#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৯
কারণ অরন্য আমার হাতটা চেপে ধরে বলল
– একটা সময় তুমি আমাকে পেতে চাইতে। তখন তো বলেছিলে আমার জন্য তুমি সারাজীবন অপেক্ষা করবে। এখন এমন কেন বলছো?
– এগুলো আবেগে বলেছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা যে জায়গায় তুমি কথার বরখেলাপ করতে পার সেখানে আমি কেন পারব না। কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। জীবনও সময়ের গতিতে রঙ বদল করে। তুমি আমার জীবনে মিশে থাকা অস্তিত্বে ছিলে, এখন নেই। এখন তুমি শুধু একটা অতীত এর বাইরে কিছু না। এর বাইরে তোমাকে আমি কিছু ভাবতেও পারব না। দয়াকরে আমার পিছু ছাড়ো। আমি চাই না আমার জীবনে কালো অতীতটা আবার ফিরে আসুক।
কথাটা বলতেই অরন্য আরও জোরে হাতটা চেপে ধরল। আশে পাশের মানুষগুলো বেশ অদ্ভুত ভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। কখনও আশাও করি নি অরন্য আমার জীবনে ফিরে এসে আমাকে পাবার জন্য এতটা পাগলামি করবে। আমি হাতটা জোরে ছাড়িয়ে নিলাম। অরন্য আর আমার আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে আমরা স্কুল কলেজে পড়ি। আমি কিছুটা রেগে গিয়ে পুনরায় বললাম
– যথেষ্ট বয়স তোমায় হয়েছে। এভাবে রাস্তায় কেন এমন করছো। পাগল হয়ে গেছো তুমি? নাকি তুমি অসুস্থ।
কথাটা বলার সাথে সাথে অরন্য আমার হাতটা আবার চেপে ধরে বলল
– আমি জানি তোমার মধ্যে অভিমান জমে আছে। আমার প্রতি তীব্র কষ্ট জমা হয়ে আছে। তোমার সব অভিমান মুছে দিব। আমিও দেখব তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও কীভাবে। দেখো হয়তো আল্লাহও চায় আমি আর তুমি এক হই। তাইতো হুট করে আবিরের এক্সিডেন্ট হয়ে তোমাদের বিয়েটা আটকে যায়।
– দিবা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো৷ আমার পেছনে না লেগে সামনে এগিয়ে যাও। মানুষের জীবনে দূর্ঘটনা ঘটেই সেটার জন্য নিজের জীবন থামিয়ে না দিয়ে গুছিয়ে নাও। আর আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। এখন তোমাকে বাসি না। ভালোবাসতাম আর ভালোবাসি এর মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। আমাকে ছাড়ো।
কথাটা বলেই অরন্যের কাছ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে এসে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এমন সময় চিৎকারের আওয়াজ কানে ভাসলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য রাস্তায় পড়ে আছে। তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তাকে একটা বাইক এসে ধাক্কা দিয়েছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ছেড়ে আবিরের কাছে যাব নাকি ওকে গিয়ে ধরব। কিন্তু মানবিকতা মনুষ্যত্ত্ব বলতে একটা কথা আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। অরন্যের কাছে গেলাম। তার মাথা ফেটে গড়গড় করে রক্ত পড়ছে। গত এক্সিডেন্টের আঘাতে আবারও আঘাত পয়েছে। অরন্যকে গিয়ে ধরলাম।হাতটা ধরে তুলে ইমারজেন্সির দিকে এগুতে লাগলাম। অরন্য আমার হতটা শক্ত করে ধরে আছে। আমি অরন্যেকে তার মাথাটা চেপে ধরতে বললাম অন্য হাত দিয়ে। সে মৃদু গলায় বলল
– তোমার হাত দুটো ধরতেই আমার বেশ ভালো লাগছে।
আমি অরন্যের কথার কোনো জবাব দিলাম না। একদম চুপ হয়ে গেলাম। ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার সাথে সাথে অরন্যের মাথাটা পুনরায় বেন্ডেজ করে দিল। অরন্য এখন সুস্থ। এর মধ্যে আবির বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে ধরতে পারে নি। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আবিরকে কল দিলাম। আবির বেশ উত্তেজিত গলায় বলল
– অপ্সরা সেই কখন বলেছো আসতেছো এখনও কী আসো নি? আর অরন্যও কোথায় যেন গেল কল ধরতেছে না।
আমি চাপা গলায় বললাম
– আমি অরন্য ভাইয়ার সাথে।
আবির কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– অরন্য তোমার সাথে?
– হ্যাঁ আবির অরন্য ভইয়া আমার সাথে।আমি এসেছি অনেক আগে। এসে দেখলাম উনি রাস্তার পড়ে আছে। আবারও এক্সিডেন্ট করেছে। এখন উনি একটু ভালো। উনাকে নিয়ে আসতেছি। সেজন্যই আমি আর উনি তোমার কল ধরতে পারে নি। তোমার শরীর কেমন এখন?
– এখন তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। জানি না কী হচ্ছে এসব। গতকাল এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকেই শুধু অঘটন ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তুমি আসো তাড়াতাড়ি। ভালো লাগছে না একদম। আর অরন্যকে পারলে সাথে নিয়ে এসো।
– হুম আসতেছি এখনি। আরেকটু অপেক্ষা করো। আর সরি।
– সরি কেন?
– এই যে কল ধরতে পারিনি। মনে হচ্ছে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।
– বোকা মেয়ে একটা।
বলেই আবির হেসে দিল। আমি আবিরের হাসি দেখে কৌতুহল গলায় বললাম
– হাসছো কেন এভাবে?
– তোমার বোকা বোকা কথা শুনে। সমস্যা তো হতেই পারে অপ্সরা এতে এত আপসেট হওয়ার কিছু হয়নি। যাইহোক জলদি আসো।
আমি কলটা কেটে অরন্যকে বললাম
– আমি আবিরের কাছে যাচ্ছি তুমি এখানেই থাকো।
– আমিও তোমার সাথে যাব।
– এ শরীর নিয়ে তুমি এখন আবিরের কাছে যাবে নাকি? আর ঢাকা মেডিকেলের অবস্থা তো জানো। এমনিতে সিটের সংকট ঐখানে গিয়ে ঠিক মতো বসতেও পারবে না। আর আবিরের মাকেও বলা হয়নি। উনাকেও বলতে হবে। তোমার মনে হয় এখানে থাকলেই ভালো হবে। অরন্য দয়াকরে আর কোনো ঝামেলা করো না।
– ঝামেলার কী দেখছো এখানে? আমিও তোমার সাথে যাব। এখানে এভাবে শুয়ে থাকতে একদম ভালো লাগছে না আর আমার শরীর একদম ঠিক আছে।
অরন্য বেশ নাছোরবান্দা আমার সাথে সে যাবেই বুঝায় যাচ্ছিল। অরন্যকে নিয়েই আবিরের কাছে গেলাম। অরন্যকে আবিরের সিটের এক পাশে বসিয়ে আমি আবিরের দিকে তাকালাম। আবির আমাকে দেখে হালকা হেসে বলল
– প্রিয়তম এখন কী আমাকে দেখে চিন্তা কমেছে। একদম পাগলের মতো হয়ে গেছিলে। দেখো আমি একদম সুস্থ আছি।
আবিরের দিকে তাকালাম আমি। আবিরের চোখ গুলো আমার দিকে আবদ্ধ করা। আবিরের চোখে এক ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম। এ মানুষটার চাহনি এত নিষ্পাপ যে সে চাহনিতে নিমেষেই হারিয়ে যাওয়া যাবে।
– আমি জানি তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার পাশে আছি সবসময় পাশে থাকব। ভালোবাসি আবির। কখনও সামনাসামনি বলা হয়নি আজকে বললাম। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। কখনও ছেড়ে যাব না। সবসময় তোমার পাশে থাকতে চাই।
আবির হেসে দিয়ে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল
– অরন্য তুই কিন্তু সাক্ষী অপ্সরা আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না ওয়াদা করেছে।
আবিরের কথা শুনে আমি অরন্যের দিকে তাকালাম। অরন্যের মুখটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। ঠিক চার বছর আগে অরন্যের বিয়ে শুনে যতটা বিরহ আমার মুখে ফুটে উঠেছিল সে বিরহ আজ অরন্যের মুখে। সৃষ্টিকর্তা ঠিকেই সব ফেরত দেন। আজকে মনটা কেন জানি না প্রাশান্ত লাগছে। অরন্য মৃদু গলায় বলল
– হুম। তবে সময় কখন কোন প্রান্তে কাকে নিয়ে যায় বলা যায় না।
আবির অরন্যের কথা শুনে অরন্যের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল
– তোর হেয়ালি কথার মানে বুঝতে পারছি না।
– সব তুই বুঝবি না। সময় হোক এমনিই বুঝবি।
– সব বুঝতেও হবে না। শুন অরন্য আমার বিয়েটা হলে অপ্সরার দায়িত্ব হবে তোর অপরাজিতাকে তোর জীবনে নিয়ে আসা। জানো অপ্সরা অরন্য একটা গাধা এ পর্যন্ত তার ভালোবাসার মানুষটাকে এখনও ভালোবাসি বলতে পারেনি।
আমার চোখে মুখে তখন বিরক্তির ছাপ। আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম
– মানুষের সব চাওয়া তো পূরণ হয় না আবির। এমনও হতে পারে অপরাজিতা অন্য কারও হয়ে গেছে। অরন্য ভাইয়া কী জানে অপরাজিতা এখনও একা নাকি অন্য কেউ তার স্থান দখল করে আছে।
অরন্য আমার কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল
– আমি জানি আমার অপরাজিতা এখনও আমারেই আছে। সময়ের কড়ালগ্রাসে হয়তো একটু বদলে গেছে তবে তার সে বদলে যাওয়ার পেছনে যে অভিমানটা আছে সেটা ঠিকেই আমি ভালোবেসে ভেঙ্গে দিব।
অরন্যের কথা শুনে আবির বিস্মিত গলায় বলল
– তোর কী অপরাজিতার সাথে কথা হয়েছে?
– বলার সময় চলে যায়নি। এখন তুই চুপ কর তো আবির। বিশ্রাম কর। আর আন্টিকে বল তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে।আন্টি অনেকবার কল দিয়েছে আমি এটা সেটা বলেছি। এখন আন্টিকে বুঝানোর ব্যবস্থা কর। অপ্সরাকে দায়িত্ব দে, ও ঠিকেই বুঝিয়ে ফেলবে। ও আবার এসব ভালো জানে। কীভাবে কী করতে হবে ওর থেকে ভালো কেউ পারবে না।
– আরে অরন্য তুই কী অপ্সরাকে চিনিস নাকি? যেভাবে বলছিস মনে হচ্ছে তুই ওকে চিনিস।
অরন্য চুপ। দৃষ্টি নীচের দিকে। এদিকে আমার বুকের ভেতরটা প্রবল বেগে কম্পন দিচ্ছে। অরন্যের মতিগতি ভালো না কখন কী করে বসে বলাও যায় না। এর মধ্যেই অরন্য বলে উঠল
– আজকে চিনলাম ভালো করে। আমার এক্সিডেন্টের বিষয়টা এত সুন্দর করে হ্যান্ডেল করেছে যে কী বলব। সে বিশ্বাস থেকে বলছি।
– তা ঠিক বলেছিস। অপ্সরাকে যতদূর চিনি এটা ঠিক যে ওর মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রখর। জানিস অরন্য অপ্সরা আজকের এ পজিশনে এসেছে নাকি বড় একটা ধাক্কা খেয়ে। জানি না কী ধাক্কা তবে সে সত্যিই একটা সাহসী নারী।হতাশায় ডুবে না গিয়ে নিজেকে গড়ে নিয়েছে। এজন্যই অপ্সরাকে আমার অনেক পছন্দ।
আবির আর অরন্যের কথোপকথন যতই চলছিল ততই আমার অস্থিরতার মাত্রা বাড়তে লাগল। আবিরকে সবটা জানানো দরকার। সব জানার পর আবির যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মেনে নেব।সব আড়াল করে আমি আবিরকে এক প্রকার ঠকাচ্ছি যেটা আমার একদম উচিত হচ্ছে না।তবে এ মুহূর্তে আবিরকে বলা উচিত হবে না। আবির একটু সুস্থ হোক তারপর আবিরকে সবটা খুলে বলব। এখন এদের কথোপকথন আমাকে থামাতে হবে। তাই তাদের কথায় ব্যাগরা দিয়ে বললাম
– হয়েছে এখন এত কথা বলতে হবে না। আর আবির ঢাকা মেডিকেলের যে অবস্থা এখানে থাকার চেয়ে বাসায় চলে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। আর মাকে এখন কল দিয়ে এখানে আনার চেয়ে তোমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে মাকে সবটা বললে ভালো হয়। আর চিন্তা করো না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না।
আবিরও আমার কথায় সম্মতি দিল। আমি আবির আর অরন্যকে নিয়ে বাসায় গেলাম।বাসায় যেতেই মা আবিরকে আর অরন্যকে এ অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠল।আমি মাকে স্থিত গলায় বললাম
-মা চিৎকার করবেন না। আবির ঠিক আছে। তিনমাস একটু বিশ্রাম নিলেই হবে। আর মা চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।বিপদ আল্লাহ দেয় পরীক্ষা করার জন্য।অবশ্যই এ বিপদের পরিবর্তে উত্তম কিছুই রেখেছেন আমাদের জন্য। আপনি একটু স্থির হোন।
মা আমার কথায় কান্না থামাল। আমি আবিরকে খাটে শুইয়ে দিলাম।আপাতত আবির হাঁটা চলা করতে পারবে না। আবিরকে শুইয়ে আবিরের রুম থেকে বের হতে নিলাম আবিরের জন্য খাবার আনতে।অরন্যও আমার সাথে বের হলো। দরজা পার হতেই অরন্যের মাথাটা ঘুরে গেল।আমি হন্তদন্ত হয়ে অরন্যকে ধরলাম। কিছুটা শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে অরন্যকে শুইয়ে দিলাম। অরন্যকে শুইয়ে রুম থেকে বের হতে নিলেই অরন্য আমার হাতটা টেনে ধরে বলল
– অপরাজিতা প্লিজ যেও না পাশে একটু বসো।
অরন্যের প্রতি কেন জানি না হালকা মায়া জমলো।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে বের হতেই বুকটা কেঁপে উঠল। আবিরের মা দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমার চোখ মুখ আবছা হয়ে গেল ভয়ে। উনি আমাকে দেখে বলল
– আবিরকে খাবার দিয়ে এসেছি। আর তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে। আমার রুমে এসো।
কথাটা বলেই মা মায়ের রুমের দিকে এগুতে লাগল। আর আমি মায়ের পিছু পিছু যেতে লাগলাম। ভেতরটা কাঁপতে লাগল। মা রুমে প্রবেশ করল আমিও মায়ের সাথে রুমে প্রবেশ করলাম। মা খাটের কোণে বসে আমাকে তার পাশেই বসতে বলল। মায়ের মুখটা গম্ভীর । এটা নিশ্চিত মা এখন যে কথাটা বলবেন সেটা আমাকে নিয়েই। আমি চুপ হয়ে মায়ের পাশেই বসলাম। মা মুখটাকে আরও গম্ভীর করে আমার দিকে তাকাল। তারপর
চলবে