#প্রাঙ্ক কাপল [শেষ পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ
মিম ভীত হয়ে চিৎকার দিলো। ‘‘রাকিব! শাঁকচু….রিমি! কেউ আছে বাহিরে?’’
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মিম প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। আমার গত দুইদিনের ব্যবহারে মিম প্রচণ্ড ভীতিগ্রস্ত। সে নিজের ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘরে তার ফোন নেই। এমন সময় তার কানে দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টার শব্দ ভেসে এলো। সে দেওয়াল ঘড়ির দিকে নেত্রপাত করল। ইতোমধ্যে বারোটা বেজে গিয়েছে দেখে মিম খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে আজ অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে।
এই সময় আমি ও রিমি অফিসে আছি, এটা ভাবতেই সে আঁতকে উঠল। মিম আশেপাশে তাকালো। তার নজর বিছানার পাশের টেবিলের উপর পড়ল। সেখানে সে একটি টিফিন বক্স দেখতে পেল।
মিম চটজলদি টিফিন বক্স খুলল। অনেক বেশি করে খাবার মজুদ করা রয়েছে। টিফিন বক্সের নিচে একটি চিরকুটও খুঁজে পেল সে। চিরকুটটা খুলে পড়া শুরু করল, ‘‘কোনো রকমের চালাকি করবে না। ব্রেকফাস্ট ও লান্সের ব্যবস্থা রুমেই করা আছে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেবো। ততক্ষণ নাহয় নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রেখো।’’
চিঠিটা পড়া মাত্রই মিম স্তব্ধ হয়ে গেল। তার হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গেল। সে নিজের এই মুমূর্ষ অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে।
অগত্যা, মিম ব্রেকফাস্ট করে নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলো। সে জানে না, কোথায় যাবে সে?
তবে একবার স্বামীর ছায়া মাথা থেকে উঠে গেলে এই সমাজে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে একজন নারীর জন্য। তবুও মিম বেঁচে থাকবে। তার অনাগত বাচ্চার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে, নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল।
বিকাল পাঁচটা নাগাদ বাহিরে কিছুর শব্দ শুনতে পেল মিম। সে আবার দরজার কাছে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় টোকা দিল।
‘‘হ্যালো, কেউ আছে বাহিরে?’’ এবারও কোনো প্রত্যুত্তর পেল না। আবারও নিরাশ হয়ে বসে পড়লাল। ইতঃপূর্বেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে সে।
‘‘আচ্ছা, আমি যাবার পর কি রাকিব ওই রিমি নামের মেয়েটাকে নিয়ে ভালোভাবে সংসার করতে পারবে? না পারবে না। আমি যেভাবে রাকিবকে আগলে রেখেছিলাম, ওই শাঁকচুন্নিটা জীবনেও পারবে না। আচ্ছা, আমি কি সত্যিই রাকিবকে আগলে রেখেছিলাম?’’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল মিম। কিন্তু এর উত্তর তার কাছে নেই।
সন্ধ্যা হতেই মিম ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেল। সে চটজলদি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু বাহিরে অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো নেই। চতুর্দিকে পিনপতন নীরবতা। এই আঁধার আর নীরবতা মিমের মনের ভয়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আচমকা বাসার সকল বাতি একসাথে জ্বলে উঠে আর তার কানে একটি অতিপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘‘হ্যাপি এনিভার্সি, মাই ডিয়ার রাগী বউ!’’
প্রথমে চারপাশটা আলোকিত হতেই তীব্র আলো সহ্য করতে না পেরে মিমের চোখ আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। আমার গলা শুনে চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলল। আর চোখ খুলতেই মিম পুরো তাজ্জব হয়ে গেল।
পুরো হোলরুম সুসজ্জিত। এমন সময় মিম তার পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরল মিম।
‘‘কোথায় গিয়েছিলে? আমি বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’’ মিমের ক্রন্দনরত কণ্ঠ শুনে বেশ মায়া হলো।
‘‘শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার রাগী বউ।’’ মিম আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বিস্ময়ে তার ভ্রুকুটি কুঁচকে গিয়েছে। সে জিজ্ঞাসু গলায় বলল, ‘‘তোমার মনে ছিল, আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী?
‘‘হুম!’’
‘‘কিন্তু মনে থাকলেও তোমার তাতে কী যায় আসে?’’ কণ্ঠে কোমল অভিমানতার ছাপ!
আমি এগিয়ে মিমের মুখে আঙুল রেখে বললাম, ‘‘চুপ! কোনো কথা নয়। আজকে আমাকে বলতে দাও। জানো মিম, যখনি তুমি আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতে কিংবা অকারণে আমার উপর রাগ দেখাতে, তখন আমি অনেক কষ্ট পেতাম। ভেবেছিলাম আমি আমার ভালোবাসা দ্বারা তোমার কৃত্রিম রাগের সমাপ্তি ঘটাবো। কিন্তু ক্রমাগত তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছিল। আমিও সহ্য করে গিয়েছি কিন্তু এক পর্যায়ে আমিও নিজের ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলি। কারণ তুমি তোমার সব সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিলে। তুমি কখনো বুঝতে চাওনি, ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রাপ্ত ছোটো থেকে ছোটো আঘাত মনে অনেক গভীর প্রভাব ফেলে। তুমি কখনো অনুভব করতে চাওনি আমার কষ্ট। কখনো উপলব্ধি করতে চাওনি তোমার থেকে প্রাপ্ত অবহেলায় আমি কতটুকু কষ্ট পাই। কিন্তু সবশেষে যে, তুমি আমার স্ত্রী আর আমি তোমার স্বামী। আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। আর এটাই চিরন্তন সত্য।’’
আমার কথা শেষ হবার আগেই মিম আমাকে পুনরায় জড়িয়ে ধরল। অঝোরে অশ্রু বিসর্জন হচ্ছে তার গাল থেকে। তবে এই অশ্রু ভীষণ অপরাধবোধের। আমার চোখ থেকেও অশ্রুবিন্দুও পড়ল।
‘‘আজকের দিনও কাঁদবে? কেক কাটবে না?’’
মিম আমাকে ছেড়ে দিল। রান্নাঘর থেকে দুই পাউন্ডের কেক ও একটি চাকু নিয়ে এলাম। দুইজনে দুজনকে কেক খাইয়ে দিলাম। মিম কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,
‘‘তাহলে রিমি, তোমার দ্বিতীয় বিয়ে, এতদিনের অবহেলা……’’
‘‘সব নাটক ছিল। অভিনয়! তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি কাছের মানুষ যখন কারণে অকারণে কষ্ট দেয় তখন কতটা কষ্ট পায় অপরজন। আমি জানি না তুমি বুঝতে পেরেছ কি না, তবে গতকাল যখন আমি আমাদের মা-বাবা হবার খবরটা শুনলাম তখন আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি।’’
মিম আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘‘তাহলে ওই শাঁকচুন্নি থুক্কু মানে রিমি যে আমাকে এত খারাপ খারাপ কথা বলল তখন তো তুমি কিছু বললে না। আর এমনকি তুমিও আমাকে একজন পতি..তার সাথে তুলনা করেছ..।’’ শেষের কথাটা বলার সময় মিমের গলা আটকে গেল কষ্টের জন্য।
আমি অপরাধবোধমিশ্রিত ও শীতল গলায় বললাম, ‘‘আমি সব জেনে বুঝেই করেছি। এই কাজটা না করলে তুমি কখনো বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারতে না। আর রিমির ব্যাপারে এলে, সে আমার কলিগ। শুধু কলিগই না বরং বেস্টফ্রন্ড বলতে পারো। যখন তুমি আমাকে আরেকটি বিয়ে করার কথা বললে, তখনি আমার মাথায় এই পরিকল্পনা আসে। আমি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রিমির সাহায্য নেই।
‘‘আরে সেই বাসর রাতের ঘটনা। বেডরুম থেকে উত্তেজনাকর শব্দ ভেসে আসার ব্যাপারটা….’’ মিমের গলা আবারও আটকে যাচ্ছে।
আমি হেসে দিলাম। মিম বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আমাকে হাসতে দেখে সে আরও রেগে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তার গাল লাল হয়ে গিয়েছে রাগের কারণে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম, ‘‘আরে, সেটাও নাটক ছিল। আমি নিচে ফ্লোরে ঘুমিয়েছিলাম। আর রিমি বিছানায়। সেই শব্দগুলো তো শুধু মুখ দিয়ে বের করছিলাম আর কিছুই না।
‘‘আমি বিশ্বাস করি না।’’ অভিমানের সুরে কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো মিম।
তবে আমি মিমের হাত ধরে ফেললাম। মিম ঘাড় কাত করে পেছনে তাকালো।
আমি বাকা হাসি দিয়ে বললাম, ‘‘এই অবস্থায় এত রাগ করা ভালো না আমার রাগী বউ। পুরো কথাটা তো বলিইনি। তোমাকে ঘরের বাহিরে রাখাটা আমাদের পরিকল্পনার অংশ ছিল। তবে বিশ্বাস করো, তুমি যেমন নিচে ঘুমিয়েছ, তেমনি আমিও নিচে ঘুমিয়েছি। গতকাল যখন তোমাকে অচেতন অবস্থায় পাই, তখন আমার অবস্থা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজের ক্ষতি করে ফেলেছ। যখন ডাক্তার আংকেল খুশির খবরটা বলেন তখন আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, তখন এক মুহূর্তের জন্য তোমার প্রতি আমার সকল রাগ ভুলে গিয়েছিলাম আমি। নিজের বানানো পরিকল্পনা এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিলাম। তবে রিমি সময়মতো আমার কাঁধে হাত না রাখলে আমাকে আমি তখনি তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম। রিমিকে রাতে তোমার কাছে থাকতে বলেছিলাম কারণ তুমি অসুস্থ ছিলে। আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আজকের দিনেই আমি আমার নিজ হাতে তৈরি করা সকল নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। তবে আল্লাহ তা’আলা আজকের দিনে আমাদের অনেক বড়ো একটা উপহার দিয়েছে।’’
ইতোমধ্যেই মিমের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে আজ থামাবো না আমি। আরও বললাম, ‘‘সব নাটকের সমাপ্তি করার জন্যই সকাল ধরে এই পর্যন্ত তোমাকে ঘরবন্দি করে রাখি যাতে বাসা থেকে কোথাও না যেতে পারো। আজকে সারাটা দিন পুরো বাসা সাজিয়েছি। তোমার পছন্দমতো সবকিছুর এরেঞ্জ করেছি। আর এসব করতে আমাকে তোমার শাঁকচুন্নি মানে রিমিই সাহায্য করেছে। বলতে পারো এই অপদার্থ স্বামীর পক্ষ থেকে একটি ছোট্ট সারপ্রাইজ। এখনো কি আমার উপর রাগ করে থাকবে?’’
মিম মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে। আমার চোখাচোখি হতে পারছে না চক্ষুলজ্জায়। তবে আমিও তো ভুল করেছি। আমার স্ত্রীকে কষ্ট দিয়েছি আমি, যা আমার করা অনুচিত ছিল। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু কাজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও করতে হয়।
আমি মিমের মাথা উঁচু করলাম। থুতনিতে হাত রেখে বললাম, ‘‘আরে পাগলি, কাঁদছো কেন? আমার রাগী বউটাকে এভাবে কাঁদতে ভালো দেখায় না। আর দেখো, তুমি যে ভুল করেছ, আমিও একই ভুল করেছি। তোমায় শিক্ষা দিতে গিয়ে আমি নিজেও কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি, তা শুধু আমিই জানি।’’
মিম অশ্রুমাখা কণ্ঠে বলল, ‘‘আমাকে মাফ করে দাও। বিয়ের আগে থেকেই সবার সাথে প্রাঙ্ক করতে করতে কবেই যে নিজের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি, নিজেও জানি না। আর এই জন্য কারণে-অকারণে সবার উপরে খারাপ ব্যবহার করেছি। সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। গত দুই দিনে আমার যা অবস্থা হয়েছিল, তার জন্যও আমিই দায়ী। আমার প্রাঙ্ক করার অভ্যাসটার জন্য সবাই অনেক দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু আমি কখনো তা বুঝার চেষ্টা করিনি। তবে এখন থেকে করব। নিজের ভেতরকার সকল রাগ দূর করে ফেলব। আমার অনেক বান্ধবীদের কাছেই শুনতাম, কীভাবে তারা তাদের স্বামীদের থেকে অত্যাচারিত হচ্ছে, তাই আমি ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছিলাম না। মূলত এটাও একটা কারণ, তোমার উপর নিজের আধিপত্য সৃষ্টি করার।’’
মিমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘‘তোমাকেও বুঝতে হবে, সব স্বামী-স্ত্রী একরকম হয় না। সব সংসারেই অশান্তি থাকে। তবে সেই অশান্তির মাত্রা এতটাও উচিত না, যার কারণে দুজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। তবে আমি আমার পুরোনো রাগী বউটাকেই চাই। তবে হ্যাঁ, বেশি রাগী না, একটু রাগী হলেই চলবে।’’ আমার কথায় মিম হেসে দিল। সে হাসতে হাসতে বলল,
‘‘আমি তোমার সাথে প্রাঙ্ক করেছি, ঠিক আছে। তবে তুমি কিন্তু মাত্রারিক্ত করেছ আমার সাথে।’’
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, ‘‘মাত্রারিক্ত হয়েছে বলেই তো সেটা প্রাঙ্ক বলে বিবেচিত হবে, নাকি! আর তাছাড়া, যার স্ত্রীর এত প্রাঙ্ক করতে পারে, তার স্বামী হয়ে যদি আমি এতটুকু না করি, তাহলে ব্যাপারটা বেমানান লাগে না!’’ মিম আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর দুষ্টু গলায় বলল, ‘‘হয়েছে, আর সাফাই গাইতে হবে না নিজের। আমার প্রাঙ্ক বর!’’
আমিও নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেললাম। জানি, মিম তার প্রাঙ্ক করার অভ্যাসটা ছাড়বে না। তবে এবার আমিও প্রাঙ্ক করতে শিখে গিয়েছি। দেখা যাক….কী হয়! তবে যাই হবে, ব্যাপারটা মঙ্গলজনকই হবে!
সমাপ্তি…..