#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৬
প্রাণ দৃষ্টি সরু করে ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “আমি বিশ্বাস করি তোমায়।”
প্রাণের কথা শুনে নয়ন চোখ দুটো বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে উঠে। সে ভাবতে পারেনি প্রাণ এত সহজে তার কথা মেনে নিবে। বিশ্বাস করবে তাকে। সে ধরেই নিয়েছিল আজ সব তার হাত থেকে ফুঁসলে যাবে। তার ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যাবে। তাই এসেছিল শেষবারের মত প্রাণকে বুঝাতে। সে জানতো প্রাণ এসব নিতে পারবে না, উ’ন্মা’দে’র মত আচরণ করবে, কান্না-কাটি করবে। শুনতে চাইবে না কোন কথা, তাকে সামলানো দায় হবে। নিজের পক্ষে আনতে অনেক কাঠখড় পো’ড়া’তে হবে। আবার প্রাণ হয়তো মানবেও না। কিন্তু বর্তমানে সব হচ্ছে তার কল্পনার বিপরীত। অদ্ভুত না? আচ্ছা,কোন মানুষ কি আদৌ কাউকে এতটা বিশ্বাস করতে পারে? সকল প্রমাণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তা অদেখা করে ভালোবাসার মানুষটির কথাই অদ্বিতীয় হয়ে যায়? সত্যি কি তাহলে ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়? হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে তুলে? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল নয়ন। কিয়ৎকাল প্রাণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নয়ন প্রাণের হাত মুঠোয় পুড়ে নিল। বলল, “আমি জানতাম প্রাণ, তুমি আমায় ভুল বুঝবে না। বিশ্বাস করবে। তোমাকে আমি ঠিক বুঝাতে পারবো না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি৷ আমার মনে তুমি ব্যতীত আর কেউ নি।”
প্রাণ আলগোছে হেসে। অতঃপর নয়নের হাত থেকে নিজের হাত এক ঝাঁটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমি বিশ্বাস করি তোমায়– এটাই শুনতে চেয়েছিলে না তুমি আমার কাছ থেকে? হাহ!”
মুহূর্তেই নয়ন তাজ্জব বনে গেল। সে গোলগাল চোখে তাকালো প্রাণের দিকে৷ স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “প্রাণ তুমি কি আমায় বিশ্বাস করছো না? বাকি সবার মত তুমিও কি এটাই ভাবছো আমি প্র’তা’র’ক?”
কথাটা শুনে চৈতির মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে আসে। সে খুঁজে পায় না কোন মুভি থেকে এসব বস্তাপঁচা ডায়লগ তুলে আনছে নয়ন। আড়চোখে একবার নয়নের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রাণের দিকে তাকায় সে। প্রাণ মন্থর কন্ঠে বলে, “নিজের অভিনয়টা এবার বন্ধ করবে? বোকা নই আমি নয়ন। আর ভুলে যেও না, তুমি যেই ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিলং কর আমিও করি। তাই কোনটা মিথ্যে-বানোয়াট আর কোনটা সত্য তার জ্ঞান আমার ভালোই আছে।”
নয়ন নিবিড় চোখে প্রাণের দিকে। সে যে প্রাণকে জানতো সে ছিল অত্যন্ত নাজুক ও অন্তর্মুখী। কঠিনতা তার মধ্যে ছিল না বিন্দুমাত্র। কোন দূ’র্ঘ’ট’না, প্র’তা’র’ণা, বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা সে নিতে পারতো না। এতটাই দুর্বল মনমানসিকতা ছিল তার। ভে’ঙে পড়তো অথবা চেপে যেত সবটা নিজের মধ্যে। অথচ আজ প্রাণের দৃঢ়তা তাকে হ্রা’স করছে। শীতল কন্ঠ কিন্তু তেজে পরিপূর্ণ। দৃষ্টিতে নেই কোন দুর্বলতা, আছে শুধু কঠোরতা। এ যেন নতুন কেউ। যার সামনে নয়ন তুচ্ছ বস্তু মাত্র। নয়ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “ভুল বুঝছো তুমি। জেসিকার সাথে আমার কিছুই নেই।”
প্রাণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “প্রমাণ যেখানে চোখের সামনে সেখানে ভুল বুঝাবুঝির প্রশ্ন আসে না। আর ভুল যখন করেছ তখন সে-টা মানতেও শিখো।”
“আমি যেখানে কোন ভুলই করিনি সেখানে কি মানব?”
প্রাণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, “ঠিক তুমি ভুল করনি। করেছি আমি। তাই ভুলটা শুধরেও নিচ্ছি আমি।”
নয়ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
প্রাণ চৈতিকে ডেকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝাতেই চৈতি নিজের জায়গায় ছেড়ে উঠে পড়ে৷ ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার হাতরে একটা আংটি বের করে প্রাণকে এগিয়ে দেয়। নয়ন যে আসবে তা প্রাণ জানতো তাই আগে ভাগেই চৈতিকে বলে রেখেছিল সে সবটা। প্রাণ চৈতির থেকে আংটিটা নিয়ে সে-টা নয়নের হাতে দিয়ে বলে, “আ’ম ব্রেকিং আপ আওয়ার এনগেজমেন্ট।”
নয়নের মাথায় এবার আকাশ ভে’ঙে পড়লো। সে বিহ্বল কন্ঠে বলে, “এমনটা তুমি করতে পারো না প্রাণ। আর বললেই আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় না।”
“কি হয় আর না হয় তা পরবর্তীতে দেখা যাবে।”
নয়ন এবার উঠে প্রাণ কাঁধ চেপে ধরে বজ্রকন্ঠে বলে, “না! এসব মানি না আমি। তুমি আমার বুঝেছ? আমি তোমাকে আমাদের সম্পর্কে ভা’ঙ’তে দিব না।”
প্রাণ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে, “রাখতে হলে, থাকতে জানতে হয় নয়ন।”
প্রাণের কথা শুনে নয়ন এবার পুরোপুরি নীরব হয়ে যায়।প্রাণের কাঁধ ছেড়ে দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়৷ প্রাণ দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে বলে, “আপাতত তুমি আসতে পারো। তোমার চেহেরা দেখতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। ভাবতেই অবাক লাগে আমার চয়েস এত থার্ড ক্লাস ছিল।”
প্রাণের শেষ উক্তিটি শুনে নয়ন স্থির হয়ে যায়। টনক নাড়ে গতরাতে বলা তার কথাটি। তাহলে কি প্রাণ তখন সজাগ থেকে তার আর জেসিকার সম্পূর্ণ করাই শুনেছিল? সে দৃষ্টি বড় বড় করে বলে, “তুমি সব জানো?”
প্রাণ না জানা ভাণ করে বলে, “কি জানব?”
নয়ন দমে যায় এবার, “নাহ! কিছু না।”
“তুমি নিজ থেকে যাবে না-কি গার্ড ডাকাব আমি?”
নয়ন এবার তর্কে জড়ালো না। শান্ত কন্ঠে বলল, “কাউকে ডাকার প্রয়োজন নেই তোমার,যাচ্ছি আমি।”
কথাটা বলে নয়ন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না, গটগট করে বেড়িয়ে যায়। নয়ন যেতেই দরজার পাশ থেকে বেড়িয়ে আসেন আশা বেগম। তিনি এতক্ষণ সবই শুনছিলেন। তার ভয় ছিল প্রাণ হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে কিন্তু না প্রাণকে অনড় ছিল। এবারের ধাক্কা আসলেই তার মনোবল দৃঢ় করে দিয়েছে। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যান।
.
প্রাণ আঁখিপল্লব এক করে পিছনের দিকে মাথা হেলিয়ে দেয়। তার এখন ভারমুক্ত লাগছে, অবশেষে মিথ্যে সব সম্পর্ক মুক্তি পেল সে। পাশে চৈতি ল্যাপটপ নিয়ে বসে বিরবির করে বললো, “যেই না চেহারা তার নাম আবার পেয়ারা। কি দেখে যে এই নমুনারে অভিনেতা বানিয়েছে আল্লাহ জানে, এর চেয়ে আমাদের শাবানা ম্যামও হাজার গুণ ভালো এক্টিং করতো। হুহ!”
চৈতি কথা কর্ণগোচর হতে প্রাণ স্মিত হাসে। মেয়েটা মাঝে মধ্যে এমন এমন কথা বলে যে না হেসে থাকাই যায় না।
_________
একদিন পার হতে না হতেই জেসিকা আর নয়নের অবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছে। চারদিক থেকে তাদের মুখে চু’ন’কা’লি মেখে চলেছে নেটিজেনরা। হাজার হাজার মিমস বের হয়ে গিয়েছে তাদের নিয়ে। জেসিকার ক্যারিয়ার ইতোমধ্যে শেষ হতে শুরু করে দিয়েছে। তার হাতে যা অফার ছিল সব আস্তে আস্তে নাই হতে শুরু করেছে। আর হবেই না কেন? নিহাল শিকদারের মেয়েকে অসন্তুষ্ট করা হয়েছে, তার মানে সে এখন তাদের শ’ত্রু। আর জেসিকাকে কাজে রাখা মানে তাদের জন্য হুমকি স্বরূপ। কেন না, নিহাল শিকদারের সম্পর্কে কম বেশি সকলের ধারণা আছে। তার কাছে নিজের সম্মান সবার উর্ধ্বে, ফলে যে তার সম্মানে আঘাত হানার চেষ্টা করে তাকে সে ভুলেও ছেড়ে দেন না। তাই আগেভাগেই সকলে সড়ে আসছে।
দুদিন যেতে না যেতেই নতুন একটি নিউজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে। হেডলাইন হয় এমন, “কাজ পেতে নিজেকে বিকিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি আলোচিত নায়িকা জেসিকা আনান। রাত কাটিয়েছেন স্বনামধন্য কোন এক ডিরেক্টরের সঙ্গে।”
মূলত জেসিকার আপত্তিকর ছবি বের হয়েছে অন্য এক ডিরেক্টরের সাথে। যদিও ডিরেক্টরটা কে তা বুঝা যায়নি, তার মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তবে তা যে নয়ন ছিল না তা এক দেখায় বুঝে গিয়েছিল সকলে। এবার নেটিজেনরা ক্ষেপে উঠে আরও৷ সমানতালে হ্যা’রা’স করে চলেছে জেসিকাকে, বাসা থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে তার। সে সাথে উঠে পড়ে লেগেছে পরবর্তী ছবিতে মানুষটাকে। এবার জেসিকার হাতে যাও কাজ ছিল সব একবারে নাই হয়ে যায়। কোম্পানির ম্যানেজাররা আর ডিরেক্টররা নিজেদের সম্মানের ভয়ে আগেভাগেই পিছিয়ে যায়। কখন কার উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় কে জানে? স্বাদে কি আর কেউ কুয়াতে ঝাঁপ দিবে নাকি? জেসিকা এখন করুণ অবস্থা। তার ক্যারিয়ার যে পুরোপুরি শেষ তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সব বুঝে উঠতে পেরে উন্মাদ হয়ে পড়ে সে। নয়নকে যাও শেষ সম্বল বানাতে চেয়েছিল তাও পরের নিউজটি আসায় আর হয়ে উঠলো না। নয়ন তাকে তার নাম্বার থেকে শুরু করে সকল যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্ল’ক করে দিয়েছে৷ সকল ধরনের সম্পর্ক ছি’ন্ন করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি সকল নিউজ দেখে তার বাবা-মাও তাকে ত্যা’জ্য করে দিয়েছে। এখন জেসিকা একবারেই নিঃস্ব, তার যাওয়ার মত কোন জায়গায় নেই। নিজেকে একপ্রকার গৃহবন্দী করে নিয়েছে সে। কেমন আছে, কি করছে কোন খবর নেই কারো কাছে।
এদিকে এসবই ছিল প্রাণের চাল। সেই চৈতিকে দিয়ে রবিন কর্মকার আর জেসিকার ছবি পুনরায় সকল নিউজ এজেন্সিতে পাঠিয়েছিল। তথাপি আগেরবার রবিনকে সে কথা দিয়েছিল তার ছবি সে বের হতে দিবে না, তাই চেহেরাটা গোপন রাখা তার। এভাবেও তার সাথে রবিনের কোন ধরনের শ’ক্র’তা নেই। বাদ বাকি জেসিকার পরিনতি নিয়ে সে যেমনটা ভেবেছিল ঠিক তেমনটাই হচ্ছে। এখন শুধু আরেকটা চাল বাকি, অতঃপর সবকিছুর সমাপ্তি৷
___________
প্রাণের শরীর তখনও পুরোপুরি ঠিক না হওয়া আশা বেগম তাকে বাসা থেকে বের হতে দেননি। উপরন্তু, কয়েকদিনের মাঝেই প্রাণকে নিয়ে নিহাল শিকদারেরও কিছু এনাউন্সমেন্ট করার আছে, তাই প্রাণও আর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। আশা বেগমের কথায় রাজি হয়ে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে৷
অবসর সময়ে বিছানায় শুয়ে প্রাণ টিভিতে নেটফ্লিক্স দেখছিল, পাশ্চাত্য মুভি। ক্যাটাগরি সাসপেন্স আর থ্রিলার। ছোট থেকেই এমন ধরনের মুভি আর বই তার ভীষণ প্রিয়। ক্লাস টেনে থাকতে ফ্যান্টাসি, সাসপেন্স,থ্রিলার টাইপ অনেক বই পড়তো। বলতে ফেলুদা সমগ্র, শার্লক হোমস সমগ্র,হ্যারি পটার,মাসুদ রানা,কিশোর,ড্যান ব্রাউন, জেমস্ বন্ড, দ্যা মিজারেবল কোনটাই বাদ রাখেনি সে। এতটাই পাগল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অভ্যাসটা কিভাবে যেন ছুটে গেল। ব্যস্ততা বেড়ে গেল তার জীবনে, উথাল-পাথাল হলো সব, হারিয়ে গেল তার মাঝ থেকে চঞ্চল প্রাণটা, বিষণ্ণতাই হলো তার সঙ্গী। শুধু পুরনো অভ্যাসের মধ্যে মুভি দেখাটা থেকে গেল।
মুভিতে যখন টানটান উত্তেজনা তখনই ঘর কাঁপিয়ে তার ফোনটা বেজে উঠলো। প্রাণ নিজের অভিনিবেশ নষ্ট করতে চাইলো না বিধায় ফোনটা বাজতে দিল। কিন্তু ফোনটা থেমে থেমে বেজেই চলেছে, থামাথামির কোন নাম গন্ধ নেই। প্রাণ এবার না পেরে একরাশ বিরক্তির সহিত ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিল। অপরপাশ থেকে সালামের উত্তর দিয়ে বলে উঠে, “আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি ছন্দ বলছিলাম।”
প্রাণের স্মিথ কন্ঠে বলে, “জি পেরেছি। বলুন।”
ছন্দ প্রসন্ন কন্ঠে বলে, “কেমন আছেন মিস. ল্যাভেন্ডার? শরীর ঠিক এখন আপনার?”
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আ’ম ফাইন মি. তুরহান।”
ছন্দ কিছুটা সময় নিয়ে বলে, “আপনি কি জানেন, আ’ম ফাইন ইজ নেভার ফাইন। ”
#চলবে
##প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৭
প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আ’ম ফাইন মি. তুরহান।”
ছন্দ কিছুটা সময় নিয়ে বলে, “আপনি কি জানেন, আ’ম ফাইন ইজ নেভার ফাইন?”
প্রাণ স্মিত হেসে বলে, “কি জানি!”
“তাহলে মানছেন, ইউ আর নট ফাইন?”
“কি শুনতে চাইছেন? হ্যাঁ নাকি না?”
“আপনি যেটা বলবেন সেটাই।”
প্রান প্রত্যুত্তর করল না। নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো পর্দায় ভাসতে থাকা চলন্ত ছবির দিকে, নৃ’শং’স এক মৃ’ত্যু’র দৃশ্য চলছে তাতে। ভ’য়ং’ক’র সেই দৃশ্যটি দেখে যে কারোই লোম দাঁড়িয়ে উঠবো অথচ প্রাণের অভিব্যক্তি শিথিল্য। দৃষ্টি দৃঢ়। মনের মাঝে ঘুরঘুর করছে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ইচ্ছে। এদিকে প্রাণের কোন উত্তর না পেয়ে ছন্দ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। মেয়েটা যে নিজের সম্পর্কে কাউকে অবগত করতে নারাজ তা এ কয়েকদিনে বেশ বুঝেছে সে। দুই পাশে বেমানান নিস্তব্ধতা বিদ্যমান। শব্দ সব নিরুদ্দেশ যেন। কিয়ৎক্ষণ পর প্রাণ নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো যে? কোন দরকার ছিল?”
ছন্দ বলে, “না এভাবেই! জানার ইচ্ছে ছিল আপনার শরীর এখন কেমন, তাই ফোন করা। কেন দরকার ব্যতীত কি আপনাকে ফোন দেওয়া নিষেধ?”
“নিষেধ না৷”
ছন্দের কৌতূহলপূর্ণ কন্ঠ, “তাহলে কি?”
প্রাণ নিশ্চুপ থেকে বলে, “দরকার ব্যতীত কেউ কখনো ফোন করেনি আমায়। তাই!”
কথাটার গভীরতা বুঝতে পেরে ছন্দ বাক্যহীন৷ প্রত্যুত্তরে করার মত কোন কিছু পেল না। তবে তার কিছু বলার পূর্বেই প্রাণ পুনরায় বলে, “যাই হোক, আপনি ফোন করে ভালোই করেছেন। এমনেও যোগাযোগ করতাম আমি।”
ছন্দ থমকায়, “কেন?”
প্রাণ কোন ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করে, “জিজ্ঞেস করার ছিল, এর মধ্যে ফ্রি আছেন কি-না?”
ছন্দ ভড়কে যায়। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে ক্ষণেই, “জি?”
“এর মধ্যে কি ফ্রি আছেন?”
ছন্দ ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “হ্যাঁ কাল সন্ধ্যায় আছি। কিন্তু কেন?”
“দেখা করতে পারবেন?”
ছন্দ স্তব্ধ হলো। একবার ভাবলো ভুল শুনেছে, প্রাণ তাকে দেখা করতে বলেছে? এ আদৌ সত্য? আকস্মিক এরূপ অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে তা কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো তার নিজেকে ধাতস্থ করতে। অতঃপর বলল, “হ্যাঁ! পারবো না কেন?”
“ওকে দ্যান! আমি পরে জায়গার নাম, সময় আপনাকে টেক্সটে জানিয়ে দিব।”
ছন্দের ইচ্ছে করলো জানতে প্রাণ হঠাৎ দেখা করতে চাইছে কেন? তবে নিজেকে সামলে বলে, “আচ্ছা।”
__________
সর্বদা সাজানো-গোছানো কক্ষটার আজ বেহাল দশা। সুবিন্যস্তভাবে ভাঁজে ভাঁজে রাখা কাপড়-চোপড় সব উলোটপালোট, বিছানার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কিছু। কিনারে রাখা বিন ব্যাগ চেয়ারে জিহান বসে, বিরক্তিকর চাহনি তার ছন্দের উপর নিবদ্ধ। ছন্দ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরোক্ষ করতে ব্যস্ত। জিহান ভেবে কূল পাচ্ছে না ছেলেটার আজ হলো কি? হঠাৎ নিজেকে নিয়ে এত পড়েছে কেন? সবসময় পরিপাটি থাকা ছেলেটা আজ অগোছালো, বিষয়টা কোনভাবেই হজম হচ্ছে না তার। ছন্দ এবার জিহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “এটা কি মানাচ্ছে আমায়? বেশি কালো লাগছে না? চেঞ্জ করব?”
জিহান মুখ খিঁচে বলে, “মেয়েদের মত ন্যাকামি করা বন্ধ করবি? এই নিয়ে সাতটা শার্ট চেঞ্জ করলি আর কত? মানে ভাই! এতবার চেঞ্জ তো আমি শুট চলাকালীনও করি না।”
ছন্দ শ্লথ কন্ঠে বলে, “বেশি কথা বলিস না নাহলে মিশার সামনে যদি আমি একবার মুখ খুলি না, তখন কিন্তু কেঁদেও নিস্তার পাবি না।”
জিহান নিজের কপাল চাপড়ে বলে, “তোর মত বন্ধু থাকার চেয়ে শক্র থাকাও ভালো। শা* বা’ট’পা’র একটা। অন্যের সংসারে আ’গু’ন লাগাতে চাস।”
ছন্দ জিহানের কথা সম্পূর্ণ অনাগ্রহ করে পুনরায় আরেকটা শার্ট নিয়ে চেঞ্জ করলো। শ্যামবর্ণ চেহেরার সাথে এবার ওশান ব্লু শার্টটা মানিয়েছে বেশ। ছন্দ নিজেকে এক পলক দেখে পিছন দিকে ঘুরতেই জিহান বলে উঠে, “এটায় ভাই আসলে তোকে মানাচ্ছে। আর চেঞ্জ করিস না, দোহাই লাগে।”
জিহানের কথায় ছন্দ অপ্রসন্ন হলো বলে মনে হলো না। তারও লাগছে শার্টটায় তাকে ভালো দেখাচ্ছে। জিহান এবার জিজ্ঞেস করে উঠে, “তবে এত ফিটফাট হয়ে যাচ্ছিস কোথায়?”
ছন্দ এক মুহূর্ত থমকে বলে, “মিটিং আছে একটা।”
জিহান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু ভাব-সাব দেখে লাগছে কার সাথে না জানি ডেটে যাচ্ছিস। তা ক্যাপ্টেন সাহেব সত্যি যাচ্ছেন না-কি?”
ছন্দ গা ছাড়াভাব নিয়ে বলে, “বাজে না বকে নিজের কাজ কর যা।”
জিহান ভাবুক ভঙ্গিতে বলে, “কুচ তো গারবার হ্যায় দেয়া। কুচ তো গারবার…”
ছন্দ ডেসিং টেবিলের উপর রাখা চিরুনিটা জিহানের দিকে ছুঁ’ড়ে দিয়ে বলে, “শা* তোর মধ্যে গারবার আছে, আমার মধ্যে না।”
“খুব জানোস তুই তাই না? রাতে ছিলি নাকি আমার সাথে?”
ছন্দ আড়চোখে তাকিয়ে বলে, “আমি থাকতে যাব কেন? মিশাকে জিজ্ঞেস করলেই সব স্বচ্ছ পানির মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
ছন্দের কথায় জিহান ফুঁসে উঠে। ছন্দের সাথে কিছুক্ষণ গ’লা’বা’জি করে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। জিহান রুম থেকে বেরুতেই ছন্দ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। জিহানকে রুম থেকে বের করার প্ল্যান তার সফল হয়েছে। আনমনে একবার জিহানের কথাগুলো আওড়ে ভাবে আসলেই সে এত তোড়জোড় লাগিয়েছে কেন? সে তো ডেটে যাচ্ছে না, তাহলে? এরকম হাজার প্রশ্নের সমোরোহ তার মনে তবে উত্তর নেই কোন।
__________
তিন তারকা এক রেস্টুরেন্টের মুখোমুখি হয়ে বসে আছে প্রাণ ও ছন্দ। মোলায়েম আলোয় তাদের টেবিল একদম কিনারে হওয়ায় তাদের সনাক্ত করা দুরূহ। কিছুক্ষণ আগেই ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গিয়েছে। এরপর থেকেই চলছে নিস্তব্ধতার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। নীরবতা ভাঙতে ছন্দ জিজ্ঞেস করে উঠে, “যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“জি বলুন।”
“আপনি কি আগেই জানতেন নয়ন আপনার ফ্রেন্ডের সাথে মিলে আপনাকে ঠ’কা’চ্ছে?”
প্রাণ দৃষ্টি তুলে বলল, “জানতাম।”
ছন্দ গোলগোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তার মানে…”
ছন্দকের সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করতে না দিয়ে প্রাণ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল, “যা ভাবছেন তাই।”
ছন্দ থমকায়, সে সাথে কিছুটা প্রসন্নও হয় প্রাণের দৃঢ়তা দেখে। ছন্দ জিজ্ঞেস করে, “ইম্প্রেসিভ! তবে একা এসব কিভাবে?”
প্রাণ মৌন থাকলো। প্রাণ উত্তর দিতে চাইছেন না বুঝে ছন্দ আরেক প্রশ্ন তার দিকে ছুঁ’ড়ে দেয়, “আচ্ছা, একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। সেদিন রাতে তারা আপনার সাথে করতে চাইছিলটা কি? আন্টি আর আপনার এসিস্ট্যান্টের কথা শুনে যা বুঝেছি সবকিছুর পিছনে তারাই ছিল। আর সে-টা আপনারা ভালো করেই জানতেন।”
প্রাণ তখনও নীরব। ছন্দ তা দেখে বলে “সমস্যা হলে বলার প্রয়োজন নেই। তাদের কথা শুনে কৌতূহল ছিল বিধায় জিজ্ঞেস করা, অন্য কোন অর্থে না।”
প্রাণ এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা বিস্তারিত জানায়। কেন না, এই বিষয় সম্পর্কে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই, ছন্দ সেদিন তাকে বাঁচিয়েছে। পুরো ঘটনা জানার অধিকার রাখে সে। সব শুনে ছন্দ বিস্ময়ের সহিত বলে, “মানুষ এতটাও নিচ হতে পারে? মানে ভাষা নেই আমার। আ’ম টোটালি স্পিচলেস।”
প্রাণ স্মিত হেসে বলে, “এই পৃথিবীর চরম সত্য কি জানেন? যে আপনার নিকট প্রিয়তম প্রিয়জন, তার নিকট আপনি কেবল অপ্রয়োজন।”
ছন্দ কিছু বলার আগেই ওয়েটার এসে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে যায়। কথাটা সেখানেই চাপা দিয়ে প্রাণ ছন্দকে খেতে বলে নিজেও খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার ফাঁকে প্রাণ বলে উঠলো, “আপনার ব্যাংক একাউন্টের ডিটেইলসটা আমার একটু দরকার ছিল।”
প্রাণের কথা শুনে ছন্দের বুঝতে দেরি নেই প্রাণ আজ তাকে কেন দেখা করতে ডাক দিয়েছে। সে রাতের সকল হিসাবের নিষ্পত্তি করতে চাইছে সে। ছন্দ তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য সংশয়িত কন্ঠে বলে, “এই জন্যই কি আমাকে আজ ডেকেছেন আপনি? সকল হিসাব চুকিয়ে ফেলতে?”
প্রাণ বলে, “ঋণী থাকাটা আমার পছন্দ নয় মি.তুরহান।”
ছন্দ হেসে বলে, “এখন আমি যদি ডিটেইলস দিতে রাজি না হই? কি করবেন আপনি?”
প্রাণ দৃষ্টি সরু করে জিজ্ঞেস করে, “না দেওয়ার কারণ?”
ছন্দ ভাবান্তরহীন কন্ঠে বলে, “আপনাকে আজীবন ঋণী রাখার পরিকল্পনা আমার।”
প্রাণ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ছন্দ হেসে বলে, “জাস্ট জোকিং! তবে এটা সত্য আমি আপনাকে কোন ডিটেইলস দিচ্ছি না।”
প্রাণ এবার বিরক্ত হয়ে বলে, “মানে কি?”
“ইন শর্ট, আমার কম্পেন্সেট হিসাবে টাকা না অন্যকিছু চাই৷”
“আর সে-টা কি?”
ছন্দ খাওয়ায় অভিনিবেশ স্থাপন করে বলে, “সময় হোক, সুদ-আসলসহ সে-টা চেয়ে নিব আমি। তখন কিন্তু আপনি না করতে পারবেন না মিস. ল্যাভেন্ডার।”
প্রাণ অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ছন্দ এবার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে প্রাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “দেখেন তো, এটা আপনার কি-না?”
প্রাণ ছন্দের হাতের দিকে নজর বুলাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কথার খেই হারিয়ে নিশ্চল, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শুধু।
#চলবে