#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৬
আজ রাতে ছন্দ ও প্রাণের লন্ডনের জন্য ফ্লাইট। ছন্দ পুনরায় সবকিছু তত্ত্বাবধান করে বেরিয়ে পড়লো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে৷ যাওয়ার পূর্বে ছন্দ চৈতির নিকট পাখিটা রেখে গেল, সে সাথে তার দায়িত্ব-কর্তব্যও বুঝিয়ে দিল। যাওয়ার পথে ছন্দ প্রাণকে নিয়ে একবার আশা বেগমের কবর দেখে আসলো। প্রাণের অভিব্যক্তি নিত্যদিনের মতই নিস্পন্দ, অনুদ্ধত রইলো। তবে দৃষ্টি হয়তো অনুভূতি আড়াল রাখতে পারলো না, অশ্রুকণায় ভর্তি হয়ে উঠলো কয়েক পলকে। সিক্ত হলো মসৃণ গাল,চিবুক। তবে শব্দরা নিরুদ্দেশ পথের পথিক হয়েই রইলো। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ঘন্টা খানেকের মাঝে তারা শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে নামার আগে ছন্দ প্রাণকে পড়ার জন্য মাস্ক,কালোচশমা ও ক্যাপ দিল। যাতে কেউ তাকে চিহ্নিত করতে না পারে। যদিও প্রাণের এসবের বিশেষ প্রয়োজন হয় না, তাকে সাদামাটা অবস্থায় কেউ সহসা চিনতে পারে না। যদি না তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও ছন্দ ঝুঁকি নিতে চাইলো না। তাছাড়া বিমানে উঠার আগ পর্যন্ত তাদের হেফাজতের জন্য দুইটা বডিগার্ড সর্বক্ষণ তাদের সাথে আছে।
ছন্দ ভেবেছিল প্রাণ হয়তো জানতে চাইবে তারা কোথায় যাচ্ছে বা কেন? কিন্তু তার আশায় পানি ফেলে দিয়ে প্রাণ টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। কাঠপুতুলের ন্যায় তার প্রত্যেকটা কথা নীরবে মেনে গেল শুধু। যেমন এখন, ছন্দ তাকে একবার মাস্ক,ক্যাপ পড়ার কথা বললে সে কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে পড়ে নিল। অথচ এমন প্রাণকে সে কখনোই চায়নি। সে তো শুরু থেকেই ঘাড় ত্যাড়া,বদমেজাজি, বেরসিক মেয়েটাকে চেয়েছে। যে কাঁদতে,হাসতে না জানলেও রাগ করতে জানে, ঝগড়া করতে জানে। যে কারো কল্পনার কল্পরতা নয়, স*র্ব*না*শি*নী হতে জানে। বাস্তবতা বুঝে। অথচ নব্য প্রবর্তনে সবটা বদলে গেল নিমিষেই। প্রাণের মৌনতা ছন্দকে ভিতরে ভিতরে হ্রা*স করলেও সে বাহিরে হাসিমুখেই তা গ্রহণ করে যাচ্ছে। বুঝতে দিচ্ছে না সামনের পক্ষকে তার অনুভূতি।
তাদের সি অফ করতে জিহান আসে। ছন্দ তার সাথে কথাবার্তা বলে চলে যায় ভিতরে। ফারহাজের ওটি থাকায় সে আসতে পারেনি তবে ফোনে কথা বলে নিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সকল কার্যপ্রণালী শেষ করে বিমানে উঠতে ঘন্টা খানেকের বেশি সময় লাগলো তাদের৷ টার্কিশ এয়ারলাইনসের বিজনেসক্লাসে উঠেছে তারা। স্বভাবগত ছন্দ যতবার বিমানভ্রমণ করে ততবারই জানালার সিট নেয়, এছাড়া সে জার্নি করে না। তবে আজ ভিন্ন কিছু হলো। সে ইচ্ছে করেই নিজের কাঙ্ক্ষিত সিটটা দিয়ে দিল প্রাণকে। এমনটা সে কেন করলো জানা নেই, তবে তার লাগলো এতে ঈষৎ পরিমান হলেও প্রাণ স্বস্তি পাবে। উপভোগ করবে।
উপরে যাত্রীরা আঁধারিয়া অম্বরে মেঘ স্পর্শ করছে, নিচেই যান্ত্রিক নগরী দ্যুতির আড়ম্বরে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কি অপরূপ সংমিশ্রণ৷ নিশুতি ঘনিয়ে আসতেই সকলে তলিয়ে যায় ভিনদেশি এক রাজ্যে। প্রাণ ঘুমিয়ে পড়েছে আরও আগে। ছন্দ উঠে প্রাণের গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে দিল ভালোভাবে৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। খানিকটা ঝুঁকে প্রাণের কপালে খুব সন্তর্পণে নিজের অধর দু’টো ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আপনাকে আমি কখনো মিইয়ে যেতে দিব না প্রাণ। কখনো না।”
____
দীর্ঘ একুশ ঘন্টার পথ পেরিয়ে অবশেষে তারা এসে পৌঁছালো গ্যাটউইক বিমানবন্দরে। ছন্দ প্রাণকে সামলে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো তার বাবা আরশাদ তুরহান এসেছেন তাদের নিতে৷ ফারহাজ আগেই জানিয়েছিল ছন্দকে, সে বাসায় তাদের বিয়ের কথা জানিয়েছে এবং সম্পূর্ণ ঘটনা,পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। কোনরকম ঝামেলা করতে কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। তারাও বুঝেছে বিষয়টা এবং ফারহাজকে আশ্বস্ত করেছেন কেউ কোন প্রকার ঝামেলা করবে না। ছন্দ ও প্রাণ যাতে আসে। ছন্দ যদিও এসব নিয়ে দ্বিধায় ছিল তবে ফারহাজ তাকে আলাদাভাবে বুঝিয়েছে যে, একসাথে থাকলে কথা কা*টা*কা*টি, মনোমালিন্য হতেই পারে। তাই এরকম কিছু হলে তখন যাতে সে মাথা গরম না করে, শান্ত মাথায় বিষয়টা সমাধান করার চেষ্টা করতে। মানিয়ে চলতে।
কথাগুলো ভেবে ছন্দ আলগোছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। যদিও ছন্দের কোন ইচ্ছা ছিল না আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার তবে যত যাই হোক তিনি তার বাবা লাগে, তাই সম্মান রক্ষার্থে সালাম জানিয়ে প্রাণের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার বাবা।”
প্রাণ দৃষ্টি তুলে তাকালো, আরশাদকে এক নজর দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো। মৌনতা ভে*ঙে মিনমিনে কন্ঠে সালাম দিল তাকে। আরশাদ হাসিমুখেই দুইজনের সালাম গ্রহণ করলেন। বুঝলেন, মেয়েটাই তার ছেলের বউ। তাই তিনি প্রাণকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভালো আছো মামণি?”
প্রাণ চটজলদি দৃষ্টি তুলে তাকায়। ‘মামণি’ বলে তাকে তার আশামা ডাকতো৷ খুব আদর করে। আজ এতদিন পর এই সম্মোধনটা শুনে বুকটা ধক করে উঠেছিল তার। সর্বাঙ্গে বয়ে গেল হিম শিহরণ। কোনরকম মাথা দুলিয়ে বুঝালো, সে ভালো আছে। কিন্তু বিপরীতে যে আরশাদের হালচাল জিজ্ঞেস করবে সেই জো আর থাকলো না। নয়নের কার্নিশে জল ভিড় জমাতেই মাথা নুয়ে ফেললো সে৷ এই এক জায়গায় এসে বার বার কেন সে দুর্বল হয়ে পড়ে জানা নেই৷ আরশাদ সবই আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ছন্দ চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝাতে নিশ্চুপ বনে গেলেন তিনি। ছন্দ এই ফাঁকে প্রাণকে পিছনের সিটে বসিয়ে গাড়ির ব্যাকসাইডে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে ফ্রন্ট সিটে এসে বসলো। আরশাদও আর বিলম্ব না করে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন।
ইংল্যান্ডের হাইওয়ে ধরে গাড়ি এগুচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ অরণ্যের দীর্ঘ বসতী। মাঝে মধ্যে নীলাভ আকাশের বুক চি*রে দুই-একটা পাহাড় মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিচ্ছে যেন। গাড়ির ভিতর গুমোটভাব ছড়িয়ে। প্রাণ জানালার বাহিরে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর ছন্দ কানে ইয়ারফোন গুঁজে সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে বসে। ফাঁকে ফাঁকে প্রাণের কিছু প্রয়োজন কি-না তার খেয়াল রাখছে। আরশাদ দেখছেন সবই কিন্তু কোন কথা বলছেন না। বড় ছেলের সাথে সহজে আড্ডা জমাতে পারলেও ছোট ছেলের সাথে সেভাবে পারেন না। শুরু থেকেই ছন্দ ও তার মধ্যকার সম্পর্ক খানিকটা খাপছাড়া। তাদের মাঝে দূরত্বও বেশ। হয়তো এককালে ছেলের প্রতি বেশি কঠোরতা দেখিয়ে ফেলেছিলেন বলে।
_____
ঘন্টা খানেকের পথ পেরিয়ে তারা এসে থামলো বিশাল এক অট্টালিকা সামনে। আরশাদ তাদের গেটের সামনে নামিয়ে বলল ভিতরে যেতে, সে গাড়ি পার্ক করে আসছে। তার কথা অনুযায়ী ছন্দ প্রাণ ও ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়লো। ছন্দ আগেও কয়েকবারের এসেছে এখানে। ইংল্যান্ডে যতবারই তার ম্যাচ থাকে ততবারই তার ছোট বোন ফারিনাজ খেলা দেখতে যায় এবং ফিরতি পথে তাকে জোরপূর্বক সঙ্গে নিয়ে আসে। একমাত্র আদরের বোন হওয়ায় ছন্দ তাকে নাও করতে পারে না। তবে দু’দিনের বেশি সে কোনবারই থাকে না। অথচ এবার সম্পূর্ণ আলাদা। কতদিনের জন্য থাকতে হয় তাকে কে জানে?
ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। এগারো তালায় এসে লিফট থামতেই নেমে পড়লো তারা৷ ব্লক-সি এর সামনে এসে ডোরবেল বাজাতেই ঊনিশ কি বিশ বছর বয়সী এক তরুণী এসে দরজা খুললো৷ ছন্দকে দেখামাত্র উচ্ছ্বাসে ‘ভাই’ বলে চেঁচিয়ে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ছন্দও আলতো হেসে ছোট বোনকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো৷ বলল, “কেমন আছিস ফারু?”
ফারিনাজ এবার সরে এসে বলল, “একবারে ফাস্টক্লাস। তুই কেমন আছিস? আর ভাবি কোথায়?”
ছন্দ পাশে ইশারা করতেই ফারিনাজ সেদিক তাকালো। প্রাণের মলিন নয়নে তার পাণেই তাকিয়ে ছিল। ফারিনাজ আলতো করে প্রাণকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি ভাবি! আগে খেয়াল করিনি তোমায়।”
প্রাণকে এবার ছেড়ে দিয়ে তার হাত ধরে টেনে বলল, “ভিতরে আসো। কতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”
প্রাণকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফারিনাজ তার হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে আসলো। ছন্দ লাগেজ সব ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। ভিতরে ঢোকার পর পরই ছন্দের মা নাফিসা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলেন। ফারিনাজকে বললেন, “যা ফ্রিজ থেকে ভাই আর ভাবির জন্য মিল্কশেক নিয়ে আয়। আমি বানিয়ে রেখেছি।”
ফারিনাজ মায়ের কথায় রান্নাঘরের দিকে ছুটলো৷ নাফিসা এবার ছন্দের মুখপানে তাকালেন। প্রফুল্লচিত্তে মন ভরে উঠল যেন। ঠোঁটের কোণে আবির্ভাব হলো বিস্তৃত হাসির। প্রায় দুই বছর পর দেখছেন নিজের ছেলেকে। অভিমান করে ছেলেটা যে দূর হলো, এখন পর্যন্ত তা ঘুচার নাম নেই। প্রতিনিয়ত তিনি এই প্রতিক্ষায় দিন গুনছেন, কবে অভিমানের দেয়াল ভা*ঙ্গ*বে আর ছন্দের মন নরম হবে৷ সে নিজের নেত্রের জলটুকু মুছে এগিয়ে এসে বললেন, “কেমন আছিস বাবা? কতদিন পর আসলি৷ আর এত শুকিয়ে গিয়েছিস কেন? খাস না কিছু ঠিকমতো?”
মায়ের সাথে রেষারেষি কম হওয়ায় ছন্দ চেষ্টা করলো সহজভাবেই কথা বলার। হেসে বলল, “আমি ঠিকই আছি মা। আর আমার ফিট বডি কি তোমার চোখে পড়ছে না?”
নাফিসা বললেন, “মায়ের চোখে এটাকে শুকানোই বলে।”
ছন্দ শ্লেষাত্মক হাসলো। বলল না কিছু। নাফিসা এবার প্রাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরেহ! তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো! বসো! ক্লান্ত লাগছে না?”
এই বলে নাফিসা ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রাণকে সোফায় নিয়ে বসালেন। তারপর ছন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস!”
ছন্দ বলল, “আমি আগে ফ্রেশ হবো। অনেক ক্লান্ত লাগছে।”
“যা তাহলে। আমি তোর জন্য বা-দিকের রুম পরিষ্কার করে রেখেছি।”
ছন্দ মাথা দুলিয়ে প্রাণকে জিজ্ঞেস করলো, “প্রাণ আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
প্রাণ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকালো শুধু। নাফিসা প্রাণের দিকে তাকালেন। মেয়েটার উপর বেশ ধকল গিয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। চোখ,মুখ কেমন র*ক্ত*শূ*ণ্য দেখাচ্ছে। তাই তিনি দুইজনকে আগে ফ্রেশ হওয়ার রুমে পাঠিয়ে দিলেন।
#চলবে
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৭
সায়াহ্নের প্রহর। প্রগাঢ় নীল নভস্থল জুড়ে রঙ্গিন মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা৷ গোলাপি আভা ছড়াচ্ছে যেন। বাতাসে বইছে ভিনদেশি কোলাহল। মাতৃভূমির সেই চিরচেনা সুগন্ধি অপরাগ। আলো বিলীন হচ্ছে পশ্চিমাকাশে। জ্বলে উঠছে নিয়ন বাতি৷ বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই প্রাণের চোখে পড়লো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লন্ডন আই-এর দিকে। শয়নকক্ষের লাগোয়া অলিন্দ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সে-টা। বৃহৎ গোলাকৃতি চাকাটির গা বাহারি দ্যুতিতে আবৃত। ধীর গতিতে ঘুরছে যেন। নিচ থেকে ভেসে আসছে থামাস স্রোতোবহার সুমধুর ধ্বনি। প্রাণ সরু রেলিং-এর উপর দুই হাত ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকলো সেদিকেই। একমনে, এক দৃষ্টিতে। কর্ণকুহরে এসে বারি খাচ্ছে দরজার সাথে ঝুলিয়ে রাখা উইন্ড চিমের টিংটিং শব্দ। যৎসামান্য সময় অতিবাহিত হতেই ছন্দ পিছন থেকে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “আ..পনি এ..খানে ক..কি করছেন?”
প্রাণ ভড়কালো না। শান্ত ভঙ্গিতেই পিছন ফিরে তাকালো। ছন্দ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কি করছেন?”
প্রাণের নিশ্চুপ কন্ঠ ধ্বনিত হলো, “কিছু না।”
ছন্দ দ্রুত কয়েক পা চালিয়ে প্রাণের এক বাহু ধরে তাকে নিজের সন্নিকটে নিয়ে আসলো। এক নজর খোলা বারান্দার বাহিরে তাকালো। রেলিং আছে তবে কোমর পর্যন্ত। ছন্দ এবার প্রাণের দিক তাকিয়ে বলল, “আমার অনুপস্থিতি আপনি কখনো বারান্দায় আসবেন না। বুঝেছেন?”
প্রাণ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো। ছন্দ তটস্থ কন্ঠে বললো, “আপনি ভিতরে যান এখন। ফারিনাজ খোঁজ করছিল আপনার।”
প্রাণ কিয়ৎক্ষণ ছন্দের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল ভিতরে। প্রাণ যেতেই ছন্দ পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো৷ আঁখি দুটির কপাট বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকবার। এরপর এক পলক তাকালো এগারো তালার নিচে। বিকেলের দিকে সে প্রাণকে নিদ্রাবিষ্ট অবস্থায় রেখে বেরিয়েছিল ফারহাজের সাজেস্ট করা সাইকিয়াট্রিস্ট ইলানের সাথে দেখা করতে। প্রাণের চিকিৎসা সে যতদ্রুত সম্ভব শুরু করতে চাচ্ছিল বলে তার যত মেডিক্যাল হিস্ট্রি আছে সব কাছে জমা দিয়ে আসে৷ ডা. ইলান সব রিপোর্ট দেখে তাকে জানাবে বলেছেন। বাসায় এসে ছন্দ প্রথমে প্রাণকে খুঁজে, রুমে তাকে না দেখে বারান্দার দিক যায়। তবে তখন প্রাণকে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকতে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস আটকে যায় তার। অপ্রীতিকর ভাবনা হানা দেয় মনোরাজ্যে। হিম শিহরণ বয়ে যায় রন্ধ্রে। তাই তো সেসময় অদ্ভুত আচরণ করে বসেছিল সে।
ছন্দ আনমনে বলে উঠলো, “আপনার ঠিক হওয়াটা এখন ভীষণ জরুরি প্রাণ। ভীষণ জরুরি।”
_______
সপ্তাহ খানেক হতো চললো প্রাণের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। দু’দিন অন্তর তার সেশন চলছে আর চারবেলা মেডিসিন। ডা. ইলান বেশ নাজুক হাতে প্রাণকে সামলাচ্ছেন। বিশেষভাবে খেয়াল রাখছেন। কেন না পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি বুঝেছেন যে, প্রাণ আচরণগত দিক দিয়ে শক্ত হলেও মানসিক দিক দিয়ে প্রচন্ড দূর্বল৷ এতদিন মেডিসিনের প্রকোপে সে স্বাভাবিক ছিল, মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত নার্ভগুলো শান্ত ছিল৷ তবে এখন অবস্থা বিগড়ে গিয়েছে অনেকখানি। মানসিক চাপ এত নিয়ে ফেলেছে যে র*ক্ত চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল তার। উপরন্তু, হাই ব্লাড প্রেশার তার আগে থেকেই ছিল। যদিও তার চিকিৎসা আরও আগে করানো উচিৎ ছিল তবুও একবারে দেরি হয়ে যায়নি। হাতের নাগালেই আছে সব। আশা করা যায় ভালো কিছুর।
প্রথমদিকে ডা. ইলান প্রাণের অবস্থা দেখে কিছুটা ভয়ে ছিলেন। যেরকম মানসিক অবস্থা প্রাণ ছিল ব্রেনে ক্লট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। আর ব্রেন ক্লট হলে প্রাণের জীবন নিয়ে ঝুঁ*কি ছিল। তবে তেমন কিছু রিপোর্টে ধরা পড়েনি বলে স্বস্তি।
প্রাণ একবারে স্বাভাবিক না হলেও কিঞ্চিৎ পরিমাণ হয়েছে বলা যায়। আগে তার কণ্ঠলগ্ন দিয়ে দুটো শব্দ বেরুতে না চাইলেও এখন বেরোয়। শত কথার বিপরীতে তিন-চারটের বেশি কথা বলে। যদিও এর পিছনে সম্পূর্ণ অবদান ফারিনাজ আর নাফিসার। বাসায় অবস্থানরত অবস্থা তারা একমুহূর্তের জন্য প্রাণকে নিঃসঙ্গ থাকতে দেন না। এটা-সেটার মাঝে ব্যস্ত রাখে তাকে। আরশাদ নিজেও চেষ্টা করেন উইকেন্ডে সবাইকে বাহিরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। আর ছন্দ তো সর্বক্ষণ আছেই ছায়ার মতো পাশে। সব মিলিয়ে প্রাণের অবস্থায় উন্নতিই দেখা দিচ্ছে বলা যায়।
ফারিনাজের আবদার রাখতে ছন্দ সকলের জন্য স্টারবাগ’স থেকে ফ্র্যাপুচিনো ও সিনামেন রোলস নিয়ে আসে। বাসায় ঢুকতেই সে দেখতে পায় ফারিনাজ সোফায় বসে প্রাণের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ফারিনাজ স্বভাবগত প্রাণোচ্ছল ও একটু বাঁচাল প্রকৃতির। একবার কথা বলার শুরু করলে থামাথামির নাম নেই। ছন্দ এগিয়ে এসে বলল, “কত কথা বলিস? এবার তো একটু অফ যা। আর তোর বলা জিনিস নিয়ে এসেছি, খা।”
ফারিনাজ মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি ভাবির সাথে কথা বললে তোর এত জ্বলে কেন?”
ছন্দ বিরবির করে উঠল, “বরের বদলে বউ যদি সারাক্ষণ ননদের সাথে চিপকে থাকে তাহলে কার না জ্বলবে?”
ছন্দ নিজের সাথে বলতে দেখে ফারিনাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছো, জোরে বল। শুনি না তো কিছু।”
ছন্দ বিমর্ষ কন্ঠে বলল, “তোর এত বড়দের কথা শুনে লাভ নেই। বাচ্চা মানুষ, বাচ্চার মত থাক।”
এই কথার বিপরীতে ফারিনাজ ফট করে বলে উঠল, “তাইলে তুমিও তো ভাবির সামনে বাচ্চা।”
কথাটা শোনামাত্র ছন্দ তী*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকালো। ফারহাজ বয়সের বিষয়টা গোপন রেখেছিল সকলের নিকট হতে। তবে ফারিনাজ কিভাবে যেন জেনে যায় আর এরপর থেকে সুযোগ পেলে ছন্দকে খোঁ*চা*তে ভুলে না। যদিও আরশাদ-নাফিসার সামনে সে কখনো মুখ খুলে না। ছন্দ দাঁতের পৃষ্ঠে দাঁত পি*ষে বলল, “ফারুর বাচ্চা, থা*প্প*ড়-টা*প্প*ড় খাওয়ার আগে চোখের সামনে থেকে দূর হো।”
“তোর চাকর নাকি আমি যে তুই বলবি আর আমি চলে যাব? আমার চেহারা দেখতে মন না চাইলে নিজে যা রুমে।”
কথাটা বলে ফারিনাজ ব্যাগ থেকে দুইটা ফ্র্যাপুচিনো বের করে নিল। একটা কাপ প্রাণকে দিয়ে আরেকটা নিজে খেতে থাকলো। প্রাণ তখনও সোফার রুমেই ছিল বিধায় ছন্দ গেল না। ব্যাগ থেকে আইস টি-র কাপটা বের করে সামনের দিকে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোফায় বসে রইলো। ফারিনাজ খাচ্ছে আর নিচুস্বরে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। প্রাণ তা নীরবে মনোনিবেশ দিয়ে শুনছে। মাঝে মধ্যে স্মিত হাসছে। প্রাণের এই সামান্যটুকু হাসি ছন্দের খরানি হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামলো যেন। প্রশান্ত হাওয়া প্রবাহিত হলো চারদিকে। এর মাঝে নাফিসা এসে যোগ দিলেন তাদের মাঝে। ছন্দ তাই আর সেখানে বেশিক্ষণ থাকলো না। নিভৃতে উঠে চলে আসলো রুমে।
_____
আজ ডা. ইলানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শেষে ছন্দ প্রাণকে নিয়ে বের হলো ঘুরতে। গন্তব্য কিংস ক্রস স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ৯, ৩/৪। মূলত হ্যারি পটার সিরিজে হগওয়ার্টস স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য যে স্টেশন মূখ্য ছিল সেখানে। চৈতির কাছে জেনেছে সে, কিশোরীকালে প্রাণ হ্যারি পটার সিরিজের হিউজ ফ্যান ছিল৷ সেকালে মুভির ক্যাসেড থেকে শুরু করে বইয়ের ফুল কালেকশন সংগ্রহ করেছিল সে। এতটাই পা*গ*ল ছিল হ্যারি পটারের জন্য। বাসায় এখনো সেসব যত্নে রাখা আছে। তাই প্রাণকে পুরোনো দিনের মিষ্ট স্মৃতিতে ডু*ব দেওয়াতে ছন্দ এই জায়গা নির্ধারণ করেছে। একটা ভ্রমণ নাহয় হয়ে যাক হ্যারি পটারের কল্পনার রাজ্যে।
আন্ডারগ্রাউন্ড বুলেট ট্রেনে চড়ে তারা চলে আসে কিংস ক্রস স্টেশনে। কাঙ্ক্ষিত প্ল্যাটফর্মে আসতেই প্রাণ বিস্ময় দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে থাকলো। অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা না গেলেও প্রাণ যে খুশি তা বুঝতে পারলো ছন্দ। এ নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল সে। অতঃপর প্রাণকে নিয়ে চারদিকে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভ্যানেশিং ওয়াল দেখা শেষ পাশের একটা দোকানে ঢুকলো ছন্দ। সেখানের পুরোটাই হ্যারি পটারের জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর ছিল। প্রাণ কিছু নিতে চায় কি-না দেখার জন্যই দোকানটায় ঢুকা। তবে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকায় ছন্দ ও প্রাণ বার বার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। হাত ধরেও কাজ হচ্ছিল না বিধায় সে বাধ্য হয়ে এক হাতে প্রাণের কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে৷ প্রাণ এতে কিছুটা শিউরে উঠলেও বলল না কিছু, আস্তে আস্তে হাটতে থাকলো ছন্দের সাথে। এর ফাঁকে ছন্দ প্রাণকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি নিবেন না কিছু?”
প্রাণ চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে হিম কন্ঠে বলল, “পছন্দ হলে নিব।”
ছন্দ কথা বাড়ালো না। প্রাণ আরও কিছুক্ষণ ঘুরে দুই-একটা জিনিস কিনলো। অতঃপর দুইজনে সেখান থেকে বের হয়ে সামনের একটি বেঞ্চে বসলো। প্রাণকে বসিয়ে দিয়ে ছন্দ গেল কিছু কিনে আনতে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই সে ফেরত আসলো কিছু খাবার ও কোমল পানীয় নিয়ে। প্রাণ প্রথমে পানীয়টা নিল, তার তেষ্টা পেয়েছিল অনেকক্ষণ ধরেই।
এই ফাঁকে ছন্দ জিজ্ঞেস করলো, “এখানে এসে ভালো লেগেছে? প্রিয় চরিত্রগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছেন?”
প্রাণ মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ!”
বিপরীতে ছন্দও হাসলো। কয়েকদিন ধরে প্রাণ হাসতে শিখেছে। এর চেয়ে বেশি ছন্দের আর কি লাগে? সে এখন মনে প্রাণে দোয়া করছে প্রাণ যেন আগের মত হয়ে উঠে। ভালোবাসুক আর না বাসুক, এট লিস্ট ঝগড়া করুক তার সাথে। প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক।
ছন্দ খাওয়ার জন্য স্যান্ডউইচ এনেছিল। প্রাণ সে-টা খাওয়ার সময় কিছুটা মেয়োনিজ মুখে লাগিয়ে ফেলে। ছন্দ তা দেখতে পেয়ে প্রাণের দিক খানিকটা ঝুঁকে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে তা মুছে দিল। ঠিক এই মুহূর্তে একজন অজানা ফটোগ্রাফার এসে তাদের ছবি তুলে ফেললো। এতে প্রাণ ও ছন্দ দুইজনই বিব্রতবোধ করলো। ছন্দ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই লোকটা হাস্যজ্বল মুখে তাদের সামনে এসে ইংরেজিতে বলল, “দুঃখিত! এভাবে আপনাদের অনুমতি ছাড়া ছবি তোলার জন্য। কিন্তু এত মিষ্টি একটা দৃশ্য হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না তাই এভাবে ছবিটা তোলা। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
ছন্দ বলল, “ইটস ওকে।”
লোকটা নিজ থেকেই পরিচয় দিল আর জানালো তারা চাইলে ছবিটা সে ইমেইল করে দিবে। ছন্দও আপত্তি জানালো না এতে। কিন্তু শর্ত দিল তাদের ছবি যাতে বাহিরে কোথাও না যায়। ফটোগ্রাফারটা রাজি হলো এতে এবং দুইজন নিজেদের ইমেইল আইডি নিয়ে নিল। যাওয়ার আগে ফটোগ্রাফারটা প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউর আর সাচ আ প্রিটি। আর ইউ গাইজ আ কাপল?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। তার পরিবর্তে ছন্দ বলে উঠলো, “ইয়েস উই আর। আ’ম হার হাসবেন্ড।”
ফটোগ্রাফারটা বলল, “অহ! দেটস গ্রেট। উইশিং ইউ গাইজ আ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।”
কথাটা সে চলে গেল। ছন্দ এবার প্রাণের দিকে কিছুটা অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল, “আমি বর হিসাবে এতটাও খারাপ না। আমাকে আপনার বর বললে মানুষ মুখ ফিরায় নিবে না।”
#চলবে