প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
1999

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩৫
#তানজিলা_খাতুন_তানু

মিহানের মা কথাটিকে কোনোরকমে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন,

– অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

মিহানের বাবা কথা না বাড়িয়ে ঘুমাতে চলে গেলেন। উনি ভালো করেই জানেন,তার স্ত্রী তাকে কিছুই বলবে না তাই জোর করে লাভ নেই। স্বামী ঘুমাতে চলে যেতেই উনি নিজের ভাবনাতে বিভোর হয়ে গেলেন,

মিহান ওনার নিজের সন্তান নয়। মিহানের মা মা/রা যাবার পর, ওনার সাথে মিহানের বাবার বিয়ে হয়। সকলের সামনে উনি মিহানকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও পেছনে একদমই ভালোবাসতেন না। মিহানের মায়ের অর্থাৎ সৎ মায়ের আগের পক্ষের একটা ছেলে ছিল তবে মিহানের বাবার সাথে বিয়ের সময়ে উনি ওনার সন্তানকে নিয়ে আসতে পারেননি। নিজের ছেলের থেকে দূরে থাকার সমস্ত ক্ষো’ভটা মিহানের উপরে গিয়ে পড়ে। মিহান বড়ো হবার সাথে সাথে উনি মিহান কে বদ অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে ফেলতে ছিলেন। সবকিছু নিজের গতিতেই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই মিহানের লাইফে অতসী আসে আর মিহান নিজেকে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

মিহানের এই কাজে ওর সৎ মা প্রচন্ড রেগে যায়। একদিন মিহান কে নিজের কাছে ডেকে পাঠান।

– মা আমাকে ডাকছিলে?
– হ্যাঁ। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– কি বলো।

মিহান ছোট বেলা থেকেই ওর সৎ মাকেই নিজের মা হিসাবে জানত। আর মাকে খুব ভালোবাসে,কখনোই মায়ের কথার অবাধ্য হয়নি।

– তুই কি কারোর সাথে রিলেশন করছিস?

মায়ের প্রশ্নে মিহান কিছুটা খুশি হয়।‌ওহ তো এটাই চাইছিল, কিন্তু মাকে বলে উঠার সাহস পাচ্ছিল না।

– হ্যাঁ মা।
– কাকে নিশ্চয় জিনিয়াকে তাই না।

জিনিয়ার নামটা শুনে মিহান চমকে উঠল।

– জিনিয়া মানে?
– কেন। তোর সাথে তো জিনিয়ার বিয়ের কথা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তুই জানতিস না।

মিহান একের পর এক চমক পাচ্ছে।

– মা আমি জিনিকে নয় জিনির বন্ধু অতসী কে ভালোবাসি।
– কিন্তু বাবা। তোর আর জিনিয়ার বিয়ে তো‌ ঠিক করা আছে। আর তোদের বিয়েটা না হলে তোর মামা প্রচন্ড রেগে যাবে আর তোর বাপির কোম্পানিতে অনেক বড়ো লস করে দেবে। তুই প্লিজ অতসীকে ভুলে যা।
– কিন্তু মা আমি অতসীকে খুব ভালোবাসি। আমি কিভাবে ওকে ভুলব।
– আমি তো তোর মা। আমি তো কখনোই তোর থেকে কিছু চাইনি আজকে এটা চাইছি এটাও দিবি না।

মিহানকে নানারকমের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে অতসীর থেকে মিহানের মনটা ঘুরিয়ে দিতে শুরু করলেন। আবার অন্যদিকে, জিনিয়ার কাছে অতসী আর মিহানের সম্পর্কের কথাটা বলে জিনিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলল।

সবকিছুই ওনার প্ল্যান মতোই চলছিল, কিছু হঠাৎ করেই মিহান আবারো অতসীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তে লাগল। তখনি মিহানের সৎ মা নিজের আসল রূপ দেখালেন…

মিহানকে আবারো ডেকে পাঠালেন উনি।

– মিহান তুমি আবারো অতসীর সাথে যোগাযোগ করছ, এইসব কি শুরু করেছ তুমি।
– মা আমি অতসী কে খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।
– আমি কিন্তু আমার কথার খেলাপ করা পছন্দ করিনা।
– মানে?
– তুম যদি আবারো অতসীর সাথে সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করো তাহলে আমি কিন্তু অতসীর ক্ষ/তি করব।
– কি বলছো এইসব মা।
– হ্যাঁ ঠিক বলছি। ভালোই ভালোই বলছি নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে মিহান।
– মা তুমি এইসব কথা বলছ কেন?
– বেশি কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। আমার অবাধ্য হবার চেষ্টা করো না, তুমি অবাধ্য হবে তার জন্য আমি এতদিন তোমাকে মানুষ করিনি।
– মা আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তুমি আমার নিজের সন্তান নয়।
– কি?
– হ্যাঁ। তোমার মা মা/রা যাবার পর তোমার বাবা তোমাকে দেখাশোনার জন্য আমাকে নিয়ে আসে। আমি তোমাকে মানুষ করার জন্য আমি আমার নিজের সন্তানকে বির্সজন দিয়েছি। আর আজকে তুমি আমার কথার অবাধ্য হচ্ছো। তুমি না যদি আমার কথা শোনো তাহলে আমি এই সংসার থেকে থেকে চলে যাবো।

মিহান আর সহ্য করতে পারছে না। আর মাকে বড্ড ভালোবাসে, সে চলে যাবে এটা মেনে নিতে পারবে না। মিহান কোনো উপায় না পেয়ে জিনিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।

মিহানের মা এইসব টাই করেছে জিনিয়ার বাবার সম্পত্তির জন্য। জিনিয়া ওর মা বাবার একমাত্র সন্তান, ওর বাবার পরে সবকিছুর মালিক জিনিয়া হবে। আর জিনিয়ার মাঝে মিহানের মা সবকিছুর রাজ করবে।

পরেরদিন,

অতসী কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার সময়ে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। অতসী দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে গেলে রুদ্র বলল,
– বোন।
– এইখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না আমি।
– প্লিজ আমার সাথে চল। তোকে বাড়ি ফিরতে হবে না, তুই আমার সাথে চল আমি তোকে কিছু কথা বলতে চাই।

অতসীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে, রুদ্র আবারো বলল,

– প্লিজ বোন চল।

রুদ্রের আকুতি ভরা কন্ঠ অতসী ফেরাতে পারল না। বাবার উপরে যতই রাগ, অভিমান, অভিযোগ থাকুক না কেন দাদাভাইকে তো প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। রাগ দেখিয়ে, অভিমান করে এতদিন চোখের আড়ালে থেকেছে তবে আড়াল থেকেও রুদ্রের খবর রেখেছে প্রতিনিয়ত।

– আচ্ছা চলো।

রুদ্র খুশি হয়ে অতসী কে নিজের বাইকে চাপিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। আগে ছোটবেলাতে রুদ্রের বাইক চড়ে সারা এলাকা ঘুরে বেড়াত অতসী, আজ কতদিন পর আবারো রুদ্রের বাইকে উঠছে ভাবতেই দুচোখে ভর্তি পানি এসে গেল অতসীর।

আয়নায় অতসীর চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে দেখে মৃদু হাসল রুদ্র। ছোট থেকে বড্ড আদরে মানুষ করেছে অতসীকে অথচ সেই আদরের দুলালীই গত ৫বছর ধরে কতটাই না সেক্রিফাইস করে যাচ্ছে।

রুদ্র অতসী কে নিয়ে একটা কফি শপেতে আসলো। কফি শপটা ওদেরই তাই ওরা আসতেই ম্যানেজার একটা ফাঁকা প্লেস ওদের জন্য দিয়ে দিলো। এখনকার আপ্যায়ন দেখে অতসীর বুঝতে অসুবিধা হলো না, কফি শপটা কার। তবুও রুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,

– এটা কার।

রুদ্র কিছু বলল না। অতসী আবারো জিজ্ঞেস করল,
– নতুন হয়েছে।
– হুম।

একজন ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই অতসী নিজের নিরবতা ভেঙে বলল,
– কি জন্য আনলে বলো।
– হয়তো কথাগুলো বললে তুই ভাববি আমি মিথ্যা বলছি, অথবা বানিয়ে বলছি। কিন্তু কথাগুলো একদম সত্যি।

অতসী রুদ্রের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রুদ্র কি বলতে চাইছে সেটা বুঝতে পারছে না।

– কি কথা।
– সেই রাতে তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর। আমরা রাতে কোনো কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু পরেরদিন সকালে মা তোকে খুঁজতে গিয়ে যখন পাই না, আর তার বদলে একটা চিঠি থাকতে দেখে। তখন মা কান্নাকাটি করতে শুরু করে।

ফ্ল্যাশব্যাক…

– কি হয়েছে তুমি এইভাবে কান্নাকাটি করছ কেন?
– তোমার জেদের কারনে আমি আমার ছোট মেয়েটাকেও হারিয়ে ফেললাম। আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করব না।

স্ত্রীয়ের কান্না দেখে আকরাম খাঁন কিছুই বুঝতে পারেন না। উপরিউক্ত প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হয়ে পড়েন।

– কি হয়েছে সেটা কি বলবে তুমি। নাকি আমি বেড়িয়ে যাবো।

কাঁদতে কাঁদতেই অতসীর মা স্বামীর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। আকরাম খাঁন প্রচন্ড পরিমানে বিরক্ত হয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন,

বাবা/মা,

প্রিয় বলেই সম্বোধন করলাম না। কারন আপনাদের নিজ স্বার্থ আমার প্রিয়স্থান থেকে আপনাদের সরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। বাবা আপনি যখন আমাদের ফিরিয়ে আনতে গেলেন, আমি সত্যি ভেবেছিলাম সবকিছু হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে দিয়ে আপনি শুধুমাত্র আমাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি যে কারোর প্রয়োজনে প্রিয়জন হতে চাই না, প্রিয়জনে প্রয়োজন হতে চাই। তাই আপনার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলাম। আমি একাই একার খরচ চালিয়ে নিতে পারব আশা করি। ভালো থাকবেন আর মাকে দেখে রাখবেন।

ইতি,
অতসী।

পুরানো কথাগুলো মনে করে রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতসী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।

– সেই ঘটনার পর মা বাবাকে দোষ দিতে থাকে। নিজের জেদের কারনে দুই মেয়েই ঘরছাড়া হয়ে যাবার শোকটা উনি সহ্য করতে না পেরে হার্ট এ্যা/টাক করেন।
– কি?
– হ্যাঁ। গত ৬মাস হসপিটালে বেডে শুয়ে মৃ/ত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁ/চে ফিরে এসেছেন। শুধুমাত্র তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে। সুস্থ হবার পর তোকে তন্নতন্ন করে সব জায়গাতেই খুঁজে বেড়িয়েছে, কিন্তু যে মানুষ নিজে থেকে লুকিয়ে থাকে তাহলে কি তাকে খুঁজে পাওয়া যায়!
– আমার বাবা মনে হয় ওনার আর একটা মেয়ের কথা ভুলেই গেছেন।
– জানি না রে। রুহির কথা উঠলেই বাবা কিরকম একটা গম্ভীর হয়ে যান। তবে আমার কি মনে হয় জানিস যদি কখনো তোরা দুইবোন বাবার সামনে‌ গিয়ে দাঁড়াস তাহলে দেখবি বাবা কখনোই তোদের থেকে মুখ ফেরাতে পারবে না।
– কে জানে। আর যে মানুষটা বেঁ/চেই নেয় সে কিভাবে কারোর‌ সামনে গিয়ে দাঁড়াবে!

কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যের হাসল অতসী। রুদ্র কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
– মানে?

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩৬
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– কে জানে। আর যে মানুষটা বেঁ /চেই নেয় সে কিভাবে কারোর‌ সামনে গিয়ে দাঁড়াবে!

কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যের হাসল অতসী। রুদ্র কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
– মানে?

– দিদিভাই আর এই পৃথিবীতে নেয়।

রুদ্র কথার বলার মতো শক্তি হারিয়ে ফেল। অতসী নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।

– বোন তুই এইসব কি বলছিস? রুহি নেয় মানে কি?
– বেবি হবার সময় দিদিভাই মা/রা যায়।

কথাটা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অতসী। রুদ্রের চোখেও পানি চিকচিক করছে,

– দাদাভাই আমার ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

অতসী রুদ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইল। অতসী ভালো করেই জানে এখন রুদ্রের সামলে থাকলে কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না। তাই চলে যাওয়াটাই শ্রেয়।

অতসী উঠে চলে যেতে যাবে তখনি রুদ্র ওকে ডেকে বলল,

– বোন।

অতসী পেছন ঘুরে তাকাতেই রুদ্র অতসী কে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে পানির উপস্থিতি দেখে অতসীর বুঝতে অসুবিধা হলো না রুদ্র কাঁদছে। অতসীর চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ল।

– বোন কেন আমাদের সাথে এইরকম হলো। রুহিকে শেষ দেখাও দেখতে পারলাম না। আর না মেয়েটার জন্য কোনোদিন কিছু করতে পারলাম।

অতসী কিছু বলল না, চুপচাপ কথাটা শুনে গেল। শান্ত হয়ে যে যার মতো রাস্তাতে চলে গেল। রুদ্রর ভালো করেই জানে অতসী কে জোর করে কিছু করানো যাবে না, যা করতে হবে সবকিছুই ওর ইচ্ছাতে করতে হবে।

সন্ধ্যায় আরুকে পড়াতে গিয়েই আদৃতের মুখোমুখি হয়। দুজন দুজনের সাথে কোনো কথা না বলেই যে যার মতো চলে যায়।

এইভাবেই কেটে যায় কয়েকটা দিন। রুদ্র এখনো‌ বাড়ির কাউকে রুহির বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি।প্রতিবার বলতে গিয়েও আটকে গেছে।

রুদ্রকে কয়েকদিন অন্যমনস্ক থাকতে দেখে ওর স্ত্রী বলল,

– কি হয়েছে তোমার। এতটা অন্যমনস্ক লাগছে কেন তোমাকে।
– অনেককিছু সত্যি জানতে পেরেছি।
– কি?
– রুহি আর বেঁ/চে নেই।
– কি!

রুদ্রের স্ত্রী সামিয়া চমকে উঠল। রুদ্রের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে শান্তনা দিলো।

– মন খারাপ করো না। মানুষের আ’য়ু চিরকালের নয়। রুহির আ’য়ু অতটাই ছিল তাই তাকে যেতে হয়েছে। মন খারাপ করো না।
– রুহি আর আমি ছোট থেকেই বন্ধুর মতো বড়ো হয়েছি, যখন বাড়ি থেকে চলে গেল তখনি বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি রুহির খোঁজ করেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। আমি জানতাম না ও কার সাথে বিয়ে করেছে, কোথায় বাড়ি তার, কোনো কিছুই জানতাম না। হ্যাঁ এটা ঠিক যখন বোন আর মাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন রুহির উপরে আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। তবে কখনোই ভাবতে পারিনি ওহ আমাদের এইভাবে ছেড়ে চলে যাবে।
– কি করবে বলো।
– আমি কিভাবে কথাগুলো মা বাবাকে বলব বুঝতে পারছি না।
– সত্যিটা তো তাদেরকে বলতেই হবে।
– হুমম। আজকে রাতেই বলবো।
– আচ্ছা।

রাতে খাবার পর রুদ্র সবাইকে কিছু বলবে বলে বসিয়ে রেখেছে। ওহ আগেই বলতে পারত, কিন্তু কথাটা শোনার পর আর কেউই কিছু মুখে তুলবে না।
তাই খাবার পরেই কথাটা বলবে ঠিক করল।

– কি বলবি বলে এইভাবে বসিয়ে রেখেছিস আমাদের। বল এইবার অনেকক্ষণ তো হলো।
– আসলে বাবা,
– কি বল।
– রুহি..
– আমি তোকে বারন করেছি ওই মেয়ের নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবি না। ওই মেয়ের মুখও তো‌ দূর, নামও শুনতে চাই না।
– আর কখনো ওর মুখ তোমাকে দেখতেও হবে না।
– মানে, কি বলছিস তুই? (অতসীর মা।)
– মা রুহি আর বেঁ/চে নেই।

কথাটা শুনে সকলে থমকে গেল। আকরাম খাঁনের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না, অতসীর মা কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,

– এইসব তুই কি বলছিস?
– হ্যাঁ মা। রুহির ডেলিভারির সময়ে কন্ডিশন খারাপ থাকাতে ওকে বাঁ/চানো যায়নি।

অতসীর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
– মেয়েটাকে শে/ষ দেখা দেখতেও পারলাম না।

অতসীর মা কান্নাকাটি করলেও আকরাম খাঁন পুরোই স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। সামিয়া শাশুড়িকে শান্ত করতে লাগল।

– সামিয়া তুমি তোমার মাকে নিয়ে ঘরে যাও।
– হুম।

সামিয়া শশুরের আদেশ শুনে শাশুড়িকে নিয়ে চলে গেল। ওনারা চলে যেতেই আকরাম খাঁন রুদ্রের উদ্দেশ্য বললেন,

– তুমি এই কথাটা কোথায় জানলে? আর কবে হয়েছে এইসব?
– বোন বলল। আর ঘটনাটা অনেক দিন আগের প্রায় ৫বছর আগে।
– এতদিনের কথা অতসী কিভাবে জানল? তাহলে অতসী কি রুহির শশুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে!

উত্তরটা রুদ্রের জানা নেয় তাই চুপ করে থাকল। আকরাম খাঁন নিজের ঘরে চলে গেলেন। রুদ্র খানিকটা অবাক হলো, ওহ ভেবেছিল রুহির কথাটা শুনে ওর বাবা আহত হবে কিন্তু তার কোনো কিছুই না হওয়াতে কিছু একটা খটকা লাগছে।‌ তাহলে কি আকরাম খাঁন আগেই এই সত্যিটা জানতেন?

আকরাম খাঁন নিজের রুমে না গিয়ে স্টাডি রুমে গিয়ে সিগারেট ধরালেন। এই বদ অভ্যাসটা আগে ওনার ছিল না, কিন্তু একাকিত্ব কাটিয়ে উঠতে উঠতে ওটাই সঙ্গী হয়ে উঠেছে। স্ত্রী ২ বছর আগে ফিরে আসলেও আগের মতো সম্পর্কটা নেই, মেয়েদের হারিয়ে উনি সবসময়েই স্বামীকেই দায়ী মনে করেন। আকরাম খাঁন সেটা চাইলেও আটকাতে পারেন না। আরামকেদারায় বসে বসে আকরাম খাঁন নিজের ভাবনাতে ব্যস্ত ছিলেন। তখনি কি মনে করে অতসীর নম্বরে ফোন করলেন,

দ্বিতীয়বারের মাথাতে কলটা রিসিভ হলো। অতসী কলটা রিসিভ করেই বলে উঠল,

– হ্যালো‌ কে বলছেন।
– আমি বাবা বলছি।

চেনা কন্ঠস্বর শুনে অতসী ফোনটা কেটে দিতে যাবে তার আগেই ওর বাবা বলল

– কলটা কাটবে না একদম। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
– কি কথা, সেই তো‌ বলবেন ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
– কেন সম্ভব নয়। এই সবকিছুই তো তোমার, তুমি আমার রাজকন্যা হয়ে কেন ভিখারীর মতো বাস করছ।
– ভিখারীর মতো বাস করলেও শান্তিতে আছি। যেটা আপনার কাছে থাকলে হয়তো পেতাম না। আমি কখনোই আপনার মিথ্যা জেদের কাছে মাথা নোয়াতে আমি পারব না।
– ঠিকাছে তুমি যা বলবে তাই মেনে নেব আমি। কোনো কিছু নিয়ে জেদ করব না ফিরে এসো।

কথাটা শুনে অতসীর মাথাতে কিছু একটা খেলে যায়।‌ ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
– ঠিক বলছেন? যা বলব তাই মেনে নেবেন।
– হ্যাঁ। (শান্ত কন্ঠে)

অতসীর মুখের হাসিটা আরো চওড়া হয়ে গেল। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

– তাহলে কালকে ঠিক সন্ধ্যা ৬টাই … রেস্টুরেন্টে দেখা করবেন।

আকরাম খাঁন একটু না অনেকটাই অবাক হলো। অতসী তার সাথে নিজে থেকে দেখা করতে চাইছে, এর পেছনে কি কারন থাকতে পারে সেটাই বুঝতে পারলেন না।

– ঠিকাছে তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। রাখছি।

অতসী কলটা কেটে দিয়ে মুচকি হাসল। আকরাম খাঁন চিন্তিত হয়ে গেলেন, মেয়ের মাথাতে আসলে কি ঘুরছে সেটা আন্দাজ করে উঠতে পারলেন না। অপেক্ষা করতে লাগলেন আগামীকাল সন্ধ্যার।

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩৭
#তানজিলা_খাতুন_তানু

পরেরদিন, অতসী বেশ খোশমেজাজেই দিনযাপন করতে লাগল। কলেজে আসলেও শাহানার মুখোমুখি হতে হয়নি, কোনো কারন বশত শাহানা কলেজে আসেনি। অতসী মিতুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, আজকে আরুকে একটু তাড়াতাড়ি পড়তে যাবে। মিতুও অমত করেনি। অতসী দুটো ক্লাস করেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, তারপরে ফ্রেশ হয়ে টিউশনি পড়ানোর জন্য বেড়িয়ে গেল।

অতসী এখন শুধুমাত্র দুজনকেই টিউশনি করায়। আরু আর অন্য একজনকে। অতসী বেড়িয়ে গেল, পরনে একটি সালোয়ার কামিজ। অন্য দিনের তুলনায় অতসী কে একটু অন্যরকম লাগছে, একটু বেশিই ফ্রেশ লাগছে।

আদৃত অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে, ড্রইংরুমেই বসে ছিল‌। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে অতসী কে দেখে একটু অবাক হলো,

– কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি আজকে?
– একটু কাজ আছে। (শান্ত কন্ঠে)

আদৃত আর কিছু বলল না।‌ অতসী আরুর রুমের দিকে এগিয়ে গেল। আদৃত অতসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
– আজকে অতসী একটু হ্যাপি হ্যাপি লাগছে যেন।

অতসী আরুকে পড়িয়ে দিয়ে, বাবার সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে গেল। অতসী পোঁছে দেখল, আকরাম খাঁন ইতিমধ্যেই ওইখানে উপস্থিত হয়ে গেছেন। অতসীকে দেখা মাত্রই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

– কেমন আছো?
– ভালোই চলছে।
– বসো।

আকরাম খান খাবার অর্ডার দিলেন।

– আমি কিন্তু কিছু খাবো না।
– কেন?
– আপনার টাকাতে আমি পানিও খাবো না।

অতসীর কথাটা শুনে আকরাম খাঁন আহত হলেন। আজকের দিনেও অতসীর মুখে এই কথাটা শুনবেন আশা করেনি। তিনি অনেক আশা নিয়ে এসেছেন যে অতসী এইবার তার সাথে তার বাড়ি ফিরবে।

– অনেক তো‌ হলো, এইবার ফিরে চলো।
– ফিরতে পারি, তবে একটা শর্তে।
– কি শর্ত।
– দিদিভাইকে মেনে নিতে হবে।
– কিন্তু রুহি তো বেঁ/চেই নেই। (ভ্রু কুঁচকে কথাটা বললেন)
– দিদিভাই না থাকলেও, দিদিভাইয়ের স্বামী সন্তান তো আছে। তাদেরকে আপনাকে মেনে নিতে হবে, তবেই আমি ফিরব।
– কখনোই না।
– তাহলে আমিও ফিরব না।
– কেন একটা বাইরের মেয়ের জন্য এত জেদ করছ অতসী।

আকরাম খাঁন প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে কথাটা বলল। কথাটার অর্থ অতসীর ঠিক বোধগম্য হলো‌ না, তাই বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করল,

– দিদিভাই আপনার সন্তান। আর তাকে আপনি বাইরের মেয়ে বলছেন।
– ভুল জানো।
– কি ভুল জানি।

আকরাম খাঁন নিশ্চুপ থাকল। অতসী পুনরায় প্রশ্নটা করতে আকরাম খাঁন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– রুহি আমার সন্তান নয়।

কথাটা অতসীর কাছে বজ্রাঘাতের মতো লাগল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– দিদিভাই পালিয়ে বিয়ে করেছিল বলে, আপনি তাকে নিজের মেয়ের্ পরিচয় থেকে বঞ্চিত করছেন? ছিঃ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলেন আপনি।

কথাগুলো বলতে বলতে অতসীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার বাবার প্রতি অনেক অভিযোগ থাকলেও তার কাছ থেকে এইটা আশা করেনি।

– অতসী তুমি আমাকে ভুল ভাবছ। আমি একটা কথাও মিথ্যা বলছি না।
– আবার আপনি বলছেন মিথ্যা বলছেন না। দিদিভাই আর দাদাভাই যদি আপনার সন্তান না হয় তাহলে তার পরিচয় কি?
– এই চরম সত্যিটা আমি এতদিন নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলাম। এই কথাটা আজ পর্যন্ত তোমার মাকেও জানতে দিইনি।‌ কিন্তু তুমি রুহিকে নিয়ে যা শুরু করেছ, আজকে আমি কথাগুলো বলতে বাধ্য হচ্ছি। তোমার আর আমার একমাত্র সন্তান তুমি। রুদ্র আর রুহি আমাদের সন্তান নয়।

অতসীর এখনো কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। ওহ ভাবছে ওর বাবা ওকে বোঝানোর জন্য কথাগুলো বলেছেন।

– রুহি ও রুদ্রের সাথে তোমার আমার কিংবা আমাদের পরিবারের কারোর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। যেই রাতে তোমার মা প্রসব যন্ত্রনায় হসপিটালে ভর্তি হয়, সেইরাতে…

আকরাম খাঁন নিজের স্ত্রীয়ের চিন্তাতে চিন্তিত হয়ে হসপিটালের করিডরে পাইচারি করে চলেছেন, তখনি তার লক্ষ্য পড়ে ওয়ার্ড বয়’রা একজন প্রেসেন্টকে হন্তদন্ত হয়ে নিয়ে আসছে। মহিলাটি যন্ত্রনায় ছটফট করে চলেছে। মহিলাটির দিকে চোখ পড়তে আকরাম খাঁন চমকে উঠলেন। মানুষটা যে তার বড্ড চেনা, তার একসময়ের প্রিয় বান্ধবী। সময়ে গতিতে আগের মতো আর যোগাযোগ হয় না, বান্ধবীও বিয়ে করে সংসার করছে আর উনিও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আজকে এইভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি।

আকরাম খাঁন এগিয়ে আসবে তখনি ডক্টর বেড়িয়ে আসলেন। আর উনি ডক্টরের সাথে কথা বলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

– ড. আমার স্ত্রী কেমন আছেন।
– বেবির কন্ডিশন ভালো না, যতটা সম্ভব আমরা বেবিটিকে বাঁচাতে পারব না। আপনি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিন।

আকরাম খাঁনের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। স্ত্রী কিংবা প্রথম সন্তানকে হারাতে উনি রাজি নন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না।

আকরাম খাঁন মাথাতে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। শশুড় বাড়ির লোক এবং নিজের বাড়ির লোক সকলেই ওনাকে শান্তনা দিতে লাগলেন। হঠাৎ করেই একটা গুঞ্জন শোনা গেল, আকরাম খানের মাথাতে তার বান্ধবীর কথা আসতেই সে এগিয়ে যেতে লাগল। পেছন পেছন তার শশুরমশাই গেলেন।

আকরাম খাঁন এগিয়ে এসে একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হয়েছে।
– একজন প্রেসেন্ট এসেছেন, শারিরীক কন্ডিশন ভালো না।
– প্রেসেন্টের নাম কী?
– টুসি।
– ওনার বাড়ির লোক কেউ আসেনি।
– না। যতটা শুনলাম উনি একাই থাকেন, ডির্ভোস হয়ে গেছে অনেক আগে।

নার্স চলে গেল। কিছুক্ষন পর বাচ্চার কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। আবারো সেই নার্সটা বেড়িয়ে আসলেন, আকরাম খাঁন তখনো ওইখানে অপেক্ষা করছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, ওইখানে তো সবাই আছে কিন্তু এই অসহায় মেয়েটার কাছে কেউ নেই তার থাকা উচিত। আকরাম খাঁনের শশুর মশাই সবটা দেখে এগিয়ে এসে আকরাম খাঁনের কাঁধে হাত দিলো।

– বাবা আপনি এইখানে,রিমা ঠিক আছে তো।
– হ্যাঁ। তুমি মেয়েটাকে চেনো?
– হাঁ।
– আচ্ছা। সবাই ওইখানে আছে, তুমি বরং এইখানে থাকো।

আকরাম খাঁন কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন। নার্সটা কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে আসলেন, তাকে দেখা মাত্রই আকরাম খাঁন বললেন,

– নার্স টুসি কেমন আছে?
– কন্ডিশন ভালো না।
– আর বেবি।
– হ্যাঁ ভালো আছে। আর একটা গুড নিউজ আছে, ওনার জমজ সন্তান হয়েছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।
– আমি কি ওনার সাথে দেখা করতে পারি।
– আচ্ছা যান।

আকরাম খাঁন কেবিনে ঢুকলেন। টুসি বেডে শুয়ে আছে।
– টুসি।

আকরাম খাঁনকে দেখে উনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।

– আকরাম তুই এসেছিস।

কথাটা বলতে বলতে কেঁদে দিলেন।

– আরে কাঁদছিস কেন?
– আমি আর বাঁ/চবো না, আমার সন্তানগুলোর কি হবে রে।
– তোর কিছু হবে না।
– নারে আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই বাচ্চার কারনেই আমার জীবনে এতকিছু হয়ে গেল আর সেই বাচ্চা যখন হলো তখন আমার জীবনের সময় শে/ষ হয়ে গেল।

বিয়ের অনেক বছর হয়ে যাবার পর যখন টুসির কখন সন্তান হচ্ছিল না তখন ওনার পরিবার ওর স্বামী ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে খারাপ হতে হতে শেষ পর্যন্ত ডির্ভোস হয়ে যায়। আর তারপরেই উনি প্রেগন্যান্ট হয়। আর এই কথা পরিবারকে জানানোর পর বাপের বাড়িতেও ওনার ঠাঁই হয় না, সকলেই ভাবেন উনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে, অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কোনোরকমে জীবনযাপন করে আজকে এই অবস্থা।

– আকরাম আমার একটা কথা রাখবি।
– কি বল।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে