#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২
আমি মৃদু গলায় বলা শুরু করলাম। বুঁকটা কাঁপছিল বলার সময় তবুও বলতে লাগলাম। বলতে বলতে কখনও আঁৎকে উঠছিলাম কখনও স্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলা শেষ করলাম। সব কিছু বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ছাড়লাম। আবির ততক্ষণে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার হাতের উপর যে হাতটা ছিল সেটাও ইতোমধ্যে চলে গেছে। আবিরের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকশে। আবিরের নিস্তবতায় বলে দিচ্ছে সে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। আমার চোখ দিয়ে ততক্ষণে অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছিল। আমি চোখের জলটা মুছে আবিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম
– আবির কিছু একটা বলো। আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে। তবে আমি চেয়েছিলাম এ অতীতটা নিশ্চিহ্ন করে সামনে এগুতে। তাই অতীতটা তোমাকে জানাইনি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই কাজ করত। তবে অতীতটা সামনে আসায় তোমাকে না বলে পারলাম না৷ আমার ভুল হলে ক্ষমা করে দিও। তবু কিছু একটা বলো। এভাবে চুপ থাকলে বড্ড কষ্ট হয়৷
বলেই আবিরের হাতটা ধরলাম। আবির সাথে সাথে তার হাতটা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
– তুমি তো অন্য কারও স্ত্রী। তোমার হাত ধরাও ঠিক হবে না। আর সব মেনে নিতাম। রিলেশন সবার হয় কিন্তু তোমার বিষয়টা এত জটিল যে আমি মেনে নিতে পারছি না। অরন্যের জায়গায় অন্য একটা ছেলে হলেও কষ্ট হত না। ওর সাথে আমার সম্পর্ক গভীর। ওর সাথে এতকিছু আমি মানতে পারছি না। তার উপর তুমি এখনও অরন্যের স্ত্রী অরন্যও তোমার জীবনে আসতে চাচ্ছে। আর তোমাদের একটা বাচ্চাও হওয়ার কথা ছিল। এটা ঠিক অরন্য যা করেছে ভুল করেছে তবে সে তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে। একদিকে তুমি একদিকে অরন্য আমি তো দুটানায় পড়েছি অপ্সরা। আমাকে নিয়ে এভাবে না খেললেও পারতে। আগে বললে হয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত আমি নিতাম না। আমি সত্যিই মানতে পারছি না। আমার পক্ষে মানা বেশ কঠিন।
আমি আবিরের কথায় মৃদু হাসলাম। আশার আলোটা ধূপ করে নিভে গেল। এটা হওয়ারেই ছিল। কারণ আবির কোনো সুপার হিরো না। বাস্তবে সুপার হিরো নেই যে, যারা হিরোইনের সব মেনে নেবে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এর কষাঘাতে প্রতিনিয়ত বলি হতে হয়। আমার হাসি দেখে আবির জিজ্ঞেস করল
– হাসার মতো কী বললাম হাসছো যে?
– তাহলে কী কান্না করা উচিত?
আবির নিশ্চুপ। আমি পুনরায় বললাম
– একটু আগেও বলেছিলে অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। অতীত যাইহোক মেনে নিবে। এর আগে বলেছিলে অতীতে আমার কোনো ভুল না থাকলে আর অতীতটা যদি আমাদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য লুকিয়ে রাখি তাহলে সব মেনে নেবে। তোমার ঐ কথাগুলো মনে হয়ে হাসি পাচ্ছে। আমার তো এতে কোনো দোষ নেই। বিনাদোষে বারবার শাস্তি পেয়েছি। তবে শুনো তুমি চাইলে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারো আমার তাতে কিছু আসবেও না যাবেও না। আর আমি অরন্যকেও আমার জীবন থেকে মুছে ফেলব। সে জীবনে না থাকবে তুমি না থাকবে অরন্য। কারও খেলার পুতুল আমি না। আমি আমার জায়গায় পারফেক্ট। নিজেকে আমি বারবার ভাঙ্গতে দেখেছি আবার বারবার গড়ে নিয়েছি। আমি এবারও গড়ে নিব আরও শক্ত করে। এ মনের আবেগী জায়গায় আবারও প্রাচীর উঠবে সেটা হবে আরও শক্ত। প্রাচীরের এ পাশে থাকব আমি যেখানে আমি আমার মতো রাজ্য বিস্তার করব। আর প্রাচীরের ঐপাশে থাকবে তুমি যে কী না, চাইলেও আর আমার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।
– অপ্সরা তুমি ঠিকেই বলেছিলে আমি কথা গুলো যতটা সহজে বলেছিলাম বাস্তবতা তার ব্যতিক্রম। আমি চাইলেও মানতে পারছি না। আমি মানতে পারতাম যদি অরন্যের জায়গায় অপরিচিত কেউ থাকত। অরন্য আমার ভাই তার বউ তুমি। এখানে চাইলেও আমি কিছু করতে পারব না। আমার হাত পা বাঁধা।
আমি এবার অট্ট হাসলাম। হেসে হালকা গলায় বললাম
– ভালো থেকো।
বলেই উঠতে নিলাম। আবির আমার হাতটা টান দিয়ে বলল
– আমাকে কী সময় দেওয়া যায় না?
– সম্ভব না। আজকে তুমি বিষয়টা মানতে দ্বিধা করছো সে দ্বিধাটা তোমার আজীবন থাকবে৷ সারা জীবন তোমার কথা শুনতে হবে। আমি কেন এ পথ বেছে নিব বলো? তিলে তিলে মরার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমার জীবনে তুমি বা অরন্য কারও স্থান নেই। আমার রাজত্বে আমি একাই বিরাজমান। আমি নিজেকে এর আগে সামলে নিতে পেরেছি এখনও পারব। আর তোমার মাকে সবটা জানানো হয়নি আজকে মাকেও সবটা জানাব। আমার পরিবার জানা বাকি আমার পরিবারকেও জানাব। সব মিলিয়ে বিষয়টা শেকড় থেকে শেষ করে নতুন ভাবে নিজেকে গড়ে নিব৷ সেখানে আমি ব্যতীত আর কারও স্থান নেই। ভালো থাকবে।
কথাটা বলেই বের হলাম আবিরের রুম থেকে। আবিরের রুম থেকে বের হতেই অরন্যের সাথে দেখা। অরন্য আমার পথ আটকে দিয়ে বলল
– দয়াকরে মাফ করে দাও। আমার তো ভুল হয়েছে আমি স্বীকার করি। প্রতি পদে পদে আমি সেটা অনুধাবন করেছি।
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি অরন্যের গালে কষিয়ে চড় দিয়ে বললাম
– আমার সামনে যেন তোমার এ মুখটা কখনও না আসে। বেয়াদব,কুত্তা, আমার জীবনটা নরক করতে বিবেকে বাঁধল না? যদি ভালোইবাসতে আমাকে, তাহলে আমার সুখটা নষ্ট করতে না। তোমার বিয়ের পর তোমার জীবনে তো আমি ঝামেলা করে নি। কারণ আমি তোমায় ভালোবাসতাম। আজকে কেন তুমি আমার জীবনটা নরক করতে উঠে পরে লেগেছ।
বলেই অপর গালে আরেকটা চড় দিলাম। তারপর বললাম
– তুমি জানো? তোমার এ সামান্য আবেগ সামান্য লোভ আমার জীবনে কি ক্ষতি করেছে? ভালোবেসার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে তো আমাকে বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলেছিলে। সেদিন তোমার সাথে যোগাযোগের কম চেষ্টা তো করে নি। কই ছিল সেদিন তোমার ভালোবসা যেদিন আমার বাচ্চাটাকে খুন করতে হয়েছে। সেদিন অধিকার ফলাতে তো তোমাকে দেখি নি৷ আমি তোমাকে মন থেকে ঘৃনা করি। আবিরকে সবটা বললাম আমার পরিবারকেও সবটা বলে এ নাটক আমি শেষ করব। আমাকে যতটা আবেগী ভাবো প্রয়োজনে তার চেয়ে কঠিন হতে আমার সমস্যা হবে না। আমার জীবনের পাতাতেও আর তোমাকে রাখতে চাই না।
কথাগুলো বলেই দৌড়ে বের হতে নিলাম। মা আমার হাতটা ধরে বলল
– কী ব্যপার অপ্সরা কী হয়েছে? অরন্যকে চড় দিলে কেন?
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
– আপনি আমার মায়ের মতো। আপনাকে বলতে পারছি না। বলার ধৈর্য আমার নেই। অরন্য আর আবিরের কাছ থেকে বাকিটা জেনে নিবেন।
কথাটি শেষ করেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপর সে বাসায় কী ঘটেছে সেটা আমার জানা নেই। রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বরাবরেই আমি মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করে বসি। যদিও এখানে আবিরের দোষ নেই কারণ আমি হলেও বিষয়গুলো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারতাম না। প্রতিটা কাজের একটা ভালো দিক থাকে। এই যে আরন্যের আগমনটা হয়ে ভালোই হয়েছে। বিয়ের পর যদি অরন্যের আগমন হতো তাহলে হয়তো আরও বেশি কষ্টের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতাম। আজকাল আমি বড্ড ইতিবাচক স্বভাবের হয়ে গেছি। প্রতিটা বিষয়ে ইতিবাচক দিক গুলোই বের করি। হালকা কষ্ট হচ্ছে তবে এটা সাময়িক। রিকশায় বসে আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের আকাশটা বড্ড সুন্দর। সে সাথে ধূলিমিশ্রিত বাতাস বইছে। এ আকাশে ডানা মেলে উড়ার জন্য একটা পাখা দরকার। সে পাখার সন্ধান কই পাব। মনে মনে এসব আওরাতে আওরাতে হাসতে লাগলাম। আজকাল বড্ড ছেলে মানুষী করি। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু জড়ছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই।
বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়েই খেয়ে নিলাম। নিজেকে এতটায় স্বাভাবিক করে রাখলাম যে কিছু একটা হয়েছে সেটা কাউকে বুঝতেও দিলাম না। খাওয়া শেষে নিজের মতো করে ঘরে এসে বসলাম। যখন একা খাটের কোণে বসলাম তখন কান্নাটা বুক ফেটে আসতে লাগল। আমি চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লাম। আজকে নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া লাগছে। নিজের পরিবর্তনটাও নিজের কাছে অদ্ভুত লাগছে। একটা সময় এই আমি অরন্যের জন্য রাতের পর রাত কান্না করতাম ওকে পাওয়ার জন্য আর আজকে ওকে আমি সহ্যই করতে পারছি না। অরন্যকে কেন জানি না আমি ক্ষমা করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে একে ক্ষমা করলে আমি শান্তি পাব না।
রাত তখন ১১ টা। আমার ফোনে কল আসলো। আবিরের মা কল দিয়েছে। আমি কান্না থামিয়ে কন্ঠটাকে স্বাভাবিক করে হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকে উনি বেশ মোলায়েম কন্ঠে বললেন
– আমি জানি তোমার সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। মা আবির তোমাকে আর চাচ্ছে না। আবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। তুমি তোমার বাবা মা কে বুঝিয়ে বলো। আর আমি কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিও।
– আপনি কেন কষ্ট দেবেন। আমি ব্যপারটা ম্যানেজ করে নেব। আর শুনেন আবির আমাকে চাই না বলে ওকে ছেড়ে দিচ্ছি তা কিন্তু না বরং এখন আবিরকেই আমি চাই না। আর আবিরকে এটা ভাবতেও নিষেধ করবেন যে আমি অরন্যের হয়ে যাব। আমি অরন্যকেও আমার জীবনে চাই না। সারা জীবন একা থাকব তবুও অরন্যকে চাই না। দুনিয়াতে একটা ছেলে অরন্য থাকলেও তাকে আমি মেনে নিব না। ভালো থাকবেন।
কলটা কেটে দিলাম। কথাগুলো বলতে পেরে একটু হালকা লাগছে। এর মধ্যেই অরন্য কল দিল। অরন্যের কলটা ধরে গালি দিতে যাব এমন সময় ও বলে উঠল
– অপরাজিতা আমি আর তোমার জীবনের কাটা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সুখের পথে দুঃখ আনতে আর চাই না। তুমি চাইলে আমি কালকেই তোমাকে ডিভোর্স দিব। সময় মতো চলে এসো। কাগজপত্র আমি প্রস্তুত রাখব।
অরন্যের কথা শুনে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। আমি হালকা গলায় বললাম
– ঠিকানা টেক্সট করো। কালকেই আসতেছি আমি।
কলটা কেটে খাটে হেলান দিলাম। কালকে নরকীয় অতীত থেকে মুক্তি পাব ভেবে মনটা শত কষ্টের মধ্যেও স্বস্তি লাগছিল। জানালার পর্দাটা সরানো রাতের কালো আকাশটা দৃশ্যমান। এ আঁধার গুচিয়ে খুব শীঘ্রই আলোর রেখার খুঁজ মিলবে। হয়তো এ কয়দিনে জীবন থেকে অনেক কিছুই বিয়োগ হয়েছে তাতে কী, আবেগের মোহে না থেকে বাস্তবতায় তো নিজেকে সামলাতে পেরেছি এটাই অনেক। আবিরকে তো চিনতে পেরেছি। এসব যোগ বিয়োগের জীবনের অংকগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠেই অরন্যের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম।
চলবে