#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩২
“প্রাণ উঠো। তুমি আমার সাথে বাসায় যাচ্ছ।”
কথাটা শুনে প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নতজানু হয়ে বসে রইলো৷ এমতাবস্থায় ছন্দ পিছন থেকে বলে উঠলো,”প্রাণ আপনার সাথে কোথাও যাবে না।”
ছন্দের কথাটা শুনে নিহাল পিছন তাকালেন। তিনি জানেন, প্রাণের মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক কি রকম। এর আগেও এমন পরিস্থিতি এসেছিল তখন প্রাণের কি অবস্থা হয়েছিল তা দেখেছেন। এবার তো কেউ নেই ও ওকে সামলানোর জন্য, একা রাখলে উল্টাপাল্টা কিছু হতে যে সময় লাগবে না। তাই চাইছিলেন প্রাণকে নিজের সাথে নিতে। কিন্তু মাঝে ছন্দের বাঁধা দেওয়ায় মেজাজ বিগড়ে গেল তার। বুঝে উঠতে পারলেন না এত কিসের কর্তৃত্ব প্রাণের উপর তার। তাই রুষ্ট কন্ঠে বললেন, “আমাকে এটা বলার তুমি কে?”
ছন্দ এগিয়ে এসে বলল, “আমি যাই হই, তা আপনার না জানলেও হবে। তবে আমার বর্তমানে আপনি উনাকে কোথাও নিতে পারবেন না। অধিকার নেই আপনার।”
নিহাল এবার রেগে উঠে বলেন, “আমি ওর বাবা হই, ওকে নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার৷ আর তুমি আমাকে থামাচ্ছো কোন সাহসে? কোন অধিকার আছে তোমার ওর উপর? নেই তো! তুমি এখানে বাহিরের মানুষ, আমাদের মেহমান। তাই নিজের সীমার মধ্যে থাকলে খুশি হবো।”
ছন্দ ঈষৎ সময় নীরব থেকে নত দৃষ্টিতে বলল, “আছে!”
ছন্দের কথা ঠিক বুঝতে না পেরে নিহাল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, “কি আছে?”
“প্রাণের ওপর আমার অধিকার আছে।”
“কি শুনি?”
ছন্দ দৃষ্টি তুলে তাকালো এবার। মৃদু হেসে শীতল কন্ঠে বলল, “শি ইজ মাই ওয়াইফ।”
কথাটা শুনে চৈতি মাথা তুললো তৎক্ষনাৎ। গোলগাল চোখে তাকালো ছন্দের পাণে। প্রাণ তখনও মাথা নত করে বসে। অন্তর্দাহে আবৃত মন বাস্তব জগতে কি হচ্ছে তার খোঁজ রাখতে আগ্রহী নয়। সে তো নিমজ্জিত অতীতের পাতায়, মধুর স্মৃতির সন্ধানে৷ এদিকে নিহাল ছন্দের কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলেন না। তিনি খানিকটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই বললেন, “যা তা বল না।”
“যা তা বলার মানুষও না।” কথাটা বলে ছন্দ পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে গ্যালারি থেকে কিছু ছবি বের করে নিহালের সামনে ধরে বলল, “টেক আ লুক।”
নিহাল শিকদার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন, ছবিগুলো হচ্ছিল রেজিস্ট্রার পেপারের, নিচের দিকে প্রাণ ও ছন্দ দুইজনের সই-ই স্পষ্ট। যা প্রমাণ করে তারা দুইজন আইনগতভাবে বিবাহিত৷ নিহাল শিকদার স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বললেন, “কবে হলো এসব?”
“তা জেনে আপনার কাজ নেই।”
নিহাল শিকদার বিহ্বল,বাক্যহীন। সে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না ছন্দ ও প্রাণের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এত বড় একটা বিষয় তার থেকে গোপন রইলো কিভাবে কে জানে? এর মাঝে ছন্দ বলে উঠলো, “প্রাণের দায়দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণ আমার। তাই আপনার হস্তক্ষেপ আর চাইছি না। আশা করি বুঝবেন।”
নিহাল প্রত্যুত্তর করার মত কিছু পেলেন না। আলগোছে শুধু তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। বুঝলেন তার এখানে কোন প্রয়োজন নেই৷ প্রাণকে সামলানোর মত মানুষ আছে, তার পাশে। বললেন, “বেশ! আসছি আমি।”
“আর একটা কথা, আমার আর প্রাণের সম্পর্কে কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে। আমি নতুন ঝামেলা কোন ঝামেলা চাইছি না।”
নিহাল শান্ত কন্ঠে বলেন, “চিন্তা নেই, জানবে না। তবে ওর খেয়াল রেখ।”
ছন্দ ঠেস মেরে বলে, “তা আপনার চেয়ে ভালোই রাখবো।”
নিহাল দ্বিরুক্তি করলেন না কোন। কিছুটা অপমানিতবোধ করলেন বিধায় বেরিয়ে গেলেন নৈঃশব্দ্যে। নিহাল যেতেই চৈতি বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ছন্দ স্যার এসব কি সত্যি? আপনি আর ম্যাম আসলেই…”
“হ্যাঁ সত্যি।”
নেত্রে চশমা থাকা সত্ত্বেও চৈতির বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলো সে, “কবে হলো এসব?”
“সে এক লম্বা কাহিনি। অন্য আরেকদিন বলব। এখন আমায় একটু সাহায্য করতে পারবে।”
চৈতি নিজের সিক্ত গাল দুটো মুছে নিয়ে বলল, “জি বলুন।”
“প্রাণের সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে দিবে একটু? তাকে আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। এই বাসায় থাকা তার জন্য ঠিক না।”
চৈতি বুঝলো বিষয়টা। আশা বেগমের স্মৃতিতে ‘সুখনীড় ভিলা’ ঠাসা। এখানে থাকলে প্রাণ কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে না, প্রতিক্ষণে মনে পড়বে তার আশা বেগমের কথা। ডিপ্রেসড হয়ে পড়বে। যা কি-না তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবেও আজ যে স্বভাবের বিপরীত ধারায় চলছে, কখন কি হয় বলাও যায় না। তাই চৈতি সম্মতি জানালো। উঠে দাঁড়ালো প্রাণের পাশ থেকে। ছন্দ পুনরায় বলল, “উনার ঔষধপত্র,মেডিক্যাল রিপোর্ট সব কিন্তু আলাদা করে প্যাক কর। আর পরে আমাকে স্ক্যাডিউল বুঝিয়ে দিও। কখন কোন মেডিসিন দিতে হবে।”
“আপনি জানেন এসব সম্পর্কে?”
“সবই জানি আমি। আন্টি বলেছেন আমায়।”
চৈতি মৌন রইলো। অতঃপর চলে গেল জিনিসপত্র গোছাতে। চৈতি যাওয়ার পর ছন্দ সোফায় গিয়ে বসলো। অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো প্রাণকে। সে সময় দিতে চাইছে তাকে, থাকুক একটু একা। চৈতির সব গোছগাছ করে ফিরলো আধা ঘন্টার মাঝে। ছন্দ নিজের ড্রাইভারকে কল করে ভিতরে আসতে বলল। অতঃপর তাকে দিয়ে সকল জিনিসপত্র গাড়িতে উঠিয়ে নিল। ছন্দ এবার প্রাণের সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলো। কোমল কন্ঠে বলল, “প্রাণ উঠুন! আমার সাথে যাবেন আপনি।”
প্রাণ নড়লো না। প্রত্যুত্তরও করলো না কোন। ছন্দ আস্তে করে ধরে তার মাথা তুললো। দেখতে পেল, নয়ন জোড়া আ*র*ক্ত হয়ে আছে৷ অধর যুগল শুকিয়ে শুষ্ক-রুক্ষ। মুখও ভার ভার দেখাচ্ছে ভীষণ। ছন্দ খুব সন্তর্পণে প্রাণের মুখশ্রীর উপর গড়াগড়ি খাওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুছিয়ে দিয়ে বলল, “যাবেন না?”
প্রাণ তখনও নিরুত্তর। ছন্দ প্রাণকে উঠানোর জন্য তার কাঁধে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো সে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। এতক্ষণ বসে থাকার জন্য বুঝা যায়নি বিষয়টা। ছন্দ অপেক্ষা করলো না। নিভৃতে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো।
_________
চার রুম বিশিষ্ট ফ্ল্যাটটায় পিনপতন নীরবতা বিদ্যমান। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানের শা শা শব্দ কানে এসে লাগছে। পাশেই জানালা দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখা যাচ্ছে। প্রাণ বিছানার একপ্রান্তে নির্জীব ভঙ্গিতে বসে আছে। অন্যদিকে, ছন্দ ও চৈতি মিলে জিনিসপত্র ঠিক করছে। ছন্দের কথায় চৈতি তাদের সাথে এসেছে, সাহায্য করতে। কাজ শেষ হলে চলে যাবে সে।
এই ফ্ল্যাটটা ছন্দ লোকালয় হতে খানিকটা দূরেই বানিয়েছিল। বসুন্ধরা রিভার ভিউ নামে অনেকে চিনে আবার চিনেও না৷ চারদিকে গাছপালা, সামনেই ছোট নদী ও কাশবন। শান্ত,নিস্তব্ধ,নির্মল পরিবেশ। প্রকৃতি প্রেমী হওয়ায় জায়গাটা মনে ধরে তার। উপরন্তু, এদিকটা বেশি পরিচিত না হওয়ায় মানুষজনের আনাগোনাও ছিল নেহাৎ কম। তাই দ্বিতীয় ভাবনা আসার আগেই থাকার জন্য দোতলা একটি বাড়ি বানিয়ে ফেলে সুপ্তভাবে। জিহান ও তার বড় ভাই ব্যতীত কেউ জানে না এই বাসার সম্পর্কে। যার জন্য মাঝে মধ্যে শান্তি পেতে ও রিপোর্টারদের ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকে। ছন্দের মনে হলো প্রাণকে এখানে রাখলেই ভালো হবে। কেউ তাদের খোঁজ পাবে না সে সাথে পাপাজিদের ঝামেলাও তেমন থাকবে না। প্রাণ নিজের মত কিছুটা সময় শান্তিপূর্ণভাবে কাটাতে পারবে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছন্দ বারবার প্রাণকে লক্ষ্য করছে। তার মনে অজানা ভয় বাসা বেঁধে বসে আছে। এমন লাগছে প্রাণকে চোখের আড়াল করলেই বুঝি উড়াল দিবে। চলে যাবে তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
কাজের মাঝে ড্রাইভার এসে কাঁচাবাজার দিয়ে গিয়েছে। সে সাথে শুকনো কিছু খাবার। মাস খানেক ধরে বাসাটা তালাবদ্ধ থাকায় ফ্রিজ ফাঁকা। খাওয়ার মত কিছু ছিল না বিধায় বাজার করে আনিয়েছে। ধুলোবালির স্তুপও জমেছিল যত্রতত্র, তাই আসার পূর্বে খবর দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে সব।
চৈতিকে বিকেলের দিকে নিজের গাড়িতে করেই পাঠিয়ে দিয়েছিল ছন্দ। এখান থেকে তার বাসার দূরত তিন থেকে চার ঘন্টার পথ। কতক্ষণ আর ধরে রাখা যায় তাকে? বিপদের সময় এগিয়ে এসেছে এই তো অনেক। অন্যথায় আজকাল দিনে বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে কে? সবাই তো মুখ ঝাপটা মেরে চলে যায়।
হাতে কাজ শেষ করে ছন্দ নামে রান্না করতে। ব্যাচেলর হওয়ার সুবাদে রান্নাটা রপ্ত করেছে ভালোভাবেই। যাতে রাত-বিরেতে খিদা লাগলে অনাহারে ম*র*তে না হয় তাকে। কাজের ফাঁকে সামনে নজর যেতেই, খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখিটি চুপটি করে বসে থাকতে দেখলো সে। আসার সময় পাখিটাকে নিয়ে এসেছিল সে। টিয়াটিকে দেখে লাগছে, মন যেন আজ তারও খারাপ। ধূসর আকাশে ঢাকা। আচ্ছা, পাখিটা কি কোনভাবে তার মালকিনের কষ্ট বুঝতে পেরেছে? যার জন্য সেও তার মত মৌনব্রত পালন করছে? কথাটা ভেবে ছন্দ স্মিত হাসলো। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে খাঁচার ভিতর খাবার আর পানি দিয়ে আসলো।
রান্না শেষ করতে করতে সন্ধ্যে হলো তার। কোনরকম মুখ-হাত ধুয়ে খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে গেল প্রাণের জন্য। মেয়েটা কাল রাত থেকে কিছু খায়নি। পানি পর্যন্ত না। চৈতি খুব চেষ্টা করেছিল তাকে খাওয়ানোর। কিন্তু প্রাণ বাধ্য মেয়ে হলে তো। শেষে চৈতিও হাল ছাড়ে।
খাবার নিয়ে প্রাণের সামনে বসলো ছন্দ। নিজের হাতে খায়িয়ে দিবে বলে ভাত মেখে তার সামনে ধরে বলল, “খেয়ে নিন। নাহলে শরীরে শক্তি পাবেন না।”
প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ছন্দ অনেক চেষ্টা করল তার মন ভুলাতে কিন্তু পারলো না। শেষে না পেরে ছন্দ বলল, “আশা আন্টি কিন্তু আপনাকে ভালো থাকতে বলেছিল। অথচ আপনি ভালো থাকছেন না, এটা কি ঠিক? আন্টি কষ্ট পাবে না?”
প্রাণ এবার যত দৃষ্টি তুলে তাকালো ছন্দের দিকে। দীর্ঘসময় প্রতিক্ষার পর অবশেষে মৌনতা ভেঙ্গে সে বলল, “আর আমি যে কষ্ট পাচ্ছি?”
“জানি পাচ্ছেন। কিন্তু এখানে আন্টির কি দোষ ছিল বলেন? তার কি হাত ছিল কোন কিছুতে?”
প্রাণ উত্তর দিল না। নীরব রইলো। ছন্দ পরবর্তীতে অনেক কিছুই বলল কিন্তু প্রাণ জবাব দিল না। ছন্দ এবার অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করলো। সে আদুরে কন্ঠ বলল, “আন্টির সাথে দেখা করতে চান?”
প্রাণ এবার উত্তর দিল, “হু?”
ছন্দ প্রাণকে সম্পূর্ণ বাচ্চাদের মতই ট্রিট করছিল। সে বেশ বুঝতে পারছিল, তার জানা সেই বুঝদার,বাস্তববাদী প্রাণটা এখন নিজের মধ্যে নেই। হারিয়ে গিয়েছে অতুল সমুদ্রে। তাই স্বাভাবিক কথায় সে গলবে না, তাকে সামলাতে হবে নাজুক হাতে। ঠিক ছোট বাচ্চাদের মত। তা সে বলে উঠলো, “আপনি যদি এখন ভাত খান তাহলে আমি আন্টির সাথে দেখা করতে নিয়ে যাব আপনাকে। ইটস আ প্রমিস।”
পদ্ধতিটা আসলেই কাজে দিল। ছন্দ প্রাণের মুখের সামনে খাবার ধরতেই সে চুপচাপ খেয়ে নিল৷ ছন্দের ঠোঁটের কোণে এবার প্রশান্তির হাসি দেখা দিল।
#চলবে
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৩
আকাশে ঘন বাদল জমেছে। দূর হতে শোনা যাচ্ছে মৃদু মৃদু বজ্রধ্বনি। হাওয়ারা মেতেছে দুরন্তপনায়। উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। পরিবেশ প্রতিকূলে, যেকোন মুহূর্তে ঝড় নামবে। এমতাবস্থায় বাসায় থাকাটা বেশি উত্তম। অথচ ছন্দ প্রাণকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছে। বড়রাস্তার ধারে নির্দ্বিধায় ড্রাইভ করছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বের হওয়ার একমাত্র কারণ, প্রাণকে সে কথা দিয়েছিল আশা বেগমের সাথে দেখা করাবে। আর সে চায় না কোনভাবে তার ওয়াদা ভঙ্গ করতে। অন্যথায় সম্পর্কের শুরুতেই সে প্রাণের বিশ্বাস হারাবে। তাই বাধ্য হয়েই ঝুঁকিটা নিল। ঘন্টারও অধিক পথ অতিক্রম করে তারা এসে পৌঁছালো কাঙ্ক্ষিত স্থানে। ছন্দ নামলো আগে, এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল প্রাণের জন্য। প্রাণ বের হতেই তার হাতটি শক্ত করে ধরলো ছন্দ। আশপাশ নিকষকৃষ্ণ আঁধারে নিমজ্জিত। দেখা যাচ্ছে না কিছু। ছন্দ মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল ভিতরে। নির্জন,নিস্তব্ধ পরিবেশ। সম্পূর্ণ জায়গায় গাছ-গাছালিতে আচ্ছাদিত। কেমন গা ছমছমে ভাব। ছন্দ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো। প্রত্যেকটি কদম ফেললো খুব সতর্কের সাথে। খেয়াল রাখলো প্রাণের দিক, সামান্যটুকু অবহেলা নেই এর মধ্যে। কয়েক মিনিট অন্বেষণ চালানোর পর ছন্দ খুঁজে পেল আশা বেগমের ক*ব*র। ছন্দ সামনে এগিয়ে বলল, “নিন! চলে এসেছি আমরা।”
প্রাণ এতক্ষণ যান্ত্রিক মানবের ন্যায় হাঁটছিল। অনুভূতিশূন্য হয়ে। শেষে ছন্দের কথা কর্ণরন্ধ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে চোখ তুলে তাকালো। অতঃপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো নতুন খো*ড়া ক*ব*র*টার দিকে। স্থির হলো সে। একমনে, একধ্যানে দেখতে থাকলো ক*ব*র*টা। প্রাণকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছন্দ তার সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “প্রাণ, আর চুপ থাকবেন না। এই দেখুন, আশামা আপনার সামনে। এবার মনে যা আছে তা নিঃসংকোচ বলে ফেলুন। মনে যত ক্ষোভ,দুঃখ, কষ্ট সব শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে দিন। এভাবে চুপ থেকে নিজেকে আর কষ্ট দিবেন না। কথা বলুন।”
প্রাণ সবই শুনলো কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর করলো না।কিয়ৎক্ষণ পর অনুভব করলো তার গলা জড়িয়ে আসছে। শরীর ঈষৎ কাঁপছে। আবেগহীন মন ডুকরে উঠছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল, “কেন ধোঁ*কা দিলে তুমি আমায় আশামা? কেন?”
প্রাণ একটু থেমে পুনরায় বলল, “তুমি না বলেছিলে সবসময় আমার পাশে থাকবে? আগলে রাখবে? তাহলে নিজের কথা ভাঙলে কেন তুমি? এমন প্র*তা*র*ণা, বি*শ্বা*স*ঘা*ত*ক*তা কেন করলে? কেন ছেড়ে চলে গেলে আমায়? কেন?”
কথাটা বলতে বলতে প্রাণ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লো৷ হাটু গেড়ে বসে পড়লো ক্ষণেই। ছন্দও বসলো তার সাথে। আগলে নিল তাকে অন্তঃস্থলের উপরিভাগে। প্রাণও দিগ্বিদিক না ভেবে আঁকড়ে ধরলো ছন্দকে। অবশেষে বাঁধ ভাঙ্গলো৷ নেত্রের কার্নিশে ভিড় করলো অশ্রুবিন্দু৷ টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। অন্তর্দাহে সিক্ত হলো মন।
ছোটবেলায় মাকে হারানো পর আশা বেগমকেই কাছে পেয়েছিল সে। মায়ের স্নেহ,আদর সব তার থেকেই পাওয়ায়। নিজ সত্তার অর্ধাংশ ছিলেন তিনি প্রাণের। আজ তাকে হারিয়ে প্রাণ নিঃস্ব,নিঃসঙ্গ যেন। পাষাণ মনের অধিকারী মানবটি যে কি-না এতক্ষণ ধরে পাথর হয়ে ছিল। সে ছন্দের হৃদয়ের উষ্ণতা পেতেই মোমের ন্যায় গলে গেল। বক্ষঃস্থল বাঁধা দুঃখের জমাট বরফ তরল কান্নায় রূপান্তরিত হলো। ছন্দকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠল। নিঃশব্দ কান্না আজ তার ভাষা খুঁজে পেল বোধহয় বহু বছর পর। অবরুদ্ধ আবেগ হারিয়ে যাওয়া পথ ফিরে পেল আবার অনেক অনেক দিন পর। ছন্দও আগলে নিল তাকে৷ খুব যত্নে। প্রাণ আধভাঙ্গা গলায় বাচ্চাদের মত বিচার দিয়েই চলেছে ছন্দের নিকট। আশা বেগমকে নিয়ে কতশত অভিযোগ। ছেড়ে যাওয়ার আকুতি৷ ছন্দ মৌনতা পালন করে সব শুনছে অভিনিবেশ সহিত৷ মিনিট কয়েক না গড়াতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। মেঘ ডেকে উঠলো গম্ভীরভাবে৷ ভিজিয়ে দিয়ে গেল দু’জনকে। এর সাথে সাথে প্রাণও নীরব হয়ে এলো৷ অর্ধনিস্তেজ হয়ে পড়লো ছন্দের বক্ষঃস্থলে। ছন্দ ডাকলো তাকে কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। সে দ্রুত প্রাণকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো। তাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে নিজেও উঠে বসলো। পিছনে তার পুরনো একটা শার্ট রাখা ছিল ওটা নিয়ে প্রাণকে ভালোমত ঢেকে দিল। মেয়েটা এখনই কাঁপছে অথচ বাসায় যেতে ঘন্টারও উপরে সময় লাগবে। না জানি এর মাঝে তার জ্বর এসে পড়ে। এই পরিবেশে তাকে নিয়ে আসাটাই বোধহয় তার ভুল হয়েছে৷
বাসায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ছন্দের ভাবনাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো৷ প্রাণের সর্বোচ্চমাত্রা ছাড়িয়ে জ্বর এসেছে, তাপে শরীর তার ঝ*ল*সে যাচ্ছে তার। ছন্দ প্রাণকে শয়নকক্ষে শুয়ে দিয়ে তার জন্য জামাকাপড় বের করলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো পোশাক পরিবর্তন করা নিয়ে। ছন্দ এবং প্রাণ আইনগতভাবে বিবাহিত হলেও, ধর্মীয় দিক দিয়ে না। যার জন্য প্রাণকে সেভাবে স্পর্শ করার অধিকার নেই তার। এদিকে প্রাণও নিজের মধ্যে নেই, অর্ধচেতন সে। জ্ব*রে পুড়ে যাচ্ছে শরীর৷ ছন্দ পড়লো বিপাকে। কি করবে না করবে এই ভেবে৷ আশেপাশে চেনা জানা এমন কেউ নেই যে এই মুহূর্তে গিয়ে সাহায্য চাইবে। শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না পেয়ে ছন্দ প্রাণের কাছে এগুলো। প্রাণকে আস্তে আস্তে করে ডেকে তুললো। কিছুক্ষণ পর প্রাণের হুস ফিরলো। ছন্দ তাকে টেনে উঠে বসালো, ঠিক মত বসতেও পারছে না সে। হেলছে দুলছে৷ ছন্দ করুণ কন্ঠে বলল, “প্রাণ কষ্ট করে একটু চেঞ্জ করে নিন। ভেজা জামাকাপড়ে থাকা ঠিক না আপনার জন্য। এভাবেই জ্বর বাঁধিয়েছেন।”
প্রাণ ম্লানমুখে তাকালো। ছন্দ পুনরায় একই কথা বলতে বেসামাল হাতে তার থেকে কাপড়গুলো নিয়ে নিল। ছন্দ তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেন, “আমি বাহিরেই আছি। সমস্যা হলে ডাক দিবেন।”
কথাটা বলেই ছন্দ দরজা ভিড়িয়ে বাহিরে চলে গেল। তবে মিনিট দশকের পরও যখন প্রাণের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তখন ছন্দের ভয় হলো। সে দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তর এলো না৷ মনে কিঞ্চিৎ ভয় নিয়েই কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললো সে। দেখতে পেল প্রাণ জামাকাপড় বদলে বিছানার মাঝে গুটি-শুটি মেরে শুয়ে আছে। দূর থেকে দেখেও বুঝা যাচ্ছে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। প্রাণ ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। বিরবির করে বলল, “এই মেয়েটাও না। মন তো হরণ করেছেই, কবে না জানি জীবনটাও হরণ করে ফেলে।”
ছন্দের নিজেরও ঠান্ডা লাগছিল বিধায় সে দ্রুত শুকনো কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে মাটি থেকে প্রাণের ভেজা কাপড় সব একটা বালতিতে তুলে রাখে৷ প্রাণের সান্নিধ্যে আসতেই সে দেখতে পায় তার চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। চাদর খানিকটা ভিজে গিয়েছে এতে। ছন্দ আরেকটা তোয়ালে বের করে প্রাণকে দ্বিতীয়বারের মত টেনে উঠে বসালো। আলতো হাতে তার চুল মুছে দিতে থাকলো৷ প্রাণ তখনও স্বাভাবিক নয়, হেলে-দুলে পড়ছে। তাই সে ছন্দের পেটের উপর মাথা ঠেস দিয়ে রাখলো। ছন্দ তা দেখে হেসে বলল, “আপনি আসলেই একটা বাচ্চা।”
নিজের কাজ শেষে ছন্দ সরে আসলো। পায়ের দিকে নজর যেতে দেখতে পেলো ব্যান্ডেজ ভিজে বিশ্রী অবস্থা। ছন্দ ড্রেসিংটেবিলের ছোট ড্রয়ার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসে৷ খুব সন্তর্পণে প্রাণের পায়ের ব্যান্ডেজ পাল্টে দেয়। অতঃপর সন্ধ্যায় করে রাখা রান্না থেকে অল্প একটু নিয়ে এসে প্রাণকে জোর করে খায়িয়ে দেয়। সাথে মেডিসিনও। চৈতি প্রাণের ঔষধপত্র গুছানোর সময় প্যারাসিটামল, এন্টিবায়োটিকও সাথে নিয়েছিল। যার জন্য এখন রক্ষা হলো। ছন্দ প্রাণকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ভারি কম্বলটা তার গায়ে জড়িয়ে দিল। সে রুম থেকে চলে যেতে নিলে প্রাণ অস্পষ্টস্বরে ডেকে উঠলো, “আশামা যেও না৷ যেও না তুমি। আমি একা থাকতে পারবো না। আশামা!”
ছন্দ থমকালো। ম্রিয়মাণ দৃষ্টি তার। সে নিভৃতে তার পাশে গিয়ে বসলো। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি যাচ্ছি না কোথাও। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”
প্রাণ তবুও বিরবির করে আশা বেগমের নাম আওড়াতেই থাকলো। তারপর একসময়টা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঘুমিয়ে পড়লো। আর ছন্দ? সে তো মগ্ন অন্যভাবনায়। মস্তিষ্কে তার কি চলছে একমাত্র সে আর উপরওয়ালাই জানে।
__________
নব্য প্রত্যুষের আলোয় চারদিকে ডানা মেলতেই জিহান এসে হাজির হলো ছন্দের দুয়ারে৷ ছন্দই ডেকে আনিয়েছে, কথা আছে বলে। প্রাণ তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মাঝ রাতে ঘাম দিয়ে উঠায় জ্বর খানিকটা সেরে এসেছে তার। গতরাতের মত অবস্থা শোচনীয় নয়, বেশ ভালো। ছন্দ তাকে একবার ভালো মত দেখে রুমের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। জিহান সোফায় বসেছিল। ছন্দকে আসতে দেখে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে সাত-সকালে এভাবে ডাকলি কেন? তাও আবার এই ফ্ল্যাটে? কিছু কি হয়েছে?”
জিহান প্রাণ সম্পর্কিত কোন ঘটনাই জানতো না। খবর পায়নি। আর পাবেই কিভাবে? প্রাণ নিজের জীবন গোপন রেখে চলে। হাতে গোনা দুই-একটা খবর বাদে তার ব্যক্তিগত জীবনে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সবের কিছুই বাহিরের জগৎ-এর কেউ কস্মিনকালেও জানতে পারে না। যার জন্য আশা বেগম প্রাণের কি ছিলেন বা তার মৃত্যুর বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গিয়েছে। ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। শুরু থেকে সব খুলে বললো জিহানকে। সব শুনে জিহান আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো, “মানে প্রাণ এখন তোর কাছে?”
ছন্দ মাথা দুলালো। জিহান মাথায় হাত দিয়ে বসলো। তার বন্ধু যে এমন ধুরন্ধর প্রকৃতির বের হবে কল্পনায়ও ভাবেনি সে৷ জিহান বিমর্ষচিত্তে বলে উঠলো, “আমাকে না জানিয়ে এত বড় স্টেপ নিতে পারলি তুই?বিয়ে পর্যন্ত করে ফেললি।”
“বিয়ে করিনি রেজিস্ট্রার করিয়েছি শুধু।”
“একই তো হলো।”
“না এক না। ইসলামিক শরিয়ত ছাড়া এই বিয়ে জায়েজ না।”
জিহান সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তো তুই এখন কি করতে চাইছিস?”
ছন্দ মেঝের দিক তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো, “কাজী খুঁজে আন। বিয়ে করব আমি।”
#চলবে