#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– কথাগুলো হয়তো তোমার শুনতে খারাপ লাগবে তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। আর সবকিছু মিলিয়ে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– জি মা বলুন। আমি শুনতে প্রস্তুত।
– দেখো কালকে এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকেই ঝামেলা হচ্ছে শুধু। একের পর এক দূর্ঘটনা। আমার মাকে আমি বিষয়টা বলার পর আমার মা ও বলল এটা কোনো ভালো লক্ষণ না। তোমরা এ যুগের মেয়ে আবিরও এ যুগের ছেলে তোমাদের কাছে এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছু না।
মায়ের কথা শুনে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ অরন্যের ব্যপারটা তাহলে মা দেখে নি। কিন্তু এখন কী মা এসব বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবে। বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠল। মুখটা ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। দৃষ্টি নীচের দিকে চলে গেল। কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। মা আমার থুতুনী ধরে মুখটা উপরে তুলে বলল
– কথাগুলো শুনে কী মন খরাপ লাগছে?
মায়ের মুখে মৃদু হাসি। হাসিটা দেখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম । তাই বেশ হালকা সুরে বললাম
– না মা মলিন কেন হবে? আপনি যা বলছেন আমি বুঝতে পেরেছি। এখন কী করতে হবে বলুন।
মা আমার কথা শুনে অট্ট হাসি দিয়ে বললেন
– পাগল মেয়ে এটা কী তুমি বাংলা সিনেমা পেয়েছো? তোমার কী মনে হয় আমি ডাইনি শ্বাশুরি তোমাকে বলব আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যেতে? এতটা অসামাজিক আমি না। কুসংস্কার আমিও বিশ্বাস করিনা। তবে যা হচ্ছে সেটা ইতিবাচক ভাবেও নিতেও পারছি না। তাই আমি সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের চার হাত এক করে দেবো তাড়াতাড়ি। বিয়ে পড়িয়ে রাখব পরে তুলে আনব তোমায়। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? এক মাসের মধ্যে একটা তারিখ দেখে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করতে চাই। আমার মনে হয় এতে সব ঝামেলা দূর হবে। তোমার পরিবার কী বিষয়টা মেনে নেবে?
উনার কথা শুনে আমার চোখের জল ছলছল করতেছে। একটা মানুষ আমাকে এত বুঝে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে ধরে বলল
– কী হয়েছে?
– প্রথমে ভেবেছিলাম আর সবার মতো আপনিও এসবের জন্য আমাকে দায়ী করবেন। আপনার গম্ভীর মুখটা দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। এখন বেশ প্রশান্ত লাগছে। এতটা ভালো আপনি আমি যত বলব তত কম হবে।
মায়ের হাতটা আমার মাথার উপর দিয়ে হাত বুলাতে লাগল। আর আলতো গলায় বলল
– প্রথমে আমি একজন মেয়ে তারপর একজন মা। আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের স্বপ্ন তো নষ্ট করতে পারব না। আবিরের মা হলেও আমি মায়ের জাত তোমার ও মা। একজন মা হয়ে মেয়েকে অপয়া অলক্ষী বলব ভাবলে কী করে। এগুলো হয়তো সাময়িক বিপদ আসতেছে তবুও মনটা আনচান করছে তাই তোমাকে এভাবে বলা। মা রে তোমার মায়া ভরা মুখটা আমার মনটা গতকালকেই কেড়ে নিছে। তুমি যে আমার বউমার জায়গা না মেয়ের জায়গা দখল করে রেখেছো। তোমার মা বাবা রাজি হয় কি না এ অবস্থায় বিয়ে দিতে সে চিন্তায় আছি।
আমি মায়ের বুক থেকে মাথাটা তুলে বললাম
– মা আমি রাজি করিয়ে নিব। উনারা আমার কথায় রাজি হবেন।
মা আমার কপালটা টেনে কপালে চুমু দিয়ে বলল
– আমার লক্ষী মেয়েটা। যাও আবিরের কাছে যাও। খাবার দিয়ে আসার সময় তোমাকে খুঁজতেছিল। আর অপ্সরা আরেকটা কথা অরন্যের ব্যপারে।
অরন্যের কথা বলতেই আমার বুকটা কম্পন দিয়ে উঠল। আমি হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
– কী কথা?
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– অরন্যকে আমি ছেলের মতো দেখি। তিন বছর যাবত আমার বাসায় আসে যায়। কত করে বলেছি এ বাসায় যেন থাকে কিন্তু তবুও আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। ওর জীবনে একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। আবিরও না। অরন্য আবিরের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে অনেক। সেদিনের পর থেকে অরন্যও আমার ছেলের জায়গা দখল করে আছে। ওর জীবনটা ছন্নছাড়ার মতো।
মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে আবির অরন্যের অতীত না জানলেও মা কিছুটা জানে। আমি মায়ের কথা আটকে দিয়ে বললাম
– কেন মা কী হয়েছে? কী ঝড় বয়ে গেছে।
– সেটা অন্য একদিন সময় করে তোমাকে বলব। শুনো অরন্যকে গতকাল থেকে কেমন জানি ছন্নছাড়া লাগছে তুমি পারলে একটু কারণটা জানার চেষ্টা করো। আর ওর খাবারটা টেবিলে রেখেছি তুমি একটু দিয়ে এসো। আমি এখন নামাজে দাঁড়াব। পারবে না মা এটুকু করতে?
যদিও অরন্যের খাবার নিয়ে যেতে আমার একদম ভলো লাগছে না তবুও মুখে হাসির রেখা টেনে বললাম
– হুম পারব।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবিরের কাছে আসলাম। যতদ্রুত সম্ভব আবিরকে সবটা বলা জরুরি। এ দোটানা নিয়ে থাকা যাবে না। আর এ খেলায় আবির নিরপেক্ষ একদম নির্দোষ। বরং এখানে আবিরের কাছ থেকে লুকিয়ে আমি আবিরকে ঠকাচ্ছি। বিষয়গুলো আজকে না বলে কাল পরশু আবিরকে সবটা বলব। এর মধ্যে আবির আমায় হালকা সুরে ডেকে বলল
– অপ্সরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছো। কোনো সমস্যা? কিছু ভাবছো নাকি?
আবিরের মোলায়েম কন্ঠ শুনে আমি আবিরের দিকে তাকালাম। তার পাশে বসে হাতটা ধরে বললাম
– মা চাচ্ছে আমাদের বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। এ মাসেই বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাচ্ছে।
কথাটা শুনে আবিরের মুখে ফিনকি হাসির রেখা সে সাথে মলিনতার টানও আছে। শান্ত গলায় জবাব দিল
– বিয়েতে তো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এ মাসে বিয়ে কী করে সম্ভব বলো। আমি তো সুস্থ হব না একমাসের মধ্যে।
– মা চাচ্ছে বিয়ে পড়িয়ে রাখতে পরে প্রোগ্রাম করবে। তুমি কী চাও?
আবির কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বলল
– তুমি মাকে কী বলেছো?
– আমি সম্মতি দিয়েছি।
– তাহলে তো সমস্যা নেই। তোমরা যা বলবে তাই হবে।
– কিন্তু আবির আমার কিছু কথা ছিল। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমার একটা অতীত আছে।
– হ্যাঁ। আর সেটা অতীত বর্তমান তো না। অতীত নিয়ে বলার দরকার নেই। বর্তমানে ভালো আছি এটাই যথেষ্ট নয় কী? আর আমি তোমাকে ভালোবাসি সেটা বর্তমান দেখেই, অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।
– কিন্তু আবির অতীতটা যদি কোনোদিন এসে বর্তমানের সুখ কেড়ে নেয় সে ভয়ে আছি।
– কাড়তে পারবে না। আমি পাশে থাকব তোমার।
– আবির বলাটা অনেক সহজ তবে করতে গেলে দেখা যাবে সেটা অনেক কঠিন।
– কী হয়েছে অপ্সরা বলবে একটু পরিষ্কার করে? গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।
– তেমন কিছু না। কিছু একটা থেকে নিজেকে লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। সেটাই এখন সামনে এসে বাঁধা দিচ্ছে।
– হেয়ালি রেখে সোজাসুজি বলো।
– আজকে নাহয় না বলি। একটু বিশ্রাম করো। ঘুৃমানোর চেষ্টা করো। কালকে এক সময় এসে বলব। কলেজ থেকে আসব তিনটায়। কলেজ থেকে বাসায় না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসব। তোমার সাথে সব কথা শেষ করে শান্ত মনে বাসায় যাব। আমি চাইনা তোমার কাছে কিছু লুকানো থাকুক। আমি চাই তুমি সবটা জানো। তারপর তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে মেনে নেব।
– এবার থামো তো। কালকের কথা কালকে ভাবা যাবে। তুমি কী খেয়েছো?
– নাহ!
– তাহলে আমার সাথে খেয়ে নাও। এখানে মা স্যুপ দিয়ে গেছে। তুমিও খাও আমাকেও খাইয়ে দাও। আর অরন্য কী খেয়েছে?
– ভাইয়া খয়নি। তুমি আগে খেয়ে নাও।
– আমার আর তোমার খাওয়া শেষ হলে অরন্যকে মনে করে খাবার দিও। মা কোথায়?
– নামাজে দাঁড়িয়েছে।
আবির আর কোনো কথা বলল না। আবিরকে স্যুপটা খইয়ে দিলাম সে সাথে নিজেও খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে আবিরকে বিশ্রাম করতে বলে অরন্যের জন্য খাবার নিয়ে গেলাম। অরন্য আমাকে দেখেই উঠে বসল। আমি অরন্যকে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বললাম
– আমাদের বিয়ের কাগজ তোমার কাছে থাকলে একটু প্রস্তুত রেখো। আমি তোমাকে খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিতে চাই। যে সম্পর্কের কোনো শেকড় নেই সে সম্পর্কের ডালপালা রেখে লাভ নেই।
– কিন্তু আমি তো তোমাকে ডিভোর্স দিব না। আর এ সম্পর্কের জোরেই তোমাকে আমার করে নেব।
– তুমি আমাকে কখনও পাবে না। শুধু শুধু সহ্যের পরীক্ষা নিচ্ছ অরন্য।
– সেটা দেখা যাবে। তুমি খেয়েছো?
– আমার খাবার নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
কথাটা বলেই রুম থেকে চলে আসলাম। খানিকক্ষণ পর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর থেকেই মনটা বেশ ছটফট করে আছে। কালকে আবিরকে বললে আবির বিষয়টা কীভাবে নিবে জানি না। আবিরের মা সবটা জানার পর কী করবে সেটাও জানা নেই। অরন্যকে ডিভোর্স দিব কীভাবে কাগজ পত্র ছাড়া তাও জানি না।
একটা সময় এ অতীতটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইতাম। আর আজকে অতীতটা আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাচ্ছে। সময় সত্যিই রঙ বদলের পালা নিয়ে বাহিত হয়। একটা সময় অরন্যকে আমি পেতে চাইতাম। আজ অরন্য আমায় পেতে চাচ্ছে। আচ্ছা এটাকেই প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে।
ভাবতেই ভাবতেই মনে হলো অরন্যের আইডিটায় একটু অন্য আইডি দিয়ে পরিচয় গোপন করে মেসেজ দিলে কেমন হয়। যদি নাফিসার কাছ থেকে কোনো তথ্য জানা যায়। যদিও অতীত নিয়ে ঘাটা ঠিক না তবুও কখন কী কাজে লেগে যায় বলা যায় না। আমি চট করেই আমার একটা পুরনো আইডির নাম পরিবর্তন করে অরন্যের আগের আইডি যেটা অরন্য দাবি করছে যে এ আইডিটা নাফিসার কাছে সে আইডিতে রিকুয়েষ্ট দিলাম। অন্য একটা মেয়ের ছবি দিয়ে আইডিটা সাজালাম যাতে করে ফেক না ভাবে। আমার এক বান্ধবীর ছবি ব্যবহার করেছি। অরন্য তাকে চেনে না আর নাফিসাও না। আইডিটা যার কাছেই থাকুক না কেন এতে কারও সন্দেহের দৃষ্টিতে আমি যাবার কথা না।
রিকুয়েষ্ট দেওয়ার মিনেট ৩০ পর রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট হলো। আমি আইডিটা ভালো করে ঘুরে দেখালাম। আইডিটা ঘুরার পর নতুন সূত্র আবিষ্কার করলাম। সেই সাথে নতুন প্রশ্ন নতুন কাহিনির সূত্রপাত ঘটল।
চলবে