প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১১

0
679

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১১)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রত্যেকটা মানুষের মনে এক সুপ্ত বাসনা থাকে। যা চাইলেও মানুষ হেলাফেলা করতে পারে না, অবজ্ঞা করতে পারে না। দৈহিক চাহিদার পাশাপাশি প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক চাহিদা রয়েছে। একবার ভেবে দেখুন, আপনি অত্যন্ত সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করলেন। মেয়েটি যেন এক সৌন্দর্যের উজ্জল দৃষ্টান্ত। এত সুন্দর মেয়ে জগতে খুব কমই আছে। আপনি মেয়েটিকে জীবন সঙ্গী করতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করেন। শারীরিক দিক থেকে আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট। তার এই সৌন্দর্যে বারংবার মুগ্ধ হন আপনি। এমন সুন্দর স্ত্রীকে পেয়ে আপনি ধন্য। তার রুপে মাতাল হন প্রতিনিয়ত, গর্ব করেন। কিন্তু সে আপনার মন খারাপ বুঝে না, আপনার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাকে গুরুত্ব দেয় না, খারাপ সময়ে পাশে এসে সান্ত্বনা মূলক বাণী ছুঁড়ে দেয় না কিংবা সহানুভূতি দেখায় না, আপনার পছন্দের জিনিসগুলোর প্রতি সচেতন না। তখন আপনার কেমন লাগবে? শারীরিক ভাবে সন্তুষ্টি পেলেও ওইযে মানসিক সন্তুষ্টি, ওটা থেকে আপনি বিরত রইবেন। একান্ত বাধ্যগত সঙ্গীর অভাব রোজ আপনাকে তাড়া করবে। তখন আপনি বুঝতে পারবেন একজন সুখ দুঃখের সঙ্গী কতটা প্রয়োজন, একজন কেয়ারিং পার্টনার পাওয়া কতটা ভাগ্যের।

এখন সকাল আটটা বেজে দশ মিনিট। অপরিচিত এক এলাকায় এসেছে ইহান আর তানিয়া। জায়গাটার নাম হবিগঞ্জ। মৌলভীবাজার থেকে অনেকটাই দূরে। প্রহরকেও এখানে আসার জন্য জোর করেছিল তানিয়া। কিন্তু প্রহরের কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি সে। অগত্যা ইহানকে নিয়েই এতদূর এসেছে তানিয়া। এখানে এর আগে তানিয়া একবারই এসেছিল খুনের কেস সামলাতে। তদন্ত করতে গিয়ে এক মহিলার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ইহানের। মহিলাটির নাম তাসলিমা খাতুন। খুনের সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তিনি খুনিকে ভালো মতো দেখেও ছিলেন। মুখ খুললে বিপদ হবে জেনেও তাসলিমা খাতুন জবান খুলেছিলেন। আদালতে কাঠগড়ায় সত্য কথা বলেছিলেন। অতঃপর খুনি খুব সহজেই ধরা পরেছিল প্রহরের টিমের হাতে। তাসলিমা খাতুনের সাথে প্রহর আর তানিয়ার ও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে ইহানের সাথে সম্পর্ক একটু বেশিই ভালো ছিল। কেননা ইহান প্রায় সময় এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে এখানে তাসলিমা খাতুনের সাথে দেখা করতে আসতো।

এতক্ষণ খুব সাহসের সাথে পুরোটা পথ এসে তাসলিমা খাতুনের বাড়ির দরজার সামনে এসে সব সাহস নিভে গেল তানিয়ার। এই প্রথম হয়তো কোন চব্বিশ বছর বয়সী পরিপক্ক, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তার বাবার জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে। বিষয়টা খুবই অদ্ভুত। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে। তাসলিমা খাতুন ডিভোর্সি। সন্তান জন্মদানে অক্ষম বলে বিয়ের সাত বছরের মাথায় উনার স্বামী উনাকে ডিভোর্স দিয়েছিল। এরপর উনি প্রতিজ্ঞা করেন প্রতিষ্ঠিত হবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তার পর বিয়েসাদির কথা ভাববেন। এ সবই ইহানের মুখে শুনেছে তানিয়া। তাইতো বাবার জীবন সঙ্গী হিসেবে তাসলিমা খাতুনকে নির্বাচিত করেছে। তাসলিমা খাতুন বিজনেস করেন। মিষ্টির বিজনেস। এ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তানিয়ার। তবে শুনেছে তাসলিমা খাতুন বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু মিষ্টি তৈরী করেন। বড়সড় একটা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার তৈরী করেছেন তিনি। উনার দোকানের বেশ নামডাক রয়েছে এলাকায়।

ইহান দরজায় মৃদু টোকা দিল তিনবার। তাসলিমা খাতুন শৌখিন মানুষ। বাড়ির দু পাশে বিভিন্ন ফুলের টপ বসিয়েছেন তিনি। আশপাশ ঝকঝকে পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন। তিনবার টোকা দেওয়ার পর তিনি দরজা খুললেন। তাসলিমা খাতুনের পরণে ঢিলেঢালা কামিজ। মাথায় পরিপাটি করে ওড়না নেওয়া। দরজা খুলে ইহানকে দেখে হাসলেন তিনি। তানিয়া আর ইহান সালাম দিল। সালামের উত্তর নিয়ে ঘরে আসতে বললেন দুজনকে। তার তৈরী মিষ্টি দিলেন খেতে। তানিয়া আসল কথাটা বলতে অসস্তি বোধ করছে। কিভাবে কি বলবে ঠাহর করতে পারছে না। ইহান বুঝল তানিয়ার ভাবাবেগ। একটু হেসে তাসলিমা খাতুনকে জিজ্ঞেস করলো,

” ভালো আছেন আন্টি?

তাসলিমা খাতুন নিজেও সামনের সোফাতে বসলেন। হাসি মুখ করে বললেন,

” ভালো আছি। তোমাদের কি খবর? সবকিছু কেমন চলছে? শুনলাম বড় একটা কেস ডিশমিশ করেছো

” এইতো চলছে। ঠিকই শুনেছেন

” অনেকদিন পর এলে। কিছু হয়েছে?

ইহান তানিয়ার দিকে তাকাল। চোখ দিয়ে আসস্ত করলো। তানিয়া বুঝতে পারল তার নাক ঘামছে। মহিলার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মনোভাব জেগে উঠছে। হাসিখুশি থাকলেও তাসলিমা খাতুন তার কথা শুনে কেমন রিয়্যাক্ট করবে ভেবেই ভয় হচ্ছে। তানিয়া সামনে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি পান করল। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দ্বারা। নার্ভাসে হাত পা থরথর করছে তানিয়ার। তবুও নিজের ভয়কে দমিয়ে তানিয়া বলে উঠল,

” আমরা এসেছি আমার বাবার পক্ষ থেকে আপনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। শুনেছি আপনার বাবা-মা থাকেন গ্রামে। আপনি এখানে একাই থাকেন। যেহেতু আপনি পরিপক্ক, বুঝদার মানুষ এবং আপনার ইচ্ছেকেই আপনি সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেন তাই এই প্রস্তাব নিয়ে আপনার কাছেই এলাম।

তাসলিমা খাতুন অবাক হলেন কি না তা বোঝা গেল না। মিষ্টি গুলো খাওয়ার জন্য দুজনকে তাড়া দিলেন তিনি। দুজন মিষ্টি থলে নিল মুখে। মিষ্টিগলো খেতে সত্যিই মজাদার। তাসলিমা খাতুন স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,

” আমার সমস্যা নিশ্চয় জেনেই এসেছো। আমার স্বামী রায়হানের সাথে আমার প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়ের সাত বছরেও আমি তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারিনি। যেজন্য সাত বছরের মাথায় আমাদের ডিভোর্স হয়। আমি তখন গৃহিণী ছিলাম। আব্বা-আম্মার সহায়তায় আমি বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সামলিয়ে উঠেছিলাম এবং স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি অনেক কষ্ট করে। সবারই জীবন সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার আছে। একবার ডিভোর্স হয়েছে বলে সারাটা জিবন একা থাকবো এমন সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। আমি চেয়েছি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই জীবন সঙ্গী বেছে নিবো। কিন্তু দোকান দাড় করানোর পর আমি আমার মনের মতো কাউকে খুঁজে পাইনি। হয় লোকটা আমার দোকানকে ভালোবেসেছে, নয়তো প্রস্তাব দেওয়া ব্যক্তি নিজের স্ত্রী কে কোনো কারণে ডিভোর্স দিয়েছে, নয়তো দেখা গেছে প্রস্তাবকারীর কোন বড়সড় দোষ আমার সামনে এসেছে, যা আমি মানতে পারিনি। এসব দেখতে দেখতে বয়স অনেকটাই চলে গিয়েছে। কতন স্বচ্ছ, পরিষ্কার ভালো মানুষ আমার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসেনি কারণ আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এখন সবটা বেমানান। এখন আর..

তানিয়া শুনল। ঝটপট বলে উঠল,

” শেষ বয়সে এসে একটা সুন্দর সংসার আপনি চান না? অবশ্যই চান তবে সেটা প্রকাশ করেন না। আমরা নারীরা ভালোবাসার কাঙ্গাল। এইযে আপনি! আপনার বয়স হয়েছে মানছি। কিন্তু অবশ্যই আপনি চান এমন একটা পুরুষ, যে আপনাকে একজন যুবতীর নজরে দেখবে, কম বয়সী পুরুষদের মতো আপনার সাথে দুষ্টুমি করবে, পাগলামো করবে, আপনার জন্য ভাববে, অনেক আগের সময়ে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, একটা শান্তির জীবন প্রদান করবে এবং আপনার গল্প শোনাল সঙ্গী হবে। কি তাইতো? দেখুন আমি আমার বাবার বিয়ে দিতে চাই। বিষয়টা হাস্যকর হলেও সত্য। আমার আম্মু মারা গিয়েছেন জ্বরের ঘোরে। আমার তখন দশ বছর বয়স। আমার বাবা আমার আম্মুর সাথে সংসার করেছে এগারো-বারো বছর। আম্মু মারা যাওয়ার পর বাবা আর বিয়ে করেনি আমার কথা ভেবে। আমিও আর ঘাটাইনি। কিন্তু এই বয়সটাতে বাবাকে খুব একা লাগে। আমার মনে হয় এখন বাবার কাউকে প্রয়োজন। আমার বাবা একজন বিচক্ষণ, দক্ষ উকিল। বর্তমানে সে কলেজে পড়ায়। বাবার অবসর সময় কাটে বই পড়ে। এইযে আমাকে দেখছেন, আমার বয়স চব্বিশ। বাবা এখন ও অবধি আমাকে বিয়ে করার জন্য জোর করেননি। কারণ বাবা নারীদের সম্মান করেন। যে সকল নারী স্বপ্ন দেখে বাবা তাদের একটু বেশিই সম্মান করে। কারণ স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে না। আমি আমার বাবার হয়ে এখানে এসেছি। অবশ্যই বাবার সাথে আপনি দেখা করবেন, খোঁজ খবর নিবেন এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন। আমি আমার আম্মুর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না। কিন্তু আব্বুর লাইফ পার্টনার হিসেবে আমি আপনাকে অবশ্যই মানবো এবং ভালোওবাসবো। আপনার স্থান বাবার পরেই সর্বদা থাকবে। এখন আপনি ভেবে বলুন।

পুনরায় তানিয়া বললো,
” ইহান স্যার আমাকে জানিয়েছে আপনি বিয়ে করতে চান। ডিভোর্সি বলে নিজেকে সারাজীবন একা রাখবেন এমন মনোভাব আপনার নেই। তাই আপনার কাছে এসেছি।

তাসলিমা খাতুন হেসে উঠলেন। তানিয়াকে তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা সুন্দর, যথেষ্ট সুন্দর। চশমা পরা চোখে এক আলাদা মায়া আছে। দেখলেই মেয়েটাকে আদর করতে ইচ্ছে হয়। তানিয়ার মতো মনোভাব সবার হয় না। মিষ্টি স্বরে তিনি বললেন,

” আমি ভেবে জানাবো। তোমার আব্বুকে বলো আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই।

__________________

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িটির দিকে ফিরল ইহান আর তানিয়া। তানিয়ার খুব ভালো লাগছে নতুন মা খুঁজতে আরম্ভ করেছে বলে। তানিয়া হাসিখুশি মুখে ফ্রন্ট সিটে বসল। ইহান বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে করতে বললো,

” আজ তুমি ড্রাইভ করো তানিয়া।

তানিয়া বিস্মিত হলো। ইহান বা প্রহর দুজনের কেউই তানিয়াকে ড্রাইভ করতে দেয় না। সবসময় নিজেরাই ড্রাইভ করে। আজ ইহানের এমন কথায় তানিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। বা চোখের উপরে থাকা ভ্রু উঁচু করে বললো,

” আমি? আপনি ড্রাইভ করবেন না?

” মাথা ব্যথা করছে। এতটা পথ আমি বোধহয় ড্রাইভ করতে পারবো না। হ্যাঁ পারতাম, যদি তানিয়া শেখ নামক দক্ষ পুলিশ অফিসার আমার সাথে না থাকতো। সে তো ড্রাইভ করতে পারে। কেন এত ঝামেলা নিবো?

ইহানের মুখে নিজেকে দক্ষ বলে দাবি করায় চোখ মুখ উজ্জল হলো তানিয়ার। প্রশংসা শুনে গাল দুটো লাল হলো তার। ইহান আর প্রহরের মুখে প্রশংসা শোনা ছোটখাটো বিষয় না। যে কেউ এই প্রশংসা শুনতে পায় না। তানিয়া শুনতে পেরেছে এটা তার পারদর্শীতার জন্য।
তানিয়া বললো,

” এখান থেকে সদর অনেক দূর স্যার। এতক্ষণ মাথা ব্যথা নিয়ে থাকা উচিত নয়। সামনেই তো একটা ক্যাফে আছে। চলুন ওখানে গিয়ে কফি খাবেন। একটু ভালো লাগবে।

হাসল ইহান। চমৎকার বাঁকা হাসি। দুষ্টুমির স্বরে বললো,

” অফার করছো?

খিলখিল করে হেসে উঠল তানিয়া। নজরা কাড়া হাসির ঝংকারে ইহান তাকিয়ে রইল কয়েক পল। নিদারুণ এক ব্যথায় চিন চিন করে উঠল ইহানের বক্ষস্থল। তানিয়া ঠোঁট নেড়ে বললো,

” ভুলে যাবেন না আপনি সর্ব প্রথম আমার বন্ধু ছিলেন। আমরা ট্রেনিং এ থাকাকালীন বন্ধুদের ন্যায় আচরণ করেছি। এরপর এক বছর পর আমি আপনার কলিগ হয়েছি। এখন কিন্তু আমরা নিজেদের প্রফেশনে নেই। আমাদের গায়ে পুলিশের ইউনাফর্ম নেই। তাই ক্যাফেতে বসাই যায়।

” তোমার উড বি মাইন্ড করবে না? জানলে জেলাস হবে না?

