প্রাণেশ্বরী পর্ব-১৮+১৯

0
913

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৮

“এটা আপনার কাছে ছিল?”

প্রাণের শিথিল কন্ঠ। ছন্দ গার্লিক ব্রেডে কামড় বসিয়ে বলে, “হ্যাঁ! ওইদিন সুইমিংপুলের পাশ থেকে পেয়েছিলাম। জানতাম আপনারই কিন্তু সময়-সুযোগ না হওয়ায় দেওয়া হয়ে উঠেনি।”

প্রাণ কাঁপা কাঁপা হাতে ছন্দের মুঠো থেকে ঘড়িটা তুলে নিল। অতঃপর সন্তর্পণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। নয়ন ধারে দেখা দিল প্রস্ফুটিত জল। সিক্ত হলো মসৃণ গাল দুটো। হয়তো অন্যের নিকট এটি সামান্য বস্তু ব্যতীত কিছুই না, তবে প্রাণের নিকট এটি অমূল্য রত্নের ন্যায়। যার সাথে জড়িয়ে আছে তার মায়ের ছোঁয়া,মোহ-ভালোবাসা,স্মৃতি। একমাত্র সেই জানে এটি হারিয়ে যাওয়ার পর তার উপর দিয়ে কি গিয়েছিল। নয়নের প্র’তা’র’ণাও তাকে এতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে পারেনি যতটা না ঘড়িটা হারিয়ে দিয়েছিল। আশা সব ছেড়ে দিয়েছিল এই ঘড়িটার পাওয়ার, অনুভূতি সব চাপা দিয়ে এগিয়ে চলছিল সামনে৷ কিন্তু আজ এভাবে ঘড়িটা পেয়ে যাবে তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। এবার সে বুঝতে পারছে কেন সেদিন সোনারগাঁও হোটেলে এত খোঁজার পরও ঘড়িটি পায়নি, ছন্দের কাছে ছিল বলেই হয়তো। প্রাণ দ্রুত অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে ছন্দের দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকায়, “থ্যাংকস আ লট ফর কিপিং ইট সেফ। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, আপনি আমায় কি ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

ঘটনাক্রমে ছন্দ বিস্ময়বিমূঢ়,বাকরুদ্ধ। নিষ্পলক তার দৃষ্টি। প্রাণের নতুন রূপটা গ্রহণ করতে সময় লাগছে তার। প্রথমদিকে প্রাণের চাহনি দেখে ধারণা করেছিল ঘড়িটা হয়তো তার নিকট বিশেষ কোন অর্থ বহন করে৷ কিন্ত পরবর্তীতে প্রাণের অশ্রু দেখে বুঝতে বাকি নেই ঘড়িটা অমূল্য কিছু। কেন না, আর যাই হোক প্রাণের অশ্রু সহজে ঝরার না তা এতদিনে বেশ বুঝেছে সে। দৃঢ়তাই তার ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। ছন্দ নিজেকে সামলে বলে, “ঘড়িটা মনে হচ্ছে খুব স্পেশাল আপনার জন্য?”

প্রাণ ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে, “হু! আমার মায়ের এটা।”

ছন্দ ভাবলো ঘড়িটা হয়তো মেহরিমা শিকদার দিয়েছে তাকে। তাই বেশি প্রশ্ন না করে ছোট করে বলে, “অহ আচ্ছা।”

প্রাণ প্রত্যুত্তরে মৌন থাকে। ছন্দ এবার রসিকতা সুরে বলে, “আপনি কিন্তু আবারও ঋণী হয়ে গেলেন আমার নিকট। সময় হলে সবটা শোধ করতে পারবেন তো?”

প্রাণ মাথা তুলে বলে, “আমি ব্যতীত আপনার যাই দাবী থাকুক না কেন আমি সে-টা পূরণ করতে রাজি আছি। এটা প্রাণের ওয়াদা আপনার নিকট।”

ছন্দ দূর্লভ হেসে বলে, “জাস্ট রিলেক্স। আপনাকে চাইব না আমি।”

প্রাণ কথা বাড়ালো না। ঘড়িটা নিজের ব্যাগে রেখে পুনরায় খাওয়ায় ধ্যান দিল। অতঃপর খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে দুইজন চললো নিজ নিজ পথে।

___________

ইন্টারনেটে কয়েকদিন ধরেই নয়ন,প্রাণ ও জেসিকাকে নিয়ে অবিশ্রান্ত নিউজ বের হয়েই চলেছে। থামাথামির কোন লক্ষণ নেই। এর মধ্যে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো নিহাল শিকদারের অফিশিয়াল নিউজটি। তিনি প্রেস কনফারেন্স ডেকে নয়ন ও প্রাণের এনগেজমেন্ট ভাঙ্গার খবরটি সকলকে জানান। সাথে এটাও জানান, নয়নের সাথে তিনি পরবর্তীতে আর কাজ করতে ইচ্ছুক না। কথাটা পাবলিশ হওয়ার কয়েক প্রহরের ব্যবধানেই বাকি ডিরেক্টররাও পিছিয়ে আসে এবং নয়নের সাথে সকল চুক্তি ভে’ঙে ফেলে। এখানে কারই বা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে যে নয়নকে কাজ দিয়ে তারা নিহাল শিকদারের সাথে শত্রুতা করতে যাবে? নিহাল শিকদার নয়নকে নিজের সকল মুভি থেকে ব্যান করেছে মানে ইন্ডাস্ট্রি থেকেও সে ব্যান। নয়নের ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি হয়তো এভাবেই ঘটে যেত তবে বিষয়টাকে আরও জটিল করতে সন্ধ্যার দিকে ভাইরাল হলো জেসিকা আর নয়নের একটা ভয়েস ও ভিডিও ক্লিপ। ভয়েসটিতে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রত্যেকটি কথা সুস্পষ্ট। বস্তুত, এটা সেদিন হোটেল রুমে নয়ন ও জেসিকা যা যা কথা বলেছিল তারই অংশবিশেষ এটা। সেদিন প্রাণ জানতো জেসিকা হয়তো বা কিছু প্ল্যান করেছে তাই নিজের সেফটির জন্য হোটেলে ঢুকার পর থেকে পুরোটা সময় সে চৈতিকে কলে রেখেছিল। যার দরুণ প্রাণ জ্ঞা’ন’হী’ন থাকলেও তার কল রেকর্ডে নয়ন ও জেসিকার সম্পূর্ণ কথোপকথন স্টোর হয়ে যায়৷ আর ভিডিওটি হচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজ, যার মধ্যে দেখা যাচ্ছে নয়ন ও জেসিকা মিলে প্রাণকে অ’চৈ’ত’ন্য অবস্থায় একটি রুমে নিয়ে যাচ্ছে। এই ফুটেজটার জন্যই প্রাণ সেদিন চৈতিকে এত তাড়া দিয়েছিল। কারণ সে জানতো নয়ন আর জেসিকা কাঁচা খেলোয়াড় না, তারা তাকে রুমে না পেয়ে সর্বপ্রথম ফুটেজটা ডিলিট করতে যাবে। তাই সে আগেই চৈতিকে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিল যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয় তাহলে ফুটেজটা আগে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ ফুটেজটা যেন ডিলিট করে দিতে। আর সেখানের স্টাফদের টাকা খায়িয়ে বলতে বলায়,” চতুর্থ তালার করিডরের সিসিটিভি নষ্ট ছিল তাই ফুটেজ রেকর্ড হয়নি।” আর হয়ও সব তার পরিকল্পনা মাফিকই।

এদিকে প্রমাণ দেখে এবার জনগণের আক্রোশ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। চারদিক হতে গুঞ্জন উঠে তাদের কু’ক’র্ম নিয়ে। অ্যান্টিফ্যানেরা তাদের উপর একেক পর এক হা’ল’মা চালায় সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, অ’শ্রা’ব্য ভাষায় যা নয় তাই বলে চলে। এমনকি তাদের পুরোপুরিভাবে ইন্ডাস্ট্রি থেকে ব’য়’ক’ট করার দাবিও জানায় তারা৷ এসব দেখে নয়নের বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেন। এতদিন সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি কিন্তু সর্বশেষ খবরটার জন্য আর সফল হতে পারেননি। দেখতেই দেখতে সব তার নাগালের বাহিরে চলে যায়। ছেলের উপর এখন তার রাজ্যসম ক্ষোভ, পারছে না শুধু বে’ল্ট দিয়ে পি’টি’য়ে ছা’ল সব তু’লে ফেলতে। এতটা বো’কা তার ছেলে কিভাবে হলো কে জানে? একমাত্র ছেলের বো’কা’মির জন্য সোনার হাঁস তার পিঞ্জরে ব’ন্দী হয়েও হলো না৷
.
ইজি চেয়ারে গা হেলিয়ে বসে আছে নয়ন। দৃষ্টি তার সিলিং-এর দিক নিবদ্ধ। কোন এক ভাবনায় বিভোর। পাশেই বিছানা পড়ে থাকা ফোনটি বার বার নোটিফিকেশনে সাউন্ডে বেজে বেজে উঠছে আর তার ভাবনায় বিঘাত ঘটাচ্ছে। বর্তমানে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ঝড় উঠেছে তার প্রভাব এটা। ওয়াইফাই অফ করেও নিস্তার নেই তার, মেসেজ-কল সমানতালে এসেই চলেছে। নিজের রাগ এবার সংবরণ করতে না পেরে নয়ন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ফোনটা তুলে সামনের দেয়ালে সজোরে ছুঁ’ড়ে মা’র’লো। চোখ দুটি তার ঈষৎ র’ক্তি’ম৷ গত কয়েক রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়ার স্বাক্ষী যেন। সে পুনরায় পিছনের দিকে গা হেলিয়ে আঁখিপল্লব দু’টি এক করে। ভাবতে থাকে সেই রাতের কথা, সেদিন জেসিকার পুরো পরিকল্পনা জানার পর তার মন সায় দিচ্ছিল না প্রাণের সাথে সেসব হতে দেওয়ার। তাই তো জেসিকার সাথে নিচে যাওয়ার পর সে তাকে ওয়াশরুমের কথা বলে চলে আসে উপরে, প্রাণকে অন্যরুমে শিফট করার জন্য। কিন্তু উপরে এসে যখন প্রাণকে পায় না তখন হন্য হয়ে প্রাণকে খুঁজে কিন্তু পায় না। এর মাঝে জেসিকাকে এসে রুমে প্রাণকে না পেয়ে ধরে নেয় নয়নই প্রাণকে সরিয়ে ফেলেছে। কেন না শুরু থেকেই নয়ন তার পরিকল্পনার বিপক্ষে ছিল। এই নিয়ে তাদের মাঝে তুমুল ঝ’গ’ড়া বেঁধে যেতেই জেসিকা নয়নকে কষে এক থা’প্প’ড় মেরে সেখান থেকে চলে যায়। নয়ন তখনও দ্বিধায় ছিল প্রাণ গেল কোথায়, তাই সিসিটিভি দেখতে গিয়েছিল সে। কিন্তু সিসিটিভি নষ্ট থাকায় রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। তাই ধরে নিয়েছিল মাঝে হয়তো প্রাণের জ্ঞান ফিরেছিল আর তখন সে বেরিয়ে গিয়েছে। বাসায় আসার পর তার মনে ভয় ছিল প্রাণ কিছু শুনে ফেলেছিল কি-না, তবে দুপুর অব্দি প্রাণের ফোন না আসায় সে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল আর প্রাণের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতে নিচ্ছিল৷ ঠিক এমনই সময় তার আর জেসিকার নিউজটা আউট হয়ে যায়৷ তখন সে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারছিল না কে করেছে এই কাজটা। কিন্তু এখন তার নিকট সব জলের ন্যায় স্বচ্ছ। এসবই প্রাণের কারসাজি। সে আগে থেকেই জানতো তার আর জেসিকার সম্পর্কে। আর সেদিন হোটেল রুমে তাদের কথাবার্তা সবই শুনেছিল। খুব ভালোই প্র’তি’শো’ধ নিয়েছে প্রাণ। একদম নিখুঁত। নয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে৷ সে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে প্রাণের পরিবর্তনগুলো ধরতে পারলো না? একবারও মাথায় আসলো না তার সহজ-দূর্বল মনের প্রাণ কিভাবে দৃঢ় হয়ে গেল? তার জন্য পাগল মেয়েটি হঠাৎ কেন দূরে সরে গেল? আচ্ছা, তার আর জেসিকার বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা’য় এই কি প্রাণের এই পরিবর্তনের কারণ? নাহলে আজ প্রাণকে এতটা অচেনা কেন লাগছে তার? কোন প্রশ্নেরই উত্তর জানা নেই নয়নের। তবে এতটুকু জানে নিজের পা’পে’র শা’স্তি’ই এখন তাকে পেতে হবে। একটু একটু করে।

_______

পরবর্তীতে বোর্ডের একক নির্দেশে জেসিকা ও নয়নকে চিরকালের জন্য ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয় এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে। তাদের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে অবশেষে। সে সাথে সমাজে মুখ দেখানোর মত জোরও অবিশিষ্ট থাকে না আর। লাঞ্চিত হয়ে রয়ে যায় তারা। এর মধ্যে শিলাকে পুলিশ গ্রে’ফ’তা’র করে বে’ই’মা’নি’র ও তথ্য পা’চা’র করার অ’প’রা’ধে। প্রাণ সেবার শিলা ও নয়নের পুরো কনভারসেশনের স্ক্রিনশট নিজের ফোনে নিয়ে নিয়েছিল, আর এই ছবিগুলার উপর ভিত্তি করেই শিলাকে সে দোষী প্রমানিত করে৷ কিন্তু কাকে সে তথ্য পাচার করেছিল তার নাম গোপন রেখে প্রাণ। কেন না, নয়ন তখন পুরোপুরি নিঃস্ব এখন। নিজের কর্মের যথেষ্ট শাস্তি পাচ্ছে সে এবং ভবিষ্যতেও পেতেই থাকবে। জনগণ যে সহজে প্র’তা’র’ক’দে’র ভুলে না। আর যেহেতু ক্ষতির পরিমাণ নেহাত কম ছিল সেহেতু পুলিশও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাটে না।

প্রাণ এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পরিশেষে সে যেভাবে চাইছিল সেভাবেই সবটা হয়েছে৷ এখন সে পুরোপুরি মুক্ত। কোন কপটতার মায়াজালে আবদ্ধ নেই আর।

#চলবে

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৯

গোধুলিতে মনখারাপি মিছিল। ধূসর-কালো মেঘ উড়ছে প্রজাপতির মত। বন্য হাওয়া ছুটেছে নিরুদ্দেশ পথে, লতা-পাতা ঝড়ে পড়ছে সমতলে। প্রস্ফুটিত কদমরানী দুলছে তালে তালে, শুভ বর্ষণের দেখা পাবে বলে। দোতলা বাড়িটি জুড়ে আজ নিস্তব্ধতার দা’পা’দা’পি। করিডর হতে মোলায়েম আলোর ছটা এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আঁধারে নিমজ্জিত কক্ষে মেঝেতে। নিভু নিভু দীপ্তির আদুরে ভাব। প্রাণ আশা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে। এ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির জায়গা। আশা বেগম খুব সন্তর্পণে হাত বুলাচ্ছেন প্রাণের মাথায়। তার হাতের ছোঁয়ায় খেলা করছে রেশমি চুলগুলো। প্রাণ নিভন্ত প্রায় কন্ঠে বলে, “জীবন কত বৈচিত্র্য না আশামা? হাজারটা মানুষের হাজারটা কাহিনি অথচ দিনশেষে সব এক সূত্রেই গাঁথা। অদ্ভুত না?”

আশা বেগম ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “অদ্ভুত না। পৃথিবীর নিয়মই এটা। অর্থ ছাড়া জীবন চলে না, জীবন ছাড়া মানুষ বাঁচে না।”

“এই নিয়মেই তো সব শেষ। অর্থের মোহ হারিয়ে দিচ্ছে সকল সম্পর্ককে, ছিনিয়ে নিচ্ছে সব। এর মধ্যে শান্তি কোথায়?”

আশা বেগম স্মিত হেসে বলে, “তৃপ্তি আর প্রশান্তি একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং, যেখানে তোমার অন্তর তৃপ্ত সেখানেই শান্তি আগত।”

প্রাণ আশা বেগমের আঁচলে মুখ গুঁজে বলে, “তাহলে আমার প্রশান্তি তুমি।”

আশা বেগম কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন তবে প্রাণের প্রফুল্লিত চেহেরার পাণে তাকিয়ে আর বলতে পারলেন না। মেয়েটা অনেকদিন পর নিঃসংকোচ ভাবনায় রয়েছে, কথাটা বলে তার মন বিষিয়ে দিতে চাইছেন না তিনি। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আশা বেগম বলে উঠেন, “তোর কিন্তু এখন একটু বেশি সাবধান থাকতে হবে। এসবের পর নয়ন,জেসিকা হাতে হাত রেখে বসে থাকবে বলে মনে হয় না।”

প্রাণ ভাবান্তরহীন কন্ঠে বলে, “তাদের নিয়ে ভাবতে আর ইচ্ছে করে না আশামা। অনেক তো হলো।”

“কিন্তু তবুও সাবধান থাকা ভালো। তাই ভাবছিলাম কয়েকদিনের জন্য বডিগার্ড..”

আশা বেগমের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রাণ বলে উঠে, “কোন বডিগার্ড রাখবো না আমি। তুমি জানো বডিগার্ড জিনিসটা অসহ্য লাগে আমার।”

“জানি তবে তোর নিরাপদ থাকাও এখন জরুরি।”

“যদি মৃ’ত্যু ভাগ্যে থাকে তাহলে এভাবেই হবে। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের প্রতি মোহ অবশিষ্ট নেই আমার।”

আশা বেগম রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “থা’প্প’ড় চিনিস? আমাকে সেদিন জ্ঞান দিয়ে এখন নিজেই বলছিস এগুলা? মানে নিজের বললে দোষ নাই অথচ আমি বললেই দোষ?”

প্রাণ হেসে বলে, “রেগে গেলে তোমাকে মারাত্মক লাগে। একদম নায়িকা!”

আশা বেগম প্রাণের ডান বাহুতে হালকা চা’প’ড় মেরে বলেন, “ঠিক মত রাগও করতে দিস না আমায়।”

প্রাণ হাসে। আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকান জানালার বাহিরে। ক্ষণেই গগনবিদারী শব্দে কেঁপে উঠলো অন্তরিক্ষ। কষ্টের মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে শহর জুড়ে, সবুজ পাতার হলুদবর্ণ দেয় সে নিমিষে সরিয়ে। ছড়িয়ে দেয় শুদ্ধ,স্নিগ্ধ কল্প। প্রাণ বাহিরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরবির করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আশা বেগমের কর্ণকুহরে ঠিকই প্রাণের কথাগুলো তরঙ্গিত হয়েছিল সুস্পষ্টভাবে। তিনি কিয়ৎক্ষণ ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন প্রাণের পাণে। মেয়েটা কবে যে এসব থেকে বেরিয়ে আসবে কে জানে?

_________

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের জন্য বসে আছে প্রাণ। মাথায় ক্যাপ, চোখে ব্রাউন শেডের সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক। দৃষ্টিতে বিরক্তির ছাঁপ স্পষ্ট। নেটিজেনদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই বেশভূষায় আসা তার। নয়ন ও জেসিকার ভালোমানুষি মুখোশ খুলে পড়ার থেকেই প্রাণের প্রতি সকলের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। তার সম্পর্কে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র তথ্য জানার জন্য সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে। যার দরুণ তার প্রোফাইল লো রাখা এখন প্রায় দুরূহ হয়ে উঠেছে৷ ঠিক এই কারণেই সে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে কোন কন্ট্রোভার্সিতে জোড়ায়নি, আর না নিজের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য বাহির হতে দিয়েছে। কিন্তু শেষে নিজের স্বার্থের জন্যই সবটা প্রকাশে এনে বড্ড ঝামেলায় পড়েছে। তাই পুনরায় নিজের প্রোফাইল লো আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কতদিনে সব আবার স্বাভাবিক হবে কে জানে?
পাশেই চৈতি বসে মোবাইল ঘাটছে। হয়তো সিডিউল পরোক্ষ করছে। প্রাণ একবার পাশ ফিরে তাকিয়ে নিজেও মুঠোফোনের মিথ্যে মায়া ডুব দেওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তী এক সপ্তাহ তার চট্রগ্রামে কাটাতে হবে, নতুন মুভির শুটিংয়ের জন্য। বর্তমানে এই মুভিটার জন্য প্রায়ই তাকে বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা ট্র‍্যাভেল করতে হচ্ছে। যার দরুণ অবসর,বিশ্রাম কোনটাই তার মিলছে না। যান্ত্রিক মানবীর ন্যায় শুধু এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি আর কাজ করেই চলেছে।যদিও তার দাদীজান চলে যাওয়ার পর থেকেই তার জীবনে ব্যস্ততা নামক বস্তুটা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, তবে এবার চাপ বেশি পড়ে যাচ্ছে তার উপর। প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে নেয়, কোলাহল হতে দূরে নিজের কাল্পনিক সাম্রাজ্যে অবগাঢ় হয়।
.
আজ দুদিন হতো চললো প্রাণ চট্রগ্রামে অবস্থান করেছে। শুটিং-ও চলছে জমপেশভাবে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ফ্রি হয় প্রাণ। হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। নেত্রপল্লব এক করতেই নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রাত দশটার নাগাদ দরজা ধাক্কানোর শব্দে তন্দ্রা কেটে যায় প্রাণের। সে উঠে বসে হামি দিয়ে মোবাইলে সময় দেখো নিল। অতঃপর খালি হাতে চুলে একটি খোঁপা করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে পেল চৈতি এসেছে৷ প্রাণ দরজা খুলে দিতেই চৈতি ধীর পায়ে ভিতরে আসে। কাঁচা ঘুম থেকে উঠার ফলে প্রাণের মেজাজ খানিকটা চড়ে ছিল। কথা বলা ছিঁটেফোঁটা ইচ্ছে নেই। তাই ছোট করে রুক্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”

চৈতি ক্ষীণ কন্ঠে বলে, “ম্যাম আজকে সকলে একসাথে ডিনার করার প্ল্যান করেছে৷ তাই রাজ স্যার চাইছেন আপনি যেন ডিনারে উপস্থিত থাকেন।”

প্রাণ কিছুটা অপ্রসন্ন হলে বটে৷ এসব গেদারিং এ তার কাজ কি সে-টা সে খুঁজে পায় না। উপরন্তু, তার এখন ঘুমের প্রয়োজন। মুভিতে সূর্যোদয়ের একটা দৃশ্য আছে বিধায় তাকে সকাল চারটায় উঠতে হয়েছে। ঘুম তো দূরে থাক, সারাদিন বিশ্রামও ঠিক মত হয়নি৷ তার উপর এসব। প্রাণ চাচ্ছিল না করে দিতে তবে রাজ সেনের আমন্ত্রণ বলে পারলো না। রাজ্যসম বিরক্তি নিয়ে বলল, “আচ্ছা! তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

চৈতি মাথা নেড়ে চলে যায়। প্রাণ মুখ-হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসে নিজের রুম থেকে। করিডরের পথ ধরে লিফটের দিকে যাওয়ার পথে আকস্মিক কারো সাথে ধাক্কা খায় প্রাণ। এভাবেই তার মেজাজ তুঙ্গে ছিল, ধাক্কা খাওয়ায় মেজাজ তার সম্পূর্ণ বিগড়ে গেল৷ উপরের দিক না তাকিয়েই অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো সে, “স্ক্রা’উ’ন্ডা’ল!”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে থাকলো, “এক্সকিউজ ইউ!”

কন্ঠস্বরটা রিচিত ঠেকতেই প্রাণ দৃষ্টি তুলে তাকায়। ছন্দকে নিজ সম্মুখে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সরু দৃষ্টিতে তাকায়, “হোয়াট?”

ছন্দ “প্রশ্ন করার অধিকার কি আজ আমার না মিস. ল্যাভেন্ডার? একটু আগে কি বললেন আমায়?”

প্রাণ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল, ‘কি বলেছি? কিছুই না।”

কথাটা বলে প্রাণ পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে ছন্দ তার পথ আঁটকে বলে, “পালিয়ে যেয়ে কিন্তু লাভ নেই মিস. ল্যাভেন্ডার, আমার প্রশ্নের উত্তর না দিকে দেওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়ছি না আপনার।”

প্রাণ বিরক্ত সহিত তাকায়, “আপনি এখানে কেন? স্টক করছেন আমায়?”

ছন্দ হেসে বলে, “আমার এত খারাপ দিনও আসেনি যে আপনাকে স্টক করতে যাব।”

“গুড ফর ইউ।”

কথাটা বলে প্রাণ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ছন্দ তা দেখে রসিকতা স্বরে বলে, “সাম ওয়ান ইজ ইন বেড মুড আই গেস।”

প্রাণ প্রত্যুত্তর করে না শানিত দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর ছন্দের পাশ কাটিয়ে চলে আসে নিচে। ছন্দ এবার মাথার পিছে হাত গলিয়ে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলে, “আজব তো! মেয়েটা রেগে গেল কেন?”
.
লম্বা টেবিলটা জুড়ে ক্রিউ মেম্বাররা আড্ডার পসরা সাজিয়েছে৷ অনুচ্চে কথা বললেও গুঞ্জন ছড়িয়ে বাতাসে। প্রাণ মাথা নত করে একমনে খেয়ে চলেছে। অকস্মাৎ রাজ সেন বলে উঠে, “আরেহ মি. ছন্দ। হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ।”

ছন্দ পাশ ফিরে রাজ সেনকে অভিবাদন জানিয়ে মিষ্টি হাসে। সাথে সাথে তার গালে ফুটে উঠে অপার্থিব সেই গর্তটি। দুইজন পরিচিত হওয়ার পর রাজ জিজ্ঞেস করে, “এবার ম্যাচ কি চিটাগং হচ্ছে নাকি?”

ছন্দ আড়চোখে প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “জি! পরশুদিন ম্যাচ।”

“অহ আচ্ছা! তা একাই ডিনার করতে এসেছে না-কি পুরো টিম নিয়ে?”

“টিম নিয়েই। ওদিকে আছে সবাই।”

রাজ সেন অমায়িক হেসে বলে, “দ্যান প্লিজ জয়েন আস।”

ছন্দ নাকচ করলেও রাজ সেনের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে যায়। ছন্দ তার দলের সবাইকে ডেকে এনে ফিল্ম ক্রিউদের সাথে যোগ দেয়। প্রাণের পাশের সিট ফাঁকা থাকায় ছন্দ কোনদিক না তাকিয়ে তার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। প্রাণ মাথা তুলে এক পলক ছন্দের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নত হয়ে খাওয়ায় অভিনিবেশ স্থাপন করে। ক্রিউ মেম্বারের সকলেই ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমকে পেয়ে উৎফুল্ল বেশ। খোশগল্পে মেতে উঠে সকলে। এর ফাঁকে ছন্দ কন্ঠস্বর নামিয়ে প্রাণের দিক কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলে, “ভাগ্যে দেখা লিখা থাকলে পালিয়ে-বেড়িয়েও লাভ হয় না মিস. ল্যাভেন্ডার।”

প্রাণ ভ্রু কুঁচকে ছন্দের দিক তাকাতেই ছন্দ মৃদু হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে, “সান্নিধ্য এড়িয়ে আমার যাবেন কই এখন?”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে