#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩০
অপরাহ্ণের প্রথমভাগ। তেজস্বান সোনালী রোদ্দুর মিঠে হয়ে এসেছে। নীলাভ অন্তরিক্ষ জুড়ে রঙবেরঙের মেঘ খেলা করছে। আড়ম্বরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নৈসর্গিক মায়ায় ডুবাতে অজানা এক পাখি কূজন তুলেছে। আবহাওয়া ঠান্ডা রাখতে দুর্দম হাওয়া বহমান। দোল খাচ্ছে নীলবর্ণা পর্দাগুলো। প্রাণ সোফায় পিঠ হেলিয়ে বসেছিল তখন। দৃষ্টি তার জানালার বাহিরে, বিস্তৃত আকাশের দুর্গমস্থানে। কিন্তু মন-মস্তিক নিমজ্জিত অতল ভাবনায়। সকালে হয়ে যাওয়া ঘটনাই পুনর্বিবেচনা করছিল। ছন্দের কাজকর্ম, শেষ উক্তি সব। অবচেতন মন উঠে পড়ে লেগেছে ‘শাদি মুবারক’-এর মানেটা খুঁজতে। সন্দেহের কাটা যদিও এক জায়গায় গিয়েই আটকাচ্ছে কিন্তু তা কতটুকু ঠিক জানা নেই তার। মস্তিষ্ক বলছিল, “ওইটা রেজিস্ট্রার পেপার ছিল।” কিন্তু মন বলছিল বিপরীত কথা। কেন যেন, মন বিশ্বাস করতে চাইছে না ছন্দ তার সাথে ছলচাতুরীও করতে পারে। মন ও মস্তিষ্কের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের হতে প্রাণ সকাল হতে অগণিতবার ফোন লাগালো ছন্দকে। কিন্তু ছন্দ মহাশয় না কল তুললেন, আর না কল ব্যাক করলেন। শেষে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ফোন দিল না আর। থম মেরে বসে রইলো। সে ভেবে কূল পাচ্ছিল না, “যদি কাগজগুলো সত্যি সত্যিই রেজিস্ট্রার পেপার হয়ে থাকে তাহলে কি হবে?” চিন্তায় মাথা ব্যথা করতে শুরু করলো প্রাণের। সে জানে, তার সাথে আর যাই হোক ছন্দের নাম জুড়তে পারে না। তাদের মধ্যে কিছু হওয়া মানেই ভিত্তিহীন। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলো না। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? সারাদিনে এক মুহূর্তের জন্যও এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না সে। উল্টো চোখের সামনে ভাসতে থাকলো ছন্দের কর্মকাণ্ড গুলো।
এদিকে, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল হতে চললো অথচ ছন্দের দেখা দেওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুদ্দেশ কোথায় হলো কে জানে? প্রাণের এসব আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝে জানালার ধারে এসে বসলো একটি দাঁড় কাক। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকেই। অকস্মাৎ দাঁড় কাকটি দেখে প্রাণ থমকালো। মনে পড়লো তার মায়ের কথা, ছোট থাকতে তিনি প্রায়শই বলতেন, “দাঁড় কাক অশুভ হয়। যে দুয়ারে যায় মৃত্যুর খবর বয়ে নিয়ে যায়।”
কথাটা টনক নাড়তেই ভয় হয় প্রাণের। একপলক তাকালো সামনেই শুয়ে থাকা আশা বেগমের দিকে। অতঃপর ত্বরিত গতিতে উঠে জানালার কাছে গেল, হাতের ইশারায় ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো৷ প্রাণকে নিকটে আসতে দেখে কাকটি অবিলম্বে কা কা শব্দ করে উড়াল দিল উদ্দেশ্যহীন পথে। প্রাণ এবার থাইগ্লাস লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চি*রে৷ সকল ভাবনা ছুঁ*ড়ে ফেলে আশা বেগমের পাশে ছোট টুল টেনে বসলো সে। তার খালি হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সন্তপর্ণে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এরপর হাতটা গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বিরবির করে বলল, “তোমাকে আমি হারাতে পারবো না আশামা। কোনভাবেই না।”
.
সায়াহ্নের অরুণ পশ্চিমাকাশে মিইয়ে যাওয়ার পরমুহূর্তেই ছন্দ এসে হাজির হলো। কেবিনের ভিতর ঢুকতেই দেখতে পেল প্রাণ আশা বেগমের কোমরের পাশে মাথা নুয়ে শুয়ে আছে৷ টুলের উপর বসে থাকার কারণের তার অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে। ছন্দ এগিয়ে গিয়ে প্রাণের সন্নিকটে হাঁটু গেড়ে বসলো। একটু ঠেস দিয়ে বসলো যাতে পড়ে না যায় সে। অতঃপর ঘুমন্ত প্রাণকে অনিমেষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। খুব কাছ থেকে। গভীরভাবে। আদুরে ভাব তার মুখমণ্ডল জুড়ে। সামনের চুলগুলো ছোট থাকায়, ক্লিপ দিয়ে বাঁধার পরও একগাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নেত্রপল্লবের উপরিভাগে। বিরক্ত করছে কিঞ্চিৎ। ছন্দ তাদের সাথেই দুষ্টুমি করতে হালকা ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো তাদের। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো নড়ে উঠার বদলে প্রাণ নড়ে উঠলো। প্রায় সাথে সাথে টুল হতে ভারসাম্য হারালো, তবে পড়ার আগেই সময়মত ছন্দ আগলে নিল তাকে। ঝুঁকে আসলো মুখ বরাবর, মাঝে দূরত্ব বিদ্যমান রইলো এক ইঞ্চি। ঝাঁকুনি খেয়ে প্রাণের ঘুম ছুটে গেল, অর্ধনিভন্ত নয়নে তাকালো সামনে। অর্ধসচেতন মন প্রথমে কিছু উপলব্ধি করতে না পারলেও পরমুহূর্তে ছন্দকে নিজের এত কাছে অনুভব করতে পেরে পিলে চমকে উঠলো। প্রাণ তৎক্ষনাৎ সরে আসতে নিলে ঠুস করে বা*রি খেল ছন্দের মাথার সাথে। দুইজনই একসাথে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “উহ!”
প্রাণ কপালে হাত গিয়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলে মেরুদণ্ডে টান অনুভব করলো। সুক্ষ্ম ব্যথাটা নিতে না পেরে আঁখিপল্লব এক করে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো। পড়ে থাকলো ছন্দের সান্নিধ্য, চেপে ধরলো তার এক বাহু। তখন ওভাবে শুয়ে থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে। ছন্দ বিষয়টা বুঝতে না পেরে রসিক কন্ঠে বলে উঠে, “আমার থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে করে না বললেই হয়। আমি তাহলে দূরে সরিয়ে রাখি নাকি?”
প্রাণ রূঢ়ভাবে বলে, “শাট আপ।”
ছন্দ প্রাণের খিঁচে থাকা মুখটা লক্ষ করে বলে বুঝলো কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। তাই চিন্তিত হয়ে বলল, “আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। কিয়ৎক্ষণ লাগলো তার স্বাভাবিক হতে। ব্যথা কমে আসতেই প্রাণ সরে আসলো। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পিছনে পিঠের মধ্যখানে নিয়ে আস্তে আস্তে বা*রি মারলো। ছন্দ তন্ময় নয়নে সবই পর্যবেক্ষণ করলো, তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি সমস্যা হয়েছে৷ প্রাণ ঘাড় ডান-বামদিক কাঁত করে সোজা হয়ে বসলো। ছন্দের দিকে তী*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কি করছিলেন আপনি?”
প্রাণের প্রশ্নে ছন্দ বিচলিত হলো না। ভাবলেশহীনভাবেই উত্তর দিল, “কিছু না তো। আপনি তখন পড়ে যাচ্ছিলেন বলে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলাম।”
প্রাণ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মৌন রইলো। কথা ঘুরানোর জন্য বলল, “সারাদিন কোথায় ছিলেন? ফোন ধরছিলেন না কেন আমার?”
ছন্দ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “আজব তো! বউয়ের মত তদারকি করছেন কেন? বাই এনি চান্স, আপনার কি আমার বউ হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে?”
ছন্দের পাল্টা আ*ক্র*ম*ণে প্রাণ অপ্রতিভ হলো। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন।”
ছন্দ ক্ষীণ হেসে বলল, “কথা আমি ঘুরাচ্ছি না-কি আপনি? বিষয়টা এমন হলো না, চোরের মন পুলিশ পুলিশ?”
ছন্দের কথায় প্রাণ যে দমে যাওয়ার পাত্রী তা একদমই না। সে নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো, “কে পুলিশ আর কে চোর তা একটু পরই জানা যাবে। তার আগে বলুন, সকালে আপনি আমাকে দিয়ে কোন পেপারে সিগনেচার করে নিয়েছিলেন?”
“আপনি কিন্তু শর্ত ভাঙ্গছেন মিস. ল্যাভেন্ডার। শর্ত অনুযায়ী, আপনি পেপার নিয়ে আমায় কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না।”
“আমি কোন পেপারে সাইন করেছি তা জানার অধিকার নেই আমার?”
ছন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপাতত নেই। সময় হলে এভাবেই জানতে পারবেন আপনি।”
প্রাণ কিছুক্ষণ মৌন থাকলো। মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “ওইগুলা কি রেজিস্ট্রার পেপার ছিল? ইয়েস ওর নো।”
ছন্দ পকেটে হাত গুঁজে বলল, “আই ডোন্ট নো।”
প্রাণ নিজেও উঠে দাঁড়ালো, “বাট আই নিড এন্সার।”
ছন্দ প্রাণের দিক এককদম এগিয়ে এসে বাম হাতের তর্জনী উঁচিয়ে আলগোছে তার মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিয়ে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, তারপর।”
ছন্দের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে প্রাণ শিউরে উঠলো। পা জমে গেল ওখানেই। গাল জুড়ে ছেঁয়ে গেল র*ক্ত*রে*ণু। কম্পিত কন্ঠে কোনরকম জিজ্ঞেস করলো, “কি প্রশ্ন?”
ছন্দ অপার্থিব হেসে জিজ্ঞেস করলো, “আমার প্রাণেশ্বরী হবেন?”
ছন্দের প্রশ্নে তব্দা খেয়ে গেল প্রাণ। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কতক্ষণ। প্রশ্নটা তার বোধগম্য হয়েছে ঠিক কিন্তু সে চেয়েও প্রত্যুত্তর করতে পারছে না। কন্ঠলগ্নে মৌনতারা পথ রোধ করে রেখেছে যেন। সহজ প্রশ্নের দুই অক্ষরের উত্তর অথচ কোনভাবেই উচ্চারণ করতে পাচ্ছিল না। অদ্ভুত না?
ছন্দ পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠলো, “ইয়েস ওর নো?”
প্রাণের কিয়ৎকাল নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনুভূতি সব নিয়ন্ত্রণ করলো। পা*ষা*ণ হৃদয়ের অধিকারী বুঝাতে ছন্দের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “নো!”
ছন্দ প্রাণের চোখে দৃষ্টি স্থাপন করেই বলল, “এবার আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, যতদিন না আপনার উত্তর ইয়েস হচ্ছে ততদিন আমিও বলছি না পেপারগুলা কিসের ছিল।”
প্রাণ হতবুদ্ধি তাকালো। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “মানে কি?”
ছন্দ কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল, “মানে যা বুঝেছেন তাই-ই।”
প্রাণ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু কেবিনে ডাক্তার ঢুকায় বলতে পারলো না। কথাগুলো কন্ঠবদ্ধ করে ফেললো। ছন্দও এর ফাঁকে বেরিয়ে পড়লো কেবিনটা থেকে৷ এদিকে আশা বেগম এতক্ষণ প্রাণ ও ছন্দের কথোপকথন শুনে হাসছিলেন। প্রশান্ত সেই হাসি।
#চলবে
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩১
ডাক্তার চেকাপ করে যাওয়ার পর প্রাণ কিছুটা সময় আশা বেগমের পাশেই বসে কাটালো। ঔষধের প্বার্শ প্রতিক্রিয়ায় আশা বেগম ঘুমিয়ে যেতেই প্রাণ পুনরায় সোফায় গিয়ে বসলো। মেরুদণ্ডে ব্যথা করছে প্রবল। সোজা হয়ে বসতে সমস্যা হচ্ছে। তার উপর মাথা ও পায়ের ব্যথা তো আছেই। সকালে একবার ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করিয়েছিল তবে মাঝে পায়ে চাপ পড়ায় ফের রক্তে ভিজে উঠছে তলা। ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করা উচিৎ কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না বলে উঠলো না। আলসেমিতে ধরেছে। উপরন্তু, সারাদিন ভাবনা, দুশ্চিন্তায় থাকার কারণে একবেলার খাবারই গলা দিয়ে নেমেছিল তার। ফলে ক্লান্ত,দূর্বল লাগছে এখন। শরীর ছেড়ে দিয়েছে পুরা। চৈতি এসময়টা পাশে থাকলে ভালো হতো। গ্রাম থেকে কাল আসবে মেয়েটা।
এদিকে ছন্দ আবারও নিরুদ্দেশ। একটু পর পর কোথায় হাওয়া হয়ে যায় আল্লাহ মাবুদ জানে। নিজের ছোট মস্তিষ্কে আর ভার নিতে পারলো না প্রাণ। দুর্ভাবনা সব ফেলে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেতে পিছনের দিকে পিঠ হেলিয়ে বসলো। এক হাত কপালের উপর দিয়ে নেত্রপল্লব এক করলো। যৎসামান্য সময় পর দরজার খোলার শব্দ কর্ণরন্ধ্রে ঝংকার তুলতেই চোখ খুলে তাকালো সে। সামনে ছন্দকে দেখতে পেয়ে বিতৃষ্ণায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। হাত নামিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো। ছন্দ তা দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এসে বসলো প্রাণের পাশে। কন্ঠস্বর নামিয়ে বলল, “এটা পিঠের নিচে দিন আরাম পাবেন।”
কথাটা শুনে প্রাণ হাত নামিয়ে পাশ ফিরে তাকালো, ছন্দের হাতে হট ওয়াটার ব্যাগ দেখে বাকশূণ্য হলো। সে তো জানায়নি তার সমস্যার কথা, তাহলে ছন্দ বুঝলো কিভাবে? দৃষ্টির আনাচে-কানাচে বিমূঢ়তা ছড়াতে দেখে ছন্দ বলল, “নিন!”
প্রাণ নিজের অভিব্যক্তি আড়াল করার চেষ্টা করে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “নো নিড।”
ছন্দ মন্থরগতিতে প্রাণের পিঠের পিছে ওয়াটার ব্যাগটা রেখে দিয়ে বলল, “প্রয়োজন শেষে অপ্রয়োজন আসে। তাই আগে প্রয়োজন মিটান।”
পিঠে উষ্ণত্ব পেয়ে প্রাণ ঈষৎ আরাম পেল। তাই ছন্দের সাথে আর তর্কে জড়ালো না। ছন্দ তা দেখে হাসলো, গালে আবির্ভাব হলো ছোট দু’টি খাদ। পাশ থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করে ধরলো প্রাণের সম্মুখে। বলল, “খেয়ে নিন। আপনার প্রিয় ক্যাসোনাড সালাদ, ফ্রাইড রাইস ও বারবিকিউ চিকেন আছে এতে।”
প্রাণ বিহ্বলিত হলো। খেয়াল হলো নয়নের কথা, তাদের তিন বছরের সম্পর্কে নয়ন এটুকু জানতে পারেনি তার পছন্দ, অপছন্দ কি। অথচ ছন্দকে বলা-কহা ছাড়াই জেনে গেল সব? এ কি আদৌ সম্ভব? অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি জানেন কিভাবে?”
ছন্দ প্রফুল্ল কন্ঠে বলল, “ম্যাজিক! এখন কথা না বলা খেয়ে নিন। দূর্বল দেখাচ্ছে আপনাকে, নিশ্চয়ই সারাদিনে খাননি ঠিক মত।”
প্রাণ প্রত্যুত্তরে বলার মত শব্দ খুঁজে পেল না। খেয়াল রাখার মত মানুষ তার জীবনে নাই বললে চলে। আশা বেগমের পর এই প্রথম কেউ তার কথা ভাবছে, খেয়াল রাখছে। প্রাণকে আপন ভাবনায় মশগুল দেখে ছন্দ নিজ উদ্যোগে পলিথিন ব্যাগ থেকে ওয়ান টাইম প্লেট বের করলো। অতঃপর খাবার তাতে পরিবেশন করে বলল, “এখন দয়া করে ‘দরকার নেই, নো নিড,খাব না’ বলে ন্যাকামো করবেন না। ভদ্র মেয়ের মত খেয়ে নিবেন।”
ছন্দের কথা কর্ণগোচর হতেই প্রাণ রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ঠিক তবে মৌন রইলো। পাকস্থলী মোচড় দেওয়ামাত্র নিস্পন্দভাবে খাবারের প্লেটটা তুলে নিল। খাওয়ার পূর্বে সৌজন্যতা রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করলো শুধু, “আপনি খেয়েছেন?”
“নাহ! পরে খাব আমি।”
“এখানে খাবার বেশি আছে, খেতে পারেন।”
“প্যারা নাই। খান আপনি।”
প্রাণ দ্বিরুক্তি করলো। নৈঃশব্দ্যে খেতে শুরু করলো। যদিও তার প্রচন্ড ইচ্ছে করছিল ছন্দকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, “সে কেন এসব করছে? সকালের কাগজগুলাই কি ছিল? কেন এমন মাইন্ড গেল খেলছে তার সাথে? চাইটা কি তার?” তবে ছন্দের যে কোন প্রশ্নের উত্তর তাকে না সে ভালো করেই জানে। উল্টো আরেক গোলকধাঁধায় ফেলে দিবে তাকে৷ খাওয়া যখন প্রায় শেষ তখন ছন্দ জিজ্ঞেস করলো, “পায়ের কি অবস্থা আপনার?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করার আগেই ছন্দ এক হাটু ভেঙে নিচে বসে পড়ে। পা দেখার জন্য হাত বাড়াতেই প্রাণ গুটিয়ে গিয়ে বলল, “ঠিক আছি আমি।”
“দেখতে দিন আমায়।” রুক্ষ কন্ঠে কথাটা বলল ছন্দ। অতঃপর তার আঘাতপ্রাপ্ত পা-টি নিজের কোলে নিয়ে দেখতে থাকলো। বলল, “রক্তে ভিজে গিয়েছে ব্যাণ্ডেজ়, তাও চেঞ্জ করাননি কেন? ইনফেকশন হলে তখন ভুগবেন কি আপনি না আমি?”
তার প্রতি ছন্দের রূঢ়ভাব দেখে প্রাণ অভিমানী কন্ঠে বলল শুধু, “ইচ্ছে করেনি।”
ছন্দ বিরবির করে বলল, “হোপলেস।”
অতঃপর উঠে গিয়ে নার্স ডেকে আনলো। নার্স এসে প্রাণের ব্যান্ডেজ করে কিছু ঔষধ দিয়ে গেল যাতে ঘা দ্রুত সেড়ে উঠে। ছন্দ এঁটো প্লেট ব্যাগে ভরে বাকি খাবার গুছিয়ে রাখলো। প্রাণকে বিশ্রাম নিতে বলে বাহির থেকে নার্সের বলা ঔষধ কিনে নিয়ে আসলো। তবে প্রাণকে সেগুলো খেতে বললে প্রাণ তৎক্ষনাৎ নাকচ করে উঠলো। তা দেখে ছন্দ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকালো, “কি সমস্যা?”
প্রাণ মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমি ঔষধ খাব না।”
ছন্দ পাতা থেকে ঔষধ ভেঙে হাতে নিয়ে বলল, “আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি ঔষধ খাবেন কি-না। সো দেয়ার ইজ নো অপশন।”
“বললাম তো খাবো না।”
ছন্দের মনে পড়লো আশা বেগম বলেছিলেন প্রাণ একেবারেই ঔষধ খেতে চায় না। যত যাই হোক। তাই ছন্দ অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করলো। আস্তে করে ঝুঁকলো প্রাণের দিকে, কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “আই ওয়ানা কিস ইউ।”
প্রাণ চোখ বড় বড় করে তাকালো। অধর দুটো আপনশক্তিতে আলাদা হয়ে গেল। উচ্চস্বরেই বলে উঠতে নিলো, “মান…”
তবে তার বলে উঠার আগেই ছন্দ তার মুখে ঔষধ পুড়ে দিল। অতঃপর তার ঠোঁট দুটো এক হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, “ঔষধগুলো গিলেন নাহলে পরেরবার যা বলেছি তাই করে দেখাব। এন্ড আই আম ডেম সিরিয়াস এবাউট ইট।”
ঘটনার আকস্মিকতা প্রাণ নিতে না পেতে অজান্তেই ঢোক গিয়ে ঔষধগুলো গিলে ফেলে। ছন্দ যখন বুঝতে পারে প্রাণের মুখ খালি তখন সরে আসে৷ পাশ থেকে পানির বোতল উঠিয়ে বলে, “কিছু মনে করবেন না প্লিজ, মাঝে মধ্যে না চাইলেও আঙ্গুল বাঁকাতে হয়।”
প্রাণ পানির বোতলটা নিয়ে এক নিমিষে বোতলে থাকা পানিটুকু খেয়ে ফেলে৷ গলা আটকে ছিল ছোট ঔষধ দুটো এতক্ষণ। পানি খাওয়া শেষে আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলে, “গেট লস্ট।”
“আ’ম নট।”
কথাটা বলেই ছন্দ প্রাণের পাশে বসে পড়লো। প্রাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে আশা বেগমের অস্ফুট ডাক শুনে দিকে কিছু বলতে পারলো না। প্রাণ পাশ ফিরে তাকালো আশা বেগমের দিকে, তিনি হাতের ইশারায় ডাকছেন তাকে। প্রাণ দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, পায়ে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হলো ঠিক কিন্তু গায়ে মাখলো না। দৌড়ে গেল আশা বেগমের নিকট। অশান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ বল, ডাকছিলে যে। কোন সমস্যা হচ্ছে তোমার?”
আশা বেগম মৃদু হাসলেন। মাথা ডানে-বামে ‘না’ জানালেন অথচ চোখের কোণে জল চিকচিক করছে তার। ম্লান হয়ে এসে মুখ, কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। প্রাণ চিন্তিত কন্ঠে বলল, “এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়?”
আশা বেগম উত্তর দিলেন না। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। তিনি কোনরকম চোখের ইশারায় ছন্দকে কাছে ডাকলেন। ছন্দ তখন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই ইশারা বুঝতে বিলম্ব হয়নি তার। উঠে ত্বরিত বেগে চলে আসে তার সামনে। আশা বেগম প্রাণের হাতটা টেনে ধরে ছন্দের হাতে দিয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বলল, “ভালো থেকো মামণী আমার।”
কথাটা প্রাণের বোধগম্য হলো না৷ সে প্যানিকড করে উঠলো, “কি বলছো এসব তুমি আশামা? ভালো থাকবো মানে কি?”
আশা বেগম কথা বললেন না। অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন শুধু। অধর জুড়ে স্মিত হাসি, নয়নের ধার ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে অবিরত অশ্রুকণা। কণ্ঠনালি শুকিয়ে মরুভূমি তার, পানির জন্য কাতরাচ্ছিলেন। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ছন্দও বিমূঢ়। আশা বেগমকে কথা বলতে না দেখে প্রাণ আরও প্যানিকড করে উঠলো। উচ্চকন্ঠে জিজ্ঞেস করতে থাকলো কি হয়েছে তার? কিন্তু জবাব পেল না কোন। হঠাৎ আশা বেগমের চোখ উল্টিয়ে আসলো, যে হাতে প্রাণের হাতটা ধরে রেখেছিল তা আলগা হয়ে এলো। ধীরে ধীরে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। ত্যাগ করলেন অন্তিম নিঃশ্বাস৷
________
ধরণীর নিয়মানুযায়ী কোন কিছুই অবিনশ্বর নয়। যার শুরু আছে তার শেষও আছে। জন্ম ও মৃ*ত্যুও ঠিক এই একই সূত্রে বাঁধা। জীবন প্রক্রিয়ার নীরব অবসান মৃ*ত্যু। জন্মের ন্যায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আসে না সে, আসে খুবআকস্মিক, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই। নিভৃতে এসে তচনচ করে দিয়ে যায় অনেক কিছু। অক্ষত করে পরিবেশ, আপনজনদের হৃদয়। কথায় আছে, “যার যায়, একমাত্র সেই বুঝে মূল্য।” কথাটার বাস্তব প্রমাণ মানবজাতি পেয়ে থাকে জীবনের প্রত্যেক মোড়ে।
মৃ*ত্যু হয়তো একজনের হয় কিন্তু প্রভাব পড়ে আশেপাশের সকলের উপর, আপনজনের উপর। কেউ বা শোক কাটিয়ে উঠতে পারে, কেউ বা পারে না। বাস্তবতা কেউ মানে তো কেউ মানে না। কিছু সংখ্যক মানুষ আবার আটকা পড়ে আঁধারপুরীর নিরাশা, একাকিত্বপূর্ণ সেই কক্ষটায় যেখানে থেকে মৃ*ত্যু ব্যতীত শান্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ প্রাণও সেই দ্বারপ্রান্তেই দাঁড়ানো। নিজের বাঁচার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব এখন। আবেগ,অনুভূতিশূণ্য। অভিব্যক্তি কঠোরের চেয়ে কঠোর। রুমের এক কোণে দুই হাটু ভেঙে বসে আছে সে, দৃষ্টি সামনে রাখা আশা বেগমের মৃ*ত*দে*হ*টার দিকে। শেষবারের মত চোখ জুড়ে দেখে নিচ্ছে নিজের আশামাকে। আর যে কখনো দেখার সুযোগ পাবে না। কে জানতো সুস্থ হয়ে উঠা মানুষটা হুট করে এভাবে চলে যাবে? কোন রোগবালা বিহীন, নীরবে? স্বাভাবিক মৃ*ত্যুই, অথচ অস্বাভাবিক পরিবেশ। অবাক করার বিষয়, প্রাণ আজ কাঁদছে না। একটুও না। যখন থেকে বুঝতে তার আশামা আর নেই তখন থেকেই পাথর হয়ে গিয়েছে। না কথা বলছে, না কাঁদছে। শুধু মৌনতা পালন করছে। অথচ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ভেঙ্গে পড়ার কথা কিন্তু তারই। পাশেই চৈতি তার বাহু ঝাপটে ধরে বসে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। সকালেই ফিরেছিল মেয়েটা গ্রাম থেকে, রাস্তায় থাকাকালীন আশা বেগমের মৃ*ত্যু সংবাদ শুনে বাসায় না গিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে। ছুটিতে থাকা বাকি স্টাফরাও এ খবর পেয়ে যে পেরেছে ছুটে এসেছে৷ নিহাল শিকদারও এর বহির্ভূত নন। তবে তিনি একাই এসেছেন, মেহরিমা শিকদার বা তার ছোট ছেলে-মেয়ের মধ্যে কেউ আসেননি।
ছন্দ দাফনের জন্য ব্যবস্থা করে মাত্র বাসায় ঢুকছিল এমন সময় নিহাল শিকদার তার দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন। বাংলাদেশের জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ায় ছন্দ দেশের বেশ পরিচিত মুখ। তাকে চিনে না এমন মানুষ খুব কমই আছে বাংলাদেশে৷ তাই তিনি ছন্দকে এখানে দেখে অবাক না পারলেন না৷ তিনি হিসাব কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “ছন্দ এখানে কেন? তার সাথে প্রাণের বা কি সম্পর্ক? এতসবই বা করছে কেন?” তবে পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে দমে গেলেন তিনি।
এদিকে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আশামাকে নেওয়ার পালা আসলে প্রাণ বিরবির করে উঠলো, “আর সবার মত তুমিও আমায় ধোঁ*কা দিলে আশামা। প্রতারণা করলে আমার সাথে৷ কেন করলে এমন? কেন? আমি তোমায় কখনো ক্ষমা করবো না। কখনো না।”
প্রাণের কথাগুলো চৈতি ব্যতীত কেউ শুনলো না। প্রাণের অবস্থা দেখে চৈতি পারছিল না নিজের কান্না আটকে রাখতে। নিঃশব্দে কেঁদে চলছিল। অতঃপর দেখতেই দেখতে আশা বেগমকে নিয়ে যাওয়া হলো। সকল কার্যক্রম ছন্দ ও নিহাল শিকদার মিলেই সম্পন্ন করলেন। জানাযা পড়ে ফিরে আসতে তাদের ঘন্টাখানেকের মত লাগলো৷ ফিরে এসে তারা প্রাণকে একই স্থানে বসে থাকতে দেখলো। নির্বাক,নির্জীব তার দেহভঙ্গি৷ তার পাশে বসেই মেয়ে কর্মীরা মুখ চেপে কান্না করছিল। ছন্দ ও নিহালসহ বাকি সবাইকে ফিরে আসতে দেখে তারা উঠে ভিতরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ছন্দ এগিয়ে এসে সোফায় বসলো, দৃষ্টি তার নিবদ্ধ দৃঢ়তায় আবিষ্ট প্রাণের দিকে। নিহাল শিকদার তার পাশে বসে একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি প্রাণকে চিনো কিভাবে? তা কিছু মনে কর না, তুমি আমার ছেলের বয়সী তাই ‘তুমি’ করেই সম্বোধন করছি।”
ছন্দের দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো, “সমস্যা নেই। তবে আমার সাথে প্রাণের কি সম্পর্ক তা আপনাকে জানানো প্রয়োজনবোধ করছি না।”
ছন্দের এমন উত্তরে নিহাল কিছুটা অপমানবোধই করলেন। চড়া গলায় বললেন, “কিন্তু আমি করছি। বাবা হিসাবে অধিকার আছে আমার জানার, ওর সাথে কি সম্পর্ক তোমার।”
ছন্দ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “বাবা হিসাবে কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন আপনি? একটু বলবেন আমায়?”
নিহাল থতমত খেল যেন। ছন্দ তা দেখে শ্লেষের হাসি হেসে বলল, “কোন কিছুই কিন্তু আমার অজানা নয় মি. নিহাল শিকদার।”
নিহাল রেগে গেলেন নাকি ঘাবড়ে বুঝা গেল না। কিন্তু তিনি আর ছন্দকে প্রত্যুত্তর করলেন না। দ্রুত নিজের জায়গা থেকে উঠে প্রাণের কাছে এগিয়ে বললেন, “প্রাণ উঠো। তুমি আমার সাথে বাসায় যাচ্ছ।”
কথাটা শুনে প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দৃষ্টি নত রেখেই বসে রইলো৷ এমতাবস্থায় ছন্দ পিছন থেকে বলে উঠলো, “প্রাণ আপনার সাথে কোথাও যাবে না।”
#চলবে