#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৪
আঁধার নিমজ্জিত কক্ষে স্বল্প আলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শৈথিল্য আবহাওয়া। বিছানার উপর অচৈ’ত’ন্য, নি’স্তে’জ অবস্থায় পড়ে আছে প্রাণ। হুশ নেই তার কোন। কক্ষে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান হওয়ায় দুই নর-নারীর ফিসফিসানি ধ্বনি পরিস্ফুট। কন্ঠস্বর দুটি বার বার প্রাণের কর্ণকুহরে বারি থেকেই ধীরে ধীরে বোধশক্তি ফিরে পেতে শুরু করে সে। আধনিভন্ত দৃষ্টিতে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করার দুরূহ চেষ্টা। অকস্মাৎ প্রাণ নয়নের ক্রোধান্বিত কন্ঠ শুনতে পায়। নয়ন বলছে, “এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না জেসিকা? কথা কিন্তু এটা ছিল না আমাদের।”
জেসিকা বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে, “তুমি এত রিয়্যাক্ট করছো কেন? খারাপ কি বলেছি আমি?”
“রিয়্যাক্ট করবো না তো কি? কথা ছিল প্রাণ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পেপারে ওর থেকে সিগনেচার নিব এবং পরবর্তীতে যখন আমার ওর বিয়ে হবে তখন পেপারগুলো সাবমিট করে ওর সকল সম্পত্তি আমি আমার নামে করে নিব। আর ধীরে ধীরে ওকে মানসিক রোগী প্রমাণিত করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরিয়ে আনব সাথে তোমার জায়গায় পরিপক্ব করে দিব। এরপর ওকে আজীবনের জন্য কোন এক এসাইলামে ভর্তি করে নিজেও বিয়ের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসব। সেখানে এখন তুমি পুরো প্ল্যান পাল্টে কি করতে চাইছো? প্রাণকে সঁপে দিতে চাইছো কোন এক ডিরেক্টরের হাতে? মাথা গিয়েছে না-কি তোমার?”
জেসিকা আশ্বস্ত কন্ঠে বলে, “বিশ্বাস কর আমার এই প্ল্যান আগেটার চেয়েও দ্বিগুণ ভালো৷ এতে জল তোমাদের বিয়ে পর্যন্ত গড়াবেই না।”
নয়ন বিক্ষুব্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তাই! শুনি তোমার প্ল্যান কি? চাইছো কি করতে?”
“এখন প্রাণকে দিয়ে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পেপারে সাইন করিয়ে নিয়ে ওকে আমি এবারের অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের বিচারক মি. মাহমুদের নিকট সঁপে দিয়ে যাব। অতঃপর যা করার তিনিই করবেন। আর কাল সকাল হতে না হতেই রিপোর্টারদের এখানে হাজির করাব আমি। তখন আপনা-আপনি হেডলাইন এটাই হয়ে যাবে যে, নিজেকে বিকিয়েই প্রাণ সেরা অভিনেত্রীর খেতাব অর্জন করেছে। তার নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেনি। সব অ্যাওয়ার্ড তখন এভাবেই হাতছাড়া হয়ে যাবে তার কাছ থেকে। অপদস্ত হবে সকল জায়গায়। ধুলোয় মিশে যাবে প্রাণের নাম,ক্যারিয়ার। ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যাবে এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকেও। এরপর সব খ্যাতি, সুনাম পাবো আমি। আর ওইসময় তুমিও প্রাণের চরিত্রের উপর সহজেই প্রশ্ন তুলে সম্পর্ক ভেঙে বেড়িয়ে আসতে পারবে সে সাথে অ্যাটর্নির পেপারও প্রোসেস করিয়ে সব নিজের নামে করতে পারবে। প্রাণ তখন তোমার উপর মামলা করলেও তুমি সকলকে ছুতো দিতে পারবে প্রাণ সব হারিয়ে এখন তোমাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে, নিজের সম্মান ফিরে পেতে তোমাকে ব্যবহার করার ফন্দি আঁটছে তাই এসব গুজব ছড়াচ্ছে।”
নয়ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “আর নিহাল শিকদার সব চুপচাপ বসে দেখবেন বলে তোমার মনে হয়? নিজের মেয়েকে ডিফেন্ড করবেন না তিনি?”
জেসিকা বলে, “প্রাণের সাথে থেকে এতদিনে যা বুঝেছি প্রাণকে নিহাল শিকদারের তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। নিজের স্বার্থের জন্যই তিনি প্রাণকে ব্যবহার করছেন। উপরন্তু তিনি নিজের সম্মানের উপরে কিছু দেখেন না। তো স্বাভাবিকভাবে প্রাণের এমন স্ক্যান্ডাল বের হলে তিনি স্বভাবসুলভ মুখ ঘুরিয়েই নিবেন, এগিয়ে আসবেন না। সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবেন।”
নয়ন একপলক প্রাণের দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্ত কন্ঠে বলে, “এমন না করলে কি হয় না?”
জেসিকা এবার ক্রোধানল দৃষ্টি নয়নের উপর স্থির করে বলে, “তোমার এত দরদ উথলিয়ে পড়ছে কেন ওর জন্য? ভালোবাসতে শুরু করলে না-কি ওকে?”
নয়ন প্রত্যুত্তর না করে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় প্রাণের নিষ্পাপ মুখ পাণে। সে প্রাণের সাথে মিশেছিল একমাত্র প্রাণ নিহাল শিকদারের মেয়ে বলে। নিজের পাবলিসিটি বাড়াতে এবং নিহাল শিকদারের চোখে পড়ে বড় বড় কাজ হাতিয়ে নিতে, বা বলা চলে প্রাণকে ব্যবহার করে সফলতার সিড়ি চড়তে চেয়েছিল। আর তাতে সে সফলও হয়েছে। এ ক্লাস অ্যাক্টরের তালিকা নিজের নাম লিখিয়েছে। অতঃপর প্রাণের সাথে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর যখন প্রাণ নিজেকে গুটিয়ে চলতো, নয়নকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিত না তখন সে জেসিকাতে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার নজর আবার প্রাণের সম্পত্তির উপর ছিল বিধায় প্রাণকে সে ছাড়তে পারছিল না৷ নয়নের বাবাও প্রাণকে তার সম্পত্তির জন্যই নিজের ঘরের পুত্রবধূ করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। করিয়ে দেন তাদের এনগেজমেন্ট। সে সাথে নয়নকেও বিশেষভাবে বলে দেন প্রাণের খেয়াল রাখতে, তাকে নারাজ না করতে। নয়নও সেই কথা অনুযায়ী চলে আসছে।
যদিও এটা সত্য সে সবকিছুই করছিল নিজের স্বার্থের জন্য কিন্তু তবুও সে কখনো প্রাণের ক্ষতি বা সম্মানহানি করতে চায়নি। ভালোয় ভালোয় নিজের কাজ আদায় করে প্রাণকে বিদায় করতে চেয়েছিল সে, তাই তো জেসিকার সাথে মিলে প্রথম পরিকল্পনাটি সাজিয়েছিল তবে এখন পুরো কাহিনীটাই ভিন্নরূপ ধারণ করতে দেখে দ্বিধায় ভুগছে সে। নয়নকে কিছু বলতে না দেখে জেসিকা চেঁচিয়ে উঠে, “কথা বলছ না কেন? সত্যি কি তুমি ভালোবাসতে শুরু করেছ ওকে?”
নয়ন জেসিকার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য সহিত বলে, “নয়নের চয়েস এত থার্ড ক্লাস না জানোই। আর এমনেও ও আমার টাইপের না, সো ভালোবাসার প্রশ্নই আসে না। তবে বিষয়টা অন্যরকম। আমার মন সাঁয় দিচ্ছে না।”
জেসিকা এবার ন্যাকা কন্ঠে বলে, “আর ও যে আমার সাথে অন্যায় করেছে? পদে পদে নিচু করেছে? আমার সব ছি’নি’য়ে নিয়েছে? তার বেলায় কিছু না? একমাত্র ওর জন্য আমার ক্যারিয়ার এখনো এগুতে পারছি না। তাই এখন যা হচ্ছে বা হবে সবই প্রাণের প্রাপ্য। ভুল নেই তাতে। তুমি এবার ওর পক্ষ নেওয়া বন্ধ কর।”
জেসিকার কথার প্রেক্ষিতে নয়ন কথা বলার মত আর কিছু পেল না। আর জেসিকা ঠিক এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে বো’কা পুরুষটিকে ভুলিয়ে নিজের পক্ষ করে নিল। অতঃপর নিজের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে দরজা ভিড়িয়ে দুইজনই বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। চলে গেল নিচে, লাউঞ্জের দিকে।
এদিকে এতক্ষণ সবটাই দাঁতে দাঁত চেপে শুনছিল প্রাণ। তাদের কথা শুনে ঘৃ’ণায়,বিতৃষ্ণায় তার গা ঘুলিয়ে আসছে। কতটা নিচু নামলে মানুষ প’শু’তে পরিণত হয়ে যেতে পারে তা হয়তো এদের না দেখলে বুঝাই যাবে না। নিজের উপর সীমাহীন রা’গ হচ্ছে প্রাণের, এতটা বছর তাদের উপর অন্ধের মত বিশ্বাস করে আসার জন্য। বুঝতে কেন এত দেরি করে ফেললো, আপনজন হতে এই পৃথিবীতে কেউ আসে, সব আসে নিজ নিজ স্বার্থের টানে৷
প্রাণ নিজের মন-মস্তিক শান্ত করে উঠে বসার সর্বস্ব চেষ্টা করলো। কিন্তু আফসোস পারলো না। তার শরীর তুলনামূলক অনেক বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে, মাথা তুলবারও শক্তি আর তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই যেন। তাকে কি খাওয়ানো হয়েছে কে জানে? প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জামার পকেট হাতড়ে ফোন বের করার চেষ্টা করলো। ভাগ্যক্রমে আজ এই পোশাকটা পরিধান করেছিল বলে নাহলে হয়তো ফোনটা তার সাথে সাথে রাখা সম্ভব হতো না, আর না লোকেশন অন রাখতে, না কলে কাউকে এতটা সময় হোল্ড করে রাখতে। যদিও কল কেটে গিয়েছে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পকেট হাতড়ে ফোন বের করার এক পর্যায় অকস্মাৎ দরজা খোলার আওয়াজ কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাতেই প্রাণ স্থির হয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ আঁখিপল্লব বুজে ফেলে। পায়ের পদধ্বনি শুনে বুঝতে দেরি নেই রুমে কেউ প্রবেশ করেছে কিন্তু কে বুঝে উঠার জন্য কান পেতে রইলো প্রাণ। কিয়ৎক্ষণ না পেরুতেই এক মেয়েলি কন্ঠে ডাক শুনতে পেল সে, “ম্যাম উঠুন! আপনি ঠিক আছেন? ম্যাম!”
চৈতির কন্ঠ সনাক্ত করতে পেরে প্রাণ চোখ খুলে তাকায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আড়ষ্ট কন্ঠে বলে, “পা..নি!”
চৈতি কথাটি বুঝতে পেরে দ্রুত পাশের টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটি তুলে নিল, প্রাণকে ধরে কোনরকম আধশোয়া করে বসিয়ে পানিটি পান করিয়ে দিল। পানি খেতে দিয়ে নিজেকে প্রায় ভিজিয়ে ফেললেও সবটুকু পানি শেষ করে দম নিল। এখন যেন একটু ভালো লাগছে তার। প্রাণ চৈতির দিকে তাকিয়ে শ্বাস টেনে টেনে বলল, “বে..র হব রুম থে..কে। জলদি!”
চৈতি বিনাবাক্যে প্রাণকে খুব কষ্টে নিজের উপর ভড় দিয়ে দাঁড় করায়। মন্থরগতিতেই তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। করিডরে আসতেই প্রাণ বলে উঠে, “রুম বুক করেছ না?”
চৈতি হাঁটতে হাঁটতে বলে, “হ্যাঁ করেছি ম্যাম। বাট আপনি সব জেনেও কেন তাদের ফাঁ’দে পা দিতে গেলেন বলুন তো? এটা কতটা রিস্কি ছিল জানেন? যদি আপনার কিছু হয়ে যেত?”
প্রাণ শ্লেষের হাসি হেসে জড়ানো কন্ঠে বলে, “কি হত? প্রাণ যেত, মুক্তি পেতাম এসব মিথ্যে মোহ-মায়া থেকে। তবে দেখার ইচ্ছে ছিল মানুষ রূপী প’শুগুলো ঠিক কত নিচে নামতে পারে। তাই রিক্সটা না নিয়ে পারলাম না।”
চৈতি জানে প্রাণ সকলের ভাবনা থেকে দুই কদম এগিয়ে চলে, তবে আজকে পদক্ষেপটা নেহাৎ ছেলেমানুষী লেগেছে তার কাছে। এভাবে নিজের জীবনে বা’জি লাগায় কেউ? হ্যাঁ, মানছে প্রাণ সকল ব্যবস্থা নিয়েই এসেছিল কিন্তু তবুও যদি কিছু হয়ে যেত? সে যদি ঠিকমতো নিজের কাজ করতে না পারতো, তখন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। এর মাঝে প্রাণ জিজ্ঞেস করে উঠে, “আ..র কত দূর?”
“এইতো ম্যাম এসে পড়েছি। আর একটু।”
“তাহলে চাবিটা আমাকে দিয়ে দাও, বাকি তোমাকে যে কাজটা দিয়েছি সে-টা পূরণ কর।”
চৈতি ক্ষীণ কন্ঠে বলে, “আমি আপনাকে রুমে দিয়ে তারপর না-হয় যাই?”
প্রাণ নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে বলে, “পারব আমি, চিন্তা কর না। তোমাকে দেওয়া কাজটা কর, আমি কিন্তু কোন ভুল চাই না।”
অগত্যা চৈতি প্রাণকে চাবিটি দিয়ে দিল এবং বলে দিল তিন রুম পরে বামদিকের রুমটি তার। প্রাণ মাথা দুলিয়ে সামনের দিকে এগুলো। প্রাণ রুমের কাছাকাছি না যাওয়ার আগ পর্যন্ত চৈতি দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলো। কিন্তু অকস্মাৎ প্রাণ পিছন ঘুরে চৈতির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে উচ্চকন্ঠে বলে, “যাওও!”
প্রাণের ধ’ম’ক শুনেই চৈতি দাঁড়ানোর সাহস পেল না। দ্রুত পিছন ঘুরে নিচে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো। চৈতি যেতেই প্রাণ বেসামাল পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে। হঠাৎ করেই তার মাথা বেশ ঘুরতে থাকে, শরীরের যাবতীয় শক্তি পুনরায় লোপ পেতে শুরু করে, পুনরায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। প্রাণ কোনরকম নির্ধারিত রুমের সামনে এসে লকের চাবি ঘুরাতে থাকে কিন্তু কোনভাবেই দরজা খুলতে পারেনা। একসময় জো’র’জ’ব’র’দ’স্তি করতে থাকে কিন্তু লাভ হয় না। ক্রমাগত তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে আসতে থাকে, পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু পাচ্ছে না সে। এই বুঝি এখনই পড়ে যাবে সে। শেষবারের মত নিজের শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো প্রাণ, এবার ফট করেই দরজাটা খুলে গেল। প্রাণ দিগ্বিদিক না তাকিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো। পরমুহূর্তেই সে কারো সুঠাম বুকে এসে বারি খেল। মাথা তুলে তাকাতেই চাইলো কিন্তু তার পূর্বেই মাথা ঘুরে উঠলো তার, আঁখিপল্লব জুড়ে ছেঁয়ে গেল অন্ধকার। দ্বিতীয়বারের মত সম্পূর্ণ অ’চৈ’ত’ন্য হয়ে হেলে পড়লো কারো বুকের মধ্যস্থলে। মানবটি দ্রুত প্রাণকে সামলে নিয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কিয়ৎক্ষণ অপলক প্রাণের দিকে তাকিয়ে থেকে মানবটি তার গালে হালকা চাপড় মেরে উৎকন্ঠিত কন্ঠে ডাকতে শুরু করলো, “মিস. ল্যাভেন্ডার আপনি ঠিক আছে? কি হয়েছে আপনার? এই যে মিস…..”
#চলবে
#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৫
নিশুতির মায়া জড়িয়ে নিষুপ্ত নগরী। আকাশটা আজ শূন্যতায় ভুগছে, তার সঙ্গী সব নিরুদ্দেশ বলে। সবুজ পাতার মাঝে হলুদ রঙের মাধুর্য, কদম। বৃষ্টিস্নাতের অপেক্ষায় চাতক নয়নে তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ অস্ফুট ধ্বনি তুলছে নিস্পন্দ কক্ষে, রুমে বসেই স্পষ্ট সে শব্দ শুনতে পারছে ছন্দ। বাথরুমের কোন একটি কল হয়তো খোলা তবে ছন্দের নিজ আসন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না বিন্দুমাত্র৷ তার মন-মস্তিক মগ্ন, দৃষ্টি আবদ্ধ বিছানার উপর শুয়ে থাকা মানবীটির দিকে৷ আবছা নীলাভ আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে যেন। গৌড়বর্ণ মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে আছে, টানা চোখের নিচে হালকা কালি, মেদুর গাল দুটো ও সরু নাকের মাথা ঈষৎ লাল, চিকন পাতলা অধরযুগল শুষ্ক,শী’র্ণ। মুক্ত চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বিছানা জুড়ে। অবস্থা এতই শো’চ’নীয় যে তাকে চেনা দুষ্কর। কে বলবে এই মেয়েটাই গ্ল্যামার ওয়ার্লের ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট ওয়ান্টেড বিউটির মধ্যে একজন, নুসাইবা আরা প্রাণ? কিন্তু তবুও অকৃত্রিম এক পবিত্রতা,স্বচ্ছতা,লাবণ্য খেলা করছে তার মধ্যে যা ছন্দকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে দিচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ এভাবেই অতিবাহিত হতে ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় টি-টেবিলের উপর রাখা চাবিটার দিকে। কি রিং-এর উপর সুব্যক্ত ‘9098’ নাম্বারটি। অথচ এই রুমটি হচ্ছে ‘9093’। প্রাণ যে ভুলবশত এই রুমে চলে এসে তা নিয়ে ছন্দের কোন সংশয় নেই। আজ এখানে তার বিসিবির এর ম্যানেজার শামীম আহসানের সাথে মিটিং ছিল, সেজন্যই এই হোটেলে আসা তার৷ আসন্ন ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে একান্ত কিছু কথাবার্তার ছিল বিধায় কয়েক ঘন্টার জন্য আলাদা রুম বুক করে নিয়েছিল সে। মিটিং শেষে শামীম বেরিয়ে যাওয়ার পর তার ফোন আসায় সে কথায় মশগুল হয়ে পড়ে। কথা শেষে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বের হতেই নিচ্ছিল এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে অস্বাভাবিক কিছু শব্দ শুনতে পায় সে। তাই এগিয়ে দরজা খুলে আর প্রাণকে এমতাবস্থায় আবিষ্কার করে। অতঃপর অনেকবার চেষ্টা করেছিল প্রাণের জ্ঞান ফেরানোর কিন্তু সফল হয়নি।
সে ভেবে পায় না প্রাণের হয়েছেটা কি? দেখে তো তাকে ড্রাংক মনে হচ্ছে কিন্তু তার জানা মতে প্রাণের কোনপ্রকার বদ অভ্যাস নেই৷ জিহানের মুখে শুনেছে সে, প্রাণের স্বভাব সম্পর্কে। তাই খটকা লাগছে। কেউ উল্টাপাল্টা করেনি তো তার সঙ্গে? তার জায়গায় যদি আজ এই রুমে অন্যকেউ হতো তখন কি হতো? সে কি আদৌ নিরাপদ থাকতে পারতো? আনমনে নিজেকে এমন হাজারটা প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ছন্দ তবুও উত্তর পায় না কোন। প্রাণ না উঠার আগপর্যন্ত পাবেও না বোধহয়। নিজের চুল পিছনের দিকে টেনে উঠে দাঁড়ায় ছন্দ, টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটা তুলে এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে ফেলে৷ প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করছে সে। কারণবিহীন। আকস্মিক কারো গো’ঙ্গা’নি শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকায় সে। বিছানার উপর প্রাণকে কাতরাতে দেখে দ্রুত সেদিক এগিয়ে যায় সে। ছন্দ প্রাণের সান্নিধ্যে এসে নিজের দিক ফিরিয়ে তার গালে হালকা চাপড় মেরে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে, চিন্তান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে বারংবার, “আপনি ঠিক আছেন? এমন করছেন কেন? কি সমস্যা হচ্ছে বলুন আমায়। প্রাণ শুনছেন?”
কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রাণ বমি করে দেয় তার উপর। সাথে র’ক্তও বেড়িয়ে আসছে। বমি করে ক্ষান্ত হতে না হতেই অস্বাভাবিক আচরণ করে সে, খিঁচুনি উঠেছে কি-না নিশ্চিত না। ঘটনাক্রমে ছন্দ কিছুক্ষণ বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় তাকিয়ে থেকে দ্রুত প্রাণকে জাগানোর চেষ্টা করে। তবে প্রাণের কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ছন্দের মধ্যে আশঙ্কা বাসা বাঁধে। সে দিগ্বিদিক চিন্তা না করে দ্রুত প্রাণকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে আসে। নিচে নেমে এসে গাড়িতে প্রাণকে সে তার পাশের সিটে বসে পড়ে নিজেও। মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক আর ক্যাপ পড়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করে সে। রাত তিনটার কাছাকাছি হওয়ায় তখন হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোর একদম নিস্তব্ধ ছিল বলে কোন প্রকার ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে৷ সাবলীলভাবেই বেরিয়ে আসতে পেরেছে সে অন্যথায় তুলকালাম কান্ড এক বাঁধতোই৷ রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকায় মিনিট দশকেরও মধ্যেই তারা হসপিটাল এসে পৌঁছে যায়৷ ইতোমধ্যে প্রাণের অবস্থা শোচনীয়, মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হতে শুরু করে দিয়েছে। ছন্দ প্রাণকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যায় কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। মধ্যরাত হওয়ায় কোন ডাক্তার এভেলেবেল নেই৷ সব ইন্টার্নিং করা ছাত্র-ছাত্রীরাই আছে, তারাই পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। ছন্দ প্রথমে তাদের দ্বারা চিকিৎসা করাবে কি-না তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলেও পরবর্তীতে প্রাণের অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে দ্বিরুক্তি করার সাহস পেল না। প্রাণের চেকাপ শেষে তাকে যথাসময়ে অপারেশন থিয়েটারে শিফট করা হলো। ছন্দ পিছু নিয়ে রুমের বাহির পর্যন্ত গেল, হঠাৎ একজন নার্স এসে তাকে বলল, “পেশেন্ট এর সাথে কি আপনি এসেছেন?”
ছন্দ হ্যাঁ সূচক মাথা দুলায়, কন্ঠস্বর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। কেন তা তার জানা নেই। নার্স ছন্দকে নিজের পিছে আসতে বলে রিসিপশনের নিয়ে যায়। অতঃপর কিছু ফর্ম দিয়ে বলে তা ফিলাপ করে টাকা আগে-ভাগেই ডিপোজিট করে দিতে। ছন্দ সব ফরমালিটি পূরণ করে তটস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তার?”
নার্স ফর্ম চেক করতে করতে বলে, “কার পেশেন্টের?”
“হ্যাঁ।”
“ফুড পয়জনিং মনে হচ্ছে, বাকি জানা নেই। আপাতত স্টোমাক ওয়াশ করা লাগবে৷”
ছন্দ আর কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ না দিয়ে নার্সটি চলে যায় অন্যদিকে৷ ছন্দ এবার উপায়ন্তর না পেয়ে পুনরায় চলে যায় অপারেশন থিয়েটারের সামনে। পাশে রাখা চেয়ারে বসে হাঁটুতে দুই হাত ভর করে নিজের চুল টেনে ধরে। চিন্তায়,শঙ্কায় তার মাথা ব্যথা করছে। না ঘুমানোর ফলে আঁখিদুটি ঈষৎ লাল, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার জীবনে এমন দুর্যোগ বয়ে যাবে, কে জানতো? ঘন্টা খানেকের মত বসে থাকার পর ভিতর থেকে একজন বেড়িয়ে আসে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে ছন্দ দৃষ্টি তুলে তাকায়, ছেলেটি ছন্দের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, “পেশেন্টের সাথে কি আপনি এসেছেন?”
ছন্দ এবার উঠে দাঁড়ায়, “হ্যাঁ! কোন সমস্যা?”
ছেলেটি হাতে থাকা রিপোর্টগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, “কি হন আপনি উনার?”
ছন্দ থমকায়, প্রত্যুত্তরে কি বলবে তা খুঁজে পায় না। দায় সারানোর জন্য ‘ভাই’ বলতে নেয় ঠিক কিন্তু শব্দটা শেষ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারে না। অগত্যা কথাটা ঘোরানোর জন্য জিজ্ঞেস করে, “ইজ শি ফাইন নাও?”
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে ছন্দকে একবার পরোক্ষ করে চোখের চশমাটি পিছনে ঠেলে বলে, “ইয়েস! শি ইজ অ্যাবসোলুটলি ফাইন। ঠিক সময়ে আনা হয়েছিল বিধায় অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন তিনি।”
ছন্দ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
“আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যা বুঝেছি তাতে তিনি হয়তো আজ কোন প্রকার নে’শা জাতীয় দ্র’ব্য বা সহজ ভাষায় ড্রা’গ’স সেবন করেছিলেন, যদিও সেটা খুবই কম মাত্রায় ছিল কিন্তু তবুও সে-টা তার শরীর নিতে পারেনি। অবশ্য তার শরীরের যে কন্ডিশন এতে এমন রিয়্যাকশন আসাটা অস্বাভাবিকও না।”
“ঠিক কেমন কন্ডিশন? কি বুঝাতে চাইছেন আপনি?”
“মূলত তার হাই ব্লাড প্রেশারের ইস্যু আছে, সে সাথে তার শরীরের হাই রেঞ্জের কিছু ঔষধের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই হয়তো সেই ঔষধ সেবন করছেন তিনি, কেন না রক্তে তার মাত্রা বিপুল পরিমাণে রয়েছে। আর সাধারণত যখন আপনি কোন হাই পাওয়ারের মেডিসিন নিচ্ছেন তখন মা’দ’ক’দ্র’ব্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হয়৷ আদারোয়াইজ ইট ক্যান কস সাম ডেডফুল সাইড ইফেক্টস। যদিও এক,দুইবার এই স্বল্প পরিমাণে এসব নিলে এমন সমস্যা দেখা দেয় না। কিন্তু এখানে রোগী একটু বেশি সেনসিটিভ। যার জন্য ডা’গ্র’সে’র পরিমাণ স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও ব্লাড প্রেশার আর মেডিসিনের প্রভাবে তার জন্য জিনিসটা বিষে পরিনত হয়ে গিয়েছিল। আজ সঠিক সময় তাকে এডমিট করানো না হলে হয়তো তার লাইফ রি’স্কে চলে যেত।”
ছন্দ প্রত্যুত্তর করলো না, মৌন রইলো। ছেলেটি বলল, “আপাতত তিনি সুস্থই আছেন, স্টোমাক ওয়াশ করা হয়েছে। রোগীর জ্ঞান ফিরলেই নিয়ে যেতে পারবেন আপনি। তবে পরবর্তীতে আপনার একবার ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। ইন্টার্নাল বিষয়গুলো তিনি ভালো বুঝবেন। আর যাওয়ার আগে রিপোর্টসগুলা কালেক্ট করে নিয়ে যাবেন।”
ছেলেটি আরও কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে চলে যায়। ছন্দ এবার চিন্তায় মগ্ন হয় প্রাণ কি ধরনের মেডিসিন নিচ্ছে? দেখতে তো তাকে সুস্থ-স্বাভাবিকই লাগে, তাহলে? দিন যত যাচ্ছে মেয়েটা তার নিকট গোলকধাঁধা হয়ে উঠছে। এভাবেই তার মন-মস্তিক ক্রমাগত হ্রা’স করে চলেছে মানবীটা, কবে না জানি সমগ্র তাকে আটক করে ফেলে এই মায়াজালে।
______
প্রভাতের পূর্বে অম্বরে রক্তিম আভা নিয়ে অরূণোদয় হয়। পাখির কূজনে খিলখিলিয়ে উঠে ধরণী। স্নিগ্ধ আলোর ছটা লতাপাতা ছুঁয়ে দিতেই লজ্জায় নুয়ে আসে তারা, আঁকে-বাঁকে উঁকি মারে মাধবীলতারা। শুদ্ধ বাতাসে নীলচে পর্দাগুলো অস্থিতিশীল। ধীরে ধীরে এবার প্রাণে বোধশক্তি ফিরে পায়। নেত্রপল্লবে ঝাপটে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে তার অবস্থান। জায়গাটা বুঝার চেষ্টা করে সে কোথায়। কিঞ্চিৎ সময় নীরবে অতিবাহিত হওয়ার বুঝতে পারে সে হসপিটালে। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় সে, বুঝে উঠতে পারে না হসপিটাল এসে পৌঁছালো কিভাবে? সে তো কাল রাত হোটেলে ছিল৷ চৈতি নিজের কাজ করতে বলে রুমের দিকে যাচ্ছিল৷ রুমেও ঢুকে সে কিন্তু…
হঠাৎ তার মনে পড়ে ওই রুমে আরেকজনও ছিল। কোন পুরুষ। কিন্তু কে? আর মনে করতে পারছে না প্রাণ। এরপরের কোন স্মৃতি তার মস্তিষ্কে নেই। সে কথা বলতে নিতে তার কণ্ঠনালী জ্ব’লে উঠে। অসহনীয় এক ব্য’থা উপলব্ধি করতে পারে। মনে হচ্ছে যেন তার গলার ভিতর কেউ জ’ল’ন্ত লোহা ঢুকিয়ে দিয়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ছটফট করতে থাকে সে। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করার অবিরাম চেষ্টা। এর মাঝেই একজন নার্স আসে প্রাণকে দেখার জন্য। প্রাণ উঠে গিয়েছে দেখে বলল, “অহ উঠে গিয়েছেন তাহলে?”
প্রাণ পাশ ফিরে তাকায় কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর করতে পারে না। নার্সটি প্রাণের পালস রেট চেক করতে করতে বলে, “গলায় ব্যথা করছে?”
প্রাণ মাথা দুলায় শুধু। নার্সটি নম কন্ঠে বলে, “আপনার স্টোমাক ওয়াশ করার জন্য টিউব ঢুকানো হয়েছিল, তাই এমন লাগছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা নেই।”
প্রাণ কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নার্সটির দিকে। তবে নার্স সেই দৃষ্টির অর্থ ধরতে পারলো না। সে প্রাণের ব্লাড প্রেশার চেক করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল, “আপনার হাসবেন্ডকে জানিয়ে দিচ্ছি আপনি উঠে গিয়েছেন। তিনি সারারাত আপনার রুমের বাহিরেই বসে ছিলেন, ঘুমাননি বোধহয়।”
প্রাণের কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়লো৷ নার্সটা কি বলল, “হাসবেন্ড?” তার হাসবেন্ড আসলো কোথা থেকে? আর কেই বা বাহিরে? হাসবেন্ড বলতে কি নয়নকে বুঝিয়েছে সে? এটা তো হওয়ার কথা না। তার কিছু হলেও নয়ন কখনোই তাকে হসপিটালে এনে এডমিট করবে না। এটুকু সে এতদিনে বুঝে গিয়েছে। কিন্তু মানুষটা কে? আর গতরাতে হয়েছিলটা কি?
পুনরায় দরজা খোলার শব্দ পেয়ে প্রাণ সেদিক তাকায়, মাস্ক-ক্যাপ পরিহিত মানুষটিকে চিনতে তার বেশ বেগ পেতে হলো না, ছন্দ। ছন্দ প্রাণের পাশে একটা টুল টেনে বসে মুখের মাস্কটা খুলে জিজ্ঞেস করে, “এখন ঠিক আছেন আপনি?”
প্রাণ হ্যাঁ সূচক মাথা দুলায়। ছন্দ প্রাণের দিক অনিমেষ চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে আমি বা আপনি এখানে কেন? রাতে কি হয়েছিল?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করতে পারে না, অভিনিবেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রাণের আগ্রহ দেখে ছন্দ নিজ থেকেই সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু করলো। সব শুনে প্রাণ নিশ্চুপ রইলো। বুঝতে পারলো, গভীর করাতে তাকে হসপিটাল আনায় নার্স হয়তো ছন্দকে তার হাসবেন্ড ভেবেছে। প্রাণ ছন্দের দিকে এবার ভালো মত তাকালো, ধূসররঙের শার্ট কুঁচকে আছে বিভিন্ন জায়গা দিয়ে, নিচের দিকে হালকা বমি,র’ক্তে’র শুকিয়ে যাওয়া দাগ, মুখে ক্লান্তি। খানিকটা বি’ধ’স্তই দেখাচ্ছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে, কতটা খেটেছে সে। কিন্তু তবুও দেখ একদম সংশয়,বিরাগ বিহীন দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রাণ লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। এদিকে, প্রাণের অসুবিধা কিছুটা আঁচ করতে পেরে ছন্দ জালালো না আর তাকে। তাকে বিশ্রাম করতে দিয়ে মাস্কটা পড়ে বেরিয়ে আসলো। ছন্দ বেরিয়ে যাওয়ার পর জামার পকেট থেকে প্রাণ নিজের মোবাইলটি বের করে খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। বন্ধ হয়ে আছে, চার্জ নেই হয়তো।
বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ফেরত আসলো। বুঝাই যাচ্ছে কাপড়চোপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এসেছে সে, সম্ভবত প্রাণের জ্ঞান ফিরার অপেক্ষায় বসে ছিল। ছন্দ প্রাণের কাছে এসে বলে, “আপনাকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে তারা। চলুন এবার।”
__________
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। দু’ধারে কাঁচ উঠানো, এসির শীতল বায়ু বিচরণ করছে ভিতরে। প্রাণ সিটে মাথা হেলিয়ে নেত্রপল্লব বুঝে শুয়ে আসে। ছন্দ ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকেই তাকে দেখছে। তার বেশ জানতে ইচ্ছে করছে কাল রাতে প্রাণের কি হয়েছিল? সে নে’শা’ক্ত কিভাবে হলো? আর সেই হোটেলেই বা কিভাবে? আর কি ধরনের ঔষধ খাচ্ছে প্রাণ যার ইফেক্ট তার শরীরে এত? তবে প্রাণের কথা বলার মত পরিস্থিতিতে নেই দেখে নীরব রইলো। মাঝে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, প্রাণের চেহেরায় তখনও মলিনতার ছড়াছড়ি৷ এভাবেই কৃত্রিম প্রসাধনী বিহীন মেয়েটাকে সনাক্ত করা দুষ্কর, এমতাবস্থায় কস্মিনকালেও চেনার উপায় নেই। যার দরুণ হসপিটালের স্টাফরা কেউও প্রাণকে এত কাছ থেকে দেখেও চিনতে পারেনি। যদিও সে তিনজন ব্যতীত কাউকে প্রাণের সান্নিধ্যে ঘেঁষতে দেয়নি। অযথা কন্ট্রোভার্সি তারও পছন্দ নয়। ক্রিকেটার হিসাবে এভাবেই তাকে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, অন্যথায় তিল থেকে তাল হতে বিলম্ব হয় না।
প্রাণের দেওয়া অ্যাড্রেসে এসে গাড়ি থামিয়ে প্রাণকে ডেকে তুলে ছন্দ। প্রাণ চারদিক একবার তাকিয়ে ছন্দের দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে, ছন্দ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই প্রাণ পাশে হাত চেপে হর্ণ বাজায়। সেকেন্ডের মধ্যে দারোয়ান এসে হাজির হয়৷ প্রাণকে দেখে সে আর কোন কথা বলে না,মেইন দরজা খুলে দেয়। প্রাণ এবার ইশারায় গাড়ি ভিতরে নেওয়ার জন্য বলল৷
ছন্দও কথা বাড়ালোনা। গাড়ি ভিতরে এনে স্থির করিয়ে প্রাণকে সাহায্য করলো বের হওয়ার জন্য। সন্তর্পণে তাকে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল তাকে বাড়ির ভিতর। ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে গেল। প্রাণ মন্থরগতিতে অন্দরে প্রবেশ করে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত আসতেই সোফায় চৈতি এবং আশা বেগমকে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকতে দেখল। চৈতি প্রাণকে দেখামাত্র দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, প্রাণের সান্নিধ্যে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলো, “ম্যাম আপনি কোথায় ছিলেন? আপনাকে রুমে না পেয়ে কতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জানেন? মোবাইলও অফ ছিল আপনার। আমি ভেবে শেষ, আপনার আবার কিছু হলো না তো।”
প্রাণ চোখের ইশারায় থামতে বলল তাকে, বুঝালো সে ঠিক আছে। আশা বেগম ইতোমধ্যে এগিয়ে এসে প্রাণকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তবে ব্যর্থ হলেন। ছন্দ তা দেখে বলে, “আন্টি আপনার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই,কোথায় বসাব বলুন শুধু।”
আশা বেগম এক পলক ছন্দের দিকে তাকিয়ে সোফার নিয়ে বসাতে বললে ছন্দ খুব যত্নে প্রাণকে নিয়ে সেখানেই বসিয়ে দিল। আশা বেগম প্রাণের পাশে এসে বসে বলে, “এক রাতেই কি অবস্থা হয়েছে তোর। কে বলেছিল নিজের জীবনের ঝুঁ’কি নিতে? সব জানার পরও কেন গিয়েছিলি নয়ন আর জেসিকার সাথে দেখা করতে? এসব বো’কা’মি কেন করলি?বল!”
আশা বেগমের কথা শুনে ছন্দের কপালে দ্বিধার ভাঁজ পড়ল। যতটুকু সে জানে নয়ন প্রাণের বাগদত্তা আর জেসিকা তার বেস্টফ্রেন্ড, তাহলে তাদের সাথে দেখা করতে গেলে জীবনে ঝুঁ’কি কিভাবে আসে? কাহিনীটা ঠিক বুঝলো না সে। এখানে প্রশ্ন করাও তার সাজে না তাই বিষয়টা অদেখা করে বলে উঠে, “তিনি এখন কথা বলতে পারবেন না আন্টি। প্রশ্ন করে লাভ নেই।”
আশা বেগম ছন্দের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে কেন? কি হয়েছে ওর? আর তুমি কে? চিনলাম না তো।”
ছন্দ নিজের মাস্ক আর ক্যাপ খুলতেই চৈতি বলে উঠে, “ছন্দ স্যার আপনি।”
ছন্দ স্মিত হাসে, সাথে সাথেই গালের মাঝে কিঞ্চিৎ গর্ত সৃষ্টি হয়। সে বলে, “আমি ফায়াজ তুরহান ছন্দ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন।”
আশা বেগম আগামাথা বুঝতে না পেরে বলে, “তুমি ওকে কোথায় পেল? আর কি হয়েছে ওর বললে না তো।”
ছন্দ একটু থেমে পুরো ঘটনাই বিস্তারিত বলল। সব শুনে আশা বেগমের উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লেন। প্রাণ যে কত বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে এসেছে তা বুঝতে পেরে তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। কিছুক্ষণ প্রাণকে জড়িয়ে ধরে রেখে তিনি কয়েকজন গৃহকর্মীকে ডেকে প্রাণকে বিশ্রামের জন্য উপরে পাঠিয়ে দিলেন। প্রাণ যাওয়ার পূর্বে একবার ছন্দের দিকে তাকালো, অতঃপর উপরে চলে গেল। চৈতিও তার পিছু পিছু গেল। প্রাণ যেতেই আশা বেগম ছন্দের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, “তুমি না থাকলে ওর কি যে হতো। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
“সমস্যা নেই আন্টি।”
“তুমি বাবা নাস্তা করে যেও, আমি এখনই খাবার দিতে বলছি টেবিলে।”
ছন্দ সত্বরে বলে, “নাহ! নাহ! আন্টি। এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমি এখন বাসায় যাব সোজা।”
আশা বেগম সৌজন্যতার জন্য বললেন, “কিছু তো খেয়ে যাও।”
“ইনশাআল্লাহ অন্য কোন একদিন।”
“তাহলে আরেকদিন এসো কিন্তু তুমি। আজ তোমায় ঠিক মত আপ্যায়নই করতে পারলাম না৷”
ছন্দ সম্মতি জানিয়ে সকল রিপোর্ট আশা বেগমকে বুঝিয়ে বিদায় নিল। যদিও তার ইচ্ছে ছিল আশা বেগমকে কিছু প্রশ্ন করার, বিশেষ করে প্রাণ কিসের জন্য এত পাওয়ারের মেডিসিন নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে তা নিয়ে। তবে পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে দমে গেল সে। উপরন্তু সে বাহিরের লোক, তার কৌতূহল কি আদৌ এত সাজে?
_________
বিকেলে গড়ানোর পূর্বেই একটি নিউজ ট্রেন্ডিং টপিক হয়ে উঠলো। ইতোমধ্যে অজস্র হেডলাইন তৈরি হয়েছে প্রাণ,জেসিকা ও নয়নকে নিয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে হাইলাইটেড হেডলাইনটি হচ্ছে, “নয়ন মেহরাব আর জেসিকা আনানের অ’ন্ত’র’ঙ্গ মুহূর্ত হলো ফাঁ’স। দুইজন দ্বারা ক্রমাগত প্র’তা’রি’ত হয়ে এসেছেন নুসাইবা আরা প্রাণ।”
হেডলাইনটা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় আ’গু’ন লাগিয়ে দিয়েছে। এই মূহুর্তে জেসিকা আর নয়নের ছবি দিয়ে ভরে আছে সকলের নিউজফিড। নেটিজেনদের মাঝেও উঠেছে তু’মু’ল ঝড়। নয়ন,প্রাণ জনিত প্রত্যেকটি পো’স্ট শে’য়া’র হচ্ছে সমানতালে। যথাযথ প্রমাণ হিসাবে ছবি এবং কিছু ভিডিও ক্লিপ থাকায় নেটিজেনরা সব প্রাণের পক্ষে কথা বলছে এবং নয়ন,জেসিকাকে ক্রমান্বয় কটাক্ষ করেই চলেছে। গা’লি, অ’ভি’শা’পে ভরিয়ে দিচ্ছে তাদের। যদিও আঙ্গুল বেশি জেসিকার উপরই উঠছে তবুও নয়ন যে পাড় পেয়ে যাচ্ছে তেমনও না। ঘণ্টাখানেক ধরেই প্রাণ নিউজফিড ঘুরছে এবং এসব দেখে চলেছে। তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। দুপুরের দিকে সেই চৈতিকে দিয়ে এই তথ্যটা বিভিন্ন নিউজ এজেন্সিতে পাঠিয়েছিল। অতঃপর ঘন্টাখানেক মধ্যেই কাজ হয়ে যায় তার, ছড়িয়ে পড়ে খবরটা চারদিকে। যেহেতু প্রাণ আর নয়নের এনগেজমেন্টের বিষয়টা তখনও ট্রেন্ডিং-এ ছিল সেহেতু খবর ছড়াতে সময় লাগেনি। ঠিক এই কারণেই প্রাণ এতটা সময় ধরে অপেক্ষা করছিল। জনগণের মাঝে স্বাদে কি এনগেজমেন্টের খবরটা ছড়িয়েছিল? সবই তো ছিল তার পরিকল্পনার অংশ, আর এর মধ্যে তাকে সাহায্য করে গিয়েছে চৈতি। শুরু থেকেই বিশ্বস্ত ছিল সে তাই তাকে কাজে লাগিয়েছিল প্রাণ।
আপাতত এখন আবার অপেক্ষা, সময়-সুযোগ মত পরবর্তী চাল চলবে সে। যাতে তার কোন আ’ঘা’ত বিফলে না যায়৷ নয়ন, জেসিকা যা করেছে তার কঠিনতম শা’স্তি সে দিবে তাদের।
.
ধূসর গোধূলি গড়িয়ে আঁধার নামো নামো ভাব। মেঘে মেঘে চলছে বজ্রের মূর্ছনা। বাতাস বইছে মাত্রাহীন। গাছের প্রকাণ্ড বারি খাচ্ছে একে অপরের সাথে, ঝরে পড়ছে পাপড়ি সকল। প্রাণের কন্ঠ এখন বেশ স্বাভাবিক,শরীরেও উন্নতি দেখা দিয়েছে। আশা বেগম একটু পর পরই দেখে যাচ্ছেন, প্রাণকে নিয়ে তার চিন্তার যেন অন্ত নেই। রুমে বসে চৈতির সাথে মন্থরগতিতে কথা বলছিল প্রাণ। এমন সময় নিচ থেকে নয়নের কন্ঠ ভেসে এলো উপরে। সে চিৎকার করে তার নাম ডাকছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই সে এসে হাজির হলো প্রাণের রুমে। প্রাণ তার দিকে তাকাতেই সে প্রাণের কাছে এসে বলতে শুরু করলো, “তুমি নিউজ দেখেছ তাই না? এই জন্য কি আমার ফোন তুলছো না? বিশ্বাস কর জেসিকার সাথে আমার কিছু নেই, এসব মিথ্যে। পুরো মিথ্যে। সব বানোয়াট, এডিটিং করা। বিশ্বাস কর।”
প্রাণ দৃষ্টি সরু করে ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “আমি বিশ্বাস করি তোমায়।”
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]