” উনি আপনার কথা জানে। জানে আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন এবং আছেন। আমি তো কোন ভুল করিনি। আর আমি এমন কিছুও করছি না যাতে উনার খারাপ লাগে। তাই ভয় পাচ্ছি না।

তানিয়া ড্রাইভিং সিটে বসল। পাশে বসল ইহান। ইহান খুব করে চাইল সময়টা ওই ক্যাফেতে থমকে থাকুক। কাউকে খুব নিবিড় ভাবে দেখার তৃষ্ণা মিটুক। কিন্তু তা কি সম্ভব? সময় কারো জন্য থেমে থাকে? উহু! সময় তার নিজের মতোই চলে। কারো জন্য সময় আটকে থাকে না। এই পৃথীবীতে সবচেয়ে স্বার্থপর হলো সময়। এর মাঝে কোনো দয়া-মায়া নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ একটা বিশেষ সময়ে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে চাইতো। আর সময় তাকে সেই সুযোগটা দিতো।

আধঘন্টা বাদেই ক্যাফেতে প্রবেশ করলো ইহান আর তানিয়া। ক্যাফের বাইরেটা ফুলে সজ্জিত। নজরকাড়া ডেকোরেশন। তানিয়া আর ইহান মাঝের টেবিলটাতে বসল। তানিয়া আর ইহান দুজনেই ব্ল্যাক কফি নিল। খুব দ্রুতই কফি চেলে এলো টেবিলে। ইহান কফিতে চুমুক দিতে দিতে আশপাশে নজর বুলাল।

তানিয়া বললো,

” কেমন কফিটা?

” দারুন। তবে এর চেয়ে আমি বেশি ভালো কফি বানাই।

” তা ঠিক।

” তানিয়া, আমার মনে হয় তাসলিমা আন্টি তোমাকে ভিষণ পছন্দ করেছেন। উনি তোমার কথাবার্তা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। আমি নজর দিয়েছি বিষয়টাতে। হয়তো তোমার জন্য হলেও এই বিয়েতে রাজি হবেন। উনার ভাবনা আর তোমার ভাবনা অনেকটাই মিলে।

” হতে পারে। আমার ও উনার কথাবার্তা আগেই থেকেই ভালো লাগে। আগে এইভাবে ভাবিনি বলে উনাকে ওইভাবে দেখিনি,বুঝিনি।

এই ক্যাফেটা চমৎকার। নানা ধরনের পেইন্টিং করা দেয়ালে। হরেক রকমের লাইটিং। ফুল দিয়ে টেবিলটা সাজানো হয়েছে। ক্যাফের মাঝখানে একটা মেয়ে গিটার হাতে গান গাইছে। এটা মূলত করা হয় কাস্টমারদের আকর্ষণ করার জন্য। অনেকে গান শুনতেও এখানে আসে বোধহয়। গান গাওয়া মেয়েটার পোশাকআসাক মার্জিত হলেও বুকের অর্ধাংশ খোলামেলা। ওড়না ঠিক স্থানে নেই। ছোট ছোট কাঁধ অবধি কালার করা চুল। মেয়েটা হিন্দি গান গাইছে। ইহান নজর ফেরাল মেয়েটার পোশাক দেখে। বা দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু লোক তাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। তানিয়া আর তাকে দেখে কেমন ভাবে যেন দেখছে। কানাকানিও করছে বোধহয়। ইহান উচ্চস্বরে হেসে উঠল হঠাৎই। সবাই তাকাল ওর দিকে। শব্দ করে কফিটা টেবিলে রাখল ইহান। ভ্রু কুঁচকাল তানিয়া। এভাবে হাসছে কেন লোকটা? কি হলো? তানিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

” হাসছেন কেন স্যার?

ইহান থামল। তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল তানিয়ার দিকে। বললো,

” তুমি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন-এর “কেউ কেউ কথা রাখে” বইটি পড়েছো?

” না তো। হঠাৎ এই কথা কেন?

” উনি এই বইটাতে লিখেছেন,- “আপনি যদি দেখেন কোনো সুন্দরির সাথে বসে আপনি আড্ডা দিচ্ছেন আর লোকজন আপনার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাচ্ছে তখন ভালো না লেগে উপায় নেই। চারপাশে ঈর্ষণীয় চোখের চেয়ে সুখের বস্তু আর কী আছে”? দেখো আমাদের আশপাশের মানুষ আমাদের কেমন আড়চোখে দেখছে।

তানিয়া অবাক হলো ভিষণ। অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসল। বললো,

” আপনি কী আমাকে ইনডিরেক্টলি সুন্দরী বলছেন?

” ডিরেক্টলিই বলছি, তুমি সুন্দর। এটা তো সবাই জানে। এটাতে লুকোচুরি করার মানে নেই।

” আপনার কাছ থেকে শুনতে বেশি ভালো লাগল কেন জানেন? আপনি সহজে কারো প্রশংসা করেন না। হয়তো করেন তবে মনে মনে। আপনি নিজের মনের কথা প্রকাশ করেন না। আই মিন কারো প্রশংসা করেন না, হম্বিতম্বি করেন। আপনি যার প্রশংসা আপনি সরাসরি/ সামনাসামনি করেন সে খুব লাকি। এই যেমন আমি।

______________

যে শহরে দুর্নীতির বাস সে শহরে আর যাই হোক উন্নতি সম্ভব নয়। আজকাল প্রকাশ্যে দুর্নীতি চলছে। সাধারণ মানুষজনের এ নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। বলতে গেলেই প্রাণ নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগতে হবে। ন্যায় বিচার চেয়ে পুলিশের কাছে গেলে প্রথমেই টাকা ছুঁড়তে হয়। এজন্য অনেক মানুষই থানায় আসার সাহস পায় না, জিডি করার সাহস হয় না সবার। ন্যায় বিচার কথাটা ভাবলে প্রথমেই বলতে শোনা যায় ” পুলিশের পিছনে দৌড়াতে হবে, অনেক টাকা ঘুষ দেওয়া লাগবে, অনেক সময় লাগবে বিচার পেতে, ঘুরঘুর করতে হবে এদিক সেদিক। অথচ এরকম কথা কোনোকালেই ছিল না। কথা ছিল পুলিশ জনগনকে নিরাপত্তা দিবে। দেশের সকল অন্ধকার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেশকে উন্নতির শিখড়ে পৌছে দিবে।

এগারোটার দিকে প্রহর ও তার টিমকে সম্মাননা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিসের সম্মাননা পাবে ওরা? জাফর আলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আজ সকালেই। জেল থেকে বেরিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে লোকটা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রহরকে বলা হয়েছে “উপর মহল জাফরকে ছেড়ে দিতে আদেশ দিয়েছে”। প্রহর উপর মহলের লোকেদের কল করলে তারা ভণিতা ছাড়াই বলে দিল ” লোকটার অনেক ক্ষমতা। নেতা, মন্ত্রীর সাথে হাত আছে, ওদেয সাথেই ওঠাবসা করে। কোনোভাবেই লোকটাকে জেলে আটকে রাখা যাবে না। পুরো পুলিশ টিমকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এই জাফর”। প্রহর এ উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ অপরাধীর ভয়ে পুলিশদের ঘরে বসে থাকতে হবে? তাহলে তারা কোন বা* এর পুলিশ?অপরাধী বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে হাঁটবে আর পুলিশ সেই অপরাধীর আক্রমনের ভয় চুপচাপ অন্যায় সহ্য করে যাবে? সমাজের মানুষ তবে দৃঢ় বিশ্বাস করে নিবে পুলিশ বলতে আসলে কোনো সৎ পেশা নেই।

জাফর তার কোম্পানির বিভিন্ন পন্যে ক্ষতিকর দ্রবণ ব্যবহার করে। এসকল খাবার গ্রহনের মাধ্যমে কতশত মানুষ ধীরে ধীরে প্রাণ হারিয়েছে কে জানে? অথচ সব প্রমাণ থাকা সত্বেও জাফরকে ছেড়ে দেওয়া হলো। প্রহরদের বলা হলো একদম গোপনে সম্মাননা প্রদান করা হবে ওদের। এটা আদৌ সম্মানের? আসামীকে শাস্তি দিতে পারেনি এটা কি খুব গর্বের? কেন সম্মাননা নেবে তারা? সাধারণ মানুষের প্রতি এত বড় অবিচারের জন্য অপরাধীকে যদি ভুগতেই না হয় তবে এই সম্মাননা গ্রহণ করবে কিভাবে? এ তো একটা অপমান। আসামীকে শাস্তি যদি দিতেই না পারে তাহলে সম্মাননা কেন নিবে তারা? এটার যোগ্য তো তারা নয়। তাদের আসামীর ভয়ে বসে থাকতে হচ্ছে হাত গুটিয়ে।

থানার বাইরে তানিয়া, ইহান আর প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মন মেজাজ খারাপ। এত দ্রুত জাফর ছাড় পেয়ে যাবে ভাবেনি ওরা। সবটা কেমন ঘোলাটে লাগছে। এত এত কষ্ট বৃথা গেল তাদের। ইতিশা ম্যামের সন্তানের খোঁজ পাওয়া গেল না এখনো। জাফরকে যে ধোলাই দিয়ে কথা বের করবে এমন সুযোগ ও পায়নি তারা। তার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। সব প্রমান হুট করেই গায়েব হয়ে গেল। এতে তো পুলিশেরই দোষ। আদালত কিভাবে রায় দিল। কিভাবে কি হলো সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে প্রহরের। নিজেদের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে সবার। ক্ষোভ নিয়ে প্রহর বললো,

” কিসের সম্মননা দিতে চাচ্ছে হ্যাঁ? অপরাধী ছাড় পেয়েছে বলে? মনে হচ্ছে আমরাই অপরাধী, আর জাফর পুলিশ। পুলিশের চেয়েও বেশি ক্ষমতা নিয়ে ঘুরছে ব্যাডা। কি আজব ব্যাপার। এমনটা হবে কখনো ভেবেছি? ক্ষমতাই কি সব কিছু? খুলে ফেলবো এই ইউনিফর্ম?

তানিয়ার কান্না পাচ্ছে কেন যেন। জাফরের কোনো শাস্তি হলো না। এত এত কষ্ট বৃথা গেল। কোনোকিছু করেই লাভ হলো না। তারা এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছে যে নিজেদের বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। কত্ত মানষ তাদের উপর ভরসা করে রয়েছে। ইতিশা ম্যাম আশায় বুক বেঁধে আছে। সবার কাছে কি জবাব দিবে তারা। চশমা ঠেলে নাক টানল তানিয়া। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে নিল সন্তর্পণে। বললো,

” আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ইতিশা ম্যাম এত ভরসা করেছিলেন আমাদের। আমরা এসবের যোগ্য নই। কিছুই হলো না।

ইহান তানিয়ার ইমোশনাল হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হলো খানিক। বললো,

” কাঁদবে না তানিয়া। এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে পারি না আমরা। নতুন ভাবে সবটা শুরু করতে হবে। ওকে এমন ফাঁদে ফেলবো, এমন কেসে ফাঁসাবো যে ওর বাপ এসেও ওকে ছাড়াতে পারবে না। আর যদি ছাড়া পায় ও, জনগন ক্ষেপে ইট ছুড়ে মারবে ওকে। সমাজে মুখ দেখিয়ে চলতে পারবে না।

প্রহর বললো,

” কি করতে চাইছিস? আমার কাছে প্ল্যান আছে। ওর অবস্থা যদি খারাপ করতে না পারি আমার নাম ও প্রহর না। ওকে ধরতে না পারলে আমি এই চাকরি ছেড়ে দিবো।

ইহান বললো,
” তুই যেটা ভাবছিস আমিও সেটাই ভাবছি। তুই তোর পরিকল্পনা আমাদের সাথে শেয়ার কর। আমরা তিনজন মিলে কিছু একটা করবোই। হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না।

প্রহর বললো,

” আই থিংক প্রিয়তা কোনো না কোনো ভাবে এই মামলায় জড়িয়ে পরবে। ওকে সেভ করতে হবে। মেয়েটা তো একদম নির্দোষ। প্রিয়তার কিছু হলে আরহাম ভেঙে পরবে। আমি মেয়েটার কিছু হতে দিতে পারি না। জাফরের নজর থেকে ওকে বাঁচাতে হবে। উফফফ কি যে হচ্ছে আল্লাহ্। হেল্প আস।

_______________

শুক্রবার দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে প্রিয়তা। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। প্রিয়তা উঠল দেরি করে। ফোনের পাওয়ার বাটন অন করে সময়টা দেখল প্রিয়তা। এগারোটার বেশি বাজে। আরহাম ঘরে নেই। হয়তো মাঠে গিয়ে খেলছে, নয়তো ছাদে বসে আছে।

প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে বিছানা ঠিক করলো। ঘরের মেঝেটা ঝাড়ু দিল। চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে গোসল করে নিল। চুলে গামছা বেঁধে রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘরে পটল আর আলু আছে। প্রিয়তা আলু ভাজি করতে চাইল। বিপত্তি বাঁধল আলু চিকন চিকন করে কাটতে গিয়ে। কোনোভাবেই চিকন করে কাটতে পারছে না। মোটা মোটা হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা তবুও কেটেই গেল। মোটা মোটা হওয়া আলুর টুকরোগুলো পুনরায় চিকন চিকন করে কাটল। আলু কাটতে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিল প্রিয়তা। পটল ভাজা আর আলু ভাজি করলো। আরহামকে ডাকার আগে নাকের নতুন নোস পিন পরে নিল প্রিয়তা। গায়ে তার অ্যাশ রঙের কামিজ। চোখে কাজল নিয়ে একটু পরিপাটি হলো সে। মাথা থেকে গামছা খুলে ছাদে ছড়িয়ে দেবে ভাবল।

আরহামকে ডাকতে ছাদে উঠল প্রিয়তা। ওদিনের পর ও ঘরের কারো সাথেই কথা বারণ ছিল আরহামের। তবে নিধি আর প্রহরের সাথে প্রিয়তা নিজেও এখন একটু আধটু কথা বলে। তাকে সন্দেহ করে ধরে নেওয়ার পর প্রহরের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়েছে প্রিয়তার। প্রিয়তা ছাদের এক পাশে আরহাম আর প্রহরকে দেখল। সেদিনের মতো একটা চেয়ারে দুজন বসে ফোনে গেম খেলছে ওরা। সেদিন আরহামের গায়ে শার্ট বা গেঞ্জি ছিল না। আর আজ প্রহরের গায়ে কাপড় নেই। ছেলেটার পরণে শুধু হাফ প্যান্ট। প্রহরের লোমশ বুকটা উন্মুক্ত। প্রিয়তা খানিক অপ্রস্তুত হলো। নিধির কাছে গতকাল শুনেছে জাফরকে ধরার জন্য প্রহরকে এওয়ার্ড টাইপ কিছু দেওয়া হবে। এওয়ার্ড দেওয়ার সময় তো এখনই বলেছিল নিধি। তাহলে প্রহর বাড়িতে কেন? প্রশ্ন এলো প্রিয়তার মনে। এগিয়ে এলো সে। আরহামের সম্মুখে গিয়ে চুল থেকে গামছা খুলে নিল। গামছা দিয়ে চুলগুলো ঝেড়ে গামছা ছড়িয়ে দিল দড়িতে।

আরহামের উদ্দেশ্যে বললো,
” চলো আরহাম। সকাল থেকে খাওনি। রান্না করেছি। চলো খাবে।

আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে প্রহরকে দেখল। একটু ভয়ে ভয়ে বললো,

” আমি খেয়েছি আপু। প্রহর ভাইয়া আমাকে বিরিয়ানি খাইয়ে দিয়েছে।

প্রিয়তা কেমন করে যেন তাকাল। একটু রাগ হলো আরহামের প্রতি। রুক্ষ স্বরে প্রহরের দিকে চেয়ে বললো,

” আজ শুক্রবার। নাবিলা আন্টিই রান্না করেছে তাইনা? তাই খেতে দিয়েছেন ওকে? আমাদের কি এতটাই গরীব মনে হয়?

প্রহরের চুলগুলো বড় বড়। কপালের খানিক অংশ চুলে ঢেকে থাকে। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। নাকের নিচেও হালকা গোঁফের অস্তিত্ব দেখা দিচ্ছে। প্রিয়তার চুল ঝেড়ে গামছা দড়িতে রাখা অবধি সবটাই পর্যবেক্ষণ করছিল সে। প্রিয়তার সদ্য গোসল করা স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছিল প্রহরের। হঠাৎ এমন রুক্ষ স্বরে এমন কথা বলতে শুনে কিছুটা রাগ হলো প্রহরের। শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রিয়তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

” তানিয়া আমি আর ইহান রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। আরহামকে আমি ভালোবাসি প্রিয়তা। ভাবলাম ওর জন্য এক প্যাকেট নিয়ে যাই। এখানে ধনী গরীবের কি হলো? মায়ের রান্না করা খাবার আমি আরহামকে দিবো ভাবলেন কি করে?

” কিন্তু আমি যে দুজনের জন্য রান্না করে ফেলেছি। ওগুলো খাবে কে? আপনি আমাকে আগে বলবেন না?

আরহাম ছোট ছোট চোখ করে চাইল। প্রিয়তার চুলের আগা দিয়ে পানি ঝরছে। নাকের ডগায় পানি চিকচিক করছে মুক্তোর মতো। পানি ঝরে জায়গাটা একটু ভিজেই গেছে। প্রহর আনমনে বলে উঠল,

” বিরিয়ানি খেয়ে জিভটা কেমন হয়ে গেছে। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। আরহামের খাবারটা না হয় আমাকেই দিন। কি রেঁধেছেন?

” পটল ভাজা আর আলু ভাজি। অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করে বললো প্রিয়তা।

” আমার জন্য নিয়ে আসুন।

প্রিয়তা ভারী অবাক হলো। তার হাতের রান্না পুলিশম্যান মুখে তুলতে পারবে? এমন আবদার করার কোনো মানে আছে? প্রিয়তা চলে যেতে উদ্যত হলো। প্রহর পিছু থেকে বললো,

” মা কে সবটা বলে দিয়েছেন? দু মাস পর নাকি চলে যাচ্ছেন।

থমকাল প্রিয়তা। পিছু ঘুরে বললো,
” যেতে তো হবেই। আন্টি আমাকে রাখবে না। ব্যাচেলর মেয়ে ভাড়া দেন না উনি।

” আমি মা কে বুঝাবো।

” তার প্রয়োজন নেই। আপনার আজ সম্মাননা পাওয়ার কথা না?

“হ্যাঁ নেইনি।

” কেন?

” কারণ এর যোগ্য আমি নই। জাফর ছাড়া পেয়ে গেছে ক্ষমতার কারণে।

প্রিয়তা অবাক হলো। খারাপ লাগল বেশ। আর কিছু বলে প্রহরের মন খারাপ করার ইচ্ছে হলো না। চলে এলো সেখান থেকে।

_______________

মার্কেটে এসেছে আরহাম আর প্রিয়তা। শুক্রবার বলে আজ অনেক ভিড়। প্রিয়তার মনে হচ্ছে দুদিন আগেই শুক্রবার গেল। দুদিন আগেই এত টাকা খরচ করে মাংস ভাত খেল দু ভাইবোন। এর মাঝে আরো ছয়টা দিন কেটেছে একদমই স্বাভাবিক ভাবে। মার্কেটের পুরো জায়গা জুড়ে মানুষের ছড়াছড়ি। প্রিয়তা প্রথমেই বাচ্চাদের খেলনার দোকানে গেল। সব ধরনের ব্যাট মিন্টন রয়েছে দোকানটাতে। আরহাম ছোট বিধায় আর সেভাবে খেলতে পারে না বলে খুব কম দামি ড়্যাকেট কিনল প্রিয়তা। আরহামের হাতে একটি চিপস ধরিয়ে দিয়ে মার্কেট থেকে চলে আসতে চাইল। চিপসের দাম দিতে গিয়ে ব্যাগ হাতরে টাকা দিয়ে পাশে তাকিয়ে আরহামকে পেল না প্রিয়তা। আতঙ্ক সৃষ্টি হলো প্রিয়তার মনে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে ডেকে উঠল ততক্ষণাৎ। অদূরে তাকিয়ে প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। পা থরথর করে কাঁপল প্রিয়তার। বুকে বিষাদ তৈরী হলো। অজানা এক ভয়ে নির্বাক হলো প্রিয়তা। পা টলমল করে উঠল। অদূরে পোশাকের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে আরিফ আর তার নব স্ত্রী দীপা। দুজনের মাঝখানে আরিফের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরহাম। মুখে ছেলেটার বিশ্ব জয় করা হাসি। আরহাম প্রিয়তাকে হাতের ইশারায় ডাকল। দ্রুত হন্তদন্ত পায়ে ছুটে আরহামের কাছে এলো প্রিয়তা। বুকটা ধরধর করছে তার। হারানোর ব্যথা প্রকাশ পাচ্ছে। আরহাম ওদের এত কাছে কেন? আরিফ আরহামকে কোলে নিয়ে বললো,

” কেমন আছিস প্রিয়তা?

প্রিয়তা কথা বলতে পারল না। চরম বিস্ময়ে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হলো। কম্পন ধরলো শিরা উপশিরায়। নজর ঘোলা হলো। বুকের ভিতর হাহাকাল প্রতীয়মান হলো। দুর্বল কণ্ঠে কষ্ট করে বললো,

” ভালো আছি। আরহামকে দাও।

‘ আরহাম আমাদের সাথে যাবে। খানিক হেসে বললো দীপা।

দীপার হাসি অসহ্যকর ঠেকল প্রিয়তার কাছে। এই মুহুর্তে ভেঙে পরলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। আরহামকে আটকে রাখতে হবে। ওদের সরিয়ে দিতে হবে আরহামের জীবন থেকে। চলামে আসার সময় দয়া দেখায়নি। এখন কিসের দয়া দেখাচ্ছে এরা? কি চাইছে?

প্রিয়তার চোখ লাল হলো। নাকের পাটা কাঁপতে লাগল। রাগে গলার রগ ফুলে উঠল। শান্ত, ধীর কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ আরহাম কোথাও যাবে না। এতদিন একবার ও ফোন করেননি। আজ যখন ওকে দেখলেন অমনিই মায়া বেড়ে গেল? আপনাদের নাটক বন্ধ করুন।

আরিফ মুখটা মলিন করল। বললো,

” তুই নিজের জীবন গুছিয়ে নে। আরহাম আমার কাছে থাকুক। ওকে তো আমরা মেনেছি।

” কাউকে মানা লাগবে না। দিন আরহামকে।

রাগে উন্মাদের তো চিৎকার করলো প্রিয়তা। খাবলে আরিফের কোল থেকে আরহামকে নিতে চাইল। উচ্চস্বরে কয়েকবার রাগ দেখাল। ফোস করে ঘনঘপ শ্বাস ছাড়ল। এমন কাণ্ডে আরহাম হতভম্ব হলো। মুখ ছোট করে বললো,

” আমি আব্বুর কাছে যেতে চাই আপু। কয়েকদিন থেকে না হয় চলে আসবো। এই আন্টিটা তো ভালো।

আরহামের কণ্ঠ কানে পৌঁছানো মাত্র প্রিয়তা থেমে গেল। স্থির হলো মেয়েটার আঁখি। অশ্রু গড়িয়ে পরল টুপ করে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। উন্মাদনা কমে এলো। বাড়িয়ে রাখা হাত নিজের কাছে আনলো। পানিতে টইটম্বুর চোখ আর ভেজা গলায় প্রিয়তা বললো,

” কি বলছো ভাই? আ..আমি আপু হই। আমাকে ছে..ছেড়ে…

আর বলার শক্তি পেল না প্রিয়তা। মুখে হাত দিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠল সে। বক্ষ স্থলে ব্যথা টের পেল। ক্ষত বিক্ষত হলো প্রিয়তার হৃদয়। দীপা হাসল নিঃশব্দে। আরহাম বললো,

” আমি তো আবার আসবো। এখন শুধু যাবো। কেঁদো না আপু।

আরিফ পিছু হাঁটল আরহামকে কোলে নিয়ে। আরহাম বোনকে হাত নাড়িয়ে টা টা দিল হাসিমুখে। প্রিয়তা প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ওরা গাড়িতে চড়ে চলে যেতেই প্রিয়তার হুশ ফিরল। মার্কেট থেকে বেরিয়ে অটো ধরে বাড়ির সামনে এলো। এতক্ষণ পর কান্না করার মতো ঠিকঠাক জায়গা পেল প্রিয়তা। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। হাউমাউ করে কাঁদল নিজের মতো। ঘাসের উপর বসে পরলো নির্দ্বিধায়। গাল পানিতে পুকুর হয়ে গেল। কান্নার শব্দে বোধহয় মাটিও কেঁপে উঠল। প্রিয়তা উন্মাদের মতো ঘাস ছিড়তে লাগল। আকাশের দিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,

” আমার সুখ কেন দেখতে পারে না কেউ?কি করেছি আমি? আমার দোষ কোথায়? আরহামকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো?

আমি তো বাঁচব না। প্রিয়তা গাল মুছে উঠল। ছাদের দিকে পা বাড়াল। আজ প্রিয়তার জীবন এখানেই শেষ হবে। এত কষ্ট সইতে পারবে না সে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে