#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৮
ঘড়ির কাটা তখন একের ঘরে পদার্পণ করেছে। বাহিরে নেমেছে ধ্বং’স’লী’লা ঝড়, বায়ুমন্ডলের চাপ ঊর্ধ্বশ্বাসে। রাস্তার ধারে পানি জমেছে গোড়ালি সমান। কয়েকটি গাছ-পালা ইতোমধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। প্র’ল’য়’ঙ্কা’রী পরিবেশ অথচ কেমন নিস্তব্ধ, নির্জীব, অসাড় লাগছে। তিমির ঘনিয়ে এসেছে, জনমানবশূন্য চারদিক। কেবিনের ভিতর রাখা ছোট সোফায় বসে আছে ছন্দ। তার কাধেই নিষ্প্রাণ অবস্থায় শুয়ে আছে প্রাণ। ডান পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ, নিচে দিকে হালকা ভিজে। শুভ্র কাপড়ের ওপর র’ক্ত রেণুর গাঢ় ছাপ। রুমের বাতি নিভানো। দরজার মধ্যস্থলে চতুর্ভুজ আকৃতির ছোট কাঁচ, সেখান হতে মিছে মিছে আলো এসে ঠিকড়ে পড়ছে মেঝেতে। দৃষ্টির সামনে হসপিটাল বেডে শুয়ে আছেন আশা বেগম। মুখে অক্সিজেন মাক্স ঝুলানো, হাতে কেনোলা পড়ানো। ছন্দ এক হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিল। অর্ধনিদ্রিত নয়নে তাকালো প্রাণের ক্লান্তি ভরা মুখের দিকে। মসৃণ গালে ক্রন্দনের দাগ স্পষ্ট। দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করার ফলে আঁখিপল্লবের কোণে ছোট ছোট অশ্রুকণা জমে আছে। ধূসর আলোয় চিকচিক করছে। ছন্দ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে তা মুছে দিল। একহাতে প্রাণকে আগলে সোফার পিছে মাথা হেলিয়ে আঁখিপল্লব দুটো এক করে নিল। আকস্মিক মনের মাঝে হানা দেয় ঘন্টাখানেক আগের ঘটনা।
ছন্দ তখন টিভিতে তার বিগত ম্যাচগুলো অবজার্ভ করছিল। কোথায় কে কোন ভুল করেছে, তার এবং সকলের মধ্যে কি কি ইম্প্রুভমেন্ট দরকার এসব দেখার জন্য৷ তিনদিন আগেই নিউজিল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ খেলে দেশে ফিরেছে সে, কয়েকটা ম্যাচে পারফর্মেন্স তাদের একবারেই খারাপ ছিল। যার জন্য ছন্দ ভুল সব পরিলক্ষিত করতেই বসেছিল, যাতে পরবর্তীতে সেগুলো আর না হয়। ঠিক সেসময় প্রাণের কল আসে তার ফোনে। ছন্দ খানিকটা ভড়কায়, কেন না প্রাণ বিনাকারণে তাকে কখনোই কল করে না। তাদের পরিচয়ের এতদিনে প্রাণ নিজ থেকে শুধু একবারই ফোন করেছিল। তাই তার ভয় হলো, খারাপ কিছু ঘটেনি তো? সে ফোন রিসিভ করতেই প্রাণ তাকে সব খুলে বলে এবং সাহায্য চায়। কথা বলার সময় তার কন্ঠ বারবার জড়িয়ে আসছিল। প্রাণের কথা শুনে সে কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে কোনরকম গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই তার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। ছন্দ পুরো রুমে রক্ত জানতে চাইলো অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়নি কেন? তখন প্রাণ জানায়, ঝড় বৃষ্টির জন্য তারা এখন আসতে পারবে না, দেরি হবে। ছন্দ একবার প্রাণের মুখপানে তাকায়। কতটা করুণ দেখাচ্ছে তাকে। কাঁদার ফলে চোখ দুটো ফুলে আ’র’ক্ত দেখাচ্ছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত আশা বেগমকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পরে। তার পিছে পিছে প্রাণও ছুটে। অতঃপর দুইজনে মিলে আশা বেগমকে সবচেয়ে নিকটবর্তী যে প্রাইভেট হসপিটাল পায় সেটাতেই এডমিট করে ফেলে। এরপর সম্পূর্ণ চেকাপ করা শেষে ডাক্তার জানায়, আশা বেগম মেজর হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভাব ও সময়মতো ঔষধ সেবন না করায় অবস্থা আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আপাতত তিনি বিপদমুক্ত, বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে আজ তাকে আনতে আরেকটু দেরি করলে হয়তো বিষয়টা হাতের বাহিরে চলে যেত।
কথাটা শোনার পর ছন্দ একটু শান্ত হয়। প্রাণও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং-এর কারণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে তার, দূর্বল হয়ে পড়ে শরীর। সে বেসামাল হাত ছন্দের হাত শক্ত করে ধরে, নিজেকে সামলে উঠার পূর্বেই ঢলে পড়ে ছন্দের বুকে। ছন্দ দ্রুত তাকে সামলে নেয়, বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের দিকে। হঠাৎ নিচের দিকে নজর যেতেই সরু র’ক্তে’র ধারা দেখতে পায় সে। ক্ষণেই চমকে উঠে। বক্ষপট দুমড়ে মুচড়ে উঠে যেন। গলা শুকিয়ে আসে বারংবার। প্রাণ যে এতটা সময় ধরে আ’হ’ত অবস্থায় ছিল খেয়ালই করেনি সে। মুহূর্তেই অপ্রীতিকর ভাবনা ভর করে মস্তিষ্ক জুড়ে। তৎক্ষনাৎ বিমর্ষচিত্তে নার্সকে ডেকে উঠে সে, যথাক্রমে তার চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থাও করে। অতঃপর প্রাণের জ্ঞান ফিরার পর সে স্থির থাকতে চাইলো না, আশা বেগমের নিকট যাওয়ার জন্য পাগলামি করতে থাকলো। ছন্দ তখন বাধ্য হয়েই তাকে ধরে কেবিনে নিয়ে আসে। প্রাণ আশা বেগমকে পলক ভরে দেখে ক্ষান্ত হয় যেন। ছন্দ এরপর তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। এদিকে প্রাণ অপেক্ষা করে কখন তার আশামায়ের ঘুম ভাঙবে। কিন্তু তার শরীর প্রচন্ড দূর্বল থাকায় সে ছন্দেত কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। ছন্দ প্রথমে ইতস্তত করলেও পরবর্তীতে প্রাণকে আগলে নেয়। তার মধ্যকার ঝড় ততক্ষণে শান্ত হলো যেন।
হঠাৎ কিছু শব্দ পেয়ে ছন্দ চোখ খুলে তাকালো। আশা বেগমকে নড়াচড়া করতে দেখে ছন্দ প্রাণকে নিজের কাছ থেকে আলতো করে সরিয়ে নিল। আলগোছে শুয়ে দিল সোফাতে, খেয়াল রাখলো তার ঘুমে যাতে সামান্যটুকু ব্যাঘাত না ঘটে। প্রাণকে ঠিকমতো শুয়ে দিয়ে ছুটে যায় নার্স ডাকতে। আবছা দৃষ্টিতে আশা বেগম সম্পূর্ণ বিষয়টাই খেয়াল করলেন। অকারণেই শান্তি অনুভব করলেন বক্ষে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন নার্স এসে চেকাপ করতে, সব নরমাল আছে দেখে নার্সটি ছন্দকে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে বেরিয়ে গেল। ছন্দ পাশেে পড়েে থাকাা টুলটাা টেনেে আশাা বেগমেরর সামনেে বসেে বলল, “এখন ভালো লাগছে আন্টি?”
আশা বেগম মাথা দুলালেন। ছন্দ বলল, “যাক আলহামদুলিল্লাহ! আচ্ছা, আমি প্রাণকে ডেকে দিচ্ছি৷ তিনি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জাগার অপেক্ষায় ছিলেন।”
আশা বেগম ধীরগতিতে হাত উঁচিয়ে ছন্দকে থামালেন। অক্সিজেন মাস্কটা খুলে বললেন, “জাগিও না। ঘুমাক ও।”
ছন্দ চিন্তিত কন্ঠে বলল, “আপনি মাস্ক খুলবেন না। এতে সমস্যা হতে পারে।”
আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “কিছু হবে না। এমনেও আমার কিছু জানানোর আছে তোমায়।”
ছন্দ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি আন্টি?”
আশা বেগম একটু থেমে জিগ্যেস করলেন, “প্রাণকে পছন্দ কর তুমি?”
আশা বেগমের প্রশ্ন শুনে ছন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। বাক্যহারা হলো যেন। নিজের দৃষ্টি লুকাতে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকলো। গ্রীবাদেশে হাত গলিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল, “না মানে আন্টি……হ্যাঁ।”
এনিয়ে-বিনিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলো ছন্দ। আশা বেগম কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, “আগলে রাখতে পারবে ওকে আজীবন?”
ছন্দ মাথা নত করে বলল, “চেষ্টা করবো।”
আশা বেগম নিদ্রাবিষ্ট প্রাণকে একবার পরোক্ষ করে বললেন, “প্রাণকে আগলে রাখা কোন মুখের কথা না। ওকে দেখতে স্বাভাবিক লাগলেও আদৌ কিন্তু ও স্বাভাবিক না।”
ছন্দের কপালে ভাঁজ পড়লো এবার, “মানে?”
“বলছি। তবে তার আগে তোমায় ওর সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তো এর মাঝেই তুমি তোমার মনের সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”
“আমি শুনছি আপনি বলুন।”
আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “একটা ফুল কিন্তু এভাবেই ম’রে যায় না। দীর্ঘদিন অযত্ন,অবজ্ঞা,অবহেলা করার ফলেই কিন্তু সে একসময় ঝরে পড়ে৷ ত্যাগ করে দেয় জীবনের মায়া। প্রাণের জীবনটাও ঠিক তেমনই। ছোট ফুল ছিল সে, যার সুবাসে ঘর-বাড়ি মুখরিত থাকতো। তবে অনাদর, উপেক্ষার সাগরে তলিয়ে সেও হয়ে যায় মৃ’ত।”
ছন্দ ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “একটু পরিষ্কার করে বলবেন বিষয়টা?”
“হুম! গল্পটা শুরু হয় আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। বড় সাহেব মানে নিহাল শিকদার তখন টগবগে যুবক। ডিরেক্টর হওয়ার তার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই, তাই সে সময়টা তিনি রাত-দিন জেগে নিজের স্বপ্নের পিছনেই ছুটছিলেন। তার বাবা শিমুল শিকদার ছিলেন তখনকার আমলের প্রভাবশালী লোক। যার জন্য নিজের বাবার পরিচয় ব্যবহার করেই বড় সাহেব সফলতার সিড়ি চড়ছিলেন। এমন সময় শিমুল শিকদার মানে বড় কর্তা হুমায়রা নামের একটা মেয়ে পুত্রবধূ হিসাবে খুব পছন্দ হয়। তার বন্ধুর মেয়ে ছিল সে। যাওয়ার-আসার সময় দেখেছিলেন কয়েকবার তিনি। হুমায়রা আপা ছিলেন রূপে-গুণে অনন্যা, সে সাথে তাদের অবস্থাও বড় কর্তাদের মতই ছিল। তাই বড় কর্তা দেরি না করে কথা পাকাপাকি করে ফেলেন। বড় সাহেবকে এ বিষয়ে জানালে তিনি প্রথমে নাকচ করে দেন কিন্তু হুমায়রা আপার ছবি দেখার পর মন বদলে যায় তার। তিনি রাজি হয়ে যান বিয়েতে। তবে শর্ত দেন যে, বিয়ের কথা বাহিরের মানুষ যাতে না জানে। বিয়ের কথা জানাজানি হলে নাকি তার ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়বে। সময় হলে তিনি নিজ থেকেই সবাইকে সবটা জানিয়ে দিবেন। বড় কর্তা প্রথমে রাজি হন না, একমাত্র ছেলের বিয়ে তিনি বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষে বড় সাহেবের জেদ দেখে তিনি তার কথায় রাজি হয়ে যান। হাতেগণা কয়েকজন আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে ঘরোয়াভাবেই বিয়ে হয় বড় সাহেব আর হুমায়রা আপার। বিয়ের কয়েকমাস পর বড় সাহেব কাজের জন্য হুমায়রা আপাকে নিয়ে অন্য জায়গায় বাড়ি নেন। এরপর সেখানেই তারা থাকতে শুরু করেন। তাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় প্রাণের জন্ম হয়। এই পর্যন্ত সব ভালোই যাচ্ছিল। বড় সাহেব প্রচন্ড ভালোবাসতেন নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে। জা’ন দিয়ে দেন এমন। কিন্তু প্রাণের যখন চার বছর তখন চিত্রটা বদলে যায়। কোন এক কারণে বড় সাহেব ও হুমায়রা আপার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। নিত্যদিনই ঝগড়া লেগে থাকতো তাদের মাঝখানে। মাঝে মধ্যে বড় সাহেব হাত তুলতেন হুমায়রা আপার উপর। এসবই প্রাণ পর্দার আড়ালে দেখতো। প্রাণ ছোট থেকেই প্রচন্ড চঞ্চল ছিল, এদিক-সেদিক ঘুরে বেরানো ওর অভ্যাস ছিল। তবে বাবা-মায়ের মাঝে মনোমালিন্য তাকে গুটিয়ে যেতে বাধ্য করে। হুমায়রা আপা তখন একটু শান্তি পেতে প্রাণকে নিয়ে ঢাকার বাহিরে চলে যেতেন। ঘুরে ফিরে আবার চলে আসতেন। যদিও মেয়েরা বাবার ভক্ত বেশি হয়ে থাকে তবে প্রাণ ছিল মা ভক্ত। মায়ের আঁচল সে কোনভাবেই ছাড়তে চাইতো না। সবসময় তার পিছু পিছুই ঘুরতো। তাই হুমায়রা আপাও কখনো ওকে একা ফেলে যেতেন না।
এর মাঝে প্রাণের যখন পাঁচ বছর তখন হুমায়রা আপার ক্যান্সার ধরা পড়ে। থার্ড স্টেজে ছিলেন তিনি তখন। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই বড় সাহেব সকল ব্যবস্থা করেন তার চিকিৎসার। এমনকি ইন্ডিয়াও নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু লাভ হয় না। এদিকে প্রাণ সবই নীরবদর্শকের ন্যায় দেখছিল। ওর তখনও বোধ হয়নি আসলে হচ্ছিলটা কি? সে ভেবেছিল তার মা সাময়িকভাবে অসুস্থ, দ্রুত ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে হুমায়রা আপার শরীর আরও খারাপ করতে থাকে। দেখতেই দেখতে তিনি চলে যান লাস্ট স্টেজে৷ একদম বিছানায় পড়ে যান। তার দেখা শোনার জন্যই বড় সাহেব একটি নার্স রাখেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় সাহেব হুমায়রা আপার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দেন। বাসায় খুব কম থাকতে শুরু করেন। প্রাণকেও কাছে টানতেন না আর তেমন। তাই প্রাণও সবসময় মায়ের পাশে বসে খেলা করতো আর কথা বলতো। তো এমনই একদিন প্রাণ হুমায়রা আপার পাশেই বসে কথা বলছিল, খেলছিল। ঠিক সময়টাতেই হুমায়রা আপা ই’ন্তে’কা’ল করেন। হুমায়রা আপার চোখ তখন উল্টে ছিল, মুখ খোলা, ঠোঁট দুটো জী’র্ণ’শী’র্ণ। মায়ের এমন অবস্থা দেখে প্রাণ ভয় পেয়ে যায়, তাকে অনেক ডাকে কিন্তু সাড়া পায় না। নার্সটাও সেদিন ছুটিতে ছিল তাই প্রাণ বাধ্য হয়ে ছুটে যায় বাবার কাছে সাহায্য চাইতে। বড়সাহেব সচরাচর বাসায় থাকলে স্টাডিরুমে থাকতেন তাই প্রাণও সেদিকেই যায়। তবে সেখানে গিয়ে বড় সাহেবকে অন্য এক নারীর সাথে দেখে ও থমকে যায়। কোনরকম নিজেকে সামলে নিম্নস্বরে ডাকে তাকে, বড় সাহেব সেই আওয়াজ শুনে দ্রুত সরে আসেন সেই নারীটির কাছ থেকে। ধমকে উঠেন প্রাণের উপর, সে কেন এসেছে এখানে? প্রাণ তখন কেঁদে সবটা বলতে চায় ঠিক কিন্তু বড় সাহেব শুনেন না। তাকে জোর করেই বের করে দেন রুম থেকে। প্রাণ কোন উপায়ন্তর না পেয়ে পুনরায় চলে যায় হুমায়রা বেগমের রুমে। তাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কখন তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই। কিন্তু যখন ঘুম থেকে উঠে তখন আর কোথাও নিজের মাকে খুঁজে পায় না সে।”
#চলবে
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৯
“ঘুম থেকে উঠার পর প্রাণ যখন তার মাকে খুঁজে পেল না তখন পাগলামো শুরু করে দিল। বড় সাহেব পাশের রুমেই ছিলেন, বড় কর্তা ও গিন্নিমার সাথে কথা বলছিলেন। প্রাণের চিল্লাপাল্লা শুনতে পেয়ে সবাই দৌড়ে আসলেন, বুঝানোর চেষ্টা করলেন তার মা আর জীবিত নেই। কিন্তু অবুঝ বাচ্চাটা কি আর সেসব বুঝে? কান্নাকাটি করতে থাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। তখন গিন্নিমা মানে প্রাণের দাদিজান মিশু বিবি প্রাণকে আগলে নিলেন। শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু লাভ হলো না এতে। অবশেষে তিনি বাধ্য হয়েই হুমায়রা আপার কবরের কাছে নিয়ে গেলেন প্রাণকে, বুঝালেন তার মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর কখনো তিনি ঘুম থেকে উঠবেন না। প্রাণ তখন হুমায়রা আপার কবরের সামনে বসেই কান্না শুরু করে দেয়৷ কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওখানেই অ*জ্ঞা*ন হয়ে পড়ে যায়। ওই ঘটনার পর থেকেই প্রাণ একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। সবসময় ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতো ও। মাঝে মধ্যে হুমায়রা আপার জিনিসপত্র কোলে নিয়ে বিরবির করতে থাকতো,কাঁদতো। খাওয়া-দাওয়া তো একদম ছেড়েই দিয়েছিল মেয়েটা। ছোট থেকেই প্রাণ দেখতে একদম পুতুলের মত ছিল, যে একবার দেখতো সহজে চোখ ফিরাতে পারতো না। অথচ তখন তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছিল ও। গিন্নিমা অনেক চিন্তায় ছিলেন প্রাণকে নিয়ে, তাই তিনি নিজ থেকেই প্রাণের পাশে থাকতে শুরু করলেন। সারাক্ষণ তার খেয়াল রাখতেন, কথা বলতেন। প্রাণও এতে কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুরো জিনিসটাই ঘেটে যায় যখন বড় সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ তুললেন। তাও কি-না আবার হুমায়রা আপার মৃ*ত্যু*র ত্রিশ দিনের মাথায়। বড় সাহেবের নতুন বউ ছিলেন মেহরিমা হোসেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। অভিনয়ের সূত্র ধরেই বড় সাহেবের সাথে তার পরিচয় এবং হুমায়রা আপা যখন একদম লাস্ট স্টেজে ছিলেন তখনই তাদের মধ্যে আপত্তিকর একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে৷ অতঃপর সেই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটাতেই তিনি বিয়ে করে নেন মেহরিমাকে। বড় কর্তা আর গিন্নিমা এই নিয়ে বেশ ক্ষেপে যান বড় সাহেবের উপর। কথা-কা*টা*কা*টি হয় বেশ। কিন্তু বড় সাহেব এসব কানে তুলেন না। সোজা চলে যান প্রাণের কাছে। পরিচয় করে দেন তার নতুন মায়ের সাথে। তবে মেহরিমাকে দেখার সাথে সাথেই প্রাণের মনে পড়ে যায় হুমায়রা আপার মৃত্যুর দিন মেহরিমাই তার বাবার সাথে ছিল। যার জন্য তার বাবা তার কথা শুনতে চায়নি, বের করে দিয়েছিল তাকে রুম থেকে। তখন প্রাণের মাথায় কিভাবে যেন এটা ঢুকে যায়, মেহরিমার জন্যই তার বাবা তাকে আর তার মাকে ভালোবাসতো না। একমাত্র মেহরিমার জন্য তার মায়ের মৃ*ত্যু হয়েছে। যার জন্যে মেহরিমাকে দেখামাত্র সে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মা*র*তে শুরু করে। ভারি কিছু ছুঁড়ে মারার ফলে মেহরিমার কপাল ফে*টে র*ক্ত বেরিয়ে আসে। যা দেখে বড় সাহেব রেগে যান ও প্রথমবারের মত প্রাণের গায়ে হাত তুলে বসেন। রাগের মাথায় তিনি হুমায়রা আপার শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। অকথ্য ভাষায় কথা বলেন এবং সে সাথে জানান, তার প্রাণের মত অ*স*ভ্য,বে*য়া*দ*ব মেয়ে চাই না। সে সময় গিন্নিমা এসে বড় সাহেবকে থামান এবং প্রাণকে মা*রা*র জন্য তাকে মা*রে*ন। অতঃপর বড় সাহেবের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি প্রাণকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসেন। যদিও পরবর্তীতে রাগ কমার পর বড় সাহেব গিয়েছিলেন সব ঠিক করে প্রাণকে ফিরিয়ে আনতে তবে গিন্নিমা তাকে ফিরিয়ে দেন। বড়কর্তাও ততদিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাই বড় সাহেব উপায় না হাল ছেড়ে দেন এবং নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আমি গিন্নিমার বাসায় অল্প বয়স থেকেই রান্নার কাজ করতাম। ষোল বছর বসয়ে বিধবা হতে হয় আমাকে, শ্বশুরবাড়ির মানুষ বের করে দেয়, বাবা-মাও নিজের কাছে রাখতে আপত্তি জানায়। এই সমাজে থাকার মত যখন ঠাই ছিল না তখন গিন্নিমাই আমাকে কাজের বদলে তাদের বাসায় থাকার জায়গা করে দেন। পড়ালেখার ব্যবস্থাও করে দেন। করে নেন আমায় তাদের পরিবারের ক্ষুদ্র একটি অংশ। যার ফলে তাদের কোনকিছুই আমার কাছ থেকে লুকায়িত ছিল না। প্রাণকে এই বাসায় নিয়ে আসার পর একদম চুপচাপ থাকতো। কথা বলতো না,হাসতো না,খেলতো না, কিছু না। নীরবে এককোণে বসে থাকতো। আমি, গিন্নিমা মিলে খুব কষ্টে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনি। আমি তখন সংসার হারা, মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ছিল মনে। ছোট প্রাণকে সামনে পেয়ে লোভ সামলাতে পারি না। ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব চেয়ে বসি গিন্নিমার নিকট। গিন্নিমা তখন ফিরিয়ে দেননি আমায়, হাতে তুলে দেন প্রাণের সকল দায়িত্ব। সেখান থেকেই আমি প্রাণের আশামা। প্রাণকে আমি নিজের সন্তানের মত করেই বড় করতে থাকি। তবে চঞ্চল প্রাণটাকে আর ফেরত আনতে পারি না, সময়ের সাথে সাথে ও আরও চাপা স্বভাবের হয়ে যায়৷ বাসায় যাও কথা বলতো বাহিরে তার এক শতাংশও বলতো না। এর পিছনে অবশ্য কারণ ছিল, স্কুলে বা পারা মহল্লায় প্রায় সবাই ওকে ওর বাবা-মা নিয়ে প্রশ্ন করতো। স্কুলে বাচ্চারাও অনেকসময় হাসা-হাসি করতো ওকে নিয়ে। বাবা-মা না থাকায় কটুক্তি করতো তারা। কিন্তু প্রাণের কোনটারই উত্তর দিতে পারতো না। তাই ও সবসময় অদৃশ্য হয়ে থাকার চেষ্টা করতো, সময় কাটাতে বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে রাখতো।
প্রাণের কাছে পরিবার বলতেই আমি,গিন্নিমা ও বড় কর্তা ছিলেন। আমাদের নিয়েই ছিল ওর ছোট পৃথিবী। তবে এই পৃথিবীতে ফা*ট*ল ধরে যখন প্রাণ আয়ে পাশ করে বের হয়। সে সময়টায় বয়সের ভার নিতে না পেরে বড় কর্তা ই*ন্তে*কা*ল করেন। তারই শোকে থেকে গিন্নিমাও এক সপ্তাহের ব্যবধানে চলেন না ফেরার দেশে। বিপর্যয় নামে প্রাণের জীবন। একসাথে এতবড় ধা*ক্কা নিতে পারেনি ও। স্মৃতিচারণে ভেসে উঠে নিজের মায়ের মৃ*ত্যু। সব মিলিয়ে প্রাণ ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। মেনে নিতে পারে না আপনজনের মৃ*ত্যু। এভাবেও হুমায়রা আপা মা*রা যাওয়ার পর ও কারো মৃ*ত্যু সহ্য করতে পারতো না। ফোবিয়া ছিল ওর এটায়। ফলে কর্তা ও গিন্নিমার চলে যাওয়ায় ওর অবস্থা করুণ হতে শুরু করে। প্রথম কয়েকদিন বদ্ধ উ*ন্মা*দে*র মত আচরণ করলেও পরবর্তীতে বন্দী করে ফেলে নিজেকে একটি রুমের ভিতর। আঁধারপুরী কক্ষটায় খাওয়া-পানি ছাড়া কাটিয়ে দেয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে সে। আমি তখন কোনভাবেই প্রাণকে সামলাতে পারছিলাম না।আমার কথাই শুনতে চাইতো না কোন। তাই বাধ্য হয়ে তখন বড় সাহেবকে ফোন দেই ও পুরো ঘটনা খুলে বলি। সব শুনার পর তিনি এসে প্রাণকে নিয়ে যান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায় যে, প্রাণ মেন্টালি ইল। ছোট থেকেই স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ও ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগার কারণে তার মানসিক অবস্থা খানিকটা বি*কৃ*ত হয়ে গিয়েছে। এমনকি সে বিপলার ডিসর্ডার ও পোস্ট ট্রোমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার (PTSD) এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, প্রাণ ভবিষ্যতে হয়তো ভারসাম্য হারাতে পারে। বড় সাহেব এটা শোনার পর তৎক্ষনাৎ প্রাণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসা ঠিকই চলছিল কিন্তু বিপত্তি ঘটে প্রাণকে ঔষধ খাওয়ানো নিয়ে। কোনভাবেই ওকে ঔষধ খাওয়ানো যেত না। ফেলে দিত ও সব। অথচ ওর নার্ভ ঠান্ডা ও স্বাভাবিক রাখার জন্য ঔষধগুলোর ভীষণ দরকার ছিল। নাহলে যত যাই করা হতো না কেন ওর অবস্থায় উন্নতি আসতো না। প্রাণকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু সে মানেনি। এর কারণ, ও ঠিক হতে চাইতো না। জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে ফেলেছিল ও। প্রতিনিয়ত নিজের মৃ*ত্যু কামনা করতো। তাই ওকে লুকিয়ে-চুড়িয়ে খাবার বা জুসের সাথে মিলিয়ে ঔষধ খাওয়াতে হতো আমাকে। খেয়াল রাখতাম প্রাণ যাতে কোনভাবে কিছু তেড় না পায়। অতঃপর দীর্ঘ আট মাস চিকিৎসার পর প্রাণ গিয়ে খানিকটা সুস্থ হয়। তবে পুরোপুআরিভাবে না। ওর মস্তিষ্কের কিছু নার্ভ অচল হয়ে গিয়েছিল, যার জন্য ওকে স্বাভাবিক রাখতে রেগুলার কয়েকটা মেডিসিন দিতে হতো। আমিও লুকিয়ে ওকে ঔষধগুলো খাওয়াতে থাকি।”
আশা বেগমের কথার এই পর্যায়ে ছন্দ বলে উঠলো, “তার মানে ওইদিন আপনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন?”
আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “হ্যাঁ! মিথ্যে বলেছিলাম আমি। প্রাণকে সেদিন ঘুমের ঔষধ না, ওর প্রেসক্রাইব করা ঔষধগুলাই খাওয়ানো হয়েছিল। জেসিকার আ*ত্ম*হ*ত্যা*র কথা শুনে প্রাণ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। বললাম না, মৃ’ত্যু জিনিসটা থেকে ওর ফোবিয়া আছে। তাই ওমন আচরণ করছিল। বলতে পারো, ওকে স্বাভাবিক ও শান্ত রাখতে মেডিসিনগুলো ভীষণ প্রয়োজন।”
ছন্দ দৃষ্টি নত করে বলল, “প্রাণ এন্টারটেইনমেন্ট জগতে আসলো কিভাবে?”
“প্রাণ যাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে ও পুনরায় যাতে একাকিত্বে না ভুগে, তাই বড় সাহেব জোরপূর্বক প্রাণকে এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রাণ কখনোই এই জগতে আসতে চাইতো না,প্রবল ঘৃ*ণা করতো। ওর ইচ্ছা ছিল হাইয়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশ যাওয়ার। তবে পরিস্থিতির খপ্পরে পড়ে সে-টা আর সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে শুধু আমার কথায় ও রাজি হয় এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে। কারণ আমি ভেবেছিলাম ব্যস্ত থাকলে হয়তো প্রাণের সমস্যা আসলেই দূর হয়ে যাবে। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যেহেতু বড়সাহেবের প্রথম বিয়ের কথা কেউ জানতো না সেহেতু প্রাণের ব্যাপারেও কেউ অবগত ছিল না। প্রাণের ডেবিউ করার পর পরই সে সমালোচনার মুখে পড়ে যায়। তখন বড় সাহেব সব সামাল দেন ও প্রাণকে মেহরিমা শিকদারের সন্তান বলেই পরিচয় দেন। প্রাণের যদিও এতে ঘোর আপত্তি ছিল কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে না মেনে উপায়ও ছিল না। এরপর অপছন্দ হলেও পড়ালেখা ছেড়ে অভিনয়কেই নিজের পেশা হিসাবে নিয়ে নেয় ও, আর পিছন থেকে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেন বড় সাহেব। খেয়াল রাখেন প্রাণের উপর যাতে কোন বিপদ-আপদ না আসে। হয়তো বাবা হিসাবে কিছু করতে না পারলেও এইটুকুতেই তৃপ্তি খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন তিনি প্রাণকে কখনো আপন করে নিতে পারবেন না আর, মেহরিমা দিবে না তাকে এমন করতে। তাই দূর থেকেই যা করার করছিলেন আর মিডিয়ার সামনে পার্ফেক্ট ফ্যামিলি হিসাবে নিজেদের উপস্থাপন করছিলেন। ধীরে ধীরে প্রাণ যাও নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল, জীবনটা উপভোগ করতে শিখছিল ঠিক সেসময় নয়ন ও জেসিকা মিলে ওর পিঠে ছুঁ*ড়ি মারে। পুনরায় চূ*র্ণ*বি*চূ*র্ণ করে দেয় ওকে। বিশ্বাস করতে ভুলে যায় মেয়েটা আমার। কথায় আছে, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে যায়। প্রাণের বেলায়ও ঠিক তাই হয়।”
ছন্দ বলল না কিছু। নীরবে একবার তাকালো ঘুমন্ত প্রাণের পাণে। কতটা না নিষ্পাপ, আদুরে লাগছে তাকে দেখতে। কেই বা বলবে এই মেয়েটা শৈশব থেকে লাঞ্ছিত,উপেক্ষিত হয়ে এসেছে? রাজ্যসম কষ্ট পেয়ে এসেছে? বক্ষঃস্থলে ভার অনুভব হলো ছন্দের। আফসোস করলো, “কেন আগে প্রাণের সাথে তার পরিচয় হলো না? কেন প্রাণের প্রথম অনুভূতি হতে পারলো না? কেন? কেন?”
আশা বেগম ছন্দের দৃষ্টি অনুসরণ করেই প্রাণের দিক তাকালেন। বললেন, “এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি যে এতটা বি*ষা*ক্ত তা আমি আগে বুঝিনি, বুঝলে হয়তো প্রাণের জীবনটা আজ এমন হতো না। দোষ সব আমারই।”
ছন্দ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে তন্ময় কন্ঠে বলল, “নিজেকে দোষারোপ করবেন না, প্লিজ। এখানে আপনার দোষ ছিল না। আপনি তো ইচ্ছে করে প্রাণকে এসবে ঠেলে দেননি, তাই না?”
“জানি কিন্তু তবুও কোথাও যে একটা কিন্তু থেকেই যায়। ও বুঝবে না তুমি। তবে তোমার কাছে আমার একটা চাওয়া আছে।”
“জি বলুন।”
“কথা দিতে পারবে, প্রাণকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে? কখনো ওকে একা ছেড়ে যাবে না? যত-যাই হোক না কেন। সবসময় ছায়ার মত পাশে থাকবে?”
ছন্দ নিস্পন্দ রইলো। পুনরায় প্রাণের দিক তাকিয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, “সে কি পারবে মনোহারিণী কন্যাটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতে? পারবে কি রক্ষা করতে?” মন তার সাথে সাথে উত্তর দিল, “পারতে হবেই তাকে। অচিনপুরের এই রাজকন্যাকে নিজের করতে হলে তাকে যদি খলনায়কও হতে হয়, হবে সে। তবুও সামান্যটুকু আঁচ আসতে দিবে না তার গায়ে।”
নিজের মনোভাব পাকাপোক্তভাবে স্থির করে ছন্দ প্রত্যুত্তর করলো, “কথা দিচ্ছি, কখনো আশাহত করবো না আপনাকে।”
আশা বেগম মুচকি হেসে বললেন, “মনে থাকে যেন, ওর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন শুধু তোমার। আমি বিশ্বাস করে ওকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।”
“আপনার বিশ্বাস আমি কখনো ভাঙাবো না। নিশ্চিন্তে থাকুন আপনি। তবে এখন একটু বিশ্রাম করুন। বিশ্রামের দরকার আছে আপনার।”
ছন্দের কথার বিপরীতে আশা বেগম দূর্লভ হাসলেন। ছন্দ সেদিক খেয়াল না করে আশা বেগমকে অক্সিজেন মাক্স পড়িয়ে দিল। অতঃপর বেরিয়ে গেল কেবিনটা থেকে।
________
সূর্যের স্বর্ণবর্ণা আলোকরশ্মিতে ঝলমল করছে অম্বর। রৌদ্রস্নাত মেঘেরা হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। দুর্দম বাতাসে নড়ছে জানালার পর্দাগুলো। একটু আগেই ফ্লোর মুছে দিয়ে গিয়েছে কেউ, ফেনাইলের কড়া গন্ধ নাকে এসে বারি খাচ্ছে। প্রাণের ঘুম ভেঙেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। উঠে সে ফ্রেশ হয়ে বসলো আশা বেগমের পাশে, একহাত তার শক্ত করে ধরে। আশা বেগম তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তিনি উঠলেন আরও ঘন্টাখানেক পড়ে। প্রাণের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে পুনরায় শুয়ে পড়লেন। দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি অনেক, বিশ্রামের বেশ প্রয়োজন। প্রাণ তার পাশে বসলো আরও কিছুটা সময়। এরপর ছন্দের কথা মাথায় আসতে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। বাহিরে এসে তার খোঁজ করলো কিন্তু পেল না। তাই ফোন লাগালো। ফোন রিং হচ্ছে তবে কেউ উঠাচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও যখন কেউ ধরলো না তখন প্রাণের কপালে ভাঁজ পড়লো। ছন্দ কখনো এখনো এমন করে না, প্রথম কলেই রিসিভ করে। যার জন্য প্রাণ কিছুটা হলেও চিন্তিত হলো। যৎসামান্য সময়ের পর ছন্দে দেখা পেল সে। চুল গুলো তার বেশ এলোমেলো, নির্ঘুম রাত কাটানোর ফলে ক্লান্তিরা সব উপচে পড়ছে চোখ-মুখ বেয়ে, ঠোঁট দুটো অমসৃণ, রুক্ষ। ফ্যাকাসে দেখাছে মুখশ্রী। পড়নে কুঁচকে যাওয়া টি-শার্ট, ট্রাউজার। তাকে এমতাবস্থায় দেখে প্রাণের বেশ মায়া হলো। সে সাথে, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ইচ্ছে হানা দিল মস্তিষ্ক জুড়ে। প্রাণ সেসব দ্রুত ডাস্টবিনে ছুড়ে মেরে স্বাভাবিক করলো নিজেকে। আনমনে অবাক হলো নিজের মধ্যে এত পরিবর্তন দেখে। নিজের স্বভাবের বিপরীত স্রোতে সে কখনোই গা ভাসায় না, তবে আজ কেন? নিজেকে প্রশ্ন করার ফাঁকেই ছন্দ তার নিকটে চলে আসে। প্রাণ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
ছন্দ ঈষৎ হেসে বলল, “এইতো কাজ ছিল কিছু।”
প্রাণ অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে তাকালো। ছন্দ সেদিক পাত্তা না দিয়ে প্রাণের পাশেই বসে পড়লো। হাতে থাকা খাম থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে বলল, “আপনি যে আমার কাছে এখনো ঋণী আছেন তা মনে আছে কি?”
প্রাণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ছন্দের দিক তাকালো। বলল, “আছে।”
“তাহলে ধরে নিন আজ আপনার ঋণ পরিশোধ করার সময় চলে এসেছে।”
প্রাণ কিছু একটা ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “বলুন কি চাই আপনার।”
ছন্দ হাতে ধরে থাকা কাগজগুলা প্রাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “বেশি কিছু না, শুধু এখানে সাইন লাগবে আপনার। তবে শর্ত এটাই পেপারগুলার লেখা আপনি পড়তে পারবেন না, আর না জিজ্ঞেস করতে পারবেন কিসের কাগজ এগুলা। ঠিক আছে?”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। টু শব্দ না করে টান দিয়ে ছন্দের কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে সাইন করে দিল। অকারণেই তার ছন্দের রাগ হচ্ছিল বেশ। কেন জানি না, স্বার্থপর লাগছিল তাকে। এর কারণ হয়তো অবচেতন মন তার ছন্দকে একটু বেশিই ভালো মনে করে নিয়েছিল। যার জন্য তার এই রূপটা নিতে পারছে না সে। প্রাণ এক নিঃশ্বাসে সাইন করে ছন্দকে কাগজগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আশা করি, আমাদের মধ্যকার সকল হিসাব-নিকাশ শেষ হয়ে গিয়েছে। হলে আপনি এখন আসতে পারেন।”
ছন্দ ফট করে সকল কাগজগুলো নিয়ে প্রাণের সাইন করা জায়গাগুলায় চোখ বুলায়। সব ঠিকঠাক দেখে বিস্তৃত হেসে বলে, “থ্যাংকস আ লট মিস. ল্যাভেন্ডার। ইয়্যু জাস্ট মেড মাই ডে।”
ছন্দের এসব আদিখ্যেতা প্রাণের সহ্য হলো না কেন যেন। রাগ তো তার বহুক্ষণ ধরেই জমেছিল এবার যেন তাতে বাতাস দেওয়া হলো। সে বজ্রগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, “আসতে পারেন আপনি।”
ছন্দ কথা বাড়ালো না। নৈঃশব্দ্যে উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল দরজার কাছে। বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে পিছনে ঘুরে অমায়িক এক হাসি হেসে বললো, “শাদি মুবারক মিস. ল্যাভেন্ডার।”
কথাটা বলে ছন্দ দ্রুত কেটে পড়লো। প্রাণ দরজার দিকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বুঝে উঠতে পারলো না ছন্দ বলে গেলটা কি?
#চলবে