#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৪
ড্রয়িংরুমের পরিবেশ কিছুটা রমরমা। ছন্দের বড়ভাই ফারহাজ তুরহান ও ভাবী মোহনা শেখ এসেছেন আজ। সাথে আছে তাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে তারিন। সে আপাতত টুকটুক পায়ে সারাঘর চষে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে টিয়ার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে আর শব্দ করে হাসছে৷ কোন পাখিকে এই প্রথম কথা বলতে দেখছে বলে তার কৌতূহলের শেষ নেই। চৈতি আছে প্রাণের সাথে রুমে। প্রাণকে তৈরি করার দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে৷ জিহান গিয়েছে কাজীকে আনতে। ছন্দ অনেক কাঠখড় পু*ড়ি*য়ে রাজি করেছে তাকে। যদিও জিহান চাচ্ছিল প্রাণ আরেকটু স্বাভাবিক হলে ওকে সবটা বুঝিয়ে তারপর বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে কিন্তু ছন্দের ধৈর্য যেন বাঁধ ভেঙ্গেছে। বুঝতে চাইছে না কিছুই। তাই জিহান কথা বাড়ালো না। এদিকে ছন্দের মাঝে ছটফটে ভাব স্পষ্ট। কালকের ঘটনার পর তার এটাই লাগছিল প্রাণ তার হয়েও হয়নি। অধিকার নেই তাকে কাছে টানার, স্পর্শ করার, আগলে রাখার। আর প্রাণকে নিজের কাছে পাকাপোক্তভাবে রাখতে হলেও বিয়েটা এখন অতীব জরুরি।
মধ্যাহ্নে প্রহর। ঘড়ির কাটা দুইয়ের ঘরে পদার্পণ করেছে সবে। ছোট তারিন সোফায় বসে তার বাবার ফোনে ‘সাবওয়ে সাব’ গেমটি খেলছে। তার পাশেই ফারহাজ ও মোহনা বসে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। ছন্দের আকস্মিক বিয়ের বিষয়টা দুইজনের মধ্যে কারোই হজম হচ্ছে না। ঘটনাগুলো পুরোই এলোমেলো ঠেকছে তাদের নিকট। তার উপর মেয়েও তো যেমন তেমন না, ডিরেক্টর নিহাল শিকদারের বড় মেয়ে নুসাইবা আরা প্রাণ। বাংলাদেশের এ গ্রেড অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন। তারা ভেবে মিলাতে পারছে না দুইজন একসাথে হলো কিভাবে? আর বর্তমানে কাহিনী কি? ছন্দ কাউকে কিছু না জানিয়ে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েই বা করছে কেন? প্রাণও কেমন নিশ্চুপ হয়ে রুমে বসে আছে, কারণ কি? তার কি মত নেই এই বিয়েতে? জোর করে বিয়ে করা হচ্ছে না-কি? এমন উদ্ভট প্রশ্ন শত মনে কিন্তু উত্তর নেই একটারও।
কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ছন্দ বাসায় ফিরলো দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে। সাথে প্রয়োজনীয় সামগ্রীও আছে। ঘেমে যাওয়ার ফলে পড়নের পাঞ্জাবি কুঁচকে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কাল রাতের ঝড়ের পর আচমকাই আজ রোদের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে৷ ভ্যাপসা গরমের অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ব্যস্ত নগরী। ছন্দ মিষ্টির বক্সগুলো টেবিলের উপর রেখে পাঞ্জাবির হাতায় ঘাম মুছলো। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা বের করে নিমিষেই শেষ করে ফেললো। অতঃপর ভাই ফারহাজের দিক তাকিয়ে বলল, “জিহান আসেনি এখনো?”
ফারহাজ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে চোখের চশমা পিছনে ঠেলে বলল, “ফোন করেছিলাম, রাস্তায় আছে বলল।”
“আচ্ছা।”
কথাটা শেষ করার পূর্বেই তারিন মোবাইল রেখে দৌড়ে আসলো ছন্দের নিকটে। তার বলার আগেই ছন্দ তাকে কোলে তুলে নিল। বলল, “কি আম্মিজান! এভাবে দৌড়ে আসলে যে?”
তারিন স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “ওই রুমে কে আছে চাচ্চু? আমি না যেতে চেয়েছিলাম ওখানে কিন্তু আম্মি দেয়নি। বল না ওখানে কে আছে?”
“তোমার চাচী আছে।”
ছোট তারিন বার কয়েক পলক ফেলে বলল, “আমার তো কোন চাচি নেই। তাহলে?”
“এখন থেকে সেই তোমার চাচি।”
তারিন প্রফুল্ল কন্ঠে বলল, “সত্যি! আমি দেখবো তাকে। দেখাও না।”
ছন্দ হেসে বলল, “আচ্ছা চল।”
কথাটা বলে ছন্দ তারিনকে কোলে নিয়েই এগিয়ে গেল প্রাণের রুমের দিকে। দরজার কাছে এসে আলতো হাতে পিছনের দিকে ঠেললো সে। দেখলো প্রাণ বিছানায় চুপটি মেরে বসে আছে। তার পিছনে চৈতি দাঁড়িয়ে তার চুল বেঁধে দিচ্ছে। ছন্দ হাতের ইশারায় প্রাণকে দেখিয়ে বলল, “ওই দেখ তোমার চাচি। খাটের ওপর বসে আছেন।”
তারিন প্রাণকে দেখে অস্থিরচিত্তে হেসে উঠলো। বলল, “চাচি তো দেখতে একদম পুতুলের মত। সে কি আসলেই পুতুল?”
“সে পুতুলই। তবে মাঝে মধ্যে পাথর হয়ে যায়।”
“মানে?”
ছন্দ আলগোছে নিঃশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বলল, “ও তুমি বুঝবে না। এখন চল, সোফার রুমে যাই৷ তুমি পরে এসে চাচির সাথে কথা বল।”
এই বলে ছন্দ দরজা ভিড়িয়ে সরে আসলো। সোফার রুমে ফিরে আসতেই তারিন ছন্দের কোল থেকে নেমে পুনরায় সোফায় মোবাইল নিয়ে বসলো। ফারহাজ এবার ছন্দকে পুরো ঘটনা জিজ্ঞেস করলো। এসব কিভাবে কি? ছন্দ তখন তাদের সামীপ্যে সম্পূর্ণ ঘটনা ব্যাখ্যা করলো। সব শুনে ফারহাজ ও মোহনা দুইজন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। কণ্ঠনালি হতে শব্দ সব যেন নিরুদ্দেশ হলো।
এর মাঝেই জিহান কাজী সাহেবকে নিয়ে হাজির হলো। কাজী আসতেই সকলে উঠে পড়লো। ছন্দ আসার পথে খাবার নিয়ে এসেছিল। মোহনা সে খাবার ওভেনে গরম করে কাজী সাহেবকে আগে খেতে দিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে কাজীর কথায় মোহনা প্রাণকে নিয়ে আসলেন এবং ছন্দের বিপরীতমুখী চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। প্রাণের কাঁধে ঝুলতে থাকা ওড়নাটা টেনে মাথায় দিয়ে বললেন, “মাশাআল্লাহ!”
প্রাণ নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শুধু। বললো না কিছু। শরীর তার তখনও দূর্বল লাগছে, জ্বরের ভাবটা এখনো যায়নি। তবে মস্তিষ্ক সচল হয়েছে ঠিকই। সে বুঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে এখানে? এদিকে তারিন মোবাইল রেখে দিয়ে গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকলো প্রাণের পাণে। লুকিয়ে চুড়িয়ে তার পাশে এসে বসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সত্যি আমার চাচি লাগো?”
প্রাণ পাশ ফিরে দ্বিধাগ্রস্থ নয়নে তাকালো। তাকে নিরুত্তর দেখে তারিন বলল, “বল! নাকি তুমিও পুতুলদের মত কথা বলতে জানো না?”
প্রাণ প্রশ্নই ঠিকঠাক বুঝলো না উত্তর কি দিবে? তারিন পুনরায় প্রশ্নের আক্রমণ চালানোর আগেই মোহনা এসে তারিনকে নিজের সাথে নিয়ে বসালো। মিনিটের মাঝে কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। প্রাণ তখনও উদাসীন হয়ে বসে। ঘটনা কিছুই তার মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি করতে পারছে না। কিঞ্চিৎ সময়ের পর কাজী প্রাণকে কবুল বলতে বললেও প্রাণ রা শব্দ করে না। পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে থাকে। সবাই এবার অনুধ্যানে একে অপরের দিকে তাকায়। চৈতি মাথা নুয়ে প্রাণকে নিচুস্বরে কবুল বলতে বলে কিন্তু প্রাণ তা শুনেও যেন না শোনার ভাণ করলো৷ নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলো ছন্দের দৃষ্টি বরাবর। ছন্দ হয়তো সেই চাহনির মানে বুঝলো। তাই সে সকলের কাছ থেকে একান্তভাবে কথা বলার অনুমতি নিয়ে প্রাণকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।
প্রাণ ও ছন্দ পাশাপাশি দাঁড়ানো। কিনারেই টিয়াপাখিটি রাখা, সে প্রাণকে দেখামাত্র ডানা ঝাপটাচ্ছে। ডেকে উঠছে মধুর সূরে, “প্রাণপাখি! লেভিউ।” কিন্তু এতে প্রাণের কোন হেলদোল নেই৷ সে তাকিয়ে আছে নভস্থলের অন্তরালে। রাশভারি মেঘদের আনাগোনা দেখছে। প্রাণের এমন খামখেয়ালি ভাব ছন্দের বোধগম্য হলো না। সে কন্ঠ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বিয়েটা নিয়ে কি আপনার কোন সমস্যা?”
প্রাণ মুখ খুললো এবার, “বিয়ে করার কথা কি আদৌ আমার ছিল?”
“না হলেও করা কি যায় না?”
“যায়।”
“তাহলে?”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই সম্পর্ক আমি চাই না।”
“না চাইলেও কি? আপনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব যেখানে আমার হাতে সেখানে এসব নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আর এমনেও আমাদের রেজিস্ট্রার হয়ে গিয়েছে। এখন পিছপাও লাভ নেই।”
“জোর করছেন আমায়?”
“সেই সাধ্য আমার নেই। তবে আন্টি যাওয়ার আগে আপনাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার ইচ্ছে কিন্তু এটাই ছিল, আমাদের বিয়েটা হোক। আপনি আজীবন আমার হয়ে থাকুন।”
আশা বেগমের কথা উঠতেই মস্তিষ্ক টনক নাড়লো প্রাণের। সে কথা বলল না। তাই ছন্দ পুনরায় বলল, “ভাববেন না জোর করছি আমি। আপনি যদি না চান এই বিয়ে কখনোই হবে না, কথা দিচ্ছি আপনায়। তবে একটা কথা, আন্টি চেয়েছেন বলেই যে আমি বিয়েটা করছি বা আপনায় আগলে রাখতে চাচ্ছি তা ভাববেন না। আমি স্বেচ্ছায় এসব করছি৷ আমি সত্যি চাই আপনাকে। আমার পাশে, আমার প্রাণেশ্বরী হিসেবে। তাই বলব, কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার ভেবে দেখবেন বিষয়টা। আমি ভিতরে আপনার উত্তরের অপেক্ষা করছি।”
কথাটা বলে ছন্দ জায়গায়টা প্রস্থান করলো। এসে বসলো সোফায়। মাথা তার ভীষণ ঘোরাচ্ছে। সে তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছে প্রাণকে বুঝানোর। কিন্তু কতটা সফল হয়েছে সে জানা নেই। এখন প্রাণের কি হবে তা ভেবেই ব্যাকুল হয়ে পড়ছে সে। বাকি সবাইকেও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে, জিহান বাদে। জিহান জানতো এমন কিছুই হবে। প্রাণের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। এত সহজে সে কোন কিছু মেনে নিবে না সে জানে। তাই এখন যদি প্রাণ এসে বিয়ে ভেঙ্গেও দেয় তাতে বিস্ময়ের কিছুই খুঁজে পাবে না। মিনিট দশেকের মাঝে প্রাণ ফিরে এসে সোফাতে মাথা নুয়ে বসে। ছন্দ কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকে প্রাণের দিকে, বুঝার চেষ্টা করে তার মতিগতি৷ প্রাণ এবার মাথা তুললো, আস্তে করে উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বুঝালো সে বিয়েতে রাজি। ছন্দকে এবার পায় কে? সে দ্রুত কাজীকে বিয়ে পড়াতে বললো। অতঃপর বিয়ে সম্পন্ন হতেই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মিষ্টিমুখ করাতে ব্যস্ত হলো। আর ছন্দ? সে তার মনোহারিণী কন্যাকে দেখতে ব্যস্ত৷ অবশেষে বুঝি অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো? ধরা-ছোয়ার বাহিরের মানুষটি তার হলো?
_____________
রাত তখন আটটা কি নয়টা৷ প্রাণ নিজের রুমেই শুয়ে আছে। জ্বর আবার উঠেছে তার। মোহনা তারিনকে অন্য একরুমে নিয়ে গিয়েছে ঘুম পাড়াতে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করার ফলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না বলে মোহনা সাথে সাথেই থাকছে। জিহান ও চৈতি বাসায় চলে গিয়েছে সন্ধ্যা হতেই। ড্রয়িংরুমে এখন আছে শুধু ছন্দ আর ফারহাজ। এতক্ষণে ধরে দুই ভাই প্রাণের কথাই বলছিল। ফারহাজ প্রাণের মেডিক্যাল হিস্ট্রি চেক করছিল। সব শেষে যা বুঝলো, প্রাণের বর্তমান যা অবস্থা সে সম্পূর্ণ ট্রমাটাইজ হয়ে আছে। এখন চিকিৎসা শুরু না করালে আগের রোগ ধাওয়া করতে সময় নিবে না। আর এমন হলে ওর কন্ডিশন আরও সিরিয়াস হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ছন্দকে এসব বিষয়ে জানাতেই সে উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লো, “এখন কি করা উচিৎ ভাই?”
ফারহাজ চোখের চশমা নামিয়ে বলল, “আমি বলব ওকে লন্ডন নিয়ে যা, বাবা-মার কাছে।”
ছন্দ ভড়কে উঠে বলে, “তুমি কি পাগল ভাই? এটা অসম্ভব।”
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৫
ফারহাজ চোখের চশমা নামিয়ে বলল, “আমি বলব ওকে লন্ডন নিয়ে যা, বাবা-মার কাছে।”
ছন্দ ভড়কে উঠে বলে, “তুই কি পাগল ভাই? এটা অসম্ভব।”
“অসম্ভবের দেখছিস কি তুই?”
“তুই ভালো করেই জানিস, বাবা-মা কতটা ট*ক্সি*ক। প্রাণের সম্পর্কে জানলে তারা রিয়্যাক্ট করবে। তার উপর না জানিয়ে বিয়ে করেছি বলে যে ঝামেলা করবে, সে-টা আলাদা।”
“তুই সবসময় আব্বু-আম্মুকে নেগেটিভলি নিস কেন? এত কি সমস্যা তোর তাদের সাথে?”
ছন্দ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কারণ তারা কোন কিছু পজেটিভলি নিতে জানে না। আমার বেলায় কি করেছে দেখোনি? কত সমস্যা ছিল আমাকে নিয়ে। তুমি তো তাদের বাধ্য ছেলে ছিলে, তাই তুমি যাই করতে তাই ঠিক। কিন্তু আমি? অবাধ্য ছিলাম। যার জন্য আমি যাই করতাম তা খারাপই। কোন কাজটা আমার আজ পর্যন্ত পছন্দ করেছে তারা? কোনদিন আমার ক্রিকেট খেলা সাপোর্ট করেনি। আমি খেলতে চাইলে বাবা বে*ত দিয়ে পিটাতো। মনে নেই?”
“তুই তাদের ভুল বুঝছিস। তারা কিন্তু তাদের জায়গায় ঠিকই ছিল। তুই পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত থাকতি বলেই তারা এমন করতো। তখনকার দিনে ক্রিকেট খেলাকে পেশা হিসাবে ধরা হতো না। এই সেক্টরে কোন ভবিষ্যৎ-ই ছিল না। তাই তারা চাইতো তুই পড়ালেখা ঠিক মত কর, নিজের ক্যারিয়ার গড়।”
“তো এখন কি করিনি নিজের ক্যারিয়ার? এই ক্রিকেটের মাধ্যমেই কিন্তু পুরো বিশ্ব চিনে আমায়।”
ফারহাজ নিরলস কন্ঠে বলল, “তুই এই সেক্টরে নিজের জায়গায় করে নিতে পেরেছিস বলে যে সবাই পারবে তা তো না। বেশিভাগ মানুষই অর্ধেক রাস্তায় এসে ঝরে পড়ে। পারে না টিকে থাকতে, ক্যারিয়ার করতে। তাই সে হিসাবে বাবা-মায়ের চিন্তা ঠিকই ছিল।”
ছন্দ কথা বলল না কোন। তা দেখে ফারহাজ বলল, “তুই টিকে থাকতে পেরেছিস, পরিশ্রম করেছিস বলেই সব সম্ভব হয়েছে ফায়াজ। তাই তাদের ভুল বুঝিস না। আব্বু-আম্মু তোর প্রতি কঠোর হয়েছে আমি মানছি কিন্তু তারা সবসময় তোর ভালোই চেয়েছে৷ আর আব্বু-আম্মুর সাথে কখনো সেভাবে মিশিসনি তাই জানিস না তারা কেমন।”
ছন্দ এবারও নিরুত্তর। ফারহাজ বলল, “তুই নিশ্চিন্তে সেখানে প্রাণকে নিয়ে যা। কিছুই হবে না। এভাবেও প্রাণের এখন নতুন পরিবেশ ও একটা ফ্যামিলি টাইপ অ্যাটমোসফিয়ার ভীষণ দরকার। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম সাজেস্ট করছি, সেখানে গিয়ে তাকে দেখাতে পারিস। চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের সাথে মিশতে পারলে, কথা বললে ওর মন এদিকেই থাকবে। রিকোভার করবে দ্রুত।”
ছন্দ বুঝলো ফারহাজের কথা। এখন সে ফ্রি আছে ঠিক তবে বিসিবি থেকে পুনরায় ডাক পড়তে পারে যেকোনো সময়। তখন না চাইলেও তার যেতে হবে আর প্রাণকে থাকতে হবে একা। সেই একাকিত্ব তাকে হ্রাস করবে। তাহলে লাভ কি হবে? তাই ভিনদেশে নেওয়াটাই এখন সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তবে মনের সংশয়ের জন্য মুখে বলল, “তুই যত যাই বলিস না কেন ভাই, তাদের উপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই।”
“আচ্ছা যা, আমি আগে থেকে বুঝিয়ে বলব নে তাদের সব। আশা করি এরপর ঝামেলা হবে না কোন। তুই জাস্ট যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
ছন্দ ফারহাজের কথায় আশ্বস্ত হলো। নীরবে সম্মতি জানালো। ফারহাজ হেসে বলল, “বাবা-মাকে এবার ভরসা করেই দেখ, নিরাশ হবি না।”
____
ছন্দ রুমে ঢুকলো রাত বারোটা বাজার একটু আগে। এতক্ষণ বাহিরেই পায়চারি করছিল সে। ত্রাসিত মনে ব্যগ্রতার ছাঁপ ছিল প্রখর। অজানা এক কারণে বেশ সংকোচ,দুঃশ্চিন্তা কাজ করছিল তার। সেসময় প্রাণ রেজিস্ট্রার নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুললেও পরবর্তীতে যে তুলবে না তা ভাবা বোকামি। কখন যে কি বলে বসে? তার উপর বিয়েটা নিয়ে প্রাণ কি ভাবছে তা জানা জরুরি। প্রাণ যে বিয়েটা আশা বেগমের জন্য করেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ছন্দ জানতো, প্রাণকে আশা বেগমের কথা বললে কিছুটা হলেও গলে যাবে। বিয়ের জন্য রাজি হলে হতেও পারে। তাই কিঞ্চিৎ আশার আলো নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সে এই বিষয়টা তুলে এবং কাজেও লাগে। তবে প্রাণ যে ধরণের মেয়ে, সকল ঘটনা শান্ত মাথায় ভাবলেই চট করে ধরে ফেলবে সব। তখন কোন প্র*ল*য়ং*ক*রী ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসবে, কে জানে। পরিস্থিতি আগের মত হলে বুঝানো যেত সে এসব তাকে পাওয়ার জন্য করেছে। তাকে ভালোবাসে বলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, প্রাণকে বুঝানো দুষ্কর ব্যতীত কিছুই না। এমতাবস্থায় প্রাণ যদি তাকে ভুল বুঝে? দূরে সরে যায়? সে কিভাবে সামলাবে সব? নিবিড় চিন্তাধারায় মাথাব্যথা করে উঠলো তার। নিজেকে কোনরকম বুঝ দিল, “যা হবে দেখা যাবে।” অতঃপর মন-মস্তিক শ্লথ করে সাহস সঞ্চার করলো ভীতরের আসার।
ভিতরে ঢুকে ছন্দ প্রাণকে বিছানায় পেল না। শূণ্য ঘরে এক নজর বুলিয়ে সে দরজা ভিড়িয়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। চাঁদ উঠেছে গগনে। স্নিগ্ধ আলোর ছটা বারান্দার শিক গলিয়ে অন্দর স্পর্শ করছে নির্বিঘ্নে। ফুলের মাতাল করা সুবাস শূন্যে ছুটছে। চন্দ্রসুধা ঠিকড়ে পড়ছে রমণীর ম্লান মুখটায়। ম্রিয়মাণ দৃষ্টি, লাবণ্যতা নেই কোন। তবুও ছন্দের চোখে তাকে মায়াবী দেখাচ্ছে। সে নীরব পায়ে এগিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। স্তিমিত কন্ঠে বলল, “জ্বর কমেছে? দূর্বল লাগছে এখনো?”
কারো শব্দহীন আগমনে প্রাণ ভড়কালো না। তবে উত্তরও দিল না। মৌনতা যেন এখন তার একমাত্র সঙ্গী,শব্দের দেখা পাওয়াই যায় না। ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কক্ষে এসে কাবার্ড থেকে পাতলা চাদর নিয়ে ফেরত গেল। পিছনদিক দিয়ে প্রাণের গায়ে চাদরটা জড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে আছেন, শরীর পরে আরও খারাপ করবে তো।”
প্রাণ পাশ ফিরে এক ঝলক তাকালো। পুনরায় ঘুরিয়ে নিল আঁধারিয়া অম্বরের পাণে। ছন্দ কন্ঠস্বর যতটা সম্ভব নামিয়ে বলল, “কথা বলবেন না? রাগ করে আছেন?”
প্রাণ নিরুত্তর। ছন্দ তবুও অপেক্ষা করলো উত্তরের৷ কিয়ৎক্ষণ পর প্রাণ নিজ থেকে বলে উঠলো, “বাকি সবার মতই আপনি নিজের কথা ভেঙ্গেছেন ছন্দ। প্র*তা*র*ণা করেছেন।”
স্বাভাবিকের তুলনায় ছন্দ দ্বিগুণ ভড়কালো। আশ্চর্যান্বিত দেখালো নয়ন যুগল। তটস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে?”
প্রাণের কন্ঠস্বর শান্ত, শীতল অথচ প্রচন্ড শা*নি*ত, “আপনি কথা দিয়েছিলেন, কোন কিছুতেই আপনি আমাকে চাইবেন না।”
ছন্দ আগেভাগেই আন্দাজ করেছিল এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে। তবে এত দ্রুত তা আশা করেনি৷ নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো৷ সবটা ঠান্ডা মাথায় না সামলালে হাতের বাহিরে চলে যাবে। বলল, “আমি তো আপনাকে চাইনি। সই চেয়েছিলাম।”
“সেটা কি আমাকেই চাওয়া নয়?”
ছন্দ নিজের কথায় অটুট থেকে বলে, “না! সইয়ের মাধ্যমে আপনার নামের পাশে আমার নাম জুড়েছে শুধু। আপনাকে পাওয়া তো হয়নি আমার। আর সে-টা আপনার অনুমতি ব্যতীত হবেও না।”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “আমি যে বয়সে আপনার দুই বছরের বড় তা জানেন?”
ছন্দ হেসে বলল, “তাতে কি? এইজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার, হুইচ ডাজন্ট ম্যাটার। আর ভালোলাগা, ভালোবাসা এসব দেখে হয় না। নাহলে আজ আপনার পাশে আমি থাকতাম না।”
“আমার অতীত সম্পর্কে জানেন তো?”
ছন্দের ভাবান্তরহীন উত্তর, “জানার আর কিছু বাকি নেই।”
“তাহলে এটাও জানেন নিশ্চয়ই নয়ন ও জেসিকার জীবনের ধ্বং*সা*ত্ম*ক আমি? ”
“আপনি সকলের জন্য প্রা*ণ*না*শী*নি হলেও আমার জন্য প্রাণেশ্বরী। আমার একান্ত প্রাণেশ্বরী।”
“আপনার জন্য আমি যাই হই না কেন, আমার জন্য আপনি বিশেষ কেউ নন। আর আমি বিয়েটা করেছি একমাত্র আশামার ইচ্ছে রাখতে৷ এর ব্যতীত কিছু না।”
“বিয়েটা যেভাবেই হোক, আমরা এখন এক সম্পর্কে আবদ্ধ এটাই আসল।”
“একটা সম্পর্কের মূলভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। এটা ছাড়া কোন সম্পর্ক টিকে না। আর নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার মাঝে নেই। আমি পারবো না আর কাউকে আপন করে নিতে, সম্পর্কটা আগলে নিতে।”
“জীবনের এক মোড়ে হেরেছেন বলে, সব মোড়েই হারবেন তা ভাবা বোকামি।”
প্রাণ নিস্পৃহ কন্ঠে বলল, “আবেগ,মোহ ক্ষণস্থায়ী। কেটে গেলে বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। সবটা এত সহজ না। আমাদের সম্পর্কটাই এলোমেলো। দায়িত্ব, কর্তব্যের মাঝে টিকবে কতদিন?”
“কঠিন সব কিছুকেই নিজ উপায় সহজ করে তুলতে হয়। আর আপনাকে বুঝি আমি। তাই বলছি একটাবার সুযোগ দিয়েই দেখুন না, শেষবারের মত ভরসার হাতটা এগিয়ে দিন। কথা দিচ্ছি, মন ভা*ঙ্গ*তে দিব না আপনার। সর্বদা আগলে রাখবো, আপনাকে এবং সম্পর্কটাকে।”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। সে বুঝে গিয়েছে এই একরোখা মানবটাকে বুঝানো তার পক্ষে সম্ভব না। মানুষটা কোনভাবেই পিছপা হবে না আর। প্রাণ যৎসামান্য সময় মৌন রইলো। অতঃপর কোন কথা না বলে চলে গেল শয়নকক্ষের দিকে৷ ছন্দ সেদিক তাকিয়ে আলগোছে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
_______
ফারহাজ ও মোহনা চলে যায় এরপরের দিনই। থাকে না আর তারা। ছন্দও চৈতির সাহায্যে প্রাণের সকল শুট,অ্যাড ও মুভির কন্ট্রাক্ট স্থগিত করে দেয়। ছুটি নিয়ে নেয় ছয়মাসের মত। সে সাথে প্রাণের পাসপোর্টসহ বাকি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যোগাড় করে নিয়ে এম্বাসিতে জমা দিয়ে দেয়। দুইজনের গ্রিন পাসপোর্ট হওয়ায় কয়েক সপ্তাহ মধ্যেই ভিসা পেয়ে যায় তারা। টিকেট কনফার্ম করে ছন্দ তার এবং প্রাণের লাগেজ গুছিয়ে নেয়। সব ঠিকঠাক থাকলে দুইদিনের মধ্যেই চলে যাবে তারা। তবে ইদানীং প্রাণ নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে একবারে। হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ বাদে কোন কথাই বলতে চায় না। সারাদিনে ছন্দ কত চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না। আগে তো ঔষধ খাওয়ানোর সময় তার মুখে শব্দ ফুটতো, এখন সচরাচর তাও হয় না। প্রাণের মনে কি চলছে তা বুঝাও দুষ্কর। মাঝে মধ্যেই ছন্দের ভীষণ ভয় হয়। প্রিয়তমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। পরিস্থিতি এখন যেভাবে এগুচ্ছে, তা নিম্নের দিকে। তার এখন জানা না এসবের পরিণতি কি হবে বা হতে চলেছে। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে, হয় লন্ডনে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে নাহয় সমাপ্তি। দেখা যাক, ভাগ্য তাদের কোন মোড়ে এসে দাঁড় করায়।
#চলবে