তার দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

রাজিয়া খালা টেবিলে খাবার সাজিয়ে তাহমিদের অপেক্ষা করছেন। তাহমিদ আসলে তিনি তাকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন।

জয়ের মা শায়লা হাসান তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

” তাহমিদ, তুমি কখন এসেছ! তুমি তো আমাকে সারপ্রাইজ দিলে! কেমন আছো তুমি? ”

” আমি ভালো আছি, খালামনি। তুমি কেমন আছো? কালকে রাজিয়া খালার কাছে জানতে পারলাম তুমি এসেছ। তাই ছুটি নিয়ে আমিও চলে এলাম। অনেকদিন তোমাদের দেখিনা। ” নির্বিকারচিত্তে বলল তাহমিদ।

রাজিয়া খালা তাহমিদের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন, মানুষ এত নিখুঁতভাবে মিথ্যা কি করে বলতে পারে!
এই ছেলে নাকি ওর খালামনিকে দেখতে রাজশাহী এসেছে!

” তাহমিদ বাজান, তুমি তারাতারি খাইয়া নেওতো। তোমার খাওয়া হইলে আমারে আবার রাতের খাওন করতে হবে। তুমিও নাকি সাহেব বাজার যাইবা? তারাতারি কর। ” রাজিয়া খালা মিছেই তাড়া লাগালেন।

তাহমিদ কিছু না বলে দ্রুতই খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ও রাজিয়া খালার ইঙ্গিত ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

কুহু কোচিং শেষে ক্লাস রুমে বসে চিন্তা করছে। বাসায় যেতে ওর ভয় করছে। জয় ছেলেটা যে মোটেও ভালো নয় এটা কুহু ভালোই বুঝতে পেরেছে। ঐ ছেলের থেকে দূরে থাকতে হবে। ওকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া যাবেনা।

” এই যে চিন্তা রানী, কি এত চিন্তা করছ? আজ কি বাসায় যাবেনা? নাকি আমাকে অপেক্ষা করানোর ধান্দা খুঁজে বেড়াও! ”

কারও গলা পেয়ে চমকে উঠল কুহু। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে তাহমিদ দাঁড়িয়ে।

” আপনি! আপনি এখানে কেন? ”

” হুম আমি। কেন? জয়কে আশা করছিলে বুঝি? ডাকব ওকে? ”

” একদমই না। ঐ অসভ্য লোকটাকে কখনোই ডাকবেননা। ”

” এভাবে দেবদাসীর মত বসে আছ কেন? বাসায় যাবেনা? ”

” হুম যাব। ”

” চল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমার আরেক জায়গায় যেতে হবে। ”

” আপনার সাথে যাব কেন! আমি একাই যেতে পারব। ”

” আমি কি বলেছি, তুমি একা যেতে পারবেনা? আমি শুধু তোমার রাস্তাটুকু নিরাপদ রাখতে চাইছিলাম। তুমিই যখন কন্টকাকীর্ণপথ চাও, তবে আমার কিসের দায় পরেছে তোমার পথের কাঁটা সরানোর। যত খুশি তুমি হাঁটো কন্টকাকীর্ণ পথে। ” তাহমিদ কোচিং থেকে বেরিয়ে আসে।

কুহু বাহিরে এসে দেখল তাহমিদ একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে কথা বলছে। কুহু সোজা গিয়ে রিক্সায় বসল। তাহমিদ প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও পরক্ষনেই মৃদু হেসে রিক্সায় উঠে বসে।

কুহু বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে বসেছে। ও গত দুই দিনে তাহমিদকে দেখে বুঝেছে, মানুষটার কথায় হেয়ালি থাকলেও সে জয়ের মত অসভ্য ধরনের নয়।

রাস্তা এবড়োথেবড়ো হওয়ায় রিক্সায় ভালোই ঝাঁকুনি লাগছে। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসায়, রিক্সার ধারে বারি খাচ্ছে ওর কোমড়, কনুই। কিন্তু ওর করার কিছুই নেই। সামনে আরও এবড়োথেবড়ো রাস্তা দেখে কুহুর ভয় হতে থাকে। এবার নিশ্চয়ই ওর কোমড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। এতদিন অটোতে যাতায়াত করেছে। পাশে কেউ না কেউ থেকেছে। তাতে একটু জড়তা থাকলেও, আজকে একটু বেশিই জড়তা কাজ করছে। কুহু কোন কিছু চিন্তা না করেই রিক্সার হুডের পাশটা শক্ত করে ধরে রাখল।

কিছুক্ষণ পর রিক্সায় ঝাঁকুনি লাগলেও, কুহু অনুভব করল, ওর কোমড় কিংবা কনুই কোথাও ব্যাথা লাগলনা। একটু অনুসন্ধান করতেই বুঝতে পারল, তাহমিদ ওর হাত কুহুর পেছনে দিয়ে রিক্সার হুডের একপাশে ধরে রেখেছে। এ কারনেই ওর ব্যথা লাগেনি!
কুহু অবাক বিস্ময়ে তাহমিদের দিকে তাকায়। সেটাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তাহমিদ সামনে তাকিয়ে আছে। যেন মনযোগ দিয়ে রাস্তার গাড়িঘোড়া দেখছে।

কুহুর এই প্রথমবার মনে হল, লোকটার কথা যতই তিতা হোকনা কেন, তার দ্বায়িত্ববোধ মন্দ নয়।

চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী

পুরোটা পথ কুহু গুটিসুটি মে’রে বসে রইল। তাহমিদও পূর্বের ন্যায় পেছনে হাত রেখে কুহুকে নিরাপদ রাখতে তৎপর।

শেষ বিকেল। উর্ধ্ব অম্বরে লালাভ দিবাকর আঁধারের কোলে ঢলে পড়বার আয়োজনে মত্ত। ঘন সবুজ বৃক্ষরাজির শাখে-প্রশাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিহঙ্গের কলতানে চারপাশ মুখরিত। কুহু মুখ তুলে বিহঙ্গের দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল।

এক প্রেমিক পুরুষের হিয়া এই র’ক্ত রাঙ্গা বিকেলে সদ্য ফোটা হিজলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হলো। সে আঁড়চোখে থেকে থেকেই দেখে চলেছে তার হৃদয়হরণীকে। তার চোখের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছেনা। সে গত দুইমাসের বেশি সময় ধরে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে ক্লান্ত। দূরত্বের অনলে সে জ্বলছে। অপেক্ষার প্রহর আজ তার বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে। তবে তাহমিদ তার শ্যামাঙ্গীনিকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় কাটাতে পারে। সে যতই কষ্ট হোকনা কেন। সে কোন সামান্যতম ভুলের জন্যও তার শ্যামাঙ্গীনিকে হারাতে চায়না। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সূদুরে তাকায় তাহমিদ।

বাসার সামনে রিক্সা এসে দাঁড়ালে কুহুকে নামতে বলল তাহমিদ। কুহু রিক্সা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিক্সাওয়ার সামনে বাড়িয়ে দিতেই তাহমিদ ওর দিকে কটমটিয়ে তাকায়।

” তোমার টাকা দিয়ে তুমি কয়েক হালি হাঁসের ডিম কিনে খেও, গা’ধা মেয়ে। তাতে যদি একটু বুদ্ধি খোলে। টাকা নিয়ে চুপচাপ ভেতরে যাও। ”

তাহমিদের ধমক খেয়ে কুহু সুড়সুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল। ওকে ভেতরে যেতে দেখে তাহমিদ রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বলল।

বাসায় ঢুকতেই রাজিয়া খালা কুহুকে জরুরীভাবে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহু পোশাক পাল্টে খালার কাছে যায়।

” খালা, এত জরুরী তলব কেন? কি হয়েছে? ”

” মাগো, তুমি একটু চিংড়ির মালাইকারী কইরা দিবা? তাহমিদ বাপজান মেলা বাজার কইরা আনছে। সেইগুলান সামাল দিতেই আমার সইন্ধ্যা হইয়া যাইব। বাপে আমার চিংড়ির মালাইকারী পছন্দ করে। দেখ কতগুলা চিংড়ি আনছে! এই টাটকা মাছগুলান যদি না রাইন্ধা তুইলা রাখি, সেইডা কি ভালো দেখায়? ”

খালার কথা শুনে কুহু বেশ অবাক হয়েছে।

” উনি বাজার করেছেন কেন, খালা! ফ্রিজে মাছ-মাংস সবইতো আছে। ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।

” বাপজানে প্রতি সপ্তাহেই বাজর করে। সে রাজশাহী নাইমাই বাজারে যায়। একগাদা বাজার হাতে নিয়া তবেই বাসায় ঢোকে। খালি গত তিনদিন আগে যে আইছিল তখন বাজার নিয়া আসেনি। সেই বাজার পরেরদিন করছিল। আর আইজকা খাইয়া সোজা বাজারে গেছিল। ”

” কিন্তু তিনি বাজার করবেন কেন? ”

” তুমি তারে চেননা, মা। সে কারও দয়া নিবার চায়না। কিংবা এইখানে প্রতি সপ্তাহে আসার জন্য, থাকার জন্য কোন কথা হোক তা সে চায়না। তাই এইখানে আসলে বাজার করে। সে প্রতি সপ্তাহে এই বাসায় একটু শান্তির জন্য আসে। এছাড়া তার নানিমা অসুস্থ। সে আবার নানিমার ভক্ত। নানিমারে না দেইখা সে থাববার পারেনা। আম্মায় বিছানা নেয়ার পর থাইকা পোলাডা খুব কষ্ট পাইতাছে। ”

কুহু খালার কথা শুনে খুব অবাক হয়। ততক্ষণে খালা ওর দিকে চিংড়ির পাত্র এগিয়ে দিয়েছেন। কুহু আর কোন কথা না বলে চিংড়িগুলো কা’ট’তে শুরু করে।

” বেইবি, কখন এসেছ তুমি! তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে আমার হার্ট শুকিয়ে গেছে। সে প্রতি মিনিটে মাত্র দশবার বিট করছে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তারাতারি এসে একটা কিসি দিয়ে আমার হার্টকে স্বাভাবিক করে দাও। ”

এতক্ষণ কুহু দিব্যি জয়কে ভুলে ছিল। হঠাৎ করেই ওর সামনে জয় এসে কথা বলাতে মেয়েটা ভয়ে কেঁপে উঠল। ও দ্রুতই রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে লুকায়। একহাতে ধরে রেখেছে খালার বাহু।

রাজিয়া খালা জয়ের এরূপ কথায় রা’গ করলেও ওপরে ওপরে শান্ত থাকলেন। তবে তিনি কুহুকে রক্ষা করতে ভুল করলেননা।

” জয় বাবা, তুমি এইখানে ক্যা? কি লাগব কও, আর নিজের ঘরে যাও। আমি তোমার ঘরে নিয়া আসতাছি। ”

” খালা, আমার যেটা লাগবে সেটা তুমি দিতে পারবেনা। তোমার আড়ালে দাঁড়ানো ঐ হটি কুইনই পারবে আমার সব সমস্যার সমাধান করতে। তুমি ওকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। ” জয় জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।

” জয় বাবা, তুমি এখনই এইখান থাইকা যাইবা। নইলে আমি কিন্তু তোমার আম্মারে এখনই ডাক দিমু। সাথে তোমার খালামনিরেও ডাকমু। ”

খালার কথায় এবার কাজ হয়। তার কথা শুনে জয় একটু থমকে যায়। সে আর কিছু না বলে কুহুর দিকে অগ্নী দৃষ্টি হেনে প্রস্থান করল।

জয় চলে যেতেই কুহু খালার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে।

” শোন মাইয়া, দুনিয়াডা খুব একটা সহজ জায়গা নয় কইলাম। এখানে টিক্কা থাকতে হইলে তোমারে শক্ত হইতে হইব। অল্পতেই এমন কুঁকড়ে গেলে হইব? তোমার বাপ-মা কেউই নাই। নিজের ছোট ভাইডার দ্বায়িত্ব এখন তোমার উপর। নিজের পাশাপাশি তারেও মানুষ করনের দ্বায়িত্ব তোমার। সেই তুমিই যদি এত অল্পেই ভয়ে পিছায় যাও, তাইলে লড়াই করবা কেম্নে? নিজের মনোবল বাড়াও, মাইয়া। কে তোমার ভালো চায়, আর কে ক্ষতি করবার চায়, প্রথমেই তাগোরে চিনতে শিখ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখ। তুমি লেখাপড়া জানো। ভবিষ্যতে আরও ম্যালা পড়াশোনা করবা। নিজের জীবনকে নিজেই গড়তে পারবা। তাইলে এত ভয় কিসের? আল্লাহর উপর ভরসা আর নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস থাকলে তোমারে উপরে আগায় যাইতে ঠ্যাকায় কার সাধ্যি? ”

কুহু অবাক হয়ে খালার কথা শুনছিল। এক অশিক্ষিত বয়োবৃদ্ধা তাকে এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল! সত্যিই কি ও শক্তিহীনা! নিজের দ্বায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ নয়? সেই সাথে আরেকটা কথা মনে হতেই ওর বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এটা জয়ের নানার বাড়ি। আর সে এই বাড়ির নাতি হিসেবে যখন খুশি তখন এখানে আসবে। আর সে এখানে আসলেই কুহুর সাথে অসভ্যতা করবে। কতদিন ও জয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? আর কিন্তু ভাবতে পারছেনা কুহু। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। আজ আরেকবার বাবা-মা’ র শুণ্যতা ও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।

” দোস্ত, চল বাসায় যাই। মায়া অলরেডি তোর জন্য রান্না শুরু করে দিয়েছে। তুই না গেলে ও মন খারাপ করবে। ”

সজল অনুনয় করছে। কিন্তু তাহমিদ ওর সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ও আপাতত সজলের কথা কানে না নিয়ে ক্যাম্পাসের বৃক্ষদ্বয়ের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু সজলের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও তাহমিদকে নিজের বাসায় নেয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছেই।

” ধুর শা’ লা, তোর কাছে এসেছি একটু রিল্যাক্স করতে। কিন্তু তুই দেখছি আমাকে আরও বেশি প্যারা দিচ্ছিস! বললামইতো আজকে তোর বাসায় যাবনা। কিন্তু তুই আমার কথা না শুনে মায়াকে ফোন করলি। আজকে আমার ভাগের খাবারও তুইই খাস। এতে তোর বউয়ের কষ্ট একটু লাঘব হবে। ”

সজল কিছু বলতে চাইলেই চারপাশে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতেই চুপ করে যায়। দুই বন্ধু মনযোগ দিয়ে আজান শুনছে।

” বাপজান, তুমি এত দেরি কইরা আসলা? এদিকে চিংড়ির মালাইকারি ঠান্ডা হইয়া গেছে। বাজার করবা ঠিকই কিন্তু একবারও গরম গরম খাইবানা। ”

” আরিব্বাহ খালা, তুমি আজকেই মালাইকারি করে ফেলেছ! খালা, তুমি গ্রেট। ” চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢালছে তাহমিদ। তিন ঢোকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল।

” বাপজান, আমি আইজকা রান্ধিনাই। আইজকা কুহু মা’য়ে রান্ধছে। ”

খালার কথা শুনে তাহমিদ বাম ভ্রু উচু করে কুহুর দিকে তাকায়। মেয়েটা তখন ডালে ফোড়ন দিতে ব্যস্ত। ওর অন্য দিকে তাকানোর সময় নেই। ড্রয়িংরুমে রিশা, নিশো, সৃজন হৈ-হুল্লোড় করেছে। তাহমিদ ওদেরকে দেখে মৃদু হেসে খালার সাথে কথা বলতে শুরু করল,

” খালা, আমাকে দিবা? মানে চিংড়ির মালাইকারি। একটু টেস্ট করে দেখতাম কেমন রান্না করে তোমার গা’ধী মা। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর রা’গ হয়। লোকটা বিকেলেও একবার ওকে গা’ধা বলেছে। কুহু ভেবে পায়না লোকটা কেন ওকে কারনে-অকারনে খোঁ’চা দেয়। ওপরে ওপরে লোকটাকে যতটা ভালো মনে হয়, ততটা ভালো সে নয়।

” এই নেও বাপজান, তোমার মালাইকারি। খাইয়া কও কুহু মা’য়ে কেমন রান্ধছে। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের দিকে একটা বাটি এগিয়ে দেন।

তাহমিদ বাটি থেকে একটা চিংড়ি নিয়ে মুখে তুলতে গিয়েই থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে খালার দিকে তাকায়

” খালা, তোমার মা’কে আগে খেতে বল। সে যদি হিংসা করে এতে কিছু মিশিয়ে দেয়? কিংবা দেখা গেল লবন দিয়ে তিতা করে রেখেছে। আমি বাপু আমার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট করতে চাইনা। বরং সে-ই আগে খেয়ে এটার টেস্ট ঠিক আছে কিনা বলে দিক। তারপর নাহয় আমি খাব। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু চরমমাত্রায় অবাক হয়ে খালার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ও মনে মনে তাহমিকদে হাজারটা গালি দিচ্ছে।

” কতবড় বদ হলে একটা মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে! তার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা আছে, যে সে আমাকে এভাবে খোঁ’চা দিচ্ছে? অসহ্য লোক একটা। শাখামৃগ, মুখপোড়া হনুমান। ” কুহু বিরবিরিয়ে তাহমিদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।

” খালা, তাকে ওয়াজ করা বাদ দিয়ে এখানে আসতে বল। সে ওয়াজ পরেও করতে পারবে। মুখের সামনে লোভনীয় খাবার রেখে বসে থাকা কত যে কষ্টের সেটা শুধু আমিই জানি। ”

” খালা, উনাকে বলে দিন আমি এখন কিছুই খাবনা। প্রয়োজনে আপনি খেয়ে তাকে বলুন সব ঠিক আছে কিনা। ” কুহু গলা চড়িয়ে বলল।

” পা’গ’ল নাকি! খালা, যে রান্না করেছে, সে-ই আগে টেস্ট করবে। কেউ যদি আমার কথা না শোনে, তবে কিন্তু আমি তাকে জোড় করে খাওয়াব। এটাই ফাইনাল। ”

” ও মা কুহু, একটা খাইয়া দেখনা। বাপজানের কথা শুন। ”

রাজিয়া খালার জোড়াজুড়িতে কুহু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসল ডাইনিং টেবিলের কাছে। তাহমিদের সামনে থেকে বাটি নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা চিংড়ি হাতে তুলে নেয়। চিংড়িটা মুখে দেয়ার আগে একবার তাকালো ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সৃজনের দিকে।

কোনরকম চিংড়িটা খেয়ে রান্নাঘরে যায় কুহু।

” খালা, উনাকে বলুন তরকারিতে লবন পরিমান মতই হয়েছে। তিনি নির্দিধায় খেতে পারবেন। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ স্মিথ হেসে ডাক দেয় রিশা, নিশো আর সৃজনকে।

” খালা, বাটিতে আরও কয়েকটা চিংড়ি দাও। আমার ব্যাটেলিয়নরা টেস্ট করলেই তবে আমি খাব। ”

ওরা তিনজন ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই খালা ওদের সামনে মালাইকারির বাটি রাখল।

কুহু আরও একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের সুদর্শন মানুষটার দিকে। এই মানুষটাকে চেনা বড় দায়। এই মনে হয় সে চুড়ান্তমাত্রার অসভ্য, তো পরক্ষণেই মনে হয় এটা তার আসল রূপ নয়। সে আসলে নিজেকে যেমনভাবে উপস্থাপন করে তেমনটা সে মোটেও নয়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে