প্রাক্তন পর্ব-০৭

0
1090

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭

আমি দৌড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম। অরন্য তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আমি যতই ওর কাছে যাচ্ছিলাম ততই ভেতরটা মুচরে যাচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। এত বছর পর ওর সাথে এভাবে কথা বলব সেটা কখনও চিন্তাও করি নি। ওর কাছে গিয়েই বলে উঠলাম

– তোমার সাথে আমার কথা আছে।

অরন্য আমার জোরালো কন্ঠ শুনে আমার দিকে তাকাল। অরন্য তাকাতেই যেন আমার কথার জড়তা বাড়তে লাগল। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ সাবলীল কন্ঠে বলল

– কী বলতে চাও বলো?

– তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কী বলতে চাই। কিসের নাটক শুরু করেছো একটু বলবে? আবির তোমার কী হয়? আর কেনই বা অতীতটা সামনে আনতে চাচ্ছ? কী সমস্যা তোমার? সেদিন কোথায় ছিলে যেদিন সব কিছু লুকিয়ে আমাকে ছুরে ফেলে দিছিলে?

অরন্য চুপ হয়ে আছে। আর ঘন ঘন চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কী বলবে হয়তো বুঝতে পারছে না। আর এদিকে আমি এক নিঃশ্বাসে সব বলেই যাচ্ছি। এবার অরন্য আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতটা দিয়ে থামতে বলল। আমি কথা থামিয়ে চুপ হলাম।সে আমাকে বলল

– অপরাজিতা এত অস্থির হইয়ো না। তোমার মধ্যে অস্থির ভাবটা এখনও কমেনি।

– এ নামে ডাকার অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছ। আমি চাইনা তুমি আমায় এ নামে ডাকো।

– এ নামে ডাকার অধিকার হারায়নি। বরং তোমাকে হারিয়েছি।

– এত জোরালো করে বলছো কীভাবে যে অধিকার হারাও নি? তুমি যেদিন সব ছিন্ন করে দিয়েছো সেদিনেই তুমি সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছো। এখন কিসের অধিকার ফলাতে চাচ্ছ?

– তুমি হয়তো আমাদের বিয়ের বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেছ। তুমি আমার স্ত্রী সেটা ভুলে যেও না। আর তোমাকে এখনও আমি ডিভোর্স দিই নি। তুমিও দাও নি। সব কাগজ পত্র আমার কাছে আছে। একজন স্বামী বর্তমান রেখে কীভাবে কোন মুখে বিয়ে করতে চাইতেছ?

অরন্যের কথা শুনে মন চাচ্ছিল তার গালে কষিয়ে একটা চড় দেই। তবে অরন্য যে খেলা শুরু করেছে সেটার শেষ আমাকেই করতে হবে। রাগের মাথায় তাকে কিছু বললে বিষয়টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এ মুহূর্তে অরন্যের মনে কী চলতেছে সেটা জানার সাধ্য আমার নেই। তবে জানার চেষ্টা করা উচিত। আমি হালকা গলায় বললাম

– আমিও চাই তোমার কাছে ফিরে যেতে। আমিও তোমাকে এতদিনে ভুলতে পারি নি৷ আর তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। অরন্য তুমি আর কিছুদিন আগে আসলে এতটা ঝামেলা তো হত না। আবির নামক কোনো বাঁধা আমার জীবনে থাকত না। আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম তুমি আর আসবে না। কারণ তুমি তো অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছিলে। কিন্তু তুমি যে আমার জীবনে ফিরে আসতে চাইতেছ সেটা কী তোমার বউ জানে? মানে নাফিসা কী সেটা মেনে নিবে।

– চলো একটু ভেতরের দিকে বসে কথাগুলো বলা যাক। আমি জানি তুমি আমাকে এখনও ভালোবাসো। আর সে ভালোবাসাটা আমি তোমার চোখে এখনও দেখতে পাই বলেই তোমার অতীত সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি৷ কখনও তোমার সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি। যেদিন তোমার মুখোমুখি হলাম সেদিন এমন পরিস্থিতিতে হব চিন্তা করে নি। হয়তো সেদিনেই তোমাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ আল্লাহ করে দিছেন। নাহয় তো তোমার সামনে যাওয়ার সাহস আমার হত না।

বলেই দম ছাড়ল অরন্য। অরন্যের কথাটা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না। আমি চাপা গলায় বলল

– ঘটনা নাহয় এক জায়গায় বসে শুনা যাবে। এখন একটু শান্ত হও। আবির কেমন আছে?

– আবির ভালো এখন। ওকে বেডে রেখে এসেছি।

– দেরিতে গেলে সমস্যা হবে না তো?

– সমস্যা হবে না।ও এখন ঝুঁকি মুক্ত।আর মোাবইল তো আছে কিছু হলেই কল দিবে।

– তোমার ডিউটি?

– আজকে রাতে ডিউটি, দিনের বেলায় নেই।

– তাহলে চলো মেডিকেলের পাশে শহীদ মিনারটায় বসি।

– চলো যাওয়া যাক।

অবশেষে মনের সকল প্রশ্নের সমাধান আজকে হতে চলল। বেশ প্রশান্তি নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগুতে লাগলাম। এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে আবারও ডুব দিলাম।

সেদিন অরন্যকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই অরন্যের একটা বদঅভ্যাস ছিল ফোন বন্ধ করে ফেলা। আমি অরন্যের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম ঢাকা মেডিকেলে। অরন্যের সাথে কী নিয়ে যেন ঝগড়া বেঁধে বসে। যার ফলে সে আমাকে রেখে মেডিকেলের ভেতর ঢুকে যায়। এদিকে আমি শহীদ মিনারে বসে আস্তে আস্তে কাঁদতে লাগলাম। রাস্তাঘাট চিনি না বাসায় যাব কী করে সেটা ভাবতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার কল দিলাম অরন্যের নম্বরে বারবার বন্ধ বলছিল।অসহায় লাগছিল খুব।সে সাথে অরন্যের উপর অভিমান।সব মিলিয়ে চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আধঘন্টা তো হবেই।এবার আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না।বাসায় যেতে হবে। তবে পথ ঘাট তো চিনি না। শহীদ মিনারের এক কোণে এক ছেলে বসে সিগারেট টানছিল।বেশ ভয় হচ্ছিল তবুও ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম

– এখানে বাস পাওয়া যায় কোথায়? আর এ বাস কী খিলক্ষেত যাবে?

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।বুঝায় যাচ্ছিল ছেলেটা নেশায় ডুবে আছে। আমার তো এদিকে ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। কোনো কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে রাস্তার পাশে এসে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম পিঠে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। অরন্যকে দেখেই আমার অভিমানটা আরও গাঢ় হলো। রাগে বলে উঠলাম

– ছাড়ো আমায়। একদম কাছে আসবে না। ফেলে গিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলে যখন তখন একবারও কী ভেবেছিলে আমার কথা?

– ফেলে রেখে যায় নি। আড়াল থেকে সব দেখছিলাম। কতদূর যেতে পার ভাবছিলাম। এত বোকা একটা মেয়ে। এখন দেখি একটু বেশি পরিমাণ কাঁদছো। তাই আসলাম। একা যেতে দিতাম নাকি। ঠিকেই তোমার পিছু নিতাম। কারণ যত বকা দাও আর রাগ দেখাও আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। বড্ড ভালোবাসি তোমায় অপরাজিতা।

আমি মুহূর্তেই গলে গেলাম। মুখটা ভার করে বললাম

– রাগ দেখাও বকা দাও যা ইচ্ছা করো ফোন বন্ধ করবা না বলো।

– ফোন তো আর ইচ্ছা করে বন্ধ করি না।ফোন বন্ধ করলেই তোমার ত্যাড়ামো কমে। এর আগে না।এবার চোখটা মুছো। নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে।

বলেই টিস্যু হাতে নিয়ে চোখ চেপে চেপে মুছতে লাগল। এমন সময় অরন্য ডেকে বলল

– অপরাজিতা। কী ভাবছো? বসো এখানে?

সিঁড়িতে বসে ঠিক পাশেই হাতে ইশারা দিয়ে বসতে বলল। অভিমানঘন মধুময় অতীত থেকে বর্তমানের বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম পুনরায়। অরন্যের ঠিক পাশেই বসলাম। অরন্য হালকা গলায় বলল

– মনে আছে ঐদিনের কথা যেদিন বাসায় যাওয়ার জন্য কোন বাসে যেতে হয় বুঝতে না পেরে একা একা ঐ জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে।

অরন্যের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার মতো সে ও সেই অতীতে ডুব দিয়েছিল। তাহলে কী আমার মনে যা চলছে অরন্যও সেটা ভাবছে নাকি এটা তার মিথ্যা ছলনা মিথ্যা নাটক। আমি কোনো কথা না বলেই অরন্যের পাশে বসলাম। এবার তীব্র কন্ঠে অরন্যের দিকে প্রশ্ন ছুরে বললাম

– তোমার স্ত্রী নাফিসা কোথায়? আর আবির কেন তোমার স্ত্রী এর ব্যপারে কিছু জানে না?

অরন্য দম নিল। চোখ গুলো তার ছলছল করতে লাগল। আমার দিকে তাকাল তারপর অসহায় গলায় বলল

– তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কতটা?

সহজ গলায় জবাব দিলাম

– একদম বিশ্বাস করি না। বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।

– বিশ্বাস না করলে ও এ কথাগুলো শুনে তোমার বিশ্বাস হবে। প্রয়োজনে যাচাই করে নিও।

– কী কথা বলো।

অরন্য চুপ। সে চুপ হয়ে একা একা কথাগুলো স্থিত গলায় আওড়াতে লাগল। হয়তো কথাগুলো সে গুছাচ্ছে। তারপর

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে