প্রাপ্তির শহরে পর্ব-১৪ সিজন ০২

0
996

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-১৪
#তাহরীমা

আদ্র,আলো, প্রিয়া যে যার কাজে চলেযায়।
কিছুদিন পরেই প্রিয়া ইন্টার্নি শেষ হবে।

বাসায় প্রিয়ার মা থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন।প্রিয়ার বাবা বলে,
–“এভাবে মন খারাপ করলে চলবে।মেয়ে মানেই পরের।নিজের মেয়ে হোক পরের মেয়ে হোক মেয়েরা ঘরে থাকে না।বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে হয়।”
–“আমি কিভাবে পিয়ুকে ছেড়ে থাকবো?”
–“মনকে শক্ত করো।আমরা কালকে আদ্রদের বাসায় যাবো।”

প্রিয়ার মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠে কষ্টে যেন বুকটা ছিঁড়ে যায়।প্রিয়ার রুমে গিয়ে প্রিয়ার সমস্ত ছবি আলমারি থেকে বের করে।কাপড় সব বের করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন।যে কান্নায় প্রতিটা দেয়াল ই শোকাহত।
____
পরেরদিন প্রিয়ার বাবা মা প্রিয়াকে সহ নিয়ে আদ্রদের বাসায় আসে।প্রিয়া জানেনা কেন এসেছে?আদ্ররা উনাদের দেখে খুশি ই হন।আত্মীয়ের সম্পর্ক না থাকলে ও কেমন যেন এনাদের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

আদ্রর মা আপ্যায়ন এর ভুল রাখেন না।

আয়াত আহিতা আহান কে অনেক আগেই আলো ঘুমিয়ে রেখে গেছে। সকলে গোল হয়ে বসে।

তখন প্রিয়ার মা ই প্রথমে কাদোকাদো হয়ে বলে,
–“আসলে একটা কথা আপনাদের জানাতে এসেছি।কথাটা না বলে সেদিন নিজেদের অপরাধী মনে হয়েছিল।প্রিয়াকে হারানোর ভয় থেকেই সেদিন লুকিয়েছিলাম সত্যিটা।”

আদ্র আদ্রর মা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আলো বলে,
–“বলুন না কি বলবেন?”
–“আপনারা যাকে প্রিয়া বলছেন সে আদৌ আমার নিজের পেটের মেয়ে নয়।সে আপনাদের ই তাহু।”

এ কথাটা শুনে আদ্র চোখ বড়বড় করে ফেলে।খুশিতে কাঁদবে নাকি হাসবে ভুলে ই গেলো সে।
আর প্রিয়া বলে উঠে,
–“কি বলছো আম্মু? আমি তোমাদের মেয়ে নই?”

প্রিয়ার বাবা বলেন,
–“আমরা অন্যশহরে থাকতাম।এখানে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিলাম।সেদিন যাওয়ার পথে প্রিয়া মানে তাহু দৌড়ে আসছিলো।সে এতটায় আতংকিত ছিল আমাদের গাড়ি আসছিল খেয়াল করেনি।গাড়ির সামনেই ধুম করে পড়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে।মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তে ভেসে যায়।তাড়াতাড়ি আমরা গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালে নিয়ে যায়।একদিন পর ওর জ্ঞান ফিরে কাউকে চিনতে পারেনা।নাম বলতে পারেনা।তখন ডাক্তার বলে মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে স্মৃতি চলে গেছে।কোনোদিন যদি একই ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটে স্মৃতি ফিরলে ও ফিরতে পারে।”

উপস্থিত সকলেই চুপ।প্রিয়ার বাবা আবারো বলে,
–“তাহুকে পাবার একবছর আগেই আমাদের একমাত্র মেয়ে প্রিয়া গাড়ি এক্সিডেন্ট এ মারা যায়।তাহুকে পেয়ে আমরা প্রিয়াকে পেয়েছিলাম মনে করেছি।যদি ও তাহুর কাছে মাতৃত্বের+বিবাহিতর লক্ষণ ছিল প্রিয়ার মা সেটা খেয়াল করেছিল।আমরা একদিন খুজ করেছিলাম কিন্তু আপনাদের খুজ পাইনি।তারপর নিজেদের সান্তনা দি আল্লাহ আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।সেটা মনে করে চলে যায় আমাদের শহরে।”

প্রিয়ার মা বলে,
–“আমাদের স্বপ্ন ছিল প্রিয়াকে ডাক্তারি পড়াবো,মানুষের সেবা করবে, কিন্তু তার আগেই সে চলে যায় আল্লাহর কাছে।তাই তাহুকে আমরা ডাক্তারি পড়িয়েছি।তাহু থেকে নাম গ্রাম এমনকি সার্টিফিকেট ও প্রিয়ার হয়ে গেলো।আর হয়ে গেলো আমাদের মেয়ে প্রিয়া।মেয়েটি খুব ভীতু ছিল আমাদের প্রিয়া ছিল সাহসী।আমি আমাদের মেয়ের মতো তাহুকে গড়ে তুলেছি।প্রথম থেকে সব হাতে কলমে আমি ই সব শিখিয়েছি।”

প্রিয়ার বাবা আবারো বলে,
–“পিয়ু মানে তাহু আগের চেয়ে সুন্দরী হয়ে উঠে একদম আমাদের মেয়ে পিয়ুর মত।তাই ওর মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলে আমরা মিথ্যা বলেছি কাল।স্বার্থপরতা করেছি।কিন্তু আদ্রর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা সত্যি বলার সীদ্ধান্ত নিই।”

এই বলে প্রিয়ার বাবা মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।তাহু এসে জড়িয়ে ধরে,
–“তোমরা আমার বাবা মা আমি আর কিছুই শুনতে চাইনা।”

আদ্র ছুটে আসে।চোখেমুখে খুশির চাপ।এসে তাহুকে টেনে দাড় করায়।তারপর সকলের সামনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।আকস্মিক এমন হওয়ায় তাহু ঘাবড়ে যায়।যদিও তার আদ্রর কথা মনে নেই।আদ্রর মা আর আলো কান্নারত চোখে হাসেন।সাথে প্রিয়ার বাবা মা হাসেন।
আদ্র ফুফিয়ে কাপা গলায় বলে,
–“কতদিন পর আমার এই বউয়ের সাথে দেখা।কিভাবে আমাকে একা রাখার কথা ভাবলে বলো?তোমাকে আমার কতটুকু প্রয়োজন ধারনা আছে হ্যা?”

আদ্রর কান্ড দেখে সবাই মুচকি হাসে।
___
আলো তারপর চিন্তিত হয়ে বলে,
–“কিন্তু অই ডেডবডিটা কার ছিল তাহলে?আর তাহুর চেইন ই বা অই মেয়েটার সাথে কেন ছিল?”

প্রিয়ার মা বলে,
–“তাহুর যেদিন স্মৃতি আসবে অইদিন ই বুঝা যাবে।তাহু ই এসব বলতে পারবে আমরা পারব না।”

আলো তখন প্রিয়ার মার হাত জোর করে বলে,
–“মেয়ে হিসেবে তাহুকে আপনারা বুকে টেনে নিয়েছেন আমরা চির ঋণী।আপনাদের মেয়ে হয়েই বাকি জীবন সে থাকবে।মেয়ের শশুড় বাড়ি মনে করে যখন ইচ্ছে আসবেন।”

প্রিয়া বাবা মা খুশি হয় খুব।প্রিয়ার মা বলে,
–“তাহলে ওকে আমরা পিয়ু বলেই ডাকবো।”

আদ্র তখন বলে,
–“আমার বউকে আমি আমার কাছেই রাখবো।এটাই ফাইনাল।”

উপস্থিত সবাই হা।বিশেষ করে প্রিয়া মানে তাহু ই হা করে আছে।শেষমেশ এ মানুষ টা তার বর ই লজ্জা লাগছে ভাবতে।

প্রিয়ার বাবা মা বলে,
–“ঠিক আছে দুইদিন পর পর আমরা পিয়ুকে দেখে যাবো।”

তাহুর খুব খারাপ লাগছে এনাদের জন্য। কিন্তু সত্যি এটাই সে এ বাড়ির বউ।খারাপ লাগলেও কিছুই করার নেই।

প্রিয়ার বাবা মা চলে যান।আয়াত ঘুম থেকে উঠে পুরাই সারপ্রাইজড।আন্টি তাদের বাসায়?

আদ্র তখন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“এটা তোমার মাম্মাম ই।”
আয়াত খুশি হয়ে তাহুকে জড়িয়ে ধরে।তাহু ও খুব খুশি নিজের ছেলেকে ফিরে পেয়ে।আসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয়।

আদ্রর মা এসে তাহুর মাথায় হাত রাখে,
–“জানি তোর স্মৃতি নেই।হয়ত স্মৃতি ফিরলে আমায় ঘৃণা করবি তাও আমাকে ক্ষমা করিস।”

তাহু তখন বলে,
–“একি আপনি গুরুজন হয়ে এসব কি বলছেন?কেন বলছেন?”

আদ্রর মা তখন অতীতের সব তোলে ধরেন যদি ও এখন তাহুর কিছুই মনে নেই।তাহু কেঁদে ফেলে,
–“ক্ষমা চাইতে হবে না।আপনি মা মায়েদের ক্ষমা চাইতে হয়না।তবে যাদের কথা বলছেন আপনার ছোট বউমা অথবা আপনার ছেলেকে আমি একবার দেখে নিবো।মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো?”

তাহুর রাগ দেখে আদ্র হাসে।এইতো তার বউ প্রতিবাদ করা শিখেছে।
______
রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো।তাহু আয়াতকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় বসে ছিলো।

তারপর আদ্র এগিয়ে আসলে তাহু বলে,
–“আপনি এত সুন্দর কেন?”
–“আমার বউ সুন্দর তাই আমি ও সুন্দর।”

আদ্র তাহুকে জড়িয়ে ধরতে নিলে তাহু বলে,
–“কেমন যেন লজ্জা লাগছে।”

আদ্র হু হু করে হেসে উঠে।আবার পরক্ষণে মন খারাপ নিয়ে বলে,
–“তোমার কখন সবকিছু মনে পড়বে?”
তাহু তখন বলে,
–“আল্লাহ যখন চায়।”
আদ্র বলে,
–“মনে পড়তে হবেনা।আমাকে ছেড়ে কোথাও না গেলেই হলো।আমি তো বেচে থেকেও মৃত ছিলাম।এতদূরে কেউ যায় বলো?”

তাহু হাসে।
–“এই হাসি আমি ভুলতে পারিনি।চোখে জল চলে আসতো ভাবলে।আচ্ছা ভালবাসা এত সুন্দর কেন?”
তাহু তখন বলে,
–“পবিত্র সবকিছুই সুন্দর।”
________
তাহুর চাচি যখন এটা জানতে পারেন খুব খুশি হয়।রিয়াদ রিপাকে নিয়ে তিনি ছুটে আসেন তাহুকে দেখতে।যদিও তাহুর কিছু মনে পড়ছেনা তাও এরা ভাইবোন পরিচয় পেয়ে তাহু তাদের জড়িয়ে ধরে।তারা একদিন থেকে চলে যায়।


পরেরদিন আদ্র সহ সবাই আকাশদের ওখানে যায়।
আকাশ আর মেঘা তাহুকে দেখে ভুত বলে চিল্লিয়ে উঠে।তাহু হাসে।
আর বলে,
–“ভুত হয়েই আপনাদের মত মানুষ দের ঘাড় মটকে দিতে এসেছি।আজ থেকে আমরা এখানেই থাকবো।”

মেঘা বলে,
–মানে কি বলছো?
তাহু বলে,
–“আপনি তো সেই যে আলাদা থাকতে চেয়েছেন।আম্মুকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চেয়েছিলেন।আচ্ছা আমায় বলুন তো আপনি কি আপনার বাবা মাকে ও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছেন?”
–“আমার বাবা মাকে কেন পাঠাবো?”
–“তাহলে অন্যের মা কে পাঠাবেন কেন?আপনার মা না হোক মা জাত তো।আপনাকে যেমন আপনার বাবা মা ভালবেসে বড় করেছেন।তেমনি আকাশ ভাইয়াকে ভালবেসে বড় করেছেন।”

আকাশ তখন মাথা নিচু করে রাখে।তাহু আবারো বলে,
–“আম্মু তার স্বামীর বাড়ি মানে এ বাড়িতেই থাকবে।কারোর সমস্যা হলে সে বের হয়ে যাক।”

আকাশ তখন মায়ের পা ধরে,
–“আমি অন্ধ ছিলাম।মেঘাকে হারানোর ভয়ে আমি স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম।মেঘা যদি আলাদা থাকতে চায় সে চলে যাক।আমি আমার মায়ের কাছেই থাকবো।বউ চলে গেলে আজ আমার আর আফসোস নেই।কত মানুষ একা জীবনযাপন করে।”

মেঘা এখন অনেকটা বাবা মার কদর বুঝে।মাহি যখন কথা শুনেনা চুল টানে তখন তার খুব কষ্ট হয়।তখন সে আদ্রর মাকে দেয়া কষ্টের কথা ভেবে অনুতপ্ত হয়।ভেবেই নিয়েছিল ক্ষমা চাইবে তার আগেই তাহুরা চলে এসেছে।

মেঘা গিয়ে আদ্রর মায়ের পা ধরে।
–“আমি সরি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

আদ্রর মা দুজনকেই পা ছেড়ে উঠে যেতে বলে,
–“ক্ষমা করে দিয়েছি।”

সবাই খুব খুশি হয়।সবার হাসিমুখ দেখে আয়াত আহিতা তালি দিয়ে উঠে।
মাহি ভ্রু কুচকে বাচ্চা দুটোকে দেখছিলো।

আকাশ তারপর মাহির ব্যপারে সব বলে।
তারপর আদ্রর মা বলে,
–“মাহি ও একদিন মেঘার মত ঠিক হয়ে যাবে।পরিপূর্ণ শিক্ষা আর বুঝ পেলে…”

আদ্রর মা আবারো বলে,
–“মাহিকে আমি আমার বাকি নাত্নিদের মতো ই ভালবাসব।ভালবাসা পেলে সে অবশ্যই বদলে যাবে।মাহি যেন কখনো জানতে না পারে সে এতিম ছিলো।আজ থেকে আমরা প্রাপ্তির শহরে থাকবো।এই #প্রাপ্তির_শহরে সব প্রাপ্তির হিসাব হবে।হারানোর কোনো বেদনা আর যাতে আমাদের সহ্য করতে না হয়।”

তাহু আদ্র খুশিতে কেঁদে ফেলে।কিন্তু তাহু অনেক কষ্টে অতীত মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে